Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবুর চোখে জল || Sunil Gangopadhyay

কাকাবাবুর চোখে জল || Sunil Gangopadhyay

হঠাৎ সন্ধে সাড়ে সাতটার সময় একটা দারুণ ভাল খবর পাওয়া গেল। আজকাল সত্যি সত্যি আনন্দের খবর তো পাওয়াই যায় না! খবরের কাগজে শুধু মারামারি, এ দলে ও দলে ঝগড়া। এই তো কালই শিয়ালদা স্টেশনে যাত্রীরা কী কারণে যেন খেপে গিয়ে অফিসঘর আর জানলা-দরজা ভাঙচুর করল। আজ সকালেই বাবা বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে গোড়ালির হাড় মচকে ফেললেন, এখন সেই পায়ে মস্ত বড় ব্যান্ডেজ। দুপুরবেলা বুলবুলিপিসির ভাতের থালায় হঠাৎ থপাস করে একটা টিকটিকি এসে পড়ল উপর থেকে। তা দেখে বুলবুলিপিসি আঁতকে উঠে এমন চেঁচিয়ে উঠলেন, যেন বাড়িতে ভূতেরা এসে নাচ শুরু করেছে।

বুলবুলিপিসি থাকেন ত্রিপুরায়। বেড়াতে এসেছেন তিন-চারদিনের জন্য। তারই ভাতের থালায় পড়ল টিকটিকি? অথচ এ বাড়িতে আগে কখনও কারও ভাতের থালায় টিকটিকি পড়েনি। কোনও টিকটিকি ধারেকাছেই আসে না।

মেয়েরা সকলে টিকটিকি ভয় পায়। মা, ছোড়দি আর বুলবুলিপিসি ভাতের থালা ছেড়ে দৌড়ে পালালেন। বুলবুলপিসি বমি করতে লাগলেন বাথরুমে গিয়ে।

সন্তু টিকটিকি দেখলে ভয়ও পায় না, ঘেন্নাও করে না। টিকটিকি অতি নিরীহ প্রাণী। সব বাড়িতেই থাকে কিন্তু মানুষকে কামড়ায় না কখনও। বরং দেওয়ালে-দেওয়ালে ঘুরে পোকামাকড় খেয়ে মানুষের উপকারই করে। সন্তু মাঝে মাঝে টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে ভাবে, ঘরের খাড়া দেওয়ালে কিংবা ছাদের সিলিং-এ ওরা কী করে লেপটে থাকে? ওরা কি মাধ্যাকর্ষণ মানে না?

সেই টিকটিকিটা ভাতের থালার উপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়েই আছে, নড়ছে-চড়ছে না। মরেনি, তা অবশ্য বোঝা যায়।

সন্তু থালাটার কাছে হাত নিয়ে গিয়ে বলল, এই, যাঃ! যা।

সেটা নড়ল না। মুখ ঘুরিয়ে সন্তুর দিকে তাকাল। কেমন যেন ফ্যালফেলে অসহায় দৃষ্টি।

সন্তু একটা চামচে নিয়ে ওর গায়ে না ছুঁইয়ে থালায় লাগিয়ে টংটং শব্দ করল। এবার সে একটু এগোবার চেষ্টা করল। তখন বোঝা গেল, ওর একটা পা ভাঙা। একদিকে কাত হয়ে পড়েছে।

উপর থেকে পড়ে গিয়ে খোঁড়া হয়ে গেল? কিংবা আগেই একটা পা ভাঙা ছিল। তাই পড়ে গিয়েছে! সন্তু আগে কখনও খোঁড়া টিকটিকি দেখেনি। আজ সকালেই বাবার পা মচকাল আর একটা টিকটিকিও খোঁড়া হল, এ যেন কীরকম আজব ব্যাপার।

সন্তু থালাসুদ্ধ টিকটিকিটাকে তুলে নিয়ে চলে এল বারান্দায়। টিকটিকিটা অমনই এক লাফে চলে এল রেলিং-এ। তারপর ডিগবাজি খেয়ে মিলিয়ে গেল যেন কোথায়।

যাক, বেঁচে তো গিয়েছে! কিন্তু এর পর কেউ আর খেতে বসলেন না।

বিকেলবেলা কথা নেই, বার্তা নেই, আচমকা ঝড় উঠল। সারাদিন আকাশ দেখে কিছুই বোঝা যায়নি। প্রথমে কয়েকবার গুড়গুড় শব্দ, তারপরই চড়াত করে একটা লম্বা বিদ্যুৎ আর একটু পরেই দশখানা কামানের আওয়াজে বজ্রপাত।

গরমকালে ঝড়-বৃষ্টি সকলেরই ভাল লাগে। সন্তু খুবই ভালবাসে বৃষ্টি দেখতে, ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজেও নেয়। বুলবুলিপিসিও বেশ বৃষ্টি পছন্দ করেন, ছাদে এসে ভিজতে লাগলেন সন্তুর সঙ্গে। মা ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, এই বুলবুলি, তুইও দেখছি মেতে উঠেছিস সন্তুর সঙ্গে। শিগগির চলে আয়, এই বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর হবে!

তা শুনে বুলবুলিপিসি একপাক নেচে নিয়ে গান ধরলেন, ওরে ঝড় নেমে আয়। আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে…

এই পর্যন্ত বেশ ভালই। তারপরই একটা খারাপ ঘটনা ঘটল।

কাকাবাবু সকাল থেকেই বাড়িতে নেই। তার বন্ধু নরেন্দ্র ভার্মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন এক হোটেলে। তারপর দুজনে যাবেন ডায়মন্ড হারবার, কখন ফিরবেন ঠিক নেই।

সারাদিন বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা ছিল না বলে কাকাবাবুর ঘরের জানলাটানলা ঠিকমতো বন্ধ করা হয়নি। একটা জানলার আবার ছিটকিনি আলগা। ঝড়ের দাপটে দুটো জানলা দড়াম করে খুলে গিয়ে এলোমেলো করে দিয়েছে সব কাগজপত্র। কেউ আগে খেয়াল করেনি। বাড়ির কাজের লোক রঘু একসময় সে ঘরে ঢুকে, ও মা গো, কী সব্বোনাশ হয়েছে গো! বলে কেঁদে উঠেছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে বেশ কিছু বই-কাগজ ভিজিয়ে দিয়েছে।

টেবিলের উপর ছড়ানো ছিল দুটো ম্যাপ। সে দুটোই ভিজেছে বেশি। এই ম্যাপ কাকাবাবুর খুব প্রিয়। তিনি দেশ-বিদেশের বহু ম্যাপ সংগ্রহ করেন। সেই সব ম্যাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তিনি ভ্রমণের আনন্দ পান। অনেক ম্যাপ তিনি কিনে আনান বিদেশ থেকে।

সন্তু ছুটে এসে দেখল, অনেক কাগজ আর বইয়ে জল লেগেছে তো বটেই, ম্যাপদুটোই ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে গিয়েছে। পুরনো ম্যাপ, ছিঁড়ে যাচ্ছে তুলতে গেলেই।

বৃষ্টি থেমে গেল। তবু সকলের মুখ থমথমে। কাকাবাবু ফিরে এসে তার প্রিয় কাগজপত্র ও ম্যাপের অবস্থা দেখে চটে লাল হবেনই। তখন কী উত্তর দেওয়া হবে?

সবচেয়ে মুশকিল এই, কাকাবাবু খুব রেগে গেলেও কাউকে তো বকাবকি করবেন না। কিছু বলবেনই না, শুধু উৎকট গম্ভীর হয়ে যাবেন। তার সেই গাম্ভীর্যকেই সকলে ভয় পায়।

সারাদিনটাই তো কাটল এইরকম গন্ডগোলে। তারপর এল সুসংবাদ।

সন্ধেবেলা লুচি আর মোহনভোগ খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টি-বাদলার জন্য বুলবুলিপিসি বললেন, মুড়ি-বেগুনি আর পাঁপড়ভাজা খাওয়া হবে। ত্রিপুরায় ভাল বেগুন পাওয়া যায় না, কলকাতার বেগুনের স্বাদ চমৎকার।

বৃষ্টির তেজ আস্তে আস্তে কমে যাওয়ার পর একসময় একেবারেই থেমে গেল। উনুনে বেগুনি ভাজা শুরু হয়েছে। মা পেঁয়াজকুচি, লঙ্কাকুচি আর সর্ষের তেল দিয়ে মুড়ি মাখছেন, এই সময় বেজে উঠল টেলিফোন।

সেই আওয়াজ শুনে চমকে উঠল সন্তু। কারণ, কাল থেকে টেলিফোনটা একেবারে বোবা হয়ে ছিল। টেলিফোন অফিসে খবর দিয়েও কোনও কাজ হয়নি। কোনও মিস্তিরি আসেনি। এখন সেটা নিজে নিজে ভাল হয়ে গেল?

সন্তু খুব ব্যগ্রভাবে রিসিভারটা তুলে বলল, হ্যালো, হ্যালো…

ওদিক থেকে শোনা গেল রিনির গলা।

রিনি ধমক দিয়ে বলল, অ্যাই সন্তু, তোদের ফোনটা এত এনগেজড থাকে কেন রে? কার সঙ্গে এত গল্প করিস? সকাল থেকে তিনবার চেষ্টা করছি…

সন্তু বলল, কী করব, ইংল্যান্ডের রানি বারবার ফোন করে কাকাবাবুকে খুঁজছেন। এদিকে কাকাবাবু কোথায় গিয়েছেন জানি না। রানির ফোন মানে জানিস তো, প্রথমে একজন সেক্রেটারি, তারপর আর-একজন, তারপর রানি নিজে…

রিনি বলল, ভ্যাট! তুই বুঝি জোজো সাজবার চেষ্টা করছিস? তুই মোটেই জোজোর মতো পারবি না। ইংল্যান্ডের রানি কেন কাকাবাবুকে খুঁজবেন, কাকাবাবু কি বোম্বাগড়ের রাজা?

শোন, রিনি…

তুই আগে আমার কথাটা শোন। এখনই টিভিটা খোল। দিল্লি দূরদর্শন চ্যানেল।

কেন, এখন টিভি দেখতে যাব কেন? বেগুনি ভাজা হচ্ছে…

বেগুনি? বেগুনি খেতে খেতে বুঝি টিভি দেখা যায় না? শিগগির যা, আমার বেশি কথা বলার সময় নেই। বাড়িসুদ্ধ সকলকে দেখতে বল।

রিনি রেখে দেওয়ার পর সন্তু ভাবল, হঠাৎ এখন টিভি দেখতে হবে কেন? এই সময় তো খবরটবর হয়। সন্তুর অত খবর শোনার আগ্রহ নেই। কিন্তু রিনি যখন বলেছে, তখন তা অগ্রাহ্য করা মুশকিল। ও নিশ্চয়ই একটু পরে আবার ফোন করে চেক করবে।

বুলবুলিপিসি মায়ের পাশে বসে গল্প করছেন। সন্তু জিজ্ঞেস করল, পিসি, তুমি টিভি দেখবে?

বুলবুলিপিসি লালচে রঙের ঠোঁট উলটে বললেন, টিভি? আমার দুচোখের বিষ। সব সময় খালি বকবক। কলকাতায় এসেছি কি টিভি দেখতে?

সন্তু দৌড়ে দোতলায় উঠে গেল।

দোতলায় বড় ঘরটাই কাকাবাবুর। অন্য দিকের ঘরটা ছিল ছোড়দির। তার বিয়ের পর ঘরটা প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে। সন্তু থাকে ছাদের ঘরের নিজস্ব রাজ্যে। দোতলায় দুটো ঘরের মাঝখানে অনেকটা চওড়া জায়গায় কয়েকটা চেয়ার পাতা। এখানে মাঝে মাঝে বাড়ির লোকের আড্ডা বসে। এখানেই রয়েছে একটা টিভি, আর-একটা টিভি একতলায়, বাবা-মায়ের ঘরে। কাকাবাবু নিজের ঘরে টিভি রাখেন না। শুধু ক্রিকেট দেখার জন্য বাইরে এসে বসেন। দোতলাতেও একটা টেলিফোন রিসিভার আছে। সন্তু এসে টিভি খুলতে না-খুলতেই আবার বেজে উঠল ফোন।

এবারও রিনি। সে বলল, উপরে উঠেছিস? দেখেছিস টিভি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, দেখেছি তো, দিল্লি থেকে খবর হচ্ছে হিন্দিতে।

ইন্দোনেশিয়ায় ভূমিকম্প হয়েছে আর হংকং-এ হাজার হাজার মুরগি মরে যাচ্ছে। এসব খবর দেখতেই হবে কেন?

রিনি বলল, চুপ করে দেখে যা। একদম ছটফট করবি না। এই খবর শেষ হওয়ার পরেই দেখবি একটা দারুণ, দারুণ খবর!

হিন্দি খবর চলল দশ মিনিট। তাতে নতুনত্ব কিছুই নেই। মাঝে মাঝে নেতাদের মুখ, তাঁরা কী বলছেন বোঝাই যায় না। রোজ যেন একই রকম। এরপর শুরু হল বিজ্ঞাপন। একবার বিস্কুট, তারপর বাড়ির রং, তারপর মোটরসাইকেল। তারপর শব্দ একেবারে থেমে গেল। শুধু পরপর ছবি। হাতে আঁকা। আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশে ছোট ছোট বাড়ি, আকাশে চিল আর ঘুড়ি উড়ছে। নদীর উপরে দুটো নৌকো, ছাতা মাথায় একটা মোটা লোক, কুঁজো হয়ে হাঁটছেন মহাত্মা গাঁধী, গোরুর দুধ খাচ্ছে একটা বাছুর, এইরকম। দেখলেই বোঝা যায়, কমবয়সি ছেলেমেয়েদের আঁকা। এইসব ছবি দেখে কী হবে? রিনি যে বলল, একটা কিছু দারুণ খবর আছে। সেটা কি আরও পরে?

ছবিগুলো দেখাতে দেখাতে ক্যামেরা একটা ছবির উপর থেমে গেল। সেটা একটা বাঘের ছবি। বাঘটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা গাছে ওঠার চেষ্টা করছে। একটু পরে সেই ছবিটার পাশে এসে দাঁড়াল কমলা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা একটি মেয়ে। হাতে মাইক্রোফোন। সে ইংরেজিতে বলল, এতক্ষণ আপনারা খুদে শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখছিলেন। সাত থেকে দশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা এই ছবি এঁকেছে। সারা ভারতের এই বয়সি ছেলেমেয়েদের ছবির প্রতিযোগিতা এই প্রথম। মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই, চণ্ডীগড়, গুয়াহাটি, ভুবনেশ্বর, কানপুর এই সব শহরে হয়েছে প্রথম প্রতিযোগিতা। তারপর প্রত্যেক শহর থেকে তিনটি করে ছবি এসেছে দিল্লিতে। মকবুল ফিদা হুসেন, সতীশ গুজরাল আর যোগেন চৌধুরী, এই তিন বিখ্যাত শিল্পী বিচার করেছেন ছোটদের আঁকা এই ছবিগুলোর। দুদিন ধরে আলাপ-আলোচনার পর…।

এই পর্যন্ত শুনে সন্তু ভাবল, রিনি তার সঙ্গে নিশ্চয়ই মজা করেছে। এ আর এমন কী শোনার মতো খবর!

সে টিভিটা বন্ধ করতে যাচ্ছে, তখনই সেই মেয়েটি বলল, বিচারকদের মতে সবচেয়ে ভাল হয়েছে এই বাঘের ছবিটি। এই ছবিটি এঁকে সারা ভারতের খুদে শিল্পীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে কলকাতার নীলধ্বজ চক্রবর্তী, বয়স আট বছর চার মাস…

সন্তুর হাতটা থেমে গেল। কলকাতার একটা ছেলে ফার্স্ট হয়েছে? বাঃ, সেটা তো ভালই খবর। কিন্তু রিনি আগে থেকে জানল কী করে? রিনির চেনা কেউ নাকি?

সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটি বলল, আসুন, এবার আপনাদের সঙ্গে লিটল চ্যাম্পিয়ন নীলধ্বজ চক্রবর্তীর পরিচয় করিয়ে দিই। সে দারুণ স্মার্ট ছেলে, চটপট সব কথার উত্তর দিতে পারে।

এবারে দারুণ চমকে গেল সন্তু। এ যে বিল্টু! রিনির ছোট ভাই। তার ভাল নাম যে নীলধ্বজ, তা সন্তু জানত না। আমাদের বিল্টু সারা ভারতের মধ্যে ছবি আঁকায় ফার্স্ট হয়েছে, এ তো সত্যিই খুব ভাল খবর! বিল্টুটা দারুণ দুষ্টু আর গুন্ডা স্বভাবের। সে আবার ছবি আঁকতেও পারে?

সন্তু চেঁচিয়ে বলল, মা, বুলবুলিপিসি, শিগগির এসো, টিভি দেখবে এসো…

এই সময় সিঁড়িতে খটখট শব্দ করে উঠে এলেন কাকাবাবু।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে রে সন্তু?

সন্তু বলল, কাকাবাবু দ্যাখো, দ্যাখো, আমাদের বিল্টু, সে ছবি এঁকে ফার্স্ট হয়েছে!

বিল্টু এ বাড়িতে প্রায়ই আসে তার দিদির সঙ্গে। কাকাবাবু তার দুরন্তপনা খুব পছন্দ করেন। এই তো গত সপ্তাহেই সে কাকাবাবুর ঘরে ঢুকে একটা কাচের গ্লোব মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেছিল। রিনি তাকে শুধু বকুনিই নয়, তার কান ধরেও টেনেছিল। কাকাবাবু খুব রাগ করবেন ভেবে সন্তুও ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

কাকাবাবু কিন্তু রিনিকেই ধমক দিয়ে বলেছিলেন, অ্যাই, ওর কান ধরেছিস কেন রে? নিজের ভাইকে তুই শাসন করবি, কিন্তু অন্যদের সামনে নয়। তাতে ছোটদের খুব অপমান হয়। আমার জিনিস ভেঙেছে, আমি বুঝব।

বিল্টুর কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিন্দুবাবু, তুমি ইচ্ছে করে গ্লোবটা ভাঙলে কেন বলো তো? নাকি হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল?

বিল্টু বলেছিল, জিয়োগ্রাফি বইয়ে যে লেখা আছে, পৃথিবীর পেটের মধ্যে গরম লাভা থাকে। তাই দেখতে গিয়েছিলাম।

কাকাবাবু হেসে বলেছিলেন, ও, এই জন্য? তা বেশ করেছিস, ভেঙেছিস?

এখন টিভির দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু সন্তুর মতোই অবাক হয়ে বললেন, বিল্টু আবার ছবিও আঁকতে পারে নাকি?

ক্ৰাচদুটো রেখে তিনি একটা চেয়ারে বসলেন।

এখন বিন্দুর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে অন্য একটা মেয়ে। তার পোশাক ছেলেদের মতো, চুলও খুব ছোট করে ছাঁটা। তবে সাক্ষাৎকারটা দিল্লিতে নয়, নেওয়া হয়েছে কলকাতায়। বোঝা যায়, আগে থেকে রেকর্ড করা। রিনিদের বাড়িটাও চেনা যাচ্ছে, ঘরের এক কোণে একটা বড় বুদ্ধমূর্তি। বিল্টুর মাকেও দেখা গেল একঝলক।

এই বয়সেই বিল্টু বেশ ইংরেজি বলতে পারে। ইংরেজি স্কুলে পড়া ছেলে। স্কুলে তো ইংরেজি বলেই সব সময়, বাড়িতেও বাংলার বদলে ইংরেজি বলা শুরু করেছিল। ওর ঠাকুরমা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ফোকলা দাতে হেসে বলেছিলেন, আমি তো দাদুভাই ইংরেজি জানি না। তোমার সঙ্গে তা হলে আর কথা বলাই হবে না। বিল্টু ঠাকুরমাকে খুব ভালবাসে। রোজ রাতে তার কাছে গল্প শোনে। তাই ঠাকুরমার সঙ্গে সে আবার বাংলা বলতে শুরু করেছে। ঠাকুরমা অবশ্য ইংরেজি জানেন না তা নয়, তিনি একসময় একটা স্কুলের হেডমিসট্রেস ছিলেন।

ক্যামেরার সামনে একটুও ঘাবড়ায়নি বিল্টু। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, তুমি ছবি আঁকা কার কাছে শিখেছ?

বিল্টু উত্তর দিল, ফ্রম মাই এল্ডার সিস্টার। রিনি চক্রবর্তী। শি ইজ আ গুড সিঙ্গার অলসো। আই কান্ট সিং!

ছবি আঁকা ছাড়া তুমি আর কী পারো?

দৌড়াতে পারি।

দৌড়োতে পারো? কোথায় দৌড়োও?

পাঁচতলা থেকে একতলা। সিঁড়ি দিয়ে।

কেন সিঁড়িতে দৌড়োও?

যারা লিফটে নামে, তাদের চেয়েও আমি তাড়াতাড়ি নামতে পারি।

বাঃ! তুমি এই বাঘের ছবিটা এঁকেছ কেন?

হাতির ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে না বলে।

কেন হাতির ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে না?

হাতির ছবি আঁকা সোজা!

তাই বুঝি? আর মানুষের ছবি?

দিদি মানুষের ছবি আঁকে। আমি দিদির মতো ভাল পারি না।

এই পুরস্কার পেয়ে তোমার কেমন লাগছে? ইন্ডিয়ার মধ্যে তুমি ফার্স্ট হয়েছ।

পুরস্কার, কই পাইনি তো?

পাবে। তোমাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হবে।

ট্রেনে না প্লেনে? আমি প্লেনে চেপে যাব।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, কী স্মার্টলি উত্তর দিচ্ছে বিল্টু। ওইটুকু ছেলে!

সন্তু বলল,পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার পাবে। অত টাকা দিয়ে ও কী করবে?

কাকাবাবু বললেন, এখন জমিয়ে রাখবে। বড় হয়ে ওই টাকায় বেড়াতে যাবে। আমার এত ভাল লাগছে, ইচ্ছে করছে এখনই বিল্টুর সঙ্গে দেখা করতে।

টিভি-তে এখন অন্য অনুষ্ঠান হচ্ছে। সন্তু সেটা বন্ধ করতেই আবার বেজে উঠল ফোন।

রিনি জিজ্ঞেস করল, কী রে সন্তু, দেখলি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ। তুই ভাগ্যিস ফোন করলি। তার ফলে কী হল বল তো? সারাদিন ফোনটা খারাপ ছিল, তুই কল করলি বলেই সেটা ঠিক হয়ে গেল! আর সেইজন্যই প্রোগ্রামটা দেখতে পেলাম। দুর্দান্ত ব্যাপার, বিন্দু যে এত ভাল ছবি আঁকতে পারে…

রিনি বলল, সারাক্ষণ তো ছটফট করে। যদি আর-একটু মন দিত, তা হলে ভবিষ্যতে…

সন্তু বলল, বি তোর কাছাকাছি আছে? কাকাবাবু ওর সঙ্গে কথা বলতে চান।

রিনি বলল, বিন্দু পাশের বাড়ি খেলতে গিয়েছে। আমি বরং কাল সকালে বিন্দুকে নিয়ে যাব তোদের বাড়ি। কাকাবাবুকে প্রণাম করতে!

আজ সারাদিন পরপর কয়েকটা বাজে ব্যাপার ঘটছিল। বিন্দুর এই সুসংবাদে সব যেন ধুয়ে মুছে গেল। বাড়ির সকলে বারবার বলতে লাগলেন বিল্টুর কথা। এমনকী, কাকাবাবুও ম্যাপ ভিজে যাওয়ার জন্য তেমন কিছু মেজাজ খারাপ করলেন না। শুধু বললেন, ইস! যাক গে, খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
Pages ( 1 of 12 ): 1 23 ... 12পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress