Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হিসেবে ভুল ছিল (১৯৯৭) || Samaresh Majumdar » Page 2

হিসেবে ভুল ছিল (১৯৯৭) || Samaresh Majumdar

জলপাইগুড়ির হাসপাতালের সামনে তখন বেশ জল জমে গেছে। ডেরেকের পাশে বসে জলে ভাসা শহর দেখতে-দেখতে ওরা বাইপাসে এসে পড়ল। ডেরেক জিপ চালাচ্ছে বেশ গম্ভীর মুখে। অর্জুনের মনে হল স্টিন হফম্যানের সঙ্গে ডেরেকের চেহারার খুব মিল আছে। একসময় ড়ুয়ার্স, দার্জিলিং এবং অসমের চা বাগানগুলোর ম্যানেজার হয়ে সাহেবরা এ দেশে ছিল। স্বাধীনতার পর তারা যে যার নিজের দিশে ফিরে গিয়েছে। এখন মাঝে-মাঝে টুরিস্ট ছাড়া সাহেব ড়ুয়ার্সে দেখা যায় না।

বৃষ্টিটা আবার জোরালো হল। সামনের রাস্তা দেখা যাচ্ছে না বললেই চলে। ডেরেক বাধ্য হল রাস্তা থেকে সরে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করাতে। এঞ্জিন বন্ধ করে বলল, এক্সকিউজ মি। সে পকেট থেকে একটা বাক্স বের করে ঢাকনা খুলল। বাক্সের মধ্যে হাতে পাকানো সিগারেট। ঠোঁটে একটা তুলে দিয়ে দেশলাই জ্বালল সে। ডেরেককে সিগারেট খেতে দেখে অর্জুনের লোভ হচ্ছিল খুব। কিন্তু ডেরেক তাকে অফার করছে না দেখে সে চুপ করে রইল। এই সিগারেটের গন্ধটা একদম অচেনা। মিষ্টি-মিষ্টি ঘোর লাগায়।

ডেরেক বলল, আমি একটু অভদ্রতা করলাম। কিন্তু এই সিগারেট আপনার ভাল লাগবে না বলে আমি অফার করলাম না।

কী করে বুঝলেন?

এর তামাক আমরা গ্রামে তৈরি করি। সতেরোশো আশি সালে আমার পূর্বপুরুষরা যখন ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন তখন তাঁরা এইরকম সিগারেট খেতেন। নেশার ব্যাপারে আমরা সেই অরিজিন্যালিটি আজও বজায় রেখেছি। আজকের সিগারেটের তুলনায় এর স্বাদ খুব কড়া। ডেরেক হাসল।

সতেরোশো আশি সালের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না!

ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। সতেরোশো আশি সালে তিরিশজনের একটা দলকে ভারতবর্ষে পাঠানো হয়। এই তিরিশজনের মধ্যে বাইশজন পুরুষ-মহিলার ইংল্যান্ডে কোনও না-কোনও অপরাধে যাবজ্জীবন জেলে থাকার কথা ছিল। তখন যাবজ্জীবন জেল মানে বারো বছর নয়, সমস্ত জীবনই থাকতে হত। কিন্তু জেলখানায় সম্ভবত স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না বলে ওঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হল নতুন পাওয়া কলোনিতে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা এঁদের উপদ্রব ভাবলেন। ভেবে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিলেন কলকাতা থেকে অনেক দূরে, এই পাহাড়ে।

তারপর?

তারপরের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। তখনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাহাড়ে খল নেয়নি। শিলিগুড়ি কার্শিয়াং-দার্জিলিঙের নামকরণ হয়নি। পাহাড় ছিল সিকিমের রাজা আর লেপচাদের অধীনে। কিন্তু তাদের ক্ষমতা ছিল সীমায়িত। তাই ওই তিরিশজন যখন পাহাড়ের এমন একটা জায়গায় বসতি স্থাপন করল যার আবহাওয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার মিল আছে, তখন এদেশিরা অথবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আদৌ বিরক্ত হল না।

তারপর?

আপনি গল্প খুঁজছেন?

না। আমি আপনার ইতিহাস জানতে চাইছি।

ডেরেক হাসল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ইংল্যান্ডের কুইন ভিক্টোরিয়া যে তাঁদের অপরাধীর বাইরে কিছু ভাবেন না, তা ওঁরা বুঝে গিয়েছিলেন। এতদূরে পাহাড়ে প্রায়-চেনা প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে সম্ভবত ওঁদের অভিমান প্রকট হয়েছিল। কিছুকাল পরে যখন সমস্ত ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের দখলে গেল, তখনও ওঁরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আলাদা হয়ে থেকে গেলেন। ওই তিরিশজনের পরিবার একটু একটু করে বড় হয়ে একটা গ্রামের চেহারা নিয়ে নিল। গ্রামে চার্চ হল, স্কুল হল, খামার তৈরি হল। ক্রমশ আমার পূর্বপুরুষরা আত্মনির্ভর হলেন। কিন্তু কখনওই তাঁরা ভারতবর্ষকে শাসন করা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মেলালেন না। হয়তো ওরা তাঁদের একসময় অপরাধী মনে করত, এটা তাঁরা ভুলতে পারেননি। কিন্তু মজার কথা কী জানেন, এই এলাকার আদিবাসী পাহাড়িদের সঙ্গেও তাঁদের সম্পর্ক তৈরি হল না। ভারতবর্ষের পাহাড়ে আমরা আমাদের নিজস্বতা নিয়ে বছরের পর বছর একদম আলাদা হয়ে বেচে আছি। এক নিশ্বাসে ডেরেক কথাগুলো বলে গেল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এখন আপনাদের গ্রামের মানুষের সংখ্যা কত?

সাড়ে সাতশো।

এই সাড়ে সাতশো মানুষ চুপচাপ পাহাড়ে কীভাবে থাকছে?

চুপচাপ থাকবে কেন? প্রত্যেকেই কাজকর্ম করছে। চাষবাস ছাড়াও আমাদের গ্রামের মূল আয় এক্সপোর্ট থেকে। প্রত্যেক বছর প্রচুর বিদেশি মুদ্রা রোজগার করি আমরা।

কীরকম? অর্জুন অবাক হয়ে গিয়েছিল।

হস্তশিল্প বোঝেন? নানা ধরনের হস্তশিল্প, যা আমাদের পূর্বপুরুষের কেউ-কেউ ইংল্যান্ডে থাকাকালীন শিখেছিল তারই ভারতীয় চেহারা বিদেশে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে।

তা হলে আর-পাঁচটা পাহাড়ি গ্রামের তুলনায় আপনাদের অবস্থা বেশ ভাল।

তা বলতে পারেন।

আপনারা কি শুধু ইংরেজিতেই কথাবার্তা বলেন?

হেসে ফেলল ডেরেক, তা কি সম্ভব? আমরা নেপালি এবং হিন্দিও বলি। না বললে কোনও কাজকর্মই করা যাবে না।

বৃষ্টি একটু কমে আসতেই ডেরেক জিপ চালু করল। অর্জুন চুপচাপ ভাবছিল। এত বছর এদেশে থেকেও ডেরেকরা কতখানি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে তা ওদের গ্রামে না গেলে বোঝা যাবে না। কিন্তু ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ধরনের। এরকম একটা ঘটনার কথা সে এর আগে কখনও শোনেনি। এমন তো নয় যে, ওরা নিজেদের গ্রামের বাইরে যায় না। সভ্য মানুষের সঙ্গে মেশে না। এই যে ডেরেক জিপ চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই ওর লাইসেন্স আছে। জিপ কিনতে হয়েছে বাইরে থেকে। এক্সপোর্ট করে যখন, তখন এক্সপোর্ট লাইসেন্স রয়েছে। তা হলে? তিরিশজনের একটা দল দুশো বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে চেপে এদেশে এসে পাহাড়ে বসতি করেছিল, যাদের সংখ্যা এখন সাড়ে সাতশো, তারা তো ইংরেজই। অথচ এদের কথা বইয়ে দুরের কথা, খবরের কাগজে বের হয় না।

মাঝখানে একবার পেট্রল নিতে জিপ থামিয়েছিল ডেরেক। তখন বাক্স খুলে খাবার এগিয়ে দিয়েছিল। পিঠেজাতীয় জিনিস। অর্জুন অমল সোমের বাড়ি থেকে খিচুড়ি খেয়ে বেরিয়েছিল বলে খেতে চায়নি আর। ডেরেক খেল। তারপর ফ্লাস্ক থেকে কফি। কালো কফি। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় কফিটা চমৎকার লাগল অর্জুনের।

শেষ পর্যন্ত সমতল থেকে পাহাড়ে উঠতে লাগল গাড়ি। মেঘ থাকায় আজ সন্ধে নেমে পড়েছে বেশ আগেই। ডেরেক হেডলাইট জ্বেলে দিয়েছে। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ধাক্কা খেতে-খেতে আলো তাদের পথ দেখাচ্ছে। ক্রমশ তিস্তার গর্জন কানে এল। অনেক নীচ দিয়ে তিস্তা বয়ে যাচ্ছে। এবার পিচের পথ ছেড়ে কাঁচা মাটির পথ ধরল জিপ। বৃষ্টিতে ভেজা বলেই ডেরেক খুব সন্তর্পণে চালাচ্ছিল। রাস্তা খারাপ বলেই বেশি সময় লাগছে। চারপাশে জঙ্গল এবং তাদের চেহারা অন্ধকারে ভয়ঙ্কর। বৃষ্টির মধ্যেই ঝিঝি আওয়াজ করে চলেছে সমানে। ড়ুয়ার্স-দার্জিলিঙের রাস্তাঘাট অর্জুন চেনে। এই অন্ধকারে জিপের আলোয় সে চিনতে চেষ্টা করছিল কোন পথে যাচ্ছে। কিন্তু কাঁচা মাটির পথ ধরার পর থেকেই তার সবকিছু গুলিয়ে গেল। আধঘণ্টা চলার পর সে আবিষ্কার করল কাঁচা রাস্তা শেষ হয়ে আবার পিচের রাস্তা শুরু হয়েছে। খুব মসৃণ রাস্তায় বৃষ্টির জল টুপটাপ পড়ে চলেছে। রাস্তাটা বাঁক নিচ্ছে ঘন-ঘন। হঠাৎ ডেরেক বলল, এই রাস্তা আমরাই বানিয়েছি।

আপনারা মানে গ্রামের লোকেরা?

হ্যাঁ। পুরো পথটায় পিচ ফেলা হয়নি, কারণ অনুমতি পাওয়া যায়নি।

হাওয়া বইছে খুব। অর্জুন বাইরে হাত বের করে দেখল জলের ফোঁটা পড়ছে। ডেরেক বলল, আমরা এসে গেছি। আপনাকে বৈশ কষ্ট দিলাম।

অর্জুন উত্তর দিল না। তার সামনে শুধুই পাহাড়ের আড়াল। কোথায় যে এলাম তা বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু হঠাৎ গাড়িটা বাঁক নিতেই চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হিরের মতো আলো জ্বলছে থোকা-থোকা। ঘরবাড়ির আদল দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। ডেরেক গাড়ি থামাল। বলল, ওই হল আমাদের গ্রাম।

পাহাড়ি রাস্তার অভিজ্ঞতা থেকে অর্জুন বুঝতে পারছিল এখনও সিকি মাইল পথ ভাঙতে হবে গ্রামে পৌঁছতে গেলে। পাহাড়ের আড়ালে এমন একটা জনপদের কথা সে জানত না, সাধারণ মানুষও জানে বলে মনে হয় না। ডেরেক বলল, উত্তরদিকের ওই যে পাহাড়, গ্রাম থেকে দূরত্ব খুবই অল্প, আগুন জ্বলে ওঠে ওখানেই।

অর্জুন দেখল ডেরেকের দেখানো জায়গাটা নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা। ওদিকে কোনও ঘরবাড়ি আছে বলে মনে হয় না।

গাড়ি গ্রামে ঢুকল। এখন বেশ রাত হয়ে গেছে। রাস্তা পরিষ্কার এবং লোকজন নেই। ইংরেজিতে পাব লেখা একটা সাইনবোর্ড লাগানো বাড়ি থেকে হইহই। চিৎকার ভেসে এল। ডেরেক তাকে নিয়ে এসে যেখানে থামল সেটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির গায়ে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ভিলেজ সেন্টার। গাড়ি থামতেই তিনজন পুরুষ এবং একজন মহিলা বাইরে বেরিয়ে এলেন। সবচেয়ে প্রবীণ টেকোমাথা মানুষটা এগিয়ে এসে বললেন, কী খবর ডেরেক?

ডেরেক অর্জুনকে ইশারা করে গাড়ি থেকে নামল, কোনও চিন্তা নেই আঙ্কল। আমি মিস্টার সোমের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি দুদিন পরে আসবেন। তার আগে ওঁর সহকারীকে পাঠিয়ে দিয়েছে তদন্তের জন্যে। ওঁর নাম অর্জুন, ইনি আমাদের গ্রামের চেয়ারম্যান মিস্টার জোন্স, ইনি ডেপুটি মিস্টার স্মিথ আর ইনি ট্রেজারার মিসেস বেনসন।

তিনটে বাড়ানো হাতের সঙ্গে হাত মেলাল অর্জুন। মিসেস বেনসন বলে উঠলেন, আরে, এ যে দেখছি নেহাতই ছেলেমানুষ। ও কী তদন্ত করবে!

ডেরেক বলল, মিস্টার সোম ওর ওপর আস্থা রাখেন।

অর্জুনকে ওরা বেশ সমীহ করেই ভেতরে নিয়ে গেল। একতলাটা অফিসঘর। দোতলায় গেস্ট হাউস। দীর্ঘ পথ গাড়িতে আসা এবং রাত হয়ে যাওয়ার কারণে অর্জুনকে বিশ্রাম নিতে বলা হল। দোতলার যে ঘরটি ওকে বরাদ্দ করা হল সেটি সুন্দর করে সাজানো। ওঁরা চলে গেলে অর্জুন বাথরুমে ঢুকল। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এখানে যা ঠাণ্ডা তাতে গরম জলের দরকার। ব্যাপারটা ভাবামাত্র দরজায় শব্দ হল। অর্জুন ফিরে গিয়ে সেটা খুলতে একটা বেঁটে সাহেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সাহেব কথা বলতে চেষ্টা করছে কিন্তু শব্দ পিছলে যাচ্ছে। সাহেবের হাতে একটা মুখ ঢাকা দেওয়া বালতি। এই প্রথম কোনও সাহেবকে সে তোতলাতে দেখল। চারবারের চেষ্টায় সাহেব বলল, গরম জল।

অর্জুন সেটা সাগ্রহে নিতে চাইলেও সাহেব বালতিটা হস্তান্তর করল না। ঘরে ঢুকে বাথরুমে বালতি রেখে হাসল, আ-আ-আমার নাম পল।

অনেক ধন্যবাদ মিস্টার পল। গরম জলের খুব দরকার ছিল।

কথাটা শুনে লোকটা দুবার মাথা নামাল এবং তুলল। তারপর বলল, আ-আ-আমি এ-এই সে-সেন্টারের কেয়ারটেকার। ডিনার আনব?

অর্জুন মাথা নাড়তেই একগাল হেসে পল বেরিয়ে গেল। এমন পবিত্র হাসি হাসতে অনেকদিন কাউকে দেখেনি অর্জুন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ও জানলায় এসে দাঁড়িয়েছিল। সমস্ত গ্রামটা এখন শব্দহীন। রাস্তায় মানুষ নেই। এখানকার সবাই সাহেব? ভাবা যায়। পশ্চিমবাংলার এক পাহাড়ে সাদা চামড়ার মানুষ নিজেদের মতো করে বেঁচে আছে। খারাপ ভাবে যে বেঁচে নেই তা গ্রামের চেহারা এবং গেস্ট হাউসের ঘরদোর দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ডেরেক বলল, এটা গ্রাম। পশ্চিমবাংলার গ্রামের যে চেহারা তার সঙ্গে কোনও মিল নেই। বড়জোর জামশেদপুরের টেলকোর সঙ্গে কিছুটা মেলে। দুশো বছরের ওপর ভারতবর্ষের মূল জনজীবনের সঙ্গে না মিশে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে এরা কীভাবে নিজেদের উন্নত করেছে তা নিয়ে যে-কেউ গবেষণা করতে পারেন। এরা কি ভোট দেয়? রাজনীতি করে? এখানে কি কেউ অপরাধ করে না? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় কামড়াতে লাগল।

দরজায় শব্দ হল। পল ডিনার নিয়ে ঢুকল। ট্রের ওপর প্লেটে রুটি, সবজি, দুধ এবং ডিমের ওমলেট। পল বলল, এখানে আমরা রাত্রে অ্যানিম্যাল প্রোটিন খাই না। তবু তোমার জন্যে ওমলেট করে দিলাম। কাল দুপুরে ভাল খাওয়াব।

কথাগুলো পল অনেকবার হোঁচট খেতে খেতে বলল। অর্জুনের মনে হল, পল যদি কম কথা বলে তা হলে ওর কষ্ট কম হয়। সে খেতে বসে গেল। খিদেও পেয়েছিল খুব। সবজিতে মশলা নেই বললেই চলে। সেদ্ধ করে নুন গোলমরিচ ছড়িয়েছে। একদম স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে না। সামনে দাঁড়িয়ে পল সমানে কথা বলার চেষ্টা করছিল। এই গ্রামে তো সবকিছু পাওয়া যায় না। প্রতি সপ্তাহে শিলিগুড়ি থেকে আনাতে হয় জিনিসপত্র। কিন্তু ওই যে আগুনটা আর তার সঙ্গে দুর্ভাগ্যের মতো উড়ে আসা লোকগুলো, ওরা আসার পর থেকেই এখানে কারও মনে একটুও শান্তি নেই। খেতে-খেতে অর্জুন হা-হুতাশ শুনছিল।

খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ট্রে তুলে নিয়ে গুডনাইট বলে পল বেরিয়ে গেল। হঠাৎ অর্জুনের মনে পড়ল বোল্টন শহরের কথা। ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুলে গিয়ে সে ওই ছোট্ট শহরটাকে দেখেছিল। ছবির মতো চুপচাপ, শান্ত। ডেরেকদের এই গ্রামের সঙ্গে বোল্টনের খুব মিল আছে। দুশো বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে আসা তিরিশজন মানুষ তাদের নিজেদের আদলে যে বাসস্থান তৈরি করেছে তাতে তো ব্রিটিশ ছাপ থাকবেই। কিন্তু এতটা মিল কল্পনা করাও যায় না।

শুয়ে পড়ার আগে অর্জুনের মনে হল, একটু হাঁটাহাঁটি করলে কীরকম হয়। যদিও রাত এখন অনেক, কিন্তু খাওয়াদাওয়ার পর দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তিটা চলে গিয়েছে। অর্জুন জ্যাকেটটা গায়ে ছড়িয়ে নিল। বেশ ভাল ঠাণ্ডা পড়েছে এখানে। দরজা ভেজিয়ে ও নীচে নেমে এল। এর মধ্যে ভিলেজ সেন্টারের সব আলো নিভে গেছে। সম্ভবত পল তার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে গেছে। মূল দরজাটার গায়ে হাত দিয়ে অর্জুন বুঝতে পারল ওটা বাইরে থেকে বন্ধ করা হয়েছে। হয়তো যাওয়ার সময় পল তালাচাবি দিয়ে গিয়েছে।

ফিরে আসছিল অর্জুন। যদিও বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার তবু রাতের নিজস্ব আলো জানলা চুইয়ে সেটাকে কিঞ্চিৎ ফিকে করেছে। তার মানে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, আকাশ পরিষ্কার। সে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। জানলায় কোনও শিক বা গ্রিল নেই। পাল্লা দুটো খুলতে অসুবিধে হল না। মাটি থেকে বেশি উঁচুতে নর জানলাটা। একটু ইতস্তত করেও অর্জুন জানলা দিয়ে নীচে নেমে দাঁড়াল। বাইরে থেকে পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিতেই বুঝল এখানে ঠাণ্ডা যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছে।

নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল সে। আকাশে এখন লক্ষ তারা। খানিকটা দূর থেকেই পাহাড়ের গায়ে অবশ্য জঙ্গলের জমাট অন্ধকারে সেই তারাদের কোনও প্রতিফলন নেই। হিমালয়ের বুকের ভেতরে বাটির মতো এই লোকালয়, যার সঙ্গে ভারতবর্ষের কোনও মিল নেই। বাড়িঘর ছিমছাম, ছাড়া-ছাড়া এবং এদেশি ধাঁচের নয়। ফেলে আসা দেশের স্মৃতি যে এরা ভোলেনি সেটা স্পষ্ট। রাস্তায় মানুষ নেই। এখানে কি চুরিচামারি হয় না? বাইরে থেকে অভাবী মানুষ যদি এখানে চুরি করতে আসে, তার জন্যে পাহারাদার থাকবে না? অর্জুন একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনেই পাহাড়ের পাঁচিল। দুপাশে রাস্তাটা চলে গেছে। হঠাৎ তার কানে শব্দ বাজল। কে বা কারা কথা বলছে। একজনের গলা বেশ উত্তেজিত।

প্রথমে সে কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু একটু এগিয়ে যেতেই দুজন মানুষকে সে আবছা দেখতে পেল। এত রাত্রে স্থানীয় মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী কথা বলছে তা শোনার লোভ সামলাতে পারল না সে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে সে যতটা পারল এগিয়ে গেল। এবার কথা স্পষ্ট হল। ইংরেজিতে কথা বলছে ওরা। কিন্তু এই ইংরেজি একটু অন্যরকম। ক্রিয়াপদের ব্যবহার নেই বললেই হয়। উত্তেজিত লোকটি বলছিল, আমার জীবনের একমাত্র সাধ, ইংল্যান্ডে গিয়ে নিজের গ্রাম দেখার। এই সাধ কোনওদিন মিটবে না, কারণ প্লেনের টিকিটের ভাড়া আমি জোগাড় করতে পারবনা। কিন্তু তুমি যদি আমার সঙ্গে হাত মেলাও তা হলে আমরা দুজনেই চলে যেতে পারি। ওদের কাছে এক লক্ষ টাকা চাইলেই পাওয়া যাবে।

দ্বিতীয় লোকটি বলল, না জন। এটা বিশ্বাসঘাতকতা।

কীসের বিশ্বাসঘাতকতা? নিজের পিতৃভূমি-মাতৃভূমি দেখতে চাওয়া বিশ্বাসঘাতকতা?

না, তা নয়। কিন্তু আমাদের এই কমিউনিটির ক্ষতি করে আমি কোথাও যেতে চাই না। ওই লোকগুলো যে বাচ্চাটাকে চাইবে তাকে চুরি করে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। একবার ভাবো তো সেই বাচ্চার বাবা-মায়ের কী অবস্থা হবে?

অনেক বাচ্চা জন্মানোর পর মারা যায়। সেইরকম ভেবে নেবে।

না, না। তুমি খুব নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছ। তারপর যখন তুমি ইংল্যান্ডে যাবে তখন সবাই জানতে চাইবে কোত্থেকে টাকা পেলে? কী জবাব দেবে?

আমরা কাউকে জবাব দেব না। টাকাটা হাতে নিয়েই এখান থেকে উধাও হয়ে যাব।

তার চেয়ে জন, তুমি মিস্টার জোন্সের সঙ্গে কথা বলো। আমি শুনেছি আমাদের এক্সপোর্টের ব্যাপারে একজনকে বিদেশে পাঠানোর কথা হচ্ছে। তুমি সেই দায়িত্ব চাও।

খেপেছ? জোন্সবুড়ো আমাকে কেন পাঠাবে? ওর নিজের লোক ডেরেক যাবে। যাকগে, আমি একজন সঙ্গী চেয়েছিলাম বলেই তোমাকে বললাম। কিন্তু এ-নিয়ে গল্প কোরো না। তা হলে সেটা আমার সঙ্গে বেইমানি করা হবে।

কিন্তু ওরা কি তোমাকে টাকা দেবে বলেছে?

নইলে এত কথা বলছি কেন?

কবে বলল? কীভাবে কথা হল?

সেদিন ওরা চলে যাওয়ার পরই আমি পিছু নিয়েছিলাম। শর্টকাট পথ ধরে গিয়ে দেখা করেছিলাম। রবিবারে যখন আসবে তখন আমাকে ইশারায় দেখিয়ে দেবে কোন বাচ্চাকে ওরা চায়।

ওরা কেন আমাদের বাচ্চা চাইছে?

আমি জানি না। কিন্তু তোমার সঙ্গে এত রাত্রে আলাদা কথা বললাম, এটা যেন কেউ না জানতে পারে। তুমি আবার ভেবে দ্যাখো। সারাজীবন এখানে পড়ে থাকার চেয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে থাকা তো স্বর্গে যাওয়ার সমান।

আমাদের ওরা থাকতে দেবে কেন?

কারণ আমরা ব্রিটিশ। আমাদের অধিকার আছে। আচ্ছা, গুডনাইট। লোকটা, যার নাম জন, দ্রুত হাঁটতে লাগল। পাহাড়ের সঙ্গে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্জুনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সে একবারও লক্ষ করল না। দ্বিতীয় লোকটা নেমে গেল নীচের রাস্তা দিয়ে। অর্জুন বুঝল ওরা নিজেদের বাড়িতে বসে কথা বলল না, কারণ আত্মীয়স্বজনকেও শোনাতে চায় না। ওর খুব শীত করছিল। ধীরে ধীরে ফিরে এসে জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। নরম বিছানায় লেপের তলায় শরীর ঢুকিয়ে ওর মনে হল, বিশ্বাসঘাতকদের খুঁজে বের করতে না পারলে বিদেশিরা কখনওই জিততে পারে না। আর এই রাস্তাটা ইংরেজরাই দেখিয়েছে।

এত সকালে যে ওঁরা দেখা করতে আসবেন আন্দাজ করতে পারেনি অর্জুন। পলের মুখে খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নীচে এসে দেখল মিস্টার জোন্স, মিস্টার স্মিথ এবং মিসেস বেনসন বসে আছেন। ওকে দেখামাত্র ওঁরা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, গুড মর্নিং।

অর্জুন হাসল, গুড মর্নিং।

মিস্টার জোন্স বললেন, বসুন মিস্টার অর্জুন। রাত্রে ভাল ঘুম হয়েছিল তো?

অর্জুন বলল, হ্যাঁ।

মিসেস বেনসন বললেন, আমরা খুব দুঃখিত, কালকের ডিনার আপনার ভাল লাগেনি বলে। আমি আশা করছি পল আজ থেকে সজাগ থাকবে।

অর্জুন মাথা নাড়ল, না, না। ডিনার ঠিকই ছিল।

মিস্টার স্মিথ বললেন, তা হলে আমরা ব্রেকফাস্ট খেতে-খেতে কথা বলি?

মিসেস বেনসন মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। পল এখনই নিয়ে আসছে। চলুন, ও-ঘরে যাওয়া যাক।

এঁদের অনুসরণ করে পাশের ঘরে ঢুকল অর্জুন। গোটা আটেক চেয়ারের এখানে একটা সুন্দর খাওয়ার টেবিল। টেবিলের পায়ার বদলে গাছের গুঁড়ি সুন্দরভাবে কেটে বসানো হয়েছে। পল এল ট্রে নিয়ে। হাসিমুখে বলল, গুড মর্নিং।

অর্জুন মাথা নেড়ে বলল, মর্নিং।

খেতে-খেতে মিস্টার জোন্স বললেন, আপনি নিশ্চয়ই ডেরেকের কাছে আমাদের সমস্যার কথা জানতে পেরেছেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত। মিস্টার সোম যখন আপনাকে পাঠিয়েছেন তখন নিশ্চয়ই আমরা ভরসা করতে পারি।

অর্জুন বলল, যতটুকু শুনেছি আপনাদের সমস্যা তৈরি করেছে হঠাৎ-আসা কিছু বিদেশি। কিন্তু কেউ এসে আপনাদের দু বছরের শিশুকে দেখতে চাইলেই আপনারা তাকে দেখাতে বাধ্য নন। তারা যদি ভয় দেখায়, আপনারা স্বচ্ছন্দে পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। আপনারা যদি চান আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে পারি।

মিস্টার জোন্স বললেন, আমরা মনে করি পুলিশ এখন কোনও সাহায্য করবে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তারা সাধারণত সক্রিয় হয়। ডেরেক নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে, আমাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের জঙ্গলে মাঝে-মাঝে আগুন জ্বলে ওঠে। পরদিন গিয়ে শুধু ছাই ছাড়া আমরা কিছু দেখতে পাইনি। পুলিশকে ঘটনাটা জানানো সত্ত্বেও কোনও কাজ হয়নি।

জঙ্গলে যে কারণে আগুন জ্বলে, প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ার কথা বলছি।

না। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হলে, গাছপালা শুকিয়ে গেলে যে আগুন জ্বলে, তা আমরা জানি। কিন্তু বৃষ্টিভেজা গাছগাছালিতে বাইরে থেকে আগুন না লাগালে কোনও কাজ হয় না। আর তা ছাড়া, এই আগুন ওপর থেকে নীচে নেমে আসে। পুলিশ বলেছে তারা সন্ধান করবে। কিন্তু তাও বছরখানেক হয়ে গেল। মিস্টার স্মিথ বললেন।

খাওয়া শেষ হল। চা এল অর্জুন লক্ষ করল চায়ের কাপ কাঠের তৈরি। মসৃণ সুদৃশ্য এই কাপ সে কখনও ব্যবহার করেনি।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে বেরিয়ে এসে ওরা দেখল ডেরেক অপেক্ষা করছে। সুপ্রভাত-পর্ব শেষ করার পর ডেরেক বলল, আপনি যদি কোথাও যেতে চান তা হলে গাড়ি তৈরি।

অর্জুন মাথা নাড়ল, গাড়ির দরকার নেই। মিসেস বেনসন, আপনি আমাকে বলতে পারবেন নিশ্চয়ই, এখানে দু বছরের কাছাকাছি বয়সের কত শিশু রয়েছে?

মিসেস বেনসন বললেন, ঠিক এগারোজন। এর মধ্যে তিনজন মেয়ে।

ওরা কি মেয়েদেরও দেখতে চেয়েছে?

মিস্টার জোন্স মাথা নাড়লেন, আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। শিশু বললে ছেলেমেয়ে আলাদা করা যায় না।

আমি এই এগারোজনকে দেখতে পারি?

মিসেস বেনসন মাথা নাড়লেন, পারেন। তবে ওইসব বাচ্চার বাবা-মা খুব ভয় পেয়ে গেছে। তারা কিছুতেই বাচ্চাদের বাইরে বের করতে চাইছে না। আমরা বুঝিয়ে বলব যে, আপনি আমাদের বন্ধু, উপকার করতে এসেছেন। যদি আজ লাঞ্চের পর ব্যবস্থা করি?

ঠিক আছে। ডেরেক, চলুন, একটু চারপাশ ঘুরে আসি।

ডেরেক উঠে দাঁড়াল। অর্জুন মিস্টার জোন্সকে বলল, একটা কথা ভাবতে অবাক লাগছে, এত বছর ধরে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আপনারা কী করে এখানে আছেন?

এজন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের অনেক লড়াই করতে হয়েছে। যাঁরা প্রথম। এসেছিলেন তাঁদের রাগ, অপমানবোধ তখনকার ইংরেজদের বিরুদ্ধে এত প্রবল ছিল যে, এই লড়াই করতে তাঁরা দ্বিধা করেননি। এত বছর পরে আমরা নিজেদের অবশ্যই ব্রিটিশ বলি না, কিন্তু ইংরেজ ভাবতে অসুবিধে হয় না। তবে আর কতদিন এই স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারব জানি না।

আচ্ছা, যদি আপনাদের কেউ ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে চায়?

অসম্ভব! একথা কেউ স্বপ্নেও ভাববে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে-ইংল্যান্ড আমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে সেখানে ভুলেও আমরা পা রাখব না। এই প্রতিজ্ঞার কথা এখানকার প্রতিটি মানুষ জানে। মিস্টার জোন্স দৃঢ় গলায় জানালেন।

ডেরেকের সঙ্গে বেরিয়ে এল অর্জুন। এখন রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে। সবাই অবাক হয়ে তাকে দেখছিল। অর্জুন লক্ষ করল পথের দুপাশে কোনও দোকানপাট নেই। প্রশ্ন করতেই ডেকে বলল, ভিলেজ কমিটি এই গ্রামের চারপাশে চারটে দোকান করেছে, যেখানে নিত্যব্যবহার্য সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। শিলিগুড়ি থেকে জিনিসগুলো নিয়ে এসে নামমাত্র লাভে বিক্রি করা হয়। লাভের টাকা কমিটি গ্রামের উপকারেই খরচ করে। এখানে কেউ ব্যক্তিগত ব্যবসা করে না।

তা হলে মানুষ টাকাপয়সা পায় কী করে?

ডেরেক অবাক হল, কেন? প্রতিটি পরিবার যে যেমন শ্রম দিচ্ছে তেমন অর্থ কমিটির কাছ থেকে পেয়ে যায়। তা ছাড়া মুরগি, ডিম, শূকর থেকে শুরু করে কম্বল পর্যন্ত কমিটির মাধ্যমে বাইরে বিক্রি করা হয়। সেই বিক্রির টাকা আমরা পাই।

অর্জুনের মনে হল এইরকম সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন পৃথিবীর কিছু মানবদরদী দেখেছিলেন, যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে নিরিদ্র বলে কিছু নেই?

দরিদ্র কেউ নেই, তবে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত আছে।

কীরকম?

যারা কম পরিশ্রম করে, একটু অলস, তাদের রোজগার কম। এ ছাড়া অন্য কোনও শ্রেণীভেদ এখানে নেই। ওরা চার্চের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে ক্যামেরায় ছবি তুলতে দেখল অর্জুন। ভদ্রলোক তারই ছবি তুলছেন। ডেরেক হাত নাড়ল। ছবি তুলে বৃদ্ধ ধীরে-ধীরে কাছে এগিয়ে এলেন।

ডেরেক বলল, ইনি আমার কাকা। ছবি তোলা ওঁর শখ। এঁর তোলা ছবি মিস্টার সোমের কাছে আপনি দেখেছেন। এঁর নাম অর্জুন।

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, শুনেছি, শুনেছি।

বয়স হয়ে গেলে কোনও-কোনও মানুষের চেহারা বেশ সুন্দর হয়ে ওঠে। এই মানুষটি সেই ধরনের। মুখে শিশুদের মতো সারল্য আছে, যদিও পাকা গোঁফজোড়া খুবই মজাদার। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে বললেন, তা হলে তুমিও আমাকে আঙ্কল বলো।

করমর্দন করে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনাকে কি আমি বিরক্ত করতে পারি?

বিরক্ত বলছ কেন? যদি প্রয়োজন হয় স্বচ্ছন্দে বলতে পারো। এতদিন আমাদের এখানে বাইরের লোকজন তেমন আসত না। কিছু পাহাড়ি আদিবাসী, ওদের কথা আলাদা। তা তুমি এসেছ আমাদের উপকারের জন্যে। তোমাকে তাই বন্ধু ভাবা যেতে পারে।

আপনার তোলা একটি ছবিতে দেখেছি চারপাশে পুড়ে যাওয়া গাছপালার মধ্যে একটি বিশাল ডিমের আকৃতির কিছু রয়েছে, যার রং কখনও সাদা ছিল বলে অনুমান করা যেতে পারে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওই বস্তুটি দেখা যেতে পারে?

ভদ্রলোক খুব অবাক হলেন, আমার তোলা ছবিতে দেখেছ?

ডেরেক উত্তর দিল, হ্যাঁ আঙ্কল। আমাকে মিস্টার সোম দেখিয়েছেন।

অদ্ভুত! আমি তো মনেই করতে পারছি না। আমার সঙ্গে এসো তোমরা। বাড়িতে ওই ছবির কপি আছে; দেখে বলব। ভদ্রলোক এমনভাবে হাঁটতে লাগলেন, যেন পৃথিবীতে ওই একটাই বড় সমস্যা রয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে ডেরেক বলল, দেখলেন তো, উনি ফোটোগ্রাফির ব্যাপারে কীরকম পাগল মানুষ।

আঙ্কল একা থাকেন। পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট বাড়িটির সামনে ফুলের বাগান আছে। ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে গেলে ডেরেক বলল, ওঁর ছেলেমেয়ে নেই। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই ছবি তোলার শখ বেড়ে গেছে। বাড়িতেই ডার্করুম বানিয়ে নিয়েছেন। বাইরে থেকে ফিল্ম আনিয়ে দেওয়া হয় ওঁকে। ফিল্মের যা দাম বেড়ে গেছে তাতে আমরা চিন্তায় পড়ে গেছি।

কেন?

এই বয়সে ওঁর পক্ষে তো পরিশ্রম করা সম্ভব নয়। ওঁর জমিতে ভিলেজ কমিটি থেকে চাষ করানো হয়। ফলে ওঁর দেখাশোনার দায়িত্ব কমিটিই নিয়েছে। আর কমিটির পক্ষে ওঁকে বলা সম্ভব নয় ছবি ম তুলুন। ডেরেকের কথা শেষ হতে-না-হতেই বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন হন্তদন্ত হয়ে। তাঁর হাতে বেশ কিছু ছবির প্রিন্ট।

দ্যাখো তো, এর মধ্যে আমি তো তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

ওরা দেখল। না, সেই ছবিটি নেই। ডেরেক জিজ্ঞেস করল, আগুনে পুড়ে যাওয়ার যেসব ছবি আপনি প্রিন্ট করেছিলেন তার কিছু কি অন্য কোথাও রেখেছেন?

নো। প্রতিটি বিষয়ের জন্যে আমি আলাদা বাক্স ব্যবহার করি। ছবিটা কীরকম ছিল আর-একবার বলো তো? বৃদ্ধকে চিন্তিত দেখাল।

অর্জুন বলল, ওই ছবিতে গাছগুলো পুড়ে গেলেও দাড়িয়ে আছে কোনওমতে। কিন্তু একটা আধপোড়া মস্ত গাছের পেটের মধ্যে বিশাল ডিমের আকারে কোনও বস্তু রয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছিল। ছবিটা আপনারই তোলা।

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, ওইরকম কোনও ছবি আমার কাছে নেই। অথচ প্রতিটি ছবি আমি দুটো করে প্রিন্ট করেছিলাম। এবার মনে পড়ছে ছবিটার কথা। কিন্তু প্রিন্টটা যদিবা হারিয়ে যায় নেগেটিভ তো থাকবে। সেটাও পাচ্ছি না।

কেউ নিয়ে যায়নি তো?

কী বলছ তুমি? এখানে কেউ কারও অনুমতি না নিয়ে ভেতরে ঢোকে না। তা ছাড়া একটা পোড়া গাছের ছবি আর নেগেটিভে কার উৎসাহ হবে?

ডেরেক বলল, আঙ্কল, আমরা কি অর্জুনকে নিয়ে ওই জায়গায় যেতে পারি?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। চলো।

গ্রামের মানুষজন, যারা রাস্তায় ছিল, তারা ওদের যাওয়া দেখল। গ্রাম ছেড়ে জঙ্গুলে পথ ধরে পাহাড়ে উঠতে লাগল ওরা। বৃদ্ধ হাঁটছেন ধীরে ধীরে কিন্তু তাঁর পাহাড় ভাঙতে কষ্ট হচ্ছিল না। অনেকটা ওপরে ওঠার পর অর্জুন নীচের দিকে তাকিয়ে গ্রামটাকে দেখতে পেল। এমন সুন্দর ছবি শুধু বিদেশের সিনেমায় দেখা যায়।

প্রায় চল্লিশ মিনিট হাঁটার পর ওরা সবাই যখন একটু ক্লান্ত তখন সেই পোড়া জায়গাটা এসে গেল। বৃদ্ধ চেঁচিয়ে উঠলেন, এ কী! এরকম তো ছিল না!

একটা ভলিবল কোর্টের মতো জায়গা জুড়ে ছাই কাদা কাদা হয়ে আছে বৃষ্টির ভল পড়ায়। কোনও পুড়ে যাওয়া গাছ দাঁড়িয়ে নেই। সেই আধপোড়া গাছটাকে যেন কেটে একেবারে ছোট করে দেওয়া হয়েছে। তার ভেতরে ডিমের আকারে যে বস্তু ছিল তার কোনও হদিস এখানে নেই।

ওরা তিনজন জায়গাটাকে ঘুরে-ঘুরে দেখল। অর্জুনের মনে হল আগুনে পুড়ে গেলে এবং তারপর বৃষ্টির জল পড়লে যে অবস্থা হয় তাই হয়েছে। গাছের সঙ্গে গাছের ঘর্ষণ লাগলে যে আগুন জ্বলে, তা এখন হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রায়ই বৃষ্টি হচ্ছে আর গাছগুলোও স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। কোনও মানুষই ইচ্ছে করে আগুন জ্বালিয়েছে। আর এত দূরে পাহাড়ের গাছগাছালিতে আগুন জ্বালানোর একমাত্র উদ্দেশ্য গ্রামের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। এই মতলব যাদের, তাদের সঙ্গে মধ্য এশিয়া থেকে আসা মানুষদের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা তা কে জানে!

বৃদ্ধ এরই মধ্যে জায়গাটার ছবি তুলেছিলেন। অর্জুন লক্ষ করল কাদা হয়ে যাওয়া ছাইয়ে কোনও মানুষের পায়ের দাগ নেই। অর্থাৎ কেউ এখানে পা ফেলেনি। যে গাছটাকে মুড়িয়ে কাটা হয়েছে তার কাছাকাছি তো দাগ থাকা উচিত। গাছটা নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক কারণে কাটা পড়েনি। বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করার পর পাথরের গায়ে ঘষটানোর চিহ্ন নজরে পড়ল অর্জুনের। যেখানে চিহ্নটা, সেখানে কাদা হয়ে যাওয়া ছাই লেগে রয়েছে। সে চিহ্নটার কাছে পৌঁছে এ-পাশে ও-পাশে তাকাতে লাগল। এই সময় ডেরেক তাকে ডাক।

জায়গাটা দেখে রেখে অর্জুন ফিরে এল। বৃদ্ধ বললেন, আমি এবার নিশ্চিত এখানকার ছবি তুলে নিয়ে যাওয়ার পর কেউ বা কারা অবশ্যই এখানে এসেছিল। আমি যেমনটি দেখে গিয়েছি তার সঙ্গে কোনও মিল নেই এখন।

আপনাদের গ্রামের কোনও-কোনও মানুষই হয়তো কৌতূহলে এখানে এসেছিল।

না। তেমন হলে তারা ফিরে গিয়ে বলত। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

আপনি কি বলতে চাইছেন আপনাদের সবাই বিশ্বস্ত? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

আপনি কী বলতে চাইছেন? ডেরেকের মুখ শক্ত হয়ে গেল।

পৃথিবীর সর্বত্রই বিশ্বাসঘাতকেরা বাস করে।

দ্রুত মাথা নাড়ল ডেরেক, অর্জুন। আপনি খুব ভুল করছেন। কয়েকশো বছর ধরে আমরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুন্ন রেখে এখানে বাস করছি। আপনার অভিজ্ঞতা অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু আমাদের একতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা মানে আমাদের অপমান করা। এই কথাটা ভবিষ্যতে মনে রাখবেন।

খুব ভাল লাগল শুনে। তবু আমি যেটা বলেছি সেটা মিথ্যে নয়।

আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে? বলেই ডেরেক হাত নাড়ল, গতকাল এখানে আসার আগে আপনি আমাদের অস্তিত্ব জানতেনই না। এখানে আসার পর চার-পাঁচজনের বাইরে কারও সঙ্গে আপনার আলাপ হয়নি। অথচ আপনি আমাদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতক আবিষ্কার করে ফেললেন। এই যদি আপনার তদন্তের চেহারা হয়, তা হলে বুঝব মিস্টার নোম আপনাকে পাঠিয়ে ভুল করেছেন।

ডেরেক, আমার জায়গায় মিস্টার নোম থাকলে একই কথা বলতেন।

উত্তেজিত হয়ে ডেরেক কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃদ্ধ বাধা দিলেন, আহা, অকারণে ও কেন এধরনের কথা বলতে যাবে? ওর কারণগুলো আগে শোনো।

অর্জুন বলল, যাঁ আঙ্কল, কারণ নিশ্চয়ই আছে। তবে সেটা এখনই আমি বলতে চাই না। কে জানে, হয়তো সেটা বললে বিশ্বাসঘাতকেরা সাবধান হয়ে যেতে পারে।

ডেরেক চিৎকার করল, মাই গড। আপনি আমাদেরও সন্দেহ করছেন?

অপরাধীকে খুঁজে বের করার আগে কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন মিস্টার ডেরেক।

বৃদ্ধ বললেন, ঠিক, ঠিক কথা। চলো গ্রামে ফেরা যাক।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর নীচের হলঘরে শিশুদের নিয়ে মায়েরা জড়ো হলেন। তাদের বাবা এবং অন্যরা খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এগারোটি শিশুকে একসঙ্গে দেখলে আলাদা ছবি তৈরি হয়। দুই বা দুইয়ের কাছাকাছি বলে প্রত্যেকেই স্বচ্ছন্দ। নিজেদের মধ্যে যে হল্লা জুড়েছে, তা তাদের মায়েরা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। মিসেস বেনসন বললেন, এই এগারোজনের কথাই বলেছিলাম।

অর্জুন প্রতিটি বাচ্চাকে খুঁটিয়ে দেখছিল। স্বাভাবিক হইচই করা শিশু। কেউ একটু বেশি দুরন্ত এই যা! একটি বাচ্চা অবশ্য বেশি চুপচাপ। গম্ভীর মুখে অন্যদের দুষ্টুমি দেখছিল। অর্জুন ওর কাছে গেল। হাঁটু মুড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী? প্রশ্নটি অবশ্যই ইংরেজিতে।

শিশুটি অর্জুনকে দেখল। ঠোঁট টিপল। কিন্তু কোনও উত্তর দিল না।

তার মা বোঝাতে লাগলেন, কথা বলো। নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হয়।

শিশুটির কানে সেসব ঢুকল না।

অর্জুন হেসে বলল, মনে হচ্ছে ও কথা বলতে পারে না। তাই না?

শিশু মাথা নেড়ে নীরবে হ্যাঁ বলল। তার মা চিৎকার করে উঠলেন, ওরে দুষ্ট, কী পাজি রে তুই! বাড়িতে বকবক করে আমার মাথাখারাপ করে দিস, আর এখন বেশ বলে দিলি কথা বলতে পারছি না।

এসব সত্ত্বেও শিশুটির মুখে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না।

মিস্টার জোন্স এসে দাঁড়ালেন পাশে। অর্জুন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি এইসব মা-বাবার সঙ্গে একটা কথা বলতে পারি?

অবশ্যই। সেই কারণেই এখানে ওঁরা এসেছেন।

অর্জুন তাকাল, ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলারা, আপনারা আমার নমস্কার গ্রহণ করুন। গত কয়েকদিন ধরে আপনারা যে উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন সে-কথা আমি জেনেছি। হ্যাঁ, উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিদেশিরা কোন উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে, আপনাদের শিশুদের কেন তারা দেখতে চাইছে, তা আমি এখনও জানি না। তাই আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। আমি মিস্টার জোন্সকে অনুরোধ করছি তিনি যেন এই এগারোটি শিশু এবং তাদের মায়েদের এই ভিলেজ সেন্টার হলে আগামী কয়েকদিন থাকার ব্যবস্থা করেন। জানি, এইভাবে নিজের বাড়ি ছেড়ে এখানে থাকতে আপনাদের অসুবিধে হবে। কিন্তু যদি আপনারা মানিয়ে নেন কয়েকদিনের জন্যে, তা হলে নিরাপদ থাকবেন। বন্যায় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ প্রয়োজনে বাসস্থান ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নেয়, এ-ও তেমনই।

সঙ্গে-সঙ্গে গুনগুনানি শুরু হয়ে গেল। অর্জুনের প্রস্তাব মায়েদের যে পছন্দ হচ্ছে না—তা স্পষ্ট। কেউ নিজের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে এখানে চলে আসতে চাইছেন না। কিন্তু মিসেস বেনসন ওঁদের বোঝাতে লাগলেন। স্বামীরাও আলোচনায় যোগ দিলেন। শেষপর্যন্ত ঠিক হল, দিনসাতেক তাঁরা, অর্থাৎ শিশুদের নিয়ে মায়েরা এখানে থাকবেন। আর সেই সময় স্বামীরা পালা করে দিনরাত এই ভিলেজ সেন্টার পাহারা দেবেন।

মিস্টার জোন্সের কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন নিজের ঘরে উঠে এল। কাল রাত্রে সে ভাল করে দেখেনি, আজ জানলাটা নজরে এল। বেশ বড় জানলা। অনেকটা পাহাড় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সে জানলার কাছে সরে এসে পাল্লা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে পড়ল। অর্জুন দেখল জানলায় কোনও গ্রিল বা শিক নেই। কাঠও তেমন মজবুত নয়। বুদ্ধিমান আগন্তুকের কোনও অসুবিধে হবে না বাইরে থেকে এ-ঘরে ঢুকতে। মিস্টার জোন্সকে বলতে হবে মায়েরা যে ঘরে শিশুদের নিয়ে থাকবেন, সেটার জানলা পরীক্ষা করতে।

অর্জুন তার ডায়েরি বের করল। এখানে আসার পর যা-যা দেখেছে এবং শুনেছে তা পরপর লিখল। লেখার পর তার মনে হল, বাচ্চাগুলোকে এক জায়গায় এনে একটু ঝুঁকি নেওয়া হয়েছে। যারা ওদের দেখতে চায়, তারা এখানে এলেই দেখতে পাবে একসঙ্গে। নইলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে খুঁজতে হত। বাইরের লোকের পক্ষে জানান না দিয়ে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু গ্রামের লোক বিশ্বাসঘাতকতা করলে তার পক্ষে খুবই সহজ কাজটা। আসলে বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে শিশুদের বাঁচাবার জন্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া। মুশকিল হল, ডেরেক ভাবতেই পারছে না এই গ্রামে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।

এই সময় পল ঢুকল চা নিয়ে, গুড আফ-আফ-আফটারনুন।

গুড আফটারনুন। আমি দুঃখিত, তোমার চাপ বাড়িয়ে দিলাম।

পল হাসল, না, না। চাপ কীসের! মিসেস কেন-বেন-বেনসন আরও দুজনকে দিয়েছেন আমাকে সাহায্য করার জন্যে। কেমন লাগছে এখানে?

ভাল। খুব ভাল জায়গা। তোমরাও খুব ভাল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অর্জুন জানলায় গেল। নীচে রাস্তার একাংশ দেখা যাচ্ছে। দু-একজন মানুষ যাতায়াত করছে। হঠাৎই অর্জুনের নজর পড়ল লোকটির ওপর। তার চিনতে ভুল হয়নি। গত রাতের দ্বিতীয় লোকটি। সে দ্রুত হাত নেড়ে পলকে ডাকল। পল কাছে আসতেই সে জিজ্ঞেস করল, ওকে চেনেনা তুমি? কী নাম ওর?

ওঃ। ও হল এ-এ-এ-এড। আমাদের জামা-প্যান্ট সেলাই করে দেয়।

লোকটাকে দেখলে খুব ভাল মনে হয়?

মিস্টার জো-জো-জোন্স ওর ব্যাপারটা ভাল জানেন।

চা খাওয়া হয়ে গেলে একটা পুলওভার আর মাফলার জড়িয়ে নীচে নামল অর্জুন। জিনিসপত্র নিয়ে মায়েদের আসা শুরু হয়েছে তখন। মিস্টার স্মিথ আর ডেরেক তাঁদের থাকার ব্যবস্থা তদারকি করছেন। ডেরেক তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল, আমি বুঝতে পারছি না অর্জুন, এটা আপনি কেন করলেন! এর ফলে আতঙ্ক আরও বাড়বে।

আতঙ্কিত মানুষেরা বেশি সজাগ হয়, তাই না?

আমি একমত নই। মিস্টার জোন্স বললেন, আপনাকে যখন ডেকে এনেছি তখন আপনার ওপর ভরসা রাখতেই হবে। কিন্তু মনে রাখবেন, আমরা মিস্টার সোমকে চেয়েছিলাম, তিনি আপনাকে পাঠিয়েছেন। ডেরেক গম্ভীর মুখে বলল।

তা হলে আপনি আমার ফেরার ব্যবস্থা করে দিন।

ডেরেক শক্ত মুখে বলল, আমি যে সেটা করতে পারি না তা আপনি ভাল করে জানেন।

আপনি কি এখানে খুবই ব্যস্ত?

কেন?

একটু যদি আমায় সঙ্গ দিতেন?

ডেরেক ফিরে গিয়ে, বোধ হয়, মিস্টার স্মিথের অনুমতি নিয়ে এল।

রাস্তায় বেরিয়ে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনাদের জামাপ্যান্ট নিশ্চয়ই বাইরে থেকে কেনেন না। এখানে কি ফ্যাক্টরি আছে?

হ্যাঁ, আছে। দুজন কর্মী রোজ সেই কাজটা করে থাকেন।

আমি সেই ফ্যাক্টরিতে যেতে চাই।

ডেরেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

এমনি, ধরে নিন শুধুই কৌতূহল।

ডেরেক কাঁধ নাচাল। পুরোটা পথ ওরা কেউ কথা বলল না। একতলা, বিশাল হলঘরের মতো একটা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ডেরেক বলল, এর কথা বলছিলাম।

প্রথমেই একটা অফিসঘর গোছের। সেখানে একটি তরুণ খাতায় কিছু তখছিল। ডেরেক বলল, গ্রামের যারই জামাপ্যান্ট দরকার হয় এখানে এসে তার দেয়। প্রত্যেকের মাপ এখানে লেখা আছে। কারও মাপ পালটে গেলে নতুন করে মাপ দিতে হয়। প্যান্ট-শার্টের কাপড়ও এখানেই পছন্দ করে খদ্দেররা। মেয়েদের পোশাকের কারখানা আলাদা, আপনি কি সেখানেও যেতে চান?

আগে এই জায়গাটা দেখি।

ডেরেক ছেলেটিকে বলতেই সে ওদের ভেতরে নিয়ে গেল। এলাহি ব্যবস্থা। লম্বা টেবিলের ওপর সেলাইয়ের মেশিন রাখা আছে। তিনজন কর্মী এখনও কাজ করে চলেছেন। জোরালো আলো জ্বলছে। এই গ্রামের সমস্ত পুরুষের পোশাক সরবরাহ করতে এদের সারা বছরই কাজ করতে হয়।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি বলছিলেন ছজন কর্মী এখানে কাজ করেন?

হ্যাঁ।

এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে কে আছেন?

এড-এডওয়ার্ড! ডেরেক ঘুরে দাঁড়িয়ে তরুণকে জিজ্ঞেস করল, এড কোথায়?

তরুণ জবাব দিল, একটু আগে উনি বাড়ি চলে গেছেন।

ডেরেক বলল, আপনার যা জানার এদের কাছ থেকে জানতে পারেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, ঠিক আছে, চলুন।

বাইরে বেরিয়ে এসে ডেরেক প্রশ্ন করল, আমি বুঝতে পারছি না আপনার তদন্তের সঙ্গে আমাদের পোশাক তৈরির কারখানার কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

অর্জুন হাসল, এমন তো হতে পারে আপনাদের শার্ট-প্যান্টের স্টাইল আমার এত ভাল লেগেছে যে, আপত্তি না থাকলে আমার জন্যে বানিয়ে নিতে চাই।

ডেরেক মাথা নাড়ল, আপনাকে ঠিক বুঝতে পারছি না।

তখন সন্ধে নামছিল। হাঁটতে-হাঁটতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, মিস্টার এডওয়ার্ডের সেলাইয়ের হাত খুব ভাল, তাই না?

উঁহু। এড ভাল কাটার। ও কেটে দেয়, সেলাই করে অন্যরা।

উনি এটা শিখলেন কী করে?

ওঁর বাবার কাছ থেকে। মানুষটা কীরকম?

কেন বলুন তো?

এত ভাল কাজ জানেন অথচ এই গ্রামেই পড়ে আছেন। শিলিগুড়ি তো কোন ছার, কলকাতায় গেলে বড় বড় দোকান ওঁকে লুফে নেবে।

আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমরা এই গ্রামের বাইরে যেতে ভালবাসি। তবে এড একটু রগচটা মানুষ। ভিলেজ কমিটি ওকে একবার শাস্তি দেওয়ার কথা ভেবেছিল। ওর স্ত্রী ক্ষমা করে দেওয়ায় ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে।

কী ব্যাপার?

স্ত্রীকে অযথা মারধোর করত। পান থেকে চুন খসলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। স্ত্রী ওর কাছ থেকে চলে যেতে চায় বলে ভিলেজ কমিটির কাছে। আবেদন করায় ও মারধোর করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভদ্রমহিলাই ক্ষমা করে দেন।

উনি কি এখন এডের সঙ্গেই আছেন?

না। ওরা আলাদা হয়ে গিয়েছে।

যদি ওর স্ত্রী ক্ষমা না করতেন তা হলে কী শাস্তি হত?

অপরাধের গুরুত্ব বুঝে। যেমন, প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয় এমন কাজ ওকে কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই করতে হত পাঁচ বছর ধরে।

যদি এড সেটা মেনে না নেয়?

না নিয়ে উপায় নেই।

যদি এখান থেকে পালিয়ে যায়?

আজ পর্যন্ত তেমন ঘটনা ঘটেনি।

অর্জুন দাঁড়িয়ে পড়ল, ডেরেক, আজ পর্যন্ত তেমন ঘটনা ঘটেনি বলে আপনারা যদি ভেবে থাকেন কখনও ঘটবে না, তা হলে খুব ভুল করবেন। এই এড লোকটিকে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। ওর বাড়িতে যাওয়া যেতে পারে?

ডেরেক মাথা নাড়ল। হাঁটতে-হাঁটতে বলল, আমার মনে হচ্ছে আপনি তদন্ত করতে এসে অকারণে সময় নষ্ট করছেন। প্রায় একদিন হয়ে গেল কিন্তু আপনার কাজ একটুও এগোয়নি।

অর্জুন হাসল, কিছু বলল না।

এডওয়ার্ডের বাড়িটির গায়ে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। রাস্তা থেকে নেমে বন্ধ দরজায় শব্দ করল ডেরেক। দ্বিতীয়বারে দরজা খুলল এড। চোখ-মুখে অবাক হওয়া স্পষ্ট।

কী ব্যাপার ডেরেক?

ইনি অর্জুন, আমাদের অতিথি। আপনার কারখানায় গিয়েছিলেন। আমাদের জামাপ্যান্ট দেখে ওঁর খুব ইচ্ছে হয়েছে নিজের জন্যে কিছু তৈরির। ডেরেক বলল।

এড বলল, অনেক ধন্যবাদ আপনার ইচ্ছের জন্যে। তবে আমরা বাইরের লোকের জন্যে কিছু তৈরি করি না। অবশ্য ভিলেজ কমিটি যদি আদেশ দেয় তা হলে আপত্তি নেই।

অর্জুন লক্ষ করল এড তাদের ভেতরে যেতে বলছে না। সে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনার পূর্বপুরুষরা কি একই কাজ করতেন?

হ্যাঁ। আমি যতদূর জানি ওঁরা একই প্রফেশনে ছিলেন।

ইংল্যান্ডে কোথায় আপনার বাড়ি ছিল?

ডেরেক বাধা দিল, সরি অর্জুন। আমরা ওই ইতিহাস মনে করতে চাই না।

তাই? কিন্তু এড, যদি আপনি সুযোগ পান ইংল্যান্ডে যাওয়ার, তা হলে কী কররেন?

এও বলল, আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

এই ধন, আপনারা এখন এক্সপোর্ট করছেন। ধরা যাক, ভিলেজ কমিটি ঠিক রেল এক্সপোর্টের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে আপনাকে ইউরোপে পাঠাবে। যাবেন?

কমিটি আমাকে পাঠাবে না।

কেন?

কারণ ওই ব্যাপারটা আমি বুঝি না।

বেশ। হঠাৎ আপনি এক লক্ষ টাকা পেয়ে গেলেন। তখন কি যাবেন?

না। আমার পূর্বপুরুষেরা ঠিক করেছিলেন ও-দেশে তাঁরা ফিরে যাবেন না। সেই সিদ্ধান্ত আমাকে মেনে নিতে হবে।

কিন্তু আপনাদের পূর্বপুরুষদের অনেক সিদ্ধান্ত ভুল ছিল এটা প্রমাণিত হয়েছে।

আগে তাঁদের ভুলটা আমার ক্ষেত্রে প্রমাণিত হোক।

ও। আপনি তো একাই থাকেন। রাত্রে কী করেন?

বাড়িতেই থাকি।

গত রাত্রে কোথায় ছিলেন?

গত রাত্রে? ও, আমার এক বন্ধু খুব ধরেছিল তাই ওর সঙ্গে একটু পাবে গিয়েছিলাম।

পাব?

আমাদের এখানে পানীয় খাওয়ার একটা দোকান আছে। সবাই আড্ডা মারে সেখানে।

ও। আপনার বন্ধুর নাম কী?

চার্লস।

খাটাখাটুনির পর একটু আড্ডা মারা ভাল। আজ বের হবেন না?

না। আজ বাড়িতেই থাক।

অনেক ধন্যবাদ। দেখুন যদি ভিলেজ কমিটি অনুমতি দেয় তা হলে আপনার তৈরি শার্ট-প্যান্ট নিয়ে যেতে পারব। আচ্ছা, ও দুটো তৈরি হতে কীরকম সময় লাগবে?

ঘণ্টাচারেক বড়জোর। এড হাসল।

ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা ফিরে আসছিল। খানিকটা আসার পর নিরিবিলি একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল অর্জুন, ডেরেক, এই চার্লসকে আপনি কীরকম চেনেন? ওর সম্পর্কে সব তথ্য জানেন?

আমাদের গ্রামটা এত ছোট, সবাই সবার সম্পর্কে মোটামুটি জানে। চার্লসকে নিয়ে আপনি চিন্তিত হলেন কেন?

ওর সঙ্গে আমার আলাপ হওয়া দরকার।

দেখুন অর্জুন, হাতের সব আঙুল যেমন সমান হয় না, এই গ্রামের সব মানুষ তেমনই এক ধাতে গড়া নয়। চার্লস একটু কুটিল প্রকৃতির মানুষ। কারও ভাল সে সহ্য করে না। সবসময় মনে করে লোকে তাকে মর্যাদা দিচ্ছে না। এই ধরনের মানুষ নিজে যেমন সুখী হয় না তেমনই অন্যকেও সুখী করতে চায় না। ডেরেক বলল।

স্বাভাবিক। অর্জুন মাথা নাড়ল।

কিন্তু পাহাড়ের আগুন অথবা বিদেশিদের সঙ্গে চার্লসের কোনও সম্পর্ক নেই।

তা তো হবেই। কারণ উনি তো কখনওই এই গ্রামের বাইরে যাননি, তাই তো?

হ্যাঁ।

ডেরেক, আপনি এবার আপনার কাজে যেতে পারেন। আমি একটু একা ঘুরতে চাই। ডিনারের আগেই আমি ভিলেজ সেন্টারে ফিরে যাব। অর্জুন বলল।

ডেরেক তাকাল। তারপর লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল।

দুপকেটে হাত পুরে অর্জুন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। গোটা পাঁচেক বাচ্চা ছেলে হইচই করতে-করতে ওপর থেকে নেমে আসছে। ওরা তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। ছেলেগুলোর হাতে বই। স্কুলের পড়ুয়া ওরা, সন্দেহ নেই। অর্জুন হেসে উঁচু গলায় বলল, হ্যালো।

পাঁচজনেই ঠোঁট নাড়ল, কিন্তু শব্দ শোনা গেল না।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমরা সবাই কোন ক্লাসে পড়ো?

পাঁচজন পরস্পরের দিকে তাকাল। শেষপর্যন্ত একজন বলল, আমরা গ্রামার পড়ি, এসে লিখি এবং প্রাথমিক অঙ্ক করি।

ছেলেটি বলমাত্র বাকিরা হইহই করে আগের মতো ছুটে নীচে নেমে গেল অর্জুনের পাশ দিয়ে। অর্জুনের ভাল লাগল। অর্থাৎ, এখানে ওয়ান টু করে ক্লাস সিস্টেম নেই। কিন্তু এই যে গ্রামার ওরা পড়ছে, পাচ্ছে কোথায়?

অর্জুন দেখল সন্ধে হয়ে গিয়েছে। ঝুপঝাপ করে নামছে অন্ধকার আর গ্রামের লাইট পোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠছে পরপর। সে পেছন ফিরল। হাঁটতে-হাঁটতে এডওয়ার্ডের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে ও দাঁড়িয়ে গেল। এডওয়ার্ডের বাড়ির দরজা বন্ধ, যেমনটি আগে ছিল। লোকটা বলেছে আজ রাত্রে সে বাড়িতেই থাকবে।

অর্জুন ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল। বাড়িটার গায়ে দুটো ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে, পাশাপাশি। সে গাছ দুটোর মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। চট করে বাইরে থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না। অর্জুনের বিশ্বাস, আজ এডওয়ার্ডের কাছে সেই ভাল লোকটা অবশ্যই আসবে। চার্লস কী বলে তা শোনা দরকার।

কিছুক্ষণ ইউক্যালিপটাস গাছের আড়ালে থাকার পর অর্জুনের মনে হল, ঘরের ভেতরে কথা বললে সে বাইরে থেকে কিছুই শুনতে পাবে না। বাড়িটার ভেতরে আলো জ্বলছে, কিন্তু এডওয়ার্ড কোথায় আছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে না। সে ইউক্যালিপটাসের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাড়িটার পেছনে লম্বা কাঠের বলা রয়েছে। অর্জুন সেই বারান্দায় উঠল। এদিকের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কোনওভাবেই সেটা ভোলা যাচ্ছে না।

এই সময় বাইরের দরজায় শব্দ হল। অর্জুন শুনতে পেল এডওয়ার্ড চিৎকার করল, কে? যে এসেছে সে জবাব না দিয়ে দ্বিতীয়বার শব্দ করল। অর্জুন বারান্দা থেকে নেমে বাড়িটার পাশ দিয়ে এগোল। ইতিমধ্যে দরজা খুলেছে এডওয়ার্ড।

আরে তুমি! কী ব্যাপার?

তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

এসো। ভেতরে এসো। বাইরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হল। জানলার আলোয় ছায়া পড়ল। অর্জুন বুঝল ওরা পাশের ঘরে এসে বসল। আগন্তুক বলল, এড, তুমি কি ইংল্যান্ডে যেতে চাও?

আবার একথা কেন? এড জিজ্ঞেস করল।

তোমাকে মনঃস্থির করতে হবে। কারণ বাইরে থেকে কেউ একজন এসেছে যার কথামতো গ্রামের সমস্ত দু বছরের বাচ্চাদের ওরা ভিলেজ সেন্টারে নিয়ে গিয়েছে। এতে অবশ্য আমাদের সুবিধে হল। তুমি আর আমি যদি হাত মেলাই তা হলে বাচ্চাটাকে পেতে অসুবিধে হবে না।

এডের গলা শুনতে পেল অর্জুন, চার্লস, তোমাকে আমি গতকালই বলেছি ওব্যাপারে আমার কোনও উৎসাহ নেই। তা হলে আবার এসব কথা কেন?

চার্লস উত্তেজিত হল, অদ্ভুত মানুষ তুমি। কোন আশায় এখানে পড়ে আছ, অ? তোমার সংসার বলে কিছু নেই। এগ্রামের মানুষদের জামাপ্যান্ট পরাতে পরাতে একসময় মরে যেতে হবে। তোমার যা হাত, তাতে লন্ডনের যে-কোনও বড় দরজির দোকান তোমাকে লুফে নেবে। পায়ের ওপর পা তুলে বাকি জীবন থাকতে পারবে তুমি।

এড তবু আপত্তি করল, না ভাই, আমার ঠিক সাহস হচ্ছে না।

তার মানে তুমি আমার যাওয়া বন্ধ করতে চাও?

না তো! তুমি তোমার প্ল্যানমতো এগিয়ে যাও।

আমার প্ল্যানমতো এগোতে গেলে তোমাকে সঙ্গে রাখা দরকার।

কেন?

সব কিছু ম্যানেজ করে আমি না হয় ইংল্যান্ডে পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে আমি কী করব? আমি যা কাজ করি তা ওখানে মূল্যহীন। বেকার হয়ে তো থাকা যাবে না। খাব কী? তুমি থাকলে আমরা একটা দরজির দোকান খুলতে পারি। কাজ শিখে নিয়ে তোমাকে আমি সাহায্য করতে পারি। বুঝতে পারছ?

পারছি। কিন্তু ধরা পড়লে কী দুর্দশা হবে ভেবে দেখেছ?

কী আর হবে? এরা আমাদের তাড়িয়ে দেবে এখান থেকে। জোন্সবুড়ো নিশ্চয়ই থানা-পুলিশ করবে না। বাইরের যে ছোকরাকে ওরা ডেকে এনেছে সে তো পুলিশ নয়।

চার্লস।

হ্যাঁ।

সেই ছোকরা আমার কাছে এসেছিল।

তোমার কাছে? কখন?

তুমি আমার একটু আগে। ডেরেক নিয়ে এসেছিল ওকে।

সে কী! তোমার কাছে কেন এল?

জানি না। বলল তো পোশক করাতে চায় কিন্তু ওর কথাবার্তা অন্যরকম।

কী বলেছে তোমাকে?

গত রাত্রে আমি কোথায় ছিলাম, কার সঙ্গে ছিলাম, এইসব জিজ্ঞেস করছিল।

তাই নাকি? কী বললে?

বললাম, পাবে আড্ডা মারতে গিয়েছিলাম। তারপর তোমার সঙ্গে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। আমাকে কেন এসব জিজ্ঞেস করল?

হয়তো, এমনি, কৌতূহলে। কিন্তু তুমি আমার নাম বলে দিলে?

আহা, আমরা তো একসঙ্গে পাব থেকে বেরিয়েছিলাম। কেউ-কেউ নিশ্চয়ই আমাদের দেখেছে। খোঁজ করলে জানবে আমি মিথ্যে বলিনি।

বুঝতে পেরেছি। ওই ছোকরা এসেছিল বলে তুমি ভয় পেয়ে গেছ। আরে এত নার্ভাস হলে চলে? আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আগামী রবিবার ওরা যখন। আমাদের গ্রামে আসবে তখন আমরা ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকব। বুঝতে পারছি এরা বাচ্চাদের সামনে রে করবে না। সেরকম হলে আমি পাকদণ্ডী দিয়ে ফেরার পথে ওদের সঙ্গে দেখা করব। ঠিক কোন বাচ্চাটাকে ওরা চায় জেনে নেব। এর মধ্যে তুমি পলের সঙ্গে ভাব জমাও।

পল!

হ্যাঁ। তোতলাটার সঙ্গে তোমার তো সম্পর্ক ভাল। মিসেস বেনসনের মেয়ের সঙ্গে ও বন্ধুত্ব করতে চায়, যেটা ভদ্রমহিলা একদম পছন্দ করেন না। মেয়েটিও পূণকে অপছন্দ করে। তুমি এই বিষয়ে সহানুভূতি দেখাও, যাতে পল তোমাকে নিজের লোক মনে করে। আর ওকে হাত করতে পারলে ভিলেজ সেন্টারের যে-কোনও বাচ্চাকে বের করে আনতে অসুবিধে হবে না।

হঠাৎ দরজা খুলে গেল। কোনওমতে নিজেকে আড়ালে নিয়ে গেল অর্জুন। বড় পা ফেলে চলে গেল চার্লস। এড দরজাটা বন্ধ করে দিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress