হোলির হায় হায়
দোলের দিনে শুধু টেলিফোনের লাইনেই না, সব জায়গাতেই রং নম্বর। সব জামাই রংদার! আপামর সবার গা-ই সমান অলংকৃত।
এই জামাকাপড়ের অনটনের দিনে এমন গায়ে-পড়া জামাই-আদর অম্লানমুখে সওয়া একটু শক্তই বই কী! তাই ঠিক করলাম, সেদিন সকাল থেকেই গা-ঢাকা দেব। বাড়ির মধ্যে নিজের ঘুপটিতে লুকিয়ে থাকব বেমালুম।
একটু সকাল সকালই শুরু করা গেল। আগের দিনের সকাল থেকেই গায়ে ঢাকা দিয়ে পড়লাম আমার বিছানায়—
তার আগের রাত্তিরে গায়ে ঢাকা না দিয়েই শুয়েছিলাম। বাসাবাড়িতে থাকা, কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ একটা অসুখ বানালে অবিশ্বাসভাজন হতে হবে, তাই শোকসংবাদের মতো রোগসংবাদটাও, ভেবে দেখলাম, আস্তে আস্তে ভাঙাই ভালো। তাই আগের রাত্তিরে আর মশারি খাটালাম না, মশাদের খাটালাম। গা আর মুখ খোলা রেখে শুলাম, এবং মশারাও আমাকে খোলাখুলি পেয়ে খাবলাতে দ্বিধা করেনি। তাদের খাটনির কিছু কসুর ছিল না—প্রাণভরে তাদের শোধ তুলছে এতদিনের। রাতভর হুল-উঁ-ধ্বনির কী শোরগোল তাদের!
সারা রাত্তির জাগবার পর সকালে উঠেই প্রফুল্ল মুখে আয়না নিলাম। নিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, মুখ বেশ ফুল্ল-ফুল্লই। মশার কামড়ে গোটা গোটা হয়ে উঠেছে গোটা মুখটাই। ঠিক বসন্তের গুটির মতোই প্রস্ফুটিত। এ যাত্রা—এ দোলযাত্রায়—এ বছরের মতন বেঁচে গেলাম তা হলে। দোলযাত্রার মধ্যে বসন্তলীলার আমদানি করে—এক ভেজালের দ্বারা আরেক ভেজালের হাত থেকে বঁাচা গেল। ভেজালিয়াতিরই যুগ তো এটা? মশার টিকা নিয়ে মশায়দের আক্রমণ থেকে বঁাচলাম।
আর কে আমায় রং দেয় এখন? হুম বাবা, মা শীতলা ভারি কড়া দেবতা। বসন্ত দেখা দিলে রং দেওয়া নাস্তি। মায়ের দয়ার ওপর আর সদয় হওয়া চলে না। অকুতোভয়ে ঘরের দরজা খোলা রেখেই ঘুম দেবার চেষ্টায় আছি,—প্রাতর্নিদ্রাদানে নির্ঘুম রাত্রির ক্ষতিপূরণের মতলব,—এমন সময়ে আমাদের সর্বকনিষ্ঠ বাসাড়ে পিচকিরি হাতে এক বালতি রং নিয়ে হাজির!
‘কী খবর, কমলচন্দর?’ ক্ষীণকন্ঠে জিগেস করি।
‘রং দেব আপনাকে।’ সেজানাল—‘রং খেলতে হয় আজ। কিন্তু এই সকাল বেলায় এমন বিছানায় কেন? উঠুন উঠুন—উঠে পড়ুন চট করে! রং দেব যে!’
‘রং দেবে? তা দাও।’—আমি বললাম—‘তবে কাছে এসো না। কাছিয়ে এসো না যেন। কাছাকাছি না এসে দূর থেকে এক পিচকিরি মেরে চলে যাও। এসেচ যখন এত কষ্ট করে—’
‘বা:, বিছানায় রং লাগবে না? চাদরটাদর নষ্ট হবে যে!’
‘তা হোক গে। তা বলে তোমাকে নিরাশ করা যায় না তো। আর তাই বলে—রং দেবে বলেই তোমার আমি সর্বনাশ করতে পারিনে। তোমার বসন্ত হতে দিতে পারিনে। রোগটা ভারি ছোঁয়াচে কিনা—’
‘বসন্ত? বসন্ত হবে কেন?’
‘কেন হবে কী, হয়েচে! হয়ে রয়েচে অলরেডি! দেখচ না, কী বেরিয়েছে আমার মুখে? গুটি গুটি—এইসব?’
আমি ওকে ডেকে দেখাই একে একে—একাদিক্রমে।
ছেলেটিও এগিয়ে আসে গুটি গুটি—‘ওগুলি কি বসন্তের গুটি?’
সন্দিগ্ধ চোখে ও তাকায়।
‘তবে কীসের? তুমি কি বলচ এগুলি তবে রেশমের গুটি?’
‘রেশমের গুটি কি মুখে বেরোয়?’ সেবুঝি একটু অবাকই হয়।
‘তা কে জানে! তবে বসন্ত ছাড়া আর তো শুধু রেশমেরই গুটি হয়ে থাকে বলে শুনেছি। তুমিই জান।’
‘না, তাহলে আপনাকে আর রং দিয়ে কাজ নেই। বসন্ত হলে রং দিতে নেই—’
বালতি পিচকিরি নিয়ে সেচলে যায়।
তারপর ঠাকুরকে ডেকে দোতলা থেকে হেঁকে—সবাইকে শুনিয়ে—খাবার পালা বন্ধ করে দিলাম। বসন্ত হলে খেতে নেই নিশ্চয়? দেখে শুনে বাসাড়েদের বিশ্বাস হল, বাসার কেউ আর রং নিয়ে এগুল না এদিকে। দিনভর গুটিসার সরকারি খেজুর চিবিয়ে নিজের বিছানায় গুটিসুটি হয়ে রইলাম। সারা দিনে অনেক রঙিন মুহূর্ত এল, কিন্তু সঙিন হয়ে এল না। মারি গুটিকার দোহাই দিয়ে মহামারির হাত থেকে বঁাচলাম। নিজের মুখপত্রে যে মারাত্মক বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম, তাই দেখিয়েই ভাগালাম সবাইকে।
পাড়ার ছেলেরা এলে দেখালাম; বেপাড়ার বেপারিদের ঠেকালাম—ওই দেখিয়েই। এমনকী, সন্ধ্যের দিকে আমার শহরতলির বন্ধুরা এসে যখন চড়াও হল, তখনও রক্তশোষক মশকদের মুখ্যকীর্তি মিলায়নি। মুখ দেখিয়েই শখ মেটালাম—তাদেরও। সখারা রঙের চর্চা না করেই বিদায় নিল একে একে—আমার রঙ্গমঞ্চ থেকে। আমাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই।
সত্যি বলতে, এই হানাদারদেরই ভয় বেশি ছিল আমার। ওদের হানাহানিকেই বেশি ডরিয়েছি।—বেরকমের অসময়ে কখন ওরা আমার উপত্যকায় এসে হামলা করবে তাদের রঙের গামলা নিয়ে—কত রকম রং যে তাদের গামলায়! আমাকে নিতান্ত বিবর্ণ দেখে পিটিয়ে আপাদমস্তক লাল না করুক, অন্তত আমার মুখের রং না ফিরিয়ে কি ছাড়বে তারা?
আমার বিশ্রী ঘরকে রংবেরঙে রংমহল বানিয়ে তবে যাবে। কিন্তু সেই রংরুটদেরও চরম রুট নিতে হয়েছে—পলায়নের। হামলাদাররা হাজির হতে না হতেই তাদের রংবাজির মামলা ডিসমিস করে দিয়েছি—একতরফাই। আমার সীমন্তে এতটুকুও না ছুইয়ে নিজেদের সীমান্তে ফিরে গেছে তারা। ঢাকুরে, বেলেঘাটা, বেহালা, আলিপুর, হাওড়ায় হাওয়া হয়ে গেছে।
তার পরেও, আরও কত যে এল! এল আর গেল। অযাচিত অনাহূতের দল। উড়ন্ত পিরিচের মতোই তারা দেখা দিতে লাগল অকস্মাৎ—এই লালিমা পাল (পুং)-এর পাল। আমাকে লালিত্যদান করবেই—না দিয়ে ছাড়বে না—নাছোড়বান্দা। কিন্তু সেই পালোয়ানদের দুরন্ত লালসাও আমি দমালাম। ক্ষণে ক্ষণেই তাদের আবির্ভাব হল, পালে পালেই, প্রচুর আবির হাতে। কিন্তু বীরত্বভাব টিকল না বেশিক্ষণ। আমার গুটি-শিল্পের সম্মুখে এসে গুটিয়ে পড়তে হল সবাইকে। সব আবিরত্ব ব্যর্থ হল দেখতে না দেখতেই। আমাকে আবির-ভূত বানাতে এসে আমার গুটি কয়েকের সামনে হটে গেছে গোটা দল। আমার ওপর রং ছেড়ে—আমায় ছেড়ে গেছে তারা—আবির্ভূত হয়েই।
আহা, কী সুখের ব্যাধি এই বসন্ত! আত্মীয়কে পরাঙ্খুখ—পরকে পরাভূত—বীরকে বিদূরিত করতে এর জুড়ি নেই। গুটির সামনে লেজ গুটোবে সবাই—ঘেঁষে কে? কাঁচা গুটিও পাকা গুটির কাজ দেয়। পরিজনদের কাছে হরিজন হতে হলে বসন্তের মতন বন্ধু আর হয় না। এমন নিরাপদ নিরুপদ্রুত রোগ আর কী আছে? ও এলে অন্য কোনো rogue পারে না—ত্রিসীমায় তিষ্ঠোতে পারে না কেউ—নিজের নীড় নিরাপদ। ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’—দারোয়ানের মতো খাড়া পাহারায়। একচোট ভবের যাবতীয় আধিব্যাধির ভাবনা মুক্ত করতে অদ্বিতীয়—এমনটি আর হয় না।
কিন্তু বসন(ত) পীড়নের এই ভয় বেশিদিনের নয় তো। চিরদিন তো এমন ছিল না। হোলি হায়—হোলির হায় হায় ছিলই, কিন্তু হোলির জন্য এই হায় হায় ছিল না। কাপড় বঁাচানোর জন্যে আমোদে বঞ্চিত হতে হয়নি।
সেদিনও তো হোলির দিন গুনেছি। বছর কয়েক আগেও। মনে দোলা দিয়েছে আসন্ন দোলের দিন। ‘আমায় রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও, যাও গো এবার যাবার আগে……রঙ যেন মোর ঘর্মে লাগে, আমার গাত্রচর্মে লাগে……’ গুনগুন করেছি আপন মনে,—কিন্তু এখন হোলির কথা ভাবতেই ভয় খাই।
দুর্যোধনের রাজত্ব গেছে, কিন্তু তাহলে দুঃশাসনের আমলে আসিনি নিশ্চয়? এবং আমরাও কিছু দ্রৌপদী না। তবু কাপড়ের টানাটানি চলছেই। অন্নকষ্টের ওপর এই বস্ত্রহরণ। এ বাজারে একখানা কাপড় খোয়ানোর খোয়ার—না, ভাবতেই পারা যায় না। ভদ্রসমাজে যাতায়াতের দু-একটিই মোটে কাপড়, তার একটারও যদি এইভাবে রং-চটে যায়, তাহলে—তাহলে ভদ্রসমাজ দূরে থাক, আমার প্রকাশকদের কাছে আত্মপ্রকাশ করাও কঠিন হবে।…
যাক গুটিকাবদ্ধ হয়ে রং-ফাগের অঙ্গরাগের থেকে তো বঁাচলাম—বসন্তের দোহাই দিয়ে বসন তো বঁাচানো গেল, কিন্তু এদিকে যে বেশ সর্বনাশ হয়ে গেছে টের পেলাম সন্ধ্যেয়। বাসার সেই ছেলেটিই এসে জানাল। সকালে সর্বপ্রথম যার উজ্জ্বল মুখ দেখেছিলাম সে-ই।
‘আপনার কোনো প্রকাশকের আসবার কথা ছিল না আজকে?’—শুধাল সেএসে।
ভেবেছিলাম, দোলের ডামাডোল কাটল বুঝি, কিন্তু না, নতুন করে দামামাধ্বনি শুনতে হল আমায়।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। কেন বলো তো?’ ওর বোল শুনে বলি।
‘আপনাকে কি টাকা দেবার কথা ছিল না তাঁর? আপনার পাওনা টাকাই? বইয়ের দরুন পাওনা?’ সেজানায়—‘তা তিনি টাকা নিয়ে এসেছিলেন।’
‘টাকা? নিয়ে এসেছিলেন? কত টাকা?’
আমি লাফিয়ে উঠি—আমার পাকা গুটি কেঁচে যাবার আশঙ্কা ভুলেই।
‘শ-পাঁচেক না কত! তা, আমি তাঁকে আপনার অসুখের কথা জানালাম। বললাম যে, এখন ওঁর হাতে টাকাকড়ি নোটফোট না দেওয়াই ভালো।’
না দেওয়াই ভালো? তার মানে? একে তো প্রকাশকই আসে না, তারপরেও যদিও এল, যদিও তিনি বর হাতে এলেন,—এসে পড়লেন এক বর্বরের হাতে। পরের অর্থ পার হয়ে যখন নিজের পকেটে আসে, তখনই তা পরমার্থ,—কিন্তু আমার বরাতে থাকলে তো? করকরে নোটগুলো নিয়ে এসে কোথায় তিনি শূন্য করে ফিরবেন না, সেগুলো তাঁর নিজের ট্যাঁকেই রয়ে গেল, আঁকড়ে রইল তাঁকেই, পরলোকের পথে গতিমুক্তি পেল না। হায় হায়, আমি তাঁর করভার লাঘব করতে পারলাম না।
‘না দেওয়াই ভালো? কেন না দেওয়া ভালো, শুনতে পাই একবার?’—আমি বেশ গরম হই—‘বেড়ে রংদার ছেলে তো তুমি!’
‘ভেবে দেখলাম, টাকাকড়ি নোটফোট এগুলিও ছোঁয়াচে তো?—কলেরা বসন্তের চেয়ে কিছু কম সংক্রামক নয়। একজনের কাছ থেকে আরেক জনের কাছে এরা যায়—প্রায় বীজাণুদের মতোই। আপনি তো টাকাগুলি নিয়ে পুড়িয়ে ফেলবেন না! অপরকেই দেবেন আবার। বাসার পাওনা মেটাবেন, এর ওর তার দেনা শোধ করবেন, কাগজওয়ালাকে শুধবেন, কাবলিওয়ালাকে সুদ দেবেন, ওষুধের বিল চোকাবেন। চাইকী, চা-ওয়ালাকেও দিয়ে বসবেন না চাইতেই। (আমার কথা ওর মুখে শুনতে হয় অকাতরে। ছেলেটা খালি যে আমার মতোই কথা কয়, তাই নয়, আমার কথার ওপর কথা কয়। শুনতে হয়, কিন্তু শিশু এত রাগ হয় আমার।) আর কার কার কাছে কত কী ধারবাকি আছে আপনার,—আপনিই জানেন! তার ধার তো আমি ধারি না! তবে এটুকু জানি, সবার ধারই আপনি ভোঁতা করে দেবেন এই ধাক্কায়। এক চোটেই,—না দিয়ে ছাড়বেন না।’
‘দিলামই-বা, তোমার কী তাতে?’
আমি লাল হয়ে উঠি—রঙে হইনি, কিন্তু রাগে হতে হয়।
‘এতগুলো টাকা একসঙ্গে পেলে আপনি কী যে করবেন, আর কী না করবেন, তার কিছুই ঠিকানা নেই। এই তো, আমিই তো আপনার কাছে পঁচিশ-ত্রিশ টাকা পাই। পাই না? চাইকী, আপনি হয়তো আমাকেও দিয়ে বসতে পারেন। সাধতে পারেন টাকাটা নেবার জন্যে…’
দায় পড়েছে আমার! তক্ষুনি আমার মত পালটাই—মনে মনে। টাকাটা আমার হাতে আসুক-না একবার! তারপর আর তোমার ধার আমি শোধ করেছি। তোমার ধারেই আমি যাব না, এ জন্মে তো নয়। এর প্রতিশোধ আমি না নিয়েই ছাড়ব?
‘টাকাটা আপনি আমার হাতে তুলেই দেবেন তো! নিতেই হবে, লোভ সামলাতে পারব না—পরের টাকা না হলেও নিজের হলেও—নিয়ে বসব অম্লানবদনে, প্রলুব্ধ হলে মানুষ কী না করে? আর এই করেই আপনার থেকে আমার—আমার থেকে তার—চা-ওয়ালার মেঠাইওয়ালার —পাড়ার সবার সকলের মধ্যে ব্যারাম গড়াবে। টাকা আর বসন্ত একসঙ্গেই আপনি ছড়াবেন— একধার থেকে ছাড়বেন আপনিই! নোটের সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে বীজাণুরা ছড়িয়ে পড়বে চারধারে। দাবানলের মতোই! এখনও আমাদের পাড়াটা ঠাণ্ডা আছে—বাসারও কারও হয়নি কিছু এ পর্যন্ত—আপনারই হয়েছে খালি—কিন্তু আপনার ওই টাকার প্যাঁচে পড়ে সবাই আমরা মারা পড়ব একে একে। তাই আমি সেই প্রকাশক-ভদ্রলোককে বললাম, মশাই, আপনি দয়া করে দিন কতক এখন অপ্রকাশ থাকুন। এমন তাড়া কী টাকা দেবার? বাড়ি বয়ে কেউ কি নিজের টাকা দিতে আসে? এতগুলো টাকা? শুনেটুনে তিনি ঘাড় নাড়তে নাড়তে চলে গেলেন।’
‘চলে গেলেন?’ আমি হায় হায় করে উঠি—‘কখন এসেছিলেন তিনি? গেলেনই-বা কখন?’
‘এই তো, এই একটু আগেই তো। আমার সঙ্গে কথা কয়ে এইমাত্রই যাচ্ছেন—’
‘গেলেন কোন দিকে? অ্যাঁ?’
‘গোলদিঘির দিকেই যেন মনে হল, বইয়ের পটি ওই দিকেই না?’
শশব্যস্ত হয়ে উঠি। আলনা থেকে কাপড়জামা ধরে টানি। কিন্তু কোথায় পাই জামাকাপড়? ফর্সা অথচ ছেঁড়া জামা, ছেঁড়া অথচ ফর্সা কাপড়? দোলের দিনের উপযুক্ত ধোপদুরস্ত পোশাক? আগের থেকে মজুত করে রাখিনি, কিন্তু এখন এই তাড়াহুড়ার মাথায় বাছবিচারের সময় কই? যা পেলাম, টেনে নিয়ে পরলাম।
‘যাচ্ছেন কোথায় আপনি?’—কমল বাধা দেয়।—‘এই মারাত্মক অসুখ নিয়ে? বীজাণু ছড়াতে ছড়াতে?’ অদূরে থেকেই সেবাধা দান করে অবশ্যি। আমার স্পর্শ বঁাচিয়েই।
‘কোথায় যাচ্ছি জান না? যমের বাড়ি।’
‘আপনি যাচ্ছেন, আর এদিকে আপনার জন্যে ক্যাম্বেলে ফোন করে দেয়া হয়েছে—’
‘ক্যাম্বেল? কেন? কেন—কেন?’
‘কেন আবার! অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্যেই। আপনাকে এখানে দেখবে কে? বাসাবাড়িতে কি এসব শক্ত ব্যামোর কোনো ব্যবস্থা হয়? এখানে থাকলে বিনা চিকিৎসাতেই মারা যাবেন। আর আপনি একলাই যাবেন না, আমাদেরকেও নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে। তাই আপনারও ভালো আমাদেরও ভালো—আপনার ভালোতেই আমাদের ভালো—’
ভালোবাসার আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না। আমি শর্টকাট করি—
‘ফোন করে দিয়েছ ক্যাম্বেলে? বেশ করেচ। বেশ বেশ।’
বলে আমি আর দাঁড়াই না। বেশ তো করাই ছিল, বেশ বেশ করে বেরিয়ে পড়ি।
‘এখুনি এসে পড়বে অ্যাম্বুলেন্স, আর আপনি—???’
‘হ্যাঁ, আমি!’ বলে আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরোই। কম্বল ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকা এক, আর ক্যাম্বেলে গিয়ে ঢোকা আর!
সেখানে বসন্ত সমেত গিয়েই, শুনেচি, কম ফেরত আসে, আর আমি বসন্ত না নিয়ে গেলে কি রক্ষে থাকবে? আসল জায়গায় ভেজাল নিয়ে গিয়ে ফিরতে পারব কি? শশব্যস্ত হয়ে বেরোলাম।
ইস! কাল রাত্তিরে শশব্যস্ত হয়ে কী ভুলই-না করেছি! না, আর বাসায় ফেরা নয়। আজ তো নয়ই, মাস খানেকের এদিকে না।
রাস্তায় তখনও চলেছে দোলযাত্রা। হোলির হল্লা আর হুল্লোর! খোট্টাই মশকরা মেশানো খোট্টাই হায় হায়! নাছোরবান্দা রংবাজি! যে যাকে পাচ্ছে রাঙিয়ে দিচ্ছে। আর রংই-বা কত রকমের! সাত রকমের রং মাত্র জানা ছিল, কিন্তু সাতাত্তর রকমের রং দেখলাম—লোকের পিঠে মাথায় হাতায়। আর রং-ই কি খালি? কালিও আছে তার ওপর। পানের পিকও আছে কি না কে জানে!
পাড়ার গোরুরাও বাদ যায়নি। তারাও পিচকৃত হয়েছে। ফিরে আবার তাদের মৌলিক রং দান করেছে অকাতরে—সেই গোবর কাজে লাগিয়েছে অপরে। গোবর গোলার ছড়াছড়িও কম ছিল না। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা শুধু জল ছুড়ছে। তাদের হচ্ছে জলতরঙ্গ!
তরঙ্গের পর তরঙ্গ কাটিয়ে বেরঙাই কোনোরকমে গোলদিঘিতে গিয়ে পৌঁছোলাম। পাকড়ালাম প্রকাশককে—মোড়ের মাথাতেই।
‘এই যে আপনি! আপনার বাড়ির থেকেই ফিরছি।’ ভদ্রলোক মিষ্টি হাসলেন—‘একটি ছেলে বললে যে আপনার—’
‘ও কিছু না। ওর কথা যেতে দিন। তা, আমার টাকাটা—’
‘টাকার জন্যে ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? টাকা আপনার ব্যাঙ্কে আছে। সেরেসুরে ভালো হয়ে উঠুন আগে, তার পরে—’
‘ভালো হয়ে উঠতে পারি—এখনি।’ আমি বলি—‘টাকাটা হাতে এলেই! তা হলেই সবচেয়ে ভালো হয়!’
‘না। অমন করবেন না। মা-র যখন দয়া হয়েছে তখন দেখাই যাক-না কী হয়, মানে—’ বলতে গিয়ে কথাটা তিনি মনেই রাখেন। কিন্তু মানে বুঝতে আমার দেরি হয় না। আমার ওপর মা-র দয়া প্রত্যক্ষ হলেও সেতো প্রকারান্তরে ওঁদের প্রতিও—পরোক্ষভাবেই যদিও। আমি যদি মা-র কৃপায় মারা যাই, তবে ওঁদেরও একটা ফাঁড়া যায়। এই মারিতে যদি ভেসে যাই তাহলে সেই সুযোগে তাঁদেরও কিছু এসে যায় তো?
‘দেখুন, আমি বলি কী—ভঁক ভঁক ভঁক…।’
ভঁক ভঁক আমি বলি না। আমার পেছনে একটা মোটর এসে ওই কথা বলে। আমার কথার ওপরে কথা বলে। কিন্তু সেকথায় কান না দিয়ে আমি নিজে বকবক করি—‘দেখুন, আমার কথাটা হচ্ছে এই—’
ভঁক ভঁক ভঁক!! আবার সেই এককথা—সেই বাধাদান—আমার বক্তব্যের মাঝখানেই।
বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকাই! আরে, একটা অ্যাম্বুলেন্স যে! কিন্তু আমি তো ওর পথ আটকাইনি। আমার পেছনে কেন ও?
‘বললাম না বেশি দূরে যাননি। গোলদিঘির কাছাকাছিই পাওয়া যাবে তাঁকে—’
চেনা চেনা গলা যেন কার? আরে, আমাদের বাসার সেই ছেলেটাই যে? হ্যাঁ, সেই শ্রীকমলই তো! তারই সুকোমল কন্ঠ কানে লাগে। ড্রাইভারের পাশে বসে হাসছে। আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমায়।
দেখেই-না আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠি।
কিন্তু পালাতে পারলে তো? অ্যাম্বুলেন্সের লোকরা এসে ক্যাঁক করে পাকড়ায় আমায়। ধরে তুলে ভরতি করে তাদের গাড়ির ভেতর।
আমি ক্যাম্বেল এড়াতে চাইলে কী হবে? আমি তো ক্যাম্বেল ছাড়তে চাই, কিন্তু ক্যাম্বেল আমাকে ছাড়ে না।