Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আশু-পাণ্ডে উপাখ্যান || Arindam Deb

আশু-পাণ্ডে উপাখ্যান || Arindam Deb

“ধরে নাও লিমিট বলে একটা জিনিস আছে “! এই ছিলো ক্যালকুলাস বা কলনবিদ্যার ইন্ট্রোডাকশন বা ভূমিকা! আর সেখানে থেকেই আমার অঙ্কে ঘেঁটে যাওয়ার শুরু!

হ্যাঁ! আমাদের আশুবাবু বা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় – প্রবল পরাক্রমশালী অঙ্কের মাস্টারমশাই – পড়ানোর এটাই তার ট্রেডমার্ক স্টাইল ছিলো!

ছিপছিপে চেহারা, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবী ও ধুতির সাথে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, সাথে সেইরকমই শ্বেতপক্ক কেশ!

বয়স দেখে বোঝা মুশকিল হলেও কিন্তু মনে হতো অশীতিপর, তবে এনার্জি বা স্ট্যামিনাতে ত্রিশ বছরের শিক্ষকদেরও হার মানাবার ক্ষমতাধারী ছিলেন! স্কুলে আসতেন সাইকেলে চড়ে – হ্যাঁ, আমি আশির দশকের শুরুর কথাই বলছি! থাকতেন প্রথমে কালীঘাট এবং পরে লেক মার্কেট অঞ্চলে, যদিও আমার সঠিক জানা নেই, যতদুর মনে পড়ে, সেটাই শুনেছিলাম কারো কাছে !

অবসর গ্রহণের পরে , সাউথ পয়েন্টের রেক্টর সাহেব, শ্রী সতীকান্ত গুহ, এরকম বহু শিক্ষকদেরই এ স্কুলে পড়ানোর অনুরোধ করেন! তার মাঝে আশুবাবু অন্যতম এক সদস্য!

শ্রী গুহ, নিজে কেবল একজন শিক্ষাবিদই ছিলেননা, সুসাহিত্যিক হওয়ার কারণে, কলা ও সংস্কৃতি জগতের বহু দিকপালই তার ঘনিষ্ঠ ছিলেন, যার মধ্যে উদয়শংকর, উৎপল দত্ত, এন. বিশ্বনাথন, কমল মজুমদার, আশিস সান্যাল, নিরদ মজুমদার, নিখিলেশ দাস (কফি হাউস – গান খ্যাত), সলিল ভট্টাচার্য, উৎপল চ্যাটার্জি, ইপ্সিতা রায়, অপর্ণা সেন, মঞ্জরী লাল, বরুণ চন্দ প্রভৃতের মতন ব্যক্তিত্বওগ তার দলেভারী করেছিলেন।

সেই সূত্রে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে, আমরা ডঃ অমল কুমার চক্রবর্তী (ডক.চক), শম্ভুনাথ রায়চৌধুরী(এস.এন.আর.সি.) শ্যামসুন্দর মাইতি,কমল মজুমদার, শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায়ের মতন প্রথিতযশা শিক্ষক তথা শিল্পীদের গাইডেন্স পেয়ে ধন্য ও ঋদ্ধ হয়েছি!

আশুবাবুর কথায় ফিরে আসি!
ভবানীপুরের সাউথ সাবার্বান মেইন স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি সাউথ পয়েন্টে আসেন! প্রাক্তন উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ড , যা তখন কেবল নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণি সংলগ্ন সিলেবাসে পরীক্ষা গ্রহণ করতো (১৯৭৫ এ যার অন্তুিম ব্যাচ পরীক্ষা দেয়), আশু স্যার সেই আমলের ছাত্রদের সত্যিই আদর্শ ছিলেন।

আমরা তাকে অনেক পরে পেয়েছি বলে হয়তো তিনি তার পড়ানোর পদ্ধতি পাল্টান এবং বার্দ্ধক্যজনিত কারণই হোক বা আমার মতন সাধারণ মধ্য মেধার ছাত্র বলেই হোক, তিনি আমার বা আমার মতন কিছু ছাত্রের জীবনে হয়তো তেমন ছাপ ফেলতে পারেননি, তবু আমার বা আমাদের তার প্রতি সম্মান বা শ্রদ্ধার একলেশও কম ছিলোনা, তার ব্যাক্তিত্বর কারণেই হোক বা তাকে ভয় পেয়েই হোক! আশুবাবু একজন আদর্শ শিক্ষক, এটা কোনোদিনই কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা, যত বড় মূর্খই হোক না সে! কিন্তু তা যারা মেধাবী ছাত্র ছিলো, অঙ্ক করার শর্টকাট তাদের এত অসাধারণ শিখিয়ে দিতেন, যাতে যে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়, অতি কম সময়, কেমন করে সকল অঙ্ক কষে ফেলা যায়, তা তিনি এমন যাদুবলে শেখাতেন, সাউথ পয়েন্টের এ + ছাত্ররা নিমেষে লুফে নিলেও আমরা সেই অথৈ জলেই নিমজ্জিত থেকে অঙ্কের রেজাল্ট বেরোনোর পরে, বাবার গাঁট্টা আর মায়ের বকুনি ব্যতীত কিছু জোটাতে পারতামনা!

আশুবাবু, কোনো অঙ্কেরই প্রতিটা স্টেপ বা ধাপ বোঝাতেননা, তিনি ধরেই নিতেন সেটা আমরা জানি এবং এ কারণেই ছাত্রদের মাঝে একটা বৈষম্য তৈরি হয়ে যেতো, যা তখনকার যুগে ডিমরালাইজিং হলেও অন্যরূপে হানিকারক আদৌ ছিলো না – আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এইরকম সিচুয়েশনে। আমাদের অন্য সাবজেক্টে ভালো পরীক্ষা দিয়ে, নম্বরের শতাংশের সাম্যতাটা বজায় রাখতে হতো।

ক্লাসে তার মাস্টার জীবনের অতীতের বহু কাহিনিও শোনাতেন, সাউথ সাবার্বান স্কুলের ” বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো ” ছাত্রদের নিয়ে তার গর্বের অন্ত ছিলোনা – সেখানে আমরা যেন দ্বিতীয়পক্ষের অবাঞ্ছিত সন্তান, যাদের ওদের সাথে তুলনাই করা চলেনা! তবু তিনি যথেষ্ট স্নেহদান করে গেছেন, সাউথ পয়েন্টের সকল ছাত্রছাত্রিদের এবং এই তফাতটি তিনি অকপটে স্বীকার করে – তার অপারগতার বিষয় দুই হাত তুলে যেন জানিয়েই দিতেন!

আরেকদিন স্থানাঙ্ক জ্যামিতি বা কো অর্ডিনেট জিয়োমেট্রির ক্লাসে – ” ইলিপ্স আর হাইপারবোলা তো একই জিনিস ” – বলে প্যারাবোলার কনসেপ্টও ঘেঁটে দিলেন (সত্যি বলতে – তখন এলিপ্স আর হাইপারবোলার সূত্রে যে মিল তা বোঝার মতন মেধা আর কোথায়?)
ত্রিকোণমিতির আইডেনটিটি বা সমতা বোঝাতে
বোর্ডের একম ওপরে বাঁদিকের এক্সপ্রেসন লিখে একদম নিচে ডানদিকে লিখে ওপরে আর নিচে, দুদিক থেকেই একটা স্টেপ লিখে লিখে, সমতা প্রমাণ করে দিতেন – এবং তাতে অবলীলায় তিন চারটি ধাপ বাদ পড়ে গেলেও তার ভ্রুক্ষেপ ছিলোনা, কারণ ভালো ছেলেরা ঠিক বুঝতে পারতো, আমরাই খাবি খেতাম। তবু বকুনির ভয়ে কেউ মুখ খুলতামনা – ক্লাসে পিন পড়ার শব্দ পাওয়া যেত, এমনটাই ছিলো ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলাবোধ যা হয়তো একরকম চাবুক মেরেই চাপানো হতো!

তাই আমরা ক্লাসের পড়ার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, নিজেরাই মনমতন গাইড বা টিউটর খুঁজে নিতাম বলে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল সকলেরই বেশ ভালোই হতো, যার কৃতিত্ব স্কুল তথা আশু স্যারেদেরই, কারণ আমরাও পিছিয়ে পড়ার ভয়ে বাড়িতেই খেটে পড়তাম!

আশুবাবুর প্রিয় গ্রুপ – ডি স্টাফ ছিলো আমাদের অনন্তদা! অনন্তদা মারাত্মক ভক্ত ছিলো, আশুবাবুর, এবং জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের ম্যানেজারের দায়ভার অনন্তদাই গ্রহণ করে। এর কারণ – শোনা কথা – আশুবাবু অনন্তদার ছেলের পড়াশোনায় প্রচুর সাহায্য করেন বলে, যুগোপযোগী কৃতজ্ঞতায় অনন্তদা একপ্রকার গদগদই থাকতো এবং আশুবাবুর কিল থাপ্পড় গাল-মন্দ কোনোটাতেই তার সাতচড়ে মুখ দিয়ে টু শব্দটিও বেরোতোনা।

আশুবাবু সাইকেল চালানোর সময়, প্রায়শই ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করতেন এবং আদালতের শমন এলে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রক্সি দিতো, আামাদের স্কুলেরাই শ্রী অনন্ত কুমার গুঁই! সেখানে জানা ছিলো, জরিমানা যত চাওয়া হোক না কেন কখনও মুখ খুলে তর্ক করা চলতোনা, তাহলে ফাইন তাহলে ডবল বা দ্বিগুণ !

আমাদের হিন্দি পড়াতেন উত্তর প্রদেশজাত এক শুদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, শ্রী জয়দেব পাণ্ডে। তিনি আশুবাবুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, যা আজও আমি বিহার ও উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দাদের মাঝে দেখতে পাই – শিক্ষক বা গুরু যেন ঈশ্বরসম! তাই স্টাফরুমে আশুবাবুর পাশের চেয়ারেই পাণ্ডেজি স্থান করে নেন! পাণ্ডেজি শুদ্ধ নিরামিষ গ্রহণ করতেন – সে জায়গায় আশুবাবু মটনভাত, চিকেন ভাত, মাছভাত খেলেও পাণ্ডেজি আশুবাবু পাশটি থেকে নিজেকে স্থানান্তরিত করেননি। তাদের মাঝে বন্ধুতাও গড়ে ওঠে ভালোই!.

পাণ্ডেজির পড়ানো বা শিক্ষকতা ছাড়াও আরও একটি শখ ছিলো। তার একটি রেডিও সারানো ও বিক্রির দোকান ছিলো। তার বিজ্ঞান পড়ার ইচ্ছে থাকলেও তার বাবার ইচ্ছে ছিলো তিনি পৌরহিত্য করেন। তাই ভালো ফল করেও তিনি বিজ্ঞান না পড়ে, একপ্রকার বাবার কথায়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করে কলকাতায় চাকরির আশায় চলে আসেন, কিন্তু বিজ্ঞানকে ভুলে যেতে চাননি বলে শখ রূপে রেডিওর দোকান করেন।

এমনিতে সারাই ও বিক্রি করতেন রেডিও কিন্তু একবার তিনি ঠিক করলেন রেডিও বানাবেন।
খেয়াল রাখতে হবে, সেটা সত্তরের দশক – তখন ট্রানজিস্টর রেডিও সবে বাজারে এসেছে আর রেডিও মানেই বড় ভাল্ভের সেট ছিলো যাতে ডায়োড ও ট্রায়োড, পেছনের বোর্ডে বাল্বের মতন বেরিয়ে থাকতো ও জ্বলতো! প্রিন্ট সার্কিট, টিভি, ইন্টারনেট তখন স্বপ্নেরও অতীত – সে যেন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগ!

তা পাণ্ডেজি একদিন, জুতোর বাক্সকে ক্যাবিনেট করে একটি রেডিও বানিয়ে নিয়ে এসে সদর্পে আশুবাবুকে দেখালেন!

” ইয়ে চলতা হায়? মানে বাজতা হায়? ” – আশুবাবু প্রশ্ন করলেন!.
” কিঁই নহি, বজতা হায়, বোলতা হায় অউর আপকে লিয়ে গানা ভি গাতা হায়! “-

পাণ্ডেজি উত্তরে আশুবাবু বললেন – ” তো চলাইয়ে, ইন্ডিয়া ইংল্যান্ড ক্রিকেট চল রহা হায়, হম কমেন্ট্রি শুনেংগে! “

পাণ্ডেজি আহ্লাদিত হলেন। এতটা সাড়া অঙ্কের মাস্টারমশাই আশুবাবুর কাছে পাবেন এটা তার কাছে আশাতীত ছিলো।

তিনি টেবিলে রেডিও বসিয়ে, দুই চারটি ফুল তার পাশে রেখে, ধুপকাঠি জ্বালিয়ে – ” হরি ওম হরি ওম” উচ্চারণের পর প্লাগ লাগানো মাত্রই বিকট আওয়াজে রেডিও চালু হলো কিন্তু কোথায় কমেন্ট্রি – কেবল খরররর খটপট খটপট ক্যাঁ কোঁ কিঁ কিঁ চিঁ চিঁ চ্যাঁ ভ্যাঁ বাদে একটা শব্দও বেরোলোনা?

পাণ্ডেজি মুখ ব্যাজার করে প্রশ্ন করলেন, মাথা চুলকে – ” এইসা কেয়া আউর কিঁউ হো রহা হায় মালুম নহি! “.

“কুছ নেহি, এ আপহিকা পাণ্ডেমোনিয়াম বাহার হোতা হায়, দেখিয়ে ইন্ডিয়া বোধ হয় হার গিয়া, ইসিলিয়ে লজ্জা মে কাঁদ রহা হায় “
স্টাফরুম হাসিতে ফেটে পড়লেও, পাণ্ডেজি লজ্জায় লাল হয়ে কোনদিনই আর রেডিও প্রসঙ্গ তোলেননি আর আশুবাবুর সাথেও দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন – হয়তো অপমানে বা অপদস্ত হবার ভয়ে, যে ইচ্ছে আশুবাবুরও ছিলোনা।

১৯৭২ – ৭৩ সালে রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে, সাউথ পয়েন্টের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়। তাতে শিক্ষকদের ১০০ মিটার রেসে, অনেকে নাম দেন এবং তাতে যথারীতি আশুবাবুর পাশের লেনেই পাণ্ডেজি! রেস শুরু হওয়ার আগে পা ছুঁয়ে প্রণাম না করেও, আশুবাবু হাত ধরে পাণ্ডেজি আশীর্বাদ চেয়ে সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন!

রেস শুরু হলো, তাক লাগিয়ে সকলের থেকে এগিয়ে পাণ্ডেজি প্রথম, দ্বিতীয় স্থানে আশুবাবু – ধুতি গুটিয়ে সে কী দৌড়, আমরা ভাবতেও পারিনি। পাণ্ডেজির পরণে পাঞ্জাবি ও চোঙা পাজামা!

আমরা যখন নিশ্চিত, পাণ্ডেজি জিতে গেছেন, ফিনিশ লাইনের আধ মিটার দূরে, হঠাৎ পাণ্ডেজি হাঁটুতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। আশুবাবুও থামতে গেছিলেন কিন্তু পাণ্ডেজি তাকে ডানহাত ঝাঁকিয়ে রেস সম্পূর্ণ করতে বললেন! হলোও তাই – পাণ্ডেজির আর মেডেল পাওয়াই হলোনা। তিনি হেরে গিয়েও আমাদের কাছে জিতলেন তবু আমৃত্যু কোনদিনই স্বীকার করেননি সত্যি কথাটা যে আশুবাবুকে তিনি হারতে দেখতে চাননি! এ কথা আশুবাবু, পাণ্ডেজির অকালমৃত্যুর পর, তারই স্মরণসভায় স্বীকার করে জীবনে প্রথমবার চোখের জল মোছেন!

এত কিছু সত্বেও আজকে আমরা ভালোমনে বলি – ” সত্যি! এনারাই আদর্শ মাস্টারমসাই বটে….”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *