Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হৈমন্তী || Sabitri Das

হৈমন্তী || Sabitri Das

আঠাশ বছর পর পুরুলিয়ার মাটিতে পা রাখলো হৈমন্তী। ঠিক আঠাশ বছর আগে মায়ের মৃত্যুর সময় হৈমন্তী এখানে এসেছিল , শেষ বারের মতো । তারপর কিসের টানেই বা আসবে! বাবাকে ভাই তার নিজের কাছে নিয়ে চলে গেছে সেই কবে‌। এই বাড়ি ছেড়ে বাবার যাবার ইচ্ছে ছিল না একেবারেই, তবুও যেতে হলো, ভাই কিছুতেই বাবাকে এখানে একা রেখে যেতে চাইলো না,বলতে গেলে একরকম জোর করেই নিয়ে গেছিল সেদিন। তা একরকম ভালোই করেছিল।
এই আঠাশ বছরের মধ্যে হৈমন্তী দেশে এসেছে বৈকি,নাই নাই করেও অন্ততঃ কুড়ি একুশ বার তো হবেই।

আশ্চর্যের বিষয় হলো আঠাশ বছরের মধ্যে হৈমন্তী কী পুরুলিয়ার মাটির টান অনুভব করতে পারে নি,নাকি চায়নি?
না না তা নয় , আসলে অবচেতনে একটা প্রস্তুতি চলছিল বৈকি!
আঠাশটা বছর কেমন করে পেরিয়ে গেছে বুঝতে ও পারেনি, দেশের বাইরে যন্ত্র আর যন্ত্রণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে সময়। দেশে এলেও কয়েকটা দিন বেহালার বাড়ীতে আর দিনকয়েক ননদের বাড়ি নিউটাউনে এই তো যাওয়া আসা। বাকী দিনগুলো খাওয়া দাওয়া আর গল্প গুজবেই কোথা দিয়ে কেটে যেত বোঝাই যেত না।
দেশে হোক বা অস্ট্রেলিয়ায় এই যে প্রতিটি মূহুর্ত কাজের ব্যস্ততা, সন্তান বড়ো করে তোলার মাঝেই বুকের ভেতর একটা নিঃশব্দ সঞ্চরণ, অবচেতনের অন্তঃস্থলে কোথাও একটা প্রস্তুতি তো অবশ্যই চলছিল,না হলে হঠাৎ করে এভাবে এসে দাঁড়াতে পারে জনমানবহীন পরিত্যক্ত আখড়ার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে! দাঁড়িয়ে আছে হৈমন্তী বজ্রপাতে জ্বলে যাওয়া শিমুল গাছটার মতো স্তব্ধ, নির্বাক ! আখড়াটার চারপাশের পলাশ গাছগুলোর দুর্দশাও বড়ো কম নয়।
মন থেকে হোক না হোক তবুও যে দায়বদ্ধতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল, আর সেগুলো যথাযথ পালনের পর সেই দায়বদ্ধতার গ্রন্থি থেকে একটু একটু করে মুক্ত হচ্ছিল। আজ তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নির্ভার মন নিয়ে আজ এসেছে সেই কবেকার এক কিশোরীর নিষ্পাপ মনের আশ্রয় টুকুর খোঁজে।

কিশোরী মেয়েটি বেণী দুলিয়ে স্কুল আসা যাওয়ার পথে রোজ মহীনকে গান গাইতে দেখত। “অচিন পুরের পথিক আমি কোনো খানেই সাকিন নাই, কোথাও আমার মনের মানুষ পেলাম না!” গাইতে গাইতে শাল পলাশের জঙ্গলের পাশ দিয়ে লাল মাটির রাস্তা ধরে চলে যেত,মনটা বড়ো উদাস হয়ে পড়ত সেই গান শুনে।
গানের গলাটি যে ভারি মিষ্টি মহীনের‌। গান শুনতে শুনতে বুকের ভেতর মহীনের প্রতি একধরনের ভালোলাগার বোধ কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে ততদিনে।
একমনে গান শুনছিল হৈমন্তী-
“পীরিত পীরিত করে লোকে পীরিতি সামান্য নয়
কলঙ্ক অলঙ্কার করে দুঃখের বোঝা বইতে হয়….”

-এমন কথা কেন? পীরিত সামান্য নয় সেটা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু পীরিতে কলঙ্কই বা হবে কেন আর দুঃখের কথাই বা আসে কেমন করে! পীরিত তো সুখের জন্য।
-তাই বটে, অনন্ত সুখে পাগল হয়ে ওঠাই তো পীরিতের আসল লক্ষ্য ।
— কিন্তু সে যে বড়ো কঠিন কাজ! বড়োই কঠিন।
–কেন কঠিন কেন?
-সেটা এখন বোঝার সাধ্যি নাই তোর।
-বুঝিয়ে না দিলে বুঝবো কেমন করে!
ঠিক আছে, সে নাহয় বুঝিয়ে দেবো।তবে তোর কাছ থেকে বেশি ক্ষণ দূরে থাকা যায় না। খুব সহজেই এভাবে বড়ো আপন করে নিস।
–কিন্তু আমার যে বড়ো ভয় হয় গো!
–আমি তোকে আত্মায় গ্রহণ করেছি তাই ভালো লাগার যেন স্রোত বইছে।
মিথ্যে স্বপ্নের মতো সম্পর্কটা ভেঙে ফেলিস না যেন।
-আমারো খুব ভালো লাগছে,খুউব।
-তুইএকটা পাগলি!
-দেখোনা কেমন চোখে জল আসছে।
-এরকম স্বর্গীয় সুখ দু সেকেন্ড পেলেও জীবন ধন্য!
–যাক মনের কথা ভাবে এমন একজন কাউকে তো খুঁজে পেলাম তবে।
তোর সঙ্গে কথা বলতে কী যে ভালো লাগছে!
— ভালো লাগলেই ভালো।
–এইভাবে কথা বলতে বলতে যদি প্রেমে পড়ে যাই,কী হবে বলতো?
–প্রেমে পড়া বললেই হলো,তাই কখনো হয়?
–কে জানে!
–আমাদের যে পায়ে পায়ে বাঁক….
“পীরিত পীরিত করে লোকে পীরিতি সামান্য নয়
কলঙ্ক অলঙ্কার করে দুঃখের বোঝা বইতে হয়….”
দুঃখ করিস না, দুঃখ কে জয় করার চেষ্টা কর। এখন এসব কথা তোকে জ্ঞান দেবার মতো শোনাবে।
–তোমাকে বলেছি না আমাকে যা খুশি বলো তবুও তুমি আমার।
তোমার কোথাও কী এই সত্যটুকুও নেই!
–পাগলী!
আমায় ছেড়ে চলে গেলেও তুই আমার ,এই জীবন বোধে পৌছাবি কবে?
–আমি তোর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম,তোর ঠোঁটে চুম্বন করলাম,দুটোই সমান আমার কাছে। তোর প্রতিক্রিয়া কী!
—আমি তোমাকে স্পর্শ করে আছি আর আমার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। একেই কী ভালোবাসা বলে!
অব্যক্ত ধ্বনির গুঞ্জরণে হৈমন্তী উপলব্ধি করেছিল কবিগুরুর সেই কথাগুলি—
“বাণী নাহি তবু কানে কানে/কি যে শুনি!কি যে শুনি তাহা কে বা জানে!”
সত্যিই তো সেদিন তার কানে, তার প্রাণে মধুর গুঞ্জরণ! আনন্দের অপূর্ব হিল্লোল! প্রাণে এসেছিল জোয়ার। সুখ দুঃখের মিলিত সুবাসে সেই জোয়ারে ভেসে যাবার সুখ তো কেবল স্বপ্নেই। জাগরণে বুঝেছিল—-
“যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,”
বললে মহীন, ‘ভুল হবে কেন, ঠিকই তো!” বলেছিল হৈমন্তী—-‘চলো না গো, এই এতবড়ো পৃথিবীতে কোথাও যাই হারিয়ে!’
রাজী হতে পারেনি মহীন। বলেছিল ‘- এ তোমার ভুল হৈমন্তী।’
মেনে নিতে চাইছিল না মন, কিন্তু মনের ভেতর যে মন আছে সে বলেছিল —–
‘এর চেয়ে বড়ো সত্যি যে আর কিছুই হতে পারে না!’
বড়ো আপন করে পেতে চেয়েছিল মায়ের মতো, প্রিয় সখীর মতো,বোনের মতো, বন্ধুর মতো।
চলেছিল টানাপোড়েন।
বলেছিল মহীন——‘যাযাবর মানুষ আমি! কবে কখন কোথায় হারিয়ে যাব!’
হৈমন্তীর বুকের ভেতর পড়েছিলো একটা মোচড়! শৈত্যতাপের পুঞ্জীভূত স্তূপ গলতে শুরু করেছিল হৈমন্তীর।
দুটি মনের ভাবনা যে খাতেই বয়ে যাকনা কেন, পরিবারের ভাবনা যে অন্যরকম, তাই হৈমন্তীর বিয়ে হয়ে যায় সুবিমলের সঙ্গে। সুবিমলরা অনাবাসী ভারতীয়। হৈমন্তীকেও একদিন তার সাথে সব ফেলে চলে যেতে হয়েছিল।

আজ যার জন্য হৈমন্তী সেই অস্ট্রেলিয়া থেকে পুরুলিয়ার লালমাটির দেশে এসে পড়েছে,সে কোথায়? দীর্ঘদিন এটা আখড়ায় যে কেউ বসবাস করেনি তা আখড়াটার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়।
ছোটো জায়গা তায় হৈমন্তী এখানেরই মেয়ে। খোঁজ পেতেও দেরী হলোনা।
পুরানো আখড়া ছেড়ে গাঁয়ের রায়বাহাদুর রাধিকা-রঞ্জন রায়চৌধুরীর বানিয়ে দেওয়া একটি একতলা বাড়িতেই থাকছে আজকাল। বাড়ীর নাম ‘মালঞ্চ’। রায়বাহাদুর রাধিকা রঞ্জন রায় চৌধুরীর আবার ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণবের উপর অসাধারণ ভক্তি, তাদের সেবা যত্নের ব্যবস্থার দায়টিও তিনিই নিয়েছেন।
এতদিন পর হৈমন্তীকে কাছে পেয়ে আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে মহীন। এতদিনে ষোলোকলা পূর্ণ হলো যে! বলে
–জানিস তরঙ্গ আকারে পৌঁছে যাচ্ছি একে অপরের মনের অন্দরে। আমার মনকে ছুঁয়ে আছিস, তুই অনন্য।
অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখ কত মানুষ মানুষ লাগছে নিজেদের।
–আমার মধ্যেও একটি স্পন্দন অনুভব করছি
–এখন তোতে আর আমাতে তফাৎ বলে কিছু নেই।
তুই যে এক অন্য জগতের সন্ধান দিচ্ছিস।
এই সুমধুর বাতাবরণ তৈরি করার জন্যই তো ঈশ্বরের নর আর নারী তৈরির আয়োজন। প্রকৃতির এত উপকরণের আয়োজন, পুরুষ তার প্রিয় নারীটিকে চাইবে এটাই স্বাভাবিক, এজন্যই তো প্রকৃতির যত কারসাজি!
এ চাওয়া চাইতে যে পারলো না , সে যে কত বড়ো দুর্ভাগা!
–মজার কথা কী জান সেখানে, দিনরাত্তির বর্ম এঁটে থাকি, কাছে ঘেঁষতে কেউ সাহস করে না।অথচ দেখ তোমার সাথে কত সাবলীল হয়ে উঠলাম।সত্যিই তাই, কিভাবে যেন সব হয়ে গেল।
–এই স্বচ্ছতায় না ডুবলে কথা বলায় যে এত অপরূপ স্বাদ থাকে তা জানা হতো না।
দুজনের মনেই ভালোলাগার একটা তরঙ্গ পরস্পরকে জুড়ে দিতে চাইছিল বার বার।অপরূপ সেই বন্ধনে, সমস্ত অপূর্ণতা, অতৃপ্ত আত্মার আর্তনাদ শুনতে শুনতে হৈমন্তীর ক্লান্ত আমিটা ভেসে যাচ্ছিল আশ্চর্য এক সুখের সাগরে।
হৈমন্তীর হাতটা ধরে মহীন বলতে থাকে
আসলে আমরা দুটিতে সমমনস্ক যে তাই ডুব দিয়েছিলাম জীবন নামক সমুদ্রের একেবারে গভীরে।
আমাদের জীবন দর্শনের মিল আমাদের মিলিয়ে দিয়েছিল।
কই তোরও কিছু হারায় নি, আমারও কিছু হারায় নি।
প্রাপ্তি যেন উপচে পড়ছে। আসলে আমরা দুটিতেই সুন্দর, দুজনেই মনের অমৃত দেবার অপেক্ষাতেই ছিলাম, শুধু পাত্র জোটেনি। ধরে নে কোনো সুপ্ত আধ্যাত্মিক চেতনার পরশে দুজনেই দুজনকে আবিষ্কার করেছি।
-এত সুন্দর কথা বলো কী করে!
-আসলে প্রকারান্তরে দুইই শিখিয়ে দিচ্ছিস, শুধু নিজে বুঝতে পারছিস না।
-মনে হচ্ছে তোমার কাছে চুপটি করে বসে কথাগুলি স্পর্শ করে করে দেখি শব্দও যে কত পেলব আর মধুর হতে পারে তোমার কথা না শুনলে বুঝতে পারতাম না।
— তোকে যেতে দিতে মন চায় না যে! কম বয়সে খুব সহজেই ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা যায় কিন্তু এই বয়সটা যে বড্ড বেয়াড়া হিমু, ভালোলাগার মানুষকে একান্তে কাছে পাওয়ার বড়ো লোভ হয়। মনটা যে আশ্রয় খুঁজে বেড়ায় ! হৈমন্তীর মনটাও কি আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে না ! একটুখানি ভালবাসার আশ্রয়!

হৈমন্তীর ছেলেরা আপন আপন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। দুজনেই পরিবার নিয়ে দুটো আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে থাকে।
আর সুবিমল! সে তো কাছে থেকেও বড়ো দূরে চলে গেছে, এক ইটালিয়ান মহিলার সঙ্গে তার ফ্ল্যাটেই লিভ ইন রিলেশনশিপে চারবছর ধরে রয়েছে। মনের টান আলগা হচ্ছে ক্রমশঃ। হৈমন্তী ভাবতে থাকে এখানে থেকে গেলেই বা কার কি! সে কি অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবে , নাকি হারিয়ে যেতে থাকবে, প্রহেলিকা ময় এক আলোর জগতে,সে জগতের নাম ভালোবাসা!
এই দোলাচল নিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে হৈমন্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *