Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » হঠাৎ দেখা || Shampa Dey

হঠাৎ দেখা || Shampa Dey

হঠাৎ দেখা

ট্রেন থেকে নেমেই কোনরকমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলি আমি। ওভারব্রিজ খুব সংকীর্ণ; মানুষের সংখ্যা অগণিত। সর্বত্র দেখা যায় প্রচন্ড ধাক্কা ধাক্কি। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার ভিড় যতখানি, তার থেকেও বেশি ভিড় ওপার থেকে সিঁড়ি দিয়ে ছুটে আসা মানুষের। তারা ট্রেন ধরবার জন্য আপ্রাণ ছুটে আসছে। তার মধ্যে আমি দিশেহারা। প্রচন্ড ভিড় ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এগোতেও পারছি না, আবার পিছনে ফেরার পথ পাওয়াও দুষ্কর। কারণ ট্রেন থেকে নেমে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছানোর তাড়া আছে সবার। তাই কে পড়ে গেল অথবা কার অসুবিধে হচ্ছে সেসব দেখার সময় নেই কারুর হাতেই।।

অগত্যা সেই ভিড়ের মধ্যেই কোনরকমে পথ খুঁজে এগিয়ে চলেছি আমি। হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়ল একটু দূরে। একজন বছর ৬৫ / ৬৬ বৃদ্ধা, চোখে ফুল পাওয়ারের চশমা, বয়সের ভারে কিছুটা বিধ্বস্ত। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে। আমার দৃষ্টি ওনার দিকেই আটকে আছে। আমি ক্রমাগত ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলছি, আর ওনাকে দেখছি। কেন জানিনা আমার বারবার মনে হচ্ছিলো – এই প্রচন্ড ভিড়ে ওনার এই সংকীর্ণ ওভার ব্রিজ দিয়ে হেঁটে যেতে খুব অসুবিধা হচ্ছে, উনি অসুস্থ বোধ করছেন হয়তো। ভীষণ ঘামে ওনার শরীর ভিজে যাচ্ছে। তাই আমি ওই ভিড় ঠেলে উনার কাছে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। কোনরকমে বৃদ্ধার কাছাকাছি এসে আমি ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম – “আপনি কি অসুবিধায় পড়েছেন…. শরীর ঠিক আছে তো আপনার ??”
আমার কথা শুনে বৃদ্ধাও যেন হঠাৎ একটু সম্বিৎ ফিরে পেলেন মনে হল; উনি বললেন – আসলে এই প্রচন্ড ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে পারছেন না; কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাও ভিড়ে খুব সমস্যা হচ্ছে; উনি অসুস্থ বোধ করছেন। সব শুনে আমি বললাম – “আপনার ব্যাগটা আমাকে দিন, আর আপনি আমার হাত শক্ত করে ধরুন। আমি আপনাকে সুস্থ ভাবে ঠিক এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বাইরে খোলা হাওয়ায় এগিয়ে নিয়ে যাব। আপনার কোন কষ্ট হবে না। আপনি একটুও ভয় পাবেন না। আমি আছি তো আপনার সাথে, আপনার মেয়ের মত। আপনি এগিয়ে চলুন আমার সাথে।

বাচ্চারা ছোট থাকলে বাবা-মাকে যেভাবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভিড় পথ অতিক্রম করে; ঠিক সেইভাবেই উনি আমার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি ভিড় ঠেলে কোনরকমে বৃদ্ধাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চললাম। ক্রমশ ওভারব্রিজ শেষ হতেই আমি ওনাকে নিয়ে পাশেই একটা দোকানে বিশ্রামের জন্য নিয়ে গেলাম। একটা চেয়ারে বসলাম সেখানেই। একটু জল খেতে দিলাম। আর বৃদ্ধাকে অনুরোধ করলাম, যাতে উনি একটু ওনার চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে নেন। তাহলে শরীরের ক্লান্তি হয়তো অনেকটা কেটে যেতে পারে। বৃদ্ধা ও সেটাই করলেন যেটা আমি বলেছিলাম ওনাকে। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে রইলাম। তারপরে উনি আমার সকল পরিচয় জানতে চাইলেন। আমিও যতটা পারলাম গল্পের মত ওনাকে একটু করে বলতে শুরু করলাম। হঠাৎ উনি আমার নাম ধরে ডেকে উঠলেন। শুনেই আমি চমকে উঠলাম। কৌতূহলবশত আমি জানতে চাইলাম – “আপনি আমাকে চেনেন…. কিভাবে চেনেন ??” বৃদ্ধা একটা প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তারপর বললেন – উনি আমার স্কুল শিক্ষিকা। শুনে আমি বাকশূণ্য হয়ে গেলাম। সুদীর্ঘ ২৫/২৬ বছর পর ওনার সাথে আমার সেদিন এই ভাবেই হঠাৎ দেখা। কখনও ভাবিনি এমন ভাবেই আমাদের দেখা হবে। আমার মন এক অজানা আনন্দে ভরে উঠলো। দীর্ঘক্ষণ আমরা ওই দোকানেই বসে অনেক কথা শেয়ার করলাম। ছোটবেলার স্কুল জীবনের অনেক আনন্দের মুহূর্ত শেয়ার করলাম। দুজনেই তখন আমরা ভীষণ খুশিতে আপ্লুত। মনে মনে ভাবলাম – আমার মত একজন ছাত্রকে (পড়াশোনায় খুব ভালো কোনো কালেই ছিলাম না) ম্যাম এখনো মনে রেখেছেন!!! তাইতো আমার নামটা আজও দিদির মুখে নিমেষেই চলে আসলো।

কিছুক্ষণ পরেই দিদির গাড়ি এসে পৌছালো। দিদিকে ভক্তিভরে প্রণাম জানিয়ে, দিদির আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে, দিদিকে গাড়িতে বসিয়ে আমি বিদায় নিতে চাইলাম। ঠিক সেই সময় দিদি বললেন – আজ অনেক গর্বিত অনুভব করছেন, গর্বিত অনুভব করছেন ওনার দেওয়া শিক্ষাকে নিয়ে। তিনি গর্বিত হয়েছেন ওনার ছাত্রীকে নিয়ে, কারণ উনি বললেন – আজকাল মানুষের হাতে সময় নেই অন্যকে দেখার। সময় নেই অন্যের বিপদে এগিয়ে এসে সময় দেবার। যেখানে মানুষ আজকাল নিজের বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছে দেখাশোনা করার দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে আমি দিদিকে চিনতে না পেরেও এগিয়ে এসেছিলাম।ভরসা আর বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম ওনার দিকে। বিপদ থেকে ওনাকে টেনে বের করার চেষ্টায় এগিয়ে গিয়েছিলাম। তাই দিদি আজ ভীষণ খুশি হয়েছেন।

সুদীর্ঘ অনেক বছর পার করে দিদি কে হঠাৎ কাছে পেয়ে, পুরানো দিনের গল্প করে আমার মনটাও আজ পরিতৃপ্ত। আজ বারবার সেই স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে ছোট ছোট অনেক হাসি -আনন্দের স্মৃতি, যে দিনগুলো আর কখনো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।পুরানো দিনের সেই আবেগ ভরা স্মৃতি রোমন্থনের সময় আজ আমার দুচোখে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমে আসছে ।আজ যেন সেই স্মৃতিটুকুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে বারবার। আজ এই শিক্ষক দিবসের প্রাক্কালে হৃদয়আমার অশ্রু ভারাক্রান্ত, ছোট বেলার সেই দিনগুলো, সেই স্কুল, সেই টেবিল-চেয়ার, সেই ক্লাসরুম, আমার সেই প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অভাব আজও অনুভব করি ।আজ হারিয়ে যাওয়া সেই আনন্দের অনুভূতি গুলো হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেলো স্মৃতির পাতায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *