অষ্টম পরিচ্ছেদ
নগেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এ কথা ত আগে বলেন নাই?”
অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আগে শুনি নাই।”
“কাহার কাছে শুনিলেন?”
“উমিচাঁদ, ললিতাপ্রসাদ আর খোদ গুরুগোবিন্দ সিং-এর নিকট শুনিয়াছি।”
“তাহারা কি বলে?”
“গত রাত্রে কে একজন গুরুগোবিন্দ সিং-এর বাসায় একখানা পত্র রাখিয়া যায়। সেই পত্রের ভিতরে দশ হাজার টাকার নোট।”
“কে সে লোক?
“গুরুগোবিন্দ সিংহের চাকর বলে যে, সে একজন দারোয়ান। কোথা হইতে আসিয়াছে, জিজ্ঞাসা করিলে সে বলে, “চিঠিতে সব লেখা আছে, চিঠি বাবুকে দিও।’ এই বলিয়াই সে চলিয়া যায়।”
“আশ্চৰ্য্য, সন্দেহ নাই।”
“এখন কে খুন করিয়াছে বলিয়া বোধ হয়?”
“আমার বিশ্বাস, এসবই গুরুগোবিন্দ সিংহের ফন্দী।”
“ভুল।”
“তবে আপনি কি স্থির করিয়াছেন, বলুন।”
“কিছুই পাকা স্থির করিতে পারি নাই, তবে কতক বিষয় জানিতে পারিয়াছি। সে রাত্রে গঙ্গা হুজুরীমলের সঙ্গে দেখা করে নাই।”
“কে করিয়াছিল?”
“যমুনা। সে এ কথা নিজ মুখে স্বীকার করিয়াছে; কিন্তু কিজন্য দেখা করিয়াছিল, তাহা সে কিছুতেই বলিবে না—কাজেই সে এ চুরি ও খুনের বিষয় জানে।”
“তবে বলিতেছে না কেন?”
“কাহাকেও ঢাকিবার জন্য।”
“কাহাকে ঢাকিবার জন্য?”
“বলিয়াছি ত হুজুরীমলের স্ত্রীকে।”
“আপনি কি মনে করেন, সে-ই খুন করিয়াছে?”
“মনে করা না করায় কি আসে যায়—প্ৰমাণ চাই।”
“কিন্তু তাহার খুন করিবার কারণ কি?”
“ঈর্ষা—সে মনে করিয়াছিল, হুজুরীমল গঙ্গাকে লইয়া পলাইতেছে।”
“রঙ্গিয়াকে খুন করিবে কেন?”
“ঈর্ষা—ঈৰ্ষাবশে স্ত্রীলোক সকল কাজই করিতে পারে। যেমন করিয়া হউক, সে জানিয়াছিল যে, গঙ্গা তাহার স্বামীর সঙ্গে দেখা করিবে। তাহাই সে তাহাদের সন্ধানে গিয়াছিল। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া তাঁহার বুকে ছুরি বসাইয়াছিল। তখন রঙ্গিয়া এই ব্যাপার দেখিয়া ভয়ে পালায়। হুজুরীলের স্ত্রী তাহার পিছনে যায়, তাহার পর তাহাকেও খুন করে।”
“সিঁদুরমাখা শিব?”
“হুজুরীমলের স্ত্রী পঞ্জাববাসিনী। নিশ্চয়ই সে এই সম্প্রদায়ের একজন—কাজেই তাহার কাছে এই সিঁদুরমাখা শিব ছিল। সম্প্রদায়ের একজনের উপর এরকম ব্যবহার করিলে তাহাকে খুন করাই বোধ হয়, তাহাদের নিয়ম। তাহাই দুইজনকে খুন করিয়া সে সেই সিঁদুরমাখা শিব লাসের কাছে রাখিয়া দিয়াছিল।”
“এ খুব সম্ভব হইতে পারে বটে; কিন্তু তাহা হইলে আপনার গাড়োয়ানের কথা ঠিক হয় কিরূপে? সে একজন স্ত্রীলোককে আর একজন পুরুষকে গাড়ীতে লইয়াছিল।”
‘এইজন্য বোধ হয়, হুজুরীমলের স্ত্রী একাকী আসে নাই—সে একজন পুরুষকে সঙ্গে লইয়া যায়। যেরূপ জোরে ছোরা মারিয়াছে, তাহাকে কোন স্ত্রীলোকের কাজ বলিয়া বোধ হয় না; কোন পুরুষ ইহার ভিতরে আছে।”
“এ পুরুষ কে মনে করেন?”
“তাহারই সন্ধান করিতেছি।’
“এ লোক গুরুগোবিন্দ সিংও হইতে পারে। কেননা, গুরুগোবিন্দ সিং পঞ্জাবের লোক, সে নিজে স্বীকার করিয়াছে যে, সে এই সম্প্রদায়ের লোক। সম্ভবতঃ এক সম্প্রদায়ের লোক বলিয়া হুজুরীমলের স্ত্রী নিজের স্বামীর দুর্ব্যবহারের কথা ইহাকে জানাইয়াছিল; তাহাতে খুব সম্ভব, গুরুগোবিন্দ সিং তাহার সহিত রাণীর গলিতে যায়, তাহার পর সে-ই খুন করে।”
“সম্ভব, কিন্তু টাকা চুরি করে কে?”
“টাকার কথা সবই মিথ্যা—সন্দেহ দূর করিবার একটা ফন্দী।”
“উমিচাঁদ নিজের হাতে টাকা সিন্দুকে রাখিয়াছিল।”
“উমিচাঁদকে ইহারা হাত করিয়াছে।”
“টাকা না লইয়াই কি হুজুরীমল গঙ্গাকে লইয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল? এ কোন কথাই স্থির হইতেছে না। এই মোকদ্দমা লইয়া খুব বেশী রকমে মাথা ঘামাইতে হইবে, দেখিতেছি।”
বিরক্তভাবে অক্ষয়কুমার উঠিলেন।