স্বর্গের বাহন : 02 – গোরস্তানে এক দর্জি
নিছক একটা তসবির অর্থাৎ ছবির জন্য কেউ কাউকে পাগল করে দিয়েছে এবং কীভাবে তা করেছে, সে নিয়ে আমার মাথাব্যথার কারণ ছিল না। কিন্তু আমাদের কাগজের চিফ অফ দা নিউজ ব্যুরো শেষ পর্যন্ত নিছক ওই ছবির জন্যই আমাকে পাগল করে ছাড়বেন, কল্পনা করিনি। “রেপোর্টাজ যে ছাপা হবে, তার সঙ্গে ছবি থাকবে না সে কী কথা? তোমার সঙ্গে আমাদের স্টাফ ফটোগ্রাফার রামবাবুও যাচ্ছেন।” রাত দশটায় ফোনে গাঙ্গুলিদা এই দুঃসংবাদ দিয়েছিলেন।
তা, রামবাবুরামকুমার হাটি মানুষ হিসেবে অমায়িক এবং ভদ্র। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক ফোটোগ্রাফি প্রদর্শনীগুলোতে পুরস্কার পেয়েছেন। নিঃসন্দেহে নামী ফটোগ্রাফার। কিন্তু সঙ্গী হিসেবে এমন বিরক্তিকর আর সবতাতে নাকগলানো মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। তার চেয়ে বড় বিপদ, ওঁর অবিরাম বকবকম। কান ঝালাপালা হয়ে যায়।
বেগতিক দেখে ভেবেছিলাম ওঁকে কর্নেলের সঙ্গে ভিড়িয়ে দেব, কিন্তু কর্নেলের উদ্দেশ্যে রামবাবু মুখ খুললেই দেখি, কর্নেল ঝটপট চোখে বাইনোকুলার স্থাপন করে ধ্বংসস্তূপের ভেতর হেঁটে চলেছেন এবং কিছুদূর অনুসরণের পর রামবাবু থমকে দাঁড়িয়ে অগত্যা ক্যামেরা তাক করছেন কোনো গম্বুজ বা মিনারের দিকে।
এতে কিছুক্ষণের জন্য রামবাবুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছিলাম। কারণ রামবাবু ফটো তুলতে বড় সময় নেন।
আমরা উঠেছিলাম নিজামতকেল্লার একপ্রান্তে একটা একতলা বাড়ির দক্ষিণ পশ্চিম কোণের একটা ঘরে। এই বাড়িটায় নবাবসাহেবের বোন শামিম-আরা বেগম বাস করেন। এ বাড়িটার বয়স বেশি নয়। জাহানাবাদ এস্টেটের ট্রাস্টিবোর্ড কেয়ারটেকারের থাকার জন্য বছর তিরিশ আগে বানিয়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণে ও পশ্চিমে একটুকরো করে খোলা বারান্দা আছে। দক্ষিণে ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা পোড়ো জমির ওধারে নিচু পাঁচিলে ঘেরা নবাব পরিবারের বংশানুক্রমিক গোরস্তান। প্রচুর গাছপালা আছে সেখানে। পশ্চিম ও উত্তর দিক জুড়ে বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। তবে সবটাই ধ্বংসস্তূপ নয়। কোনো কোনো অংশ এখনও গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের একটা প্রকাণ্ড গম্বুজ ও মিনারওয়ালা মসজিদও অক্ষত আছে। তার ওধারে গঙ্গানদী বয়ে যাচ্ছে। এই নিজামতকেল্লার পশ্চিমের দেয়াল পুরোটাই বুকে টেনে নিয়েছে।
শামিম-আরা পর্দা মানেন না। কিন্তু রামবাবু সহাস্যে ওঁর দিকে ক্যামেরা তাক করলে নিষেধ করেছিলেন। কিছুক্ষণ পরে রামবাবুকে স্বগতোক্তি করতে শুনেছিলাম, “ভাবা যায় না। ভাবা যায় না। লাইফে অ্যাদ্দিনে সত্যিকারের বেগম দেখলাম।”
শামিম-আরার যমজ কন্যা দুটিকে কিছুক্ষণ আগে পেছন থেকে একপলকের জন্য দেখেছিলম। ওরা কবরখানায় ঢুকেছিল। সম্ভবত দাদামশাইয়ের কবরে ফুল দিতেই যাচ্ছিল। কিন্তু কোন পথে ওরা বাড়ি ফিরল হদিস করতে পারিনি।
কর্নেল ফিরে এলেন প্রাতঃভ্রমণ সেরে, তখন আটটা বাজে। রামবাবু ওঁর পেছন পেছন বেরিয়েছিলেন। মসজিদের ফোটো তোলার সময় আমি সুযোগ বুঝে ঘরে ফিরে বই নিয়ে বসেছিলাম। জাহানাবাদের ঐতিহাসিক পটভূমি জানা দরকার। তাই খান দুই বই সঙ্গে এনেছি কর্নেলের পরামর্শে। কর্নেলের সম্ভাষণে বই বুজিয়ে রেখে বললাম, “রামবাবুকে কোথায় রেখে এলেন?”
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “সম্ভবত কবরে।”
কবর-টবর শুনলেই বুক ধড়াস করে ওঠে। “সর্বনাশ!” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
কর্নেল বাইনোকুলার এবং তার সেই অত্যদ্ভুত ক্যামেরা–যা রাতের আঁধারেও ছবি তুলতে ওস্তাদ, টেবিলে রেখে বললেন, “সর্বনাশের কিছু নেই, জয়ন্ত! গেলে হয়তো দেখবে, রামবাবু কবরের লোকগুলোর গ্রুপফোটো তোলার চেষ্টা করছেন। তারা সবাই অবশ্য হোমরা-চোমরা এবং কেউ কারো চেয়ে কম যান না। তাই একটু ঝামেলা হলেও হতে পারে। প্রত্যেকেই চাইবেন ফোটোতে যেন সামনের সারিতে…”
কর্নেলের কথা শেষ না হতেই রামবাবু ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘরে এসে ঢুকলেন এবং ধপাস করে তার বিছানায় বসে বললেন, “একটু জল।”
আমরা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কালো বোর্ডে চকে আঁকা মূর্তির মতো রামবাবুর চেহারা। চোখের তারা ঠেলে বেরুচ্ছে। হাঁপাচ্ছেন ফোঁস ফোঁস শব্দে। কোনার টেবিলে রাখা জগ থেকে ঝটপট এক গ্লাস জল এনে দিলাম। রামবাবু ঢকঢক করে জলটা গিলে সুস্থ হলেন। তারপর বললেন, “সাংঘাতিক জায়গা। ওঃ! আর একটু হলেই কী যে ঘটত ভাবা যায় না।”
কর্নেল বললেন, “কী ঘটত বলুন তো রামবাবু?”
রামবাবু কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেটের প্যাকেট বের করছিলেন। বললেন, “তা অবশ্য জানি না। শুধু বলতে পারি আমি জোর বেঁচে গেছি। দিনদুপুরে একেবারে চোখের সামনে–ঔঃ! ভাবা যায় না! ভাবা যায় না!”
রামবাবুর কথা বলার এই ঢঙটার জন্যই আমার বিরক্তি লাগে। বললাম, “আহা, ব্যাপারটা খুলে বলবেন তো!”
কর্নেল এই সময় মেঝের দিকে তাকিয়ে কী দেখছিলেন। দেখলাম, উনি একই ভঙ্গিতে দক্ষিণের বারান্দায় গেলেন। তারপর বারান্দা থেকে নেমে পোড়ো জমিটা পেরিয়ে কবরখানার দিকে হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন। অস্বস্তিতে গা শিরশির করছিল। রামবাবুর দিকে ঘুরে রাগ করে বললাম ফের, “ধুর মশাই! আপন মনে কী বিড়বিড় করছেন? বলুন তো কী হয়েছে?”
রামবাবু দুপাশে মাথা দুলিয়ে বললেন, “জানি না! সত্যি জানি না! জয়ন্ত, তুমি কি কখনও দেখেছ, কবর ফাঁক করে আস্ত মড়া প্রকাণ্ড গিরগিটির মতো ঢুকে যাচ্ছে?”
“আপনি দেখেছেন?”
“উ দেখেছি। জাস্ট বিশ বাইশ ফুট দূরে।” রামবাবু গলার স্বর চাপলেন। “তোমাকে বলব কী জয়ন্ত, এ জিনিস স্বপ্নেও দেখা যায় না। স্বপ্নেও অনেক উদ্ভুট্টে জিনিস দেখা যায় বটে। দেখে বর্ণনা দেওয়াও যায় না অনেক সময়। তবে এইমাত্র যা দেখে এলাম, আমি ইন ডিটেলস বর্ণনা করতে পারি। হা–তুমি বলবে, আমার হাত কলমে খোলে না, ক্যামেরায় খোলে। তাহলে কেন আমি ক্যামেরায় ধরে রাখিনি? জয়ন্ত, তুমি তো জানো, সেবার কৃষকমজুর পার্টির নেতা মনোরঞ্জনবাবুকে স্টাব করার মোমেন্টেও আমার মাথার ঠিক ছিল এবং সেই ঘটনা ছবিতে ধূরে ফেলেছিলাম। কাজেই, আমার নার্ভ শক্ত। তুমি আমাকে আর যাই ভাবো, আশা করি ভিতু ভাবতে পারবে না। কিন্তু এ দৃশ্য তো অবাস্তব। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।…”
রামবাবুর ঝরনা খুলে গেছে। আপাতত বন্ধ করার কোনো উপায় নেই ভেবে দক্ষিণের খোলা বারান্দায় বেরিয়ে গেলাম। দেখলাম, কর্নেল কবরখানায় দাঁড়িয়ে পায়ের কাছে কিছু দেখছেন। একটু পরে মুখ তুলে এদিকে ঘুরলেন এবং আমাকে দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় ডাকলেন। তখন পোড়ো জমিটার। ঝোঁপজঙ্গলের ভেতর দিয়ে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলাম।
কাঠের ছোট্ট ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম চারদিকে অসংখ্য কবর। তার ভেতর কোনো কোনোটা সাদা বা কালো পাথরের এবং বেশিরভাগই লাইমকংক্রিটের। অনেক কবরের মাথায় খাড়া একটুকরো দেয়াল। দেয়ালে ফলক আঁটা। ফলকে ফার্সি এবং ইংরেজি হরফে মৃতের নাম ও জন্মমৃত্যুর তারিখ লেখা আছে। কিছু কবরের ওপর ছোটো ছোটো থামে চাপানো খুদে গম্বুজও আছে। কবরখানায় গাছপালা প্রচুর। ফুলের গাছও যথেষ্ট। কর্নেলের কাছে পৌঁছতে দেরি হচ্ছিল। কারণ কবরগুলোর ফাঁকে প্রচুর ঝোঁপ আর ইট বা পাথরের টুকরো পড়ে রয়েছে। কর্নেল যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে প্রকাণ্ড একটা কাঠমল্লিকার গাছ। অজস্র শাদা ফুল ফুটে আছে এবং অজস্র ফুল ছড়িয়ে রয়েছে কবরগুলোতে। কর্নেলের কাছে গিয়ে না পৌঁছুনো পর্যন্ত আমি ভাবতে পারিনি উনি কিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
কাছে গিয়েই যা দেখলাম আমারও রামবাবুর মতো অবস্থা হল। গলা শুকিয়ে গেল। মাথা ঘুরতে থাকল। একবার দেখেই মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম।
একটা কালো পাথরের কবরের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা লোক। তার মাথার পেছনটা একেবারে থ্যাতলানো। চুলে চাপচাপ রক্ত। লোকটার পরনে পাজামা আর পাঞ্জাবি। একটা পায়ে হাল্কা রবারের চটি কোনোভাবে আটকে আছে, অন্য পা খালি। সে কালো পাথরের কবরটা দুহাতে আঁকড়ে ধরার ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে আছে এবং তার পা দুটো নিচে ঝুলছে।
কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, “জয়ন্ত! তুমি শিগগির গিয়ে বেগমসায়েবাকে খবর দাও। আর বলো, উনি যেন এখনই থানায় কাউকে দিয়ে খবর পাঠান, কবরখানায় একটা খুন হয়েছে। দেরি কোরো না! যাও।”
রামবাবুর মতোই উধশ্বাসে ফিরে গেলাম। তারপর ঘরে ঢুকে ভেতরের দরজার কড়া নাড়লাম কাঁপাকাঁপা হাতে। রামবাবু আপন মনে তখনও বিড়বিড় করছিলেন। আমাকে দেখে কিছু বললেন সম্ভবত। কী বললেন আমার মাথায় ঢুকল না। তবে দেখলাম, এতক্ষণে নিজের জুতোর দিকে ওঁর চোখ গেছে এবং “এ কী! এত লাল রঙ লাগল কোথায়” বলে উঠে দাঁড়ালেন।
দরজা খুলে এক পরিচারিকা মৃদু স্বরে বলল, “বলিয়ে সাব!”
জলদি বেগমসায়েবাকো খবর দো! জরুরি বাত হ্যায়।”..
বেগমসায়েবা তার পেছনেই ছিলেন। এগিয়ে এসে কপালে হাত ঠেকিয়ে ভদ্রতাসূচক আদাব দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, “কী হয়েছে জয়ন্তবাবু?”
“কবরখানায় কেউ খুন হয়ে পড়ে আছে। কর্নেল কাউকে থানায় খবর দিতে বললেন।”
শামিম-আরা চমকে উঠেছিলেন। তারপর ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। মৃদুস্বরে পরিচারিকাকে কিছু বললেন। মেয়েটি চলে গেল ভেতরে। তখন শামিম-আরা পা বাড়িয়ে বললেন, “চলুন তো দেখি!”
রামবাবু বারান্দার নিচে ঘাসে জুতো ঘষে সাফ করতে ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের লক্ষ্যও করলেন না। কবরখানায় কর্নেলের কাছে পৌঁছেই শামিম-আরা থমকে দাঁড়ালেন। তারপর নিহত লোকটিকে দেখেই বলে উঠলেন, “হায় খোদা! এ যে দেখছি তাহের দর্জি!”
কর্নেল বললেন, “তাহেরমিয়া কোথায় থাকেন?”
শামিম-আরা আঙুল দিয়ে কবরখানার পূর্বদিকটা দেখিয়ে বললেন, “ওদিকে প্যালেসের আস্তাবল ছিল। কয়েকটা ঘর এখনও আস্ত আছে। সেখানে একটা ঘরে তাহের থাকে। কিন্তু কবরস্তানে ও কেন এসেছিল?”
কর্নেল বললেন, “এই দেখুন রক্তের দাগ। পূবদিক থেকে এদিকে এসেছে। তার মানে তাহের মিয়াকে আঘাত করার পর উনি আহত অবস্থায় এদিকে ছুটে এসেছিলেন। ছুটেই এসেছিলেন। কারণ রক্তের দাগ থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। এসে এখানে পড়ে গেছেন এবং মৃত্যু ঘটেছে।”
শামিম-আরা যে খুব শক্ত মনের মহিলা, বুঝতে পারছিলাম। কর্নেল রক্তের দাগ অনুসরণ করলে তিনিও এগিয়ে গেলেন। আমিও টাটকা এবং রক্তাক্ত মড়ার কাছে একা দাঁড়িয়ে থাকার পক্ষপাতী নই। ওঁদের পেছন-পেছন গেলাম।
পূর্বসীমানার নিচু দেয়ালের এধারে দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন, “মনে হচ্ছে এখানেই আচমকা তাহের মিয়ার মাথায় পেছন থেকে শক্ত কোনো জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। হু–এই যে ওঁর একপাটি চটি পড়ে আছে। যাই হোক, পুলিশ আসুক।”
শামিম-আরা আস্তে বললেন, “আমার স্বামীকেও ঠিক একইভাবে খুন করা হয়েছিল।”
“কোথায় ওঁর ডেডবডি পড়ে ছিল, জানেন?”
“জানি। আসুন, দেখাচ্ছি।” শামিম-আরা এগিয়ে গেলেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। যেতে যেতে বললেন, “তখন গ্রীষ্মকাল। ভোরবেলা আমার মেয়েরা ওদের দাদামশাইয়ের কবরে ফুল দিতে এসে তাদের বাবাকে ঠিক ওই অবস্থায় দেখতে পায়।”
ডানদিকে একটা সিমেন্টের কবর দেখিয়ে বেগমসায়েবা বললেন, “এটা আমার বাবার কবর। আর এই যে দেখছেন কালো পাথরের কবর, এখানে। আমার স্বামীর লাশ পড়ে ছিল।”
কর্নেল বললেন, “সে-রাতে আপনার স্বামী বাড়ি ছিলেন না?”
“ছিলেন। ওঁর অভ্যাস ছিল খুব ভোরে উঠে গঙ্গার ধারে নিজামতি মসজিদের চত্বরে নমাজ পড়া। ওখানে কেউ নমাজ পড়তে যায় না। তাছাড়া মসজিদটা পড়ো-পড়ো অবস্থায় আছে।” শামিম-আরা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন, “তো সেদিন তাই ভেবেছিলাম। একটু বেলা হলে আমার মেয়েরা কবরখানায় এল ফুল দিতে। তারপর..”
শামিম-আরা হঠাৎ চুপ করলেন। কর্নেল বললেন, “তাহের মিয়ার বাড়িতে কে আছে?”
“আর কেউ নেই। তাহের একা থাকত। ওর বিয়ে হয়েছিল। বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। বউটা রোগে ভুগে মারা যায়। তারপর আর বিয়ে করেনি। আসলে তাহেরের বরাবর একটু রাগী স্বভাব। স্বার্থপর, একানড়ে যাকে বলে। এমন লোককে কৈ মেয়ে দিতে চাইবে?”
আমরা নিহত তাহেরের কাছে ফিরে এলাম। এতক্ষণে দেখলাম, একটু তফাতে গম্বুজওয়ালা উঁচু প্রাচীন একটা কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে শামিম আরার যমজকন্যা। দেখে সত্যি চোখ ঝলসে গেল। মুখের গড়ন যাই হোক, এমন আশ্চর্য গায়ের রঙ আমি কখনও দেখিনি। দুই বোনই মায়ের মতো শাড়ি পরে আছে। দুজনের চেহারা হুবহু এক। বয়স আঠারো-উনিশের মধ্যে বলেই মনে হল। শামিম-আরা ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলেন কাছে এবং চাপা স্বরে সম্ভবত বকে দিলেন। তখন ওরা বিষণ্ণভাবে চলে গেল।
শামিম-আরা আমাদের কাছে এসে একটু হেসে বললেন, “আমার স্বামী বলতেন, তোমাদের বংশের জান খুব শক্ত। ঠিকই বলতেন। ওই যে দেখলেন, খুনখারাপি দেখেও ভড়কায়নি। দিব্যি প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে দেখছিল।”
কর্নেল বললেন, “কবরখানায় আসতেও ওরা বোধ করি ভয় পায় না?”
শামিম-আরা বললেন, “এটা মুসলিমদের একটা ধর্মীয় সংস্কার আসলে। কবরখানাকে কোনো মুসলিম ভয়ের জায়গা বলে মনে করে না। বরং ভয় পাওয়ার সময় কবরখানাকেই নিরাপদ মনে করা হয়। প্রত্যেক মুসলিম বিশ্বাস করে, বিপদে পড়ে কবরখানায় ঢুকলে মৃত মুসলিমদের আত্মা তাকে বাঁচাবে। এই অদ্ভুত সংস্কার অন্য ধর্মের লোকের পক্ষে বোঝা সম্ভবই নয়।”
“বুঝেছি। সেজন্যে অনেক মুসলিম পরিবারকে দেখেছি বাড়ির উঠোনেই কবর দেন প্রিয়জনদের।”
আমি বললাম, “তাই তো! কলকাতার তিলজলা এলাকায় আমার এক মুসলিম বন্ধুর বাড়ির উঠোনে তার বাবা-মায়ের কবর দেখেছি।”
কর্নেল বললেন, “বেগমসায়েবা, থানায় কাকে পাঠিয়েছেন খবর দিতে?”
শামিম-আরা বললেন, “আবুর যাওয়ার কথা। আমি গিয়ে বরং দেখি, মিনা ওকে পাঠাল নাকি।”
শামিম-আরা চলে গেলেন ব্যস্তভাবে। কর্নেল নিহত তাহের দর্জির দিকে একটু ঝুঁকে তীক্ষ্মদৃষ্টে কী দেখতে থাকলেন। এই সময় রামবাবু এসে পড়লেন হন্তদন্ত হয়ে। তার হাতে ক্যামেরা। থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে উঠলেন, “সর্বনাশ! সর্বনাশ! একী দেখছি?”
বললাম, “রামদা গিরগিটির মতো একটা মড়াকে কবরে ঢুকতে দেখেছিলেন। তখন এই ডেডবডিটা দেখতে পাননি?”
“রামবাবু জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “না তো! এ কী সাংঘাতিক ব্যাপার! ওরে বাবা! এ কোথায় এসেছি আমরা? এ যে দেখছি মানুষ খুন! জয়ন্ত, ও জয়ন্ত, খুলে বলো তো ব্যাপারটা কী? আমার যে কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না!”
বলে ঝটপট ডেডবডির চারদিকে ঘুরে পটাপট শাটার টিপে কয়েকটা ছবি। তুলে ফেললেন। কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন, “রামবাবু, আপনি ওই অদ্ভুত ব্যাপারটা কোথায় দেখেছিলেন বলুন তো?”
রামবাবু বিচলিতভাবে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঠাহর করার চেষ্টা করলেন। তারপর মাথা চুলকে বললেন, “ঠিক বুঝতে পারছি না কর্নেল স্যার! একবার মনে হচ্ছে, শুটকো ডেডবডিটাকে ওই গম্বুজওয়ালা কবরে ঢুকতে দেখেছি আবার মনে হচ্ছে, ওইখানটাতে। সঠিক মনে পড়ছে না।”
রামবাবু গম্বুজওয়ালা কবরটার দিকে কয়েক পা এগিয়েও গেলেন। কিন্তু বোধ করি, ভয় পেয়েই আর এগোতে পারলেন না। কর্নেল ভুরু কুঁচকে আবার পুবের পাঁচিল অব্দি গেলেন। তারপর দেখলাম, উনি কবরে কবরে চক্কর মেরে বেড়াতে শুরু করলেন। আমার গা ঘুলচ্ছিল রক্ত দেখে! রামবাবুকে বললাম, “চলুন রামদা! পুলিশ যখন আসবে, আসুক। কর্নেলের এসব অভ্যাস আছে। উনি থাকুন। আমরা ঘরে গিয়ে বসি।”
রামবাবু সায় দিয়ে পা বাড়িয়ে বললেন, “চলো। আমারও অবস্থা শোচনীয়। এখন যদি এক কাপ গরম চা-ফা না পাই, কেলেঙ্কারি হবে। জয়ন্ত, আমার মনের অবস্থা এবার ভেবে দেখ। আমি যে তখন রঙ-টঙ ভেবে জুতো ঘষে সাফ করলাম, তা আসলে রক্ত। মানুষের রক্ত! ঔঃ! ভাবা যায় না সত্যি, ভাবা যায় না!”
বেগমসায়েবার সেই পরিচারিকা মিনা ওপাশের খিড়কিতে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মুখে কবরখানার দিকে তাকিয়ে ছিল। রামবাবু তার উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, “ওগো বিবিঠাকুরুন! একটুখানি–মানে থোড়া চায় পিলানে সেকো গি?”
মিনা বিশুদ্ধ বাংলায় বলল, “বসুন। করে দিচ্ছি।” তারপর সে বাড়িতে ঢুকে গেল।
এই গণ্ডগোলের সময় হাসতে ইচ্ছে করে না। তবু রামবাবু হাসিয়ে ছাড়লেন। বললাম, “রামদা, বিবিঠাকুরুন ব্যাপারটা কী?”
রামবাবু বারান্দায় উঠে বললেন, “মাথায় এসে গেল, আর কী! তবে আশ্চর্য ব্যাপার দেখ জয়ন্ত, এরা দিব্যি বাংলা জানে তো! বোঝাই যায় না নবাববাড়ির লোকেরা বাংলায় কথা বলে!”
বললাম, “এতে অবাক হবার কী আছে? আর সে নবাবী তো নেই। এখন সাধারণ মানুষ হয়ে গেছেন। স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। এই বাড়িটা দেখেও বুঝতে পারছেন না?”
রামবাবু চেয়ারে বসে বললেন, “তা তুমি ঠিক বলেছ। এতক্ষণে খেয়াল হল তাই তো ভাবছিলাম, মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠন নেই, মেঝেতে জাজিম বিছানো নেই, একেবারে গেরস্থ হাবভাব। অথচ লখনউতে সেবার এক নবাববাড়ির ছবি তুলতে ঢুকে তো চক্ষু ছানাবড়া হয়েছিল।” বলে ভেতরের দরজার দিকটা দেখে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন, “তবে খাওয়া-দাওয়াতে একটু নবাবী গন্ধ টের পেয়েছিলাম রাত্রে। এখন ব্রেকফাস্টে কী দ্যায় দেখা যাক। রামবাবু লখনউ নবাববাড়ির খাওয়ার সঙ্গে তুলনা শুরু করলেন।
একটু পরে মিনা দরজা খুলে দু কাপ চা নিয়ে এল। চা রেখে মৃদুস্বরে বলল, “বুড়োসায়েবকে চা পাঠিয়ে দেব, নাকি ওঁকে ডাকবেন?”
বললাম, “পাঠিয়ে দিতে পারো। উনি খেতে আপত্তি করবেন না।”
মিনা যেতে যেতে ঘুরে বলল, “আধঘণ্টার মধ্যে নাশতা তৈরি হয়ে যাবে। বেগমসায়েবা জানতে চাইলেন আপনাদের খুব খিদে পেয়েছে নাকি। তাহলে একটু করে সেমাই খেয়ে নেবেন।”
একটু হেসে বললাম, “আমার খিদে পায়নি। রারমদা আপনার নিশ্চয় পেয়েছে?”
রামবাবু হাত নেড়ে তেতোমুখে বললেন, “এখন আধঘণ্টা চা ছাড়া গলা দিয়ে কিছু নামবে না। মনে হবে রক্ত খাচ্ছি!”
মিনা চলে গেলে বললাম, “রক্ত তরল পদার্থ। চাও”
কথা কেড়ে রামবাবু ফাঁচ করে হাসলেন। “তোমার মাইরি সবসময় ফঞ্চুরি। কর্নেল স্যারের কথা আলাদা। উনি গোয়েন্দা-টোয়েন্দা মানুষ। আচ্ছা জয়ন্ত, এখানে যে খুনখারাপি হবে, কর্নেল স্যার নিশ্চয় আভাস পেয়েছিলেন। কী বলো?”
আমার জবাব না পেয়ে বললেন, “কিন্তু লোকটা কে জানতে পেরেছ? বেগমসায়েবা তো গিয়েছিলেন দেখতে। কী বললেন?”
“ভদ্রলোকের নাম তাহের মিয়া। উনি একজন দর্জি।”
রামবাবু নড়ে উঠলেন হঠাৎ। “জয়ন্ত, জয়ন্ত! আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। ঔঃ! আমি রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, জয়ন্ত! তার মানে, কবর থেকে একটা শুটকো মড়া দর্জি ভদ্রলোককে মেরে রক্তারক্তি করে কবরে ঢুকছিল, ঠিক সেই সময় আমার চোখে পড়ে যায়। ভাবা যায় না, জয়ন্ত! ভাবা যায় না!”
এই সময় আমার চোখে পড়ল, কবরখানার ভেতর খাকি পোশাকপরা লাল টুপিওয়ালা কিছু লোক ঢুকেছে। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, পুলিশ এসে গেছে। প্রকাণ্ড চেহারার এক পুলিস অফিসার কর্নেলের সঙ্গে খুব হাত-মুখ নেড়ে কথা বলছেন। রামবাবু বেরিয়ে এসে দেখে বললেন, “আমি যাই। আমার যাওয়া কর্তব্য। তুমিও এস জয়ন্ত! আমরা যে যা জানি, সব বলব।”
রামবাবুকে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে বললাম, “প্লিজ রামদা! চুপচাপ বসুন তো! কর্নেল আমাদের গার্জেন। উনি যা বলবেন, আমরা তাই করব?”
রামবাবু একটু ভেবে সায় দিলেন। “হু ঠিক, ঠিক বলেছ। কর্নেল স্যার যদি বলেন, তবেই আমার বলা উচিত যে আমি কবরে একটা জ্যান্ত মড়া ঢুকতে দেখেছি। নইলে মুখই খুলব না। কিন্তু ব্যাপারটা একবার ভাবো, জয়ন্ত! গোরস্তানে একজন দর্জিকে একটা মড়া–ঔঃ! ভাবা যায় না!”
রামবাবু আপন মনে বকবক করতে থাকলেন।