ভরত যখন কিশোর
ভরত যখন পনেরো বছরের কিশোর তখন একটি ছবি দেখেছিল টিভিতে। তখন রবিবার বিকেলে বাড়ির সবাই একসঙ্গে বসে টিভি দেখত, গল্প করত, চা খেত। বড় সুখের সময় ছিল তখন। ছবিটা ছিল ইংরেজিতে, পটভূমিও ভারতবর্ষ নয়। ছিমছাম রাস্তা, গাড়িগুলো ট্রাফিক আইন মেনে চলছে, বাসে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। বাড়িগুলোর দুপাশে বাগান, রাস্তার গায়ে সার দেওয়া গাছেরা দাঁড়িয়ে। ভোরবেলায় খবরের কাগজ আর দুধের প্যাকেট বাড়িগুলোর দরজায় রেখে দেওয়া হয়েছে গৃহস্বামী ঘুম ভেঙে তুলে নেন বলে। কোনো মতলববাজের দেখা পাওয়া গেল না যে সেগুলো চুরি করতে এসেছে। বাজারে হাঁকাহাঁকি চিৎকার নেই কিন্তু অনেকরকমের সবজি মাছ মাংস থরে থরে সাজানো রয়েছে যাদের গায়ে নির্দিষ্ট দামের লকেট ঝুলছে। তাই দেখে প্রয়োজনীয় ওজনের প্যাকেট তুলে নিয়ে গিয়ে লোকে কাউন্টারে দাম দিচ্ছে। ছবিটার আর কী কী ঘটনা ছিল, মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে কী নাটক করেছিল তা ভরতের স্মরণে নেই কিন্তু ওইসব দৃশ্যগুলো দারুণভাবে মনে গেঁথে গিয়েছিল। ছবি দেখা শেষ হতেই সে প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা বাবা, আমাদের কলকাতা এ রকম হতে পারে না?
সঙ্গে সঙ্গে বড়রা বিশ্রীভাবে হেসে উঠেছিল। মা বলেছিল, চেষ্টা করলে হয় না কি!
বাবা বলেছিল, স্বপ্ন! স্বপ্ন দেখতে পারিস।
স্বপ্নটা দেখতে ভাল লাগত ভরতের। তার বয়স পনেরো হলেও বাবা এবং মা একটুও ভরসা করতে চাইতেন না। দামি স্কুলের বাস তাকে ফ্ল্যাটবাড়ির গেট থেকে তুলে নিয়ে যেত সকালে, ফিরিয়ে দিত ছুটি হলে। স্কুলের পাঁচিলঘেরা চৌহদ্দিতে যে জীবন তার সঙ্গে কলকাতা শহরের কোনো মিল ছিল না। যা কিছু সে দেখতে পেত তা আসা যাওয়ার পথে বাসের জানলা দিয়ে। তবে অনেক কিছু ঠিকঠাক বুঝে ওঠার আগে বাস জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চলে যেত। স্কুলের সমবয়সী বন্ধুরা যে জীবনের গল্প বলত তার স্বাদ সে স্কুল ছাড়ার আগে পায়নি। স্বাধীনভাবে বাসে ট্রামে স্কুলে যাওয়ার জন্যে বাড়িতে আবেদন করলে উল্টে বকুনি শুনতে হয়েছে। বাবা বলত, স্কুলে যাওয়া আসা করছ, সেটা সহ্য হচ্ছে না? বৃষ্টি মিছিল এগুলো হলে বুঝতে পারবে স্কুলের বাস কি ভাল! আর মা বলত, কে তোকে এ সব বদ মতলব দিচ্ছে বল তো? একা যাবি, বন্ধু-বান্ধব জুটবে, সিগারেট বিড়ি ধরাবে তারপর ড্রাগ। সর্বনাশ হয়ে যাবে তোর!
অতএব বারো ক্লাশ পর্যন্ত জানলা দিয়ে যে কলকাতা সে দেখেছিল তার সঙ্গে স্বপ্নের ছবির কোনো মিল নেই। ওর স্কুলের নিকটতম বন্ধু পাভেল বলেছিল, তুই যেটা দেখছিস সেটা রঙিন ছবি।
তার মানে?
খুব বিশ্রী ভাঙাচোরা কোনো বাড়ির যদি রঙিন ছবি তোলা হয় দেখবি বেশ সুন্দর লাগে। একবার খবরের কাগজের প্রথম পাতায় পুজোর সময় ডাস্টবিনে জমে থাকা আবর্জনার রঙিন ছবি ছাপানো হয়েছিল, দেখে মনে হচ্ছিল ঠাকুরের ছবি ছাপা হয়েছে। বাস্তব ফোটে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে। সেটা দেখতে পাবি রাস্তায় হাঁটলে মানুষের সঙ্গে মিশলে। কলেজে ওঠার আগে তুই জাল কেটে বের হতে পারবি না, ততদিন রঙিন ছবি দ্যাখ।
ভরতের মনে কলেজে যাওয়ার বাসনা তীব্র হয়েছিল বলে ও পড়াশুনায় খুব মন দিয়েছিল। ফল বের হলে দেখা গেল তার নাম তাবৎ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে।
.
তার নাম কেন ভরত রাখা হয়েছিল তাই নিয়ে সে অনেকবার প্রশ্ন করেছিল অল্প বয়সে। রামায়ণে রামচন্দ্র নায়ক, তার পরে লক্ষ্মণ। শত্রুঘ্নর ভূমিকা খুব অল্প, নেই বলতে গেলে। ভরত সুবোধ বালক, দাদার পাদুকা মাথায় করে দেশ শাসন করেছিল বারো বছর। তার মায়ের কুকর্মের জন্যে সে মানুষের সহানুভূতি অত কাণ্ড করেও পায়নি। এমন কি মন্থরাকে শাসন করলেও নয়। পাভেল বলেছিল, মুখ্যমন্ত্রী যখন দেশের বাইরে যান তখন মন্ত্রিসভার এক নিরীহ প্রবীণ মন্ত্রীর ওপর দায়িত্ব দিয়ে যান যিনি তার অনুপস্থিতিতে অ্যাক্টিং মুখ্যমন্ত্রী হয়ে থাকেন। লোকটার কোনও সিদ্ধান্ত নেবার সাহস থাকে না এবং জনসাধারণও তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী বলে মনে করে না। ভরত ছিল সেইরকমের রাজা। তাই ভরতের ভূমিকা বকলম। বুঝলি?
ভরত এই রকম ব্যাখ্যা পছন্দ করেনি। সে কারও বকলম নয়। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে তার মনে হয়েছিল এখন তাকে প্রমাণ করতে হবে সে একজন স্বাধীন মানুষ। তখন তার বয়স আঠারো।
ইদানীং বাবা এবং মা, আবার বাবার সঙ্গে তার, মায়ের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক তাতে গোলমাল বাধছিল। বাবা চেয়েছিলেন সে জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক। পাশ করে ম্যানেজমেন্ট শেষ করে সোজা পথে এগিয়ে যাক। মা চেয়েছিলেন সে ডাক্তারি পড়ুক। ডাক্তারদের চাকরি যাই হোক না কেন চেম্বার খুলে বসলে আয় হতে বাধ্য। বাবা এবং মায়ের দুটো প্রস্তাবই তার পছন্দ হয়নি। ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে সে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে বেশী আগ্রহী। কিন্তু তার এই আগ্রহকে কোনও মূল্য দেয়নি ওরা। বলেছিল, এত বছর পড়াশুনার পরে বাকি জীবন অনিশ্চিত হয়ে যাবে। পাঁচ বা ছয় বছর পরে নিশ্চিত অর্থ সে রোজগার করতে পারবে না বলে ওদের বিশ্বাস। এবং এই একটা জায়গায় বাবা এবং মা একই ভাবনা ভেবেছিল। ভরত তর্ক করেছিল, সবাই যদি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয় তবে গবেষণা করবে কে? গবেষণা না করলে দেশের উন্নতি হবে কী করে? ভারতবর্ষে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার প্রচুর কিন্তু কোনও বিজ্ঞানী নেই, দেশের অবস্থা কী হবে ভাবতে পারো?
বাবা বলেছিল, সে সব ভাবার জন্যে নেতারা আছেন। তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার সময়ে সাত আট হাজার মাইনে পেলে চলে যাচ্ছে কোনও মতে, তোমার সময়ে কুড়ি হাজার মাসে পেতে হবে। সেটা পেতে গেলে ও সব বিলাসিতা করা চলবে না।
মা বলেছিল, ঠিকই। তবে কুড়িতে হবে না। সাত আট হাজারে আমার দুর্দশা দেখতে পাচ্ছি। ইঞ্জিনিয়ার হলে মাস মাইনেতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে হবে। বরং ডাক্তারদের ফি আরও বাড়বে। এখনই কলকাতার অনেক ডাক্তার মাসে লাখ টাকা হেসে খেলে রোজগার করে।
কিন্তু জয়েন্ট দেয়নি ভরত। বলা যেতে পারে দিতে পারেনি। বাবা মা ফর্ম জমা দিয়েছিল। তার মত এত বিরূপ ছিল যে পরীক্ষার আগের দিন যখন চিকেন পক্সের আবির্ভাব বোঝা গেল তখন অত্যন্ত খুশি হয়েছিল। মনে হয়েছিল তাতে মুখে ফুটে ওঠা গুটিকাগুলো আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। পরীক্ষায় বসলে তাকে ঠিকঠাক উত্তর দিতে হত। ইচ্ছে করে জানা উত্তর না লেখা তার পক্ষে সম্ভব হত না। ভরত জানে জয়েন্ট দিলে তাকে হয় যাদবপুর নয় মেডিক্যাল কলেজে যেতে হত। পনেরো দিন বিছানায় পড়ে থেকে সে যখন বাইরে বের হল তখন প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা নেই। রেগে মেগে বাবা বলেছিল, ও ইচ্ছে করে পক্স বাধিয়েছে। স্রেফ শয়তানি করার জন্যে। মা অবশ্য বলেছিল, ইচ্ছে করে জ্বর, পেটের অসুখ, সর্দি বাধানো যায়, পক্স কি করে কেউ বাধায় আমি জানি না। কি বুদ্ধি! বাবা চেঁচিয়ে বলেছিল, তোমার ছেলে সব পারে।
সেদিন প্রায় কুরুক্ষেত্র হয়ে গিয়েছিল তাদের বারোশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটায়। প্রবল জ্বরে আক্রান্ত, ভরত সমস্ত শরীরে ব্যথা নিয়ে ওদের দুজনের সংলাপ শুনতে বাধ্য হয়েছিল। মা ছুটে গিয়েছিল বাবার সামনে, আমার ছেলে! আমার ছেলে বলতে তুমি কী বোঝাচ্ছ?
যা বোঝায় তাই। তুমি ওকে পেটে ধরেছিলে, অতএব তোমার ছেলে।
অদ্ভুত! যখন ও কিছু খারাপ করবে তখনই তুমি বলবে তোমার ছেলে! যখন পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করল তখন পাঁচজনকে বলেছ আমার ছেলে? তোমার মতো সুবিধেবাদী পুরুষ পৃথিবীতে নেই।
আমি সুবিধেবাদী? চমৎকার! একটু ভেবে বলো কথাটা!
যথেষ্ট ভেবেছি। আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছ তুমি। মা কড়া গলায় বলেছিল।
কে কার জীবন নষ্ট করল তা পাবলিককে বিচার করতে বলবে? সুবিধেবাদী! তোমার জন্যে, তোমার মন রাখার জন্যে আমি মা-ভাইবোনদের ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলাম। ওরা প্রচণ্ড অর্থকষ্টে পড়বে জানা সত্ত্বেও মাসে দুশো টাকার বেশি দিইনি। আমি সুবিধেবাদী?
বাঃ। আমি তোমাকে নিষেধ করেছি দুশো টাকার বেশি দিতে! বলেছি তোমার মা ভাইবোনকে না খাইয়ে রেখে আমাদের কেক পোলাও খাওয়াও!
বলোনি? কিন্তু করতে বাধ্য করেছ। তোমার এই ফ্ল্যাট, স্ট্যাটাস মেইনটেন করে দুশো টাকার বেশি ওদের দেবার ক্ষমতা আমার ছিল না সেটা তুমি জানতে না?
এত কম ক্ষমতা নিয়ে বিয়ে করেছিলে কেন? মা ভাইবোনের জন্যে যখন এতটা কষ্ট পেয়েছ তখন ক্ষমতা বাড়াবার চেষ্টা করোনি কেন? তোমার কলিগদের যখন তরতর করে প্রমোশন হয়েছে, মাইনে বেড়েছে তখন তুমি আটকে ছিলে কেন? জবাব দাও।
আমি দুনম্বরি করতে পারিনি, পা চাটতে পারিনি।
ওহো, রামচন্দ্র। তোমার কেন প্রমোশন হয়নি আমি জানি না বলে ভেবেছ?
কেন? কী জানো তুমি?
তোমার বসের বউ, ওই পাঞ্জাবি মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়েছিলে তুমি। মেয়েটা তোমাদের সঙ্গে ফ্লার্ট করত, সবাই সেটা বুঝত শুধু তুমি বোঝনি, মজে গিয়েছিলে। তোমাদের লুথার সাহেব সেটা জানতে পেরে তোমার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছেন।
তুমি জানলে কী করে এ সব কথা। কে বলেছে তোমাকে?
আমি জেনেছি।
ও বুঝেছি! মুখার্জি বলেছে। বলবেই তো! এই মুখার্জি সোয়াইনটার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক তা আমি জানি না ভেবেছ! তোমাকে গিফট দেয়, পার্টিতে গিয়ে তোমার মাথা ধরলে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়, হোয়াই! আমাকে সুবিধেবাদী বলা হচ্ছে!
দীপক! খুব বাড়াবাড়ি করছ তুমি। মুখ সামলে কথা বলল।
ভয় দেখিও না। চেঁচিও না।
ওয়েল। আমাকে বিয়ে করতে তোমাকে কে বলেছিল। আমি কি তোমার পেছনে ঘুরেছিলাম। তুমি কেন তখন নেড়ি কুকুরের মতো আমার প্রেম আদায় করতে পাগল হয়েছিলে? মুখার্জি! ও রকম হাজারটা মুখার্জিকে আমি কখনও কেয়ার করিনি। তোমার লুথার সাহেব টেলিফোনে আমাকে প্রেম নিবেদন করতেন। লুথার সাহেব। তোমার মুখার্জির সারোগীর বস! তুমি জানো সে কথা! ইচ্ছে করলে লোকটাকে নাচিয়ে আমি অনেক কিছু আদায় করতে পারতাম। কেন? মিসেস লুথার, ওই পাঞ্জাবি উইচটা যখন দিল্লি গিয়েছিল আর লুথার অসুস্থ হলো তখন তুমি চাওনি আমি গিয়ে লোকটাকে দেখে আসি! গেলে তোমার প্রমোশন আর আটকে থাকত না! তুমি কি নিজের সুবিধের জন্যে আমাকে ব্যবহার করতে চাওনি?
অসম্ভব! তোমার সঙ্গে কথা বলা যায় না। আমি সরল মনে যা বলেছি তখন তুমি প্রতিবাদ করোনি আর এখন বিশ্রীভাবে ব্যাখ্যা করছ। বাবার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। কথা বলতে বলতেই অন্য ঘরে চলে গেলেন। বিছানায় শুয়ে চোখের আড়ালে থাকা মায়ের মুখ কল্পনা করল ভরত। মা এখন হাঁপাচ্ছে। ঠোঁট কামড়াচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি বাবা রণে ভঙ্গ দেবে ভাবতে পারেনি।
প্রেসিডেন্সি কলেজে যাতায়াতের জন্যে কলেজবাস থাকলে বাবা-মা খুশি হত। তখন ওর দিকে তারা এমন চোখে তাকাত যেন ক্যান্সার রুগি দেখছে। কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই, নিশ্চিত অর্থ রোজগারের প্রতিশ্রুতি নেই এমন জীবনে ছেলে প্রবেশ করেছে এবং সেটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে তারা। ওইসময়ে ওদের কথাবার্তায় বেশ মিল থাকত, দেখে মনে হত মেড ফর ইচ আদার। প্রথমদিন কলেজে ভর্তির সময় বাবা গিয়েছিল। বাড়ি থেকে কোন বাস কতরকম রাস্তা হয়ে যায় তা পইপই করে বুঝিয়ে বলেছিল, যদি কোনও প্রব্লেম ফেস করো সঙ্গে সঙ্গে আমার অফিসে ফোন করবে। তোমার পকেটে যেন এক টাকার কয়েন সবসময় থাকে। পাবলিক বুথ থেকে ফোন করতে পারবে?
মা বলেছিল, শোনো, পড়াশুনায় ভাল রেজাল্ট করলেই সবার চরিত্র ভাল হয় না। তোমার কলেজে এমন অনেক মেয়ে বা ছেলে পাবে যারা সিগারেট খায়, ড্রাগ নেয়, আরও কত কী করে। তুমি তাদের সঙ্গ এড়িয়ে যাবে। কফি হাউসে আড্ডা মারতে যেও না। ওখানে ভদ্রলোক দুদণ্ড বসতে পারে না।
কিন্তু আমি ওদের চিনব কী করে? ভরতের খুব মজা লাগছিল।
মা ছেলের মুখের দিকে তাকাল, কে কী বলছে, কার সম্পর্কে কী শুনলে রোজ বাড়ি ফিরে আমাকে বলবে, আমি শুনে তোমাকে গাইড করব।
প্রথম কয়েকদিন আদেশ মান্য করেছিল। যে যা নয় তাকে তাই সাজিয়েছিল ভরত। এমন কি অধ্যাপকরাও বাদ যায়নি। আর তার ফলে মা তামাম কলেজকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাবাকে বলেছিল ভরতকে অন্য কলেজে ভর্তি করতে। কারণটা শুনে বাবা হো হো করে হেসেছিল, লোকে তোমাকে পাগল বলবে।
একথা ঠিক প্রথম প্রথম বাসে ট্রামে একটু অস্বস্তি হত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাদুড়ঝোলা ভিড় দেখতে দেখতে শরীর কিরকম করে উঠত। ঝুলন্ত মানুষের মুখগুলো কি ভয়ঙ্কর। নতুন কোনও যাত্রী পাদানিতে পা রাখতে চাইলে তারা স্বার্থপর এবং নৃশংস হতে দ্বিধা করছে না। এই মানুষরাই যখন মাটিতে হাঁটে, ঘরে বা অফিসে বসে থাকে তখন তাদের চেহারা বদলে যায়। বাসের ভেতরে ঢোকার জায়গা পেলে একটা তীব্র বোঁটকা গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে। দুঃসহ গরম, মানুষের ঘাম এবং শরীরের চাপ সহ্য করতে করতে কেবলই একটাই প্রার্থনা কত দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো যায়। ভরত অবাক হয়ে দ্যাখে কেউ এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ না করে নিজেদের মধ্যেই দাঁড়ানোর সুবিধে নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে। পৃথিবীর একটি সভ্য দেশের নাগরিকদের যাতায়াতের পথে স্বস্তি পাওয়ার কোনও উপায় নেই এবং কেউ যে তাই নিয়ে চিন্তা করছে তাও ওর মনে হয় না। এই সময় স্কুলবাসকে স্বর্গ বলে মনে হত তার।
কলেজে অর্ণব বসুরায় নামের একটি ছেলের সঙ্গে ভরতের সখ্যতা হল। এই বয়সে অর্ণব যা পড়েছে ভরত তা পড়ার সুযোগ পায়নি। সে বঙ্কিমচন্দ্র পড়েছে, শরৎচন্দ্রের বাছাই করা বইগুলো এবং রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু। বিজ্ঞান পড়ার সঙ্গে সাহিত্যের কোনও যোগ নেই বলে তাকে বোঝানোনা হয়েছিল ওই সব পড়ে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের। সব লেখা সে পড়েছে। বাবা বলত, বিকেলে যখন পড়াশুনা করবে না তখন ফেলুদা শঙ্কু পড়বে, তোমার ব্রেন রেস্ট পাবে। প্রত্যেকটা মানুষের একটু আধটু রিলিফ দরকার।
অর্ণব বসুরায় যখন তাকে গোর্কি, মম অথবা ডিকেন্সের কথা বলে তখন সে অবাক হয়। ওর স্কুলের বন্ধু পাভেল এখন যাদবপুরে পড়ে। ওর নামটা গোর্কির উপন্যাস থেকে নেওয়া তা সে জানে। কিন্তু উপন্যাসের বিষয় তার অজানা। বলেছে সত্যজিৎ রায় রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজ খুব ভাল লেখেন কিন্তু উপন্যাস পড়তে হলে বিভূতিভূষণ তারাশঙ্কর পড়তে হবে।
ভরত জিজ্ঞাসা করছিল, শুধু মজা পাওয়ার জন্যে এগুলো যে পড়ব তার সময় কোথায়?
অর্ণব বসুরায় অবাক হয়েছিল, কী বললে তুমি? সাহিত্য শুধু মজা পেতে পড়ে নাকি লোকে?
তা হলে কী জন্যে পড়ে? ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথস-এর সঙ্গে উপন্যাসের কী সম্পর্ক?
জীবনদর্শন তৈরি হয়। সাহিত্য সমাজের প্রতিবিম্ব। সামাজিক বিবর্তনের বিবরণ সাহিত্যে পাওয়া যায়। তুমি যে প্রফেশনই নাও মানুষকে জানতে গেলে এবং নিজের মূল্যায়ন করতে হলে সাহিত্য পড়তে হবে তোমাকে। তুমি আগে মানুষ তারপর অন্য কিছু। যত বড় বিজ্ঞানীই হও তোমার মন খারাপ হলে রবীন্দ্রনাথের গান অথবা জীবনানন্দের কবিতায় তুমি বন্ধু খুঁজে পাবে।
অর্ণব বসুরায় তাকে একটা লিস্ট বানিয়ে দিয়েছিল। হুতোম প্যাচার নকশা থেকে দেখি নাই ফিরে পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের যে সব বই অবশ্যই পড়া উচিত তা সেই লিস্টে ছিল। ভরতের মনে হয়েছিল বিকেলের কয়েকঘণ্টায় ও-গুলো পড়ে শেষ করা অসম্ভব। ফলে সে রাত জাগতে আরম্ভ করল।
বাল্যকালে মা তাকে গান শোনাত। সেইসব গান মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সে লক্ষ্য করেছিল ওই গানগুলোর প্রতি বাবারও মমতা ছিল। মাঝে মাঝে দুজনে গলা মেলাত। এখনও মন ভাল থাকলে, সম্পর্ক কাছাকাছি এলে দুজনে গান গায়। অদ্ভুত ব্যাপার, গানগুলোর সবই দেশাত্মবোধক। আজ বিকেলে, ছুটির বিকেলে ওদের গাইতে শুনল ভরত। দেবদাস পড়ছিল সে। বই রেখে সে ওদের ঘরে গেল। বাবা শুয়ে শুয়ে গাইছে, মা পাশের চেয়ারে বসে খাটে পা তুলে দিয়ে গলা মেলাচ্ছে। ওকে দেখতে পেয়ে বাবা হাতের ইশারায় গাইতে বলল। সে মাথা নেড়ে আঙুল তুলতেই ওরা থেমে গেল। ভরত বলল, এই যে লাইনটা এত আবেগ দিয়ে গাইছ তার মানে কী? ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে!
ভারতবর্ষের আবার সুদিন ফিরে আসবে। জগতের শ্রেষ্ঠ দেশ হবে। খুব সরল কথা। মা আগ বাড়িয়ে জবাব দিল।
চমৎকার। আবার শব্দটার মানে আপাতত শ্রেষ্ঠত্বে নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাই তো। বল তো, কবে ভারত জগতের শ্রেষ্ঠ দেশ ছিল?
মা বাবার দিকে তাকাল। বাবা উঠে বসল, ছিল। যখন ভারতীয় সংস্কৃতি সমস্ত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃত ছিল।
কখন?
আশ্চর্য। তুমি ইতিহাস পড়নি?
পড়েছি। মোগল সাম্রাজ্যের সময়, আলেকজান্ডার যখন এসেছিল তখনও নয়। আর তার আগে ভারতবর্ষ কনসেপ্টটাই ঠিক গ্রো করেনি। সব ছোট ছোট রাজ্য এবং তাদের মধ্যে সংঘাত
হত। ভারত যে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ হয়েছিল তার সদস্য কারা ছিল? আই মিন কমপিটিটার?
বাবা বলল, তুই কী বলছিস? মহেঞ্জোদাড়ো হরপ্পা?
মহেঞ্জোদড়ো হরপ্পা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা নয়। ওগুলোকেও আর ভারতবর্ষের বলা নিরর্থক। একসময় এইসব গান লেখা হয়েছে দেশাত্মবোধক আবেগে। তখন দেশকে মহান করার জন্যে যা মনে আসে তাই লিখেছেন কবি। কিন্তু এখন তোমরা গাইবার সময় যে ভুলভাল গাইছ তা মনে রাখবে না কেন?
বাবা বলল, আজকাল দেখছি খুঁত ধরতে শিখে গিয়েছ। আর কোনও গানে ভুল পেয়েছ?
ভুল নয় নয়, বাড়াবাড়ি। সেইসঙ্গে পরাধীন মনোভাব।
যেমন?
ওই যে, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি!
মাই গড! এত ভাল গান নিয়েও তুমি ব্যঙ্গ করছ?
বাবা, তোমরা একটু ভাব। আমি আমার দেশকে সব চেয়ে ভালবাসব, দেশের সব কিছু আমার প্রিয় হবে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। নিজের ভাঙাবাড়িও অনেক আপন। কিন্তু যখন কবি বলেন সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি তখন অবশ্যই একজন রাজার অদৃশ্য অস্তিত্ব মনে করতে হয়। পৃথিবীতে একমাত্র ব্রিটেনের রানি ছাড়া সব রানীই রাজার অধীন। আমার দেশ রানি মানে আমরা একটি রাজার অধীন। হোয়াই? ব্রিটিশদের খুশি করতে কি ওই গান লেখা হয়েছিল? প্রশ্ন করে তাকিয়ে থাকল ভরত কিছুক্ষণ। জবাব না পেয়ে ধীরে ধীরে ফিরে গেল দরজার বাইরে এবং তখনই কানে এল মায়ের গলা, স্পয়েল হয়ে যাচ্ছে। কলেজে ঢোকার পর থেকেই ওর মধ্যে চেঞ্জ দেখতে পাচ্ছি আমি।
রাজনীতি করছে নাকি? বাবার গলায় আশঙ্কা।
বুঝতে পারছি না। বলেছি তো ইউনিয়ন থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু ওর টেবিলে আমি গোর্কির মাদার পেয়েছি। আমার ভয় করছে।
বাবা বলল, মাদার আমরাও কলেজে পড়েছি। আমার কি, নিজের ক্যারিয়র ও যদি নিজে নষ্ট করতে চায় তা হলে ওই পস্তাবে।
আশ্চর্য! সুবিধেবাদীর মতো কথা বলবে না। আমাদের ছেলের ভবিষ্যৎ আমরা দেখব না?
কী ভাবে দেখবে? ও কি স্কুলবয়? দেখছ না কীভাবে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে।
সেক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তি দিতে হবে।
দ্যাটস ভেরি ডিফিকাল্ট। এই তো আমি এখনও ভেবে পেলাম না ভারত কবে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিয়েছিল। এই আবার শব্দটা লেখার কী দরকার পড়েছিল কবির!
তুমি অন্যদিকে চলে যাচ্ছ? মা ধমকে উঠল।
দ্যাখো, ও ড্রাগ খাচ্ছে না, কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে না। রেজাল্ট খারাপ না করা পর্যন্ত লক্ষ্য করে যাও।
খারাপ হলে কিছু করার থাকবে?
তুমি কী বলতে চাও? ওই ছেলেকে ডেকে আমি শাসন করব? কী বলব? কেন তুমি চিরাচরিত সত্য বলে যা জানি তাকে চ্যালেঞ্জ করছ? কেন উদ্ধত হচ্ছ? মুশকিল হল কি তোমার কোনও ব্যাপারেই ধৈর্য নেই। আমার ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড করেছ। বাবার গলা ওপরে উঠল।
ও, তাই? তুমি অন্যায় করছ দেখেও আমি চুপ করে থাকলে তোমার শান্তি! পার্টিতে গিয়ে যখন বুড়িগুলো তোমার কোলের ওপর আঁচল ফেলে দেয় তখন আমাকে চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে? তার নাম ধৈর্য? নো। আমার দ্বারা অসম্ভব। এই পঞ্চাশ বছর বয়সেও তোমার ছোঁকছোঁকানি গেল না। মা ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসে ওকে দেখতে পেয়ে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল। ভরত হেসে ফেলল।
মা জিজ্ঞাসা করল, হাসছ কেন? হাসির কী আছে?
আমি ভেবে পাই না, তোমাদের মধ্যে প্রতি কথায় মতভেদ হয়, ঝগড়া বাধে তবু তেইশ বছর ধরে তোমরা পরস্পরকে টলারেট করে একসঙ্গে আছ কী করে?
তার মানে? মা আঁতকে উঠল।
রাগ কোরো না। পাশাপাশি দুটো দেশ থাকলে এরকম সম্পর্কে হলে বহুবার যুদ্ধ হয়ে যেত, প্রচুর লোক মারা যেত। কিন্তু তবু তোমরা একসঙ্গে গান গাও। আমি জানি না রহস্য কী!
তোমাকে এ সব কিছুই জানতে হবে না। কলেজে ঢুকে এই উন্নতি হয়েছে!
তাহলে প্লিজ আমার সামনে ঝগড়া করো না তোমরা। অ্যাট লিস্ট, আমি যখন থাকব না সে রকম সময় বেছে নিও অথবা আমি বাড়িতে থাকলে ঝগড়া করার আগে বলো আমি বেরিয়ে যাব। ভরত নিজের ঘরে ফিরে এল।
ব্যাপারটা একটু বেশি হয়ে গেল হয়তো কিন্তু না বলে পারেনি ভরত। আর বলার পর দেখতে পেল বাবা-মায়ের মধ্যে চমৎকার আঁতাত তৈরি হয়ে গেল। দুজনেই এখন একসঙ্গে তাকে প্রতিপক্ষ বলে ভাবছে। অবশ্য সে জানে এই আঁতাত বেশি দিন থাকবে না। ঝগড়া না করে ওদের পক্ষে জীবনযাপন অসম্ভব। কিন্তু তাকে উপলক্ষ করে যদি ওরা কিছুক্ষণ এক হয় তাই বা মন্দ কী! কলেজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কথা বলে সে ক্রমশ জানতে পারল সবারই কম-বিস্তর একই অভিজ্ঞতা। পঞ্চাশের কাছাকাছি শিক্ষিত বাবা-মা যারা অনেককাল আত্মীয়স্বজন বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা থাকে সম্পর্ক জটিল হয়ে যাচ্ছে। পরস্পরকে সহ্য করতে না পারলেও তাদের খুব কম সংখ্যকই বিবাহ বিচ্ছিন্ন করছে। এই সব মানুষের কথা গল্প-উপন্যাসে খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে আজকের অনেক লেখকই এই সব সমস্যা তাদের উপন্যাসে তুলে ধরেননি। শরশ্চন্দ্রের সময়ে হয়তো এই সমস্যা ছিল না কিন্তু তারপরে? মানুষের জীবনের কথা না বলে তাদের নিয়ে নানান কল্পনা করা কি সামাজিক চিত্র চিত্ৰণ? আজ পর্যন্ত কোনও লেখায় বাবা কিংবা মাকে পাওয়া গেল না। অথচ এরা প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত পরিবারের সদস্য। সেদিন তাদের হাউসিং কমপ্লেসে একজন বাউলের পোশাক পরা মানুষ গান গাইছিল। তার দুটো লাইন ভরতের খুব মনে ধরেছিল, আমার আসার গরজ কিছু নাহি ছিল/দুজনার ইচ্ছায় আমায় আসিতে হইল।
গানের লাইনদুটো অর্ণব বসুরায়কে বলেছিল ভরত। রোগা চশমা পরা ছেলেটা বলল, আবার বলো। ভরত দ্বিতীয় বার বলেছিল। অর্ণব বসুরায় বলেছিল, বাউল বৈরাগী দরবেশ ফকির যাঁদের আমরা অশিক্ষিত বলি তারা জীবনের কঠিন সত্যগুলো কি সহজে বলে দেন। জানো ভরত, আমি ঠিক করেছি খাওয়া পরা এবং পড়াশুনার খরচ ছাড়া বাবা-মায়ের কাছ থেকে বাড়তি কিছু নেব না। আমি একটা টিউশনি করছি তাতে যাতায়াতের খরচ ইত্যাদি দিব্যি কুলিয়ে যায়।
কেন? হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন?
ওই গানটাতেই সেটা বলা আছে। আমার তো আসার গরজ ছিল না, বাবা-মা নিয়ে এসেছেন বলে এসেছি। যতদিন আমি সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী না হচ্ছি ততদিন সেটা তৈরি করে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু যেহেতু এই পৃথিবীতে আসার পর ধীরে ধীরে আমার নিজস্ব সত্তা তৈরি হয়েছে তাই আমি সব ব্যাপারে তাদের ওপর নির্ভর করব না।
সব ব্যাপার বলতে?
এই যেমন সিগারেট খাওয়া, সিনেমা দেখা, কফিহাউসে কফির দাম দেওয়া। এই খরচগুলো করতে হলে টাকার দরকার হয়। বাবা-মায়ের কাছে হাত পেতে টাকা নিয়ে তা করতে আমার আপত্তি আছে। একটা মানুষ এগুলো ছাড়াই চমৎকার বেঁচে থাকতে পারে। যেসব প্রয়োজন এড়িয়ে যাওয়া যাবে না তার জন্যে আমি ওদের নির্ভর করব। আর যেদিন আমি নিজে রোজগার করে ওই সব খরচ অ্যাফোর্ড করতে পারব সেদিন করব।
অর্ণব বসুরায়ের এই সব কথায় চমক ছিল। কলেজে যাওয়া আসার জন্যে বাবা প্রতি মাসে দুশো টাকা দেন। তার বেশির ভাগই বেঁচে যায় যা কফিহাউসে খরচ করে ভরত। শুধু সে কেন কলেজের অনেক ছেলে মেয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি হাতখরচ পায় বাড়ি থেকে, ফুরিয়ে গেলে জোর করে আদায় করে আবার। কণিষ্ক যে বিদেশি সিগারেট রোজ এক প্যাকেট করে খায় তার দাম চল্লিশ টাকার বেশি। অথচ অর্ণব বসুরায় নিজেকে কষ্ট দিতে চাইছে। ভরত আবিষ্কার করল এই কষ্ট করে অন্য এক সুখ পাওয়া যায়। সে হাউসিং কমপ্লেক্সেরই একটি ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব নিল। প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে বাবাকে বলে দিল তার আর হাত খরচের দরকার নেই। ছেলে ছাত্র পড়াচ্ছে এ খবর পাওয়ার পর মা অনেক নাটক করেছিল, মিসেস গুপ্তার কাছ থেকে তুই টাকা নিবি? ও কী ভাববে আমাদের?
তোমাদের ভাবতে যাবে কেন? নেব তো আমি।
আশ্চর্য! এখানে তোকে সবাই আমাদের ছেলে বলেই জানে।
ওঁর ছেলেকে পড়াচ্ছি বলে উনি টাকা দেবেন। ওঁর একজন প্রাইভেট টিউটারের দরকার ছিল আর আমার টাকাটার। চুকে গেল।
আমরা বেঁচে থাকতে তোর এত টাকার দরকার হলে?
তুমি ব্যাপারটা বুঝবে না মা। দয়া করে এমন সিন করো না যে মনে হবে গোটা মহাভারত আজ অশুদ্ধ হয়ে গেল। আমি ঠিক আছি। ভরত বলেছিল।
.
নিজেকে একটু আলাদা করে ভাবতে ভাল লাগে ভরতের। আজকাল মাথায় এমন সব প্রশ্ন উঁকি দেয় যার উত্তর সহজে পাওয়া যায় না। ওদের কলেজের অধ্যাপক পি কে জি রাজনীতি করা মানুষ। বাম মহলে যথেষ্ট যথেষ্ট শ্রদ্ধা পান ভদ্রলোক। মাথায় ঢোকা একটা সমস্যা তার কাছে পেশ করেছিল সে। শুনে ভদ্রলোক চোখ বন্ধ করলেন, হঠাৎ এমন ভাবনা?
গতকাল একটা বই পড়ছিলাম। তা থেকেই মনে এল। আপনার কাছে এটা সমস্যা বলে মনে হচ্ছে না?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। তবে যখন স্রোত উত্তাল হয় তখন কচুরিপানা ভেসে যায় তাতে। অধ্যাপক হেসেছিলেন, এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। সময় তাদের পরিবর্তিত করবে।
এটা ঠিক উত্তর হল না স্যার।
তুমি কী জানতে চাইছ?
আমি আবার বলছি। যখন কোন স্বৈরাচারী শাসক দেশ শাসন করে তখন তাকে সাহায্য করে নিজেদের আখের গোছাতে প্রচুর লোক এগিয়ে যায়। সৈন্যবাহিনীও লোকটির হাতে থাকে। এই শক্তির বিরুদ্ধে তিলতিল করে দেশের মানুষ যদি একত্রিত হয়ে বিপ্লব করে তখন স্বৈরাচারী পিছু হঠতে বাধ্য হয়। বিপ্লব হয়ে গেলে জনগণের সরকার যখন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন দেখা যাবে দেশের নাগরিকদের কিছু অংশ, ধরা যাক দশ কি পনের অংশ স্বৈরাচারী শাসকের অনুগামী ছিল। এদের সংখ্যা হয়তো তিন লাখ। বেছে বেছে এদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হলো আর বাকিরা নতুন শাসনব্যবস্থার সঙ্গে মিশে গেল নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে। দেখা গেছে পরে এরাই আবার জনসাধারণকে ভুল বুঝিয়ে উদ্বুদ্ধ করে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে স্বৈরাচারীকে ফিরিয়ে আনার কাজে। আমাদের দেশেও যারা একসময় ব্রিটিশদের সাহায্য করত তারাই স্বাধীনতার পরে বড় বড় সরকারি পদে গিয়ে বলেছে ব্রিটিশ আমল ভাল ছিল। বিপ্লবের পর এদের বাঁচিয়ে রাখা মানে যাকে ছুরির ওপর শুয়ে থাকা বলে যারা মনে করেন তারা কি ভুল করেন? ভরত জিজ্ঞাসা করল।
মাই গড! তুমি কি চাইছ বিপ্লবের পর ওই তিনলক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হোক? তা হলে নাৎসিদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায় থাকল? অধ্যাপক জিজ্ঞাসা করলেন।
ওদের বাঁচিয়ে রাখা মানে প্রতি মুহূর্তে কষ্টে পাওয়া শাসনব্যবস্থাকে বিপন্ন করার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা। বিশ্বাসঘাতকরা সবসময়ই বিশ্বাসঘাতক।
ঠিকই। কিন্তু জনগণের চাপে এরা পথ বদলাতে পারে। তুমি যা বলছ তা গণহত্যা, কোনও বিপ্লবী সরকার সেটা করতে পারে না। অধ্যাপক মাথা নাড়লেন, ধরা যাক তাদের ওই শাস্তি দেওয়া হল। তারপর ওই অত লক্ষ্য লোকের পরিবারের কী হবে? কে তাদের দায় বহন করবে? আগে বিপ্লব হোক তারপর এ সব ভাবনা ভেবো।
ভরত সন্তুষ্ট হয়নি। তার কেবলই মনে হতে লাগল কোথায় কঁক থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয় চিন্তাটা মাথায় আসামাত্র সে অধ্যাপককে ধরল, আমাদের দেশে প্রায় সতেরো বছর ধরে মার্ক্সবাদী মানুষেরা শাসনব্যবস্থায় আছেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশ কম্যুনিস্টদের।
হ্যাঁ। জনসাধারণ সেই রায় দিয়েছে। কিন্তু এতগুলো বছরেও পশ্চিমবাংলায় কোনো এলাকার সমস্ত মানুষদের মার্ক্সবাদে দীক্ষিত করা গেল না কেন? কেন সরকারি সমস্ত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মার্কসীয় সমাজের ছবি এরা তুলে ধরতে পারলেন না কোনও পাড়ায়? সেই চেষ্টা কি করেছেন উঠতি থেকে প্রতিষ্ঠিত নেতারা? কোনও এলাকায় কর্মীরা কি বুর্জোয়া বদমায়েসী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছেন?
অধ্যাপক চোখ ছোট করলেন, এই শাসনব্যবস্থায় সেটা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকার সেটা হতে দেবে না। আমরা যা করেছি তা সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকে করেছি। মনে রেখে প্রায় আমাদের কাছাকাছি ভট প্রতিপক্ষ পেয়ে থাকে। এ দেশে বিপ্লব না হলে তুমি যা বলছ তা হওয়া অসম্ভব।
ব্যাপক আকারে না হলেও ক্ষুদ্র গণ্ডিতেও অসম্ভব?
হ্যাঁ। তাই।
এমনকি দলের কর্মীদের মধ্যেও বুর্জোয়া ভাইসেস থেকে যাবে?
যাদের মধ্যে ও সব আছে তারা দলের সদস্য নয়।
এসব কথা দায় এড়াবার জন্যে বলা তা বুঝে দিয়েছে ভরত। ক্রমশ তার মনে হতে লাগল এ দেশের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো সংঘবদ্ধ একটা যন্ত্র যা কোনও সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। তারা যা মনে করে ঠিক তাই মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে খুশি হয়। তার ফলে জনগণের উপকার যদি দশ শতাংশ হয় তা হলে ক্ষতি হয় নব্বই। কংগ্রেসিদের ওপর ভরসা করার কোনও মানেই নেই। একটি শিশুও জানে দুজন কংগ্রেসি একসঙ্গে থাকা মানে তাদের পেছনে দুটো উপদল আছে। একেবারে নগ্ন গুণ্ডাবাজি করা তাদের খুব স্বাভাবিক আচরণ। জনসাধারণের উপকার করার কথা এরা ভাবে কিন্তু বাস্তবে এঁদের কাজের জন্যে শতকরা একভাগও উপকৃত হয় না। তবু এই দুই দলের ওপর দেশের ভাগ্য নির্ণয় করে। এরাই হর্তাকর্তা। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় দেশের ভালমন্দ কী হবে তা এরাই ঠিক করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর কৌশল এমনই, জনসাধারণ যাতে এদের বাইরে আর কারও কথা চিন্তা না করতে পার তার জন্যে এরা মরিয়া।
প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে একটু একটু করে জড়িত হচ্ছিল ভরত। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা হওয়ায় ছাত্রদের ভাবনা নিয়ে ভাবার চাইতে আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে লাফালাফি করে নিজেদের জাহির করতে ওদের আগ্রহ দেখে সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। অভিজিত সরকার নামে একটি ছাত্রনেতার সঙ্গে ভরতের সামান্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। স্কুল থেকে ভাল ফল করে অভিজিত প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছে। শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সে সক্রিয় সদস্য। ওর বাবা হাইকোর্টের সফল ব্যারিস্টার। অর্থের অভাব নেই। অভিজিতের জীবনের লক্ষ্য পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে পৌঁছানো, মন্ত্রিসভায় যাওয়া। এ বিষয়ে তার ভাবনা পরিষ্কার। আমার সময়ের অন্য ছাত্রনেতার থেকে আমি একটু এগিয়ে আছি কারণ প্রেসিডেন্সি কলেজের লেবেলটা আর কারও নেই। ছাত্র হিসেবে আমি মেধাবী তা প্রমাণিত। পার্টি সংক্রান্ত পড়াশুনা আমি যে ভাবে চালাচ্ছি তা আমার ভিত শক্ত করবে। আমি নিজে নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন পরিবার থেকে আসিনি, আমার বাবার প্রচুর টাকা আছে, এটা বেশ গুরুত্ব পায়। পার্টির ওপরের তলায় দু চারজন বাদে বেশির ভাগই উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাছাড়া কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক অথবা অধ্যাপক হবার লক্ষ্যে নিজেকে তৈরি করে আর আমি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করছি। কারণ একজন মন্ত্রী ডাক্তার থেকে অধ্যাপকদের নিয়ন্ত্রণ করে। আমার বাবা আমাকে সমর্থন করেন।
কফিহাউসে বসে এমন সাবলীল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছিল অভিজিত যে অবাক হয়ে গিয়েছিল ভরত। ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার জন্যে প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন ছাত্র পরিশ্রম করছে, এ কথা বাবা-মা কখনও বিশ্বাস করবে? ভরতকে ছাত্র রাজনীতিতে না জড়িয়ে পড়ার জন্যে ওরা বারবার নিষেধ করেছে। কলেজে ও-সব করে কত ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছে তার ফিরিস্তি দিয়েছে। বাবা বলেছে নকশাল আন্দোলনের সময় প্রেসিডেন্সি কলেজের উজ্জ্বল ছেলের ওই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে চিরদিনের জন্যে। তার মানে, তখন যারা ছাত্র রাজনীতি করত তারা অভিজিতের মতো বুদ্ধিমান ছিল না। তারা একটা আদর্শে বিশ্বাস করত, আখেরে নয়। অভিজিত তাকে বলেছিল কয়েকজন নেতার কথা। যারা ছাত্র এবং যুব রাজনীতি করে আজ নেতা হয়েছে। কোনওদিন চাকরিবাকরি অথবা ব্যবসা করেনি। কিন্তু দিল্লি বোম্বে যেতে গেলে তাদের বাড়িতে এক ডজন প্লেনের ওপেন টিকিট এসে যায়। এরা শুধু শাসক দলেই নয়, কংগ্রেসেও আছেন। যেহেতু এঁদের বয়স প্রায় পঞ্চাশ তাই তিরিশ বছর আগে ছাত্র রাজনীতি করার সময় তারা বুদ্ধি খরচ করেছিলেন।
অনেককাল অন্ধকারে বাস করার পর যদি আচমকা আলোয় আসা যায় তা হলে চোখ ঝলসে যেতে বাধ্য। প্রথম প্রথম ভরতের তাই হয়েছিল। শুধু রাজনীতি নয়, জীবনের অন্যক্ষেত্রেও সে হিসেব মেলাতে পারছিল না। সুদেষ্ণা নামের মেয়েটি কলেজে খুব নামকরা। সুদেষ্ণা সুন্দরী, মেধাবী। গল্প উপন্যাস বা সিনেমায় এমন মেয়েকেই নায়িকা হিসেবে ভাবা হয়। সুদেষ্ণাকে দেখে ওর মাথায় অন্য এক চিন্তা এসেছিল। মেয়ে মানেই নায়িকা নয়। ক্লাশের কুড়িটি মেয়ের মধ্যে বড় জোর দুজনকে নায়িকা বলে ভাবা যেতে পারে। বাকি আঠারোজন সারাজীবন পার্শ্বচরিত্র থেকে যাবে। একমাত্র বিয়ের রাত্রে তারা নায়িকার মর্যাদা পেতে পারে। অথচ সেই সব মেয়ে যখন একা থাকে তখন তাদের কল্পনা আচার-আচরণ এবং পুরুষের কোনও কথার প্রতিক্রিয়াতে ঠিক নায়িকাসুলভ অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। সে যে নায়িকা নয় তা এককভাবে হজম করা বেশ কষ্টকর তার পক্ষে।
সুদেষ্ণা সম্পর্কে এ সব তথ্য খাটে না। কোনোদিন কলেজে এক পোশাকে সে আসে না। তার সঙ্গে কথা বলতে পেরে অধ্যাপকরাও খুশি হয়। গল্প উপন্যাসে ভরত আবিষ্কার করেছে নায়িকা একজন পুরুষবন্ধুর জন্যেই জীবন দিয়ে দিতে পারে। তাকেই বলে প্রেম। সে সুন্দরীর একাধিক প্রেমিক থাকে, যে অবলীলায় কয়েকজন ছেলের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকে ভ্যাম্প বলা হয়। লেখক এবং পাঠকের তার ওপর কোনও সহানুভূতি থাকে না। বদ চরিত্র বলে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সাবেকী উপন্যাসগুলোতে। যে মেয়ে তাও করে না অথচ কোনও অল্পবয়সী চরিত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয় তাকেও চরিত্রহীনা বলা হয়েছে। এই সব সংজ্ঞা বাতিল হয়ে গেল সুদেষ্ণাকে দেখার পর। সুদেষ্ণার ছেলে বন্ধুর সংখ্যা কত তাই নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। সবাই নিজেকে ওর একমাত্র বন্ধু হিসেবে দাবি করে করে এখন প্রথম বন্ধুতে সীমিত হয়েছে। সুদেষ্ণা নাকি সবার সঙ্গেই প্রেমের কথা বলে। কলেজের ছাত্র অথবা অধ্যাপকদের সে মিষ্টি কথা বলতে ইতস্তত করে না। যে ছেলে তাকে এড়িয়ে দূরে সরে থাকতে চায় তার সঙ্গে সে যেচে গিয়ে কথা বলে আসে। আর এ সব করা সত্ত্বেও তার রেজাল্ট ঈর্ষণীয় ভাবে ভাল। সুদেষ্ণা যেন নদীর মতো দুপাশের চরাচর ঘর বাড়ি গাছপালা ছুঁয়ে ছুঁয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওকে বদ মেয়ে বা চরিত্রহীনা বলার সাহস কারও নেই অথবা সেরকম কিছু ভাবতেও ইচ্ছে করে না। পুরনো ভাবটাকে তাই বাতিল করতে হয় ওকে দেখে।
একদিন মা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তোদের কলেজের মেয়েরা কেমন?
ভরত জবাব দিয়েছিল, মেয়েরা যেমন হয়।
ও বাবা। মেয়েরা কেমন হয় তা তুই জেনে বসে আছিস?
বইতে পড়েছি, টিভিতে দেখেছি, তার ওপর তোমাকে তো দেখছিস।
ওরা তোদের সঙ্গে কথা বলে?
প্রয়োজন হলে বলে। সবাই অবশ্য নয়। বলেই সুদেষ্ণার কথা মনে পড়েছিল। ওকে যেটুকু সে দেখেছে তাই অকপটে বলেছিল। শুনে মায়ের মুখ গম্ভীর, কী রকম বাড়ির মেয়ে?
কেন?
কলেজে গিয়ে এত ছেলের সঙ্গে ভাব করছে, বাড়ির লোক কিছু বলে না?
ভাব করছে মানে?
তুমি এখন বড় হয়েছ, তোমার জেনে রাখা উচিত এই সব মেয়ে ছেলেদের মুণ্ডু চিবিয়ে আনন্দ পায়। বোকা ছেলেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যায়।
আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। সোজা হয়ে বসেছিল ভরত।
বুঝতে হবে না। শুধু ওই সুদেষ্ণার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করো। মা উঠে গিয়েছিল। যখন মেজাজ গরম হয় তখনই মা তুই থেকে তুমিতে উঠে যায়। হয়তো তুমি বলে দূরত্ব বাড়াতে চায়। বাবার ক্ষেত্রে এ রকমটা অবশ্য করে না। তুমি থেকে আপনিতে চলে যেতে মাকে কখনও শোনেনি সে। ভরত ভেবে দেখেছিল মা যতই আধুনিকা হোক সুদেষ্ণকে গ্রহণ করতে পারছে না। শুধু মা-ই কেন, কলেজের সমবয়সী অনেক ছেলে-মেয়ে সুদেষ্ণার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে। মানুষ কেন যে যার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে না, অন্যের জীবনের খুঁটিনাটি জেনে মন্তব্য করতে উদগ্রীব হয় সেটা ভরত কিছুতেই বুঝতে পারেনি। সুদেষ্ণার সঙ্গে তার কথা হয়েছে দু-একবার। ওর স্বাভাবিক ব্যবহারে সে কোনও অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়নি। খোঁজার চেষ্টাও অবশ্য করেনি।
এইভাবে জীবন চলছিল ভরতের যেমন আর পাঁচজন তরুণের শুরু হয়। এতকাল বন্ধ এলাকায়। বাস করে বাইরের পৃথিবীতে পা দিয়ে সে অনেক কিছু মেলাতে মারছিল না। রাত্রে প্রায়ই স্বপ্ন দেখত সেই ছবিটার। সেই নিটোল রাস্তা, ছবির মত বাড়ি, হাসিখুশি স্বাস্থ্যবান মানুষ, শান্তির জীবন। এই ছবির সঙ্গে ভরতের দেখা পৃথিবীর কোনও মিল নেই। এই ব্যবধান ঘোচাবার জন্যে কোনও দায় বোধ করে না। তার কেবলই মনে হয় এখন বাবা মা শিশুদের শেখায়, কী করে স্বার্থপর হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। যা তোমাকে উপকৃত করবে না তার দিকে ভুলেও তাকিও না। এই পৃথিবীতে তুমি এবং তোমার নিকটজন ছাড়া আর কারও কথা চিন্তা করা বোকামি। এবং ভুল করেও ওই নিকটজনের সংখ্যা বাড়িও না। দেশ, সমাজ ইত্যাদির জন্যে ভাবনা ভাবা মানে আত্মহত্যা করা। তোমাকে যে করেই হোক প্রচুর টাকা রোজগার করতে হবে যাতে ভারতবর্ষে যে সব সুখ সুবিধে কিনতে পারা যায় তা কেনার উপযুক্ত হতে পার। সোজা পথে যে টাকা আসে তা তোমাকে চিরকাল অসুখী রাখবে কারণ পরিমাণে বেশি হতে পারে না। অতএব নিজেকে বাঁচিয়ে তুমি অর্থ আনো এবং একবার আনার পরে সেই অর্থের গায়ে কালো দাগ যখন অবলীলায় মুছে যায় তখন নিজের প্রতিপত্তি বাড়াও। এই না হলে বেঁচে থাকা অর্থহীন।
.
ক্রমশ ভরত তার চারপাশে দুই তিন এবং তার বেশি মুখওয়ালা মানুষ দেখতে শুরু করল। তার বাবার তিনটি মুখ আছে। একটি মুখ দেখলে মনে হয় ভদ্রলোক অত্যন্ত সহৃদয় প্রকৃতির, দেশের জন্যে ভাবেন, গুনগুনিয়ে বঙ্গ আমার জননী আমার গাইতে ভালবাসেন, ছেলেকে ডেকে বলেন পথের পাঁচালি ইংরেজিতে লেখা হলে নোবেল প্রাইজ পেত, বুঝলে! দ্বিতীয় মুখ বেরিয়ে আসে বিশেষ বিশেষ টেলিফোন এলে। তখন গলার স্বর নেমে যায়। সত্যিকারের ষড়যন্ত্রীর মতো দেখায় মুখটা। টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে, ফিসফিসিয়ে কথা বলেন। হয় তো নিজের কানকেও ঠিক বিশ্বাস করেন না। মায়ের সঙ্গে হেসে এমন ভাবে কথা বলেন যে মনে হয় মা মিস ইউনিভার্স। বেড়াল বেড়াল ভাব এসে যায় তখন। বিশেষ করে মায়ের কোনও বান্ধবী বা বাবার বন্ধু বাড়িতে এলে ভাল প্রেমিক প্রেমিক মুখটি স্পষ্ট দেখা যায়। ফিসফিসিয়ে টাকার কথা বলে যে মুখ তার সঙ্গে এই মুখটির কোনও পার্থক্য আজকাল ভরত দেখতে পায় না। তৃতীয় মুখটি বেরিয়ে পড়ে যখন বাবার আঁতে ঘা লাগে। মায়ের সঙ্গে ঝগড়ার সময় মুখে নেকড়ের ছাপ ফুটে ওঠে। একই ব্যাপার মায়ের ক্ষেত্রেও হতে দেখছে সে। বাইরের লোকের সামনে এক মুখ, বাবার সঙ্গে ঝগড়ার সময় দ্বিতীয় মুখ আর সুখী সুখী চেহারা করে ফেললেই তৃতীয় মুখটি বেরিয়ে আসে।
ভরতদের নিচের ফ্ল্যাটে থাকেন রবীনবাবু। মাত্র দু বছর আগে হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছেন নয় লক্ষ টাকা দিয়ে। রবীনবাবু শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। প্রায়ই খবরের কাগজে নাম বের হয়। সকালবেলায় লিফটে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা মানুষের ভিড় থাকে খুব। কিন্তু নামকরা শ্রমিক নেতা বলে কেউ আপত্তি থাকলেও জানাতে পারে না। লিফট ছেড়ে হেঁটে নিচে নামে অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা। বাবা বলেছিল, শ্রমিক আন্দোলন করে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছে, ভেবে দ্যাখো।
মা বলেছিল, আগে বোধহয় কোনো বস্তিতে থাকত। বউটার চেহারা তাই বলে।
বাবা বলল, কিছু বলা যাবে না। এখন তো ওদেরই যুগ। মা বলল, ওর মেয়েটাকে দেখেছ? কি অশ্লীলভাবে জামা পরে, বুকের দিকে তাকানো যায় না। এর মধ্যেই অন্য ফ্ল্যাটের ছেলেরা গায়ে পড়ছে। আমাদের এখানে আগে কখনও এমন কাণ্ড হয়নি। কালচারের ছিটেফোঁটা নেই তা বোঝা যায়।
তোমার ছেলে তাকায় না তো!
শুধু আমার ছেলে হলে তাকাত না, মুশকিল হল ও তোমারও ছেলে।
কথাগুলো দরজার ওপাশে থেকেও কানে ঢুকেছিল। মেয়েটাকে সে দেখেছে কয়েকবার। যে ছেলেই সিঁড়ি দিয়ে নামে তার দিকেই অদ্ভুত চোখে তাকায়।
সেদিনরাত্রে ঘটনাটা ঘটল। মা টিভি দেখছিল। ভরত নিজের ঘরে। বাবা হুইস্কির গ্লাস নিয়েই বই পড়ছিল এমন সময় বেল বাজল। মা দরজা খুলল, ও আপনি! আপনি।
একটু বিরক্ত করছি বোধহয়।
না না বিরক্ত কেন? আসুন। এই শুনছ? মা বাবাকে ডাকল।
সাধারণত মায়ের প্রথম ডাকে বাবা সাড়া দেয় না। হুইস্কি খাওয়ার সময় তো নয়ই।
ভরত আগন্তুকের গলা পেল, আসলে আমার টেলিফোনটা আউট অফ অর্ডার হয়ে আছে। আমি রবীন, আপনাদের নিচের ফ্ল্যাটে আছি।
ওমা একি কথা! আপনাকে চিনব না কেন? অ্যাই শুনছ! এবারে ডাকটা একটু উঁচুতে।
বাবা গ্লাস রেখে যেতে বাধ্য হলো। মা বলল, চিনতে পারছ? রবীনবাবু।
বাবা বলল, নিশ্চয়! আসুন, কি সৌভাগ্য।
একটা টেলিফোন করতে পারি?
একশবার। বাবা টেলিফোনটা এনে দিল। ভরত দরজায় এসে দেখল লোকটা বোতাম টিপে চোখ বন্ধ করেছে, হ্যালো। রবীন বলছি। কী ভেবেছেন বলুন তো? শ্রমমন্ত্রীকে বলে ব্যাপারটা ম্যানেজ করলাম অথচ আপনার হুঁশ নেই। শ্রমিকরা খেপে লাল হয়ে আছে। তা আপনি যদি এই চালে চলেন তা হলে ওদের লেলিয়ে দিই, কী বলেন? একটু চুপ করলেন রবীনবাবু, ঠিক আছে, শেষবার চান্স দিলাম, কাল সকাল দশটা পর্যন্ত। টেলিফোনের লাইন কেটে দিয়ে রবীনবাবু বললেন, কারও উপকার করা এ যুগে অন্যায়।
বাবা বলল, কোনও প্রব্লেম?
আর প্রব্লেম। আমার লাইনে এক মিনিট শান্তি নেই মশাই। শ্রমিকদের প্রভিডেন্ড ফান্ড কেটেছে অথচ সরকারের ঘরে জমা দেয়নি। এক্সাইজ ডিউটি অর্ধেক দিয়ে পুরো মাল বাজারে ছাড়ছে। অথচ শ্রমিকদের হকের পাওনা দেবার বেলায় নানা অজুহাত। হ্যাঁ, আমি জানি আজকাল যা খরচ বেড়েছে তাতে সৎপথে ব্যবসা করলে সব কিছু মেটানোর পর মালিকের পকেটে কিছু যাবে না। আমি চাই না ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হোক। শুধু ধর্মঘট আর আন্দোলন করলে তো কারখানাগুলোর উন্নতি হবে না। কিন্তু লোকগুলো এমন অকৃতজ্ঞ যে যতক্ষণ না শাসিয়ে কথা বলছি ততক্ষণ। রবীনবাবু হাসলেন, আপনারা আবার আমাকে ভুল বুঝবেন না।
মা বলল, সে কি! আপনাকে ভুল বুঝব কেন? চা না কফি?
না না, এত রাত্রে ও সব। মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন রবীনবাবু।
মা বলল, তা কি হয়! এই প্রথম আপনি এলেন আমাদের বাড়িতে।
কী দরকার। আসলে আমি এখন চা কফি খাই না। সারাদিন ধরে এত চা খেতে হয় যে, বুঝতেই পারছেন, শ্রমিকদের নিয়ে কারবার।
বাবা বলল, আপনাকে বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে।
না না। সঙ্কোচ কীসের, বলে ফেলুন।
আমি একটু হুইস্কি খাচ্ছিলাম। আপনার আপত্তি না থাকলে–।
সেটা একটু চলতে পারে। প্রিমিয়াম তো?
হ্যাঁ। তা তো নিশ্চয়ই।
মা বলল, তুমি সার্ভ করো, আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি।
ভরত দেখল বাবা হুইস্কির বোতল, ঠাণ্ডা জল এবং গ্লাস নিয়ে শ্রমিক নেতার পাশে বসল। মা চটপট খাবার বানিয়ে টেবিলে রাখল। ভরতের এক পিসি রাত আটটায় এ বাড়িতে এসে চা চেয়েছিল বলে মা বিরক্ত হয়েছিল। আর যে লোকটার নিন্দে করেছে দুজনেই তাকে সেবা করতে এখন বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা দেখাচ্ছে না ওরা।
রবীনবাবু বললেন, আপনি যেন কোথায় আছেন?
বাবা জবাব দিলেন। গ্লাসে চুমুক দিয়ে রবীনবাবু হাসলেন, আপনাদের এম ডি লুথার সাহেব যাকে বলে দুনম্বরি লোক, ঠিক তাই ছিলেন।
আপনি চিনতেন? বাবা অবাক।
বাঃ। চিনব না কেন? আমার ইউনিয়ন তো ওখানে পাওয়ারে।
লুথার সাহেব!
লোকটা আমাকে টাকা দিত, একটু বেশিই দিত আবার নিজের জন্যে রাখত। অবশ্য সেটা আমাকে জানিয়েই রাখত। এমন কি পার্টি ফান্ডে চাঁদা দিতে বললেও ও ওই একই কারবার করত। হে হে করে হাসলেন রবীনবাবু।
বাবা বলল, এখনকার এম ডি?
আজই কথা হচ্ছিল। দিল্লি যাওয়া আসার ওপেন টিকিট ফেরত পাঠালাম। লোকটা ভাবে কী? প্লেনে যেন আমি উঠতে পারি না? আরে আমি একটা কাজ নিয়ে দিল্লি যাই না রে। দশজনের দশটা কাজ করে দেব আর দশজনই দশটা ওপেন টিকিট দেবে। যাব তো একটায়। আমাকে টিকিট দেখাচ্ছে। দেব অ্যাইসা টাইট যে বাছাধন বুঝবে ঠ্যালা।
সত্যি নাকি?
আমি মিথ্যে বলি না মশাই।
তা হলে আমি যে বিপদে পড়
কী রকম?
কোম্পানির কিছু হলে?
দুর! দেখছেন না সি এম চাইছেন না শ্রমিক অশান্তির জন্যে কারখানার প্রোডাকশন যেন বন্ধ না হয়। এই যে এত এন আর আইদের লোভ দেখিয়ে টেনে আনা হচ্ছে সব হাওয়া হয়ে যাবে। তাই আমি রামকৃষ্ণর পলিসি নিয়েছি, ফোঁস করব কিন্তু ছোবল মারব না। হুইস্কিতে চুমুক দিলেন রবীনবাবু, বিপদে পড়বেন কেন? এই মওকায় কিছু কামিয়ে নিন।
কী রকম? বাবা উৎসুক।
কোনওমতে এম ডির কানে তুলে দিন আমি আপনার প্রতিবেশী। ব্যস, তারপরে দেখবেন মাল আপনা আপনি আপনার পকেটে এসে যাবে। হো হো করে হাসলেন রবীনবাবু, আপনার ছেলেমেয়ে কটি? প্রশ্নটা আচমকাই মায়ের দিকে তাকিয়ে ছুড়লেন তিনি।
একটি! প্রেসিডেন্সিতে পড়ে।
আচ্ছা! তা হলে ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। কই ডাকুন ওকে।
মা উঠে এল। দরজা পেরিয়েই ভরতকে দেখতে পেয়ে হকচকিয়ে গেল। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু বুঝতে চেষ্টা করতেই নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল ভরত।
মা ফিসফিস করে বলল, দু মিনিটের জন্যে গেলে জাত যাবে না, এসো। তারপরেই ফিরে গিয়ে মা হাসল, পড়াশুনা করছিল, আসছে।
অগত্যা যেতেই হল। তাকে দেখতে পেয়ে রবীনবাবু বললেন, ও, তুমি। প্রেসিডেন্সিতে পড়? ওখানে আমাদের প্রচুর ছেলে আছে।
অভিজিতের মুখ মনে এলেও কিছু বলল না ভরত।
রবীনবাবু বললেন, কোন পার্টি কর?
এখনও ভেবে পাচ্ছি না। তা ছাড়া মা-বাবা বলেছেন ইউনিয়ন না করতে।
রবীনবাবু একটু কুঁকড়ে যাওয়া মায়ের দিকে তাকালেন, না না। এই তো ইউনিয়ন করার বয়স। এখন থেকে না নামলে বেশ শক্ত হবে কী করে। বাধা দেওয়া ঠিক নয়।
মা মিন মিন করল, পড়াশুনায় ব্যাঘাত হবে বলে। হ্যাঁ। ওদিকটাও নজরে রেখো। পড়াশুনা যেন নষ্ট না হয়। আমার মেয়েকে তো আমি বলি পড়াশুনা হচ্ছে সবচেয়ে প্রথম কর্তব্য। তুমি কি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছ?
জবাব দিল মা, হ্যাঁ। আগাগোড়া!
বাঃ। খুব ভাল। আমার মেয়েটার সব ভাল শুধু স্পোকেন ইংলিশটা খারাপ। তুমি একটা কাজ করতে পারবে? ওকে ইংরেজি বলাটা শিখিয়ে দাও।
মা বলল, দিস না। সপ্তাহে দু-একদিন শেখালেই শিখে নেবে।
হ্যাঁ। তার বেশি লাগবে না। যাও, পড়াশুনা করো। রবীনবাবু বলল হাই তুলে।
চার পেগ মদ্যপান করে ভদ্রলোক চলে গেলে বাবা আর রাতের খাবার খাব না বলে শুয়ে পড়ল। মা গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে প্লেট গ্লাস গোছাচ্ছিল। ভরত এসে দাঁড়াল সামনে, তোমরা এটা কী করলে?
কোনটা?
ওই বাজে লোকটাকে এন্টারটেইন করলে?
বাজে লোক মানে?
চমৎকার! তোমরা বলোনি লোকটা বাজে? শ্রমিক নেতা হয়ে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনে কী করে বলে সমালোচনা করোনি? অথচ ওর সঙ্গে যে ভাবে কথা বললে তাতে মনে হল কৃপা পাওয়ার জন্যে গলে যাচ্ছ। বেশ জোরে জোরে কথাগুলো বলল ভরত।
কৃপা? ওর কাছে আমরা কোনও কৃপা চেয়েছি বলে তোর মনে হল? প্রতিবেশী বাড়িতে এসেছে, পছন্দ করি বা না করি ভদ্র ব্যবহার করাটাই নিয়ম। তা ছাড়া আমরা কী করছি না করছি তার কৈফিয়ত তোকে দেব না। মা কড়াগলায় বলল।
বাঃ, এ ব্যাপারে তোমাদের বেশ মিল দেখছি।
ভরত! বাড়াবাড়ি করো না। মা চিৎকার করল।
এই সময় বাবা বেরিয়ে এল, কী হয়েছে? কী বলছে ও?
রবীনবাবুকে ড্রিঙ্ক অফার করেছ বলে আমাদের সমালোচনা করছে। বলছে ওঁর কাছে কৃপা চাওয়ার জন্যে আমরা খাতির করেছি। এমন বিশ্রী ভাবে কথা বলে আজকাল! মা বলল।
বেশ করেছি। আমার কোম্পানির এম ডি যাকে তোয়াজ করে তাকে খাতির করলে যদি উপায় হয় তা হলে নিশ্চয়ই করব। এনি মোর কোশ্চেন? বাবা যে ভাবে ঘুরে দাঁড়াল প্রশ্ন মনে এলেও ভরতের আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না।
.
সেই রাত্রে ভরত কিছু খেল না। মা মাত্র একবার খাওয়ার কথা বলেছিল, দ্বিতীয়বার আসেনি। প্রচণ্ড ক্রোধ ভরতকে আপ্লুত করেছিল। তার মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীটার সব কিছু বানানো, মানুষগুলোর আচরণে ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নেই। তার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত তা হলে এই সবকিছু চুরমার করে ফেলত। ভারতবর্ষে, কলকাতায় বাস করে কোনও মানুষ সুস্থ থাকতে পারে না। তাকে প্রতিপদে ভণ্ডামি করে যেতে হবেই। অথচ কেউ এর প্রতিবাদ করে না, কেউ না। যে সব সন্ন্যাসীরা বিবেকানন্দের বাণী আওড়ান তারাও অনুদান না পেলে স্কুলে ছাত্র ভর্তি করেন না। এদের মধ্যে বাঁচতে হলে হয় তাকে ভণ্ড হতে হবে নয় প্রতিপদে প্রতিবাদ করতে হবে। ওই রাত্রে প্রচণ্ড রাগ এবং খিদে একাকার হয়ে যাওয়ায় ভরত ঠিক করল সে প্রতিবাদ করবে। এ ব্যাপারে সে কারও সাহায্য নেবে না। যে সব রাজনৈতিক দল আদর্শের কথা বলে তাদের ভণ্ডামিও আজ স্পষ্ট। ফলে রাজনৈতিক দলের সদস্য হলে তাকে এই ভণ্ডামির পথেই যেতে হবে। সে ঠিক করল মানুষ হিসাবে সে স্পষ্টবাদী হবে।
পরদিন সকালে কলেজে যাচ্ছিল ভরত। হ্যারিসন রোড আর কলেজ স্ট্রিটের মোড় যখন সে পার হচ্ছে তখন চারধারে প্রচুর মানুষ। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। বাস ট্রাম এবং রিকশায়। মোড়টা প্রায় ভরাট। ভরত দেখল একস্টা লরি বেআইনি ভাবে নো এন্ট্রি লাগানো পথে ঢুকছিল। তাকে দাঁড় করিয়ে ট্রাফিক পুলিশ খুব ধমকাচ্ছে। লরির ড্রাইভার কয়েক শো লোকের সামনে হাত বাড়িয়ে দুটো টাকা এগিয়ে ধরতেই পুলিশটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তারপর হাত নেড়ে ড্রাইভারের ইচ্ছে অনুযায়ী পথে যেতে বলল। ভরত দৃশ্যটা দেখল অবাক চোখে। লরিটা বাঁক নেবার চেষ্টা করতেই সে দৌড়ে গেল সামনে। ব্রেক চাপতে বাধ্য হল ড্রাইভার। পুলিশটা বিরক্ত হয়ে তাকে দেখছে। ভরত নোকটাকে কাছে ডাকল। এগিয়ে এল লোকটা, কী করছেন? জ্যাম হয়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন না?
খপ করে লোকটার বাঁ হাত ধরে ফেলল ভরত, আপনি ঘুষ নিলেন কেন?
ঘুষ? হকচকিয়ে গেল পুলিশ।
আপনি প্রকাশ্যে এত লোকের সামনে ওর কাছে ঘুষ নিয়েছেন।
কী যা-তা বলছেন? কে আপনি?
তাতে আপনার কোনও দরকার নেই। আপনি ঘুষ নিয়ে লরিটাকে বেআইনি পথে যেতে দিয়েছেন। আপনি পুলিশ, আইনের রক্ষক। তবু এত নির্লজ্জ আপনি যে পাবলিকের চোখের সামনে অন্যায় কাজ করতে দ্বিধা করছেন না। ভরতের কথার মধ্যে আশেপাশের গাড়ি থেকে হর্ন বাজা শুরু হল। দুচারজন মানুষ এগিয়ে এসেছিল কাছে। তাদের একজন বলল, ছেড়ে দাও ভাই, পুলিশ তো ঘুষ নেবেই।
আশ্চর্য! আপনারা এই অন্যায়কে সমর্থন করছেন?
একজন বলল, এটাই তো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মারুতি গাড়ির কঁচ নামিয়ে এক সুবেশ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?
ভরত তাকে ব্যাপারটা বলল। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, কেন আমাদের দেরি করিয়ে দিচ্ছেন ভাই। দুটো টাকার মামলা। ওর ওপরওয়ালারা দুশো দুহাজার থেকে দু লাখ নিচ্ছে। আপনি কলকাতায় নতুন নাকি?
ভরত মাথা নাড়ল, নো। আমি ওকে ছাড়ব না। ওকে টাকা সমেত ধরেছি। একজনকে শাস্তি দিলে হয়তো দুজন ব্যাপারটা করার আগে ভাববে।
ভিড় বাড়ছিল। পাবলিক ভরত এবং পুলিশটিকে ফুটপাতে তুলে দিল। তারাই ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে আরম্ভ করল। ভরত পুলিশটির হাত শক্ত করে ধরেছিল। হঠাৎ লোকটা যেন খেপে উঠল, সততা মারাচ্ছেন না? সততা। রোদ জল ঝড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি রাস্তায়, ক পয়সা। মাইনে পাই জানেন? পারবেন আপনি টানা চারঘণ্টা গ্রীষ্মকালের দুপুরে ওখানে দাঁড়াতে? আর দু চারটাকা যা আসে তা কি আমি একা ঘরে নিয়ে যাই ভেবেছেন? ক ভাগ করতে হয়, আমি কত পাই তার হিসেব জানেন?
আমি কিছু জানতে চাই না। আপনি থানায় চলুন।
থানায়? লোকটা অনেকক্ষণ পরে হাসল, আমায় থানায় নিয়ে গেলে আপনি বিপদে পড়বেন। বড়বাবু আপনাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবেন।
লোকটার কথা সত্যি হলেও হতে পারে। ভরত বলল, চলুন আমার সঙ্গে?
কোথায়? আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল!
আমাদের কলেজে আসুন। প্রায় টানতে টানতে লোকটাকে কলেজে নিয়ে এল ভরত। ওদের পেছনে পেছন মজা দেখতে চাওয়া জনতা আসছিল। কেউ কেউ ভরতকে সমর্থন করছিল। পুলিশের ওপর যাদের সহজাত রাগ আছে তারা সেটা প্রকাশও করছিল।
অভিজিত এগিয়ে এল, কী হয়েছে?
ভরত বলল ব্যাপারটা। শেষ করল, ইনি বলছেন থানায় গেলে বড়বাবু উল্টে আমাকে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবেন।
অভিজিত পুলিশটিকে জিজ্ঞাসা করল, তাই নাকি?
এবার লোকটির গলার স্বর পাল্টে গেল। মিনমিনে গলায় বলল, আমি বুঝতে পারিনি স্যার ইনি ছাত্র। আমাকে মাপ করে দিন, আর হবে না।
এই মোড়ে ডিউটি করলে আর ঘুষ নেবেন না? অভিজিত প্রশ্ন করল।
কক্ষনো না। মাইরি বলছি।
এই মোটরবাইকের আওয়াজ পাওয়া গেল। বিশালদেহী এক সার্জেন্ট ভিড় সরিয়ে এগিয়ে এল, কী হয়েছে? একে ধরে এনেছেন কেন? কে এনেছে?
ভরত জবাব দিল, আমি। ও ঘুষ নিচ্ছিল। প্রতিবাদ করলে ভয় দেখিয়েছে।
কত টাকা ঘুষ নিয়েছে?
দু টাকা।
তুমি ঘুষ নিয়েছ? সার্জেন্ট পুলিশটিকে জিজ্ঞেস করল।
না স্যার। লোকটার কাছে আমি টাকাটা পেতাম, দেখা হতে শোধ করে দিল। অবলীলায় মিথ্যে কথা বলে ফেলল পুলিশটি। হাঁ হয়ে গেল ভরত।
সার্জেন্ট ভরতকে বলল, একজন সরকারি কর্মীকে জোর করে কর্তব্যস্থল থেকে নিয়ে আসার জন্য আপনাকে অ্যারেস্ট করা যেতে পারে, আপনি জানেন? ও যে এই কথাটা মিথ্যে বলল তা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?
ভরত প্রতিবাদ করল, ও মিথ্যে বলছে। একটু আগে ঘুষ নেবার জন্য ক্ষমা চাইছিল।
আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?
ওই লরিওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করুন। নো এন্ট্রিতে ঢুকছিল বলে টাকা দিয়েছে।
কোন লরিওয়ালা?
মোড়ে দাঁড়িয়েছিল।
ছিল হয়তো, এখন নেই। নাম্বার নিয়েছেন?
না
নিলেও সে কি এসে স্বীকার করবে ওকে ঘুষ দিয়েছে নো-এন্ট্রিতে ঢোকার জন্যে? কী মনে হয় আপনার? সবাই যুধিষ্ঠির হয়ে গেছে?
অভিজিত চুপচাপ শুনছিল। এবার ভরতকে বলল, তুমি একটা সাধারণ ব্যাপারে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। লেটস ফরগেট ইট।
সার্জেন্ট বলল, আমি ভেবে অবাক হচ্ছি যে এখনকার ছেলে হয়েও ট্রাফিক পুলিশের দু টাকা ঘুষ নেওয়াটা আপনার কাছে অসহ্য হয়েছে কী করে? লাল সবুজ আলোর মত এটাও এত স্বাভাবিক তা আপনার বোঝা উচিত। যাকগে, আমি কোনো কেস দিচ্ছি না। যাও, ডিউটিতে যাও। আদেশ পাওয়ামাত্র পুলিশটি ছুটে গেল।
ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে অভিজিত ওর কাঁধে হাত রাখল, ব্যাপারটা কি?
ভরত বলল, নিজেকে একটা গর্দভ বলে মনে হচ্ছে।
হঠাৎ তোমার অ্যাডভেঞ্চার করার বাসনা হল কেন?
অ্যাডভেঞ্চার?
নয় তো কি? এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে মাথা গরম করলে। বুর্জোয়ারা যেখানে সক্রিয় সেখানে এ সব ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তুমি কজন পুলিশকে সংশোধন করবে? এরা তো নিচের তলার ক্ষমতাহীন প্রাণী। রাঘব বোয়ালদের যদি শায়েস্তা না করা যায় তা হলে এরা তো অভ্যেস ত্যাগ করবে না। অভিজিত থামল। হেসে বলল, তা ছাড়া, ওরা সবাই আমাদের সরকারি প্রশাসনের অঙ্গ। সামান্য ব্যাপার নিয়ে এদের কলঙ্কিত করলে তার দায় সরকারের ওপর পড়বে। মাঝে মাঝে পি এমকে তাই বলতে হচ্ছে পুলিশ কোনও অন্যায় করেনি। বুঝলে?
তুমি বুঝতে চাইছ না। এই রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছা তোমাকে ছাড়তে হবে। অভিজিত আর দাঁড়াল না। ক্ষোভে বিরক্তিতে নিজেকে প্রতারিত বলে মনে হচ্ছিল ভরতের। এইসময় দেখতে পেল সুদেষ্ণা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, অভিনন্দন।
মানে?
এতকাল শুনেছি পুলিশ সাধারণ মানুষকে ধরে ভোগাচ্ছে। আজ নাকি আপনি পুলিশকে নাজেহাল করেছেন? কী ব্যাপার? সুদেষ্ণা হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।
রাগ হয়ে গেল ভরতের, অভিনন্দন জানাতে এসেছেন অথচ জানেন না ব্যাপারটা কি? যারা গল্প করেছে তারা ওটাই বাদ দিল?
সুদেষ্ণার মুখ নরম হয়ে গেল, কি হয়েছে আপনার?
ভরত মাথা নাড়ল, চলি।
দাঁড়ান। আমি কিন্তু আপনার শত্রু নই।
হ্যাঁ। জানি। সবাই আপনার বন্ধু। এই কলেজের সব ছেলেকে তাই বলে উন্মাদ করে দিতে পারলে খুশি হন।
তাই নাকি? আমার এত ক্ষমতা?
ক্ষমতা যে আছে তা নিজে জানেন না?
বাঃ। এতগুলো উন্মাদের সঙ্গে মিশে আমার কি লাভ হবে?
আনন্দ। স্রেফ মজা দেখবেন।
তাই। আর কে কত উন্মাদ তা আমি জানি না। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সত্যিকারের এক উন্মাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এবং একটুও মজা পাচ্ছি না। সুদেষ্ণা চলে গেল।
ভরতের এ বার খারাপ লাগল। পুলিশের ব্যাপারটা নিয়ে বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে সে সুদেষ্ণাকে উল্টোপাল্টা কথা বলে ফেলল। এ সব তার চিন্তায় ছিল না। মা-এর কাছাকাছি কথা বলায় সে নিজে প্রতিবাদ করেছে। অথচ এখন অজান্তেই তাই আউড়ে গেল।
সুদেষ্ণা তাকে বলে গেল সত্যিকারের উন্মাদ। ভরত ক্লাসে ঢুকে শেষ বেঞ্চিতে বসল। অধ্যাপক কী পড়াচ্ছেন তা শোনার চেষ্টা করল। হঠাৎ তার মনে হল লোকটা বানানো কথা বলছে। তার আগে বছরের পর বছর এই একই কথা অজস্র ছাত্রছাত্রী শুনেছে। শুনে তাদের কার কি লাভ হয়েছে কেউ হিসেব দেয়নি। বি.এস সি পাশ করে, এই সব বক্তৃতা শুনেও মুদির দোকান করেছে। এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া শক্ত নয়। ইচ্ছে হল কথাটা অধ্যাপককে বলে। ঠিক সেই সময়ই অধ্যাপক পড়া থামিয়ে তার দিকে তাকালেন, উঠে দাঁড়াও।
ভরত উঠল। অধ্যাপক বললেন, মনে হচ্ছে আমার ক্লাস তোমার ভাল লাগছে না। তাই তোমাকে সাজেস্ট করছি যেখানে ভাল লাগবে সেখানে যেতে পার।
আমার যদি ভাল না লাগে তা হলে কেন ভাল লাগছে না জানতে চাইবেন না?
নো। আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি যেতে পার।
ভরত বেরিয়ে এল। একেবারে কলেজ স্ট্রিটে এসে সে আবিষ্কার করল কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। চুপচাপ সে হাঁটতে লাগল। কলুটোলার মোড়ে এসে সে একজন প্রৌঢ়কে ধমক দিতে শুনল। লোকটার আগে আগে একটা দশ বারো বছরের ছেলে মাথায় বিরাট বোঝা নিয়ে ছোটার চেষ্টা করছে। প্রৌঢ় ধমকাচ্ছে ছেলেটা ভালভাবে ছুটতে পারছে না বলে। ভরতের মাথা গরম হয়ে গেল। সে ছেলেটার সামনে গিয়ে ওকে থামাল। তারপর প্রৌঢ়কে বলল, এটা কী করছেন? ওইটুকু বাচ্চার মাথায় অত মাল চাপিয়ে ছোটাচ্ছেন?
আঃ। আমাকে ট্রেন ধরতে হবে। পথ ছাড়ো।
না ছাড়ব না। আপনার লজ্জা করছে না ওকে এক্সপ্লয়েট করতে?
এক্সপ্লয়েট? ও টাকা নিচ্ছে না? মাগনা খাটছে? সারা পৃথিবীতে কে কোথায় এক্সপ্লয়েট করছে বলতে পার? ও যেচে দর করে কাজটা নিয়েছে হে। কেটে পড়। চল, চ।
প্রৌঢ় ছেলেটিকে নিয়ে ছুটলেন। ভরত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
.
বিকেলবেলা বাড়িতে ফিরে এসে ভরত দেখল দরজা বন্ধ। এই ফ্ল্যাটের দুটো চাবি আছে। একটা বাবার পার্সে থাকে, দ্বিতীয়টা দেওয়ালে ঝোলানো। কোনো কারণে মাকে যদি বেরুতে হয় তাহলে চাবি পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস মুখার্জির কাছে রেখে যান। এই মিসেস মুখার্জির সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক অদ্ভুত রকমের। মাঝে মাঝে গলাগলি ভাব, মাঝে মাঝে কথা বন্ধ। কি বিষয়ে মত-পার্থক্য হয় ভরত জানে না। মিস্টার মুখার্জির মাথা ভর্তি টাক, বয়স হয়েছে, খুবই নিরীহ চেহারার মানুষ। ওঁদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই বলে মিসেস মুখার্জি প্রায়ই বাপের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটান।
ভরত মিসেস মুখার্জির দরজার পাশের বোতাম টিপল। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভেতরে বেল বাজছে কি না! দ্বিতীয়বার বেল বাজতেই দরজা খুলল, তার আগে কি-হোলের ওপাশে যে চোখ এসেছিল তা বুঝতে পারল ভরত। মিসেস মুখার্জি একটা আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরে আছেন, মাথার চুলে ভোয়ালে জড়ানো। ভরতকে দেখে বিরক্ত হলেন তিনি, কী ব্যাপার?
মা কি আপনার কাছে চাবি রেখে গেছেন?
কই, আমি জানি না তো! চোখ ঘোরালেন মহিলা।
না দরজা বন্ধ, ভেতরে কেউ নেই বলে ভাবলাম আপনার কাছে চাবি রেখে মা বেরিয়েছে।
এখন তোমার মায়ের চাবি রাখার কত জায়গা হয়েছে, দ্যাখো কোথায় রেখে গেছে?
ভরত ঠোঁট কামড়াল। মিসেস মুখার্জি হাসলেন, তোমার মা যতক্ষণ না ফিরছে ততক্ষণ কি তুমি এখানে বসবে? বসতে পার।
ভরত মাথা নাড়ল, না, ঠিক আছে। সে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। হ্যাঁ, রোজ যে সময়ে সে বাড়ি ফেরে তার অনেক আগে আজ ফিরেছে। মা যদি কোথাও বেরিয়ে থাকে তাহলে ওই সময়ের মধ্যেই ফিরে আসবে। চাবি যখন মিসেস মুখার্জির কাছে রাখা নেই তখন বোঝাই যাচ্ছে মায়ের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক আবার খারাপ হয়েছে।
নিচে নামতেই ভরত দেখল ওদের সঙ্গে পড়ত প্রণব নামের একটি ছেলের মা ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছেন। প্রণবের বাবার সম্প্রতি সেরিব্রাল হওয়ায় শয্যাশায়ী। প্রণব রাত্রে কলেজে পড়ে এবং এই বয়সেই দিনের বেলায় কোথায় চাকরি করছে। প্রণবের মা একেবারেই হাউসওয়াইফ এবং পুরনো আমলের চালচলন। ভরত জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন মাসিমা?
ভাল না বাবা। তোমার মেসোমশাই তো এখনও ওই অবস্থায় রয়েছেন। ছেলেটার পড়াশুনায় ব্যাঘাত হচ্ছে খুব। টাকা-পয়সারও খুব টানাটানি যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা অকপটে বললেন, এই দ্যাখো না, আজ থেকে সাত বছর আগে তোমার মেসোমশাই পাঁচকাঠা জমি কিনেছিলেন। আট হাজার করে কাঠা ছিল তখন। ইচ্ছে ছিল জায়গাটায় বাস চলাচল ভাল করে শুরু হলে একটা ছোট বাগানওয়ালা বাড়ি করবেন। ভগবান আর সেই ইচ্ছে পূর্ণ হতে দিলেন না। এখন যখন টাকারই টানাটানি তখন ওই জমি বিক্রি করে দিতে চাই। কিন্তু পারছি না।
পারছেন না কেন? জমি তো আপনাদেরই।
কর্পোরেশনের খাতায় তোমার মেসোমশাই-এর নাম নেই। প্রণব পয়সা খরচ করে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। তার জবাবে অনেকে কিনতে চাইছে কিন্তু তারা সবাই কাগজপত্র ঠিক আছে। কিনা জানতে চাইছে। মিউটেশন করা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করছে সবাই।
সেটা করা নেই? ভরতের আগ্রহ হলো।
মাসিমা মাথা নাড়লেন। না বাবা, নেই। আমি তো এসব কিছু জানতাম না। গতকাল কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম। ওরা আজ বিকেলে দেখা করতে বলেছে।
আপনি একাই যাচ্ছেন?
আর কে যাবে বাবা? প্রণব চাকরিতে কামাই করলে মাইনে কাটে। দিন রাতের লোকের ভরসায় তোমার মেসোমশাইকে রেখে যেতে ভরসা হয় না, তবু তাই যাচ্ছি।
ঠিক আছে, আমার হাতে কোনো কাজ নেই এখন, আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।
তুমি যাবে? প্রণবের মা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তার ছেলে যখন স্কুলে পড়ত। তখন ভরত সহপাঠী ছিল। কিন্তু ভরতের বাবা-মায়ের চালচলন বুঝিয়ে দিত দুটো পরিবারের মধ্যে দূরত্ব রাখাই ভাল। সেকারণেই একই ফ্ল্যাট বাড়িতে থেকেও কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। এখন অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে নেমে এসেছে সেখানে ওটা আশা করাই যায় না।
চলুন। কিসে যাবেন?
ট্রাম যায়। একটু হাঁটতে হয় যদিও তবু অনেক আরামে যাওয়া যায়।
ধর্মতলামুখী ট্রামে লেডিস সিটে জায়গা পেয়ে গেলেন মাসিমা। ভিড় কম ছিল বলে ভেতরে দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেল ভরত। সে মাসিমার কথা ভাবছিল। তার মায়ের চেয়ে বেশি বড় নন অথচ দুজনের কথা বলার ধরন আলাদা। বাংলা সিনেমায় যেসব মা-মাসিমাদের দেখা যায় ইনি সেই রকম। তার মা এখনও নায়িকাদের সঙ্গে মানিয়ে যাবে। মায়ের সঙ্গে পড়ত একজন বিখ্যাত মহিলা এখনও বাংলা ফিল্মের নায়িকা যখন, তখন মাকে বয়স্কা ভাবা যাচ্ছে না। আর মা যদি মাসিমাদের মতো কথাবার্তা বলত অথবা ওইভাবে শাড়ি পড়ত তাহলে বাবা আরও খেপে যেত। বাবা নিজেকে প্রৌঢ় বলেও ভাবতে চায় না। আজ ভরতের মনে হল বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃকোলে হয়তো ঠিক কিন্তু যেমন বয়স তেমন সাজো আর বোধহয় চলে না। কিন্তু ছেলে হিসেবে তার মায়ের চেয়ে মাসিমাকেই এখন বেশি পছন্দ হচ্ছে।
তখন প্রায় বিকেল কিন্তু ছুটি হতে ঘন্টাখানেক দেরি আছে। মাসিমার সঙ্গে কর্পোরেশন অফিসে ঢুকে ভরত দেখল অধিকাংশ চেয়ারই খালি। এতলোকে একসঙ্গে অফিসে আসেনি? মাসিমা এর আগের দিন যাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি অবশ্য ঘরেই ছিলেন। পর্দা সরাতে দেখা গেল তার টেবিলের সামনে কয়েকজন বসে আছেন। ওদের দেখে হাত নেড়ে অপেক্ষা করতে বললেন। বাইরে বসারও জায়গা নেই। মাসিমা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ একটা শুটকো চেহারার লোক ওদের সামনে এগিয়ে এল, জমি-জমার ব্যাপার নাকি?
মাসিমা বললেন, হ্যাঁ। ওঁর সঙ্গে দেখা করব।
দেখা করলে কাজ হবে বলে ভেবেছেন? কিছু হবে না।
ভরত জিজ্ঞাসা করল, কী করে বুঝলেন কাজ হবে না?
থার্টি ইয়ার্স এক্সপেরিয়েন্স। প্রব্লেমটা কী?
কথা বলার ধরনের মেজাজটা খারাপ হল ভরতের, আপনাকে বললে কাজ হবে?
চান্স আছে। এটা সরকারি অফিস। সোজা কথায় কোনো কাজ হয় না। আপনারা তো ছার, মহামান্য মন্ত্রীমশাই এলেও দেখবেন ফাইল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই যে দেখছেন চেয়ারগুলো ফাঁকা, অফিস কিন্তু ছুটি হয়নি। যে যার কাজে চলে গেছে। পার্সোনাল কাজ। মন্ত্রীর বাবারও সাধ্য নেই ছুটি না হওয়া পর্যন্ত ওদের আটকে রাখতে। আর যাঁরা টেবিলে রয়েছেন তারা জনসেবায় ব্যস্ত। সকাল বেলায় বারোটার আগে কোনো কাজ পাবেন না।
আপনার কথা সত্যি হলে কর্পোরেশনের কাজ কী করে চলছে?
কোথায় থাকেন?
কেন?
নতুন ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকলে বুঝবেন না। পুরনো কলকাতায় কিছু বাড়ি আছে যার অনেক শরিক। কেউ আগবাড়িয়ে সারাতে চায় না। ইট বেরিয়ে গেছে, দেওয়ালে ফাটল ধরেছে তবু তাতে মানুষ থাকছে। ওইভাবে আরও পঞ্চাশ বছর থাকবে। কর্পোরেশনও থাকবে। প্রব্লেম কী?
এই সময় অফিসারের ঘরের লোকগুলো বেরিয়ে এল বাইরে। লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে মাসিমাকে ইশারা করে ভরত ভেতরে ঢুকল। অফিসার বয়সে প্রবীণ নন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন বের হবেন বলে। ওদের দেখে কাঁধ ঝাঁকালেন, কী ব্যাপার?
ভরত বলল, ওঁকে আজ আসতে বলেছিলেন।
আপনারা এমন অসময়ে আসেন কেন? সকালের দিকে আসতে পারেন না?
ওঁকে তো এই সময় আসতে বলেছিলেন।
অ। বলুন। অফিসার আবার চেয়ারে বসলেন।
মাসিমাকে উল্টোদিকের চেয়ারে বসালো ভরত। মাসীমা বললেন, আমাদের জমির ব্যাপার কী করতে হবে সেটা জানতে এসেছি।
কোথাকার জমি?
আপনাকে আমি সব বলেছিলাম। আপনি রেকর্ড দেখে রাখবেন বলেছিলেন।
সরি। মাথায় সব রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া রেকর্ড তো আমি বের করব না। ওটা যাতে ঠিকঠাক আমার টেবিলে আসে তার ব্যবস্থা করুন।
কী ভাবে করব? মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনি মহিলা। আপনাকে যেতে হবে না। আপনি গিয়ে পিওনদের সঙ্গে কথা বলুন।
ভরত লোকটাকে হাঁ করে দেখছিল। বলল, আপনার পিওনকে আমি বলব কেন? আপনার হুকুম শুনবে না? তার তো সেটাই চাকরি।
হুকুম? এখানে হুকুমে কিছু হয় না। বলেই যেন একটু অস্বস্তিতে পড়লেন ভদ্রলোক, আচ্ছা, আপনার সমস্যাটা কী আর একবার বলুন তো?
আমার স্বামী একটা জমি কিনেছিলেন।
কতটা?
পাঁচ কাঠা। আট হাজার টাকা কাঠা ছিল তখন। কোর্টে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। সেসব কাগজ আমার কাছে আছে। কিন্তু কর্পোরেশন থেকে মিউটেশন করানো হয়নি।
খুব অন্যায় করেছেন। আপনারা স্বামী এখনও জীবিত?
হ্যাঁ। উনি শয্যাশায়ী। উনি কিন্তু আট বছর আগে মিউটেশনের জন্যে আবেদন করেছিলেন এখানে। তার কাগজও আছে। এখান থেকে কাজটা করা হয়নি।
কেন করা হয়নি?
উনি তো এখন ভাল করে কথা বলতে পারেন না। তবু যা শুনেছি তা বলা বোধহয় ঠিক হবে না।
বলে ফেলুন। ওটা শোনা দরকার।
বোধহয় পয়সাকড়ি চেয়েছিল কেউ। উনি রাজি হননি তাই কাজটাও হয়নি।
খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এখন আপনারা মিউটেশন করাতে চাইছেন কেন?
আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। টাকার দরকার।
ও, বিক্রি করবেন। আট হাজার কাঠার জমি এখন আশিহাজার হয়েছে তা নিশ্চয়ই জানেন।
হ্যাঁ। শুনেছি।
তার মানে চল্লিশ হাজারের বদলে চার লাখ পাবেন। কদ্দিন আগে কিনেছিলেন?
সাত বছর আগে।
সাত বছরে ব্যাঙ্কে ডাবল হয়। অথচ আপনি বিক্রি করতে পারবেন না যদি মিউটেশন করানো থাকে। যিনি কিনবেন তিনিও অবশ্য মিউটেশন থাকলে কিছুটা সুবিধে পাবেন ট্রানসফারের সময়, তবু তাকে ভুগতে হবে খানিকটা। অফিসার হাসলেন।
ভরত সোজা হয়ে বসল, এখন মিউটেশন করাতে হলে কী কী দরকার?
অফিসার বললেন, আবেদন। যিনি জমি কিনেছিলেন তিনি নথিপত্র সমেত আবেদন করবেন।
নথিপত্র বলতে?
জমির দলিলের কপি, আদালতে যে ডিড রেজেস্ত্রি হয়েছে তার কপি এবং যার কাছ থেকে জমি কেনা হয়েছে তার নামে মিউটেশন করা থাকলে তার কপি এবং আপটুডেট খাজনা দেবার রসিদ পেলেই চলবে।
মাসিমা বললেন, আমি শুনেছিলাম উনি যাঁর কাছ থেকে কিনেছিলেন তিনি ওসব কিছুই করেননি। দু-চার টাকা খাজনা ছিল বলে দেব দেব করে দেননি।
তাহলে বিশ বাঁও জলে পড়ে গেলেন। এখানে টাকাটা বড় কথা নয়, নিয়ম মেনে চলাই ধর্তব্য। আপনাকে আপটুডেট খাজনা ওর হয়ে দিতে হবে। সেটা ঠিক করব আমরা। আর এসব করে সার্টিফিকেট পেতে বছরখানেক লাগবে। ঠিক আছে, আপনারা আবেদন করুন, আমি দেখছি।
মাসিমা বললেন, মাসখানেকের মধ্যে ব্যাপারটা না হলে খুব মুশকিল পড়ব যে।
আই অ্যাম সরি। আপনার মতো আবেদন করেছেন এমন কয়েকশো কেস পেন্ডিং আছে। অফিসার উঠে দাঁড়ালেন।
ভরত সব শুনছিল চুপচাপ। এবার জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কাজটা করতে কত দিন লাগে?
সেটা বড় কথা নয়। যিনি কাজটা করবেন তার ওপর বাড়তি চাপ আমি দিতে পারি না।
কিন্তু ওঁর টাকার দরকার। নিজের জমি বিক্রি করে টাকা পেতে চান।
আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু সরি বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। অফিসার হাসলেন, অবশ্য আপনাদের যদি বড় ক্যাচ থাকে, যেমন ধরুন মেয়র অথবা পুরমন্ত্রীকে দিয়ে যদি বলাতে পারেন তাহলে তাড়াতাড়ি হয়ে যেতে পারে।
আমার তো তেমন কেউ জানাশোনা নেই। মাসিমা বললেন।
অফিসার মাথা নেড়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন ভরত দ্রুত তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, আপনি বুঝতেই পারছেন উনি বিপদে পড়েছেন। কোনো অন্যায় অনুরোধ করছেন না। আপনি কি হেল্প করতে পারেন না?
অফিসারের ঠোঁট বেঁকাল, আমি সাহায্য করতে চাইলে সবাই বলবে টাকা খেয়েছি। খামোকা বদনাম নেব কেন বলতে পারেন?
টাকা খেয়েছি মানে?
আশ্চর্য! টাকা খেয়েছি মানে জানেন না? সবাই জানে ওই জমির বর্তমান দাম কত। উনি লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করবেন জমি বিক্রি করে আর আমি বিনিপয়সায় ওঁকে সাহায্য করছি একথা কর্পোরেশনের একটা ইটও বিশ্বাস করবে না। ওঁর স্বামীকে আমি চিনতাম না। উনি সততা আঁকড়ে থেকে ওঁকে বিপদে ফেলে গেছেন।
ভরত লোকটার মুখের দিকে তাকাল, এই কাজটা সাতদিনের মধ্যে করাতে হলে কত টাকা দিতে হবে? টাকাটা আপনাকে দিলে আপনি নেবেন?
অফিসার ভরতের শক্ত হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, আপনি সরকারি অফিসে এসে ঘুষের প্রস্তাব দিচ্ছেন?
আমি প্রস্তাব দিচ্ছি আপনার কথা শুনে!
আপনারা এবার আসতে পারেন।
ভরত শিথিল হল। মাসিমার সঙ্গে বাইরের করিডোরে বেরিয়ে এল সে। মাসিমা বললেন তুমি ওভাবে বললে কেন বাবা। আমাদের তো কাজটা হওয়া নিয়ে কথা।
কিন্তু লোকটা ওর ডিউটি করবে অথচ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টাকার কথা বলছিল না? আমি চাইছিলাম ও টাকার কথা বলুক একবার–। ভরত চুপ করে গেল এই সেই দালাল চেহারার লোকটিকে আসতে দেখে। লোকটি বলল, ঝামেলা করলে এ বাড়িতে কোনো দিন কাজ করাতে পারবেন না। আমি ভাল কথা বলছি, মাল ছাড়ুন কাজ হয়ে যাবে।
ভরত কিছু বলার আগেই মাসিমা বললেন, উনি নতুন করে আবেদন করতে বললেন।
ওঁর কথা ছাড়ুন। রাঘব বোয়াল। আপনাদের মাথা খারাপ তাই সরাসরি ওঁরা কাছে গিয়েছিলেন। আমাকে বলুন ঠিক কী কী চাই আপনাদের।
মাসিমা লোকটিকে বিশদে বললেন। লোকটি হাসল, ম্যাক্সিমাম মাসখানেক। আজ দুশো টাকা দিয়ে যান। দিন সাতেক পরে এসে জেনে যাবেন কবে কাগজপত্র হাতে পাবেন। কাগজ পেলে বাকি আটশো দেবেন। খুব সস্তায় করে দিলাম, আমার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না।
ভরত চিৎকার করে উঠল, কী বলছেন আপনি? কোনো অন্যায় আবদার করছেন না উনি তবু হাজার টাকা দিতে হবে? এটা কি মগের মুলুক?
এই মেরেছে! এসব কী হচ্ছে? লোকটি বিড়বিড় করল।
সামান্য কিছু লোক করিডোরে ঘোরাফেরা করছিল, চিৎকার শুনে তারাই ভিড় জমাল। একজন জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে ভাই?
ওঁর জমি উনি বিক্রি করবেন। সেই বাবদ কর্পোরেশন থেকে অনুমতি চাইতে এসেছেন। এরা বলছে বছর খানেক লাগবে নয়তো হাজার টাকা ঘুষ দিতে হবে। এর প্রতিবাদ করা উচিত। এখানে কি ঘুষ না দিলে কোনো কাজ হয় না?
এইসময় এক রাসভারী চেহারার মানুষ এগিয়ে এলেন, কে ঘুষ চেয়েছে?
ভরত লোকটিকে দেখাল, ইনি।
ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি কর্পোরেশনে চাকরি করেন?
আজ্ঞে না।
তাহলে ঘুষ চাইলেন কেন?
কই, চাইনি তো। লোকটি দুদিকে মাথা দোলালো।
আপনি চাননি? লায়ার!
আমি দালালি চেয়েছিলাম। আদালতে গেলে উকিলরা ফি নেয়, আমি দালালি নিয়ে কাজটা করে দিই। বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করলে খাব কী?
ভদ্রলোক বললেন, এর ঘুষ নেবার কোনো সুযোগ নেই কারণ এখানে চাকরি করে না। অথচ ভাই তুমি চেঁচিয়ে লোকজড়ো করে যা বললে তাতে কর্পোরেশনের মানহানি হয়েছে। তোমার বয়স কম নইলে তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বিপদে ফেলতাম আমি। যান আপনারা, এখানে দাঁড়িয়ে কিছু দেখার নেই। যান। ধমকের সুরে জনতাকে বলা মাত্র ভিড় সরে গেল। ভদ্রলোক চলে গেলে লোকটি বলল, কালিদাস হয়ে গেলে ভাই?
মানে?
যে ডালে বসে আছ তারই গোড়া কাটছ?
মাসিমা এতক্ষণ উদ্বিগ্ন হয়ে শুনছিলেন, এবার বললেন, আপনি ব্যবস্থা করুন আমি ওই টাকা দিতে রাজি আছি। আমার কাজটা পাওয়া নিয়ে কথা।
ওই টাকায় তো আর হবে না মা! লোকটা হাসল।
আপনি তো হাজার টাকা বললেন?
বলেছিলাম। তখন তো দৃশ্যে নতুন অভিনেতার আগমন হয়নি। যিনি এইমাত্র এখানে অভিনয় করে গেলেন তাকে যে দক্ষিণা দিতে হবে এবার। অন্তত দুশো।
ভরত হতভম্ব হয়ে বলল, উনি আপনাকে চেনেন?
বিলক্ষণ। কতবার টাকা নিয়েছেন আমার কাছ থেকে। হ্যাঁ, বারো শো। দুশোই দিয়ে যান, বাকি হাজার কাগজ নেবার সময় দেবেন।
মাসিমা এমন চোখে ভরতের দিকে তাকালেন যে সে মাথা নিচু করতে বাধ্য হল। এই যে দুশো টাকা বেড়ে গেল তা ওর কারণে মাসিমা যেন বোঝাতে চাইলেন।
লোকটা ওদের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল কাগজপত্র এবং দুশো টাকা নিয়ে নিল। ভরত জিজ্ঞাসা না করে পারল না, আপনি এখানে চাকরি করেন না। আর যদি আপনাকে খুঁজে না পাই?
ভয় হওয়াটা স্বাভাবিক। শুনুন। ওই বাড়িতে কত মেয়র এসে চলে গেল, কত অফিসার এসে দুদিনের জন্যে লাঠি ঘুরিয়ে বদলি হয়ে গেল, কত কেরানিবাবু ফেয়ারওয়েল নিয়ে বিদায় হলেন কিন্তু আমি ঠিক এক জায়গায় রয়ে গেছি। মৃত্যু অবধি থাকব। এলে সোনার ডিম পাই, টাকা মারা মানে মুরগির পেট কাটা। ওই চায়ের দোকানে গোবিন্দর খোঁজ করবেন, ওটা আমার নাম।
মাসিমা বললেন, আমি আপনাকে বিশ্বাস করলাম ভাই।
এ লাইনে বিশ্বাসই সব। কিন্তু মা, এই শেষ নয়। আপনি জমিটা তো বিক্রি করবেন?
হ্যাঁ।
তখন আবার আমাকে দরকার হবে।
কেন?
আপনি কাঠা প্রতি কত দাম পাচ্ছেন?
ধরুন এক লক্ষ টাকা।
বাঃ। চার লক্ষ টাকার জন্যে কত স্ট্যাম্প কিনতে হবে জানেন? যিনি কিনবেন তিনি নিশ্চয়ই সেটা দিতে চাইবেন না। তার মানে অন্তত দু লক্ষ হোয়াইট দু লক্ষ ব্ল্যাক করতে হবে। আপনি যদি পঞ্চাশ হাজার কাঠা দেখিয়ে স্ট্যাম্প কেনেন তাহলে অ্যাসেসার সেটা মানবে না। এই সব ঝামেলার সমাধান আমি করে দেব। নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনি লাভ করলে আমায় একটু চিড়েগুড় দেবেন, তাতেই আমি খুশি। লোকটা হাসল।
ওরা বাইরে বেরিয়ে এল। ভরতের সমস্ত শরীর জ্বলছিল। সে বলল, মাসিমা, আপনাকে ট্রামে তুলে দিলে যেতে পারবেন একা?
তুমি কোথায় যাবে?
ভরত উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকাল।
মাসিমা বললেন, আমি তো একাই আসছিলাম, তুমি নিজেই সঙ্গে এলে।
আমি খুব দুঃখিত যে আমি সঙ্গে আসায় আপনার দুশো টাকা খরচ বেড়ে গেল।
মাসিমা গম্ভীর হতে গিয়ে হেসে ফেললেন, তাই তুমি আমাকে একা যেতে বলছ?
মাসিমা, আপনি বুঝতে পারছেন না, এটা প্রতারণা। সাধারণ মানুষকে তার ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে চাপ দিয়ে প্রকাশ্যে এরা টাকা রোজগার করছে আর কেউ তার প্রতিবাদ করার কথা ভাবছে না। ঘুষ নেওয়ার মতো ঘুষ দেওয়াটাও এখানে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। আমি এটা সহ্য করতে পারছি না। ওই দালালটা কেমন দিয়ে দুশো টাকা বাড়িয়ে নিল। আর আপনি এই অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করলেন! ভরত উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বলল।
মাসিমা বললেন, তুমি ঠিক বলেছ।
তাহলে আপনি টাকা দিলেন কেন?
না দিয়ে উপায় ছিল না।
কেন?
এক বছর অপেক্ষা করেও হয়তো কাজটা করাতে পারতাম না। কাজটা না হলে আমি টাকা পাব না। তোমার মেসোমশাই-এর চিকিৎসা ভালভাবে হবে না, ছেলেটাকে চাকরি ছাড়িয়ে দিনের
কলেজে ভর্তি করাতে পারব না। আর যদি এক বছর পরে হত তাহলে এই চার লক্ষ টাকার ব্যাঙ্কের সুদ নিশ্চয়ই হাজার টাকার অনেক বেশি হত। দ্যাখো বাবা, জীবন অনেক বেশি সত্য, আদর্শ এবং আবেগ যা আমাদের পূর্বপুরুষ স্থির করে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির কোনো মিল নেই তা আমি এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছি। মাসিমা বললেন।
মাসিমার মুখে এমন কথা শুনবে আশা করেনি ভরত। মা বললে মানাতো। ভরতের মনে হল মানুষ এখন নিজের স্বার্থের জন্য যে কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে পারে। মাসিমার মতো একজন বয়স্কার ঘরোয়া মহিলাও তার ব্যতিক্রম নয়? প্রায় মুখ বুজে ওরা ট্রাম স্টপে এল। মাসিমা উঠে লেডিস সিটে জায়গা পেয়ে গেলেন। ভরত ভিড় সামলাতে একপাশে দাঁড়িয়েছিল। ট্রাম যত এগোচ্ছে ভিড় তত বাড়ছে। কয়েকজন মহিলা খুব কষ্ট করে দাঁড়িয়ে আছেন সামনে! হঠাৎ তার চোখ পড়ল একটি হাত একজন মহিলার নিতম্বে অশ্লীলভাবে ঘুরছে। কার হাত অথবা কার নিতম্ব সে বুঝতে পারছে না ভিড়ের আড়াল থাকায়। ভরত চোখ সরিয়ে নিল। কিন্তু তার চোখ আবার ফিরে গেল অজান্তেই। দৃশ্যটা এখনও অব্যাহত আছে। বোঝা যাচ্ছে হাতের মালিক মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে নেই। একটু দূর থেকেই লোকটা ওই অপকর্ম করছে। মাথায় খুন চেপে গেল ভরতের। সে হাত বাড়িয়ে লোকটার কবজি হ্যাঁচকা টান দিয়ে চিৎকার করল, এই কী হচ্ছে এসব?
ভিড় থাকা সত্ত্বেও ওই টানের ফলে একটি মাঝবয়সী মানুষের মুখ বেরিয়ে এল, আরে, হাত ধরে টানছেন কেন? কী অদ্ভুত!
অদ্ভুত? দেখাচ্ছি মজা! কী করছিলেন আপনি?
আমি? আমি আবার কী করব? ভিড় সামলে দাঁড়িয়েছিলাম! লোকটা হাত ছাড়াতে চাইল।দাঁড়িয়েছিলেন? আপনার হাত কী করছিল?
আমি দাঁড়িয়ে থাকলে হাত কী করতে পারে! অদ্ভুত!
আশেপাশের মানুষগুলো খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইল, কী ব্যাপার ভাই? পকেটমার নাকি?
ভরত মাথা নাড়ল, না, তার চেয়েও খারাপ!
অ্যাঁ? তার চেয়ে খারাপ! কি করেছে?
উনি ওই ভদ্রমহিলার শরীরে হাত বোলাচ্ছিলেন অনেকক্ষণ ধরে।
সঙ্গে সঙ্গে জনতার নজর লোকটি এবং ভদ্রমহিলাকে আবিষ্কার করতে তৎপর হয়ে উঠল? লোকটি বলল, একদম মিথ্যে কথা বলছ ভাই। ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।
তৎক্ষণাৎ একটা মিনি আদালত বসে গেল চলন্ত ট্রামে। দুজন যুবক উদ্যোগী হয়ে বলল, এটা বন্ধ করা দরকার। যদি উনি যা বলছেন সত্যি হয় তাহলে আপনার কপালে দুর্ভোগ আছে। ভিক্টিম কোন্ মহিলা?
তখন তখনও মহিলার মুখ দেখতে পাচ্ছিল না। শরীর দেখিয়ে বলল, ইনি।
ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, দিদিভাই, আপনার শরীরে কেউ কি হাত দিয়েছিল।
আমার শরীরে? ওমা, ওসব কী কথা? গলার স্বর শুনতে পেল ভরত।
উনি অভিযোগ করছেন, ওকে আপনার শরীরে হাত বোলাতে দেখেছেন।
আমার কি গণ্ডারের চামড়া যে কেউ হাত বোলালে টের পাব না। আর তেমন হলে জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দিতাম না। ভদ্রমহিলা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন।
সঙ্গে সঙ্গে তখনও কবজি ধরে থাকা লোকটি বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বদনাম, বদনাম দিচ্ছিস শালা। আমার প্রেস্টিজ-এর বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিস!
ভরত-এমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিল যে লোকটা তাকে কয়েক ঘা দেওয়া সত্ত্বেও সে কথা বলতে পারছিল না। সে ভুল দ্যাখেনি। তাহলে ওই ভদ্রমহিলা অস্বীকার করলেন কেন? ওই হাত বোলানো কি উনি উপভোগ করেছেন? কোনও মহিলা তা পারেন! এখন চলন্ত ট্রামে দু একজন তাকে লক্ষ্য করে টিপ্পনী কাটছে। ভিড় হালকা হচ্ছে। সেই লোকটাও সদর্পে নেমে গেল। ভরত মহিলার দিকে তাকাল। মাসিমার পাশে বসার জায়গা পেয়েছেন তিনি।
সে সোজাসুজি মাসিমার সামনে গিয়ে বলল, ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন তো কেন মিথ্যে কথা বললেন!
এবার ভদ্রমহিলা ভরতকে দেখলেন। তারপর ট্রামের ভেতরটা নজর বোলালেন। মাসিমা তাকে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপারটা কি ঠিক?
লেডিস সিটে আর কেউ নেই, কাছাকাছি বলতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা কন্ডাক্টর। ভদ্রমহিলা বললেন, আমি যদি অস্বীকার না করতাম তাহলে ট্রামে যাতায়াত করা অসুবিধে হয়ে যেত। বাসে যা ভিড় আমি উঠতেই পারি না। স্বীকার করলে আমি দ্রষ্টব্য বস্তু হয়ে যেতাম। এর আগে একটি মেয়ে প্রতিবাদ করেছিল, লোকটাকে গালাগাল দিয়েছিল। কিন্তু তারপর বেচারাকে অনেকবার শুনতে হয়েছে ছেলেদের উল্লাস, এই মেয়েটা এই মেয়েটা। গায়ে হাত সহ্য করার চেয়ে সেটা অনেক মর্মান্তিক।
ভরত শুনছিল। জিজ্ঞাসা করল, তাই বলে আপনি প্রতিবাদ করবেন না?
তখন তো আমি ভাল করে দাঁড়াতেই পারছিলাম না। কোন ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়েছে, আমি না দেখে ধরব কাকে? ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন। ট্রাম দাঁড়ানো মাত্র নেমে গেলেন। এবং কন্ডাক্টর ওদের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, ভাই, পঁচিশ বছর এই চাকরি করছি। লেডিজদের ব্যবহার একটু একটু করে কিরকম পাল্টে গেল। আগে সামান্য ধাক্কা লাগলে শুনতে পেতাম আপনাদের বাড়িতে মা বোন নেই? বদমাস ইতর এইসব গালাগাল। এখন ভিড় ট্রামে ওঁরা যখন উঠতে চান আর আমি নিষেধ করি তখন শুনতে পাই, আমি কি মোমের পুতুল যে গায়ে গা লাগলে ক্ষয়ে যাব? লেট মার্ক পড়ে গেলে আপনি বাঁচাবেন?
ভরত কথা বলল না। হঠাৎ তার অন্য কথা মনে এল। একটি মেয়ের হাত কনুই পিঠে ভিড়ের চাপ পড়লে কেউ কিছু মনে করে না, তিনিও এখন ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক ভাবে নেন না। কিন্তু বুক বা নিতম্বকে আলাদা করে দেখা হয় কেন? ওইসব জায়গাগুলো কি খুব সেন্সেটিভ বলে হাত-পা থেকে আলাদা? শরীরের যেসব জায়গা মেয়েরা ঢেকে রাখে তার মধ্যে তো পিঠও পড়ে। তাহলে পিঠে চাপ পড়লে কেউ কিছু মনে করে না কেন?
ট্রাম থেকে নেমে মাসিমা জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করো? এই আজ যেমন দেখলাম?
এতদিন করতাম না, কারণ এসব ব্যাপারে সামনে কখনও যাইনি।
কিন্তু কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তুমি বুঝবে কী করে?
আশ্চর্য! এ আপনি কী বলছেন?
ঠিকই বলছি বাবা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর চেহারা বদলে যাচ্ছে। তুমি এমন হট করে মাথা গরম করে না। সস্নেহে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা।
ভরতের মনে হচ্ছিল চার লক্ষ টাকার জমি বিক্রি করার ইচ্ছায় মাসিমারও চরিত্র বদল হয়ে গেছে।
বাড়িতে ফিরে ভরত জিজ্ঞাসা করল, তুমি চাবি কোথায় রেখে গিয়েছিলে?
মা রান্নাঘরে ছিল, বলল, কেন?
তুমি দুপুরে বেরিয়েছিলে?
হ্যাঁ। রবীনবাবুদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম। কেন, তুই এসেছিলি?
হঠাৎ ওখানে?
ইচ্ছে হল, গেলাম।
তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার আমি বুঝতে পারি না।
তুমি নিজের কাজ করো, আমাদের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। কিন্তু আজ তোর ক্লাস হয়নি? দুপুরে ফিরে এলি হঠাৎ?
এলাম। ভরত নিজের ঘরে চলে গেল। জামা ছেড়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কিছু ভাল লাগছে না। আজকাল যেন কারো সঙ্গে কোনো কিছুর সঙ্গে তার মিল হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছিল এখন কলকাতার বেশির ভাগ মানুষই মুখোশ পরে বেঁচে আছে।
শরীর খারাপ? মায়ের গলা পেল ভরত।
না। একটুও না নড়ে জবাব দিল সে।
তোর হয়েছেটা কী? আজকাল সব ব্যাপারে উল্টোপাল্টা কথা বলছিস, সবসময় মুখে বিরক্তির চিহ্ন। কলেজে ঢোকার পর এমন পাল্টে গেলি কি করে?
চিত হয়ে শুলো ভরত, এতকাল তোমরা আমার চোখে ঠুলি পরিয়ে রেখেছিলে বলে সত্যিকারের চেহারা দেখতে পাইনি। এখন দেখে থই পাচ্ছি না।
তার মানে?
তোমরা কি অদ্ভুতভাবে বেঁচে আছ মা!
আমরা? যেভাবে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকে সেইভাবেই আছি। তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? কি উদ্ভট কথা বলছিস?
তাই? অন্ধের দেশে গেলে চোখ খুলে রাখলে অশান্তি হবেই, কথাটা সত্যি।
ভরত! তুই কী বলতে চাইছিস? মায়ের গলা চড়ল।
আমি যাদের দেখছি তাদের কেউ আর নিজেকেও বিশ্বাস করে না। সততা শব্দটা অভিধান থেকেও মুখে গেছে যেন। শুধু স্বার্থ, স্বার্থ নিয়ে বেঁচে থাকবে বলে প্রত্যেকে নিজেকেও নিজের অজান্তে ঠকিয়ে যাচ্ছে। এই যে তুমি, এত বছর ধরে বাবার সঙ্গে রয়েছ কিন্তু তোমাদের সম্পর্কটা কী? স্বামী-স্ত্রীর?
সে কী? তাহলে আমরা কী?
কী রকম স্বামী-স্ত্রী। প্রতিটি দিন যে কোনো ইস্যুতেই দুজনে দুজনকে চরম গালাগাল করছ। তখন দেখে মনে হয় কেউ আর কারও মুখ দেখবে না। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছ না। অথচ তার পরেই দুজনের কমন স্বার্থে ঘা পড়লে এমন এক হয়ে যাও দেখে কে বুঝবে একটু আগে খেয়োখেয়ি করছিলে। তোমরা নিজেদের কি করে এত বছর টলারেট করছ তা তোমরাই জানো! ভরত মুখের ওপর বলে ফেলল।
মা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। ধীরে-ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল। তার চোখ অদ্ভুতরকমের বড় দেখাচ্ছে। ভরত হাসল, তোমরা যে লোকটাকে সমালোচনা করো, ব্যঙ্গ করো নোংরা বললো সেই লোকটারই বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্যে লালায়িত হও যখন জানতে পার তার হাতে ক্ষমতা আছে। তার ফ্ল্যাটে গিয়ে গল্প করে আসতে সম্মানে লাগে না তোমার। পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস মুখার্জির সঙ্গে তোমার বোধহয় এখন খারাপ সম্পর্ক তাই তিনি ঠাট্টা করেন বলেন এখন তোমার মায়ের চাবি রাখার অনেক জায়গা হয়েছে। মা, আমি জানি না বাবা ঘুষ নেয় কি না, চুরি করে কি না! এখন মনে হচ্ছে নেয়। আগে কখনও ভাবিনি এখন চিন্তা করলে বুঝতে পারি মাইনের টাকায় রোজ স্কচ খাওয়া যায় না। ঘুষের ফ্লো বজায় রাখার জন্যই ম্যানেজিং ডিরেক্টরের মন পাওয়াটা জরুরি আর তাই ওই শ্রমিক নেতাকে তেল মাখাতে তার আপত্তি নেই। সব রকম বিবেক বিসর্জন দিয়ে। আরও শোনো, একজন শ্রমিক নেতা নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। পার্টিতে তাঁর ইনফ্লুয়েন্স খুব। অন্যের পয়সায় স্কচ খেতে তিনি অভ্যস্ত। সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েদের দেরিতে ইংরেজি শেখাতে বলে নিজের মেয়েকে ইংরেজিতে কইয়ে বলিয়ে করতে চান। আজকের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে। একজন শ্রমিক নেতার কাজই হল বড় বড় রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের খেপিয়ে মালিকদের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করানো। ধর্মঘটী শ্রমিকরা যখন অভুক্ত অবস্থায় ইনক্লাব জিন্দাবাদ করছে তখন মালিক বেনামদারকে রেস্টুরেন্ট বিক্রি করে দিচ্ছেন নেতাকে তুষ্ট করে। নতুন মালিক যখন রেস্টুরেন্ট খুলছে তখন তার বিরুদ্ধে তো আন্দোলন করা যায় না এই অজুহাত দেখিয়ে আন্দোলন তুলে নিয়ে পুরনো কিছু কর্মীর বদলে নিজের লোক ঢোকাচ্ছেন নেতা। ওইসব কর্মীর অপরাধ তারা পেটের জন্যে বসে না থেকে সাময়িকভাবে অন্য কাজ খুঁজে নিয়েছিল। এই নেতার পক্ষে নয় লক্ষ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব এবং পার্টি কোনো আপত্তি করে না। তোমার কোনো কাজ সরকারি অফিসে থাকলে টাকা না দিলে সেটা হওয়া অসম্ভব। যে লোকগুলো টাকা নিচ্ছে তারা কারও বাবা কারও ছেলে। বাড়িতে ফিরে এসে তাদের বিবেকের কোথাও কোনো অস্বস্তি হয় না। ট্রামেবাসে মেয়েদের শরীর স্পর্শ করলে এখন তারা উপেক্ষা করেন কারণ প্রতিবাদ করলে আরও বড় লজ্জায় পড়তে হবে। নিচের তলায় প্রণবের মা ঘুষ দিলেন কর্পোরেশনকে কারণ তিনি জমি বিক্রি করে চার লক্ষ টাকা পাবেন। আমি এগুলো মানতে পারছি না, মানতে খারাপ লাগছে কিন্তু আমি একা তো কিছু করতে পারি না। একটানা কথাগুলো বলে থামল ভরত।
মা চুপচাপ বসেছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, তোর মাথায় এসব কে ঢোকাল?
তোমরা।
আমরা? মা অবাক।
হ্যাঁ। ছোটবেলা থেকে যদি বোঝাতে বড় হয়ে ঘুষ নিবি, স্বার্থের বাইরে এক পা হাঁটবি, যার সঙ্গে ঝগড়া করবি তার সঙ্গেই ভাব করবি, অসৎ না হলে তুই বড় হতে পারবি না তাহলে আজ সবাইকে স্বাভাবিক বলে মনে হত। কিন্তু তোমরা আমাকে বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে। সতোর জয় সর্বত্র বলে গল্প শোনাতে। এই তুমি স্কুলের প্রথমদিকে কেউ আমার টিফিনে ভাগ বসালে ঝগড়া করতে নিষেধ করতে। মানুষ করেছ এক ভাবে আর নিজেরা বেঁচে আছ অন্যভাবে। ধাক্কাটা লেগেছে সেই কারণে।
তুই ঠিক কী চাইছিস?
আমি জানি না। তাহলে আগে সেটা ঠিক করে নে তারপর তোর সঙ্গে কথা বলব। মা উঠে গেল।