শোনো তোমরা হে আমার বাল্যবন্ধুগণ-
শোনো আফজাল, তাহের, ফরহাদ, সূর্যকিশোর।
আজ পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
ভাবছি তোমাদের কথা।
আফজাল, আমি জানতাম
সেলুলয়েডে একটা নির্মল কাহিনী রচনার সাধ ছিলো তোমার।
তাহের, তুমি একটা বিরাট সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে।
ফরহাদ, গ্রাম-থেকে-আনা তোমার গোলাপী রঙের টিনের
স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো
যাবতীয় চিরকুট, সবুজ শাল আর একটা রাজহাঁস।
সূর্যকিশোর,
প্রতিদিন সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাওয়াতেই ছিলো তোমার আনন্দ।
আফজাল, তোমার সেই সেলুলয়েডী সাধ, যদ্দূর জানি,
পূর্ণ হয়নি। এইতো সেদিন আমরা কতিপয় শোকার্ত মানুষ
গোলাপজল আর লোবানের ঘ্রাণময় হাতে
তোমাকে শুইয়ে দিলাম মাটির নিচে, যেখানে
কাঁকড়াবিছে আর পোকামাকড়ের ঘনিষ্ঠ গেরস্থালি।
প্রতিবাদহীন তুমি ছিলে অসম্ভব নিশ্চুপ, অথবা শার্টের কলারে
কিং জ্যাকেটের আস্তিনে একটা পিঁপড়ে
অথবা, কাঁচপোকা আনাগোনা করলে তুমি
মাথাখারাপ-করা অস্বস্তিতে ভুগতে, টোকা মেরে উড়িয়ে দিতে
তৎক্ষণাৎ। মনে পড়ে, আফজাল তোমার সঙ্গে দেখেছিলাম
জীবনের প্রথম জোনাকি আর তোমার স্মৃতি এখন জোনাকি।
তাহের তুমি সেতু তৈরির স্বপ্ন খারিজ করে
বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে একদিন পাড়ি জমালে সুদূর বিদেশে।
তুমি আজ ফেঁসে গিয়েছো ভিনদেশী এক শহরে, ডিপার্টমেন্টাল
স্টোরের ঝলমলে করিডোরে, ব্যাংক ত্র্যাকাউন্টের ঝকমকিতে,
চকচকে এস্কেলেটারে।
ফরহাদ, তোমার সেই ‘এলাহি ভরসা’ খচিত
গোলাপী রঙের টিনের স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে-পড়া রাজহাঁস
গ্রামীণ তেজারতির অন্ধকার গুদামে দম আটকে
মারা গ্যাছে। তুমি চটজলদি
তাকে দাফন করেছো জামতলায় হল্দে পাতার নিচে।
সূর্যকিশোর; সেই যে তুমি হাঙ্গামায় বেচারামের
দেউড়ির বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেলে
সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে, তারপর তোমার কোনো খোঁজখবর
আমি পাইনি। তুমি কি পশ্চমবঙ্গের রাইটার্স বিল্ডিং এ
কলম পিষছো? নিত্যদিন মিশছো চৌরঙ্গীর ভিড়ে ? নাকি
ডেলি প্যাসেজ্ঞারি করছো মফস্বলী ট্রেনে?
সূর্যকিশোর, তুমি কি আজ খুচরো যন্ত্রাংশের কারবারি?
তুমি কি ধিকিয়ে-ধিকিয়ে-চলা খবর কাগজের
সংবাদ-শিকারি? তুমি কি ফাটকা বাজারে ঘোরো নিত্যদিন?
সূর্যকিশোর, হে বন্ধু আমার, তুমি এখনো
সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যেতে ভালোবাসো প্রত্যহ?
ইতিহাসের চেল্লাচিল্লি আর রাজনীতির হৈ-হল্লায়
তুমি বেঁচে আছো কিনা, আমি তা জানি না সূর্যকিশোর।
শোনো তোমরা শোনো, হে আমার বাল্যবন্ধুগণ,
পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
আমি ভাবছি তোমাদের
এবং ভাবছি আমার নিজের কথা।
একদা সুকান্তের মতো গালে হাত দিয়ে
পুরোদস্তুর কবির কায়দায়
একটা ফটো তুলেছিলাম,
উই-খাওয়া সেই ফটো আজ
কোথায় হারিয়ে গ্যাছে। তোমাদের অলক্ষ্যে
কী রহস্যময় সখ্যে
অক্ষরের পরী ভর করেছিলো আমার ওপর। এখনো
গায়ে-কাটা-দেওয়া প্রহরে প্রহরে
আমার নিভৃত ঘরে, পথে-বিপথে তার
অনির্দিষ্ট আনাগোনা।
শোনো তোমরা শোনো, হে বাল্যবন্ধুরা আমার, শোনো
আমার ঘরে নিমেষে বস্তুময়তার উপরিতলে পিছলে
অনেক রঙিন মাছ এসে যায়, সাঁতার কাটে, এসে যায়
জলাভূমির ধারে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের
হাড়গোড়ের সারে মজ্ঞরিত লক্ষ লক্ষ টাটকা গোলাপ।