কিরণকাকুর শ্রাদ্ধ
অফিস থেকে ফিরতেই বাবা বললেন, রতন এসেছিল কিরণবাবুর শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন করতে। তোর কথা বার বার বলে গেছে। যেতে ভুলে যাস না।
কিরণকাকুর মৃত্যু সংবাদ কয়েকদিন আগে আমি অফিসেই শুনেছিলাম। ইচ্ছে করেই বাবাকে খবরটা দিইনি। বাবা এখন এমন এক বয়সে এসে পৌঁছেছেন যখন প্রতি সপ্তাহেই একজন না একজন প্রায় সমবয়সি না হলেও অতি পরিচিত আত্মীয় এবং অনাত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনতে হচ্ছে তাঁকে। তাই ভেবেছিলাম যে, খবরটা যত দেরি করে জানেন ততই ভালো।
মানুষের জীবনে মৃত্যু ব্যাপারটা একটা বিশেষ বয়স পর্যন্ত তার অমোঘ ও অবিসংবাদী রূপ নিয়ে একেবারেই প্রতিভাত হয় না। মৃত্যু আছে তা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষমাত্রেই জানেন। কিন্তু মৃত্যুকে যে এমন করে অসহায় পৌনঃপুনিকতায় স্বীকার করতে হয় তা যতদিন না জানা যায় ততই মঙ্গলের।
কারোই মা-বাবা চিরদিন থাকে না জানতাম কিন্তু ছেলেমানুষি এক বিশ্বাসে ভর করে পরম সুখে ছিলাম যে আমার মা-বাবার বেলায় সে নিয়ম খাটে না। আমার মা বা বাবা না থাকলে কী হতে। পারে সেকথা ভাবার মনের জোরটুকুও কখনো ছিল না। কিন্তু সব শিশুকেই একদিন বড়ো হতে হয়, বাবা হতে হয়। সব বাবাকেই হতে হয় মাতৃহারা, পিতৃহারা। এটাও সুর্যের অয়নের মতো। জীবনধারণের এক অনস্বীকার্য অঙ্গ। মানছি, মেনে নিচ্ছি। এক এক করে কত কিছু ভয়াবহ। সত্যকে জীবনের সঙ্গী করে নিয়ে তবুও বাঁচছি। এ বাঁচা বড়ো কষ্টার্জিত বাঁচা। সেই অনাবিল, শুধু-হাসির শুধু-সুখের দিনগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অথচ এই টালমাটাল জীবনের মধ্যেই টুকরো টুকরো সুখ ছিনিয়ে নিয়ে দিন কাটছে। কাজ করছি, টাকা রোজগার করছি, কর্তব্য করছি। এবং করছি না।
কিরণকাকুর সঙ্গে অফিসে প্রায়ই দেখা হত। কয়েকদিন আগেই কিরণকাকুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমাদের হেড অফিসেরই করিডরে।
বললেন, তোমার একটা লেখা পড়ে সেদিন কেঁদেছি।
আমি শুধিয়েছিলাম, কোন লেখা?
উনি বললেন, দ্বীপান্তর। ট্যুরে গেছিলাম, কাজে, বিহারের ছোট্ট এক জায়গায়। ডাকবাংলোর বারান্দায় রবিবারের কাগজে তোমার লেখা পড়ে একা একাই কেঁদেছি।
তারপর একটু থেমে বলেছিলেন, একটা চিঠি লিখব তোমাকে।
আমি বলেছিলাম, লিখবেন। গল্পর কপিটা হারিয়ে গেছে। যেমন অনেক গল্পরই যায়। কিছুই গুছিয়ে রাখার সময় ও স্বভাব আমার নয়। তাই গল্পটা কিরণকাকুর মনে আছে। একথা ভেবে ভালো লাগল।
তার আগে আমি কখনো জানি নি যে, কিরণকাকু এসব লেখা-টেখা পড়েন, পড়বার সময় পান।
কাছের মানুষদের মধ্যে ক-জনকেই বা আমরা চিনি? চেনার সময় বা ইচ্ছাই বা কোথায়? ভাবিনি যে, তাঁর মধ্যেও এমন একজন সংবেদনশীল নরম দুঃখী মানুষ বাস করেন। নইলে একজন। যুবকের তীব্র দুঃখের গল্পে একজন সত্তরোর্ধ্ব মানুষ এমন একাত্মবোধ করেন কী করে?
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে বসে অনেক পুরোনো কথা ভাবছিলাম। আমার তখন বয়স দশ-এগারো। ক্লাস সিক্স-এ পড়ি। বরিশালে তখন আমরা। কিরণকাকু মাঝে মাঝে কাজে যেতেন। আমার জন্যে রঙিন গেঞ্জি নিয়ে যেতেন। সেই তখনকার স্মৃতি থেকে আরম্ভ করে আজকের দিন অবধি প্রায় তিরিশ বছরের বেশিই হবে। কত টুকরো টুকরো ঘটনা, হাসি, ওঁর মিষ্টি মুখের মিষ্টি কথা। সব মনে আসছিল ভিড় করে।
সিগারেটটা নিবিয়ে ফেলে মনে মনে বললাম, নিশ্চয়ই যাব। শ্রাদ্ধের দিন তো যেতেই হবে। তার আগেও একদিন যাব। কিছু ফলমূল, মিষ্টি আর আতপ চাল, ঘি এই সব নিয়ে।
আসলে আমরা ভাবি না, হয়তো ভাবার সময়ই পাইনা, নইলে এ জীবনে দুঃখের ভারের বোঝা কত সহজে সুখের ভারে লাঘব করা যায়। কমই-বা কী পেলাম এ জীবনে? কত ভালোবাসা, স্নেহ, যত্ন আদর, কত স্মৃতি, প্রশংসা! এই সবেরও তো ওজন আছে! নাকি নিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, নোরামি ইত্যাদিই সব? সব মিলিয়েই তো জীবনের নিক্তি সমানই হয় শেষে। আগে পরে। এইটে বুঝতে বুঝতেই যে মৃত্যু এসে দরজায় কড়া নাড়ে। জীবনের মানে বোঝার আগেই, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার আগেই জীবন ফুরিয়ে যায় আমাদের। মনে মনে বললাম, নিশ্চয়ই যাব। কিরণকাকুর শ্রাদ্ধে না গেলে বড়োই অন্যায় হবে।
২.
অফিসের রিক্রিয়েশন রুমে গজেনদার সঙ্গে দেখা হল সেদিন। এই ভদ্রলোককে বুঝতে পারি না আমি। এঁর চরিত্র জাতকের গল্পের খলের চরিত্রের মতো। এই সব মানুষেরা যোগ্যতা এবং পরিশ্রম ব্যতিরেকেই, জীবনে তেমন কিছু না দিয়েই সব কিছুই পেতে চান। শুধু টাকার বা চাকরির বড়ো মাপের বিনিময়ে যে সব কিছু এ জীবনে পাওয়া যায় না একথা তিনি মানতে রাজি নন। একে খুঁচিয়ে, ওকে চটিয়ে, একের নামে আরেকজনকে দুটো কথা বলে মানুষের সম্পর্ক। নামক আপাতসুন্দর কিন্তু বড়োই কন্টকিত বস্তুটিকে তিনি নিরন্তর তাঁর চারিত্রিক জটিলতার পিন ফুটিয়ে ফাঁসিয়ে যান। এতেই ওঁর আনন্দ। কত মানুষ কত বিভিন্নভাবে আনন্দিত হন। সহজ জিনিসকে বক্র করতে, অনাবিল জিনিসকে আবিল করতে এঁর মতো দক্ষ লোক বড়ো বেশি দেখিনি।
বললেন, যাচ্ছ না কি আজ?
বললাম, নিশ্চয়ই!
উনি বললেন, তুমি সকলকেই ভালো দেখ। তোমার চোখে সকলেই ভালো।
আমি বললাম, মানে?
মানে আর কী?
কেন বলুন না?
না, শুনে আর কী করবে? মানুষটাও নেই। মরা মানুষের নিন্দা করে কী হবে?
ভাবলাম জ্যান্ত বা মরা কোনো মানুষরাই ওঁর হাত থেকে নিষ্কৃতি পান না। কিন্তু এঁরা সোজাসুজি নিন্দা কখনো করেন না। অদ্ভুত এঁদের মোডাসঅপারেন্ডি। এঁরা কোন কথা কী ভেবে বলেন, কেন বলেন তা যখন বোঝা যায়, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। ক্ষতি হয়ে যায়।
তাই অধৈর্য হয়ে বললাম, বলুনই না।
উনি বললেন, তোমার চাকরিতে যে উন্নতি হয়েছে এটা ভদ্রলোক একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। তোমাকে দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। বুড়ো মানুষের এমন স্বভাব দেখা যায় না। কী আর বলব!
আমি বললাম, বলেন কী? উনি তো আমাকে খুবই স্নেহ করতেন, সেদিনও কত কথা হল। তা ছাড়া আমি কি ওঁর সমকক্ষ বা প্রতিযোগী? কোন দিক দিয়ে আমি ওঁর যোগ্য? উনি আমার পিতৃবন্ধু, ওঁর পক্ষে আমাকে খারাপ বলার বা খারাপ দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
গজেনদা মুখ-ভরা পানে একমুঠো জর্দা ফেলে বললেন, তুমি একটি ছাগল। তোমার ধারণা পৃথিবীর সবাই তোমাকে ভালোবাসে। তোমার উন্নতিতে সকলে আহ্লাদিত। তাইনা?
আমি বললাম, তা যদিনা-ও হয় তাহলেও আমি সেকথা জানতে চাই না। এই মূখর স্বর্গও আমার ভালো। সবাই ভালোবাসে এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ আছে আলাদা। আমি ওসব শুনতে চাই না।
গজেনদা বললেন, শুনতে চাও না, তা তোমাকে বলছেই বা কে? ওই তো তোমার স্বভাব। তোমার ভালো করতে গেলেও, তোমাকে ভালো কথা বললেও তুমি চটে যাও।
আমি বললাম, আপনি যে কথা বললেন তার কি কোনো প্রমাণ আছে?
জর্দার ঢোঁক গিলে গজেনদা বললেন, প্রমাণ সাক্ষী সবই আছে। চাও তো পাবে।
আমি বললাম, চাই না।
গজেনদা বললেন, আমারই অন্যায়। মাফ চাইছি তোমার কাছে।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে এবং ফেরবার পথে গজেনদার কথা ভাবছিলাম। কিরণকাকুর সম্বন্ধে আমার মনটা বিষিয়ে দিলেন ওই মানুষটা। এঁদের কাছে বোধহয় ডিজেলের ধোঁয়া, কলকাতার ধোঁয়াশা, ফুটপাথের দোকানদার, সি এম ডি এ ও এম টি পি-র খোঁড়াখুঁড়িও বর্তমান কলকাতার আবহাওয়াকে যথেষ্ট বিষাক্ত ও বিরক্তিকর করে তুলেছে বলে মনে হয় না। সেই বিষাক্ততাকে আরও নিচ্ছিদ্র করতে চান তাই ওঁরা।
৩.
তারপর একটা একটা করে দিন কাটতে লাগল। কাজে, কর্তব্যে, আলস্যে, উদাসীনতায়, একঘেয়েমিতে। কিরণকাকুর বাড়িতে যে একদিন যাব তার সময়ই করে উঠতে পারলাম না। মন্দ্রিতার পিসিমা মারা গেলেন, একদিন মিনিবাসের স্ট্রাইক হল, আমার ভাগলপুরের বন্ধু বিজন। হুট করে চারদিনের জন্যে না-বলে-কয়ে কলকাতায় এসে পড়ল। আরো অনেক কিছু ঘটল ইতিমধ্যে।
ক্যালেন্ডারের তারিখগুলো যে কারো জন্যেই বসে থাকে না তা একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম। যেদিন, ঠিক তার পরদিনই কিরণকাকুর শ্রাদ্ধ।
সেদিন খুব ভোরে বাবা ট্যাক্সি নিয়ে চলে গেলেন। আমি তখন বাথরুমে। যাওয়ার সময় বাবা খোঁজও করে গেলেন আমাকে। মন্দ্রিতা এসে বাথরুমের দরজা ধাক্কাল। আমি ওকে বললাম, বাবাকে চলে যেতে বল, আমি অফিস যাওয়ার পথে ঘুরে যাব।
তাড়াতাড়ি তৈরি হলাম। তারপর স্ট্যান্ডে এসে মিনিবাস ধরলাম।
মিনিবাসে উঠতে গিয়েই ধাক্কা লেগে চশমাটার এমন অবস্থা হল যে চশমার দোকানে তখনই একবার যাওয়া দরকার পড়ল। চশমাটার একদিক ভেঙে গেছে। পাওয়ারও কম নয়। যখন তখন পড়ে যেতে পারে।
ঠিক কিরণকাকুর বাড়ির এক স্টপেজ আগে নেমে পড়লাম চশমা মেরামত করবার জন্যে। চশমা মেরামত করিয়ে এক খিলি পান খেলাম জর্দা দিয়ে। পানের দোকানের আয়নায় চেহারা দেখে বিনা কারণে একবার চুল আঁচড়ালাম। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কিরণকাকুর বাড়ির দিকে এগোতে লাগলাম পায়ে হেঁটে।
ওঁদের বাড়ির গলির মোড়ে এসেছি ঠিক এমন সময় কে যেন পিছন থেকে হঠাৎ ডাকল আমায়, আমার নাম ধরে।
চমকে তাকিয়ে দেখি অনিমেষ। আমার অফিসের সহকর্মী। এখন কোম্পানি ন্যাশনালাইজড হয়ে গেছে। অনেকদিন একসঙ্গে কাজ করেছি আমরা। ও একাজ ছেড়ে দিয়ে একটা অন্য কোম্পানিতে বেশি মাইনেতে ঢুকেছিল।
ও বলল, কীরে! চিনতেই যে পারছিস না।
আমি বললাম, তুই কিন্তু একরকমই আছিস।
ও বলল, তুই এত বুড়ো মেরে যাচ্ছিস কেন?
বললাম, এমনিই…। জ্ঞান বেড়েছে তো!
আমি শুধোলাম, এখানে দাঁড়িয়ে? এখন?
বাঃ, থাকি তো এখানেই। ভুলেই গেলি? তারপর বলল, তুই তো পাঁচ নম্বরে উঠবি। তারপর বলল, কোন ব্রাঞ্চে আছিস এখন?
এমন সময় একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পেয়ে অনিমেষ আমাকে হাত ধরে আচমকা টেনে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল।
বলল, গাড়িটা রিপেয়ার করতে দিয়েছি। পুরোনো অফিস আর নতুন অফিস কাছাকাছি। চল আমার অফিস দেখে যাবি।
আমি একটা শ্রাদ্ধ বাড়িতে যাচ্ছিলাম।
আপত্তির গলায় বললাম, আমি।
আমাদের পাড়ায়? কোন বাড়ি?
সান্যালদের বাড়ি। ও কিরণ সান্যাল? ভারি ভালো লোক ছিলেন।
বললাম, নেবে যাই আমি এখানে। আমার যাওয়া উচিত ছিল।
ছাড় তো! এসব রিচুয়ালে এখনও বিশ্বাস করিস? কী রে? তুই না নবেল লিখিস। আঁতেল?
বলেই আমার হাত চেপে ধরল। বলল, আমার অফিসে চল। এক কাপ চা খেয়ে যাবি, তারপর তুই তোর অফিসে যাস। কত্ত দিন পরে দেখা হল!
অনিমেষ এখন আমার চেয়ে অনেক বড়ো চাকরি করে। ওর আলাদা চেম্বার। উর্দিপরা বেয়ারা বসে আছে বাইরে। ও বেল বাজিয়ে চা আনতে বলল। তারপর বলল, এমন দায়িত্বের কাজ, বুঝলি, সর্বক্ষণ নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করছি.তোর মতো পরের শ্রাদ্ধে নাম প্রেজেন্ট করে বেড়ানোর মতো ফালতু সময় আমার নেই।
চা খেতে খেতে আমার কেন যেন মনে হল যে, ওর অফিসে ও যে একজন কেওকেটা, পদমর্য্যাদাতে ও যে আমার চেয়ে অনেকই বড়ো, এটা দেখাবার জন্যেই ও প্রায় জোর করেই এত বছর পর প্রথম দর্শনেই আমাকে পথ থেকে পাকড়ে নিয়ে এল। পুরোনো অফিসের কোনো। কথাই হল না। পুরোনো বন্ধুদের কথা জিগগেসও করল না ও।
চা খাওয়া হয়ে গেলে ড্রয়ার খুলে দামি বিলিতি সিগারেট বের করে খাওয়াল। নিজে ধুয়ো ছেড়ে বলল, পারচেজ ডিপার্টমেন্টে আছি বুঝেছিস। সাপ্লায়াররা অনেক কিছুই দিয়ে যায় মাঝে মাঝে। খাতির-যত্ন একটু আছে এই চাকরিতে।
বাঃ, বেশ।
অনিমেষের অফিস থেকে যখন বেরুলাম, তখন এগারোটা বেজে গেছে। উলটোদিকের বাসে চড়ে কিরণকাকুর বাড়ি যেতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যায়। আর গেলাম না। অফিসেই চলে গেলাম।
অফিসে ঢুকতেই বড়ো সাহেব ডেকে গালাগালি করলেন। ইরেসপনসিবল কোথাকার! তোমাদের কবে আক্কেল হবে বলতে পার? তোমাকে বারবার বললাম, সাড়ে নটার মধ্যে আসবে। বোম্বে থেকে মালহোত্রা এসে বসে আছে দশটা থেকে। বলছিল, কলকাতার মানুষ কাজ ছাড়া আর সব কিছুই করে।
আমি চুপ করে রইলাম। দেরি হল। কিন্তু বিনা কারণেই। শ্রাদ্ধে যেতে পারলেও না হয় বকুনিটা হজম হত।
পরদিন রতনদার সঙ্গে দেখা হল। খুব দুঃখিত হয়েছেন, বোঝা গেল।
বললেন, বাবা তোমাকে এত ভালোবাসতেন, তুমিই এলে না!
আমি কী যেন একটা কারণ দেখালাম। কারণটা সত্যি নয়। কী বলেছিলাম, এখন আর তা মনেপড়ছে না। কিছু একটা মিথ্যা কথা বানিয়ে বলেছিলাম।
রতনদা বললেন, তোমার বাবা শচীনকাকা কিন্তু এসেছিলেন।
আমি বললাম, জানি।
মনে মনে বললাম, ওঁরা অন্য প্রজন্মের লোক। ওঁদের মনের জোর, কর্তব্যের জোর অন্তত এখনও আছে। আমাদের মতো শ্যাওলার মতো ভারহীন ভেসে বেড়ানোতে ওঁরা বিশ্বাস করেন না।
রতনদার খুব অভিমান হয়েছিল বলে আর বেশি কথা বললেন না।
আমার এমন খারাপ লাগতে লাগল যে কী বলব। অথচ কেন। কোন তুচ্ছ ও অনির্ধারিত কারণে যে যেতে পারলাম না তা আমিই জানি। আমি জানি যে, কারণটা বা কারণগুলো সত্যি কিন্তু সেগুলো বুক ফুলিয়ে বলা যায় এমন বিশ্বাসযোগ্য কারণ নয়।
সত্যি কথা সব সময় ইচ্ছা থাকলেও বলা যায় না। কারণ তা কেউই বিশ্বাস করে না। তাই। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমরা রোজ মিথ্যা বলি। যেটা করব বলে ভাবি, যেটা কর্তব্য বলে জানি, ঠিক সেটাই সময়মতো করে হওয়া ওঠে না। না-করতে পারার গ্লানিটা বুকে জমেই থাকে, নিজের কাছে নিজেকে ছোটো মনে হয়, অথচ অন্যর কাছে এই তুচ্ছ কারণের অপারগতাকে প্রকাশ করাও যায় না।
আমরা যা মনে মনে করতে চাই তা করতে পারি না প্রায়ই। ইচ্ছা থাকলেও পারি না। আমরা কতগুলো দিগভ্রষ্ট পশু হয়ে গেছি। সারাদিন ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে অথবা বিনা কারণেই এদিক ওদিকে চরে বেড়াই, যা করার নয়, তাই-ই করি আর যা করার তা করতে ভুলে যাই।
কিরণকাকুর শ্রাদ্ধ দু-বার হবে না। অথচ আমার বুকে চিরকাল সেই শ্রাদ্ধে অনুপস্থিত থাকার লজ্জা ও গ্লানি জমা থাকবে। আমি জানি যে, আমার শ্রাদ্ধে অথবা সুদূর ভবিষ্যতে আমার মেয়ের বিয়েতে আমার অনেক প্রিয়জন আসার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলেও এসে উঠতে পারবেন না। সেদিনকার আমারই মতো কোনো কাজে অথচ অকাজে অথবা আলস্যে বা উদাসীনতায় আটকে যাবেন। ব্যস্ত মানুষ হলে হয়তো ভুলেও যেতে পারেন।
আমি এও জানি যে, আমার আত্মা অথবা আমি কেউই সেই সব অপারগদের ক্ষমা করবে না বা করব না।
মনে হল, আমাদের আজকের জীবনের অনেকানেক কর্তব্য কিরণকাকুর শ্রাদ্ধে না-যাওয়ার। মতোই অবহেলিত হচ্ছে। এই ছোট্ট ছোট্ট স্তুপীকৃত পৌনঃপুনিক অপরাধের চেয়ে একটা বড়ো রকমের অপরাধ, খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, এমনকী ধর্ষণ করাও বোধহয় শ্রেয় ছিল। অপরাধেও আমি বড়ো হতে পারলাম না।
শহুরে, ছা-পোষা, সাধারণ একজন মানুষ আমি।
এই উদাসীন সামান্যতার ভারে, না-ভালোনা-মন্দর মলিন মানসিকতার ক্লান্তিতে ক্লান্ত আমি কিরণকাকুর শ্রাদ্ধে না যেতে পেরে লক্ষ লক্ষ নিরুপায় মধ্যবিত্তদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলাম। মধ্যবিত্তদের নানারকম কষ্ট থাকে। তার মধ্যে কিছু কষ্টর কথা বলা যায়, অন্যর সঙ্গে আলোচনা। করা যায়, সেই সব কষ্ট নিরসনের পথও বের করা যায়। কিন্তু এই সব সামান্য…কী…কাকে…।