একটা আওয়াজ
১৬.
ঢিক-চুঁই-ই-ই-ই-ই..
একটা আওয়াজ হল। এবং আওয়াজটার সঙ্গে সঙ্গেই পাহাড়ি পথের লাল ধুলো যেন পিচকিরির মুখের আবিরের মতো উৎক্ষিপ্ত হয়ে জিপের পেছনে উড়ে গেল।
কালু বলল, হল কেলো! যেখানে বাঘের ভয় সেইখানেতেই সন্ধে হয়।
বাইধর বিরক্ত মুখে নামল স্টিয়ারিং ছেড়ে। ভ্রূকুঁচকে বলল, আপনাদের নামতে হবে। টায়ার পাংচার হয়েছে।
তুমি ভালো মনে আজ সঙ্গী হওনি গোপেনদা।
কালু বলল।
মনের ভালোমন্দ কি আমি নিজেও জানি।
কতক্ষণ লাগবে বাইধর? জ্যাকটা আছে তো?
কালু বলল।
অচ্ছি অচ্ছি সব্ব অছি।
বিরক্ত গলায় বলল বাইধর।
গোপেন একটু অসন্তুষ্ট হল। ড্রাইভারের কাজ গাড়ি চালানো। এবং এই কাজের মধ্যে টায়ার পালাটানোরা কাজও পড়ে। গাড়ি চড়লে মাঝে মাঝে টায়ার পাংচার হয়। এতে এত উম্মার কারণ কী থাকতে পারে, তা ভেবে পেল না। অবশ্য গতরাতে বাইরেরও নিশ্চয়ই ঘুম ভালো হয়নি।
গাড়িটা পাহাড়ের ওপরে চড়েছিল। হাজারখানেক ফিট হবে। একপাশে খাদ অন্য পাশে উঁচু পাহাড়। পথের পাশে খাদের দিকে পাথর আর সিমেন্ট দিয়ে বেঁধে পাঁচিলের মতো করা। যাতে গাড়ি সরাসরি খাদে না গিয়ে পড়ে।
জিপটা থেমে যেতেই বনের, পাহাড়ের খাদের শেষদুপুরের আশ্চর্য এক অপ্রাকৃতিক নিস্তদ্ধতা ওদের গ্রাস করে ফেলল। খাদের মধ্যে শিমূল, বাঁশ আর নানা হরজাই গাছের জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে একটি পাহাড়ি নালা বয়ে চলেছে। এই নালাটির উৎপত্তি হয়েছে। চামুন্ডি মন্দিরের পাশের ঝরনা থেকেই। ঝরনার নামও চামুন্ডি নালা।
সূর্যটা পথের পাশের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে থাকাতে উপত্যকা এখন ছায়ায় ভরে গেছে। বসন্তর পরে গাছে গাছে নতুন পাতা এসেছিল। তখন যাদের পাতা আগে ঝরেনি সেসব পাতা-ঝরা গাছেদের কারো কারো পাতা এখন ঝরছে। বনভূমির পদতল নানা রঙা ঝরা পাতাতে ছেয়ে আছে। ঝিরঝির করে স্নিগ্ধ ঠাণ্ডা হওয়া বইছে একটা, বনের পাতায় পাতায় ঝিরঝিরানি মচমচানি তুলে। টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে উপত্যকার এপাশ থেকে ওপাশে। সবুজ-রঙা মুঠি-ভরা খুদে খুদে পাখিগুলো ধাতব শব্দে ডাকছে পিটি-টুড, পিটি-পিটি-পিটি টুড। পিটি-টুড।
কালু বলল, এই বেলা কাবাব-পরোটা সাঁটিয়ে নিই গুরু। কিন্তু এমন সিনসিনারির মধ্যে খাওয়ার কথাও মনে পড়ে না। দুর শালা। এসব জায়গাতে এলেই আমার সন্নিসী হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। কী শান্তি এল তো মাইরি গোপেনদা! এখানে আসার পরও কারো হুরহুলাগড়ে ফিরে গিয়ে সুমন সেনের ইমেজ গড়ে তোলবার জন্যে প্রাণাতিপাত করতে ইচ্ছে করে? তুমিই বল।
গোপেন পথপাশের ওই সিমেন্ট-পাথরের বেড়ার ওপর বসে ছিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, যা বলেছিস।
ঘটাং করে আওয়াজ করে জিপের পেছনের টুল-বক্স থেকে জ্যাকটা বের করল বাইধর। ওই নিস্তব্ধ পরিবেশে ওই সামান্য শব্দতেই যেন মনে হল, বোমা ফাটল।
তুমি সারিসকাতে গেছ গোপেনদা কখনো?
সেটা আবার কোথায়?
চমকে উঠে বলল গোপেন। নিজের ভাবনাতে বুঁদ হয়ে ছিল ও।
রাজস্থানে। আলোয়ার স্টেট ছিল না? সেই নেটিভ স্টেটের রাজার শুটিং-প্রিসার্ভ ছিল সারিসকা। ভারি সুন্দর জঙ্গল। ঠাণ্ডায় বেজায় ঠাণ্ডা। আর গরমে বেজায় গরম। সেখানে কালিঘাটি বলে একটি ঘাট আছে। এই জায়গাটা দেখে কালিঘাটির কথা মনে পড়ে যায় যখনই আসি।
সারিসকায় গেছিলি কেন? তুই?
বা : রে। আমি তো সোনার এক কারখানায় কাজ করতাম এখানে জয়েন করার আগে। জায়গার নামই সোনা। ওই অঞ্চলে চষে বেরিয়েছি। জয়পুর, উদয়পুর, মাউন্ট আবু, জয়সালমির, পুস্কর, আলোয়ার আরও কত জায়গা। এই বেড়ানোর শখেই তো বিয়ে করাও হল না। মাল কিছু জমাতে পারলে না বিয়ে করব? যত্র আয় তত্র ব্যয়। তবে গুরু, অনেক বিয়েওয়ালা পার্টি দেখলাম। বেশ আছি। তা ছাড়া, যখন মিল্ক ইজ সো চিপ ইন দ্য মার্কেট, হোয়াই শুড আই প্রোভাইড আ কাউ? বেশ আছি। বেঁচে গেছি।
একমুহূর্তের জন্যে গোপেনের ঈর্ষা করতে ইচ্ছে হল কালুকে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
বাইধর কাছে এসে বলল, পেনিতে হাওয়া নেই।
কালু ফিচ করে হেসে বলল, ফাসকেলাস।
সে কী? কী হবে এখন?
আতঙ্কিত গলায় বলল, গোপেন।
ঠাণ্ডা গলায় কালু বলল, হবে আবার কী? কোনো গাড়ি বা ট্রাকে তুলে দেব বাইধরকে, জিরারিতে নেমে যাবে। যেখানে অনেক টায়ার টিউব মেরামতের দোকান আছে।
কোনো ট্রাক বা গাড়ি এলে তো! যা পাণ্ডব-বিবর্জিত পথ।
আরে আসবে আসবে। নইলে টায়ারটা গড়াতে গড়াতেই নিয়ে যাবে বাইধর জিরারিতে।
হঃ।
অবিশ্বাসের গলায় বাইধর বলল।
নীরব বক্তব্য এই যে, শেষে এই আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথে টায়ারটাই গড়িয়ে গিয়ে খাদে পড়ে যাক আর কী! সেটাও একটা কথা বটে।
বাইরের হঃর মানে বুঝে নিয়ে কালু বলল।
তবে?
গোপেন চিন্তান্বিত গলায় বলল। কারণ গাড়িটা কোম্পানির হলেও তারই ব্যবহারের জন্যে তারই হেফাজতে আছে। কালু বলল, জিপটা বাইধরের। সে যেমন বুঝবে তেমন করবে। এই নাও বাইধর, পঁচিশ টাকা ধরো। হেঁটে যাও, ট্রাকে যাও, বাসে যাও যেমন করে হয় যাও। গিয়ে জিরারিতে টিউব বা টায়ার বা দুই-ই সারিয়ে নিয়ে আবার কিছু ধরে ফিরে এসো। আমরা ততক্ষণে হেঁটে হেঁটে এগোচ্ছি।
কোথায়? মন্দিরে? সে তো অনেক পথ। কোথায় খুঁজব?
বাইধর আতঙ্কিত গলাতে শুধোল। এই কালুকে বাইধর মোটেই ভালো চোখে দেখছে না।
না। মন্দিরে নয়। মন্দিরের মাইল দুই নীচে, ঝরনাটা যেখানে পথ পেরিয়ে গেছে তারই বাঁ-দিকে সমান জঙ্গলে থাকব আমরা।
জঙ্গলে? একটু পরই তো অন্ধকার হয়ে যাবে। সাপখোপ বিছা, বাঘ, পেন্ড্রা সব আছে। অন্ধকারে খুঁজব কী করে?
আরে! কাঁই পাট্টি করিচি তু? সন্ধে হলেও অন্ধকার হবে না। আজ ত্রয়োদশীর রাত।
আপনাদের কোথায় খুঁজতে যাব আমি? যে-রাতেই হোক, জঙ্গল তো বটেই!
আমাদের খুঁজতে হবে না তোমায়। জিপটা এ নালার কাছে রেখো। আমরা চলে আসব। এইরকম নীলবর্ণ শৃগালের মতো মাহিন্দ্র জিপ তো হুরহুলাগড়ে দুটি নেই। দর্শনমাত্রই চিনে। নেব আমরা।
গোপেন বলল, আরও দশটা টাকা রাখো। চা-টা খেয়ে নিয়ে।
বাইধর বলল, মুখ গোঁজ করে। টাকা আছে।
তাহলে আমরা এগোলাম।
বলেই, কালু ওপরের দিকে হাঁটা দিল। গোপেন তার পেছন পেছন।
দশ মিনিটের মধ্যেই যেন এক স্বর্গরাজ্যে পৌঁছে গেছে বলে মনে হল গোপেনের। সত্যিই বড়ো শান্তি এখানে। ঠাণ্ডা, এয়াকণ্ডিশানড় ঘরের মতো। ক্কচিৎ পাখির ডাক। স্নিগ্ধ, কলুষমুক্ত হাওয়ার ফিসফিসানি। বড় ভালো লাগতে লাগল গোপেনের। মনে পড়ল না কখনো এর আগে ঠিক এমন জায়গাতে এসেছে বলে। অথচ হুরহুলাগড়ের কত কাছে। হুরহুলাগড়ে এসেছে কম দিন নয়। কালু, গোপেনের মনের ভাব বুঝে বলল, স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে তবে তা এখানেই। বুঝেছ দাদা।
হুঁ।
চলো, আমরা আগের বাঁকটাতে গিয়ে বসে খাব। খেতে খেতে সূর্য ডুবে যাবে। আসলে ডুববে অনেকই পরে। আমরা পাহাড়ের খোঁদলে আছি বলে প্রায় আধঘণ্টা আগে সূর্য অদৃশ্য হবে এখানে। এখানে ভোরের প্রথম আলো পৌঁছোতেও আধঘণ্টা সময় নেয়। খাওয়া শেষ হতে হতেই যেমন সূর্য ডুববে তেমন চাঁদও উঠবে। চাঁদ অন্দর, সূর্য বাহার! আরও একটু এগিয়ে ওই ঝরনার পাশের সমতল বনের মধ্যে পাথরের ওপরে বসে থাকব আমরা। তোমার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে নিজেকে শুধোবার, যদি সমস্যা থাকে কোনো সমাধান করবার, তবে ওইখানে বসে নিজেকে শুধোবে, চাঁদকে সাক্ষী রেখে। সমস্যার কথা ভাববে, দেখবে আপনা হতেই সব উত্তর পাবে, সব সমস্যার সমাধান হবে। এ আমার পরীক্ষিত সত্য।
তাই?
তাই!
আসলে আমি এই চাকরিবাকরি ছেড়ে দেব গোপেনদা। আমাকে এই বন-পাহাড়, এই দুধলি-রাত, এই টুয়েন্টি-টু ক্যারেট গোল্ডের সূর্যাস্ত বড়োই তীব্রভাবে টানে। এত আনন্দ পাই আমি যে, কী বলব। একজন মানুষের পেট পুরোতে কী-ই বা লাগে এল। গান গেয়ে যেটুকু পাব মাধুকরীতে, তাতেই নিজের একার পেটটি চলে যাবে। তাহলে আর অত চিন্তার কী? চিন্তা তো অন্য মানুষদের সঙ্গে থাকলেই।
খাবি না এবার?
খাব। কিন্তু সত্যি বলছি, খিদে তৃষ্ণাও চলে যায় এমন এমন জায়গাতে এলে।
গোপেন কালুর উচ্ছ্বাসে বাধা দিল না।
গোপনে ভাবছিল, একদিন তো মানুষ এমন বনে নির্জনেই বাস করত। তারাই তো শখ করে ও তথাকথিত সভ্যতার তাগিদে শহরে গিয়ে ভিড় করেছিল, সভ্য হয়েছিল, বুদ্ধিমান হবার সাধনায় ব্রতী হয়েছিল। আজ হয়তো সেই প্রসেসকে উলটোবার প্রয়োজন ঘটেছে। শুধু কালুই নয়, বিভিন্ন বুদ্ধিবেত্তার বিভিন্ন মানুষ, বিভিন্ন মানসিকতার স্তরে কালুর ভাবনাটিই নাড়াচাড়া করছে। এ নিয়ে ভাববার অবকাশ সত্যিই হয়তো হয়েছে।
এই মুহূর্তে গেপেনের তার অত্যন্ত ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তা ছাড়া শ্ৰী-সুমন-গোপেন এই ত্রিভূজের ভাবনা ছাড়া, অন্য কিছু ভাবার মতো সময় বা মানসিকতা নেই। এই প্রেক্ষিতে কালুর এই একটানা সলিলোকি ওর ভালো লাগছে না। অন্যভাবে ভেবে দেখলে দেখছে যে, কালুর এ একটানা কথা তাকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্তত বিশ্রাম দিয়েছে ওই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকার থেকে। সব জিনিসেরই যে ভালো-মন্দ দিক আছে তা গোপেন বিলক্ষণই বুঝতে পারছে।
কাবাব পরোটা খেতে খেতেই অন্ধকার হয়ে এল। হাবিবের দোকানের খাবার এমন করে মহুলান পাতায় মুড়ে দেয় যে অনেক্ষণ তা গরম থাকে।
কালু বলল, লক্ষ করছ; সূর্যাস্তর ঠিক আগেই বনে পাহাড়ে ভীষণ এক ব্যস্ততা চারিয়ে যায়। পাখিদের মধ্যে, কোটরা হরিণের ডাকে, কখনো বা বাঘের ডাকেও। কপাল ভালো থাকলে শুনতে পাবে।
গোপেন বলল, আমার কপাল ভালো হয়ে দরকার নেই। ভোদকার বোতলটা খোল। শীত শীত করছে।
এই নাও না। বোতল তো দুটো আছে। জল মেলাবে না?
পরে হবে। গ্লাস-টাস কোথায় এখানে।
চলো, আস্তে আস্তে এগোই ওপরের দিকে।
চল।
মিনিট কয়েক চলবার পরই হঠাৎ কালু বলল, দেখো, গোপেনদা।
গোপেন চেয়ে দেখল পশ্চিমাকাশে, যেখানে সূর্যের শেষ আভাটুকু তখনও রয়েছে ঠিক তার বিপরীতে, একটি থালার মতো, কাঁসার থালার মতো চাঁদ উঠছে।
বা:।
অজানিতে গোপেনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল শব্দটা।
ভাবল, গোপেন।
আরও দশ মিনিট পর সমতল একটি জায়গাতে এসে পৌঁছোলো ওরা।
একটু পরই সমস্ত বন রুপোঝুরি হয়ে যাবে। দেখো। গাছের পাতায় পাতায় রুপোর পাত ঝরবে, রুপোর ঝালর, রুপোর ফুল, বনের মধ্যিখানের পরিষ্কার সমতলে রুপোর গালচে পাতা হবে। ঝিঁঝিরা সরোদে ধূন বাজাবে দেখো।
গোপেন মুখে বলল, থাম! আর বেশি কাব্যি করতে হবে না।
কিন্তু গোপেন সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেছিল। কালু যখন ওকে নিয়ে বনের মধ্যের সাদা গ্র্যানাইটের এক মস্ত চাঙরের ওপরে বসাল তখন গোপেনের মনে হল, এমনি শিলাসনে বসেই বোধহয় সাধুসন্তরা ধ্যান করেন।
হঠাৎ কালু বলল, আচ্ছা গোপেনদা, কম্যুনিস্টদের চাঁদের ওপরে এত রাগ কেন এল তো?
গোপেন হেসে ফেলে বলল, শুধু কমুনিস্টদেরই-বা কেন! সমস্ত বুদ্ধিজীবীরাই চাঁদের ওপর খাপ্পা।
কিন্তু কেন এল তো? ওঁদের বুদ্ধি চাঁদের আলোয় ঘুলিয়ে যায় বলেই কি?
হাসল গোপেন কালুর কথাতে।
বলল, জানি না।
থাকগে। এমন সুন্দর সন্ধেতে কম্যুনিস্টদের আলোচনা বাদ দাও।
এবার কথা থামা তোর। আমার মনটা কালু, বিশেষই বিচলিত আছে।
সে কি আর জানিনে! নইলে তোমাকে এখানে ধরে আনলুম কেন!
আমার বউ…
কে তোমার বউ?
আঃ। শ্রী।
কীসের জোরে তোমার বউ?
তার মানে?
তার সঙ্গে নেপেনের বউ বা জগবন্ধুবাবুর কন্যের কী তফাৎ?
মানে? বিয়ে করা বউ আমার।
বিয়ের মন্ত্র কি বুঝেছিলে দাদা? সেটা বিয়ের মন্ত্র না হয়ে তো শ্রদ্ধর মন্ত্রও হতে পারত! না, কী? সংস্কৃত ভাষার কি তুমি একবর্ণও বোঝো?
না। সেটা ঠিক।
মিনমিন করে বলল গোপেন।
এ জন্যেই তো আজকাল বে-র পরেই অত লাঠালাঠি, মারামারি, ডিভোর্স। কোনো ছেলে বা মেয়েই তো আর বিয়ের মন্ত্র বুঝছে না। আর শালার পুরুতরাও হয়েছে তেমন। সত্যনারায়ণের পুজো করছে না রক্ষেকালীর না বিয়ের মন্ত্র বলছে না শ্রাদ্ধর তা তারা নিজেরাই জানে কি? কেউ কর্পোরেশানের ক্লার্ক, কেউ এ জি বেঙ্গলে লেজার চেক করে, পুজো-আর্চার দিনে পৈতে ঝুলিয়ে নাদুর্ভুড়ি দুলিয়ে পুরুতের কর্ম করে। ওই অপকর্মে আর সুফল কী হতে পারে? তুমিই এল।
কথাটা ভাববার মতো। গোপেনের বিয়ের মন্ত্র গোপেন সত্যিই প্রায় কিছুই বোঝেনি। শ্রী হয়তো আরও কম বুঝেছে। তাই মন্ত্র পড়ে ওদের যে বিয়েটা হয়েছে, তার কোনো শুচিতা ওদের দুজনের কাছেই তেমন নেই। তবে বিয়ের পরে ওরা দুজনে মিলে নিজেদের চেষ্টায় ও যত্নে একটি সুন্দর, সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিল। যা অবশ্য এখন ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
বনের গভীর থেকে একটা পাখি ডাকছে টাকু-টাকু-টাকু-টাকু। পাহাড়তলি থেকে তার দোসর সাড়া দিচ্ছে টাকু-টাকু-টাকু-টাকু-টাকু। একটা খালি ট্রাক নেমে গেল পথ বেয়ে। তার পেছনে যে সামান্য মালপত্র ছিল তা ট্রাকটি খালি থাকায় প্রচন্ড শব্দ করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে লাফাতে লাফাতে চলেছে।
কালু বলল, যাক, এতক্ষণে বাইরের হিল্লে হল।
কেন?
বাঃ। ট্রাক ধরে ও স্টেপনি নিয়ে জিরারিতে যাবে।
কতক্ষণে ফিরবে?
তা ঘণ্টা দুয়েকের ধাক্কা তো বটেই। ওপরে আসার ট্রাক পেলে না ফিরবে।
ট্রাকের শব্দ মিলিয়ে যেতেই আবার সেই অপার্থিব গা-শিরশির-করা নিস্তব্ধতা। ভোদকার নেশা এবং চাঁদের আলো আরও জোর হতে লাগল।
চাঁদের আলোয় গোপেন তার ডান হাতের পাতাটি মেলে ধরল চোখের সামনে। এই হাত দিয়েই সে চড় মেরেছিল শ্রীকে। একবার ইচ্ছে হল, হাতটা কেটেই ফেলে কিছু দিয়ে। এই গোপেন ব্যানার্জির শিক্ষা, সহবৎ, ভদ্রতা সম্বন্ধে এত দীর্ঘ বছর তার অনেকই শ্লাঘা ছিল। সবকিছু কালকে রাতে মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়ে গেছে। হয়েছে আজ সকালে ফোনে যেভাবে কথা বলেছে শ্রীর সঙ্গে গোপেন তাতেও।
কালু স্বগতোক্তির মতো বলল, যে ঘরের ভেতরটা সম্বন্ধেই সন্দেহ আছে গভীর, সেই ঘর তো ঠেলা লাগলেই ভেঙে যায়; গোরু মোষে গা ঘষলেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তাই ঘর-ফর-এর ঝামেলা আমি কখনোই করব না।
আঃ। হঠাৎ একথা?
হঠাৎ আবার কী? কথা তো মনে হঠাই আসে। আগের স্টেশন থেকে কি টরে-টক্কা করে। তারপর কথা আসবে না কি?
তোকে বললাম না কথা না-বলতে।
এ তো কথা নয়। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলাও কি কথা বলা?
নিজের সঙ্গে নিজে কথা-না-বলেই কথা বলতে হয়।
তাই?
হ্যাঁ।
আচ্ছা।
রাত বাড়ছে। নতুন নতুন পাখি চামুন্ডি মন্দিরের পাহাড়ে তাদের গান শোনাচ্ছে। চাঁদের আলো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই পাহাড়টাতে ভোলোমাইট, ম্যাঙ্গানিজ এবং বক্সাইট বেশি নেই। কোয়ার্টজাইট আর গ্র্যানাইট বেশি। তাই যেখানে যেখানে পাহাড়ের গা অনাবৃত সেখানে সেখানে সাদা-কালোর খেলা চলছে। রাতের সঙ্গে সঙ্গে নেশাও বাড়ছে। চাঁদের, ফুলের বাহার খুলছে। রাতের পাহাড়তলি থেকে বনের গন্ধ উঠে সমতলভূমি মাড়িয়ে এসে চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব মানুষকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করছে গোপেনের। নিজের আসল মাপের চেয়ে অনেকই বড়ো মাপের হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে।
ও কি পারবে ক্ষমা করতে শ্রীকে? সুমনকে দিতে পারবে? দিয়ে দিতে পারবে? তার নিভৃত একান্ত ছিল?
না :। তারপর আর মুখ দেখানো যাবে না এখানে। শ্রীকে না-দিয়ে দিলেও আর এই মুখ দেখানো যাবে না। কতরকম দয়া, বাহবা এবং অনুকম্পা সে প্রত্যাশা করবে তার বস-এর কাছ থেকে?
তেমন হীন জীবনে তার বিশ্বাস নেই।
তাহলে কি শ্রীকে নিয়ে হুরহুলাগড় ছেড়ে চলেই যাবে চিরদিনের মতো? ছিঃ ছিঃ করবে তাহলেও লোকে। বলবে কাপুরুষ। তাহলেও তো সুমন ভালো হয়ে উঠেই কলকাতাতে চলে আসতে পারে। সুমনের হাত তো অনেকই বিস্তৃত। সেই হাতের নাগালের বাইরে যেতে পারবে না শ্রী আর কোনোদিনই। সে সাধ্য শ্রীর তো নেই গোপেনেরও নেই। তবে সুমন সেন ফাস্ট-রেট জেন্টেলম্যান। তিনি এমন কিছু করবেন না, যা অভদ্রজনোচিত। আসলে গোপেন শ্রীকেই বেশি ভালোবাসে না সুমনকে, তা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। তা ছাড়া, যদি শ্রীকে নিয়ে এখান থেকে, সুমনের বর্তমান ক্রিটিকাল অবস্থায় গোপেন এ জায়গা ছেড়ে চলেই যায় তাহলে শ্রীও কি ক্ষমা করবে গোপেনকে?
দীপা? দীপার কাছে গেলে কেমন হয়? অদ্ভুত একটি মেয়ে সে। রহস্যময়ী। সে হয়তো শ্রীকে সুমনের কাছে পাঠানোর জন্যেই এই হেঁয়ালির চাল চেলেছিল। গোপেনকে ভালোলাগার মতো বিশেষ কিছুই তো নেই গোপেনের। এমন কিছু অবশ্যই নেই যে একবার দেখেই কোনো সপ্রতিভ শিক্ষিত আধুনিক মেয়ে তার প্রেমে পড়ে যেতে পারে। সেটা একেবারেই অবিশ্বাস্য। কিন্তু তবু, দীপার কাছে একবার তো না গেলেও নয়। তার আসল উদ্দেশ্যটি যে কী, তা না জানলেই নয়। অথচ গেলে দীপা যদি অপমান করে ফিরিয়ে দেয়। দীপার এই অবিশ্বাস্য ভূমিকা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না গোপেন। কে জানে! সে শ্রীকে কী লিখেছিল?
কী যে করবে গোপেন কিছুতেই ভেবে তার কূলকিনারা পাচ্ছে না।
.
১৭.
রাতে অনেকই দেরি করে ফিরেছিল। ফিরেই শুনল ভরতের কাছে যে, শ্রী নীপাদিদের বাড়িতে চলে গেছে।
এমন হতে পারে যে তা ভাবেনি। তবে ভাবা উচিত ছিল। আজকে শ্রীর সঙ্গে অনেকই কথা বলার ছিল তার। জানে না, বলা আর কখনো হবে কি না। ঘড়িতে চেয়ে দেখল, রাত এগারোটা। শ্রীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
ভরত জেগেছিল খাবার নিয়ে। একা বাড়িতে ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেছিল। কয়েকদিন হল কোথা থেকে যেন ও একটি সাদারঙা দিশি কুকুরের ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে। হয়তো সঙ্গী হিসেবেই। শ্রীর বিনা অনুমতিতে নিশ্চয়ই আনেনি। তার গলায় নারকোলদড়ি পাকিয়ে রান্নাঘরের লাগোয়া বারান্দাতে রেলিং-এর সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। ও-ই তার বন্ধু এখন ফাঁকা বাড়িতে।
চান করিয়েছিলি?
গোপেন বলল।
হ্যাঁ। খুব ভালো করে। ভিম দিয়ে।
ভিম দিয়ে? মরে যাবে যে। কক্ষনো করাবি না। ডেট দিয়ে করাবি।
কী খেতে দিয়েছিস?
আমার খাবারের অর্ধেক দিয়েছি দাদাবাবু। আপনাদের খাবার নষ্ট করিনি।
কেন তা করেছিস? কাল থেকে ওর জন্যে আলাদা করে চাল ডাল নিবি।
আচ্ছা।
নাম কী ওর?
ক্ষমা।
ক্ষমা?
হ্যাঁ।
মেয়ে কুকুর?
হ্যাঁ।
কে দিয়েছে নাম?
বউদি।
বাঃ ভালো নাম।
বলেই, গোপেন গম্ভীর হয়ে গেল।
একটু পরে বলল, আমি খাব না। আমার খাবার তুই আর ক্ষমা ভাগ করে খেয়ে নিস।
আচ্ছা।
বউদি কখন গেছেন?
হাসপাতাল থেকে ফিরেই খেয়ে-দেয়ে।
কীসে করে এলেন হাসপাতাল থেকে?
মস্ত একটা সাদা গাড়ি করে, দাদাবাবু। বড়োসাহেবের গাড়ি। লোকেরা ফিরে দেখছিল।
তাই?
হুঁ।
বউদি কখন ফিরবেন?
জানি না। বলেছেন, আপনার সঙ্গে কথা বলবেন ফোনে। বউদির গালে আপনার পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে, দাদাবাবু।
তুই চুপ কর।
হ্যাঁ দাদাবাবু, আজও ওঠেনি। ওই নিয়েই হাসপাতালে গেছিলেন।
কেন?
বললেন, এই আমার গয়না।
তাই? তুই তো বেশি কথা বলছিস। যাকগে সেকথা।
হুঁ।
কাল সকালে একটু বাইরে যেতে হবে আমাকে। সকাল সকাল কিছু খাবার করে দিবি?
কী খাবার?
লুচি-তরকারি তো তুই খুব ভালো করিস। তোর বউদি তো খুব ভালো বলেন। তাই না?
হ্যাঁ। বুঝেছি। কালোজিরে হলুদগুঁড়ো আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে আলুর তরকারি তো!
হ্যাঁ। হ্যাঁ।
ক-টার সময় খাবেন?
ন-টার মধ্যে।
কোথায় যাবেন? বাইরে?
বাইরে মানে, হুরহুলাগড় থেকে দূরে।
কোথায়?
তা তোর বউদিকেই জানিয়ে যাব। একটি চিঠি দিয়ে যাব। তুই পৌঁছে দিতে পারবি নীপাদিদের বাড়িতে?
বাঃ রে! তা কেন? বউদি তো হাসপাতাল থেকে আসবেনই আমার খোঁজ নিতে। তবে বলেছেন যে, খাবেন না এখানে।
কেন?
নীপাদিদের বাড়ি খাবেন।
আমি তো চলেই যাব।
কবে ফিরবেন? আপনি?
এখনই বলা যাচ্ছে না। তুই একা বাড়িতে থাকবি কী করে? হয়, তোর বউদি এসে এখানে থাকুন নয় তুই গিয়ে নীপাদিদের বাড়িতে থাক।
আমি অন্যলোকের বাড়িতে থাকব না।
যা ভালো মনে হয় করিস, তোর বউদির সঙ্গে কথা বলে, তাই করিস।
চান করতে করতে ভাবছিল গোপেন যে, আজ একবোতল ভোদকা খেল কিন্তু কই চেঁচামেচি তো হল না। অবাক হল খুব। মত্ত মানুষ বাধা পেলেই বর্ষার ব্রহ্মপুত্র হয়ে ওঠে। কিন্তু বাধা না পেলে সে শীতের জিঞ্জিরাম নদীর মতো শান্ত। এই কথাটা, যারা বাধা দেয়, তারা যদি বুঝত।
.
১৮.
পরদিন ঘুম ভেঙে গেল খুব সকালেই।
বিয়ের পর জোড়া খাটেই শুয়েছে। মাঝরাতে বার বার অভ্যেসবশে হাত বাড়িয়েছিল শ্রীর দিকে। হাত বারবারই শূন্য বিছানায় পড়েছে। ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে উঠেছে বুকের মধ্যে। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি। আশ্চর্য! কাল সন্ধের চামুণ্ডি পাহাড়ের ওপরে যে পাখিটা ডাকছিল টাকু-টাকু-টাক-টাকু-টাক-টাকু করে সে-ই যেন ডাকছে কাছেই কোথাও। আর তার সহচর সমানে সাড়া দিচ্ছে। সঙ্গে নিয়ে যাবার মতো বেশি জিনিস ছিল না। জয়েন্ট-অ্যাকাউন্ট ওদের। হাজার পাঁচেক টাকা জমেছে তাতে। সেভিংস অ্যাকাউন্ট। কারেন্ট অ্যাকাউন্টটিও জয়েন্ট। তাতেও হাজার পাঁচেক টাকা আছে। এখানের ব্যাঙ্ক সকাল আটটাতে খোলে। বারোটাতে বন্ধ হয়ে যায়। আবার বিকেলে তিনটে থেকে পাঁচটা। দু-হাজার টাকার একটা বেয়ারার চেক কাটল। তারপর দুটি পায়জামা-পাঞ্জাবি, দুটি প্যান্ট আর হাওয়াইন শার্ট এবং দাড়ি কামানোর জিনিসপত্র, দুটি করে রুমাল গেঞ্জি আণ্ডারওয়্যার, বাড়িতে পরার চটি এসব গুছিয়ে নিল। তারপর চিঠিটি লিখতে বসল। চিঠি লিখতে ওর গায়ে জ্বর আসে। কিন্তু প্রবাসী বন্ধুবান্ধব ছাড়া কাউকেই ও চিঠি লেখেনি বলতে গেলে। শ্রীকে লেখার সুযোগই হয়নি কখনো, কারণ দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়নি একদিনের জন্যেও।
হুরহুলাগড় মঙ্গলবার
শ্ৰী। কল্যাণীয়াসু।
তুমি যা করেছ তা ভালোই করেছ। সে সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র বলার এক্তিয়ার এবং অধিকারও নেই।
তুমি শুনে হয়তো অবাক হবে যে, গতকাল আমি কালুর খপ্পড়ে পড়ে আজ অফিস থেকে দুপুরে বেরিয়ে চামুণ্ডি মন্দিরের পাহাড়ে গেছিলাম। হ্যাঁ। তুমি যাকে মোদো-মাতাল এল সেই কালুরই সঙ্গে। কালু ছেলেটি কিন্তু বেশ। ওর ভাবনাচিন্তা খুবই ওরিজিনাল। কালও অনেক। মদ খাওয়া হল। পরশুর চেয়েও অনেক বেশি।
কিন্তু ভরতকে জিজ্ঞেস করে দেখো যে, একটুও চেঁচামেচি করিনি বাড়ি এসে।
মদ জিনিসটা যে অতীব খারাপ সেকথা সম্বন্ধে আমরা প্রত্যেকেই কম-বেশি অবহিত কিন্তু কিছু কিছু গুণও যে তার আছে সে সম্পর্কে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। তবে মদ জিনিসটার প্রতি যাদের পারিবারিক অসূয়া আছে তাঁদের খাওয়া আদৌ উচিত নয়। এই অসূয়া প্রায়ই তাঁদের মধ্যেই দেখা যায়, যাঁদের বাবা অথবা অন্য কোনো নিকট আত্মীয় মদের মাধ্যমে পরিবারের বিসর্জন ডেকে এনেছেন। এমন অনেক অ্যাবনরম্যাল, সাইকিক প্রায়-পাগল, মদ বিরোধী কিছু মানুষকে আমি জানি। তুমি আমার সঙ্গে একটু Considerate ব্যবহার করলে হয়তো আমি একটুও রুক্ষ হতাম না।
যাকগে সেকথা।
পরিমিতির মধ্যে জীবনের সবকিছু উপভোগ্য জিনিসকে ভোগ করারই আরেক নাম শিক্ষা। এত কথা তোমাকে বলার কারণ যে, সুমন সেন প্রায় সবসময় মদের ওপরেই থাকেন। ওটাই তাঁর staple food, যদিও কখনো বেচাল হন না। এবং তিনি একজন মানুষের মতো মানুষ।
বছরে দু-একদিন পাকে-চক্রে পড়ে আমার মদ খাওয়াকে এমন চোখে দেখলে, সুমন সেনের সঙ্গে ঘর করবে কী করে? যাই হোক, পরশু রাতের ব্যবহারের জন্যে তোমার কাছে আমি নিঃশর্তে ক্ষমা চাইছি। আশা করি, নিজগুণে তুমি আমাকে ক্ষমা করবে।
আমি আজই হুরহুলাগড়ের মায়া ছেড়ে, তোমার স্নেহ-প্রেমের বাঁধন ছিঁড়ে, সুমন সেনের কর্মযোগের তীব্র আকর্ষণও কাটিয়ে উঠে চলে যাচ্ছি। ব্যাঙ্কের চেকবইগুলো সঙ্গের মোটা ব্রাউন-রঙা খামটার মধ্যে রইল। আলমারির চাবিও তার মধ্যে রইল। আলমারি খুলে দেখলাম তোমার গয়নাগাটি এবং অন্যান্য নানা সম্পত্তির কোনো সম্পত্তিই তুমি নিয়ে যাওনি। হয়তো পরে নেবে। এসে নিয়ে যেয়ো, যা আমার নয়, তার এককণাতেও আমার লোভ নেই।
তোমার বড়োমামা, যিনি সাংবাদিক, তিনি আমাকে একটি ‘মঁ ব্লাঁ’ কলম দিয়েছিলেন। সেই কলমটিই শুধু নিয়ে যাবার লোভ সামলাতে পারলাম না। শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি বলতে ওই একটিই নিলাম। আমি লজ্জিত।
ব্যাঙ্ক থেকে (কারেন্ট) দু-হাজার টাকার একটি চেক ভাঙিয়ে নেব।
বাকি তিনহাজার দুশোমতো থাকবে। আর সেভিংস-এ থাকবে পাঁচহাজার পাঁচশোমতো। অ্যাকাউন্ট আমাদের জয়েন্টই। চেকবইগুলো রইল, যখন যতটুকু দরকার হবে তুলে নিয়ো। কলকাতা গিয়েই আমার যা সঞ্চয় আছে তা বাড়িয়ে কুড়িয়ে নিয়ে তোমাকে পঞ্চাশহাজার মতো ক্রসড অ্যাকাউন্ট-পেয়ি ড্রাফট-এ পাঠাব নীপাদিদের ঠিকানাতে। এই আমার উপহার।
কোথায় যে যাচ্ছি তা এই মুহূর্তে আমি সত্যিই জানি না। একবার ভেবেছিলাম দীপার কাছে যাই। এরকম কোনো দুর্দৈবর দিনে তার কাছে গিয়ে ওঠার অবাধ অধিকার সে আমায় দিয়েছিল। অন্তত চিঠিতে। কিন্তু যে মেয়েকে চেনারই বাকি অনেক তার কাছে কোন লজ্জায় এবং কোন সুবাদে গিয়ে উঠি! মেয়েটির চরিত্রের রকম এবং সে যে ঠিক কী চায় তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি বলেই না-যাওয়াই মনস্থ করেছি। ঠিক করেছি, চেপে বসব ট্রেনের কামরায়।
কোনো-না-কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যেই তো সকলে চিরদিনই গেছে। অনির্দিষ্ট গন্তব্যে বেরিয়ে পড়ার মজাটাই আলাদা। পেছনে পড়ে থাকবে হুরহুলাগড়, সেনসাহেব, আমাদের অগণ্য কলিগেরা; তুমি, নীপাদি। ভরত এবং ক্ষমা।
ভাবতেই খুব ভালো লাগছে, জানো। ছেলেবেলা থেকে নানারকম ভারে চাপা থাকতে থাকতে ইট-চাপা ঘাসেরই মতো বিবর্ণ, একমুখী, পেঁয়াজখসি-রঙা হয়ে গেছে মানসিকতা। এবারে নিজেকে আবিষ্কার করতে চাই জীবনের আলোতে; শঙ্খ ঘোষের, তুষার রায়ের, জয় গেস্বামীর, কালহিল জিব্রানের কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়ে, তাদের আলো-আঁধারির রহস্য উন্মোচন করতে চাই। জীবনের কম্পাস মেরামত করে নিতে চাই শ্ৰী।
তোমার কালকের চিঠিতে তুমি লিখেছিলে যে, তোমাকে আমি ভালোবাসি বলেই বোধ হয় ঈর্ষাকাতর হয়েছি। তা তো নিশ্চয়ই! ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষকে হারানো তো দূরের কথা, তার ওপরে সামান্যতম ভাগ বসালেও ঈর্ষা হতেই পারে। কিন্তু আমার ভালোবাসা তোমাকে বন্দি না করে যেন মুক্ত করে দিতে পারে চিরদিনের মতো; এই প্রার্থনা করি।
সুমন সেনের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনোরকম যোগ্যতাই আমার নেই। না রূপের, না গুণের।হয়তো তোমার পাশে দাঁড়ানোর মতোও নেই। সেনসাহেব তোমাকে ভালোবেসেছিলেন, এবং তুমি তাঁকে। সেই ভালোবার স্বাভাবিক পরিণতি তোমাদের বিয়েতেই হতে পারত। সেনসাহেবের কোনো দোষই ছিল না। কারণ, কেমন করে তা জানি না, তিনি তোমাকে হারিয়েই ফেলেছিলেন, আণ্ডার মিস্টিরিয়াস সারকামস্ট্যান্সেস।
যাই হোক, তোমার কোনো একদিনের হঠাৎ হঠকারিতার দায় তোমাকে বইতে হত আজীবন দীর্ঘশ্বাসে, চোখের জলে। সেই দায় থেকে তোমাকে আমি মুক্ত করে দিলাম।
আমি কাল অনেক ভেবেছি এই নিয়ে। আমার মনে কোনো খেদ, অভিমান বা দুঃখ নেই। তবে আমার মতো করে কিন্তু আমিও তোমাকে ভালোবাসতাম। সব মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ একরকম নয়। তা হওয়া উচিতও নয়। অনেকে আছেন, ভালো-না-বেসেও খুবই ভালোবাসেন এমন ভাব দেখাতে পারেন। আবার আমার মতোও অনেকে আছেন, দলে তাঁরাই হয়তো ভারী; যাঁরা ভালোবাসা প্রকাশ করার শিক্ষাই পাননি। এটা একধরনের অশিক্ষাও। স্বীকার করি তা। ভালোবাসা প্রকাশ করার শিক্ষাটা যেমন এক ধরনের Art
মনে কোরো, তোমাকে কোনো বহুমূল্য সুদৃশ্য বিদেশি পাখির মতোই কাছে পেয়েছিলাম, কিছুদিন। কাছে রেখেছিলাম, কেয়ারটেকার বেসিসে; একদিন মালিকের হাতে তাকে তুলে দেব বলেই। ট্রেনের কামরাতে একরাত্রি থাকলেও সেই কামরার ওপরে মায়া পড়ে যায়, নেমে যাওয়ার সময় মন খারাপ লাগে; আর তুমি তো মানুষ। একজন জলজ্যান্ত প্রাণবন্তু বুদ্ধিমতী সুন্দর মানুষ। তোমার শরীর মনের এত কাছে দীর্ঘ আট বছরের প্রতিদিন ছিলাম, তাই ছেড়ে যেতে কষ্ট একটু তো হবেই। কিন্তু এই কষ্টের তুলনাতে তোমাকে মুক্তি দিতে পারার কারণে আমার যে আনন্দ, তা অনেক অনেকই গভীর।
দেখছে তো! আমাদের সন্তান না থাকাটা আজ কত বড় সহায় হল। তুমি কত সহজে তোমার ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরে যেতে পারলে। সন্তান থাকলে আমাদের দুজনের কাছেই ব্যাপারটা অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারত। তোমার দয়িতকে তুমি খুঁজে পেয়েছ, বলব, by an acccident. এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে। সেনসাহেবের মা-ও তোমাকে ফিরে পেয়ে খুশি।
আইন-টাইন আমি ভালো জানি না। জানতে চাইও না। ডিভোর্স না পেলে তো তুমি বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু দু-বছরের separation-এর কী দরকার? যদি অবিলম্বে বিয়ে করা সম্ভব হয় তবে তাই কোরো। একটি স্ট্যাম্প কাগজে (তুমি শাড়ির ব্যাবসা করবে নীপাদির সঙ্গে পার্টনারশিপে, তাই কিনে রাখা হয়েছিল দু-মাস আগে, মনে পড়ে?) সই করে দিয়ে গেলাম। যা লিখে নিলে তোমাদের দুজনের কাছে-আসার ব্যাপারটা বাধাহীন হয় তাই তোমাদের উকিলকে বোলো, লিখে নিতে।
ঈশ্বর না করুন, যদি সেনসাহেব ভালো না হয়ে ওঠেন এবং পঙ্গু বা প্যারালিটিক হয়ে যান বাকি জীবনের মতো, তাহলে আমাকে অবশ্যই খবর দিয়ে। আমি ফিরে আসব। তোমাকে নতুন করে দাবি করার জন্যে নয়। সেনসাহেব যে যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন, তা আমাদের সকলে মিলে মিশে, করতে চাওয়াটাই সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য বলে মনে করব। জানি না, অন্যরা কী বলবেন। আদর্শবান মানুষের হার হলেও হতে পারে কিন্তু আদর্শের হারকে কখনো মেনে নেওয়া যায় না। তবে আমার মনে হয়, তার প্রয়োজন হবে না। হাসপাতালে তুমি যদি সবসময় ওঁর কাছে থাকো তাহলেই উনি অনেক তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠবেন।
আর কী লিখব জানি না শ্ৰী। নীপাদিকে ও অশেষদাকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ো। ভরতকে তোমার সঙ্গেই রেখো। যেখানেই থাকো। ছেলেটা তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। অবশ্য তোমাকে কেই বা না ভালোবাসে। আর সঙ্গে রেখো, ক্ষমাকেও।
ভারি, সুন্দর, সময়োপযোগী নাম দিয়েছ কিন্তু কুকুরির।
পরশুর ব্যবহারের জন্যে আবারও ক্ষমা চাইছি। আমার মনে হয়েছে ক্ষুদ্রতা, নীচতা, ঈর্ষা ইত্যাদির মোড়কের মধ্যেই মরকতমণির ঔজ্জ্বল্যে আমাদের বুকের কোরকে আসল মানুষটা বিরাজ করে; সেই প্রাণের প্রাণ! তার গায়ে কিন্তু কোনো কলঙ্ক লাগে না, কোনো গ্লানি বা কালিমা। সে চিরসুন্দর, শুভ্র এবং পবিত্র। সেই সত্তাটি আড়ালে থাকে বলেই, আমাদের শুধু নোংরাটুকুই চোখে পড়ে।
তোমাদের কাছে নিজ পরিচয়ে আর আসব না কখনোই। নিজের ওপর যে আমার আর কোনো ভরসাই নেই। তাই, আসতে ভয় হবে। আমি যে একমাত্র আমি নই! যদি তখনও তোমাদের সুখী দেখে আবার সেই ঈর্ষাকাতর, সাধারণ, ইতর অন্য আমিটা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে! ভয় করে।
ভালা থেকো। খুশি থেকো। সেনসাহেবকে আমার কথা বোলো। বোলো যে, তাঁর কর্মকান্ডে উপস্থিত থাকতে না পারলেও তাঁর সর্বকর্মের সুষ্ঠু সমাধানের জন্যেই তোমাকে রেখে গেলাম। আমার শ্রম দিতে পারছি না বলেই আমার প্রেম দিয়ে গেলাম ওঁকে। দিয়ে গেলাম কথাটা বলার মতো ধৃষ্টতা যেন আমার কখনো না হয়। তুমি তো প্রাণহীন জড় পদার্থ নও। তুমি যে, তুমিই!
শ্ৰী, তোমাকে একদিন সেনসাহেব সম্বন্ধে বলেছিলাম যে, মানুষটির মন তো নয়, যেন হাজারদুয়ারি! বা ওইরকম কোনো কথা। ঠিক কী বলেছিলাম তা মনে পড়ছে না। ভেবে দেখলাম, শুধু সেনসাহেবের মনই নয়, আমার, তোমার, দীপার, নীপাদির, কালুর এবং যত মানুষকে আমরা চিনি জানি তাঁদের প্রত্যেকেরই মনই বোধহয় হাজারদুয়ারি। কোন দুয়ার দিয়ে যে কখন আলো আর হাওয়া ঢুকবে আর কোন দুয়ার দিয়ে যে মনের জমাট-বাঁধা অন্ধকার কখন নিষ্ক্রান্ত হবে তা মন বোধ হয় নিজেই জানে না। এক দুয়ারে যখন রোশনচৌকি বসবে, সানাইতে হংসধ্বনি রাগ বাজবে, অন্যদুয়ার দিয়ে তখন কোরা-কাপড়ে মুড়ে মনের অন্য কোনো শরিককে অন্তিম যাত্রা করাতে হবে। একের মধ্যে বহু, আপাত-সাধারণ্যের মধ্যে এত বৈচিত্র রয়েছে বলেই হয়তো মানুষ হওয়াতে আমাদের এত গর্ব। তাই না?
তোমার জন্যে এবং সেনসাহেবের জন্যেও আমার অনেক গর্ব। আমাদের প্রত্যেকের মনুষ্যত্বর জন্যেও গর্ব।
ভালো থেকো শ্ৰী, আমার একসময়ের স্ত্রী।
Take care.
ইতি–গোপেন।
তোমার একসময়ের স্বামী।
চিঠিটা লেখা শেষ করে, ভাঁজ করে একটি খামে ঢুকিয়ে সেলোটেপ দিয়ে যত্ন করে মুখটি আটকাল। তারপর ভরতকে ডেকে বলল, তুই চটপট খাবারটা তৈরি করে নে ভরত। আমি ঝটপট চানটা সেরে নিয়ে একবার ব্যাঙ্ক থেকে ঘুরে আসি। এই চিঠিটা তোর কাছে যত্ন করে রেখে দে। আর এই একশোটা টাকা রাখ।
কেন? টাকা কেন দাদাবাবু?
আরে আমার ফিরতে তো দেরিও হতে পারে!
বাজার দোকান করতে হবে না? তোর বউদি তো রইলেন। ভালো করে দেখাশোনা করিস বউদিকে। আমি যাচ্ছি। আর শোন। এই চিঠিটা শুধু বউদিকেই দিবি। এবং আমি চলে গেলেই।
আপনি কোন ট্রেনে যাবেন?
ঠিক বলেছিস। কোন ট্রেনে যাব তা আমিই জানি না।
আপ না ডাউন?
তাও জানি না।
তাড়াতাড়ি চান করেই গোপেন ব্যাঙ্কে দৌড়োল। বাইধর আসেনি এখনও। হেঁটেই গেল।
ম্যানেজার চাঁদসাহেব বললেন, এত সকালে? এত টাকা!
দান করার পক্ষে এই সময়টাই কি প্রশস্ত নয় চাঁদসাহেব?
তা গ্রহীতাটি কে? কোন ভাগ্যবান?
স্বয়ং নিজেই। নিজেকে নিজে দান করার সুযোগ তো বড়ো একটা আসে না।
চাঁদসাহেব হেসে ফেললেন।
বললেন, কথাটা আপনি খুবই ভালো বলেন।
ওই জন্যেই তো কাজে লবডঙ্কা। চলি।
ভরত তৈরিই রেখেছিল লুচি তরকারি উপাদেয়। পেট-ভরতি করেই খেয়ে নিল। পথে কোথায় কী জোটে না জোটে! পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে স্টেশন। পানীয় জল পেতেও ঝামেলা। ওয়াটার-বটলটা ঝুলছিল বারান্দার র্যাকে।
ওদিকে তাকাতেই ভরত বলল, জল ভরে দেব? দাদা?
না থাক। ওটা তো তোর বউদির।
বউদি কি একার জল খাওয়ার জন্যে কিনেছিলেন নাকি?
না, তা নয়। শখ করে কিনেছিলেন যখন, তখন কাজে লেগে যাবে কোনো-না কোনোদিন। যেদিন খোঁজ পড়বে সেদিন তুই তো বলবি, দাদাবাবু মেরে দিয়ে চলে গেছে। পরের জিনিস না বলে নিলে চুরি করা হয়, তা জানিস না বুঝি?
বউদি বুঝি আপনার পর?
না:। পর হতে যাবেন কেন! আপনই। তবে কী জানিস ভরত, তুই এখনও ছোটো আছিস, তাই বলছি, আপন কাউকেই করা ভালো। মনে করবি, সকলেই তোর পর। তারপরও যদি কেউ আপন হতে চায়, তোর বন্ধু, সাদা কুকুর। এই ক্ষমার মতো; যে তোর পায়ে গা ঘষে, তোর গাল চেটে দেয় ভালোবেসে, তাতে খুশি হবি। কিন্তু সব সময় জানবি, এটা বাড়তি পাওনা। এই সুখ, হিসেবের মধ্যে আদৌ ছিল না।
বুঝেছিস?
ভরত কিছুই না বুঝে মাথা নাড়ল।
সব কথা ভরত বুঝবে এমন ভেবে গোপেন কথাগুলো বলেওনি। মানুষকে যখন কথায় পায় তখন সামনে ছোটো-বড়ো, গাছ বা পাথর কাউকে পেলেও কথা বলে হালকা হতে ইচ্ছে যায়।
ক্ষমা, না বুঝেই কান নাড়তে লাগল।
মেয়ে কুকুরও বোধ হয় পুরুষমানুষের চেয়ে বুদ্ধি বেশি রাখে।
চা-এর কাপটা একচুমুকে নামিয়ে রেখে ব্যাগটা তুলে নিয়ে গোপেন বলল, চলি রে ভরত। ভালো থাকিস। তোর বউদিকে দেখিস।
আমি যাব না স্টেশনে?
না : কী দরকার। যদি তোর বউদি এসে পড়ে তো বাড়িতে ঢুকতে পারবেন না। চিঠিটা ভালো করে রেখেছিস তো?
হ্যাঁ। এই তো। বুক-পকেটেই আছে।
আমি গেলে বেশ সিটি-অফ করতে পারতাম।
ভরত বলল।
কী অফফ?
সিটি-অফফ।
সি অফফ! কথাটা বুঝে হেসে ফেলল গোপেন।
বলল, থাক আর সিটি-অফফ না করলেও চলবে।
প্রায় ঠিক সময়েই পৌঁছোল গোপেন স্টেশানে। মাথাটা ভারশূন্য মনে হচ্ছিল। বড়োজামদার টিকিট নিল একটা। কিন্তু নেমে পড়বে আগের কোনো স্টেশনে। যেখানে জঙ্গল ঘন, নদী আছে, পাহাড়; যেখানে কটা দিন দায়িত্বশূন্য, কাজশূন্য, দাবিশূন্য হয়ে কাটাতে পারবে একেবারেই একা।
কালুর কথা মনে পড়ে গেল।
একজন মানুষের পেট-পুরোতে কীই-বা লাগে এল? গান গেয়ে যেটুকু পাব মাধুকীরতে তাতেই নিজের একটি পেট চলে যাবে। তাহলে আর অত চিন্তার কী? চিন্তা তো অন্য মানুষদের সঙ্গে থাকলেই! মন শান্ত হয়ে এলে তারপর পেটের রুজির তাগিদে আবার বেরোবে।
দেখা যাবে সেসবপরের কথা পরে।
সেকেণ্ড ক্লাসের জানালার পাশের একটি সিটে হেলান দিয়ে বসেছে গোপেন। প্রথম ঘণ্টা বেজে গেছে। দ্বিতীয় ঘণ্টাও বাজল। বিভিন্ন যাত্রীর আত্মীয়-পরিজন, স্বামী-স্ত্রী, পুত্রকন্যার বিদায়-সম্ভাষণের পালা শেষ হল। কোম্পানির একজন কনট্রাক্টর হঠাৎ গোপেনকে চিনতে পেরে হন্তদন্ত হয়ে বললেন, আপনি স্যার? এই ক্লাসে? কেন?
হ্যাঁ ভাই। এখন থেকে এই ক্লাসেই…
ডিমোশান হয়েছে নাকি?
কনট্রাক্টরের মুখ থেকে গদগদভাব, এবং খোশামোদি উবে গেল।
গোপেন উত্তর দিল না কোনো! তাকিয়ে রইল ভদ্রলোকের দু-চোখে।
ট্রেনটা ছেড়ে দিল। প্ল্যাটফর্মের শেষপ্রান্ত থেকে গার্ডসাহেবের বাঁশি শোনা গেল। তারপরই গতি পেল ট্রেন।
একটা চেঁচামেচি শুনে প্ল্যাটফর্মে পেছন ফিরে চেয়ে দেখল গোপেন। শ্ৰী, ভরত এবং ক্ষমা প্ল্যাটফর্মে ছুটোছুটি করে সম্ভবত ওকেই খুঁজছে। ওদের পেছনে পেছনে ভানু মহাপাত্রবাবু। তিনি কী করে জুটে এলেন কে জানে! মনে পড়ে গেল গোপেনের যে, আগামীকাল ত্রিপাঠীজিকে বলে ভানুবাবুকে দেড় লাখ টাকার একটা চেক পাইয়ে দেবার কথা ছিল। কথা দিয়েছিল, হুরহুলাগড়ের অফিসার গোপেন।
এই গোপেন সেই গোপেন নয়।
শ্রী একটি কচি-কলাপাতা রঙা শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউজ। ছুটোছুটিতে ওর আঁচল খসে পড়েছে। ব্লাউজের নীচে ফর্সা সুন্দর নাভি দেখা যাচ্ছে সুগঠিত কোমরের কেন্দ্রবিন্দুর মত। নিজের স্ত্রীকে ট্রেনের অন্ধকার কামরায় বসে রৌদ্রালোকিত প্ল্যাটফর্মে পরপুরুষের চোখ দিয়ে দেখা একটি অভিজ্ঞতা বইকি! ক্ষমা ল্যাজ নাড়ছে আর ঘন ঘন ডাকছে উত্তেজিত হয়ে। কিন্তু ওরা কেউই দেখতে পায়নি গোপেনকে। ওরা ফার্স্টক্লাস আর এয়ার কণ্ডিশানড ক্লাসের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল এতক্ষণ।
ভরত চিঠিটা দিয়েছে তো শ্রীকে?
এবার ট্রেনটা ফাঁকায় এসে পড়েছে। স্টেশানের শোরগোল আর নেই। পাশেই ইয়ার্ড। ঘটাঘট শব্দ করে ট্রেনের চাকা অনেক জোড়া জোড়া লাইন পেরিয়ে এল। ইয়ার্ড পেরোনোর পরই উন্মুক্ত সবুজ প্রান্তর, পাহাড় জঙ্গল, নদী, হাওয়া লাগছে চোখে-মুখে। এক অচেনা অজানা জগতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও।
গোপেন একটা সিগারেট ধরাল পকেট থেকে বের করে।
একজন অন্ধ ভিখিরি, ভিখিরি বোধ হয় নন; সম্ভবত মাধুকরী করেই খান, কারণ ভিক্ষে কারো কাছেই চাইছিলেন না। দিলরুবা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে এলেন কামরার অন্য প্রান্ত থেকে। পিলুতে বাঁধা ঠুমরি। রাগের সময় বিচার করে গান আর কে গায় আজকাল!
চোখ বুজে ফেলল গোপেন!
সাইঞা মোরে তেহার বিনা
নিন্দিয়া না আয়ে।
তড়প তড়প মোহে বীত গ্যই রতিয়া
জিয়া তুম বিনা কাল নাহি আয়ে।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছেন গায়ক। ভারি ভালো জুয়ারি। গলার। চোখ বন্ধ করেই শুনছে এখন ও। কামরার মধ্যের নানা আওয়াজ-এর সঙ্গে মিশে সে-গানের জমক যেন আরও বেড়েছে।
পাশের সিটে একজন বৃদ্ধা বসেছিলেন। তিনি বললেন, তোমার চোখে কি কয়লা গেছে বাবা? জল গড়াচ্ছে কেন? দেখো, চোখটা আবার কচলে দিয়ো না যেন।
গোপেন মাথা নাড়ল।
ইঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ। এবং না।
ভাবছিল, কয়লার বাষ্পে চলা ট্রেন তো কবেই উঠে গেছে তবু ট্রেনে চড়লেই আজও চোখে কখনো কখনো কয়লা পড়েই!
আশ্চর্য!