Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হাট্টিম রহস্য || Syed Mustafa Siraj

হাট্টিম রহস্য || Syed Mustafa Siraj

হাট্টিম রহস্য

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার খুব মন দিয়ে একটা চিঠি পড়ছিলেন। পড়া শেষ হলে আমার দিকে ঘুরে মৃদু হেসে এই ছড়াটা খুব ধীরে আওড়ালেন?

হাট্টিমাটিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমাটিম টিম।

অবাক হয়ে বললুম, হঠাৎ ছড়া আওড়াতে শুরু করলেন যে?

কর্নেল তাঁর সাদা দাড়ি থেকে কী একটা বের করে ফেলে দিলেন। পোকা হওয়াও বিচিত্র নয়। সেই ভোরবেলা থেকে আটটা পর্যন্ত ছাদের বাগানে হরেকজাতের উদ্ভিদের সেবা করেছেন। দাড়িতে পোকা ঢুকে থাকা খুবই সম্ভব। হাসতে হাসতে বললেন, জয়ন্ত, ঠিক হাট্টিমাটিম টিমের মতোই পৃথিবীতে কিছুকিছু আজব মানুষ আছে। না, না—তাদের সকলেরই শিং আছে বা তারা মাঠে ডিম পাড়ে, সেকথা বলছি নে। কিন্তু তাদের ব্যাপার-স্যাপার দেখে তাজ্জব লাগে। যেমন ধরো, এই ভদ্রলোক–কালোবরণ মুখুয্যে।

চিঠিটা বুঝি তাঁরই?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চিঠিটা টেবিলে চাপা দিয়ে পায়চারি করতে করতে বললেন, না—চিঠিটা তার নয়। তাঁর নাতনি অনামিকার। সে আবার কিনা বিজ্ঞানের ছাত্রী। ঠাকুর্দার রকম-সকম দেখে ভড়কে গেছে। শেষে আমরাই শরণাপন্ন হয়েছে। কিন্তু আমি কি ভূতের ওঝা?

রহস্যের গন্ধ পেয়ে বললুম, কালোবরণ মুখুয্যেকে কি ভূতে ধরেছে?

তাই তো লিখেছে। বলে কর্নেল হঠাৎ মাথার টুপি খুলে প্রশস্ত টাক থেকে এবারও সম্ভবত একটা পোকা ঝেটিয়ে ফেললেন। তবে কথাটা হল, মানুষ বুড়ো হলে কিছুটা ভীমরতি ধরতেই পারে। যেমন আমারও মাঝে মাঝে ধরে। সেটা বিলক্ষণ বুঝতেও পারি। কিন্তু তাই বলে কি আমি রাতদুপুরে কোনও উদ্ভুট্টে কাণ্ড করি?

বিরক্ত হয়ে বললুম, আসল কথাটা বলুন না! এসবের সঙ্গে হাট্টিমাটিমের কী সম্পর্ক?

কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ পায়চারি করার পর আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার কি সময় আছে হাতে? চলো না একবার ঘুঘুডাঙা থেকে বেড়িয়ে আসি। কলকাতা থেকে কাছেই।

এদিন আমার ছুটি। তবে বলা যায় না কিছু। কাগজের আপিসে সাংবাদিকের চাকরি পুলিশের চাকরির মতোই। বিশেষ করে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার কর্তৃপক্ষের বড় বেশি সুনজর তাঁদের এই স্পেশাল রিপোর্টারটির ওপর। ছুটির দিনেও তলব পাঠিয়ে হুকুম দিতে পারেন, ধাদ্ধাড়া-গোবিন্দপুরে সাংঘাতিক খুনোখুনি হয়েছে। এক্ষুনি গিয়ে সরজমিন খোঁজখবর নিয়ে এস। তার মানে ওটাই পরদিন সকালে পাবলিককে খাওয়াতে হবে। পাবলিকও এমন হয়েছে আজকাল যে রোজ সক্কালবেলা রক্ত-গরমকরা খবর ছাড়া আর কিছু মুখে রোচে না।

আমার মুখে নিশ্চয় এইসব দোনামনার ছাপ ফুটে উঠেছিল। কর্নেল একটু হেসে বললেন ফের, ডার্লিং! চিন্তা কোরো না। ঘুঘুডাঙার হাট্টিমরহস্য ফাঁস হলে তোমার কাগজের প্রচারসংখ্যা দশগুণ বেড়ে যাবে। কর্তৃপক্ষকে বরং ফোনে এখনই তার ইশারা দিয়ে রাখো।

এরপর আর না করা চলে না। ষষ্ঠীচরণ কফি রেখে গেল। কফি খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লুম। আমার ফিয়াট গাড়িটা মাঝে মাঝে একটু গণ্ডগোল বাধায়। কিন্তু এদিন দিব্যি খুশমেজাজে ছুটে যেতে আপত্তি করছিল না।

হাট্টিম রহস্যটা কী, রাস্তায় বারতিনেক জিগ্যেস করেও জবাব পেলুম না। কর্নেল চোখবুজে ধ্যানস্থ হয়েছেন তো হয়েছেনই। আশ্চর্য ব্যাপার, অভ্যাসমতো গাড়ির জানালা দিয়ে পাখি দেখার কথাও যেন ভুলে গেছেন। অথচ বুকের ওপর দিব্যি বাইনোকুলারটি ঝুলছে।

চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ঘন্টাখানেকের মধ্যে আমরা ঘুঘুডাঙা পৌঁছে গেলুম। শহর ও গ্রামে জটপাকানো মাঝারি সাইজের একটা জনপদ। কালোবরণ মুখুয্যের বাড়িটা একেবারে শেষদিকে মাঠের ধারে। একে-ওকে জিগ্যেস করে পৌঁছুতে অসুবিধে হল না।

পরিবেশটা কেমন নির্জীব, খাঁ খাঁ। এদিকে ওদিকে কিছু ভিটে, ভাঙাচোরা দালানকোঠা, কদাচিৎ দু-একটা নতুন বাড়ি, আর ঝোপঝাড় গাছপালায় ভর্তি। কালোবাবুর বাড়ির গেটে মান্ধাতা আমলের ফলকে লেখা আছে : স্বর্গপুরী।

স্বর্গপুরীর দশা বড় করুণ। প্রকাণ্ড সেকেলে দোতলা বাড়িটার গায়ে ছালচামড়া খুব কমই আছে। গেটের কাছে গাড়ি থামতে থামতে একটি ফুটফুটে ফর্সা তরুণী দৌড়ে এল। বছর কুড়ি-একুশের মধ্যে তার বয়স। বেশ স্মার্ট বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। চোখে চশমা আছে। কর্নেল পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছিলুম, এই সেই নাতনি—শ্রীমতী অনামিকা।

কর্নেল বললেন, তোমার দাদুর খবর কী, অনি?

অনামিকা তক্ষুনি গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, দাদু এখন ঘুমুচ্ছেন। কাল রাতে সে কী কাণ্ড, কল্পনা করতে পারবেন না। সবে একটু চোখের পাতা টেনে ধরেছে, আমার দরজায় ধাক্কা। দাদুর গলা শুনে দরজা খুলে দিলুম। দাদু ভেতরে ঢুকে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তারা এসেছে! আমাকে লুকিয়ে রাখ শিগগির! আমি টর্চ নিয়ে বেরুলুম। তখন লোডশেডিং চলছিল। কানাইদা নিচে থেকে ব্যস্তভাবে লণ্ঠন নিয়ে এল। দাদুকে ঘরে রেখে আমরা প্রথমে গেলুম দাদুর ঘরে। তন্নতন্ন খুঁজে কাউকে দেখতে পেলুম না শুধু মেঝেয় এই চিরকুটটা পড়ে থাকতে দেখলুম। এই দেখুন। আবার সেই ছড়াটা লেখা রয়েছে।

কর্নেল ভাঁজ করা কাগজটা মেলে ধরলেন। পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখি, কর্নেলের মুখে শোনা সেই হাট্টিমাটিম ছড়াটা লেখা আছে গোটাগোটা সুন্দর হরফে। আর পাশে আঁকা আছে একটা ছবি। ছোটদের ছড়ার বইয়ে হাট্টিমাটিম নামে আজব প্রাণীর যে ছবি দেখা যায়, সেই ছবি, পেঁচার মতো মুখ, মানুষের মতো দুপায়ে দাঁড়ানো, বড়-বড় চোখওয়ালা পাখি এবং তাদের মাথায় দুটো খোঁচাখোচা শিংও আছে। গা ভর্তি পালক।

কর্নেল কাগজটা পকেটে রেখে বললেন, এই নিয়ে তাহলে চারবার ছড়াটা পাওয়া গেল?

অনামিকা মাথা নাড়ল। তারপর পা বাড়িয়ে বলল, ভেতরে আসুন।

সে সিঁড়ি বেয়ে আমাদের ওপরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরে নিয়ে গেল। এই ঘরে সে থাকে। সে সোফায় আমাদের বসিয়ে বেরিয়ে গেল। বললুম, এই তাহলে হাট্টিমরহস্য?

কর্নেল হাসলেন। শুধু এটুকু হলেও কথা ছিল জয়ন্ত। আরও কিছু ব্যাপার আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তুমি সেগুলো জানতে পারবে।

অনামিকা ফিরে এল চায়ের ট্রে আর দু প্লেট সন্দেশ নিয়ে। তারপর একপাশে বসে আগের জের টেনে বলল, তারপর কানাইদা আর আমি বাড়ির চারপাশে ঘুরে খোঁজাখুঁজি করলুম। কাউকে দেখতে পেলুম না। আমরা ফিরে আসছি, হঠাৎ দেখি কখন দাদু ওপর থেকে নেমে এসেছেন। কিছু বলার আগেই দৌড়ুতে শুরু করলেন। পেছন-পেছন কানাইদা দৌড়ুল। কিন্তু দাদু যেন মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কানাইদা ফিরে এসে বলল, ছেড়ে দাও। ফিরে আসবেনখন। এ তো আজ প্রথম নয়।

কর্নেল বললেন, কখন ফিরলেন উনি?

প্রায় ঘন্টাখানেক পরে। বাগানের দিক থেকে এলেন। আমরা এত জিগ্যেস করলুম, জবাবই দিলেন না। সোজা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, সাড়ে দশটা বাজে। এখনও উনি ঘুমুচ্ছেন?

না। সকাল সাতটায় দরজা খুলে চা খেয়েছিলেন। চা দিতেই ফের দরজা আটকে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে কানাইদা জানালার খড়খড়ি ফাঁক করে দেখে এসে বলল, ঘুমুচ্ছেন।

ব্রেকফাস্ট করেননি তাহলে?

না। অনামিকা দুঃখিতভাবে বলল। একটু আগে আমি দরজা নক করলুম। সাড়া পেলুম না।

তুমি আরেকবার গিয়ে জোরে দরজায় ধাক্কা দাও তো!

অনামিকা অনিচ্ছুকভাবে বেরিয়ে গেল। বুঝতে পারছিলুম, দাদুর ব্যাপার-স্যাপার দেখে সে যত দুঃখিত, তার চেয়ে বেশি বিরক্ত।

কর্নেলকে জিগ্যেস করলুম, বাড়িতে কে কে থাকে?

কর্নেল বললেন, কালোবরণবাবু, অনামিকা, আর কানাই নামে একজন চাকর। কানাই ছেলেবেলা থেকে এ বাড়িতে আছে। তাকে বাড়ির লোকই বলা নয়। অবশ্য তাকে আমরা এখনও দেখিনি। অনামিকার মুখে আমি যেটুকু শুনেছি, তা হল, কালোবাবু রেলে স্টেশনমাস্টার ছিলেন। রিটায়ার করে পৈতৃক এই বাড়িতে ফিরে আসেন বছর পনেরো আগে। এখন ওঁর বয়স প্রায় পঁচাত্তর। তবু শক্তসমর্থ মানুষ। ওঁর একমাত্র ছেলে দেবনাথ ছিলেন কাস্টমস অফিসার। বছর দুই আগে খিদিরপুর ডক এলাকার স্মাগলাররা তাকে খুন করে। তার স্ত্রী শ্বশুরের কাছে চলে আসেন। মেয়েকে নিয়ে। স্বামীর শোকে এবং নানা অসুখে ভুগে মাস ছসাত আগে তিনি মারা গেছেন।

হুঁ—মেয়েটা বড় দুর্ভাগা! তা এই হাট্টিমরহস্যের শুরু কবে থেকে?

মাসখানেক হয়ে এল প্রায়। অনামিকা আমার কাছে দিয়েছিল ১৫ই সেপ্টেম্বর। আজ ১৪ই অক্টোবর। হামাসখানেক হল। এর মধ্যে সে আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখে যা যা ঘটেছে, সব জানিয়েছে। আজ যে চিঠিটা পেলুম, তাতে গত সপ্তাহের ঘটনার বিবরণ ছিল। মোটামুটি কাল রাতে যা হয়েছে শুনলে, প্রায় তাই। শুধু একটা বাড়তি ঘটনা ছিল, তা হল : অনামিকা সে-রাতে নিচের বাগানে সত্যি একটা বিদঘুটে প্রাণীকে এক ঝলক টর্চের আলোয় দেখেছে—সেটা নাকি

অবিকল হাট্টিমাটিমের যে ছবি দেখলে সেটারই মতো।

ভড়কে গিয়ে বললুম, বলেন কী!

কর্নেল একটু হাসলেন। তবে তার চেয়ে অদ্ভুত কথা, সকালে বাগানে গিয়ে অনামিকা কয়েকটা পালক কুড়িয়ে পেয়েছিল। পালকগুলো নাকি প্রকাণ্ড। ভেবে দেখো জয়ন্ত, অনামিকা জীববিজ্ঞানের ছাত্রী—বিশেষ করে ওরিন্থােলজি বা পক্ষিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাও করছে। কিন্তু ওই পালকগুলো দেখে সেও ভীষণ অবাক হয়েছে। এমন পালক যার, সে কোন প্রজাপতি পাখি বা প্রাণী, বিজ্ঞানে তার হদিস নেই।

এইসময় অনামিকা ব্যস্তভাবে ফিরে এসে বলল, দাদু সাড়া দিচ্ছেন না।

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কৈ, চলো তো দেখি।

অনামিকার দাদুর ঘর দোতলার উত্তর প্রান্তে। কর্নেল দরজার কাছে গিয়ে আমাদের ভীষণ অবাক করে দিয়ে সুর ধরে আওড়ালেন :

হাট্টিমাটিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমাটিম টিম।

অমনি ঘরের ভেতর মচমচ ধুপধুপ হল এবং দরজা খুলে গেল। শ্যামবর্ণ, কিন্তু ঘাসচাপা পাতার মতো ফ্যাকাসে গায়ের রং, ঢ্যাঙা গড়নের এক বৃদ্ধ পর্দা তুলেই থমকে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেল ও আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে রাগী গলায় বললেন, কে মশাই আপনারা আমার সঙ্গে রসিকতা করতে এসেছেন।

অনামিকা খিলখিল করে হেসে উঠল। কালোবাবু তার দিকে তেড়ে গিয়ে বললেন, সব তোরই চক্রান্ত অনি! তুই-ই এই লোকদুটোর সাহায্যে আমাকে ভয় দেখাস। এতদিনে সব ফাঁস হয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, না, মুখুয্যেমশাই! কিছুই ফাঁস হয়নি।

কালোবাবু বললেন, কে আপনি?

অনামিকা কর্নেল ও আমার পরিচয় দিল। তবু সন্দিগ্ধ দৃষ্টে আমাদের দেখতে দেখতে কালোবাবু বললেন, ঠিক আছে। আমার খিদে পেয়েছে। অনি, আগে আমাকে খেতে দে। তারপর কথাবার্তা হবে।

দুই

কালোবাবুর হাবভাবে মোটেও তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে মনে হচ্ছিল না। রীতিমতো রাশভারি প্রকৃতির মানুষ উনি। নিজের ঘরে আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কর্নেলের প্রশ্নের উত্তরে যা বলেন, তা হল এই

মাস দেড়েক হবে, এক রাত্রে হঠাৎ কিসের শব্দে ওঁর ঘুম ভেঙে যায়। বাগানের দিকের জানালা দুটো ভোলা ছিল। একটা জানালার দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠেন। কারা যেন উঁকি দিচ্ছে। লোডশেডিংয়ের যুগ বলে রাতে বিছানার পাশে টর্চ রেখে শোন। ঝটপট টর্চ জ্বালতেই দেখেন, দুটো বিদঘুটে মুখ। পেঁচার মতো অবিকল। কিন্তু মানুষের মুখের সাইজ মুখটা। মাথায় দুটো ছোট্ট শিং আছে। ভূতুড়ে গলায় ওরা বলে, ডিম কৈঁ? ডিম দে।

আতঙ্কে টর্চের সুইচ থেকে আঙুল সরে গিয়েছিল। ফের সুইচ টিপে দেখেন, বিদঘুটে মুখটি আর নেই। সাহস করে জানালায় দিয়ে টর্চের আলো ফেলে দেখেন। কিন্তু তাদের কোনও পাত্তা পাননি। শেষে ব্যাপারটা স্বপ্ন ভেবে আর বিশেষ গা করেননি। কিন্তু সকালে ঘরের মেঝেয় ওই ছড়ালেখা একটুকরো কাগজ কুড়িয়ে পান।

তারপর থেকে কিছুদিন অন্তর-অন্তর ওই বিদঘুটে জীবদুটি দুপুররাতে ঘরের জানালায় আবির্ভূত হচ্ছে। ভূতুড়ে গলায় ডিম চাইছে। অনামিকা ভয় পাবে ভেবে তাকে সবটা খুলে বলেননি। শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছেন যে, জীবদুটির ডানা আছে। তা না হলে দোতলায় জানালায় কীভাবে তারা উঁকি দিতে পারে?

এইসময় অনামিকা বলল, গত সপ্তাহে ওদের আমি বাগানে দেখেছি, দাদু। তুমি আরও ভয় পাবে বলে বলিনি। তিনটে পালকও কুড়িয়ে পেয়েছি বাগানে।

কালোবাবু আঁতকে উঠে বললেন, অ্যাঁ! বলিস কী রে?

বুঝলুম দাদু ভেবেছেন নাতনিকে সব খুলে বললে ভয় পাবে এবং নাতনিও ভেবেছে, দাদুকে সব খুলে বললে দাদু ভয় পাবেন।

কর্নেল বললেন, কিন্তু আপনি বাগানের দিকে দৌড়ে যান কেন বলুন তো মুখুয্যেমশাই? কোথায় যান?

কালোবাবু বিকৃত মুখে বললেন, যাব না কেন? ব্যাটারা আমাকে ভয় দেখাবে, আর আমি তাদের ছেড়ে দেব? প্রথমে ভয় পাই বটে, কিন্তু তারপর মাথায় খুন চেপে যায়। তাই লাঠি নিয়ে খুঁজতে যাই ওদের। পেলে এক্কেবারে হাড় গুঁড়ো করে দেব না বুঝি?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে একটু হেসে বললেন, তাহলে বলতে চাইছেন, অত্যন্ত মরিয়া হয়েই বেরিয়ে পড়েন। তাই না?

আলবাত। মরিয়া হব না? রোজ অমনি করে জ্বালাতে আসবে, আর মুখ বুজে সয়ে যাব?

কিন্তু প্রথমে ভীষণ আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন তো?

কালোবাবু মাথা নেড়ে বললেন, তা পড়ি। আপনি হলে আপনিও পড়তেন।

কালোবাবুর চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। তারপর নিজেকে শান্ত করে বললেন, হঠাৎ ওকথা, আসছে কেন? আপনার মশাই দেখছি, খালি লোকের মনে খোঁচা দেওয়ার অভ্যেস!

কর্নেল বললেন সরি। কিছু মনে করবেন না মুখুয্যেমশাই। আচ্ছা, আমরা উঠি।

কালোবাৰু গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। কোনও কথা বললেন না। আমরা বেরিয়ে এলুম ঘর থেকে। সিঁড়ির কাছে এসে কর্নেল অনামিকাকে বললেন, অনি, সেই পালকগুলো কাগজে মুড়ে আমাকে এনে দাও। পরীক্ষা করা দরকার।

অনামিকা তার ঘর থেকে একটা মোড়ক এনে কর্নেলকে দিল। আমরা ওর কাছে বিদায় নিয়ে কলকাতা ফিরে চললুম। কর্নেল ওকে প্রচুর আশ্বাস দিতে ভুললেন না অবশ্য।

পথে কর্নেল পালকগুলো বের করে দেখতে দেখতে বললেন, পাখিটখি নিয়ে আমিও বিস্তর ঘাঁটি। কিন্তু এ পালক যে কোন পাখির হতে পারে, মাথায় আসছে না।

বললুম, আবার কোন পাখির? হাট্টিম পাখির। আপনি দেখেননি বলে কি হাট্টিম পাখি থাকতে পারে না? পৃথিবীতে বিস্তর আজগুবি জীব থাকতে পারে।

কর্নেল হাসলেন। পারে। কিন্তু লিখতেও পারে কি? কিংবা নিজের ছবি আঁকতে? নিজের নামে ছড়া বানাতে?

হ্যাঁ-সেও একটা কথা। অর্থাৎ পেছনে মানুষ আছে। ধরুন, মানুষটা হাট্টিম দুটোর মালিক।

বেশ তো। কিন্তু কালোবাবুকে সে ভয় দেখাবে কেন?

ভয় কোথায় দেখাল? রসিকতা করছে। আর কালোবাবু রসিকতায় ভয় পাচ্ছেন।

কিন্তু কেন রসিকতা করছে?

এমনি। মানুষের স্বভাব রসিকতা করা। বুড়ো মানুষ—তাতে হয়তো বদরাগী। তাই–

আমার কথায় বাধা পড়ল। পাশ দিয়ে হঠাৎ একটা কালোরঙের মোটর গাড়ি এগিয়ে সামনে চলে এল এবং আমি দুর্ঘটনার আতঙ্কে ব্রেক কষে গাড়ি থামালুম। সামনের গাড়িটাও থেমে গেল। তারপর দুদিক থেকে দুজন মুখোশপরা লোক বেরিয়ে একজন আমার পাশে এবং অন্যজন কর্নেলের পাশে এসে দাঁড়াল। তাদের দুজনের হাতেই রিভলভার। কর্নেলের দিকের লোকটা হিসহিস করে বলল, এই বুড়ো ঘুঘু! শিগগির মোড়কটা দে। নইলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।

কর্নেল নিরীহ মুখ করে বললেন, কিসের মোড়ক চাইছ বাবা?

মুখোশপরা লোকটা গাড়ির জানালা দিয়ে কর্নেলের কানে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বলল, ন্যাকা! তখনও কর্নেলের হাতে হাট্টিম পাখির পালকের মোড়কটা রয়েছে। সে সেটা খপ করে অন্য হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। তারপর শাসিয়ে বলল, ফের যদি স্বর্গপুরীতে নাক গলাতে গেছ তো দেখবে কী হয়!

মোড়কটা হাতিয়ে লোকটা করল কী, আমার গাড়ির সামনের টায়ারে রিভলভারের গুলি ছুড়ল। হিস করে শব্দ হল। বুঝলুম, রিভলভারে সাইলেন্সার লাগানো আছে। আমার পাশের লোকটাও আরেকটা টায়ার ফাসিয়ে দিল গুলি ছুড়ে। তারপর কালো গাড়িটাতে চেপে চলে গেল। রাগে দুঃখে অস্থির হয়ে ওই গাড়ির নম্বর টুকতে যাচ্ছি, কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ডার্লিং! ওটা আসল নম্বর নয়। গাড়িতে আসল নম্বর ঝুলিয়ে কেউ এসব কাজ করতে আসে না!

গনগনে রোদে রাস্তার মধ্যে গাড়িটা নিয়ে বিপদে পড়লুম দেখছি। দুধারে ফাঁকা মাঠ। বেরিয়ে টায়ারের অবস্থা দেখতে দেখতে বললুম, কর্নেল! হাট্টিমাটিম টিমের পাল্লায় পড়ে দুটো নতুন টায়ার গচ্চা যাবে জানতুম না। ওঃ! হাত নিসপিস করছে—সঙ্গে আমারও রিভলভার আছে। অথচ টায়ার দুটো ফেঁসে গেল!

যাবে না! কর্নেল বললেন। তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার কর্তৃপক্ষ কিনে দেবে। কারণ এই হাট্টিমরহস্য কাগজের প্রচার আরও বিশহাজার বাড়িয়ে দেবে। কলম বাগিয়ে তৈরি হও বৎস!

বিরক্ত হয়ে বললুম, আপনার কাছেও তো রিভলভার আছে নিশ্চয়। আমি না হয় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলুম। আপনি কেন রিভলভার বের করলেন না? ওরা গুলি ছোড়ার আগেই…..

কর্নেল গাড়ির ভেতর ঝুঁকে কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, তাতে আমাদের প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তবে যাই হোক, একটা পালক সময়মতো সরিয়ে ফেলেছিলুম। ওদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। এই দেখো।

কর্নেলের হাতে একটা পালক দেখতে পেলুম। বললুম, কিন্তু ওরা পালকগুলো হাতাতে এসেছিল কেন বলুন তো? এগুলো কী এমন জরুরি ওদের কাছে?

কর্নেল হাসলেন। ওরা আমাকে চেনে। শুনলে না আদর করে বুড়ো ঘুঘু বলে সম্ভাষণ। করল? এই পালকেই সম্ভবত কোনও সূত্র লুকিয়ে আছে।….

ঘুঘুডাঙার মাঠ থেকে দুমাইল দূরের একটা গ্যারাজে খবর দিয়ে ব্রেকভ্যানে করে গাড়ি টেনে এনে এবং ফাঁসা টায়ার কোনওরকমে মেরামত করে কলকাতা ফিরতে সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল।

পরদিন সকালে কর্নেলের বাড়ি গিয়ে দেখি, উনি একগাদা পুরনো বিলিতি খবরের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করছেন। আমাকে দেখে বললেন, বোলো ডার্লিং! খবর আছে।

বললুম, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। লন্ডনের ইভনিং স্টার পত্রিকা ঘাঁটছেন!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, ১৮৫৭ সালে ভারতের সিপাহি বিদ্রেহের খবর পড়ছিলুম।

কিন্তু হাট্টিমরহস্যের কী হল?

কর্নেল আরও জোরে হেসে বললেন, বুঝতে পারছি, টায়ার ফঁসিয়ে দেওয়াতে তুমি ওদের ওপর ভীষণ রেগে গেছ। তবে তোমার টায়ার ফাসানোর ঘটনার সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহের সম্পর্ক আছে, জয়ন্ত?

সোজা হয়ে বসে বললুম, তার মানে?

কর্নেল জরাজীর্ণ ইভনিং স্টারের পাতায় লাল চিহ্ন দেওয়া একটা খবর দেখিয়ে বললেন, পড়ে দেখো। এই কাগজগুলো আমি সেবার লন্ডনে গিয়ে সংগ্রহ করেছিলুম একটা নিলামের দোকানে।

খবরটা হল এই : বারাকপুর সেনানিবাসের ক্যাপ্টেন বার্ট জনসনের প্রিয় পাখি দুটি গতকাল লন্ডনে পৌঁছেই মারা পড়েছে। বারাকপুরে সিপাহিরা বিদ্রোহ করায় নিরাপত্তার জন্য ক্যাপ্টেন বার্ট পাখি দুটিকে স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে লন্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পাখিদুটি অত্যন্ত দুর্লভ প্রজাতির। জানা গেছে, ক্যাপ্টেন বার্ট এদের সংগ্রহ করেছিলেন আফ্রিকা থেকে। পাচার মতো মুখের গড়ন, মাথায় শিং আছে এবং দুপায়ে দাঁড়ানো মতো লাগে। এরা প্রায় তিনফুট উঁচু। পিয়ানোর শব্দের মতো টিং টিং করে এরা নাকি ডাকে। পাখি দুটিকে মর্যাদার সঙ্গে ক্লিভল্যান্ড কবরখানায় কবর দেওয়া হয়েছে।….

কর্নেলের মুখের দিকে তাকালে উনি আরেকটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। লাল চিহ্ন দেওয়া আরেকটা খবরে চোখ দেল। এবার খুব অবাক হয়ে গেলুম।

…গতরাতে ক্লিভল্যান্ড কবরখানায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। কে বা কারা ক্যাপ্টেন বার্টের দুটি পাখির কবর খুঁড়েছিল। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে দেখে, দুটি পাখিরই পেট ধারালো অস্ত্রে চিরে রেখে গেছে তারা। মৃত পাখির পেট চেরার কারণ নিয়ে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের খবর দেওয়া হয়েছে।…

কর্নেল আরও একটা ইভনিং স্টার এগিয়ে দিয়ে বললেন, এবার আশা করি রহস্য অনেক স্পষ্ট হবে।

…স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ক্যাপ্টেন বার্ট পাখিদুটিকে দুটি বহুমূল্য রত্ন গিলিয়েছিলেন। চোরেরা যেভাবেই হোক সেই খবর জানত। ক্যাপ্টেন বার্টের কাছে এ সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের পাঠানো হয়েছিল। তিনি কবুল করেছেন। বিদ্রোহের সময় রত্নদুটি লুঠ হওয়ার ভয়ে তিনি একাজ করেছিলেন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এখন সেই রত্নদুটি উদ্ধারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আরও জানা গেছে, রত্নদুটি অযোধ্যার নবাবের কাছ থেকে ক্যাপ্টেন বার্ট উপহার পেয়েছিলেন।…

পড়ার পর বললুম, এতকাল পরে ওইসব ঘটনার সঙ্গে হাট্টিম রহস্যের কী সম্পর্ক আছে, আমার মাথায় আসছে না।

কর্নেল হাসলেন। কালোবাবুর জানালায় রাতবিরেতে সেই পাখিদুটোরই ভূত এসে ভয় দেখাচ্ছে, জয়ন্ত।

কেন?

সেই নবাবি রত্নদুটো তারা ফেরত চায়।

আমি নড়ে বসলুম। অ্যাঁ! বলেন কী? কালোবাবুর কাছে ও জিনিস কীভাবে এল? সে তো সেই লন্ডনের কবরখানা থেকে চোরেরা হাতিয়ে নিয়েছিল। একশো পঁচিশ বছর পরে ঘুঘুডাঙার কালোবরণ মুখুয্যের কাছে…. ধ্যাৎ! আমি এর একবর্ণ বিশ্বাস করি না।

কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে একটা যোগসূত্র আছেই।

হ্যাঁ—সেটা ওই বিদঘুটে আফ্রিকান পাখি দুটোর ব্যাপারে।

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আজ সন্ধ্যায় আমরা আবার ঘুঘুডাঙা যাব, জয়ন্ত। তৈরি থেকো। তবে না—গাড়ি করে নয়। বাসে যাব এবং অন্ধকারে মাঠ ঘুরে স্বর্গপুরীতে ঢুকব।

তিন

দিনটা খুব উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেল। পাঁচটায় খবরের কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়ে কর্নেলের কথামতো লালবাজারের পুলিশ দপ্তরের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলুম। একটু পরে গেট দিয়ে বেরুতে দেখলুম কর্নেলকে। কাছে এলে বললুম, পুলিশের দফতরে ঢুকেছিলেন দেখছি। আমি ভেবেছিলুম এখান থেকে বুঝি ঘুঘুডাঙার বাস ধরা যায়।

কর্নেল বললেন, বাস ধরব এসপ্ল্যানেডে। এল-২০ নম্বরে বারাকপুর যাব। সেখান থেকে ঘুঘুডাঙার বাস পাব।

লালবাজারে কি কোনও সূত্র পেলেন?

কর্নেল হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, রোখকে! রোখকে! তারপর আমাকে হ্যাচকা টানে সঙ্গে নিয়ে একটা মিনিবাসের দিকে দৌড়ুলেন। পরে বুঝলুম, এই মিনিবাসটা বারাকপুর যাচ্ছে। ভিড়ে ঠাসাঠাসি অবস্থা।

বারাকপুরে একটা বাসস্ট্যান্ডে নামলুম যখন, তখন সাড়ে ছটা বেজে গেছে। সেখানে ঘুঘুডাঙার বাস পাওয়া গেল। ঘুঘুডাঙার স্টপে নেমে দেখি ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। লোডশেডিং। কর্নেল বললেন, পেছনে চর লেগেছিল, ডার্লিং! লালবাজারের উল্টোদিকে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল। যাই হোক, মনে হচ্ছে তাকে ফাঁকি দিতে পেরেছি।

আমরা মাঠ ঘুরে স্বর্গপুরীর পেছনে গেলুম। দুজনের সঙ্গেই টর্চ আছে। কর্নেল গতকাল এসেই বাড়ির চৌহদ্দি মুখস্থ করে ফেলেছেন দেখছি। অবশ্য বরাবর তার এসব ব্যাপারে খুব দক্ষতা দেখে আসছি। এবার আর টর্চ জ্বালতে নিষেধ করলেন। আমাকে ইশারা করলেন পেছনে আসতে। এদিকে নিচু পাঁচিল আছে। দোতলায় অনামিকার ঘরে লণ্ঠনের আলো দেখা যাচ্ছে। ওর দাদুর ঘরেও আলোর আভাস পেলুম বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে।

উত্তর পূর্ব কোণে গিয়ে কর্নেল ফিসফিস করে বললেন, এখানে একটা মন্দির আছে। এস আমরা মন্দিরের কাছে যাই।

অন্ধকারে ততক্ষণে দৃষ্টি পরিষ্কার হয়েছে। মন্দিরটা পুরনো মনে হল। সামনের চত্বরে একটা আটচালার ওদিকে একটা ঝোপের আড়ালে দুজনে বসে রইলুম।

বসে আছি তো আছি। বাতাস বইছে। কিন্তু মশার উৎপাত প্রচণ্ড। একসময় ফিসফিস করে বললুম, এখানে আমরা বসে আছি কেন? মশার কামড়ে যে ঢোল হয়ে গেলুম ফুলে!

কর্নেল বললেন, চুপ!

অমনি দেখলুম, স্বর্গপুরীর দিক থেকে মাটির ওপর টর্চের আলো ফেলে কেউ এগিয়ে আসছে। সে মন্দির চত্বরে এসে একটু দাঁড়াল। এদিক ওদিক তাকাল। তারপর সটান গিয়ে মন্দিরে ঢুকল।

কর্নেল আমাকে খোঁচা মেরে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পা টিপে টিপে এগিয়ে মন্দিরের দরজায় গিয়েই টর্চ জ্বেলে বললেন, ডিমদুটো আছে তো মুখুয্যে মশাই?

দেখলুম, বোঁ-ও করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অনামিকার দাদু। মুখ একেবারে সাদা হয়ে গেছে। আর ওঁর একটা হাতে একটা কালো চোঙ যেন।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, এই শিবলিঙ্গের নকলটা চমৎকার বানিয়েছেন কিন্তু। এবার দয়া করে ঘর থেকে আসল পাথরের শিবলিঙ্গটা এনে যথাস্থানে বসিয়ে দেবেন। আর এক কাজ করুন, হাট্টিম পাখির ডিম দুটো আমাকে দিন। তাহলে আর আপনাকে উদ্বেগ পোয়াতে হবে না। কেউ ভয় দেখাতেও আসবে না। ডিম দুটো সরকারের শুল্ক দফতরের প্রাপ্য নয় কি মুখুয্যে মশাই? হা—দিন, দিন। ও দুটো কাস্টমসকে ফেরত দিতে হবে।

নকল শিবলিঙ্গটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে দিলেন কালোবাবু। একেবারে হতবাক দশা ওঁর। পা দুটো কাঁপছে।

কর্নেল নকল কাঠের তৈরি শিবলিঙ্গ থেকে একটা কাগজের মোড়ক বের করে বললেন, আপাতত এই নকল শিবলিঙ্গ আগের মতো বসানো থাক। পরে আসলটা এনে বসিয়ে দেবেন। আসুন। আর এখানে থাকা নিরাপদ নয়।

কালোবাবু গলার ভেতর থেকে বললেন, চলুন।

খিড়কি দিয়ে বাগানে ঢুকে আমরা সোজা বাড়ির দোতলায় ওঁর ঘরে গেলুম। অনামিকা সাড়া পেয়ে বেরিয়েছিল। প্রথমে অবাক হয়ে পরে একটু হেসে ফেলল। ওর দাদুর অবস্থা দেখেই।

কতক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কালোবাবু বললেন, অনি! আমাদের চা এনে দে! গলা শুকিয়ে গেছে। তারপর কর্নেলের দিকে ঘুরে বললেন, আপনি কেমন করে জানলেন কে জানে! ব্যাপারটা জানতাম শুধু অনির মা আর আমি। আপনার তো জানার কথা নয়!

কর্নেল বললেন, তা ঠিক। তবে ব্যাপারটা অনুমান করতে আমাকে বিশেষ মাথা ঘামাতে হয়নি। ওই ছড়ার ভেতর ডিমের কথা আছে এবং আপনার ছেলে কাস্টমস অফিসার ছিলেন। তাকে স্মাগলাররা খুন করেছিল। দামি রত্নকে সাংকেতিক ভাষায় স্মাগলাররা ডিম বলে। কাজেই..

বাধা দিয়ে কালোবাবু বললেন, হ্যাঁ–দেবুর কাছে শুনেছি কথাটা। দেবুকে ওর নিউ আলিপুরের বসায় ফলো করে এসে গুলি করে পালায় ওরা। দেবুর বুকে গুলি লেগেছিল। বউমাকে সে মৃত্যুর আগে শুধু বলতে পেরেছিল, পকেটে দুটো জিনিস আছে। সামলে রাখো। আর কোনও কথা বলতে পারেনি। স্মাগলিং ঘাঁটি থেকে এই রত্ন দুটো উদ্ধার করে বাসায় আসছিল। তখন রাত প্রায় বারোটা।

তাহলে আপনার বউমা আপনাকে এ দুটো রাখতে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। কিন্তু আমার মাথায় আসেনি, এ জিনিস সরকারের ঘরে জমা দেওয়া উচিত।

আজ রাতে যদি ওরা আপনাকে ভয় দেখাতে না আসে, আর কোনওদিনই আসবে না। কারণ কাল সকালেই জয়ন্তদের কাগজে খবর বেরুবে। ওরা দেখবে পাচার করা রত্ন দুটো সরকারের ঘরে জমা পড়েছে। আর ফিরে পাওয়ার আশা নেই।

অনামিকা চা নিয়ে এল ট্রেতে, সবাইকে চা দিয়ে একপাশে বসল সে। তারপর বলল, পালকগুলো পরীক্ষা করেছেন কর্নেল?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। ওগুলো সিন্থেটিক ফাইবার দিয়ে তৈরি নকল পালক।

তাহলে ওই বিদঘুটে পাখিদুটোও নকল পাখি?

তা আর বলতে? ওরা ভেবেছিল, বুড়োমানুষ—তাকে এভাবে ভূতের ভয় দেখালে ডিম দুটো ফেরত পেতে অসুবিধে হবে না।

কালোবাবু রাগ দেখিয়ে বললেন, আমি ন্যাকা, না বুদ্বু? এদুটো দামি জিনিসকে সত্যি সত্যি হাট্টিমাটিমের ডিম ভেবে ফেরত দিতে চাইব?

ওরা তাই ভেবেছিল। রিটায়ার্ড স্টেশনমাস্টার। ৭৫ বছর বয়স। তিনি কি আর রত্ন চিনতে পারবেন? তাছাড়া রত্ন দুটো দেখুন, অবিকল সাদা ডিম যেন।

আমি বললুম, সব বুঝলুম। কিন্তু দোতলার ওই জানালায় অত উঁচুতে নকল পাখি নিয়ে কীভাবে উঠত ব্যাটাচ্ছেলেরা?

কর্নেল চাপা গলায় বললেন, আমার নাক গলানোতে ওরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে—আজ তার যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছে। আমার ধারণা, ওরা মরিয়া হয়ে সম্ভবত আজ রাতেই শেষ চেষ্টা করবে।

কালোবাবু লাঠি ঠুকে বললেন, আসুক না! ছাতু করে দেব। দেবুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। জয়ন্ত তুমি থাকো। আমি একবার চুপিচুপি থানা থেকে আসছি। দেখি, লালবাজারের ওঁরা থানায় এসে গেছেন নাকি। আমি খিড়কি দিয়ে বেরুব। অনি, তুমি তোমাদের কানাইকে বললা, খিড়কির দরজাটা আটকে দিয়ে আসবে।..

চার

ঢং ঢং করে দেয়ালঘড়িতে রাত বারোটা বাজল। কালোবাবুর ঘরে আলো নিভিয়ে আমরা বসে আছি। কর্নেল থানা থেকে ফিরে এসেছেন। আমরা ওত পেতে আছি হাট্টিমাটিমের অপেক্ষায়।

হঠাৎ পুবের সেই জানালার খুটখাট শব্দ হল। তারপর ভুতড়ে গলায় হিঁ হিঁ শব্দ করে কেউ বলে উঠল, আঁমাদের ডিঁমদুটো দেঁ! এক্ষুনি দেঁ! কী? দিঁবিনে? ঠুঁকরে চোঁখ উঁপড়ে নেব।

বারণ ছিল কথা বলতে! কিন্তু কালোবাবু টর্চ জ্বেলে লাঠি উঁচিয়ে গর্জে উঠলেন, তবে রে হারামজাদার দল! দিচ্ছি তোদের ডিম!

টর্চের আলোয় দেখলুম, জানালায় দুটো প্রকাণ্ড পেঁচার মতো মুখ, মাথায় দুটো শিং, ভয়ংকর বিদঘুটে হাট্টিমাটিম টিম। চোখ দুটো যেন জ্বলছে।

আর তারপরই ওপাশে নিচের বাগানে যেন হুলস্থূল শুরু হয়েছে। গুলির শব্দ। পাকড়ো পাকড়ো চিৎকার। হাট্টিম দুটোও সাঁৎ করে সরে গেল জানালা থেকে। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! শিগগির!

নিচে নেমে বাড়ি ঘুরে পেছনের বাগানে গিয়ে দেখি, একদঙ্গল পুলিশ, দুটো লোককে পাকড়াও করে ফেলেছে। ঘাসের ওপর পড়ে আছে হাট্টিমদুটো। তাদের পায়ের সঙ্গে দুটো লম্বা বাঁশ বাঁধা। বুঝলুম ওই বাঁশের সাহায্যেই ওদের দোতলার জানালায় তুলে ধরত এরা।

আরও মজা আবিষ্কৃত হল। একটির মুখের ভেতর ছোট্ট মাইক বাসানো। একটা তার পালকের ভেতর দিয়ে জড়িয়ে-মড়িয়ে নেমে এসেছে। ঘাসের ওপর পড়ে আছে একটা স্পিকার। স্পিকারের সঙ্গে ব্যাটারি ফিট করা আছে। খুব ফন্দি তো এদের! স্পিকারে ভূতুড়ে স্বরে ডিম ফেরত চাওয়া হচ্ছিল তাহলে।

এখন মুখোশ পরে না থাকলেও লোকদুটোর গড়ন দেখেই চিনতে পারছিলুম, এরাই কাল আমার গাড়ির টায়ার ফাঁসিয়েছিল।

লালবাজারের গোয়েন্দা অফিসার সাবির আমেদ হাসতে হাসতে বললেন, যাক। বহুদিন ফেরারি হয়ে বেড়াচ্ছিল দুই কুখ্যাত ডাকু। কর্নেল, এরাই সেই জগু আর হায়দার। পোর্ট এলাকায় এদের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ হয়েছিলুম তিনটে বছর। বিদেশ থেকে জাহাজে দামি মাল এলেই এদের দলবল সেগুলো সরিয়ে ফেলত।

কালোবাবু ডাকু দুজনের সামনে মুখ খিচিয়ে বললেন, ডিম চাই? অ্যাঁ? তারপর ভেংচি কেটে সুর করে ছড়া আওড়ালেন :

হাট্টিমাটিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমাটিম টিম।

অনামিকা দাদুর কাণ্ড দেখে খিল খিল করে হেসে উঠল।

কিশোর কর্নেল সমগ্র ১ (Kishore Cornel Samagra)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *