Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নীললোহিতের অন্তরঙ্গ || Sunil Gangopadhyay

নীললোহিতের অন্তরঙ্গ || Sunil Gangopadhyay

সেই গল্পটা আশা করি সবারই মনে আছে? সেই মহাভারতে, যুদ্ধের পর— ভীষ্ম শরশয্যায় রয়েছেন, যুধিষ্ঠির এসে তাঁকে রোজ নানারকম প্রশ্ন করেন— একদিন প্রশ্ন করলেন, দাদামশাই, নারী এবং পুরুষ—এদের মধ্যে কার জীবন বেশি সুখের? (কী সময় কী প্রশ্ন! তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, ভীষ্ম মরতে বসেছেন, তার ওপর পিঠে অতগুলো তীর বেঁধানো—এ—সময় তিনি বললেন নারী-পুরুষের সুখের কথা! তাছাড়া ভীষ্ম, যিনি সারাজীবনে কখনো কোন নারীকে স্পর্শ করেননি, তিনি ওদের সম্পর্কে কী জানবেন?)

কিন্তু দমলেন না ভীষ্ম। বললেন, প্রশ্নটা খুব জটিল বটে, কিন্তু এ-সম্পর্কে একটি আখ্যান আছে—তার থেকেই এর উত্তর পাওয়া যায়। পাঠকরা গল্পটা নিশ্চয়ই জানেন। আমি সংক্ষেপে আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। পুরাকালে ভঙ্গস্বন নামে এক রাজা ছিলেন (হাতের কাছে মহাভারত নেই, নামটাম একটু ভুল হতে পারে—কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনা।)—একদিন তিনি শিকারে বেরিয়ে গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেলেন। তারপর তৃষ্ণার্ত হয়ে খুঁজতে-খুঁজতে এক জলাশয়ের কাছে এলেন—সেই পুকুরটা ছিল অপ্সরাদের স্নানের জায়গা—পুরুষের সেখানে আগমন নিষিদ্ধ, রাজা তো জানেননা—তিনি যেই পুকুরে নেমেছেন, অমনি তিনি স্ত্রীলোক হয়ে গেলেন। পুরোনো সব কথাও তাঁর মন থেকে মুছে গেল। অনুচররা রাজাকে খুঁজে না-পেয়ে ফিরে গেল, রাজা ভঙ্গস্বন এক রূপসী রমণী হয়ে থেকে গেলেন বনে। ক্রমে এক ঋষিকুমারের সঙ্গে দেখা হল তাঁর, দর্শন থেকে প্রণয়, প্রণয় থেকে বিবাহ। ঋষির বউ হয়ে আশ্রমে অরণ্যে সুখে দিন কাটাতে লাগলেন তিনি। কয়েকটি ছেলেমেয়েও হল।

একদিন মহর্ষি নারদ খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখতে পেলেন। তাঁকে নারদ চিনতে পারলেন দিব্যদৃষ্টিতে। তিনি রাজাকে (এখন ঋষিপত্নী) বুঝিয়ে বললেন যে, তাঁর অভাবে রাজ্য ছারখারে যাচ্ছে—তাঁর আগের পক্ষের ছেলেরা ঝগড়াঝাঁটিতে মত্ত, সুতরাং তাঁর ফিরে যাওয়া উচিত। নারদ মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে তাঁকে আবার পুরুষ করে দিলেন।

আশ্রম ছেড়ে, এ-পক্ষের ছেলেমেয়ে ও স্বামীকে ছেড়ে, রাজধানীতে ফিরে এলেন রাজা। রাজ্যের সুবন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু মনে সুখ নেই তাঁর। নারদকে ডেকে রাজা বললেন,—আমাকে আবার রমণী করে দিন, রমণী অবস্থায় আমি যে সুখ ও আনন্দ পেয়েছি—তার তুলনায় পুরুষের জীবন তুচ্ছ! আমি আবার সেই ঋষির আশ্রমেই ফিরে যেতে চাই। সত্যি-সত্যিই, রাজ্য ছেড়ে আবার সেই ঋষির বউ হয়ে চলে গেলেন ভঙ্গস্বন। প্রমাণিত হল, নারীর জীবনই বেশি সুখের।

আমি প্রায়ই ভাবি—এখনকার দিনেও নারী-পুরুষের মধ্যে কে বেশি সুখী? এই নিয়ে যদি একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতা আরম্ভ করা যায়, তাহলে বুঝতে পারছি, মেয়েরা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে আসর সরগরম করে রাখবেন। প্রায়ই তো মেয়েদের মুখে অনুযোগ শুনি, আপনাদের ছেলেদের কী মজা! যখন যা খুশি করতে পারেন! জানি, সেই বিতর্কসভায় মেয়েরা প্রমাণ করে ছাড়বেন—তাঁদের জীবন নিতান্ত বিড়ম্বনাময়, পুরুষেরা তাঁদের স্বাধীনতা খর্ব করে রেখেছে ইত্যাদি। পুরুষদের জীবনের সুখের প্রমাণ হিসেবে—তাঁরা বলবেন, পুরুষরা যখন যেখানে খুশি যেতে পারে, পুরুষরা টাকা উপার্জন করে, তারা দেশ শাসন করে, ইত্যাদি—ইত্যাদি। এর সবকটার উত্তরই আমি দিতে পারি—মেয়েদের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পারবনা, আড়াল থেকে।

আমার ধারণা, সব সভ্যতাই মাতৃতান্ত্রিক। পুরুষরা ক্রীতদাসমাত্র। তারা নির্বোধের মতন খেটে-খেটে মরছে, কিন্তু কৃতিত্ব ও মজাটুকু সব নিয়ে নেয় মেয়েরা। পুরুষরা টাকা উপার্জন করে ঠিকই, কিন্তু সেই টাকা খরচ করে মেয়েরা, অবহেলায়, বিলাসিতায় যা খুশি। পুরুষরা অকারণে যুদ্ধবিগ্রহ করে মরে, দুরন্ত নদীর ওপর ব্রিজ বানানো থেকে শুরু করে প্রাণ তুচ্ছ করে সিংহের সঙ্গে লড়াই পর্যন্ত— পুরুষদের এ-সবকিছুই কোন-কোন মেয়েকে খুশি করার জন্য। মেয়েরা এতেও খুশি হয়না, অবশ্য ঠোঁট উল্টে বলে, এ আর এমন কী, এ তো অনেকেই পারে। তুমি নিজে আলাদা বেশি কী পারো—তাই দেখাও! এই আলাদা হবার নেশা ধরিয়ে দেওয়াও মেয়েদের অন্যতম কৌশল। বেচারা পুরুষরা নদীতে ব্রিজ বানাবার পরেও আবার সমুদ্রে বাঁধ দিতে যায়, সিংহ হত্যা করার পর মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে। ফরাসিরা বলে, ‘শ্যারশো লা ফাম্’, মেয়েটাকে খুঁজে আনো—সব দুর্ঘটনার আড়াল থেকে সেই মেয়েটাকে খুঁজে আনো। দিল্লিতে থাকবার সময় একজন হাইকোর্টের বিচারপতিকে দেখেছিলাম আদালতে কী দোর্দণ্ডপ্রতাপ তাঁর—কিন্তু বাড়িতে তিনি পাঞ্জাবি না ড্রেসিং গাউন পরবেন—স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া সেটুকু নির্বাচনের স্বাধীনতাও তাঁর নেই। মেয়েরা ইচ্ছেমতন যেখানে-সেখানে যেতে পারেনা বটে, কিন্তু ইচ্ছেমতন যখন-তখন যেখানে-সেখানে পুরুষদের পাঠাবার ক্ষমতা তাদের আছে। যাও, পার্ক সার্কাস থেকে নিয়ে এসো মাংস, বাগবাজার থেকে ইলিশ, বড়বাজার থেকে জর্দা—এসব হুকুম অবলীলাক্রমে বেরুবে তাদের মুখ থেকে। পুরুষদের চিন্তাভাবনা পরিকল্পনা এক নিমেষে বদলে দিতে পারে মেয়েরা। স্বামী ঠিক করেছেন ময়দানে মিটিং শুনতে যাবেন— স্ত্রী এসে বললেন, ওমা সেকি, আজ যে আমি সেজো মাসির বাড়িতে যাব—তাঁকে কথা দিয়ে ফেলেছি। এক বন্ধুর বাড়িতে ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়ে আমরা তর্কে মত্ত, দেশ ও পৃথিবীর দুঃসময় নিয়ে বন্ধুটি অত্যন্ত চিন্তিত—বন্ধুপত্নী খানিকটা শুনলেন, বিরক্তভাবে হাই তুললেন, তারপর বললেন, দ্যাখো তো, অমুক হলে কী সিনেমা হচ্ছে? তোমার বন্ধু তো ওখানকার ম্যানেজার, ফোন করে দ্যাখো -না -এখন টিকিট পাওয়া যাবে কিনা! নিমেষে পৃথিবীর দুঃসময়ের কথা ফুৎকারে উড়ে গেল, আমরা ডুবে গেলাম, হিন্দি সিনেমার জগতে।

অন্যকথা থাক্‌। আমি মেয়েদের কয়েকটি বিশেষ সুবিধের কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমেই বলা যায়, মেয়েদের দাড়ি কামাতে হয়না। এটা যে একটা কতবড়ো সুবিধে—মেয়েরা তা ৰুঝবেনা। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ, ছুটির দিন, কাজের দিন—এই যে প্রত্যেকদিন দাড়ি কামাবার অসহ্য একঘেয়েমি—এর হাত থেকে নিস্তার নেই পুরুষদের। আমি পারতপক্ষে আয়নার সামনে যেতে চাইনা—কিন্তু দাড়ি কামাবার সময় আয়নার সামনে মুখ আনতেই হয়—তখন নিজেকে ভেংচি কাটি রোজ। ঠিক সময় ব্লেড কিনতে ভুলে গেলে পুরোনো ব্লেডে গাল ঘষার সময় ইচ্ছে করে নিজের গলায় এক কোপ বসিয়ে দিই। দাড়ি রাখব, মাত্র দু-তিনদিন দাড়ি না কাটলেই মেয়েরা এমন বিশ্রীভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর মেয়েরাই যদি—দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয়—তাহলে আর সে মুখের মূল্য কী?

মেয়েদের আর-একটা সুবিধে তাদের শাড়ির কোন সাইজ নেই। যে-যার শাড়ি যখন-তখন পরতে পারে—নিত্যনতুন সাজপোশাকের অভাব হয়না তাদের। অথচ, বাড়ি থেকে বেরুবার আগে প্যান্ট-সার্ট নিয়ে আমার প্রতিদিন দুশ্চিন্তা। প্যান্ট কাচা আছে তো জামা ইস্তিরি নেই। প্রতিমাসে একবার নাপিতের কাঁচির নিচে মাথা পেতেও দিতে হয়না মেয়েদের—অথচ এই ব্যাপারটা আমার কাছে অসীম বিরক্তিকর।

আর থাক্! তবে অবশ্য আমাকে আরও যতবার জন্ম নেবার সুযোগ দেওয়া হবে—আমি পুরুষই হতে চাইব। কারণ, একটি জিনিশ মেয়েরা একেবারেই পারেনা—কিন্তু পুরুষদের সে-ক্ষমতা আছে। মেয়েরা মেয়েদের ভালোবাসতে পারেনা, আমরা পারি। মেয়েদের দোষ মেয়েদেরই শুধু চোখে পড়ে, আমরা ও-ব্যাপারে একেবারেই অন্ধ।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17
Pages ( 1 of 17 ): 1 23 ... 17পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress