বই পড়তে পড়তে
বই পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া কাকাবাবুর অভ্যেস। একটানা বেশিক্ষণ পড়তে পারেন না। বড়জোর আধঘণ্টা পড়ার পর চোখ বুজে যায়। দশ-পনেরো মিনিট সেই অবস্থায় থাকেন, কখনও সখনও একটু একটু নাকও ডাকে। তারপর আবার পড়া শুরু হয়। তাতে নাকি তাঁর আরাম হয় চোখের।
এক-একদিন সারারাত ধরে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে, খানিকক্ষণ জেগে পড়ে শেষ করে ফেলেন এক-একটা বই।
এখন বেলা এগারোটা। জোজো ঘরে ঢুকে দেখল, কাকাবাবু ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন, কোলের ওপর একটা মোটা ইংরেজি বই। চক্ষু বোজা।
কিন্তু কাকাবাবুর ঘুম খুব পাতলা। ঘরে কেউ ঢুকলেই টের পেয়ে যান। জোজো কোনও শব্দ করেনি, তবু কাকাবাবু চোখ মেলে তাকালেন।
সোজা হয়ে বসে বললেন, এসো, এসো, জোজো মাস্টার। নতুন কী খবর বলো!
সাদা প্যান্টের ওপর একটা হলুদ রঙের টি-শার্ট পরে আছে জোজো। দুএকদিন আগেই চুল কেটেছে। সে সবসময় বেশ ফিটফাট থাকে।
জোজো বলল, গরমের ছুটি পড়ে গেছে। দিনগুলো নষ্ট হচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, কেন, নষ্ট হচ্ছে কেন?
জোজো বলল, এখন কলকাতায় থাকার কোনও মানে হয়? কোথাও বেড়াতে যাওয়া উচিত ছিল। বাবা অবশ্য আমাকে পাপুয়া নিউগিনি পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সন্তু না গেলে, মানে আপনার আর সন্তুর সঙ্গে যেতেই আমার বেশি ভাল লাগে। আপনাকে এবার কোনও জায়গা থেকে কেউ ডাকেনি?
কাকাবাবু বললেন, না তো! অবশ্য কেউ না ডাকলেও তো এমনিই কোথাও যাওয়া যায়।
জোজো বলল, স্পেনে যাবেন? বার্সেলোনার আকাশে পরপর তিনদিন অন্য গ্রহের রকেট দেখা গেছে।
কাকাবাবু সরলভাবে অবাক হয়ে বললেন, তাই নাকি! কোন গ্রহের রকেট?
জোজো বলল, তা এখনও জানা যায়নি। তবে হাতির মতন শুড়ওয়ালা একটা মানুষকেও নাকি দেখা গেছে সেই রকেট থেকে উঁকি মারতে।
কাকাবাবু বললেন, গণেশ দেবতা নাকি? বোধ হয় স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে না এসে স্পেনে গেলেন কেন? ওরা তো আর ঠাকুর-দেবতায় বিশ্বাস করে না। তুমি এ খবর জানলে কী করে?
জোজো বলল, স্পেন দেশের কাগজে বেরিয়েছে। আমাদের বাড়িতে তো পৃথিবীর সব দেশের কাগজ আসে। আমার বাবা সাতাশটা ভাষা জানেন। চলুন না দেখে আসি।
কাকাবাবু বললেন, আমি তো অত ভাষা জানি না। অন্য গ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে কোন ভাষায় কথা বলব? যদি গণেশ ঠাকুর হন, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে সংস্কৃত ভাষায়। আমি সংস্কৃতও ভাল জানি না। তা ছাড়া স্পেনে যাওয়ার অনেক খরচ।
জোজো বলল, তা হলে ইন্দোনেশিয়ায় চলুন। সত্যিকারের ড্রাগন দেখতে পাওয়া গেছে। মুখ দিয়ে আগুন বেরোয়। সেই আগুনে গাছপালা পুড়িয়ে দিচ্ছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এ-খবরটা আবার কোথায় বেরিয়েছে?
জোজো বলল, কোথাও বেরোয়নি। আমেরিকানরা জানতে পারলেই তো ড্রাগনটা কিনে নিয়ে যাবে। আমার বাবার কাছে ইন্দোনেশিয়া থেকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি চুপি চুপি বলে দিয়েছেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু কোথায়? তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি?
জোজো বলল, হ্যাঁ। ও কাঁচা আম মাখছে। নুন আর লঙ্কা দিয়ে। আপনি খাবেন?
কাকাবাবু বললেন, শুনেই তো জিভে জল আসছে। নিশ্চয়ই খাব। এখন তো আমের সিজুন নয়। কাঁচা আম কোথায় পেল!
জোজো বলল, ও পায়নি। আমি এনেছি। আফ্রিকা থেকে একজন পাঠিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ! সারা পৃথিবী জুড়ে তোমার চেনাশুনো।
জোজো এবার প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুপোর মেডেল বার করল। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা দেখেছেন?
কাকাবাবু বললেন, মেডেল? এটা কে দিয়েছে তোমায়? ইংল্যান্ডের রানি না জাপানের সম্রাট?
জোজো হেসে ফেলে বলল, এটা আমার নয়, সন্তুর। ও লজ্জায় আপনাকে দেখায়নি।
কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে বললেন, সন্তুকে হঠাৎ কে দিল? গোল মেডেলটির মাঝখানে লেখা :
শরৎ স্মৃতি পুরস্কার
১ম
শ্রীসুনন্দ রায়চৌধুরী
কাকাবাবু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কীসের পুরস্কার বলো তো? সাঁতারের?
জোজো বলল, না। প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা। সব কলেজের মধ্যে। সন্তু ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। বিষয়টা ছিল, পৃথিবীর আয়ু কতদিন।
কাকাবাবু বললেন, খুব শক্ত বিষয় তো। আমি নিজেই জানি না। পৃথিবীর আয়ু কতদিন? জোজো, এই প্রতিযোগিতায় তুমি নাম দাওনি?
জোজো বলল, কী যে বলেন কাকাবাবু! একই প্রতিযোগিতায় সন্তু আর আমি দুজনে কি একসঙ্গে নাম দিতে পারি? আমি ফার্স্ট হয়ে গেলে সন্তু দুঃখ পেত না? সন্তুকে আমি অনেক পয়েন্ট বলে দিয়েছি। আসলে একটাই মেন পয়েন্ট।
কাকাবাবু বললেন, কী বলো তো মেন পয়েন্ট!
জোজো বলল, সাবজেক্টটা হল পৃথিবীর আয়ু কতদিন। এতে কিন্তু পৃথিবী নিয়ে কিছু লিখতে হবে না। লিখতে হবে, মানুষের আয়ু কতদিন। ধরুন, কোনও কারণে যদি পৃথিবী থেকে সব মানুষ শেষ হয়ে যায়, তা হলে তার পরেও পৃথিবী থাকবে কি থাকবে না, কে তার হিসেব রাখবে?
কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছ তো? আচ্ছা জোজো, তুমি ভূতের আয়ু কতদিন তা বলতে পারো?
জোজো বেশ অবাক হয়ে বলল, তার মানে?
কাকাবাবু বললেন, একজন মানুষ ষাট-সত্তর-আশি বছর বাঁচে। তারপর মরে গিয়ে ভূত হয়। ভূত হয়ে আবার কতদিন বেঁচে থাকে? চার-পাঁচশো বছর কি ভূতের আয়ু হতে পারে?
জোজো ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?
কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, আগে তো করতাম না। এখন মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
এই সময় সন্তু একটা পাথরের বাটি হাতে নিয়ে ঢুকল। তাতে কাঁচা আম পাতলা পাতলা করে কেটে নুন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখা।
কাকাবাবু একটুখানি আমমাখা তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে বললেন, দারুণ! অনেকদিন পরে খেলাম! আর একটু দে তো!
জোজো বলল, বেশি খেলে দাঁত টকে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ রে সন্তু, তুই প্রবন্ধ লিখে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিস, আমাকে বলিসনি কেন?
সন্তু লাজুকভাবে বলল, ও এমন কিছু না।
কাকাবাবু বললেন, তোকে আমারও একটা প্রাইজ দেওয়া উচিত। জোজো বলছিল কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা। সেটাই প্রাইজ হতে পারে। কিন্তু আমি বিদেশে নিয়ে যেতে পারব না। তাতে অনেক খরচ। কেউ তো আমাদের ডাকছে না। এমনিই বেড়ানো হবে। কোথায় যেতে চাস বল! এমন কোথাও যাওয়া যাক, যেখানে আমরা আগে যাইনি।
সন্তু বলল, জয়শলমির! রাজস্থানে কখনও—
জোজো বলল, আমি গেছি!
সন্তু বলল, তা হলে রাজগির?
জোজো বলল, তাও আমার দেখা!
কাকাবাবু বলল, আমি কয়েকটা জায়গার নাম বলছি, জোজো বলো তো, সেগুলো তোমার দেখা কি না! চেরাপুঞ্জি। উটকামণ্ড। কালিকট। রামটেক। পারো। মহাবলীপুরম।
জোজো বলল, এইসব ছোট জায়গা… না, আমার যাওয়া হয়নি।
সন্তু বলল, অনেক সময় ছোট জায়গাই বেশি ভাল লাগে।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে এর মধ্যেই একটা বেছে নেওয়া যাক। কোথায় যাবে ঠিক করো।
সন্তু বলল, চেরাপুঞ্জি।
জোজো বলল, মহাবলীপুরম।
কাকাবাবু বললেন, ওভাবে হবে না। লটারির মতন একটা কিছু করা যাক।
তিনি একটা কাগজকে ছ টুকরো করে প্রত্যেকটাতে লিখলেন এক-একটা জায়গার নাম। তারপর কাগজগুলো উলটে দুহাতে ধরে জোজোর দিকে এগিয়ে বললেন, তুমি একটা টেনে নাও!
জোজো একটা কাগজ নিয়ে পড়ে দেখে বলল, কালিকট।
কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কালিকট যেতে আপত্তি আছে?
সন্তু বলল, ঠিক আছে কালিকটেই যাব। এটা কি সেই কালিকট, যেখানে ভাস্কো দা গামা প্রথমে এসে জাহাজ ভিড়িয়েছিল?
কাকাবাবু বললেন, কালিকট একটাই আছে।
জোজো বলল, কালিকটের রাজার নাম ছিল জামোরিন। তার সঙ্গে ভাস্কো দা গামার আলাপ হয়। সেই প্রথম সমুদ্র পেরিয়ে ইওরোপের বণিকরা এসেছিল। ভারতে।
সন্তু বলল, ভালই হল। নিশ্চয়ই ওখানে ইতিহাসের অনেক চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাবে!
কাকাবাবু বললেন, তা জানি না। হয়তো এখন আর কিছুই নেই। যাই হোক, একটা নতুন জায়গা তো দেখা হবে
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী করে যেতে হয়? ট্রেনে?
কাকাবাবু বললেন, ট্রেনে যেতে অনেক সময় লেগে যাবে। প্লেনেও যাওয়া যায় নিশ্চয়ই।
কাকাবাবুর ঘরের এক দেওয়ালে সবসময় একটা বড় ম্যাপ টাঙানো থাকে ভারতের। সেখানে উঠে গিয়ে তিনি বললেন, এই যে দ্যাখ, কেরালায় কালিকট শহর। বম্বে দিয়ে যাওয়া যায়, ম্যাড্রাস দিয়েও যাওয়া যায়।
জোজো বলল, বম্বে নয়, এখন মুম্বই। ম্যাড্রাস নয়, চেন্নাই।
কাকাবাবু বললেন, তা বটে! মনে থাকে না। ভাগ্যিস আমাদের কলকাতার নামটাও বদলায়নি। আমরা মুম্বই দিয়েই যাব।
একটু পরেই একজন তোক দেখা করতে এল কাকাবাবুর সঙ্গে। খাকি প্যান্ট ও খাকি শার্ট পরা। কাকাবাবুর দিকে একটা লম্বা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল, সার, এই আপনার প্লেনের টিকিট।
কাকাবাবু খাম খুলে একটা প্লেনের টিকিট বার করে ভাল করে দেখলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ ঠিক আছে। কিন্তু রামরতন, ঠিক এইরকম আরও দুটো টিকিট যে চাই, আমি নাম লিখে দিচ্ছি, আজ বিকেলের মধ্যেই দিয়ে যেতে হবে!
লোকটি বলল, হ্যাঁ সার, পৌঁছে দেব।
কাকাবাবু তাঁর প্যাডে সন্তু ও জোজোর নাম লিখে দিলেন।
লোকটি চলে যাওয়ার পর সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এটা কোথাকার টিকিট? তুমি অন্য কোথাও যাচ্ছ?
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, না তো! এটা কালিকটের টিকিট। তোদের জন্যও আর দুটো টিকিট আসছে।
সন্তু বলল, তার মানে? কালিকট যাওয়া তো এইমাত্র ঠিক হল। আর সঙ্গে সঙ্গে কালিকটের টিকিট এসে গেল? এটা কি ম্যাজিক নাকি?
কাকাবাবু এবার উত্তর না দিয়ে গোঁফে আঙুল বোলালেন।
জোজো বলল, আমি যে কালিকট লেখা কাগজটা টানলাম, আমি তো অন্য কাগজও টানতে পারতাম!
কাকাবাবু বললেন, না। তা পারতে না। আমি একটু একটু ম্যাজিক শিখছি। ম্যাজিশিয়ানরা একটা তাসের ম্যাজিক দেখায়, দেখোনি? তুমি যে-কোনও একটা তাস টানলে, ম্যাজিশিয়ান দূর থেকেই বলে দিল সেটা কী তাস। এটা এক ধরনের হাতসাফাই, ইংরেজিতে বলে ফোর্সিং। ম্যাজিশিয়ান ইচ্ছেমতন একটা বিশেষ তাস তোমাকে গছিয়ে দেবে। দেখবে খেলাটা?
কাকাবাবু বিভিন্ন শহরের নাম লেখা কাগজগুলো একসঙ্গে মিশিয়ে দিলেন। কয়েকবার সবকটা ওলটপালট করার পর, আবার বিছিয়ে ধরে বললেন, সন্তু, তুই একটা টান।
সন্তু বেশ কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে একেবারে কোণের কাগজটা টেনে নিল।
কাকাবাবু বললেন, ওটা উটকাম, তাই না?
সন্তু দারুণ অবাক। সে জোজোর চোখের দিকে তাকাল। জোজো হাততালি দিয়ে বলল, চমৎকার। কাকাবাবু আপনি আর কী কী ম্যাজিক শিখেছেন?
কাকাবাবু বললেন, আরও শিখেছি কয়েকটা। পরে দেখাব।
জোজো বলল, আপনি আগেই কালিকট যাবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। তার মানে, ওখানে আপনার কোনও কাজ আছে?
কাকাবাবু খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, না, কাজ ঠিক নেই। বেড়াতেই যাচ্ছি। তবে ফাউ হিসেবে একটা চার-পাঁচশো বছরের বুড়ো ভূতের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে।