ধীর গম্ভীর স্বরে সাতনা বলল
ধীর গম্ভীর স্বরে সাতনা বলল, “যে-হাত আমার গায়ে তুলছে, সে-হাত তোমার শরীর থেকে কেটে ফেলা হবে।”
কিন্তু সাতনা মুখে যা-ই বলুক, তার আর সেই ভয়ংকরতাও নেই। মুখটা কেমন ভোতা দেখাচ্ছে। চোখে একটা দিশেহারা ভাব। কিংকর একটু হেসে বলল, “ভয় দেখাচ্ছ নাকি? তোমার আমার জীবন যেরকম, যাতে কাউকে কারো ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। খামোকা চোখ রাঙিয়ে নিজের কাছে নিজেই হাস্যাস্পদ হচ্ছ। ভয় খাওয়ার হলে এতক্ষণে খেতাম।”
সাতনাও সেটা ভালরকমে টের পাচ্ছে। কিংকর কিছুতেই ভয় পাচ্ছে না। তাই সাতনা খানিকটা চুপসে গিয়ে বলল, “আমার মেয়ের ছবি যদি খাঁটি হয়ে থাকে, যদি জাল-জোচ্চুরি না করে থাকে তবে এ-যাত্রায় তুমি প্রাণে বেঁচে যাবে। এখন বলো, আমার মেয়ে কোথায়?”
কিংকরের মুখ থেকে এখনো হাসি মুছে যায়নি। সে মাথা নেড়ে বলল, “ধীরে বন্ধু, ধীরে। অত তাড়া কিসের? তোমার শরীরে যে একটু নামমাত্র মায়াদয়া এখনো অবশিষ্ট আছে, তা ওই মেয়েটির জন্য, তা জানি। কিন্তু আমারও শর্ত আছে।”
সাতনা থমথমে মুখে বলল, “সেটা না-বোঝার মতো বোকা আমি নই। শর্তটা কী তা বলে ফ্যালো।”
“এক, দলের যে মাথা, তার নাম আমাকে বলতে হবে।”
“তার নাম জেনে কি হবে? ধরিয়ে দেবে?”
“সেটা পরে ঠিক করব। আগে নামটা’ত জানি।”
“আর কোন শর্ত আছে?”
“আছে। তোমাকে দল ছাড়তে হবে।”
সাতনা একটু ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। “তোমার শর্তগুলো শুনতে ভাল কিন্তু কাজের নয়। প্রথম কথা, দলের বড়-সর্দারের নাম আমারও জানা নেই। দুনম্বর কথা হল, দল ছাড়া অসম্ভব। এ-দলে ঢোকা যায়, বেরোনো যায় না।”
কিংকর হাসি-মুখে বলল, “আমার তিন নমবর শর্ত হল, কোনো নির্দোষকে সাজা দেওয়া উচিত নয়। তাই বেচারা গোবিন্দ মাস্টারকে খালাস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।”
সানা মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “যদি এর কোনো শর্তই না মানি?”
কিংকর এবার হাসল না। মৃদু স্বরে বলল, “তোমার যে-মেয়ে যাওয়ার পর তুমি মানুষ থেকে পশু হয়েছ, সেই মেয়ের খোঁজ জীবনেও পাবে না।”
সাতনা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ কিংকরের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর কেমন ভ্যাবলার মতো বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ বাদে বলল, “রাত দুটোর সময় আবার এই চোর-কুঠুরিতে এসো। কথা হবে।”
“কিন্তু বাইরে যে-সব যমদূত মোতায়েন আছে তারা আবার পিছু নেবে না তো?”
“বারণ করে দিচ্ছি। এখন তুমি স্বাধীন।”
দুজনে বেরিয়ে এল।
সাতনার মুখ নিচু। ভাবছে। মাঝে-মাঝে হারানো মেয়েটার কথা ভেবে চোখে জল আসছে তার। হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছছে মাঝে-মাঝে, সাতনার চোখে জল! ব্যাপারটা তার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না।
এই কিংকর নামে লোকটা কে, তা ভেবে সারাদিন রামুর মাথা গরম। গতকাল রাতে জঙ্গলের অন্ধকারে প্রথম দেখা। লোকটা তাদের ধরিয়ে দিল। কিন্তু আজ সকালে আবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তাকে বাঁচাল। সাতনা
যখন তাকে ডাকিয়ে নিয়ে লোকটাকে চিনতে পারে কি না জিজ্ঞেস করল, তখন তার স্পষ্টই মনে হল, যে কিংকরকে চেনে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না, কোথায় দেখেছে বা কবে।
আজ সকালেই ডাকাতরা তার গলা কাটতে গিয়েছিল বটে, কিন্তু আজই আরার কী মন্ত্রে যেন তারা ভারী সদয় হয়েছে তার ওপর। সকাল থেকে কিছু খেতে দেয়নি। কিন্তু বেলা দশটা নাগাদ একজন নরম-সরম চেহারার ডাকাত এসে জামবাটি-ভরা সর-ঘন দুধ কলা আর নতুন গুড় দিয়ে মাখা চিড়ের ফলার খাওয়াল। তারপর ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “যাও খোকা, ঘুরে-টুরে বেড়াও গিয়ে। তোমাকে আর ঘরে আটকে রাখার হুকুম নেই।”
রামু বেরিয়ে এল। চারদিকে আলো আর গাছপালা। মুক্ত বাতাস। বুক ভরে শ্বাস টানল সে। ডাকাতরা কেন সদয় হয়েছে তা বুঝতে পারল না।
ছেড়ে দিলেও রামুর পিছু-পিছু ছায়ার মতো একজন পাহারাদার রেখেছে। এরা। ভাঙা প্রকাণ্ড বাড়িটার সব জায়গায় যাওয়া বারণ। লোকটা মাঝে-মাঝে পিছন থেকে সাবধান করে দিচ্ছে, “ওদিকে যেও না খোকা। না না, ওই কুঠুরিতে উঁকি মেরো না।”
ঘুরতে ঘুরতে নয়নদার সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল রামুর। নয়নকাজল দিব্যি হাসিমুখে পিছন দিককার একটা বাগনে রোদে বসে গায়ে সর্ষের তেল মালিশ করতে করতে একজন রোগা-পটকা পশ্চিমা ডাকাতের সঙ্গে ভাঙা হিন্দিতে কথা বলছিল। “ছাপরা জিলা হাম খুব চিনতা। ওদিকে খুব ভাল দুধ মিলতা।”
রামু চেঁচিয়ে ডাকল, “নয়নদা।”
নয়ন একগাল হেসে বলল, “তোমাকেও ছেড়ে দিয়েছে? যাক বাবা! আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
রামু কাছে গিয়ে বসে একটু নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, কিংকর লোকটা কে বলো তো?”
নয়ন নিশ্চিন্ত গলায় বলে, “সাংঘাতিক ডাকাত। এ সাতনার চেয়েও ভয়ংকর।”
“তা তো বটে, কিন্তু তোমার চেনা-চেনা লাগছে না?”
নয়নকাজল একটু ভেবে বলল, “তুমি কথাটা বললে বলেই বলছি, আমারও মনে ওরকম একটা ভাব হয়েছিল। লোকটাকে যেন কোথায় দেখেছি। তারপর ভাবলাম, দেখলেও সে-কথা মনে না রাখাই ভাল। লোকটা এক নম্বরের বিশ্বাসঘাতক। আমাদের কাল রাতে ধরিয়ে দিল। আর-একটু হলেই পালাতে পারতাম।”
রামু বিষণ্ণ মুখে বলে, “পালিয়ে লাভটা কী হত? বাড়ি গিয়েও তো রক্ষা পেতাম না। তুমিও না, আমিও না।”
নয়ন চিন্তিত মুখে বলে, “তা বটে।”
“লোকটা হয়তো আমাদের ভালর জন্যই ধরিয়ে দিয়েছে। হয়তো এর পিছনে কোনো কারণ আছে। লোকটা জানত, পালিয়েও আমরা বেশিদূর যেতে পারব না। গেলেও বাঁচব না এদের হাত থেকে।”
নয়ন খুব মিনমিন করে বলল, “আমি অত ভেবে দেখিনি। কিন্তু এখন তুমি বলার পর দ্যাখো ভয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।”
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে নয়নদা, কিংকর লোকটা আমাদের শত্রু নয়।”
“না হলেই ভাল। ওরকম লোক যার শত্রু হবে, তার অনেক বিপদ।”
দুপুরে স্নান করে রামু আর নয়ন একটা ছোটোখাটো ভোজ খেল আজ। নতুন একটা ঘরে খড়ের ওপর পাতা নরম বিছানায় দুজনে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে নিল অনেকক্ষণ। কাল রাতে অনিদ্রা গেছে। যখন উঠল, তখন বেলা ফুরিয়ে এসেছে। রামু দেখল তার বালিশের পাশে একটা ছোট্ট চিরকুট এক টুকরো পাথর চাপা দেওয়া। তাতে লেখা, “আজ রাতে সজাগ থেকো।”
আশা আর ভরসায় রামুর বুক ভরে উঠল। সে নয়নকাজলকে ঠেলে তুলে দিল। তারপর চিরকুটটা দেখিয়ে বলল, “আমার মনে হয় এটাও সেই কিংকরের কাজ।”
ঠিক রাত দুটোয় সানা চোর-কুঠুরিতে হাজির হল। সারাদিন কেঁদে কেঁদে তার চোখ লাল। মুখের চামড়া ঝুলে পড়েছে কিছুটা। বেশ নড়বড়ে আর বুড়ো দেখাচ্ছে দানবের মতো লোকটাকে।
চোর-কুঠুরিতে কোনো আলো নেই। জমাট অন্ধকার। কিন্তু সাতনা মৃদু একটু শ্বাসের শব্দ শুনে বুঝল, কিংকরও হাজির।
গলা খাঁকারি দিয়ে সাতনা ডাকে, “কিংকর। “বলো।”
“এখানে নয়। বড় সর্দারের হাজারটা চোখ, হাজারটা কান। চলো, জঙ্গলের দিকে যাই।”
“তথাস্ত। তোমার লোকজন আজ কেমন পাহারা দিচ্ছে?”
“পাহারা নেই। বেশির ভাগই গেছে কাছের একটা গঞ্জে ডাকাতি করতে। বাদবাকিদের আমি ছুটি দিয়েছি।”
“তাহলে চলো।”
দুজনে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে। তারপর আগে সাতনা এবং তার পিছনে কিংকর ছায়ার মতো জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে।
নিস্তব্ধ জঙ্গলাকীর্ণ একটা জায়গায় এসে দুজনে দাঁড়ায়।
সাতনা বসে। মুখোমুখি কিংকর। সাতনা বলে, “আমি রাজি।”
“ভাল করে ভেবে বলো।”
“ভেবেই বলছি। দুনিয়ায় ওই মেয়েটা ছাড়া আমার কেউ নেই। মেয়েটা চুরি যাওয়ার পর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার মাথায় খুন চেপেছিল। সারকাস ছেড়ে ডাকাতের দলে নাম লিখিয়েছিলাম। আজ সারাদিন ভেবে দেখলাম, মরতে একদিন হবেই। তার আগে যদি সুযোগ পাই, মেয়েটার একটা হিল্লে করে দিয়ে যাই। একবার তাকে চোখের দেখাও তো দেখতে পাব।”
“তা পাবে।”
“যখন ছোট্টটি ছিল, তখন সারাদিন আমার বুকের সঙ্গে লেগে থাকত মেয়েটা। মা-মরা মেয়ে। তাকে বুকে করে সারকাসের সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরতাম। মেয়েটাই ছিল আমার জীবন, আমার শ্বাসের বাতাস আমার নয়নের মণি।”
“জানি সাতনা।”
“সকলেই জানত। জানত, সাতনার মেয়েই সাতনার সর্বস্ব।”
“এবার বড় সর্দারের নামটা বলো সাতনা।” সাতনা একটু চমকে উঠল।
.
৩২.
সাতনার মতো ডাকাবুকো লোককে আঁতকে উঠতে দেখে একটু হাসল কিংকর। মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, “ভয় পাচ্ছ?” সাতনা চারদিকে ভাল করে চেয়ে দেখল। তারপর ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় বলল, “পাচ্ছি। আমার আয়ু আর বেশিদিন নয়। আজ অবধি সর্দারের চোখকে কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি। আমিও পারব না। তবু জেনেশুনে যে হাঁড়িকাঠে গলা দিচ্ছি, তার কারণ আমার কাছে আর নিজের প্রাণের দাম নেই। শুধু একটাই সাধ। মরার আগে যেন মেয়েটার মুখ একবার দেখে যেতে পারি।”
কিংকর একথার জবাব দিল না চট করে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, “তোমার কি ধারণা, সর্দার তোমার ওপর নজর রাখছে?”
সাতনা মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। কিন্তু মনে-মনে যেই ঠিক করেছি যে, সর্দারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব, তখনই মনে ভয়টা এল। কোন্ মানুষের মনে কী আছে তা সর্দার মুখ দেখলেই টের পায়।”
কিংকর মৃদুস্বরে বলল, “মানুষের মুখে যে তার মনের কথা লেখা থাকে। সর্দার তো আর অন্তর্যামী ভগবান নয়, সে শুধু তোমাদের চেয়ে আর এক ডিগ্রী বেশি চালাক। এ-লাইনে আমার গুরু হল শংকর মাঝি। সে তোমাদের মতো নোংরা ডাকাত নয়। টাকা-পয়সা সোনাদানায় লোভ নেই। সারাদিন জপ-তপ নাম-ধ্যান নিয়ে থাকে। লোকের ওপর কখনো খামোখা হামলা করে না। শুধু অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়ায়। লোভ-লালসা নেই বলে তার মনটাও পরিষ্কার। চোখটাও পরিষ্কার তোমাদের সর্দারের চেয়ে লোকের মন বোঝবার ক্ষমতাও তার বেশি। শংকর মাঝি একবার আমাকে বলেছিল, পাপী তাপী খুনে গুণ্ডা বা বদমাশদের ফাঁসিকাঠে ঝোলালে বা জেলে ভরে রাখলেই কি আর তাদের ঠিক-ঠিক সাজা হয় রে? লোকটার মনে অনুতাপ জাগাতে পারলে বরং সেইটেই ঠিক শাস্তি। একটা ডাকাতকে যদি ভালো করে তুলতে পারিস তবে দেখবি তার মত মানুষই হয় না।
সাতনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি শংকর মাঝির দলে কতদিন ছিলে?”
“বছর-দুই। তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি।”
সাতনা একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলে, “অনেক কিছু শিখেছ বটে, কিন্তু আগুন নিয়ে এই খেলাটা না খেললেও পারতে। আমার মেয়ের খবর এনে আমাকে দুর্বল করে ফেলেছ, কিন্তু তা বলে তো আর বড় সর্দারের মন গলবে না। তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর মন্ত্রটা কে তোমাকে এখন শেখাবে?”
কিংকর নির্ভীক গলায় বলে, “বড় সর্দার ভগবান নয়, আগেই বলেছি। যত ক্ষমতাই থাক, তারও কিছু দুর্বলতা আছে, ভয় আছে। একবার তার মুখোশটা খুলতে দাও, তখন দেখবে।”
মাথা নেড়ে সাতনা বলে, “মুখোশ বা মুখ কোষ্টা তা আমিও জানি না। শুধু জানি, সর্দার মস্ত তান্ত্রিক। মারণ উচাটন বশীকরণ সব জানে। মানুষের মনের কথা টের পায়। আর জানি, পুলিশ বা গভর্মেন্টের সাধ্য নেই যে তাকে ধরে। তুমি তার ডেরায় ঢুকে মস্ত ভুল করেছ। তুমি পুলিশের লোক গভর্মেণ্টের চর তা জানি না। শুধু জানি, যাই হয়ে থাকো, সর্দারের হাত থেকে রেহাই পাবে না।”
কিংকর হাত নেড়ে প্রসঙ্গটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার একটা শর্ত ছিল, নির্দোষ গোবিন্দ মাস্টারকে খুনের দায় থেকে রেহাই দিতে হবে। সেটা ভেবে দেখেছ?”
সাতনা বিষাক্ত গলায় বলল, “আমাকে তার জন্য কী করতে হবে।”
“দায়টা তোমাকে নিজের ঘাড়ে নিতে হবে।”
“নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু যে মামলা বহুকাল আগে চুকেবুকে গেছে, আসামির ফাঁসির হুকুম পর্যন্ত হয়ে গেছে তা আবার কেঁচে গণ্ডুষ করতে আদালত চাইবে কি? তা ছাড়া আমি স্বীকার করলেই তো হবে না, আদালত চাইবে প্রমাণ। তার ওপর আসামী জেলহাজত থেকে পালিয়েছে, সেটাও তোমত অপরাধ। পুলিশ তাকে এত সহজে ছাড়বে না।”
“সে আমরা বুঝব। তুমি তোমার কাজটুকু করলেই হবে।”
“করব। এখন আমাকে আমার মেয়ের কাছে নিয়ে চলো।”
ট্যাক থেকে একটা মস্ত পকেট-ঘড়ি বের করল কিংকর। ঝুঝকো অন্ধকারে অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ নজরে চেয়ে থেকে সময়টা ঠাহর করল। তারপর বলল, “আর আধঘণ্টা। তারপর কিছু কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ব দু’জনে।”
সাতনা সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, “সময় দেখলে কেন? কিসের আধঘণ্টা?”
কিংকর মৃদুস্বরে বলল, “তোমার যেমন দলবল আছে আমারও তেমনি একটা ছোট্ট দল আছে। তাদের আজ রাত্তিরে এখানে পৌঁছানোর কথা।”
সাতনা অস্ফুট একটা শব্দ করে দুহাতে মুখ ঢাকল। মিনিটখানেক বাদে মুখ তুলে বলল, “তার মানে কী? তুমি কি লড়াই করতে চাও?”
কিংকর মাথা নেড়ে বলল, “না। লড়াই হবে না। তোমার যে কয়জন স্যাঙাত আছে, তাদের ঠেকিয়ে রাখবে তুমি। আমরা বিনা লড়াইয়ে যুদ্ধ জিতে তোমাদের বেঁধে নিয়ে যাব। আর তাহলে বড় সর্দারের মনে তোমার সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ আসবে না।”
“বড় সর্দারকে কি ছেড়ে দেবে তাহলে?”
কিংকর অন্ধকারেও একটু হাসল। “না। বড় সর্দারের জন্য আমি তো রয়েছি।”
“কে বলল নেই?” কিংকর আবার একটু হাসে। মৃদুস্বরে বলে, “আমি যে বড় সর্দারের গায়ের গন্ধ পাচ্ছি।”
আর ঠিক এই সময়ে একটা মস্ত কণ্টিকারির ঝোঁপের ওপাশ থেকে একটা ভারী পায়ের শব্দ আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে লাগল।
সাতনা পাথর হয়ে বসে থাকে। কিছুক্ষণ শ্বাস ফেলতে পর্যন্ত ভুলে যায়। কিংকর মৃদু হেসে বলে, “কী হে, বিশ্বাস হল?” সানার মুখে বিস্ময়ে কথা এল না। শুধু মাথা নাড়ল।
কিংকর স্বাভাবিক গলাতেই বলে, “তোমার মতো সর্দারও আমাকে বিশ্বাস করেনি। সারাক্ষণই আবডাল থেকে নজর রেখেছিল।”
“তবু ভয় পাচ্ছ না?”
“না। কিন্তু আমার আর সময় নেই। তুমি ওঠো, স্যাঙাতদের গিয়ে বলল, গায় একটা ছোটখাটো হামলা হবে। তারা যেন বাধা না দেয়। বাধা দিলে রক্তের গাঙ হয়ে যাবে।”
সাতনা উঠল। অসহায়ভাবে বলল, “আর বড় সর্দার?”
“তার কথা আমার খেয়াল আছে। তুমি ভেবো না। যাও।” সাতনা দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে ভাঙা কেল্লার দিকে এগোতে লাগল।
তার ছায়ামূর্তির দিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইল কিংকর। তারপর ট্যাকঘড়িটা আর-একবার দেখে নিয়ে খুব টানা নিচু পর্দায় একটা শিস দিল। এমনই সে শব্দ যে, জঙ্গলের অন্যান্য শব্দের মধ্যে ঠিক ঠাহর হয় না।
শিসটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঘুঘুর ডাক ভেসে এল কাছ থেকে। নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলল কিংকর। তার দল এসে গেছে।
কিংকর উঠে চকিত-পায়ে কেল্লার দক্ষিণ কোণের দিকে চলে এল। ভাঙা ইদারার পাশে দুটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে।
কিংকর সাবধানী গলায় ডাকল, “রামু।”
“আজ্ঞে।”
“এসো।” বলে কিংকর হাত বাড়িয়ে রামুর একটা হাত ধরে। রামুর পিছনে নয়নকাজল দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে কাকাতুয়ার দাঁড়। কাঁপা-কাঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করল, “আবার আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সেদিনকার মতো নতুন কোনো বিপদে পড়ব না তো?”
কিংকর একটু হেসে বলে, “না। বিপদের মধ্যেই তো আছে। বিপদকে ভয় করলে কি চলে?”
ধীরে ধীরে তিনজন গভীর জঙ্গলের দিকে এগোতে থাকে। অন্যদিক দিয়ে দশ-বারোটা ছায়ামূর্তি দ্রুত পায়ে নিঃশব্দে কেল্লায় গিয়ে ঢোকে।
একটা বাঁশঝাড় গোল হয়ে একটা চত্বরকে ঘিরে রেখেছে। বাইরে থেকে ভিতরকার ফাঁকা জায়গাটা বোঝা যায় না। কিংকর সেইখানে এনে রামু আর নয়নকাজলকে দাঁড় করাল! বলল, “আমার একটা কাজ বাকি আছে। সেটুকু সেরেই আসছি।”
নয়নকাজল উদ্বেগের গলায় বলে, “যদি কোনো বিপদ হয় এর মধ্যে?”
“তাহলে, ভগবান দুখানা পা তো দিয়েছেন, দৌড় মেরো।”
কিংকর আর দাঁড়ায় না। অতি দ্রুত পায়ে সে দৌড়তে থাকে কেল্লার দিকে। যেতে-যেতেই দেখে, দশ-বারোজন লোক পাঁচ-সাতজন লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে আর ভ্রুক্ষেপ করে না কিংকর।
কেল্লায় ঢুকে সে জোর কদমে ছুটে একদম বায়ুকোণে চলে আসে। পুরনো ভাঙা খিলান গম্বুজের ভিতর একটা মিনার। তাতে ঢোকার কোনো রাস্তা নেই। কিন্তু কিংকর দিনের বেলায় লক্ষ্য করেছে এই মিনারের গায়ের কারুকাজ একটু অন্যরকম। খাঁজগুলো কিছু বেশি গভীর।
চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে কিংকর বানরের মতো সেই খাঁজগুলোয় হাত আর পা রেখে উঠে যেতে থাকে ওপরে।
কিন্তু বেশিদূর উঠতে হয় না তাকে। উপর থেকে একটা ঝাঁঝালো টর্চের আলো এসে পড়ে তার ওপর। আর সেইসঙ্গে একটা গুলির শব্দ।
.
৩৩.
গুলিটা একেবারে চুল ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। প্রাণের ভয়ে অনেকটা উঁচু থেকেই কিংকর লাফ দিয়ে নীচে পড়ল। একটা ভেঙে পড়া থামের আড়ালে গা ঢাকা দিতে যাবে, তার আগেই পরপর আরও দুটো গুলি। তবে মিনারের মাথা থেকে এত দূরের পাল্লায় রিভলবারের গুলি ততটা বিপজ্জনক নয়। রাইফেল হলে এতক্ষণে কিংকর ছ্যাঁদা হয়ে যেত।
থামের আড়াল থেকে মিনারের মাথাটা লক্ষ্য করল কিংকর। অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। শুধু বোঝা যায়, একটা মস্ত মানুষের ছায়ামূর্তি একটু ঝুঁকে নীচের দিকে নজর রাখছে। টর্চটা মাঝে-মাঝে ঝিকিয়ে চারদিকে আলো এসে পড়ছে কিংকরের।
হঠাৎ কিংকরের কাঁধে একটা ভারী হাত আলতো করে রাখল কেউ। একটু চমকে উঠেছিল কিংকর। পিছন থেকে একটা ভারী গলা তার কানে কানে বলল, “সর্দারকে অত সহজে বাগে আনতে পারবে না।”
“সাতনা! তুমি এখনো যাওনি?”
“আমি গেলে সর্দারকে লড়াই দেবে কে? একা তোমার কর্ম নয়।”
“মিনারের ওপর লোকটাই কি সর্দার?”
“হ্যাঁ। সর্দারের আজ এখানে থাকার কথা নয়। কিন্তু কিছু একটা আঁচ পেয়ে সর্দার আবার ফিরে এসেছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। আমার সঙ্গে এসো।”
“কোথায়?”
“কাকাতুয়ার কাছে। একমাত্র কাকাতুয়াটাই জানে ওই মিনারে ঢোকার গুপ্ত পথ। আমরা অনেকদিন ধরে তাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছি কিন্তু পাখিটা বলেনি। এখন শেষ চেষ্টা করে দ্যাখো, যদি তাকে দিয়ে কথা বলাতে পারো।”
“কিন্তু সর্দার যদি পালায়?”
“গুপ্তধন না নিয়ে সর্দার পালাবে না। ও এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া খুবই কঠিন। মই লাগিয়ে আমরা প্রত্যেকটা মিনারের মাথায় চড়েছি। আশ্চর্য এই যে, তিনটে মিনারের মাথায় গুপ্ত সুড়ঙ্গের মুখও মিলেছে। সেই পথ ধরে আমরা পাতালেও নেমেছি। কিন্তু বৃথা। গোলকধাঁধার মতো কিছু গলিখুঁজি ছাড়া আর কিছু পাইনি। এই মিনারের সুড়ঙ্গটাও তাই। তবু সর্দার শেষ চেষ্টা করতে ওখানে উঠেছে। সহজে পালাবে না।”
কিংকর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লোভই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। সে বলল, “কাকাতুয়াটা রামু আর নয়নকাজলের কাছে আছে। চলো।”
বাঁশবনে ঘেরা নিরাপদ জায়গাটায় পৌঁছে তারা দেখল, দুজন জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। দাঁড়ে বসে ঝিমোচ্ছে কাকাতুয়া। টর্চের আলো চোখে পড়তেই ডানা ঝাঁপটে বলে উঠল, “মেরো না, মেরো না আমাকে বিশু।”
“সবাই পাখিটার কাছে গুপ্তধনের সন্ধান জানতে চেয়েছে। পাখিটা বলেনি। কিংকর এবার পাখিটার সামনে বসে খুব আদরের গলায় বলল, “না না, বিশু তোমাকে মারবে না।”
পাখিটা ডানা ঝাঁপটে বলে, “আলমারিতে টাকা নেই। টাকা আছে…।”
কিংকর চাপা গলায় বলে, “বোলো না, বোলো না, টাকার কথা বোলো না।”
পাখিটা আবার ডানা ঝাঁপটায়। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, “তিন নম্বর মিনার। পাথর সরাও, পাথর সরাও।”
“পাথর নেই।”
“তলার দিকে। পাথরে চিহ্ন আছে।” কিছুক্ষণ কেউ কথা বলতে পারল না। তারপর কিংকর উঠে দাঁড়াল। সানা বলল, “তিন নম্বর মিনারের মাথাতেই এখন সর্দার থানা গেড়েছে।”
কিংকর মৃদু হেসে বলে, “মিনারে চড়তে হবে না। পাখি কী বলল শুনলে তো। মিনারের গোড়ায় আর একটা পথ আছে। চলো! যদি পারো একটা শাবল নিয়ে এসো চট করে।”
দুজনে যখন আবার মিনারটার কাছে এল, তখন ওপরটা অন্ধকার। কোনো ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে না।
মিনারের গোড়ার দিকে চৌকো-চৌকো পাথর গাঁথা। তার ওপর নকশা। টর্চ জ্বেলে কিংকর পরীক্ষা করে দেখল, সব নকশাই একরকম। কোন্টা নির্দিষ্ট পাথর এবং তাতে কী চিহ্ন আছে তা বোঝা মুশকিল। কিংকর হাঁটু গেড়ে বসে তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে থাকে। বহু পুরনো আমলের নকশাগুলো সব ক্ষয় হয়ে এসেছে। তবু কিংকর বুঝবার চেষ্টা করে।
আচমকা ওপর থেকে আবার এক ঝলক টর্চের আলো এসে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে গুলির আওয়াজ। দুজনের খুব কাছাকাছিই গুলি দুটো মাটিতে গেঁথে যায়। সাতনা অন্ধকারে কী একটা জিনিস মাথার ওপর তুলে ধরে। কিংকর তাকিয়ে দেখে, মস্ত একটা লোহার ঢাল। ছাতার মতো বড়। পুরনো আমলের ভারী জিনিস দেখে একটু হাসে সে, সাতনার বুদ্ধি আছে।
ওপর থেকে পর-পর আরো দশ-বারোটা গুলি ছুটে আসে। দু-চারটে টকাটক ঢালের ওপরও এসে পড়ে।
সাতনা চাপা গলায় বলে, “সর্দার নেমে আসছে মনে হয়। তাড়াতাড়ি করো।”
কিংকর নিশ্চিন্ত গলায় বলে, “আমরা দুজন, ও একা। ভয় কী?”
সাতনা মৃদু একটু হেসে বলে, “সর্দারকে চেনো না তাই বলছ। দু-দশ জনের মহড়া নেওয়া সর্দারের কাছে জলভাত। আমার এই লোহার মতো। পাঞ্জা একবার সর্দার একটু চেপে ধরেছিল। তখনই বুঝেছিলুম, এর সঙ্গে ইয়ার্কি নয়।”
কিংকর এসব কথায় কান দেয় না। মন দিয়ে খুঁজতে থাকে। অনেক নিরিখ-পরখ করে তার মনে হয়, একটা পাথরের একটা কোনায় যেন খুব অস্পষ্ট একটা তীরের চিহ্ন আছে। খুবই অস্পষ্ট আন্দাজ। তবু এখন অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া ছাড়া উপায়ও তো নেই। শাবলটা পাথরের খাঁজে ঢুকিয়ে গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে চাড় দিতে লাগল সে।
ঠিক এই সময়ে হাত দশেক ওপর থেকে সর্দারের রিভলবার দু ঝলক আগুন ওগরায়। এখন এত কাছ থেকে তার নিশানা ভুল হয় না। ঢাল ঘেঁষে দুটো গুলিই কিংকরের পায়ের কাছে গেঁথে যায় মাটিতে।
কিংকর মুখ তুলে সাতনাকে বলে, “হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? পালটা গুলি চালাও।”
সাতনা মাথা নেড়ে বলে, “তা হয় না। ভাল যোক মন্দ হোক, সর্দার আমার গুরু। তাকে মারতে পারব না।”
কিংকর হাত বাড়িয়ে বলে, “তবে আমাকে অস্তরটা দাও।”
“তাও হয় না। আমার অস্ত্র দিয়ে ওকে মারা চলবে না।”
“তা বলে ওই পাষণ্ডটার হাতে মরবে নাকি?”
“আমার চেয়ে সর্দার তো বেশি পাষণ্ড নয়। দুজনেই সমান পাপী, তাহলে কে কার বিচার করবে বলো!”
ঢালের আড়াল থেকে খুব সাবধানে মুখ বের করে কিংকর ওপরের দিকে চেয়ে দেখল একটু। প্রকাণ্ড একটা ছায়ামূর্তি প্রায় বাদুড়ের মতো ঝুলে ঝুলে নেমে আসছে। মিনারের অগভীর খাঁজে স্রেফ আঙুলের সাহায্যে শরীরের ভার নিয়ে নেমে আসা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ কাজ পারে সার্কাসের বাজিকররা। সর্দার নামছেও বেশ তাড়াতাড়ি। একবার থেমে একটা হাত ঘুরিয়ে নীচের দিকে তাক করল যেন। সাঁত করে ঢালের আড়ালে মাথা টেনে নেয় কিংকর। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি এসে মাটি ছিটকে দেয় খানিকটা। একটা রিভলবারে এত গুলি থাকার কথা নয়। কিংকর অনুমান করল, সর্দারের কোমরে অন্তত গোটা চারেক রিভলবার আছে। একটার গুলি ফুরোলে আর একটা চালাচ্ছে।
শাবলে আর একটা চাড় দিতেই পাথরটা নড়ে উঠল। শাবল টেনে নিয়ে পাথরের অন্য ধারে ঢুকিয়ে আবার চাড় দেয় কিংকর। পাথরটা আলগা হয়ে ঢকঢক করে নড়ে। শাবল ফেলে দু হাতে মত পাথরের চাইকে ধরে টান দেয় কিংকর।
ধড়াম করে পাথরটা খসে পড়ে মাটিতে। আর সেই মুহূর্তে প্রকাণ্ড বাঘের মতো সর্দারও লাফ দিয়ে নামে নীচে। নেমেই রিভলভার তুলে বিকট গলায় হাঁক দেয়, “খবর্দার! প্রাণে বাঁচতে চাস তো পালা। মাত্র দশ সেকেণ্ড সময় দেব। পালা!”
ঢালের নিরাপদ আড়ালে থেকেও সেই স্বরে একটু কেঁপে ওঠে সাতনা। কিন্তু কিংকর কাপে না। পাথরটা হঠাৎ খসে আসার ফলে টাল সামলাতে না পেরে সেও পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। কিন্তু খাড়া হওয়ার কোনো চেষ্টা না করে সে নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে মিনারের আড়ালে সরে গেল। সর্দার বোকা নয়। দশ দিকে তার চোখ ঘোরে। তবু কিংকর শেষ একটা চেষ্টা করতে চায়। লোভে আর উত্তেজনায় এখন হয়তো সর্দারের মাথার ঠিক নেই।
সর্দার গম্ভীর গলায় বলে, “সাতনা পিস্তল ফেলে দে।”
সাতনা কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, “সর্দার, তোমাকে গুরু বলে মানি। কিন্তু জান নিয়ে টানাটানি হলে আমাকেও অস্ত্র ধরতে হবে।”
সর্দার একটা পেল্লায় মাটি কাঁপানো ধমক দিয়ে বলে, “চোপ শয়তান। সর্দারের পিছন থেকে ছোবল মারতে চেয়েছিলি, তার সাজা কী জানিস?”
“জানি।”
“সেই ছুঁচো কিংকরটা কোথায়?”
“আমার সঙ্গেই আছে।”
“যদি নিজের ভাল চাস তো সরে যা। আগে ওটাকে খুন করব। তোর বিচার তার পরে।”
সাতনা নরম গলায় বলল, “শোনো সর্দার। তোমাকে আমি তোমাকে আমি এমনিতে মারতে পারি না। সেটা অধর্ম হবে। তবে যদি একই জমিতে দাঁড়িয়ে ভগবানের আকাশের নীচে আমাদের মারার চেষ্টা করো, তাহলে কিন্তু গুলি তোমার দিকেও ছুটবে। রিভলবার আমার হাতেও তৈরি।”
সর্দার একটু চুপ করে থেকে এক পর্দা গলা নামিয়ে বলে, “মেয়ের কথা ভেবে তুই দুর্বল হয়ে পড়েছিলি। তোর মাথা গুলিয়ে গেছে। সেইজন্য তোকে আমি এবারের মতো মাপ করে দিচ্ছি। একটা কথা মনে রাখিস, কাছেপিঠের একশো গাঁয়ে আমার চর আছে। তোর মেয়ে যদি বেঁচে থাকে, তবে তাকে আমি খুঁজে দেব। ভাবিস না।”
হামাগুড়ি দিয়ে মিনারের ও-পিঠে চলে এসেছে কিংকর। সর্দারের পিছন দিকে মাত্র হাত পাঁচেকের মধ্যে এসে থেমেছে সে। অপেক্ষা করছে।
সর্দার সাতনার দিকে এক পা এগিয়ে গেল। বলল, “সাতনা, এখনো বলছি, ফিরে আয় আমার দিকে। গুপ্তধনের পথ মিলেছে। দুজনে মিলে ভাগ করে নেব। আর উঞ্ছবৃত্তি করতে হবে না।”
সাতনা এক-পা পিছু হটে বলে, “দল ভেঙে দেবে?”
“দিতেই হবে। ডাকতরা চিরকাল ডাকাত থাকে না। দুনিয়ার নিয়মে ভোল পালটাতে হয়।”
সাতনা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, “তুমি ভোল পালটাতে পারো সর্দার, কারণ তোমার আসল পরিচয় আজও কেউ জানে না। কিন্তু আমরা দাগি লোক, আমরা ভোল পালটাতে চাইলেও পারব না।”
অসাবধানে সানা ভারী ঢালটা এক হাত থেকে অন্য হাতে নিতে গিয়েছিল। পলকের সেই অসতর্কতাই কাল হল তার। সর্দারের রিভলভার গর্জে উঠল। একটা নয়, দু হাতে দুটো।
“আঃ!” বলে চেঁচিয়ে সাতনা উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। ঢালটা ছিটকে গেছে একধারে। আর আড়াল নেই।
সর্দার রিভলভার তুলে ভাল করে নিশানা করছে। আর তখনই তার ঘারে চিতাবাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল কিংকর।
.
৩৪.
কিংকর ঝাঁপিয়ে পড়ল বটে কিন্তু সর্দারকে নাগালে পেল না। সর্দার তো সোজা লোক নয়, সাতনার মতো দানবও তাকে খামোখা সমঝে চলে না। পিছন দিকে যেন-বা সত্যিই তার আর দুটো চোখ আছে। কিংকরও কঁপ দিয়েছে, তৎক্ষণাৎ সর্দারও তড়িৎগতিতে সরে গেছে। কিংকর পড়ল মাটিতে, মুখ থুবড়ে।
সর্দার তার রিভলভার সোজা কিংকরের মাথায় তাক করে সাতনাকে বলল, “তোর অস্ত্র ফেলে দে। নইলে তোর এই প্রাণের ইয়ারকে শেষ করে দেব।”
সাতনা কিংকরের অবস্থাটা দেখল। বোকার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পস্তাচ্ছে। কিংকর সর্দারের হাত মারা পড়লে সাতনার শোক করার কিছু নেই। কিন্তু ভয় একটাই। কিংকর মরলে জীবনেও আর মেয়েটার খোঁজ পাওয়া যাবে না। সাতনার এখন ধ্যানজ্ঞান তার মেয়ে। একবারে তাকে চোখের দেখা দেখতেই হবে। তারপর মরে গেলেও দুঃখ নেই। কিন্তু এখন যে সংকটে তারা রয়েছে তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আশা দেখছে না সাতনা। সর্দারের হাতে দুজনকেই না মরতে হয়।
সাতনা জানে, সর্দারকে গুলি করার উপায় নেই। এখন আর গুরু বলে সর্দারকে খাতির না করলেও চলে। কারণ সর্দার বিনা কারণে তার দিকে গুলি চালিয়েছে। এখন উলটে গুলি চালালে সাতনার অপরাধ হয় না। কিন্তু তাও সম্ভব নয়। একটু নড়লেই কিংকরের মাথাটা সর্দারের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। আর অস্ত্র ৫ ল দিলেও যে রেহাই পাওয়া যাবে তা নয়। সর্দার দুজনকেই মারবে। সুতরাং এই শীতেও সাতনা ঘামতে লাগল।
সর্দার দুম করে একটা গুলি চালিয়ে দিল। কিংকরের মাথার মাটি ছিটকে গেল খানিকটা। একটু হেসে সর্দার বলে, “এখনো ভেবে দেখ সাতনা, খুব। বেশি সময় পাবি না। পরের গুলিটা ওর খুলি ফাটিয়ে দেবে।”
সর্দারের মস্ত টর্চের আলো অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে কিংকরের চারধারে। সেই আলোয় সাতনাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সাতনার আর সর্দারের মাঝখানে কেবল একটা বেঁটে কামিনীঝোঁপ। সাতনা ক্ষীণ স্বরে বলল, “দিচ্ছি।”
কিংকরের নড়াচড়ার নাম নেই। এমন ভঙ্গিতে শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে, যেন বা একটু বাদেই ওর নাকের ডাক শোনা যাবে। অসহায় সাতনা তার আগ্নেয়াস্ত্রটা সর্দারের পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
বেচারা! প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই রিভলভার থেকে আগুন ঝাঁকিয়ে ওঠে। সাতনা তার পাঁজর চেপে ধরে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সর্দারের রিভলভারের নল চকিতে কিংকরের দিকে ফেরে।
চোখে পলক ফেলার মত একটুখানি দেরি হলে হয়তো কিংকর বেঁচে থাকত না। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে নির্ভুল নিশানায় একটা হট সাঁ করে সর্দারের কপালে লাগে। সর্দার থমকে যায়। বাঁ হাতখানা কপালে চেপে ধরে। কিন্তু পড়েও যায় না, মূৰ্ছাও হয় না।
ততক্ষণে কিংকর উঠে দাঁড়িয়েছে। খুব-একটা তাড়াহুড়ো করল না সে। শাবলটা কুড়িয়ে নিল শান্তবাবে। তারপর সর্দারের ডান হাতের কব্জিতে আলতোভাবে মারল। রিভলভারটা পড়ে গেল। দু-পা এগিয়ে কিংকর সর্দারের মুখে একখানা ঘুষি চালাল।
সর্দার পড়ল না। এমন কি নড়লও না এতটুকু। হাত বাড়িয়ে সে কিংকরকে প্রায় মাথার ওপর তুলে ছুঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করল দূরে। কিন্তু কিংকর তো ঘাসজলে খায় না। সর্দার যখন তাকে দুহাতে টেনে ওপরে তুলছে তখনই সে তার দুখানা পায়ে ফুটবল-খেলোয়াড়ের মতো দুটে শট কষাল সর্দারের মুখে আর পেটে।
সেই দুটো লাথিতে যে-কোন শক্তসমর্থ লোকেরও জমি নেওয়া উচিত। কিন্তু সর্দারের কাছে তা বোধহয় পিঁপড়ে কামড়ের শামিল। সে শুধু ‘উম’ করে একটা বিরক্তির শব্দ করল। তারপরই উলটে এক ঘুষি মারল কিংকরকে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে মুখটা সরিয়ে নিয়েছিল কিংকর।
তারপরই শুরু হল দুজনের ধুন্ধুমার লড়াই।
কে জিতত, কে হারত তা বলা মুশকির। কিন্তু হঠাৎ ঘটনাস্থলে আর একজন লোকের আবির্ভাব হল। মজবুত গড়ন। মাঝারি লম্বা। সে এসেই একটানে কিংকরকে সরিয়ে আনল সর্দারের থাবা থেকে। তারপর নিজে লাফিয়ে পড়ল সর্দারের ওপরে।
এই দু’নম্বর লোকটা লড়তে জানে। মিনিটদুয়েক পরই দেখা গেল, সর্দার হাঁফাচ্ছে। লড়াইয়ের তাল পাচ্ছে না। যতবার ঘুষি লাথি চালায় ততবার তা বাতাস কেটে বেরিয়ে যায়। কুস্তির প্যাঁচে যতবার লোকটাকে কাবু করার চেষ্টা করে ততবার লোকটার পাচে পড়ে যায়।
কিংকরের দম শেষ। সে হাঁফাতে হাঁফাতে কিছুক্ষণ দম নিয়ে টর্চ আর রিভলভার তুলে নেয় মাটি থেকে। দুটোই সর্দারের। রিভলভারটা তুলে ধরে সে আদেশ দেয়, “সর্দার, লড়াই ছাড়ো। ধরা দাও।”
সর্দার একবার তার দিকে তাকায়। তারপর আচমকা প্রতিপক্ষকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিচু হয়ে ভোজবাজির মতো জঙ্গলের আবছা অন্ধকারে মিলিয়ে যায় চোখের পলকে।
কয়েক মুহূর্ত বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে কিংকর সর্দারের অনুসরণ করার জন্য পা বাড়ায়। সেই সময়ে কামিনীঝোঁপের ওপাশ থেকে চলতে চলতে উঠে দাঁড়ায় সাতনা। টর্চের আলোয় দেখা যায়, রক্তে তার বুকের বাঁদিক ভেসে যাচ্ছে। বুকে হাত চেপে ধরে সাতনা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, “সর্দারের রনপা আছে। পশ্চিমধারে একটা শুড়ি পথ ধরতে হলে সেদিকে যাও, সাবধান।” ….বলে সাতনা আবার ঢলে পড়ে।
কিংকর আর দু’নম্বর লোকটা তৎক্ষণাৎ পশ্চিমদিকে ছুটে যায়।
শুড়ি পথটার ধারেই জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। রামু আর নয়নকাজল। রামুর হাতে কয়েকটা আধলা ইট।
নয়ন বলল, “তোমার ঢিলটা সর্দারের কপালে লেগেছে। নইলে এতক্ষণে কিংকরের হয়ে যেত। কী টিপ তোমার! আর কি সাহস!”
রামু রাগের গলায় বলে, “কিন্তু তুমি অত কাপছ কেন? এত ভয়টা কিসের?”
“ও বাবা! এরা সব সাংঘাতিক লোক। ঢিলটা মেরে তুমি ভাল কাজ করোনি। সর্দার জানতে পারলে তোমাকে আঁস্ত রাখবে না।
“অত সস্তা নয়। তুমি চুপ করে থাকো তো।”
“দেখলে তো নিজের চোখে তিন-তিনটে জোয়ান সর্দারকে কাবু করতে পারল না। তুমি বাচ্চা ছেলে কী করতে পারবে?”
“আর কিছু না করতে পারি ঢিল মারতে পারব। তুমি অত ভয় পেয়ে।”
নয়ন মাথা চুলকে বলে, “বুঝলে দাদাবাবু, আমি খুব-একটা ভিতু ছিলুম। এই ডাকাত হওয়ার পর থেকেই ভয়টা বেড়েছে। ওরে বাপরে! ওটা কি! রাম রাম বলতে বলতে নয়ন মাটিতে বসে দু’হাতে মুখ ঢাকে।
রামু প্রথমটায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। ভাল করে তাকিয়ে দেখল, শুড়ি পথটার মুখে ভীষণ ঢ্যাঙা এক মূর্তি হনহন করে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। কম করেও বারো ফুট লম্বা। আবছায়ায় ভাল দেখা যায় না। কিন্তু ভুল নেই।
রামুর রনপায়ে চড়া অভ্যেস আছে। সুতরাং প্রথমটায় ঘাবড়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। সর্দার রনপায়ে চড়ে পালাচ্ছে।
রামু শুড়ি পাথটার মাঝখানে এগিয়ে গিয়ে মূর্তিটার মুখোমুখি দাঁড়াল। তারপর বোঁ-বোঁ করে তার দুটো ঢিল ছুটে গেল নির্ভুল নিশানায়।
রনপায়ে লোকটা একটু থমকে গেল। রামু ভেবেছিল, বুঝি লাগেনি। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে মূর্তিটা হঠাৎ টলতে টলতে ধড়াস করে পড়ে গেল।
সেই সঙ্গেই ছুটে এল কিংকর আর সেই লোকটা। কিংকরের হাতে টর্চ। কিংকর চেঁচিয়ে বলল, “শাবাশ রামু!”
একটু বাদে সকলেই ঘিরে দাঁড়াল সংজ্ঞাহীন সর্দারকে। কিংকর শক্ত দড়ি এনে সর্দারের হাত-পা বেঁধে ফেলে। বলে, “বড় সাংঘাতিক লোক, বাঁধা না থাকলে জ্ঞান ফিরে আসার পরই গণ্ডগোল পাকাবে।”
রক্তাম্বর এবং দাড়িগোঁফে সর্দারকে বাঁধা অবস্থাতেও ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
দ্বিতীয় লোকটা আসলে গোবিন্দ। সে এসে রামুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার এলেম আছে। আমার যা বিদ্যে সব তোমাকে শিখিয়ে দেব।”
রামু মুখ তুলে বলে, তুমি একা কেন গোবিন্দদা? গবাদা আসেনি।”
মৃদু একটু হেসে গোবিন্দ বলে, “গবাদাও এসেছে। একটু তফাতে আছে। পাগল মানুষ তো। এসে পড়বে কিছুক্ষণ বাদে।”
কিংকর সর্দারকে বাঁধার পর মুখের ওপর ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে তার নকল দাড়িগোঁফ টেনে খুলছিল। খুলতে খুলতে বলল, “এ লোকটাও চেনা লোক। কিন্তু কিছু করার নেই। ধরিয়ে দিলেও কেউ বিশ্বাস করবে না যে, এ সর্দার ছিল।”
“নিজেই দ্যাখো।”
রামু টর্চের আলোয় দাড়িগোঁফহীন সর্দারের মুখের দিকে চেয়ে হাঁ হয়ে যায়। এ যে আন্দামান আর নিকোবরের বাবা, দারোগা কুন্দকুসুম।
রামু কঁপতে কাঁপতে বলে, “ইনিই সর্দার?” কিংকর মাথা নাড়ে, “ইনিই।”
.
৩৫.
কুন্দকুসুম যখন চোখ মেলে তাকাল, তখনো সকলের অবাক ভাবটা যায়নি, যাকে বলা যায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। হাত-পা-বাঁধা কুন্দকুসুম কিন্তু একটুও ঘাবড়াল না। চারদিকে চেয়ে নিজের অবস্থাটা একটু বুঝে নিল কয়েক সেকেণ্ডে। কিংকরের হাতে একটা মশাল জ্বলছে। তার মস্ত আলোয় সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কুন্দকুসুম রামুর দিকে চেয়ে মৃদু একটু হাসল। তারপর বলল, “তুমি উদ্ধববাবুর ছেলে রামু? আন্দামান আর নিকোবরের বন্ধু?”
রামু এত ঘাবড়ে গেছে যে, গলায় শব্দ এল না। শুধু মাথা নাড়ল।
কুন্দকুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তোমার টিপ খুব ভাল। আজ তোমার জন্যই সর্দার প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল আর কী! শেষ অবধি অবশ্য পালাতে পেরেছে। কিন্তু বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না।”
এ-কথা শুনে রামুর মাথা একদম গুলিয়ে গেল। বলে কী লোকটা? তাহলে কি কুন্দকুসুম সর্দার নয়?
কুন্দকুসুম চারদিকে আর-একবার চোখ বুলিয়ে রামুকে জিজ্ঞেস করে, “এরা সব কারা বলো তো! আর আমাকে এমনভাবে বেঁধেছেই বা কে? কার এত সাহস?”
গোবিন্দ একটু হেসে বলল, “সেলাম দারোগাসাহেব। কিছু মনে করবেন না, নিজেদের জান বাঁচাতে আপনাকে একটু বাঁধতে হয়েছে।”
কুন্দকুসুম একটা হুংকার দিয়ে বলে, “খুলে দে। তারপর দেখাই তোর ঘাড়ে কটা মাথা!”
“মাথা একটাই, তবে সেটা এত সস্তা নয়। আপনার তো অনেকগুলো মাথা আর মুখ। কখনো দারোগা, কখনো সর্দার। আপনার একটা মাথা গেলেও আর-একটা থাকবে।”
কুন্দকুসুম একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলে, “দারোগাদের মাঝে মাঝে ছদ্মবেশ ধরতেই হয়, তাতে আশ্চর্যের কী? আমি সর্দার এ কথা তোকে কে বলল রে মার্কেট?
“অত চিল্লাবেন না দারোগাবাবু। এখন আপনি একটু অসুবিধের মধ্যেই আছেন। আমরা ছাপোষা লোক সব, দারোবাবুকেও ভয় খাই, ডাকাতের সর্দারকেও ভয় খাই। কিন্তু আপনার স্যাঙাত সাতনা আপনার গুলি খেয়ে ভারী রেগে গেছে। জানেন তো বাঘ জখম হলে বড় বিপজ্জনক। সে এখন আপনাকে গুরু বলেও মানছে না, দারোগা বলেও মানছে না। আপনার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সে এল বলে।”
কুন্দকুসুমকে একটু অস্বস্তি বোধ করতে দেখা যায়। গলা এক পর্দা নামিয়ে বলে, “তোমরা বিশ্বাস করো, এই ডাকাতের দলটাকে অ্যারেস্ট করার জন্য গত তিনমাস ধরে চেষ্টা করছিলাম। আজই প্রথম এদের ডেরার পাকা সন্ধান পাই। আমার ফোর্স এই জঙ্গলটা ঘিরে আছে এখনও। আমি কাপালিকের ছদ্মবেশে–”
এতক্ষণ কিংকর একটাও কথা বলেনি। এবার সে হঠাৎ হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে। কুন্দকুসুম কটমট করে তার দিকে চায়।
কিংকর হাসি থামিয়ে বলে, “আমারও সেটা সন্দেহ হয়েছিল দারোগাবাবু, আপনি বোধহয় সর্দার নন। আসল সর্দার বোধ হয় সত্যিই পালিয়েছে। আপনাকে আমরা ছেড়েও দিতে চাই। তবে তার আগে আমাদের কয়েকটা কথা আছে।”
কুন্দকুসুম গম্ভীর হয়ে বলে, “বলে ফেল।”
কিংকর মাথা নেড়ে বলে, “আমার তেমন সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস নেই। কথা বলবে গবাদা। আমি তাকে ডেকে আনছি। এই বলে কিংকর জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল চকিত পায়ে।
কয়েক মিনিট বাদে একটু দূরে গবার গলা পাওয়া গেল। সে গান গাইছে? “বলো রে মন কালী কালী। আমার বুকটা করে ধুকুর পুকুর, পেটটা লাগে খালি-খালি। অধিক কী আর কবো রে ভাই, মনেতে মোর আনন্দ নাই। কত নাচন-কোঁদন দেখাইলাম রে, তবু দেয় না যে কেউ হাতে লি।”
সামনে এসেই গবা এক হাত জিব কেটে নিজের কান ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ, কী পাষণ্ড রে তোরা! বড়বাবুকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছিস! নরকে যাবি যে রে! খুলে দে! ওরে খুলে দে!”
গবা নিজেই নিচু হয়ে তাড়াতাড়ি কুকুসুমের বাঁধন খুলতে লেগে যায়।
রামু গবাকে দেখেও নড়ে না। তার মনের মধ্যে টিকটিক করে কী যেন একটা হতে থাকে। সে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে শুধু।
গবা কুকুসুমের হাতের বাঁধন খুলে ধরে-ধরে তাকে তুলে বসায়। তারপর সামনে ঢিপ করে মাথা ঠুকে বলে, “বড়বাবু, অপরাধ নেবেন না। ছেলেমানুষ সব, না-বুঝে করে ফেলেছে।”
কুন্দকুসুম গম্ভীর গলায় বলে, “।” গবা নিরীহ গলায় বলে, “মানুষ মাত্রেরই ভুল হয় আজ্ঞে।” কুন্দকুসুম বলে, “তা বটে…”
গবা হাতজোড় করে বলে, “তা সেই ভুলের কথাই বলছিলুম আর কী। ভুল কি দারোগা-পুলিশেরও হয় না? এই আমাদের গোবিন্দ মাস্টারের কথাই ধরুন না। খুন-টুন করার ছেলেই নয়। তবে ফেঁসে গেছে!”
“তাই নাকি?”
“একেবারে নির্যাস সত্যি কথা।” বলতে বলতে গবা কুকুসুমের পায়ের বাঁধনটা খুলবার চেষ্টা করতে করতে বলে, “এঃ, এই গিটটা বড় এঁটে বসেছে দেখছি। ওদিকে আবার সাতনাকেঁদেখে এলুম একটা খাঁড়ায় ধার দিচ্ছে। নাঃ বড় বিপদ দেখছি। পায়ের বাঁধনটা তাড়াতাড়ি না খুললেই নয়…”।
কুন্দকুসুম একটা ধমক দিয়ে বলে, “ইয়ার্কি রাখো। এটা ইয়ার্কির সময় নয়। কী চাও সেটা স্পষ্ট করে বলো।”
গবা মাথা চুলকে বলে, “আপনি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, গরিবের মা-বাপও বটে। আপনার কাছে আব্দার করে চাইব তাতে আর লজ্জা কী! বলছিলাম, গোবিন্দকে খালাসের একটা ব্যবস্থা করে দিতেই হবে আপনাকে।”
কুন্দকুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “দেখা যাবে।”
“ভরসা দিচ্ছেন তো?”
কুন্দকুসুম একটু বিষাক্ত হেসে বলে, “হাতি কাদায় পড়েছে বাপু, ভরসা দিয়ে যে আমার উপায় নেই সে তুমি ভালই জানো।”
ভারী লজ্জার ভান করে গবা বলে, “কী যে বলেন বড়বাবু! তা দিলেনই যদি, তবে আরো একটু দিন।”
“আবার কী?”
“আজ্ঞে ওই গুপ্তধনের ব্যাপারটা। ওটা সরকারের হক পাওনা।” কুকুসুমের চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলে ওঠে।
চাপা গলায় গবা বলে, “প্রাণের দাম যে ওর চেয়ে একটু বেশি বড়বাবু। কিংকর বা সাতনা যেমন লোক, থানা-পুলিশ-কোর্ট-কাছারির তোয়াক্কা করবে না। জানে তো তাতে লাভ নেই। কোন ঝানু উকিল মামলা ঘুরিয়ে আপনাকে খালাস দিয়ে দেবে। তাই ওরা চায় বল্লমে এফেঁড় ওফেঁড় করে চলে যেতে। আমি অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছি।”
কুন্দকুসুম নিভে যায়। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “ঠিক আছে, তাই হবে।”
গবা আবার মাথা চুলকে বলে, “আর একটা কথা।”
“আবার কী?”
“এতই যদি দিলেন তবে আর-একটু বা বাকি থাকে কেন? বলছিলাম, এ-জায়গায় আপনার অনেক দিন চাকুরি হয়ে গেল। আমরা পাঁচজনে দেখছি, এখানকার জল-হাওয়া আপনার তেমন সহ্য হচ্ছে না। শুকিয়ে একেবারে অর্ধেক হয়ে গেছেন। তাই বলছিলুম আজ্ঞে, একটা বেশ ভাল স্বাস্থ্যকর জায়গায় বদলি নিয়ে চলে যান না বড়বাবু।”
কুন্দকুসুম থমথমে মুখ করে বলে, “বুঝেছি।”
“আজ্ঞে আপনি বুঝবেন না তো কে বুঝবে! এমন পাকা মাথা দেশে কটা আছে?”
কুন্দকুসুম বিরক্তির গলায় বলে, “এবার পায়ের গিঁটটা খুলতে পারো কি না।”
গবা জিব কেটে বলে, “ঐ দ্যাখো, কথায় কথায় ভুলেই যাচ্ছিলাম, ইয়ে বড়বাবু, আর-একটা কথা।”
“আরো কথা?”
“মানে সাতনার কাছে কয়েকটা চিঠি আছে। সর্দারের নিজের হাতের লেখা। কোথায় কোন বাড়িতে ডাকাতি করতে হবে, কাকে খুন করতে হবে, এই সব বৃত্তান্ত, সর্দারের হাতের লেখা সেই সব চিঠি সাতনা আবার পুলিশের কাছে পাঠাতে চায়। আমি বলি, তার কি কোনো দরকার আছে বড়বাবু?”
কুন্দকুসুম বিবর্ণ মুখে বলে, “না। তার দরকার নেই।”
গবা সঙ্গে-সঙ্গে বলে, “হ্যাঁ, আমিও তাই বলি। দরকার কী? কেঁচো খুঁড়তে আবার সাপ বেরিয়ে পড়বে। তার চেয়ে চিঠি কটা বরং থাক। পরে কাজে লাগবে।”
কুন্দকুসুম ইঙ্গিত বোঝে। একটু চাপা স্বরে বলে, “তোমরা খুব ঘড়েল।”
“ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! আপনি থাকতে আমরা? হেঃ হেঃ…”
গবা পায়ের বাঁধনটা খুলে দিলে কুন্দকুসুম উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু অত বড় মানুষটা যেন নুয়ে পড়েছে, বয়সটাও যেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বেড়ে গেছে।
কুন্দকুসুম ধীরে-ধীরে গিয়ে রণপা দুটো কুড়িয়ে নিল। কারো দিকে একবারও তাকিয়ে রণপায়ে চড়ে লম্বা-লম্বা পা ফেলে জঙ্গলের অন্ধকার আর রহস্যময়তার মিলিয়ে গেল।
.
৩৬.
ঘটনার মাসখানেক পর এক গাঁয়ের রাস্তায় তিনজন হাঁটছিল। গবা পাগলা, সাতনা আর রামু।
একটা পুকুরধার পেরিয়ে কয়েকটা তালগাছের জড়াজড়ি। তারপর একটা বাঁক দেখা যাচ্ছিল। গবা বলল, “ওই বাঁকটা ঘুরলেই যুধিষ্ঠিরের সেই পিসি না মাসির বাড়ি। এসে গেচি হে।”
সাতনার বুকে এখনো ব্যাণ্ডেজ। আঘাত মারাত্মক না হলেও সর্দারের দুটো গুলিই তার পাঁজরে ক্ষত করে দিয়ে গেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। তার ওপর মেয়েকে দেখতে পাবে সেই আনন্দে তার হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “কথাটা মনে রেখো গবা, মেয়ের কাছে বাপ বলে আমার পরিচয় দিও না।”
“জানি। বলব দূর-সম্পর্কের আত্মীয়।”
সাতনা একটু ভাবল। তারপর বলল, “তারও দরকার নেই। মেয়ে খুব সম্ভব আমাকে চিনতে পারবে। আবছা হলেও আমার কথা তার মনে আছে। এ-চেহারা তো ভোলার নয়। তার চেয়ে এক কাজ করি এসো। ওই বাঁকের মুখে ঝুপসিআমগাছটার ছায়ায় বসে থাকি। একবার না একবার না একবার সে পুকুরে কিংবা বাগানে বেরোবেই। তখন একটু চোখের দেখা দেখে নেব।”
এ-কথার ওপর গবা কোনো কথা বলতে পারল না। রামুর চোখদুটো ছলছল করতে লাগল। সে ফিরে আসার পর তার বাবা যে আনন্দে কঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে-কথাটা এখন মনে পড়ল তার। বাবাকে আগে তার খুব রাগী আর নির্দয় বলে মনে হত। এখন জানে, বাবা তাকে কত ভালবাসে। সাতনার জন্য তাই তার বড় কষ্ট হচ্ছিল।
গাছতলায় বসে সাতনা অপলক চোখে কিছুক্ষণ সামনের বাগানঘেরা একতলা পাকা বাড়িটার দিকে চেয়ে রইল। কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না। সাতনা গবার দিকে চেয়ে বলল, “তুমি যে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে না, আমি যে কোনো শাস্তি পেলুম না, এটা কি ঠিক হল?”
গবা মৃদু হেসে বলল, “শাস্তি কাকে বলো তুমি? কত চোর-ছ্যাঁচোড় খুনে জালিয়াতকে তো পুলিশ গারদে ভরে। জেল খেটে কি আর তাদের শুদ্ধি হয়। বাপু হে, আমি বুঝি অনুতাপের আগুন না জ্বললে মানুষের পাপ পোড়ে না। অনুতাপ কাকে বলে জানো? কোনো কাজ করে বিচার দ্বারা তার ভালমন্দ অনুভব করে যে তাপের দরুন মন্দে বিরতি আসে তাই হল অনুতাপ। সেই অনুশোচনায় নিজের মেয়েটার সামনে গিয়ে পর্যন্ত তুমি দাঁড়াতে পারছ না। এর চেয়ে বেশি সাজা তোমাকে আর কে দেবে?”
সাতনা ধুতির খুঁটে চোখের জল মুছল।
ঠিক এ-সময়ে একটা দীঘল চেহারার মেয়ে বেরিয়ে এল। সদ্য স্নান করে এসেছে বুঝি। এক রাশ চুল এলো হয়ে আছে পিঠের দিকে। ভারী সুন্দর মুখোনি। একটা ভেজা কাপড় শুকোতে দিচ্ছিল বাইরের তারে।
গবা একটু ঠেলা দিয়ে সানাকে বলল, “দ্যাখো হে, দ্যাখো। দানবের মেয়ে কেমন পদ্মফুলটির মতো দেখতে হয়েছে।”
সাতনা জবাব দিল না। সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল মেয়ের দিকে। চোখের পলক পড়ে না, শ্বাসও বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে।
ধীরে-ধীরে রোদে একটু পায়চারি করল মেয়েটি। তারপর ভিতর থেকে কেউ বুঝি ডাকল। মেয়েটি সাড়া দিল, “যাই।”
তারপর চলে গেল।
গবা উঠে পড়ল। বলল, “মেয়ের সামনে যদি না-ই যেতে পারো তবে আর মায়া বাড়িও না। দশটা গাঁয়ের লোক তোমাকে চেনে। ধরা পড়লে বিপদ আছে। ওঠো, ওঠো।”
সাতনার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল অঝোরে। উঠে আস্তে-আস্তে ফেরার পথ ধরে সে বলল, “যত খারাপ কাজ করেছি তার দশগুণ ভাল কাজ যদি বাকি জীবনটায় করি, তাহলে মেয়ের সামনে একদিন দাঁড়ানোর সাহস হবে না গবা?”
“হবে। খুব হবে। ইচ্ছেটাই আসল, অনুতাপটাই আসল।”
সাতনা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে, “তাহলে এখান থেকেই আমায় বিদায় দাও ভাই। পৃথিবী জায়গাটা বিশাল, কাজেরও অন্ত নেই। দেরি করে কী হবে। এক্ষুনি শুরু করে দিই গিয়ে।”
গবা মাথা নাড়ল, “এসো তবে।”
সাতনা একটু ভেবে বলল, “আর একটা কথা। মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়েছে। আমার খুব ইচ্ছে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ওর বিয়ে হোক। তুমি ব্যবস্থা করবে?”
গবা একটু হেসে বলল, “করব। ভেবো না।”
“তাহলে যাই।”
চোখের পলকে লম্বা-লম্বা পা ফেলে সাতনা বাঁ পাশের মাঠটা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রামু গবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে এল ভারী মনে।
পুলিশ নতুন করে রিপোর্ট দেওয়ায় গোবিন্দ মাস্টারের মামলা আবার আদালতে উঠেছে। গোবিন্দর পক্ষে সওয়ালে নেমেছেন মস্ত মস্ত ডাকসাইটে সব উকিল। সামন্তমশাই তাদের মোটা টাকা দিচ্ছেন। গোবিন্দ নিজে গিয়ে শহরে ধরা দেওয়ার পর ফের জামিনে খালাস পেয়ে সারকাসে তার খেলা দেখাচ্ছে। মামলার যা গতিক তাতে সে খালাস পাবেই।
কুন্দকুসুম বদলি হয়নি। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে সপরিবারে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। সেখানে নাকি চাষবাস নিয়ে থাকবে। নতুন যে দারোগা এসেছে, তার নাম চন্দ্রাতপ খাঁড়া। ভারী ভাল লোক। প্রায়ই উদ্ধববাবুর বাড়িতে এসে রামুকে আদর করেন আর কাকাতুয়াকে ছোলা খাওয়ান।
উদ্ধববাবুর হঠাৎ জ্ঞানচক্ষু খুলেছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন, রাঘব ঘোষ তার চেয়ে ভাল গাইয়ে। তাই আজকাল সন্ধের পর রাঘবের বৈঠকখানায়। গিয়ে বসেন প্রায়ই। চোখ বুজে গান শোনেন আর রিফ করেন, “ওয়াঃ, ওয়াঃ, কেয়াবাত।”
রাঘব ব্যথিত স্বরে বলে, “কেয়াবাতটাও ঠিক জায়গামতো বলতে পারছেন উদ্ধববাবু! বেজায়গায় তারিফ করলে সুর কেটে যায়।”
উদ্ধববাবু ভারী লজ্জা পান।
নয়নকাজলের সঙ্গে এখন আর কাকাতুয়ার আড়াআড়ি নেই। সরকারি লোকেরা গুপ্তধনের প্রায় দু-কলসি মোহর উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। কাকাতুয়াকে তাই এখন হরিনাম শেখানো হচ্ছে। তবে পাখিটার স্মৃতিশক্তি বড়ই প্রবল। ভোর হতে না-হতেই সে ডাকতে থাকে, “রামু ওঠো। রামু ওঠো। মুখ ধোও। পড়তে বসো।”
রামুর মনে বহুদিন ধরেই একটা খটকা লেগে আছে। সে একদিন গবাকে ধরে পড়ল, সেই কিংকর লোকটা সেই রাত্রে যে হাওয়া হয়ে গেল তারপর আর তার দেখা পেলাম না কেন বলো তো! কোথায় গেল সে?”
গবা এক গাল হেসে বলে, “সেই কথাটা কিন্তু খুব গুহ্য কথা। কেউ জানতে পারে!”
“কেউ জানবে না।”
“তবে বলি। সেই যে তোমাকে আলফা সেনটরের কথা বলেছিলুম, মনে আছে?”
“আছে। আলফা সেনটর হল সৌরলোকের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র। পৃথিবী। থেকে চার আলোকবর্ষ দূরে।”
“বাঃ, ঠিক বলেছ। সেখান থেকে একদল লোক আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করে যায়, জানো তো!”
“জানি। কিন্তু সে তো গুল।”
“তাহলে বলব না।”
“আচ্ছা, গুল নয়। বলো।”
“আলফা সেনটরের একটা গ্রহের নাম হচ্ছে নয়নতারা। কিংকর হল আসলে সেই গ্রহের লোক। ডাকাতদের সঙ্গে যখন আমরা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলুম না, তখন আমি টেলিপ্যাথিতে নয়নতারায় খবর পাঠাই। খবর পেয়ে কিংকর একদিন একটা মহাকাশযানে চেপে চলে এল। তারপর সব ঠিকঠাক করে দিয়ে সামলে-সুমলে দিয়ে ঘটনার সেই রাত্রে আবার নয়নতারায় ফিরে গেছে।”
“আর তুমি কে গবাদা?”
“আমি? ও বাবা, ও আবার কেমনধারা কথা! আমি হচ্ছি আমি, গবগবাগব পাগলা খুড়ো, উলিঝুলি ফোকলাটেকো নাংলাবুড়ো। ঝুলদাড়ি আর ঝোলা গোঁফে গুমসো ছিরি, নালে-ঝোলে চোখের জলে জড়াজড়ি!”
“তুমি কিন্তু মোটেই বুড়ো নও। বুড়োদের চামড়া এত টান থাকে না।”
“থাকে থাকে। এ কি তোমাদের এই নোংরা জায়গার আধমরা বুড়ো নাকি! এসব মেড ইন অ্যানাদার ওয়ার্ড।”
“তার মানে?”
“কথাটা কিন্তু খুব গুহ্য। গোপন রেখো।”
“রাখব। কিন্তু ফের গুল দিলে!”
“আহা, আগে শোনোই না। কাউকে বেলো না। আমিও আসলে ওই নয়নতারার লোক। সেখানে জল-হাওয়ার এমন গুণ যে, দেড়শো দুশো বছর বয়সে মানুষের যৌবন আসে।”
“ফের গুল?”
“গুল নয় গো। শুনলে প্রত্যয় যাবে না, সেখানে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের লোকেরা হামা দেয়। ত্রিশ-চল্লিশে গিয়ে হাঁটতে শেখে। আধো-আধো বোল ফোটে তখন। সত্তর বছর বয়সে আমাদের হাতেখড়ি। পঁচাত্তর বছর বয়সে ইসকুলের পাঠ শুরু। সেখানে গেলে দেখবে আশি নব্বই বছরের লোকরা ঢিল মেরে আম পাড়ছে, ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, ক্রিকেট খেলছে।”
“সেখানে কি কিংকরদার গাঁয়েই তোমার বাড়ি?”
“হ্যাঁ, তা বলতে পারো একরকম। পাশাপাশি গাঁ। ওর গাঁয়ের নাম বাঘমারি, আমার গাঁ হল কুমিরগড়। দু গাঁয়ের মধ্যে দুরত্ব মাত্র শ-পাঁচেক মাইল, একই থানা আমাদের।”
“বলো কী! পাঁচশো মাইল দূরের গাঁ কি পাশের গাঁ হল নাকি?”
গবা খুব হাসে। বলে, “তোমাদের এখানকার মতো তো নয়। আমাদের গ্রহটাও যে বিশাল। আমাদের একটা জেলা তোমাদের গোটা ভারতবর্ষের সমান। চলো একবার তোমাদের নিয়ে যাব। জামবাটি ভর্তি সরদুধ আর সবরিকলা আর নতুন গুড় দিয়ে মেখে চিড়ের এমন ফলার খাওয়াব না! আর সেই জামবাটির সাইজ কী! ঠিক তোমার ওই পড়ার ঘরখানার মতো…..”
“গুল! গুল!”
“আহা, শোনোই না….”
পরদিনই গবা আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। নয়নতারাতেই ফিরে গেল কি না কে জানে!