Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বলাকা || Bani Basu

বলাকা || Bani Basu

সত্যপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় ওরফে কর্নেল চ্যাটার্জির বয়স আটান্ন পার হল দুই হপ্তা আগে। কেউ বলবে না। চোখের দৃষ্টি তিরের মতো, পড়ার জন্যে ছাড়া চশমা লাগে না। দাঁড়ান সটান, চলেন সোজা, কপালে একটি, একটিমাত্র ভাঁজ। অনুভূমিক, ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক। চোখ বা ঠোঁটের পাশে কাকের পা নেই। পঞ্চাশ পার হয়েছেন কিনা সন্দেহ হয়। ষাটে জীবনে দ্বিতীয়বার অবসর নেবেন।

ইতিমধ্যেই নানান জায়গা থেকে আগাম ডাক আসছে, তারই মধ্যে যে-কোনো একটাকে বেছে নেবেন। নিজের সময় এবং পছন্দমাফিক। যৌবনের তেজ আর কর্মক্ষমতা, প্রৌঢ় বয়সের অভিজ্ঞতা ও প্রাজ্ঞতা এসবের প্রয়োগের দিন শেষ হতে তাঁর এখনও অনেক দেরি। এ কথা তিনি একাই বোঝেন না, বোঝে যারা আশেপাশে অর্থাৎ সংসারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, কাছাকাছি রয়েছে তারাও। ছিলেন। মিলিটারিতে। চিন-ভারত যুদ্ধে একটানা দু-মাস নিখোজ থাকার পর ফিরে এলে মায়ের কান্নাকাটি, ঠাকুরমার টানা তিন দিন জল স্পর্শ করব না ইত্যাদির পরও সেই রোমাঞ্চকর চাকরিটি ছাড়েননি। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা তাঁর রক্তে। এখন আছেন বাণিজ্যিক সংস্থায়। এখানকার অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ আলাদা। অনেকটা দাবা খেলার মতো। এখানে কর্নেল মনের সাধে ঘোড়ার চালে কিস্তি মাত করে চলেন। কিন্তু জীবনযাপনের কায়দায়, চলার ফেরায়, সর্বোপরি শিকারের নেশায় কর্নেল চ্যাটার্জি এখনও মিলিটারির লোক রয়ে গেছেন। হাতটা কেমন নিশপিশ করে। এখনও লক্ষ্য স্থির আছে তো? নিশানা? কিছু করতে পারবেন এখনও দরকার হলে? ঘুমের মধ্যে তির ছোড়েন। বন্দুক বাগিয়ে ধরেন। ঘুমের মধ্যে নিক্ষিপ্ত তির, বন্দুকের গুলি, প্রায়ই পাশের মানুষটির বুকে পিঠে গিয়ে বিধত।

উঃ! উঃ! কীরে বাবা। ঘুমের মধ্যে সে কাতরে উঠত। কর্নেলের ততক্ষণে হয় ঘুমটা একেবারেই ভেঙে গেছে, তিনি পাশের মানুষটির আঘাত লাগা জায়গাটা ডলে দিতে দিতে বলছেন, এইটুকুতেই জখম হয়ে গেলে? আরে বাবা, সম্মুখসমরে তো কখনও যাওনি, যাবেও না ক আর আধ-ঘুম অবস্থায় থাকলে তিনি মটকা মেরে পড়ে থাকতেন। কিছুটা ঘুম ফিরিয়ে আনার জন্য, কিছুটা বা লজ্জায়। এখন পাশের জায়গাটা শূন্য। খুব আশ্চর্যের কথা, এখন কর্নেলের ঘুমের মধ্যে তির-ছোড়ার রোগটা সেরে গেছে। গত দেড় বছরে একবারও, অন্য কারণে হলেও এই কারণে জেগে ওঠেননি। চাঁদমারি নেই বলেই কী? কথাটা মনে করে দুঃখের মধ্যেও কর্নেলের হাসি পেল। চাঁদমারিই বটে! শেষ দিকটায় অতসী কঞ্চির মতো রোগা হয়ে গিয়েছিল। শুধু বক্ষ এবং নিতম্ব সামান্য গুরুভার। ছোট্ট মুখটা ভরাট। কপালে একটা নীল শিরা। কেউ বলত অলক্ষণ, কেউ বলত রাজরানি হবার লক্ষণ। কোনোটাই মেলেনি। অলক্ষণ? অর্থাৎ বৈধব্য? তিনি এখন বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। সে-ই বরঞ্চ অত্যন্ত অসময়ে তাঁকে যেন একটু অস্বস্তিতে ফেলে চলে গেল। আর হবোহবো করেও তিনি কিছুতেই কোম্পানিতে এক নম্বর হতে পারলেন না। চেয়ারম্যান সাহেবের স্তাবকমণ্ডলীর মধ্যে প্রবেশ করতে পারেননি বাঙালি হওয়ার দরুন। দ্বিতীয়ত, তাঁর কর্মক্ষমতা, মৌলিকত্ব ইত্যাদি বহুজনের ঈর্ষার বস্তু হয়ে পড়েছিল। কাজেই রাজা, যুবরাজ হওয়া আর হয়ে উঠল না। তবে এ-যুগের বাণিজ্য সংস্থার চেয়ারম্যান যদি বিক্রমাদিত্য হন, তাহলে তাঁর নবরত্নসভার একজন তিনি। নিজের ক্ষমতা ও প্রতিভাবলে হয়েই আছেন। কিন্তু বরাহমিহিরের স্ত্রীকে তো আর কেউ রাজরানি বলবে না। সুতরাং অতসীর কপালের নীল শিরাটা জ্যোতিষীদের সবরকম গণনাকে হারিয়ে দিয়েছে, বা বলা ভালো, ভুল প্রমাণিত করেছে। ক্ষীণতার কারণে ইদানীং কর্নেল স্ত্রীকে অতসী না বলে বেতসী বলে ডাকতেন।

কলকাতা নামক বিকট শহরটির থেকে অন্তত একশো কিলোমিটার দূরে এই নির্জন বনবাংলা বানিয়েছেন তিনি। মাসের দুটো সপ্তাহান্ত অন্তত কাটিয়ে যান। বাংলার গ্রাম যেরকম হয় তার চেয়ে একটুও কম বা বেশি ভালো না জায়গাটা। কিন্তু সবরকম ময়লা, আবর্জনা, অগোছালোপনা, দৈন্য ঢেকে যায় সবুজে। শীতের ক-টা দিন ধরণী মলিন, কিন্তু আকাশ অথই নীল। যেন প্রশান্ত মহাসাগর। রোদ যেন কাঁচা হলুদ বাটা। বাটি উপুড় সেই নীল চাঁদোয়ার দিকে তাকিয়ে থাকো, দেখবে খুশিয়াল মেঘদের পশ্চিম-মেঘ পর্ব। আর দেখবে পারাবতের খেলা। বিকেল বেলার ছাদে দিনশেষের রাঙা মুকুল আকাশ দেখতে এলে আরও দেখবে টানা কুন্দফুলের একটি মালা সমানভাবে দুলতে দুলতে চলে যাচ্ছে। যাযাবর হাঁস-বকেদের দল—বকের পাঁতি। কর্নেলের বনবাংলোর থেকে সোয়া কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট ঝিল। এলোমেলো তার তটরেখা। কোথাও বাঁধানো পাড় নেই। কচুরিপানার দল কখনও কখনও ভেসে আসে। আবার ভেসে চলে যায়। ধোপায় কাপড় কাচে, জেলেতে মাছ ধরে, কিছু কিছু লোক চান করে, কিন্তু গাগরিভরনে কাউকে যেতে দেখা যায় না। দূরবিন চোখে নিয়ে কর্নেল দেখেছেন অনেক সময়ে কচুরিপানার দামের পাশ কাটিয়ে তরতর করে পানসি চলেছে। কোমর জলে নেমে খ্যাপলা জাল ফেলে প্রচুব কুচো মাছ তুলছে অল্পবয়সি জেলের ছেলে, কুচকুচে হাতে জ্যান্ত রুপোর কুচিগুলো তুলে পরখ করছে। তারপর সবসুদ্ধ কাঁধে ফেলে চলে যাচ্ছে খুশকদমে। শহরে কর্মজীবনের এবং জীবনযাত্রার একটা ধনুকের ছিলার মতো টানটান ভাব আছে। সবসময়ে শরীরে স্নায়ুতন্ত্রী চড়া সুরে বাধা থাকে। যাকে বলে টেনশন। গেল গেল ভাব। গাড়ি চালাতে চালাতে সামনে বাবু, দিন না এসে গেল। ঘ্যাঁচ ব্রেক, সেই সঙ্গে দরদর ঘাম, অরেকটু হলেই চলে গিয়েছিল লোকটা চাকার তলায়, গাড়ির চালক জনগণের হাতে, গাড়ি পুলিশের হেপাজতে। ট্যাঁ ট্যাঁ ফোন —শিগগিরই চলে এসো, মিঠু, হ্যাঁ মিঠুর…বোধহয় গ্যালপিং হেপাটাইটিস। চেষ্টার ত্রুটি হবে না, নাঃ তোমার তো ডক্টর দাশগুপ্তর সঙ্গে খুব জানাশোনা। আরে বাবা পেলে তো! সব সময়েই ডাক্তাররা আজকাল কনফারেন্সে বিদেশে… দেখছি…। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ, মিঠু…মিঠু বড়দার একমাত্র নাতনি, ঝুলঝুলে চুল, তুলতুলে মুখ, গ্যালপিং…হে…পা টাইটিস! হ্যালো চ্যাটার্জি কে? হিতৈষী। কংগ্রাচুলেশনস। হোয়াট ফর? ফর রিমেইনিং, হোয়্যার ইউ ওয়্যার। শিট! ফোনটাকে এবার শোবার ঘর থেকে দূর করে দেবেন।

দুধে গন্ধ কেন রে? এই গোবর্ধন!

কৌটোর দুধ সাহেব। বাজারে দুধ নেই।

কেন? গোরুমোষরাও স্ট্রাইক করেছে নাকি?

খাটাল হঠাও আন্দোলন হচ্ছে না সাহেব! গোয়ালারা তাই…

…দমাদ্দম আওয়াজ কীসের, শেষ রাত্তিরে? জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন পাশের ছ তলাটার ওপর থেকে ভাঙা শুরু হয়েছে। ডেমলিশন অর্ডার হয়ে গিয়েছিল, অনেকদিন। ফ্ল-এ ঠিক যেদিন তাঁর সারারাত মাথায় বোমা পড়েছে আর শেল ফেলেছে, সেই রাতের পর ভোরে প্রথম ঘুমঘোরের সময়টাই ডেমলিশন অর্ডার কার্যকরী করা শুরু হয়ে গেল। এরই নাম শহুরে টেনশন। তাঁদের বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ির হাতা বেশ খানিকটা। তারপর গাড়িবারান্দা। ভেতরের ঘরগুলো উঁচু উঁচু বড়ো বড়ো, তবু সে সমস্ত পেরিয়ে, দীর্ঘদিনের অপরিষ্কৃত আবর্জনাস্থূপের গন্ধ, মিছিলের স্লোগান, রাজনৈতিক বক্তৃতা, পুজোটুজোর হইহল্লা সবই প্রবেশ করে। তাই এই নির্জন বনবাংলা। শরীর-মন শিথিল, চিন্তাভারমুক্ত, শহুরে ক্লেদ-বর্জিত থাকে কিছুক্ষণ। অতসীরও খুব পছন্দ হয়েছিল বাংলোটা। বিশেষত এই ঝিলের জন্য।

আরও একটা শরীর-মন ঠান্ডা করার, চাঙ্গা করার জায়গা আছে তাঁর। সল্টলেকে। রীমা তরফদারের বাড়ি। রীমা আর রীতা দুই বোন একসঙ্গে একা থাকে। তাদের বাড়ি কর্নেল চ্যাটার্জি চাঙ্গা-ঠান্ডা হতে যান মাঝে মাঝে। কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। হঠাৎ একটা ফোন করে দেন আগে থেকে। না হলে ওরা অপ্রস্তুতে পড়তে পারে। অন্য কেউ যদি চাঙ্গা হতে এসে থাকে! রীমা রীতা কর্নেলের অনেক দিনের অভ্যাস। যেহেতু মেজাজসাপেক্ষ এই দেখাশোনা, তাই রোমাঞ্চটা এতদিন পরেও চলে যায়নি। কবে রীতা আর কবে রীমা এটাও একটা মেজাজ অনুযায়ী শেষ মুহূর্তের নির্বাচনের ব্যাপার। সেখানেও তাই রোমাঞ্চ। এক পাশে রীমা, দোহারা সুন্দরী, সপ্রতিভ, বাকপটু, কিন্তু যাকে বলে গ্রেসফুল, অন্যদিকে রীতা, অনেক অল্পবয়স্ক, উচ্ছল, অশ্লীল, মাদক, সুন্দরী নয়, কিন্তু উত্তেজক। ওখানে ঝিল নেই, আছে মরশুমি ফুলের কেয়ারি-করা বাগান, সুইমিং পুলে স্ট্রিপটিজ।

আকাশে ঝটপট ডানার শব্দে চমকে মুখ তুলে তাকালেন কর্নেল চ্যাটার্জি। বকের পাঁতি। খুব নীচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এখন আর কুন্দফুলের মালা নয়। গলার লম্বা, পেটের ফোলা, ডানার ঢেউখেলানো চওড়া—সবই দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট ক্লাক ক্লাক ডাক অবধি শোনা যাচ্ছে। কর্নেল অবাক হয়ে দেখলেন প্রথম মালার পেছনে আরও মালা আসছে, আরও আরও, ছেড়া মালা, গোটা মালা। তারপর অদূরে ঝিলের চারপাশটায় সাদা সাদা ফোঁটা পড়তে শুরু করল। ঝিলের একধারটা একেবারে সাদা হয়ে গেছে। বকগুলো কোন সুদূর থেকে এসে তাঁর বনবাংলোর সংলগ্ন ঝিলের চারদিকে নেমে পড়েছে। আশ্চর্য তো! তিন বছরের ওপর এ বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে, এ দৃশ্য তিনি এখনও দেখেননি। এই বছর এই প্রথম এরা এখানে এল, না কী? বাইনোকুলার চোখে লাগালেন কর্নেল। ঝিলের ওপরে এখনও বকের দল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েনি। এখনও বেশ প্যারেডের ভঙ্গিতে আছে, কেউ কেউ অতি মনোহর ভঙ্গিতে শরীর লম্বা করে ডানা ঝাড়ছে। রোটারি ক্লাব বছরে একবার করে আন্তঃস্কুল পি টি প্রতিযোগিতা করে। মেম্বার হিসেবে এগুলো তাঁকে দেখতে হয়, দেখতে খুব ভালোও লাগে। সাদা গেঞ্জি আর মেরুন শর্টস পরে ছেলেরা মাটিতে সহস্রদল পদ্ম হয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন ফর্মেশন। ভারতবর্ষের মানচিত্র। মেয়েরা বেঁটে বেঁটে ডিভাইডেড স্কার্ট আর আলগা ব্লাউজ পরে পিয়ানোর সুরের তালে তালে লাল বলটা এক জনের থেকে আরেক জনের কাছে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পায়ে নাচের ছন্দ। হাত আর মাথা একদিকে বেঁকিয়ে পাঠাচ্ছে বলগুলো, মাঝে মাঝে একেকটি মেয়ে লাফিয়ে ধরছে বল, ব্লাউজের হাতা উড়ছে পাখনার মতো, অবিকল ওই বক না হাঁসগুলোর মতো। মাথার ওপরে আবার আওয়াজ ক্লাক ক্লাক। চোখ তুলে তাকালেন কর্নেল। ইউনিফর্ম-পরা একদল স্কুলের মেয়ের মতো উড়ে যাচ্ছে বলাকা। ছাই-সাদা ইউনিফর্ম।

হঠাৎ বহুদিন আগে দেখা এইরকম এক ঝাঁক স্কুল-গার্লের কথা মনে পড়ে যায়। তুলনাটা আজ এতদিন পর একটা বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে এল। তখন মনে হয়নি। সিক লিভে বাড়িতে। প্রতিদিন এই রকম একটা ঝাঁক রাস্তা পার হত। প্রথমে মনে হত সবগুলো এক, আস্তে আস্তে আলাদা করতে পারলেন। কোনটা রোগা, কোনটা মোটা, কোনটা দোহারা, কোনটা বেঁটে, কোনটা মাঝারি, কোনটা লম্বা। কেউ দোদুল বেণি, কেউ বব-কার্ট, কেউ ফরসা, কেউ কালো, কেউ শ্যামলা। দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল। আর নড়তে চাইল না। অনবদ্য অনুপম।—অতসী, এই অতসী, তোর জোগ্রাফির খাতাটা আমায় একবার দিবি?

নে না! এতে আর বলবার কি আছে?

মুখার্জি আঙ্কল বকবেন না তো।

বকবেন কেন?

উনি কপি করা পছন্দ করেন না। শেষকালে যদি ভূগোলেতে গোল।

ধুত আমার বাবা, আমি বুঝব, তুই নে।

দু চারদিন বন্ধুদের স্কুল-ফিরতি হাস্যালাপ থেকে ধরে ফেলা গেল অতসী। মুখার্জি, মেয়ে স্কুলের ভূগোলের সার অমলেশ মুখার্জির মেয়ে। তখন মার কাছে গিয়ে হ্যাংলাপনা, দেখেছি পথে যেতে তুলনাহীনারে। মার চোখ ড্যাবড়েবে খুশিতে। সংলাপ আরম্ভ হয়।

অমলেশ মুখার্জি, দেখুন, অতসী আমার একমাত্র সন্তান।

মিসেস চ্যাটার্জি, শি ইজ দ্য বেস্ট স্টুডেন্ট, দিস স্কুল হ্যাজ এভার প্রোডিউসড।

অমলেশ মুখার্জি, মাতৃহীন সন্তান। প্রাণপণে মানুষ করছি। আমার ইচ্ছে ও ডাক্তার হয়। কিংবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস। এখনই বিয়ে…

মিসেস চ্যাটার্জি, বেশ তো। ও স্কুলটা পাস করুক। আমাদের বাড়ি থেকেই পড়তে পারবে। মা নেই, মা পাবে। আপনিও ছেলে পাবেন।

সুবিখ্যাত চ্যাটার্জি বংশের গৃহিণী মিসেস চ্যাটার্জি কন্যা প্রার্থনা করছেন জোগ্রাফির টিচার অমলেশ মুখার্জির কাছে, যিনি স্ত্রীলোকহীন সংসারে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, উচ্চাশী কিশোরী কন্যাকে নিয়ে ভেতরে ভেতরে ব্যতিব্যস্ত। নিজের বা মেয়ের বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলেই ঘর্মাক্ত হয়ে যান দুর্ভাবনায়, অসুখ করলে অসহায়। নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন। অনেক ভেবেছিলেন। মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। অনেক কথা। যতই বুদ্ধিমতী হোক, যতই উচ্চাশী হোক, সপ্তদশী বই তো নয়। সুতরাং মিসেস চ্যাটার্জির জয়। কর্নেল চ্যাটার্জির জয়। অভিজাত, বনেদি পরিবারের জয়। বৈভব এবং আভিজাত্য ছিল বংশের, বুদ্ধিবৃত্তি এবং সত্যিকারের সৌন্দর্য যোগ হল। এতদিন বাড়িতে রমণীকুল বলতে সোনা এবং হিরেয় মোড়া আলুসেদ্ধ ছিল, এবার এল স্নিগ্ধ তন্বী দীপশিখা। বিয়েবাড়িতে হইচই পড়ে গেল। কর্নেল চ্যাটার্জির বুক ক্রমশই ফুলছে। উচ্চমাধ্যমিকে একগাদা লেটার। ন্যাশনাল স্কলারশিপ। জয়েন্টে দুটোতেই সুযোগ ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং।—তুমি তো বরোদা চলে যাচ্ছ, আমি মেডিক্যাল কলেজে ভরতি হয়ে যাই? আমি কি একা থাকব, বরোদায়? দু বছর? ছুটি পাব না, তার পরই ফ্রন্ট।কিন্তু আমি তাহলে কী করে পড়ব? আরে বরোদায় কি আর কলেজ নেই? ভরতি হয়ে যাবে। ডাক্তারি? সম্ভব হবে কী করে? চোখের আলো দপ করে নিবে গেল।

সপ্তদশী অষ্টাদশীদের কুমারী শরীর নতুন জাগে। ঠিক ফোঁটার পূর্ব মুহূর্তের কুঁড়ির মতো। সোহাগে, অভ্যস্ত, শিক্ষিত, নিপুণ হাতের যন্ত্রে সেই দীপশিখা জ্বালাতে কতক্ষণ। বলল, বলো তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? অস্পষ্ট অব্যক্ত কণ্ঠের গোঙানি আমি যে কী করি? কী করি? চার পাঁচটা তো বছর… চার, পাঁচ বছর নাহ অতসী তুমি আমায় একটুও… পেছন থেকে মুখের ওপর হাত চাপা।

বরোদা। মিলিটারির জিপে করে অতসী কলেজ যাচ্ছে। ইতিহাস পড়ছে। টুকটাক শিখে নিচ্ছে, বাংলো সাজাবার কায়দা, এনটারটেইন করার কায়দা, অফিসার্স ক্লাব, উইমেনস ক্লাবের পার্টি। হ্যাললো মিসেস চ্যাটার্জি, য়ু আর সো চা র্মিং, লেটস হ্যাভ এ ডানস। দূর থেকে সকৌতুকে দেখছেন কর্নেল। উদ্ধার করবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছেন না। ওর নাকের ওপর এখন নিশ্চয় চিরঞ্জীব সুদের হালকা হুইস্কি আর কড়া তামাক মিশ্রিত নিশ্বাস। খুব অনিচ্ছুকভাবে পা ফেলছে অতসী। তাঁর সঙ্গিনী মিসেস তলোয়ারকর অবশ্য খুব স্মার্ট। শি ইজ এনজয়িং হারসেলফ। তাঁর নিশ্বাসের গন্ধ মাদাম তলোয়ারকরের ভালো লাগছে। তীব্র পুরুষালি গন্ধ।

গ্র্যাজুয়েশন হতে না হতেই গোল্ডি এসে গেল। সোনালি রঙের বাচ্চা। তাই চম্পক। সে মা যে নামেই ডাকুক না, বাবার আদরের নাম গোল্ডি। আহ কী বিশ্রী একটা কুকুরের মতো নামে ডাকো। কিসসুই জানো না, অতসী, আমি ঠিক একেবারে সঠিক নামে ডাকছি। গোল্ডি সাইকেল চড়ছে, গোল্ডি এয়ার গান চালাচ্ছে, গোল্ডি মারপিট করছে, গোল্ডির মা তার নানান স্বপ্নের কথা বলে চলেছে, রুপকথার মাধ্যমে, উপকথার মাধ্যমে। সোনালি রঙের গোল্ডি বলে, এই ট্র্যাশ গল্পগুলো তুমি কোথায় পেলে মাম্মি। গোস্টস? হাঁড়ি উপুড় করলেই মিষ্টি ঝরবে? মারমেইড, এ সমস্ত আজগুবি—কেন? তোর জিরো জিরো সেভেন, টিনটিন এসব আজগুবি নয়? আজগুবি কেন হবে? ডিফিকাল্ট। কিন্তু অসম্ভব নয়। বাবা ছেলে একসঙ্গে বলে ওঠে। কর্নেল চ্যাটার্জি বিজয়ীর হাসি হেসে বলেন, গোল্ডি ইজ হিজ ফাদার্স বয়, নট হিজ মাদার্স বেবি। গোল্ডি চলে গেল দেরাদুন। চোখ ভরতি জল, অতসী বলল, আমি কী করব, বলে দাও—সোশ্যাল সার্ভিস করো, মিসেস তলোয়রকর যেমন করেন। ধুত ওকে সোশ্যাল সার্ভিস বলে? আমাকে একটা মেয়ে দাও। মেয়ে কি ইচ্ছে করলেই দেওয়া যায়। অনেক কিছু ইচ্ছে করলেই কেড়ে নেওয়া যায়, কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও কিছু কিছু জিনিস দেওয়া যায় না। কর্নেলও দিতে পারলেন না। দুবার নষ্ট হয়ে গেল। শেষেরটা আকার পেয়ে গিয়েছিল একটা। ফরসা, গার্লচাইল্ড। অতসীর সে কী বুক ফাটা কান্না। সেই একবারই। তারপর অতসী শুকোতে থাকল। অতসী ছায়াময়ী হতে থাকল। মিলিটারি থেকে রিটায়ারমেন্ট নিয়ে যখন তিনি এই শহরে, উঁচুর দিকে ওঠার কাজে ব্যস্ত, তখন অতসী বালিগঞ্জ প্লেসের বিশাল বাড়িতে প্রেতিনীর মতো প্রায় কায়াহীন শূন্য চোখে ঘুরে বেড়ায়। রাজ্যের কুকুর আর বেড়াল জড়ো করেছে, রাস্তার ভিখারি বাচ্চা ডেকে ডেকে খাওয়ায়। বিশেষত মেয়ে দেখলেই। অতএব রীমা রীতার দরকার হল। গোল্ডি ছুটিতে এসে বলে, মা, কুকুর পুষবে তত ভালো কুকুর পোষো, পেডিগ্রি দেখে, কোত্থেকে এই খেকি-নেড়িগুলো জড়ো করেছ? শান্ত, কিন্তু কেমন একরকম দৃঢ় চোখে চেয়ে অতসী বলে, আমি যদি থাকি ওরাও থাকবে। গোল্ডি গার্ল ফ্রেন্ডকে হিরো হন্ডার পেছনে বসিয়ে হু হু করে ছুটে চলে যায়। মাঝরাত্তিরে সামান্য মাদকের গন্ধ মুখে নিয়ে কর্নেল বাড়ি ফেরেন। অতসী, ক্ষীণা, অস্বাভাবিক সাদা বেতসী শোবার ঘরের দরজা খুলে কেমন একরকম চোখে তাকায়, তারপর সযত্নে কর্নেলের জামাকাপড় খুলে বাথরুমের বালতিতে ফেলে এসে, নাইট সুট পরিয়ে দেয়। শুইয়ে দেয়। দরজাটা বন্ধ করবার শব্দ পান কর্নেল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে উঠে বুঝতে পারেন পাশটা সারা রাত খালিই ছিল।

অতসী-ই বেতসী-ই কর্নেল চ্যাটার্জি ডাকছেন। নিঃশব্দে চৌকাঠের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে অতসী। টাইয়ের নটটা নিজে নিজেই বাঁধতে বাঁধতে আয়নার মধ্যে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মুখে নির্মল হাসি নিয়ে কর্নেল বলছেন, মদ্য তো আমি আগেও পান করেছি, তখন তর্ক-বিতর্ক করতে, তোমার সঙ্গে যুক্তি-তর্কে আমি কখনোই পারতাম না, আফটার অল ইউ ওয়্যার দা ব্রাইটেস্ট স্টুডেন্ট ইয়োর স্কুল হ্যাড সো ফার প্রোডিউসড। কিন্তু এত রাগ তো করতে না ক

আয়নার মধ্যে দিয়ে অতসী চেয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না।

কী হল? কিছু বলো? দাও-দাও, টাইটা ঠিকঠাক করে বসিয়ে দাও তো! আফটার শেভের বোতলটা হাতড়াচ্ছেন কর্নেল। মুখ তুলতে তুলতে বলছেন, কই দিলে না?

কাকে বলেছেন? আয়নার মধ্যে প্রতিবিম্ব অদৃশ্য হয়ে গেছে।

অতসী! অতসী! রোববারের মরা মরা দুপুর। অতসী চৌকাঠে।

চলো আজ তোমার বাবাকে দেখে আসি। চট করে তৈরি হয়ে নাও। সাবিরকে গাড়ি বার করতে বলে দিয়েছি। অতসী চৌকাঠে এখনও দাঁড়িয়ে।

কী হল? যাও!

আমি গতকালই ঘুরে এসেছি।

সে কী? বলনি তো! সাবির বলেনি তো!

সাবিরকে নিইনি।

সে কী? তোমার এই শরীর, কীভাবে গেলে। ট্যাক্সিতে?

বাসে।

সে কী? কেন?

বৃদ্ধাবাসে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে লজ্জা হয়—অতসী আর দাঁড়ায়নি।

বাবা যখন অথর্বপ্রায়, শাশুড়ি মৃত, এত বড়ো বাড়িতে কর্নেল, তাঁর পত্নী এবং ভৃত্যকুল ছাড়া আর কেউ নেই, সে সময়ে কর্নেল-পত্নী বাবাকে এখানে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিলেন। কর্নেল হেসে বলেছিলেন, এই জন্য তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে পারি না অতসী, সংসারে থার্ড পার্সন কখনও আনবে না। বাইরে, অন্য বাড়িতে রেখে তুমি বাবার যত খুশি সেবাযত্ন কর না! টাকার অভাব হবে না।

কাচের মতো চোখে চেয়ে অতসী বলেছে, আমার তো কোনো টাকা নেই ক…বাবার একমাত্র আমিই আছি…

তোমার টাকা নেই! তোমার টা…নাহ অতসী, আই অ্যাম ড্যামড।

শহরতলির কোনো বৃদ্ধাবাসে জায়গা হয়েছে ভূগোল-শিক্ষক মিস্টার অমলেশ মুখার্জির। তাঁর নিজের সংগতিমতো।

এ সপ্তাহে দেখে গেলেন। পরের সপ্তাহে প্রস্তুত হয়ে আসবেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে, ডানায় হাওয়া কাটার একটা মোহময় সু উ শ শ শ শব্দ শুনতে শুনতে ভাবলেন কর্নেল। অনেক অনেকদিন শিকার হয়নি, কোনো লক্ষ্যভেদ হয়নি। বন্দুকগুলোয় মরচে ধরছে। সাফ করতে হবে ভালো করে। নাকি তির ধনুক? আর্চারি? এই বিশেষ খেলাটিতে তাঁর বড্ড সুনাম ছিল এক সময়ে। সব সময়ে এক নম্বর।

ফেরবার সময়ে হাইওয়েতে পড়ে মাথায় এল কথাটা। দুইয়েরই পরীক্ষা হয়ে যাক। তিরন্দাজ এস. পি. চ্যাটার্জি আর বন্দুকবাজ এস. পি. চ্যাটার্জি। সাবিরকে বলতে হবে ওর বউকে নিয়ে আসবে। হাঁসের মাংস পাকায় চমৎকার! একবার খাইয়েছিল। অবশ্য খাওয়াটা জরুরি নয়, জরুরি হল নিশানার পরীক্ষা। গোন্ডিটাও খুব ভালো করছে। ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ একদম ঠিকঠাক লেগে গেছে সব। যেখানে যা লাগবার। গোল্ডিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে, মরা বিকেলের আলোয় ছাদে রিভলভিং চেয়ার নিয়ে বসলেন কর্নেল চ্যাটার্জি। পাশে তাঁর পরিষ্কৃত পাখি মারা বন্দুক, আর গোল্ডেন রিট্রিভার। সাড়ে চার বছর বয়েসের দুর্দান্ত আর একটি গোল্ডি। বাচ্চাটাকে দেখে প্রথমেই তাঁর অতসীর কথা মনে পড়েছিল। কী একটা কুকুরের মতো নামে ডাকো ছেলেটাকে ক আহা, একেও গোল্ডি বলতেই ইচ্ছে করে তাঁর। কিন্তু ছেলে বাড়ি ফিরে বাবার কাণ্ড দেখে কিছু মনে করতে পারে। যতই যুক্তিনিষ্ঠ, যতই প্র্যাকটিক্যাল হোক! কর্নেল চ্যাটার্জি একে স্কাড বলে ডাকেন, যদিও মনে মনে বলে ফেলেন, গোল্ড, গোল্ডি। ওই চলে গেল প্রথম সারি। ওরা গিয়ে বসবে ঝিলের ধারে, গাছের ওপর বাসা বাঁধবে, ছোটো ছোটো টিলা সাদা করে বসে থাকবে। বন্দুকটা হাতে তুলে নিলেন কর্নেল—ডোন্ট কিল এ সিটিং বার্ড। পাখিগুলো অর্ধবৃত্তাকারে উড়ে যাচ্ছে। তাদের কাজল পরা চোখের মতো ডানায় এখন নীচের দিকে টান। একটা…দুটো…তিনটে…চারটে…দলছুট… চতুর্থটা সামান্য দলছুট। তাতেই নিশানার সুবিধে হয়ে গেল। বুমমমম…ঘুরতে ঘুরতে লাট খেতে খেতে পড়ছে। যতই নীচে নামছে গতিবেগ বাড়ছে। একদম অব্যর্থ লক্ষ্য। কোথায় লেগেছে গুলিটা তিনি এখনও জানেন না। লক্ষ্য ছিল পেটটার ওপর। ওই জায়গাটাই সবচেয়ে নধর তো! স্কাড ছুটছে, ছুটুক। তিনি তির-ধনুক তুলে নিয়ে পেছন পেছন ছুটেছেন। পরনে শর্টস, হাফ-হাতা সোয়েট শার্ট, পায়ে হ্যান্টিং শ্য। ঝিলের কাছটা কাদা জলা। ওখানে এখন পাখিদের মেলা বসে গেছে। ওরা বোধ হয় বুঝতেই পারেনি ওদের একজন সঙ্গী কম পড়ে গেছে। এখন ঝিলের পানা, শ্যাওলা, গেঁড়ি, গুগলি, কুচো মাছ খেতে ভারি ব্যস্ত। কাদার মধ্যে ক্লাক ক্লাক করছে মেলাই।

কিন্তু এখানেও তিনি বসা পাখি মারবেন না। সেই যে শরীরটাকে লম্বা করে দিয়ে অসম্ভব সুন্দরভাবে ডানা ঝাপটায়। সেই সময়ে, সেই সময়ে ছুটে যাবে অর্জুনের তির। একটা বিশাল তেঁতুল গাছের পাশে দাঁড়িয়ে শরসন্ধান করলেন কর্নেল, উঠছে, একটা পাখি উঠছে, টানছেন, তিনি ছিলা টানছেন, হঠাৎ কনুইয়ে টান পড়ল, চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক।

কী করলেন? কে আপনি? হাউ ডেয়ার য়ু? কর্নেল চ্যাটার্জি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে টকটকে লাল হয়ে গেছেন।

আমিও আপনাকে ওই একই প্রশ্ন ফিরিয়ে দিতে পারি। হাউ ডেয়ার ইউ? সংযত কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ভদ্রলোক।

এই নির্জন ঝিলের ধারে শামখোলগুলো কতদূর থেকে এসে জিরোতে বসেছে। ঝিলের সৌভাগ্য, আমাদের সৌভাগ্য, আপনারও অশেষ ভাগ্য যে এমন দৃশ্য দেখতে পেলেন। ওরা যেমন চায়, তেমনভাবে হাসতে দিন, খেলতে দিন, বাসা বানাতে দিন, বিশ্রামান্তে নতুন শাবক-দল নিয়ে দূরে আরও দূরে উড়ে যেতে দিন, যেখানে ওদের প্রাণ চায়। কী রাইট আছে আপনার ওদের হত্যা করবার? ভদ্রলোকের চোখমুখ ক্রমশ তপ্ত হয়ে উঠছে। কর্নেল কিছু বলতে পারছেন না।

এ ঝিলে হঠাৎ শামখোল আসছে, সরকারের কাছে খবর চলে গেছে। শিগগিরই পাহারা বসবে। ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না। হনহন করে চলে গেলেন। নইলে দেখতে পেতেন স্কাড তিরবেগে ছুটে এসে কর্নেলের পায়ের কাছে মৃত পাখিটাকে ছুড়ে দিচ্ছে। সাদা লম্বা গলা। যৌবনাগমে ধবধবে বুক, বক্র চঞ্চুসমেত মুখটা ডান দিকে নেতিয়ে আছে। ডানা দুটো দুদিকে অসহায়ভাবে ছড়ানো, একটা ভেঙে ঝুলছে। ওইখানেই তাহলে লেগেছিল গুলিটা। খুব সামান্য এক ফালি রক্তের ধারা ডানায়। কর্নেলের চোখে কেমন ধাঁধা লেগে গেল। সাদা শাড়ি পরে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে এক বিদ্ধ নারী। এক হাত ছড়ানো, আরেকটা লাল-মাদুলিপরা হাত কনুই থেকে ভাঁজ। দুটি পায়ের পাতা দুদিকে। শেষ শয়ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress