Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রসরাজ ও যেমনকৰ্ম্ম তেমনি ফল

রমাপ্রসাদ রায়ের মার সপিণ্ডনে সভাস্থ হওয়ায় কোন কোনখানে তুমূল কাণ্ড বেধে উঠলো–বাবা ছেলের সঙ্গে পৃথক হলেন। মামী ভাগ্নেকে ছাঁট্‌লেন–-ভাগ্নে মামীর চিরঅন্ন-পালিত হয়েও চিরজন্মের কৃতজ্ঞতায় ছাই দিয়ে, বিলক্ষণ বিপক্ষ হয়ে পড়লেন! আমরা যখন স্কুলে পড়তুম, তখন সহরের এক বড়মানুষ সোণার বেণেদের বাড়ীর শম্ভুবাবু বলে একজন আমাদের ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন; একদিন তিনি কথায় কথায় বলেন যে “কাল রাত্রে আমি ভাই অমাড় স্ত্রীকে বড় ঠাট্টা কড়েচি, সে আমায় বলে তুমি হনুমান্”; আমি অমনি ভস কড়ে বললুম তোর শ্বশুড় হনুমান!” ভাগ্নেবাবুও সেই রকম ঠাট্টা আরম্ভ কল্লেন। ‘রসরাজ’ কাগজ পুনরায় বেরুলো, খেউড় ও পচালের স্রোত বইতে লাগলো। এরি দেখাদেখি একজ সংস্কৃত কলেজের কৃতবিদ্য ছোকরা ব্রাহ্মধর্ম্ম ও কলেজ-এডুকেশন মাথায় তুলে যেমন কম্ম তেমনি ফুল নামে ‘রসরাজে’র জুড়ি এক পচালপোরা কাগজ বার কল্লেন—’রসরাজ’ ও ‘তেমনি ফলে’ লড়াই বেধে গেল। দুই দলে কৃত্বাস্ত্র ও সেনাসংগ্রহ করে, সমরসাগরে অবতীর্ণ হলেন —স্কুলবয়েরা ভূরি ভূরি নির্ব্বুদ্ধি দলবল সংগ্রহ কয়ে, কুরুপাণ্ডব যুদ্ধ ঘটনার ন্যায় ভিন্ন ভিন্ন দলে মিলিত হলেন। দুর্ঘদ্ধিপরায়ণ ক্যারাণী, কুটেরা ওবাজে লোকেরা সেই কষ্য রস পান করবার জন্য কাক, কবন্ধ ও শৃগাল শকুনির মত, রণস্থল জুড়ে রইলো! ‘রসরাজ’ ও ‘তেমনি ফলের’ ভয়ানক সংগ্রাম চলতে লাগলো—“পীর গোরাচাঁদের ম্যালা ‘পরীর জন্মবিবরণ’ ‘ঘোড়া ভূত’ ও ‘ব্রহ্ম-দৈত্যের কথোপকথন’ প্রভৃতি প্রস্তাবপরিপূর্ণ ‘রসরাজ’ প্রতিদিন পাঁচশ, হাজার, দু হাজার কপি নগদ বিক্রী হতে লাগলো। কিন্তু ‘ব্রাহ্মধৰ্ম্ম’ মাসে একখানাও ধারে বিক্রী হয় কি না সন্দেহ। ‘তিলোত্তমা’ ও ‘সীতার বনবাসের’ খদ্দের নাই। কিছুদিন এই প্রকার লড়াই চলচে, এমন সময়ে গবর্ণমেণ্ট বাদী হয়ে কদর্য্য প্রস্তাব লিখন অপরাধে ‘রসরাজ’ সম্পাদকের নামে পুলিসে নালিশ কল্লেন, ‘যেমন কর্ম্ম’ ও পাছে তেমনি ফল পান, এই ভয়ে গা ঢাকা দিলেন; ‘রসরাজের’ দোয়ার ও খুলীরে মূল গায়েনকে মজলিসে বেধে, ‘চাচা আপন বাঁচা’ কথাটি স্মরণ করে, মেদ্দোষ ও মন্দিরে ফেলে চম্পট দিলো। ভাগ্নেবাবু (ওরফে মিত্তির খুড়ো) সফিনের ভয়ে, অন্দরমহলের পাইখানা আশ্রয় কল্লেন—গিরিবর ক্ষেত্রমোহন বিদ্যারত্ন চামর ও নূপুর নিয়ে সৎসাহিত্য-গ্রন্থাবলী তিন মাসের জন্য হরিণবাড়ী ঢুকলেন। ‘পীর গোরাচাঁদের’ বাকি গীত সেইখানে গাওয়া হলো। পাতরভাঙ্গা হাতুড়ির শব্দ, বেতের পটাং পটাং ও বেড়ীর ঝুমঝুমানি মন্দিরে ও মৃদঙ্গের কাজ কল্লে–কয়েদীরা বাজে লোক সেজে ‘পীরের গীত’ শুয়ন মোহিত হয়ে বাহবা ও পালা দিলে; “খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারে ব্যালা গোবর্দ্ধন”। যে ভাষা কথা আছে, ভাগ্নেবাবু (ওরফে মিড়ির খুড়ো) ও রসরাজ-সম্পাদকের সেইটির সার্থকতা হলো; আমরাও ক্রমে বুড়ো হয়ে পড়লেম, চসমা ভিন্ন দেখতে পাইনে।

বুজরুকী

পাঠক! আমাদের হরিভদ্দর খুড়ো কায়স্ত মুখখী কুলীন, দেড় শ’ ছিলিম গাঁজা প্রত্যহ জলযোগ হয়ে থাকে; থাকবার নির্দ্দিষ্ট ঘরবাড়ী নাই, সহরে খান্‌কীমহলে অনেকের সঙ্গে আলাপ থাকায় শোবার ও খাবার ভাবনা নাই, বরং আদর করে কেউ “বেয়াই” কেউ জামাই” বলে ডাকতো। আমাদের খুড়া ফলার মাত্রেই পার ধূলো দেন ও লুচিটে সন্দেশটা বেঁধে আনতেও কসুর করেন না। এমন কি, তাগে পেলে চলনসই জুতা জোড়াটাও ছেড়ে আসেন না। বলতে কি, আমাদের হরিভদ্দর খুড়ো এক রকম সবলোট গোছের ভদ্দর লোক। খুড়ো উপস্থিত হয়েই এ কথা সে কথার পর বল্লেন যে, “আর শুনেছ, আমাদের সিমলে পাড়ায় এক মহাপুরুষ সন্ন্যাসী এসেছেন তিনি সিদ্ধ, তিনি সোনা তৈরী কত্তে পারেন—লোকের মনের কথা গুণে বলেন, পারাভস্ম খাইয়ে সেদিন গঙ্গাতীরে একটা পচা মড়াকে বাঁচিয়েছেন, ভারি বুজরুক!” কিন্তু আমরা ক’বার ক’টি সন্ন্যাসীর বুজরুকী ধরেচি, গুটিকত ভূতনাচার ভূত উড়িয়ে দিয়েছি, আর আমাদের হাতে একটি জোচ্চোরের জোচ্চুরী বেরিয়ে পড়ে।

যখন হিন্দুধর্ম্ম প্রবল ছিল, লোকে দ্রব্যগুণ কিম্বা ভূতত্ব জানতো না, তখনই এই সকলের মান্য ছিল! আজকাল ইংরেজি লেখা-পড়ার কল্যাণে সে গুড়ে বালি পড়েছে। কিন্তু কলকেতা সহরে না দেখা যায়, এমন জিনিষই নাই; সুতরাং কখন কখন “সোণা-করা” “ছলে-করা” “নিরাহার” “ভূতনাবানো” “চণ্ডসিদ্ধ” প্রভৃতির পেটের দায়ে এসে পড়েন, অনেক জায়গায় বুজরুক দ্যাখান, শেষ কোথাও না কোথাও ধরা পড়ে বিলক্ষণ শিক্ষা পেয়ে যান।

হোসেন খাঁ

বছর চার পাঁচ হলো, এই সহরে হোসেন খাঁ নামে এক মোছলমান বহু কালের পর ঐ রঙ্গে ভয়ানক আড়ম্বরে দেখা দেন—তিনি হজরত জিনিয়াই সিদ্ধ; (পাঠক আরব্য উপন্যাসের আলাদিন ও আশ্চৰ্য্য প্রদীপের কথা স্মরণ করুন)—“মনে করেন, সেই জিনিষই জিনি দ্বারা আনতে পারেন, বাক্সের ভিতর থেকে ঘড়ি, আংটী, টাকা উড়িয়ে দেন, নদীজলে চাবির থলে ফেলে দিলে জিনির দ্বারা তুলে আনান” এই প্রকার অদ্ভুত কৰ্ম্ম কত্তে পারেন।

ক্রমে সহরে সকলেই হোসেন খাঁর কথার আন্দোলন কত্তে লাগলেন—ইংরেজী কেতার বড়দলে হোসেন খার খবর হলো। হোসেন খাঁ আজ রাজা বাহাদুরের বাগানে বাক্সর ভিতর থেকে টাকা উড়িয়ে দিলেন, উইলসনের হোটেল থেকে খাবার উড়িয়ে আনলেন, বোতল বোতল শ্যামপিন, দোনা দোনা গোলাবি ধিলি ও দলিম কিসমিস্ প্রভৃতি হরেক রকম খাবার জিনিষ উপস্থিত কল্লেন। কাল–রায়বাহাদুরের বাড়ীতে কমলালেবু, বেলফুলের মালা বরফ ও আচার আনলেন। যাঁরা পরমেশ্বর মনিতেন না, তাঁরাও হোসেন খাঁকে মানতে লাগলেন! ভাষায় বলে, “পাথরে পূজিলে পাঁচে পীর হয়ে পড়ে;” ক্রমে হোসেন খাঁ বড় বড় কাশ্মীরী উললুক ঠকাতে লাগলেন। অনেক জায়গায় খোরাকি বরাদ্দ হলো। বুজরুকী দেখবার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে লোক আসতে লাগলো। হোসেন খাঁ “প্রিমিয়ম্‌” বেড়ে গেল। জুচ্চুরি চিরকাল চলে না। “দশ দিন চোরের, এক দিন সেধের”; ক্রমে দুই এক জায়গায় হোসেন খাঁ ধরা পড়তে লাগলেন—কোথাও ঠোনাকা ঠানাকা, কোথাও কানমলা; শেষ প্রহার বাকী রইলো না। যাঁরা তাঁরে পূর্ব্বে দেবতা-নির্ব্বিশেষে আদর করেছিলেন, তাঁরাও দু এক ঘা দিতে বাকী রাখলেন না। কিছুদিনের মধ্যেই জিনি-সিদ্ধ হোসেন খাঁ পৌত্তলিকের শ্রাদ্ধের দাগ ষাঁড়ের অবস্থায় পড়লেন; যাঁরা আদর করে নিয়ে যান, তারাই দাগী করে বাহির করে দেন, শেষে সরকারী অতিথিশালা আশ্রয় কোল্লেন–হোসেন খাঁ জেলে গেলেন! যিনি পাতাল আশ্রয় কল্লেন!

ভূত-নাবানো

আর একবার যে আমরা ভূতনাবানো দেখেছিলেম, সেও বড় চমৎকার। আমাদের পাড়ার একজনের বড় ভয়ানক রোগ হয়। স্যাকরারা বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন, সুতরাং রোগের চিকিৎসা কত্তে ত্রুটি কল্লে না, ইংরেজ-ডাক্তার বদ্দি ও হাকিমের ম্যালা করে ফেল্লে; প্রায় তিন বৎসর ধরে চিকিৎস হলো, কিন্তু রোগের কেউ কিছু কত্তে পাল্লে না। রোগ ক্রমশঃ বৃদ্ধি হচ্ছে দেখে বাড়ীর মেয়েমহল তুলসী দেওয়া-কালীঘাটে সস্তেন—কালভৈরবে স্তবপাঠ-তুক্‌তাক—সাফরিদ-নারাণ–বালওড়-বালসী— শোপুর–নুরপুর ও হালুমপুর প্রভৃতি বিখ্যাত জায়গার চন্নামেন্তো ও মাদুলি ধারণ হলো, তারকেশ্বরে হত্যে দিতে লোক গেল-বাড়ীর বড় গিন্নী কালীঘাটে বুক চিরে রক্ত দিতে ও মাথায় ও হাতে ধূনো পোড়াতে গেলেন—শেষে একজন ভূতচালা আনা হয়।

ভূতচালার ভূতের ডাক্‌তারি পর্য্যন্ত করা আছে। আজকাল দু-এক বাঙ্গালী ডাকতার মধ্যে মধ্যে পেসেণ্টের বাড়ী ভূত সেজে দেখা দেন—চাদরের বদলে দড়ি ও পেরেক সহিত মশারি গায়ে, কখন বা উলঙ্গ হয়েও আসেন, কেবল মন্ত্রের বদলে চার পাঁচ জন রোজায় ধরাধরি করে আনতে হয়। এঁরা কলকেতা মেডিকেল কলেজের এজুকেটেড ভূত। ভূতচালা চণ্ডীমণ্ডপে বাসা পেলেন, ভূত আসবার প্রোগ্রাম স্থির হলো—আজ সন্ধ্যার পরেই ভূত নামবেন, পাড়ায় দু-চার বাড়ীতে খবর দেওয়া হলো—ভূত মনের কথা ও রুগীর ঔষধ বলে দেবে। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে গেল, কুঠীওয়ালারা ঘরে ফিল্লেন-বারফট্‌কারা বেরুলেন, বিগ্রহের উত্তরাঢ়ি কায়েতের মত (দর্শন মাত্র) সেতল খেলেন, গীর্জ্জের ঘড়ীতে ঢং ঢং ঢং করে নটা বেজে গেল, গুম করে তোপ পড়লো। ছেলেরা “বোমকালী কলকেতাওয়ালী” বলে হাততালি দে উঠলো,–ভূতনাবানো আসরে নাবলেন!

আমাদের প্রতিবাসী, ভূতনাবানোর কথাপ্রমাণ ও বাড়ীর গিন্নিদের মুখে শুনে ভূতের আহার জন্য আয়োজন কত্তে ত্রুটী করে নাই; বড়বাজারের সমস্ত উত্তমোত্তম মেঠাই; ক্ষীরের নানারকম পেয় ও লেহ্যরা পদার্পণ কল্লেন। বোধ হয়, আমাদের মত প্রকৃত ফলারের দশ জনে তাদের শেষ কত্তে পারে না; রোজা ও তাঁর দুই চেলায় কি করবেন! রোজা ঘরে ঢুকে একটি পিঁড়েয় বসে ঘরের ভিতরে সকলের পরিচয় নিতে লাগলেন—অনেকের আপদমস্তক ঠাউরে দেখে নিলেন—দুই এক জন কলেজ বয় ও মোটা মোটা লাঠিওয়ালারা নিমন্ত্রিতদের প্রতি তাঁর যে বড় ঘৃণা জন্মেছিল, তা তাঁর সে সময়ের চাউনিতেই জানা গেল।

রোজার সঙ্গে দুটি চেলামাত্র, কিন্তু ঘরে প্রায় জন চল্লিশ ভূত দেখবার উমেদার উপস্থিত, সুতরাং ভূত প্রথমে আসতে অস্বীকার করেছিলেন। তদুপলক্ষে রোজাও “কাল ও কৃশ্চানীর” উপলক্ষে একটু বক্তৃতা কোত্তে ভোলেন নাই—শেষে দর্শকদের প্রগাঢ় ভক্তি ও ঘরের আলো নিবিয়ে অন্ধকার করবার সম্মতিতে, রোজা ভূত আন্‌তে রাজি হলেন–চেলারা খাবার দাবার সাজানো থালা যে সে বসলেন, দরজায় হুড়কো পড়লো, আলো নিবিয়ে দেওয়া হলো; রোজ্য কোশা-কুশী ও আসন নিয়ে শুদ্ধাচারে ভূত ডাকতে বলেন। আমরা ভূতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বারোইয়ারির গুদোমজাৎ সংগুলির মত অন্ধকারে বসে রইলেম!

পাঠক! আপনার স্মরণ থাকতে পারে, আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, আমাদের ঠাকুরমা ভূত ও পেতনীর ভয় নিবারণের জন্য একটি ছোট জয়ঢাকের মত মাদুলীতে ভূকৈলেসের মহাপুরুষের পায়ের ধূলো পূরে আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দেন, তা সওয়ায় আমাদের গলায় গুটি বারো রকমারি পদক ও মাদুলী ছিল, দুটি বাঘের নখ ছিল, আর কুমীরের দাঁত, মাছের আঁশ ও গণ্ডারের চামড়াও কোমরের গেটে সাবধানে রাখা হয়। আর হাতে একখানা বাজুর মত কবচ ও তারকেশ্বরের উদ্দেশে সোণার তাগা বাঁধা ছিল। খুব ছেলেবেলা আমাদের একবার বড় ব্যায়রাম হয়, তাতেই আমাদের পায়ে চোরের সিধের বেড়ী পরিয়ে দেওয়া হয় ও মাথায় পঞ্চানন্দের একটি জট থাকে; জট্‌টি তেল ও ধুলোতে জড়িয়ে গিয়ে রাম ছাগলের গলায় নুন্নশীর মত ঝুলতো! কিন্তু আমরা স্কুলের অবস্থাতেই অল্পবয়সে অ্যাম-বিশেষণের দাস হয়ে ব্রাহ্ম-সমাজে গিয়ে একখানা ছাবান হেডিংওয়ালা কাগজে নাম সই করি; তাতেই শুনলেম যে আমাদের ব্রাহ্ম হওয়া হলো। সুতরাং তারই কিছু পূর্ব্বে স্কুলের পণ্ডিতের মুখে মহাপুরুষের দুর্দশা শুনে পূর্বোক্ত কবচ, মাদুলী প্রভৃতি খুলে ফেলেছিলাম! আজ সেইগুলি আবার স্মরণ হলো, মনে কল্লেম, যদি ভূত নাবানো সত্যই হয়, তা হলে সেগুলি পোরে আসতে পাল্পে ভূতে কিছু কত্তে পারবে না। এই বিবেচনা করে, সেইগুলির তত্ত্ব করে, কিন্তু পাওয়া গেল না—সেগুলি আমাদের পৌত্তরের ভাতের সময়ে একটা চাকর চুরি করে; চুরিটি ধরবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি হয় নি। গিন্নী শনিবারে একটা সুপুরি, পয়সা ও সওয়া কুনকে চেলের মুদে বাঁধেন; ন্যেপীর মা বলে আমাদের বহুকালের এক বুড়ী দাসী ছিল, সে সেই মুদোটি নে জানের বাড়ী যায়, জান গুনে বলে দেয়, “চোর বাড়ীর লোক, বড় কালও নয় সুন্দরও নয়। শামবর্ণ, মানুষটি একহারা, মাজারি গোঁফ, মাথায় টাক থাকতেও পারে”–না থাকতেও পায়ে” জানের গোণাতে আমাদেরও চাকরটিকেই চোর স্থির করে ছাড়িয়ে দেওয়া যায়। সুতরাং সে মাদুলীগুলি পাওয়া গেল না, বরং ভূতের ভয় বেড়ে উঠলো।

ব্রাহ্ম হলেও যে ভুতে ধরবে না, এটিরও নিশ্চয় নাই। সে দিন কলকেতার ব্রাহ্মসমাজের এক জন ডাইরেক্টরের স্ত্রীকে ডাইনে পায়—নানা দেশদেশান্তর থেকে রোজা আনিয়ে কত ঝাড়ান-ঝোড়ান, সরষেপড়া জলপড়া ও লঙ্কাপড়া দিতে ভাল হয়। অনেক ব্রাহ্মের বাড়ীতে ভূতচতুর্দ্দশীর প্রদীপ দিতে দেখা যায়।

এদিকে রোজ খানিকক্ষণ ডাকতে ডাকতে ভূতের আসবার পূর্ব্বলক্ষণ হতে লাগলো। গোহাড়, ঢিল, ইট ও জুতো হাঁড়ি বাড়ীর চতুর্দ্দিকে পড়তে লাগলো। ঘরের ভেতর গুপ গুপ করে কে যেন নাচছে বোধ হতে লাগলো; খানিকক্ষণ এই রকম ভূমিকার পর মড়া করে একটা শব্দ হলো; ভূতের বসবার জন্য ঘরের ভিতর যে পিঁড়েখানা রাখা হয়েছিল, শব্দে বোধ হলো সেইখানি দুচীর হয়ে ভেঙ্গে গেল—রোজা সভয়ে বলে উঠলেন–শ্ৰীযুৎ এয়েচেন।

আমরা ছেলেবেলা আমাদের বুড়ো ঠাকুরমার কাছে শুনেছিলেম যে ভূতে ও পেত্নীতে খোঁনা কথা কয় সেটি আমাদের সংস্কারবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, আজ তার পরীক্ষা হলো। ভূত পিঁড়ে ফাটিয়েই খোঁনা কথা কইতে লাগলেন প্রথমে এসেই কলেজ-বয়দের দলের দুই একজনের নাম ধরে ডাকলেন, তাদের নাস্তিক ও কৃশ্চান বলে ডাক দিলেন। শেষে ভূতত্ত্ব নিবন্ধন ঘাড় ভাঙ্গবার ভয় পৰ্য্যন্ত দেখাতে ত্রুটি করেন নাই। ভূতের খোঁনা কথা ও অপরিচিতের নাম বলাতেই বাড়ীর কর্ত্তা বড় ভয় পেলেন জোড় হাত করে (অন্ধকারে জোড় হাত দেখা অসম্ভব কিন্তু ভূত অন্ধকারে দিব্বি দেখতে পান সুতরাং কর্ম্মকর্ত্তা অন্ধকারেও জোড় হস্তে কথা কয়েছিলেন, এ আমাদের কেবল ভাবে বোধ হলে ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু ভূত সর মর্ডাণ্ট ওয়েলসের মত যা ধরেন, তার সমূলচ্ছেদ না করে ছাড়েন না। সুতরাং আমাদের ঘাড় ভঙ্গিবার প্রতিজ্ঞা অন্যথা হলো না, শেষে রোজা ও বুড়ো বুড়ো দর্শক ও বাড়ীওয়ালার অনেক সাধ্যসাধনার পর ভূত মহোদ ষষ্টীবাটায় আগত জামাইয়ের মত, যৎকিঞ্চিৎ জলযোগ কত্তে সম্মত হলেন, আমরাও পালাবার পথ আঁচতে লাগলেম।

লুচির চটকানো চিবানোর চপ চপর ও সাপটা ফলারের হাপুর হুপুর শব্দ থামতে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগলো, শেষে ভূত জলযোগ করে গাঁজা ও তামাক খাচ্ছেন, এমন সময়ে পাশ থেকে ওলাউঠো রুগীর বমির ভূমিকাত মত উঁকীর শব্দ শোনা যেতে লাগলো। ক্রমে উঁকীর চোটে ভুতের বাকরোধ হয়ে পড়লো–বমি! হুড় হুড় করে বমি! গৃহস্থ মনে কল্লেন, ভুত মহাশয় বুঝি বমি কচ্চেন; সুতরাং তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে আনালেন! শেষে দেখি কি চেলা ও রোজা খোদই বমি কচ্চেন, ভূত সরে গেচেন। আমরা পূৰ্ব্বে শুনিনে যে, গেরস্তর অগোচরে একজন মেডিকেল কলেজের ছোকরা ভূতের জন্য সংগৃহীত উপচারে ‘টার্‌টার এমেটিক্’ মিশিয়ে দিয়েছিলেন; রোজা ও চেলারা তাই প্রসাদ পাওয়াতেই তাদের এই দুর্দশা, সুতরাং ভূতনাবানোর উপর আমাদের যে ভক্তি ছিল, সেটুকু উবে গেল! সুতরাং শেষে আমরা এই স্থির কল্লেম যে, ইংরেজি ভুতেদের কাছে দেশী ভূত খবরে আসে না।

এ সওয়ায় আমরা আরও দুস্টারি জায়গায় ভূতনাবানো দেখেচি, পাঠকরাও বিস্তর দেখেছেন, সুতরাং সে সকল এখানে উত্থাপন করা অনাবশ্যক, ভূনানো ও ‘হোসেন খাঁ’ কেবল জুচ্চরী ও হুজুকের আনুষঙ্গিক বলেই আমরা উল্লেখ কল্লেম।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress