Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্ট্রাইকার || Moti Nandi » Page 4

স্ট্রাইকার || Moti Nandi

লিগের তৃতীয় ম্যাচ

১৬.

লিগের তৃতীয় ম্যাচ শোভাবাজারের সঙ্গে। এরিয়ানের সঙ্গে ২-২ করে, উয়াড়িকে ৩০ হারিয়েছে সোনালি। পাঁচটা গোলই আমার, লিগে প্রথম হ্যাট্রিকও। যুগান্তরে লিখেছে, সোনালি সংঘের নবাগত ফরোয়ার্ড পি ভট্টাচার্য সুযোগসন্ধানীরূপে পরিচয় দিয়ে গুনে গুনে তিন তিনটি গোল দিয়ে মরসুমের প্রথম হ্যাট্রিক লাভের গৌরব অর্জন করেন। পিন্টু কাগজ থেকে কেটে রেখে দিয়েছে। ও প্রায়ই এখন বায়না ধরে আমার খেলা দেখার জন্য। যদি খারাপ খেলি ওর সামনে, এই ভয়ে ওকে কখনও মাঠে আনিনি। ও আমার সব থেকে বড় ভক্ত। কিন্তু আজ ওকে এনেছি, আজ আমি কনফিডেন্ট, ভাল খেলবই।

আনোয়ার দূর থেকে হাত তুলল। আমিও হাত তুললাম। তখন খেলার আগে ওয়ারমিং আপ চলেছে। আনোয়ার জগ করতে করতে আমার কাছে এসে বলল, খুব গোল দিচ্ছিস, আজ পারবি না।

জুনিয়ার ইন্ডিয়া ক্যাম্পে তোর আর নিমাইয়ের নাম আছে দেখলাম।

আনোয়ার হেসে চলে গেল। নিমাই আমাদের দিকে এল না। রতন একবার বল কুড়োতে এসে বলে গেল, সাবধানে থাকবি আজ।

কেন?

বললুম।

রতন চলে যাবার পর আমি ওর কথার মানে বোঝার চেষ্টা করেও কোনও হদিস পেলাম না। অবশেষে বুঝলাম হাফ টাইমের মিনিট তিনেক আগে। শোভাবাজার পেনালটি বক্সের মধ্যে আমাদের রাইট আউট ব্যাক সেন্টার করতেই ছুটে গেলাম। আমার সঙ্গে টিকাদারও। বলটা দু গজ দূরে ড্রপ পড়ে উঠছে, কী করব? ভলি মারলে বারের দশ হাত উপর দিয়ে যাবে। একমাত্র উপায় ডাইভ দিয়ে হেড। সামনে গোলকিপার বেরিয়ে আসছে, আনোয়ারের বুটের ধপধপ বাঁ দিকে, আমি ঝাঁপ দিলাম।

মাথায় বলের স্পর্শ পাবার সঙ্গে সঙ্গে, ডান পাঁজরে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা ছুরির ফলার মতো বিঁধল। টিকাদার লাথি কষিয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে, চোখে অন্ধকার দেখছি। তার মধ্যেই রেফারির লম্বা হুইল শুনতে পেলাম।

সাইড লাইনের বাইরে আমাকে শোয়ানো হল। জারসি খুলে বুকে বরফ ঘষা হচ্ছে। চোখ খুলতেই পিন্টুর কাঁদো কাঁদো মুখটা প্রথমে চোখে পড়ল। হাত তুলে ওকে আশ্বাস দিতে গিয়ে খচ করে বুকে যন্ত্রণা উঠল। হাসলাম শুধু। দাসুদা, কমলদা ঝুঁকে রয়েছেন। এখন হাফ টাইম।

গোলটা হয়েছে? আস্তে উচ্চারণ করলাম।

হ্যাঁ। কমলদা বললেন।

কেউ নেমেছে নাকি?

সুশান্ত নামছে।

বারণ করুন, আমি খেলব, আমি পারব। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। আমার কিছু হয়নি।

তোকে খেলতে হবে না প্রসূন।

ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। আনোয়ারের টকটকে রাঙা মুখ চোখে পড়ল। আবার লাগলে সিজনের মতো বসে যাবি।

রাগে আমি জ্বলে উঠলাম। সেই ব্যবস্থাই তো তোরা করেছিস। কাওয়ার্ড।

আনোয়ারের চোখ দুটো দপ করে উঠল, কথা না বলে চলে গেল।

খেলতে পারবি? আমার আপত্তি নেই যদি খেলতে চাস। দাসুদা বললেন।

কিন্তু দাসুদা কমলদা থেমে গেলেন দাসুদার তোলা হাতটাকে দেখে। পিন্টু ফিসফিস করে বলল, আনোয়ারদা একা দু হাতে তোমায় মাঠ থেকে তুলে আনল। কী গায়ের জোর!

মাঠে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বল এখন আমাদের ডিফেনডিং জোনে। নিমাই যথেচ্ছ কাটাচ্ছে, একটার পর একটা বল বাড়াচ্ছে আর শোভাবাজারের ফরোয়ার্ডরা প্রত্যেকটা নষ্ট করছে। শেষে নিমাই শোধ করল গোলটা। আমি জানি, ও করবেই। ওকে রোখার সাধ্য সোনালির ডিফেনসের নেই। আমাদের আটজন পেনালটি বক্সের মধ্যে। এক ছুটের ওপর তিনজনকে কাটিয়ে শরীরটাকে ডান দিকে বাঁ দিকে করিয়ে ছোট্ট একটা চিপ, বেটাল গোলকিপারের ফ্যালফ্যালে চোখের উপর দিয়ে বলটা গোলে ঢুকে গেল।

আমি দু-এক বার ছোটার চেষ্টা করে বুঝলাম, পারব না। টিকাদার ছায়ার মতো সঙ্গে রয়েছে। তবু চেষ্টা করলাম। রাইট হাফ উঠে এসেছে। ওর সঙ্গে ওয়াল পাস করে বক্সের মাথায় পৌঁছোলাম। রাইট স্টপার ব্যাক ট্যাকল করতে এল। কাটালাম। লেফট হাফ সামনে। ঠেলে দিলাম বলটা বাঁ দিকের ফাঁকা জায়গায়। আমাদের লেফট আউট উঠে আসছে দেখছি। আনোয়ারের পিছনে চমৎকার জায়গা পড়ে আছে, ওখান থেকে গোল দশ গজ। ছুটে গেলাম সেখানে। লেফট আউট দিল আমাদের লেফট ব্যাককে। বল ধরে ও কাকে দেবে খুঁজছে, আমি হাত নাড়তেই ঠেলে দিল। শোভাবাজারের চারজন আমার দিকে ছুটে এল।

বলটা ঠিকমতো থামাতে পারলাম না। ছিটকে বেরিয়ে গেল পা থেকে। আনোয়ার ছুটে এসে পড়েছে। এবার সোজা গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেবে, তা ছাড়া উপায় নেই। তবু একবার শেষ চেষ্টা করলাম। আনোয়ার বলটা মারবার জন্য পা তুলে থমকে গেল। হুড়মুড়িয়ে আমি আর টিকাদার বলের জন্য এগিয়ে গেলাম।

ওরে বাপস।

একটা চাপা আর্তনাদ উঠল। আনোয়ার আর টিকাদার মাটিতে পড়ে। বলটা গড়াচ্ছে। ছুটে গিয়ে ধরলাম বলটা। গোল মাত্র পাঁচ-ছ গজ দুরে। একটা টোকা দিয়ে বাকি কাজটা সেরে ফিরে তাকিয়ে দেখি, টিকাদার তলপেট চেপে কাটা পাঁঠার মতো ছটফটাচ্ছে। আমি আনোয়ারের মুখের দিকে তাকালাম।

কী করলি?

বেশ করেছি, তোর কী?

বিপিনদা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন মাঠের মধ্যে চিৎকার করতে করতে : সাসপেন্ড করব তোকে। নিজের প্লেয়ারকে মারলি, জানোয়ার কোথাকার! বন্ধুত্বের প্রতিদান হল, সব বুঝি, সব বুঝি।

আমি লজ্জা পেয়ে সরে গেলাম। রতন আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, এমন একটা ব্যাপার যে হবে তা সে জানত। টিকাদারকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাবার পর শোভাবাজার আর খেলতে পারল না। আমাদের রাইট আউট পর পর দুটো গোল করল। দাসুদা হাত নেড়ে আমাকে মাঠ থেকে চলে আসতে বললেন।

রাত্রে আমার বুকে ব্যথা শুরু হল। মাকে ডাকলাম। পিন্টু বাড়ি এসে মাকে নিশ্চয় মাঠের কথা বলেছে, নয়তো মা প্রথমেই ক্ষুব্ধ স্বরে বলবেন কেন, কী। দরকার ছিল অমন করে ডেনজারাসলি গোল দেবার? বুকে লাথি খেতে হয় যেখানে, দরকার কি সে কাজ করার?

মার মুখে ইংরিজি শুনলে হাসি পায় আমার। আসলে পিন্টুর কথাই মার মুখ দিয়ে বেরোল। বললাম, গোেল ডেনজারাসূলিই পেতে হয়। গজগজ করতে করতে মা সরষের তেল গরম করে আনলেন। বুকে মালিশ করতে করতে একবার শুধু বললেন, ফুটবলই আমার সর্বনাশ করবে।

.

১৭.

সকালে বুক টাটিয়ে উঠল। আমার শুধু একটাই ভয়, এত পরিশ্রম করলাম সারা বছর, বুঝি বিফলে গেল। চোট পেয়েছি জানলে দাসুদা বসিয়ে দেবেন। অথচ বড় ম্যাচ একটাও খেলা হল না এখনও। পরশুই খিদিরপুরের সঙ্গে খেলা। আজ কি কাল ক্লাবে না গেলে নিশ্চয়ই কেউ খোঁজ করতে আসবে, জেনে যাবে চোট পাওয়ার কথা।

ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম দাসুদা কি কমলদাকে জানিয়ে দিই যে, আমি কলকাতায় নেই। মাসির বিয়েতে মামাবাড়ি চলে গেছি। কিন্তু কাকে দিয়ে খবর পাঠাব! পিন্টু ছাড়া আর কেউ নেই। কালীঘাটে দাসুদার বাড়ি কি গড়িয়ায় কমলদার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার মতো ডাঁটো এখনও সে হয়নি। দাসুদার টেলিফোন আছে, নম্বরটা জানি না। ওঁর ভাল নামটাও জানি না। হর্ষদা জানতে পারেন। পিন্টুকে হর্ষদার কাছে পাঠিয়ে দিলাম, আর সাবধান করে দিলাম, একদম যেন চোট পাওয়া সম্পর্কে একটি কথাও না বলে, তা হলে আর কোনও দিন মাঠে নিয়ে যাব না।

পিন্টু টেলিফোন নম্বর আনল। এবার সমস্যা কাকে দিয়ে টেলিফোন করাব। নীলিমাকে ডাকলাম, ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতেই ও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল এবং টেলিফোন নম্বর নিয়ে বেরিয়ে গেল। আধ ঘন্টা পর নীলিমা ফিরল। ওর সাড়া পেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে হৃৎপিণ্ডটা ধক করে গলায় আটকে গেল। দুই মূর্তি দাঁড়িয়ে, আনোয়ার-নিমাই।

ওদের দেখাচ্ছিল খুবই ব্যস্ত আর সিরিয়াস। আনোয়ার মোটা মোটা আঙুলগুলো আমার বুকে রেখে আলতো চাপ দিল। আমার মুখে যন্ত্রণা ফুটে উঠতে দেখে নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করল। নিমাইও গম্ভীর হয়ে মাথাটাকে দুবার উপর-নীচ করল। তার পর দুজনে ফিসফিস কী কথা হল, নিমাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আনোয়ার মাকে বলল, মাসিমা, ওকে জামা পরিয়ে দিন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

আমি একটাও কথা বলিনি। শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে কোনও পাত্তা না দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। মা আমাকে জামা পরিয়ে দিতে আনোেয়ার বলল, হাঁটতে পারবি? আমি মাথা নাড়লাম। নিমাই ট্যাক্সি এনেছে। দুপাশে দুজনে ধরে আমাকে ট্যাক্সিতে তুলল। আমরা শ্যামবাজারের দিকে রওনা হলাম।

হাড় ভাঙেনি। এক্স-রে না করলে চিড় খেয়েছে কি না বোঝা যাবে না। ডাক্তার কষে ব্যানডেজ করে দিল বুকটা। শুয়ে থাকতে হবে, নড়াচড়া বারণ। ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম। ওরা কেউ আমার সঙ্গে কথা বলল না, আমিও বললাম না। পৌঁছে দিয়ে, মার সঙ্গে কথা বলেই ওরা চলে গেল। নীলিমাকে দেখা মাত্র রেগে বললাম, কে তোমাকে সদারি করে ওদের ডাকতে বলেছে?।

নীলিমা উত্তর দিল, টেলিফোন করেছি। বলেছি, দিন পনেরো মামাবাড়ি থাকবে। এই বলে গম্ভীরভাবে ও আঙুলের ইশারায় আমাকে শুয়ে থাকতে বলে বেরিয়ে গেল।

এক্স-রে রিপোর্টে কিছুই পাওয়া গেল না।

খিদিরপুর, ইস্টার্ন রেল, মহামেডান, কালীঘাট, রাজস্থান—পাঁচটা ম্যাচ শুয়ে রইলাম বাড়িতে। তিনটে হেরেছি, দুটো ড্র। এর পর আর শুয়ে থাকা গেল না। একদিন সকালে অল্প দৌড়োলাম, সামান্য ব্যায়ামও করলাম, কোনও অসুবিধা হল না। বিকেলে টেন্ট-এ গেলাম। পরদিনই স্পোর্টিং ইউনিয়নের সঙ্গে খেলা। এত দিন মামাবাড়িতে থাকার জন্য দাসুদা মৃদু বকুনি দিলেন এবং জানালেন, টিম হয়ে গেছে। তবে আমি খেলছি। আমার জায়গায় যাকে নামানো হয়েছিল, সে একদম সুবিধা করতে পারছে না।

সাবধানে, ঝুঁকি না নিয়ে প্রায় দাঁড়িয়েই খেললাম। জিতলাম ৩০। পেনালটি বক্সের মাথায় বল পেয়ে দুটো শট থেকে গোল করলাম। পরের ম্যাচ বি এন আর-এর সঙ্গে। এবার অরুণ ঘোষের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে যাচাই করব, এই ভেবে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কিন্তু মাঠে এসে যখন শুনলাম অরুণ ঘোষ খেলছে না, তখন বেশ ক্ষুন্ন হই। মনে হল, অরুণ ঘোষ আমাকে বঞ্চিত করল। নয় মিনিটের মধ্যে দুটো গোল দিয়ে মাঠকে অবাক করে দিলাম। ছোট টিম সোনালি শুরু থেকেই ডিফেনসিভ খেলবে, বোধ হয় এই রকম একটা ধারণা করেছিল বি এন আর। বদলে আমরা সোজা তাদের গোলের দিকে এগিয়ে যাই। পাঁচ মিনিটের পর রাইট আউটের ক্রস করা বল গোলকিপার এগিয়ে এসে পাৰ্চ করে সামনে ফেলতেই ছুটে এসে ভলি মেরে নেটে পাঠিয়ে দিলাম। দ্বিতীয় গোল একইভাবে। এর পর বি এন আর গুছিয়ে নিয়ে আমাদের কোণঠাসা করলেও আর। গোল দিতে পারেনি। আমাদের গোলকিপার রবি নিশ্চিত চারটে গোল বাঁচিয়েছিল।

পরের ম্যাচে যুগের যাত্রীর সামনে পড়লাম আমরা। লিগে যাত্রী এখন সবার উপরে, একটাও পয়েন্ট নষ্ট করেনি। মোহনবাগান হেরেছে ইস্টার্নের কাছে, ইস্টবেঙ্গল ড্র করেছে রাজস্থানের সঙ্গে। এ বছরে পাঁচটা ম্যাচ খেলেছি মাত্র, কিন্তু তাতেই ময়দানের আনাচে কানাচে, অনেক টেন্টে আমাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। সামনের বছর কোন ক্লাব আমাকে তুলে নেবে, কত দুর হবে, এ সব কথাও নাকি বলাবলি হচ্ছে। লিগের টপ স্কোরার এখন আমি—পাঁচটি ম্যাচে এগারোটা গোল। অসীম মৌলিক দশটা ম্যাচে দশ গোল, অশোক চ্যাটার্জি এগারোটা ম্যাচে আট গোল।

.

১৮.

নীলিমা স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে সেকেন্ড ডিভিশনে। বাড়িতে হইহই পড়ে গেছে সকালেই। তখনও আমি বিছানা ছেড়ে উঠিনি। বাড়িওয়ালা বিশু দত্ত চেঁচাচ্ছে : নুটুবাবু, খাওয়াতে হবে।

নিশ্চয় নিশ্চয়, কী খাবেন বলুন!

রাবড়ি। বড়বাজারের রাবড়ি।

ঘরের বাইরে এলাম। দেখি, নীলিমা প্রণাম করছে মাকে। তার পর আমাদের ঘরে ঢুকল। বাবা আছেন ঘরে। মা ফিসফিস করে আমাকে বললেন, তোর কাছে টাকা আছে? একটা শাড়ি দিতুম! আহা, কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে।

বাবার কাছে নেই?

এই মাসটা চালাবার মতন আছে।

আমার কাছে টাকা বারো আছে। তাই দিয়ে কি শাড়ি হবে?

মা ভেবে বললেন, থাক তা হলে, পরে দেবখন।

জ্যেঠিমা, প্রসূন আমার থেকে কত বড়? নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ছ মাসের বেশি কি?

মা হেসে বললেন, ওই রকমই হবে।

এর পরই একটা ভয়ংকর অপ্রতিভতার মধ্যে নীলিমা আমাকে ফেলে দিল। গোল থেকে এক গজ দূরে বল পেয়ে গোলের বাইরে মারলে মাঠভর্তি লোকের সামনে যা হয়, সেই রকম বোঁ বোঁ করে উঠল মাথাটা। নীলিমা প্রণাম করেছে আমায়। পাশ করলে দেখছি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়! আমি আমতা আমতা করে কী সব বলতে বলতে ঘরে পালিয়ে এলাম। শুনলাম নীলিমা বলছে, প্রসূন যত মন দিয়ে প্র্যাকটিস করে, আমি যদি সেভাবে পড়তাম, তা হলে স্কলারশিপ পেতাম।

উঁকি মেরে দেখলাম, নীলিমা বালতি হাতে কলঘরে যাচ্ছে। ওকে ডাকলাম।

এবার তো কলেজ?

হ্যাঁ। টাকা জোগাড় করতে হবে, প্রায় একশো।

মনে মনে সিঁটিয়ে গেলাম। যদি এখন এত দিনের ধারের টাকা চেয়ে বসে! তাড়াতাড়ি বললাম, তোমাকে কিছু একটা উপহার দিতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু হাতে এমন টাকা নেই যে কিনতে পারি।

নীলিমা কিছু বলতে যাচ্ছে, এমন সময় পিন্টু ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকল।

দাদা, একটা লোক তোমায় ডাকছে। বলল, খুব দরকার।

গলিতে বেরিয়ে দেখি, রঙিন বুশ শার্ট গায়ে, ফরসা, কটা চোখ, বছর চল্লিশের একটি লোক দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই খুব পরিচিতের ভঙ্গিতে বলল, প্রসূন, একটা কথা ছিল, চলো একটু বাইরে গিয়ে বলব।

রাস্তায় এসে বললাম, যা বলবার এখানেই বলুন, আমি আর যাব না, কাজ আছে।

একটা ফিয়াট গাড়ি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে লোকটা বলল, চলো না একটু ঘুরে আসি, মোটরে বসেই বলব। কথাটা খুবই প্রাইভেটলি বলতে চাই।

লোকটার চালচলন আমার বিশ্রি লাগছে, তার উপর প্রাইভেটলি কথা বলার প্রস্তাবটা ভাল লাগল না। বললাম, আপনার প্রাইভেট কথা এখানে দাঁড়িয়েও বলতে পারেন, কেউ শুনতে পাবে না।

লোকটা এধার-ওধার তাকিয়ে, গলা খাঁকারি দিয়ে ফিসফিস করে বলল, কালকের ম্যাচটা তুমি খেলো না।

যাত্রীর সঙ্গে খেলব না? আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। বলছেন কী আপনি!

তুমি কত টাকা আর পাও সোনালি থেকে, মাসে মাসে একশো…খবর রাখি, ক্লাবেরই খবর রাখি। লোকটা হঠাৎ পকেট থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে আমার হাতটা টেনে মুঠোয় গুঁজে দিল। খেলতে চাও যদি, নিশ্চয়ই খেলবে। কুড়ি-পঁচিশ বছর কলকাতায় কোনও বড় ট্রফি আমরা পাইনি, এবার ভাল চান্স এসেছে লিগ পাবার, কাল তুমি ব্যাগড়া দিয়ো না ভাই।

আমি তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠিনি। বললাম, আমি ব্যাগড়া দেব?

ভয় তোমাকেই প্রসূন। কলকাতার সব ক্লাব এখন তোমাকে ভয় করে; মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডান সবাই। কাল তুমি গোল দিয়ো না।

এতক্ষণে আমি সংবিৎ ফিরে পেয়েছি। একশো টাকার নোটটা লোকটার বুকপকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললাম, এখন থাক। আপনি আমাদের বাড়িতে আসুন, আমার বাবার হাতে এটা দেবেন।

লোকটা ইতস্তত করে বলল, তোমার বাবা কী করেন?

বেকার। একটা ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। লক আউট হয়ে বন্ধ।

তা হলে তো তোমরা বেশ অসুবিধের মধ্যে রয়েছ। লোকটা বুকপকেটে হাত দিয়ে বেশ খুশি হয়েই বলল, তোমার উচিত সংসারকে হেল্প করা।

আমি কথা বললাম না। লোকটাকে নিয়ে সটান বাবার সামনে হাজির করলাম। নীলিমা তখন বাবার কাছে বসে কলেজে ভর্তি হওয়ার অসুবিধা নিয়ে কথা বলছে। আমি কোনও ভূমিকা না করে বললাম, বাবা, কাল যুগের যাত্রীর সঙ্গে আমাদের খেলা। কাল আমি যেন না খেলি বা খেললেও যেন গোল না দিই, এই কথা ইনি বলছেন আর একশো টাকা আমায় দিতে চাইছেন।

আচমকা এমন ভাবে বললাম যে, শুধু বাবা আর নীলিমাই নয়, কটা-চোখ লোকটাও আড়ষ্ট হয়ে গেল। অবশেষে বাবা মৃদু স্বরে বললেন, কোন ক্লাবের সঙ্গে খেলা?

যুগের যাত্রী। আমি বললাম। মনে হল বাবার চোখ ঝলসে উঠল। ওঁর কপালের উপর আমি অবধারিত চোখ রাখলাম।

বাবা মাথা নিচু করে বললেন, আমি জানি না। আমি কোনও কথা বলব না। তুমি নিজেই ঠিক করো ঘুষ তুমি নেবে কি না।

বাবা মাথা তুলে আমার মুখের দিকে তাকালেন। আমার বুক কাঁপতে শুরু করেছে। নীলিমা কী যেন বলবার চেষ্টা করছে আর আমি কী যেন একটা করতে চাইছি। আর মনের মধ্যে তখনই কার কণ্ঠস্বর শুনলাম, প্রসূন, দ্যাখো দ্যাখো, তোমার বাবার অপমানিত কপাল। ওখানে বিজয়তিলক এঁকে দেবে তুমি, হ্যাঁ তুমিই।

কাল যাত্রীকে আমি হারাবই, দাঁতে দাঁত চেপে বললাম। তার পর লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে বললাম, গেট আউট!

লোকটা অবাক হল মাত্র, কিন্তু ঘাবড়াল না। যাবার সময় মুচকি হেসে বলে গেল, তুমি গোল দিতে হয়তো পারো, কিন্তু গোল খাওয়া বন্ধ করতে পারবে না। ফুটবল এগারো জনের খেলা মনে রেখো।

আমার খুপরিতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে আমি বসে ছিলাম। ঘরে কে এসে দাঁড়াল। মুখ তুলে দেখি, নীলিমা একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে। সাগ্রহে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা কিছু বললেন কি তার পর?

না, শুধু অনেকক্ষণ পর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল মুছে নিতে দেখেছি।

আমি ঠিক করিনি নীলিমা?

নীলিমা ভারী স্নিগ্ধ নরম স্বরে বলল, তুমি আজ সব্বাইকে এত বড় উপহার দিলে প্রসূন। ওহ এত বিরাট! প্রসূন, কাল তুমি দারুণ খেলবে, ঠিক জিতবে।

.

১৯.

ফুটবল যে এগারো জনের খেলা, এই সত্য নির্মমভাবে উপলব্ধি করলাম পরদিন। আর একটি শিক্ষা পেলাম—জিতবই এমন কথা কদাচ বলবে না। যাত্রীর কাছে আমরা ২-৩ গোলে হেরে গেলাম। মাঠে যে এত ভিড় হবে কল্পনা করিনি। মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলের সাপোটারই বেশি। ওরা যাত্রীর হার চায়, তাই সোনালিকে মদত দিতে ওরা সবাই সোনালির সাপোর্টার হয়ে গেছে। ওরা আশা করেছিল, আমি একটা কিছু করব।

কিন্তু যাত্রী শোভাবাজার নয়। অত্যন্ত আঁটসাট আর চমৎকার গুছোনো। ডিফেনস। ওদের লেফট হাফ অমিয় আর রাইট স্টপার ব্যাক দুলাল গত বছর মারডেকা টুরনামেন্ট খেলে এসেছে। গোলকিপার শ্যাম যে দিন খেলে, সে দিন একটি মাছিও গোলে ঢুকতে পারে না। তবে সেই দিনটি যে কোন খেলায় আসবে, তা কেউ বলতে পারবে না, শ্যামও না।

রাইটইন বিষ্টু মিশ্র এ বছর জুনিয়ার ইন্ডিয়া ক্যাম্পে ডাক পেয়েছে, বলের উপর ভাল কনট্রোল আছে, তবে নিমাইয়ের মতো নয়। কিন্তু অনেক বেশি পরিশ্রমী আর যেমন ওঠে তেমনই নেমেও আসতে পারে। বুদ্ধিটা একটু কম। লেফট আউট আব্রাহামের মতো দ্রুত উইঙ্গার কলকাতায় দ্বিতীয় নেই। পেনালটি বক্সের কোণ থেকে ডান পায়ে এমন শট নেয়, যার শতকরা নব্বইটা গোলে ঢুকবেই। লেফট-ইন শিবরমন ছোটখাটো, অত্যন্ত চতুর, বক্সের মধ্যে চুকচুক করে বেড়ায়। কখন যে গোল ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, বোঝা কঠিন। বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু সেটা জানতে দেয় না।

আমরা মরিয়া হয়ে খেলব প্রতিজ্ঞা করে নেমেছিলাম। পনেরো মিনিট পর্যন্ত দু পক্ষই সতর্ক হয়ে শুধু মাঝ মাঠে খেলেছি। তার পরই বিষ্টু হঠাৎ বল নিয়ে এগোয় আমাদের গোলের দিকে। রাইট হাফ ওর পিছু নেয়। বিষ্টু বাঁ দিকের কনার ফ্ল্যাগের দিকে সরে গেল, আব্রাহাম ভিতরে ঢুকে এল। বিষ্টু ব্যাক পাস দিল অমিয়কে, সে দিল আব্রাহামকে। কুড়ি গজ থেকে গোলে দুর্বল নিচু শট করল আব্রাহাম। সোনালির গোলকিপার রবি ঝাঁপিয়ে ধরতে পারল না। আমার মনে হল, রবি যেন ইচ্ছে করেই দেরিতে ঝাঁপিয়েছে। হঠাৎ সেই কটা চোখের কথাটা মনে চমকে উঠল, গোল দিতে হয়তো পারো, কিন্তু গোল খাওয়া বন্ধ করতে পারবে না।

আমি শিউরে উঠলাম। তা হলে একশো টাকার নোটের কাছে নিজেকে বিক্রি করার লোক সোনালিতে ওরা পেয়েছে। কিন্তু কজনকে কিনেছে জানি না। প্রত্যেকের উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে এখন। রাইট আউট একটা সহজ বল ট্র্যাপ করতে গিয়ে বাইরে পাঠাল, অমনি সন্দেহ হল। পারলে নিশ্চয় আমাকেই দিতে হত, কেননা চমৎকার জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে। আব্রাহাম রাইট ব্যাককে কাটাতে গিয়ে পারল না। রাইট ব্যাক বলটা পায়ে রেখে লোক খুঁজতে তাকাচ্ছে, আব্রাহাম বল ছিনিয়ে নিল আর আমার সন্দেহ হল। সোনালির গলদ দেখছি আর সন্দেহ হচ্ছে।

হাফ টাইমের দু মিনিট আগে যাত্রী দ্বিতীয় গোল দিল। ডান দিক থেকে চমৎকার মুভ করে বাঁ দিক থেকে শেষ করল আব্রাহাম। পোস্ট আর ক্রসবারের কোণ দিয়ে বিদ্যুৎবেগে বলটা ঢুকল। রবির কিছুই করার ছিল না। হাফ টাইমে দাসুদাকে বললাম আমার সন্দেহের কথা, আর গতকাল যা ঘটেছে। দাসুদা রবির কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। দূর থেকে দেখলাম রবি খুব অবাক হয়ে গেল, হাত নেড়ে তর্ক শুরু করতেই দাসুদা ইশারায় রিজার্ভ গোলকিপার অজিতকে ওয়ারম-আপ করতে বললেন। রবির মুখ ফ্যাকাশে হতে দেখলাম।

খেলা আবার শুরু হতেই আধ মিনিটের মধ্যে আমি গোল দিলাম। সেন্টার লাইন থেকে বল নিয়ে তিনজনকে কাটিয়ে যোলো গজ থেকে শট নিলাম। শ্যাম ঠাওর করতে পারেনি, অন্তত তিন গজ বাইরে দিয়ে যাওয়ার কথা যে বলের, সেটা বেঁকে এসে ঢুকতে পারে। বিরাট গর্জন উঠল ইস্টবেঙ্গল মাঠ কাঁপিয়ে। আমি এই প্রথম গোল দেওয়ার পর এত বড় আওয়াজ পেলাম। তিন মিনিট পর রাইট আউট তরতরিয়ে উঠে ক্রস করল। শ্যাম গোল ছেড়ে বেরোতে সেকেন্ড তিনেক মাত্র দেরি করে, বল মাটিতে পড়া মাত্র হাফ ভলিতে নেটে পাঠিয়ে দিলাম।

গ্যালারিতে যেন বাজ ডেকে উঠল আর মাঠ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। চার-পাঁচ জন। আমাকে জাপটে ঘাড়ে পিঠে ওঠার চেষ্টা করছে। দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার মতো অবস্থা। এর পর গ্যালারি থেকে শুধু প্রসূনকে বল দে, প্রসূনকে, প্রসূনকে রব উঠতে লাগল।

যাত্রী দ্বিগুণ উদ্যমে আক্রমণ শুরু করেছে। একে একে আমরা পিছিয়ে নেমে ঠেকাবার চেষ্টা করছি। চাপ ক্রমশই বাড়ছে। নতুন অনভিজ্ঞ অজিত পাগলের মতো খেলছে। লক্ষ করলাম, আমার কাছে যাত্রীর দুজন দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। পঁয়ষট্টি মিনিট পর্যন্ত যাত্রীকে রুখে আর পারা গেল না। অমিয়র চিপ থেকে বিষ্টু হেড করল, বারে লেগে বল ফিরে আসছে, রাইট স্টপার বলটা উড়িয়ে দিতে গিয়ে মিস-কিক্ করে বিষ্টুর পায়েই দিল। সেখান থেকে বিষ্টু সহজেই গোল দিল।

হেরে গেলাম। মাঠ থেকে বেরোচ্ছি আর শুনছি ওয়েল প্লেড প্রসূন…সাবাস প্রসূন! কিন্তু আমি মনে মনে কুঁকড়ে আছি। যাত্রীকে হারাব বলে বাবার সামনে জাঁক করেছি। হারাতে পারলাম না। হঠাৎ পিঠে একটা মৃদু চাপড়ানি আর চাপা স্বরে তুমি সত্যিই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে শুনে পিছনে তাকিয়ে সেই কটা-চোখকে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যেতে দেখলাম।

টেন্টে ফিরে রবিকে কয়েকটা কথা বলার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু বলতে পারলাম না। উন্মনা হয়ে ও এক কোণে বসে রইল, কারও সঙ্গে কথা বলল না। তার পর নিঃশব্দে এক সময় টেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। পিন্টু আমার সঙ্গে রয়েছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি রওনা হলাম। বাসে পিন্টু বলল, নিমাইদা আমার সামনে বসেছিল। তোমাকে একটা ছেলে গালাগাল দিতেই নিমাইদা তাকে এক চড় কষিয়ে দিয়েছে।

আনোয়ার ছিল?

হ্যাঁ। নিমাইদাকে বার বার বলছিল তুই থাকলে প্রসূন আরও দু-তিনটে গোল পেত।

কী বলল নিমাই?

কিছু বলেনি।

বাড়ি ফিরে অন্ধকার ঘরে শুয়ে রইলাম। খেলার রেজাল্ট পিন্টুই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। মা একবার ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে গেলেন। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম না খেযেই।

.

২০.

যাত্রী লিগ চ্যাম্পিয়ান হল না। শিল্ডও শেষ হল না কোর্টের ইনজাংশনে। এর থেকেও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটল পরের বছরের শুরুতেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, যুগের যাত্রী, তিনটি ক্লাবই আমাকে চেয়েছে। আমার ইচ্ছে মোহনবাগানে যাওয়ার। কিন্তু শুনলাম, হাবিব আর সুকল্যাণকে ওরা নিচ্ছে, সুভাষকে ইস্টবেঙ্গল। আমি দোটানায় পড়েছি—যাব কি যাব না, গেলে খেলার সুযোগ পাব কি পাব না, এমন সময় যাত্রী আমায় ছ হাজার টাকা দর দিল।

যাত্রীর সম্পাদক অনাদি বিশ্বাসের বাড়িতে কথা হচ্ছিল। আর ছিল সেই কটা চোখ। পরে ওর নামটা জেনেছি, ডাকুদা। যাত্রীর টিম সিলেকশন কমিটির মেম্বার। বছরে হাজার দশেক টাকা খরচ করে। ক্লাবের মধ্যে প্রতিপত্তিতে সম্পাদকেরও উপরে। ডাকুদাই নাকি বিশেষ করে আমাকে চেয়েছে।

তুমি অনিল ভটচাজের ছেলে। তোমার উপর তো যাত্রীর বিশেষ দাবি আছে। সম্পাদক এই বলে তাকাল ডাকুদার দিকে। ডাকুদা শুধু মাথা নাড়ল। বাপ-ছেলে একই ক্লাবে খেলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। তা ছাড়া সম্পাদক থেমে গেল। ডাকুদার দিকে একবার তাকিয়ে কেশে বলল, তোমার বাবার উপর সুবিচার করেনি যাত্রী। আমি জানি। কিন্তু তখন আমি তো ক্লাবের একটা অরডিনারি মেম্বার। সেই ফাইনাল খেলা আমি দেখেছি। আহ, কী খেলা তোমার বাবার, এখনও চোখে ভাসছে। অথচ ওর নামেই কিনা কলঙ্ক রটানো হল। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। আমাকেই করতে হবে। সম্পাদকের যেন। আবেগে কণ্ঠরোধ হল। আমার মন দুলে উঠছে বাবার প্রশংসা শুনে। যাক, তা হলে সবাই বিশ্বাস করে না।

এবার আমরা ইয়ং টিম করব। বয়স হয়ে গেছে বেশির ভাগেরই। তোমাদের দিয়েই রিপ্লেস করাব। বাইরে থেকে আর প্লেয়ার আনব না। কেড়ে নাও, এই সব বুড়োদের হটিয়ে জায়গা কেড়ে নাও। ইন্ডিয়া টিমে যাত্রীর কোটা আছে, আমি তোমায় পুশ করব। স্কুল ফাইনালটা পাশ করো, আমি তোমায় ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকিয়ে দেব। যাত্রীর মেস আছে, সেখানে থাকবে। ভাল খাবে, ভাল করে খেলবে…এত অল্প বয়স, কত সম্ভাবনা তোমার সামনে। সম্পাদক আন্তরিক স্বরে যেভাবে বলল, তাতে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।

ছ হাজার টাকা এখন তোমায় কেউ দেবে না, কিন্তু আমরা দেব। ডাকুদা হাতের নখ পরীক্ষা করতে করতে বলল, এটা কিন্তু ঘুষ নয়।

আমি এবার একটু লজ্জা পেলাম। বললাম, আমি সত্তাবে টাকা রোজগার করতে চাই।

নিশ্চয় নিশ্চয়, তাই তো উচিত। সম্পাদক টেবিল চাপড়ে বলে উঠল। ডাকুদা ঘড়ি দেখে বলল, আচ্ছা প্রসূন, তা হলে এই কথাই রইল। তুমি ভেবে দেখো। এখনও মাসখানেক সময় তো আছে।

ওখান থেকে আমি সোজা দাসুদার বাড়ি গেলাম। সব কথা শুনে দাসুদা বললেন, তুই যাত্রীতেই যা। সোনালিতে থাক, এমন কথা আমি বলব না। নিজের ভবিষ্যৎ তোকে দেখতে হবে তো। ফুটবলই তোর সব কিছু। তুই এবার বড় ক্লাবে যা। তবে সাবধানে থাকিস। ওখানে টাকাপয়সা যেমন বেশি, দলাদলিটাও বেশি। ডাকু লোকটা সুবিধের নয়। অনেক ছেলের ক্ষতি করেছে, কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছে।

আমার কী ক্ষতি করবে? আমি যদি খেলতে পারি, তা হলে আমায় আটকাবে কে? খেলা দেখিয়েই এতটা এসেছি, আরও যাব। আস্থাভরেই কথাগুলো বললাম। দাসুদা হেসে বললেন, তাই যেন পারিস।

আমি যাত্রীতেই সই করলাম। ডাকুদা সেই দিনই দু হাজার টাকা দিল। বাকিটা সারা বছরে চার কিস্তিতে দেবে। আমি সই করার দু দিন পরেই কাগজে দেখি, আনোয়ার আর নিমাই যাত্রীতে সই করেছে। মনে মনে আমি ভীষণ খুশি হলাম।

দাসুদাকে বলেছিলাম, যদি খেলতে পারি, তা হলে আমায় আটকাবে কে? কিন্তু খেলার সুযোগই যদি না পাই, তা হলে পারি কি পারি না, প্রমাণ করব কেমন করে! যাত্রীর প্রথম পাঁচটা ম্যাচ ড্রেস করে সাইড লাইনের ধারে বেনচে বসে থাকলাম। আমাকে খেলানো হচ্ছে না, আমি নাকি খুবই কাঁচা, অনভিজ্ঞ। বালী প্রতিভা কি কালীঘাটের সঙ্গে খেলার মতন যোগ্যতাও নাকি আমার নেই। এই সব টিমের সঙ্গে খেলাতেও যাত্রীর কমিটি মেম্বারদের মুখ শুকিয়ে আসে, নতুন ছেলেদের নামাতে ভয় পায়। যদি পয়েন্ট যায়, তা হলে দোষ পড়বে কমিটির ঘাড়ে। তার থেকে নামী বুড়ো প্লেয়াররা নিরাপদ, কিছু ঘটলে দায়িত্বটা ওদের।

আনোয়ারকে প্রথম দুটো ম্যাচ খেলানো হয়নি। বালীর সঙ্গে ভাল খেলল, তার পর আর বসেনি। নিমাইও ওই ম্যাচে আধখানা খেলেছে। পরের ম্যাচ। খিদিরপুরের সঙ্গেও আধখানা। কালীঘাটের সঙ্গে খেলার দশ মিনিটেই শিবরমনের চোট লাগা হাঁটুতে আবার লাগতে নিমাই নামে। দুটো গোলও দেয়। নিমাইকে এখন আর বসানো যাবে না।

যাত্রীর কোচ প্রিয়দাকে একদিন অধৈর্য হয়ে বললাম, আমাকে কি বসিয়ে রাখার জন্য এনেছেন?

কী করব ভাই, নির্বিরোধী প্রিয়দা এধার ওধার তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন, টিম করে সিলেকশন কমিটি, আর কমিটি মানে ডাকুদা। আমাদের কোনও কথাই কানে নেয় না। তুমি বরং ওকেই জিগ্যেস করো।

ডাকুদাকে সেই দিনই ধরলাম। ওর কয়েকজন পেটোয়া প্লেয়ার আছে, তার মধ্যে দুজন বিষ্টু আর আব্রাহাম তখন ডাকুদার সঙ্গে ক্লাব টেন্টের বাইরে বাগানে চেয়ারে বসে গল্প করছিল। আমি সটান জিজ্ঞাসা করলাম, ডাকুদা, আমাকে নিয়ে এলেন, কিন্তু খেলাচ্ছেন না কেন?

দরকার হলেই খেলাব। ডাকুদা হাতের নখের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন।

কবে দরকার হবে?

বলতে পারছি না এখন। হয়তো এই সিজনে দরকার নাও হতে পারে।

তা হলে এত টাকা খরচ করছেন কেন আমার জন্য? বসে থেকে যে আমার খেলা নষ্ট হয়ে যাবে। কাতর স্বরে আমি বললাম।

যাত্রীর মতন ক্লাব তোমার মতন দু-চারটে প্লেয়ারকে বসিয়ে টাকা দিলে দেউলে হয়ে যাবে না। টাকার জন্যই তো খেলা, তা যখন পাচ্ছ তখন এত উতলা হওয়া কেন? ডাকুদা তার কটা চোখ দুটো বিরক্তিতে সরিয়ে নিলেন আমার মুখের উপর থেকে।

বিষ্টু ব্যস্ত হয়ে বলল, এখন যা তো, আমরা দরকারি কথা বলছি, পরে যা বলার বলিস।

মুখ কালো করে আমি চলে এলাম। নিমাই হেসে হেসে দুটো ছেলের সঙ্গে টেন্টের মধ্যে কথা বলছে। দেখেই বোঝা যায় পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। প্রায়ই ওদের দেখি, নিমাইকে নিয়ে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে যেতে। নিমাই আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে আবার গল্প করতে লাগল। আনোয়ার আজ আসেনি। আমি ক্লাব থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ালাম।

একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, দু হাজার টাকা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছোনো মাত্র কেমন উৎসবের মতন হইচই শুরু হয়ে গেছিল। বিশু দত্তও নেমে এল উপর থেকে। পিন্টু, পুতুল, নীলিমা ভিড় করে দাঁড়াল। বাবা বাড়ি ছিলেন না।

আরে বাব্বাঃ, ফুটবল খেলে অ্যাতো টাকা পাওয়া যায়, তা হলে তো ছোটবেলায় বল পেটালেই লাভ হত দেখছি! বিশু দত্ত বলল।

সবার কি আর সব জিনিস হয় দত্ত মশাই, এ সব হল গিয়ে ভগবানদত্ত ব্যাপার। প্রসূনকে তো একটা রিসেপশন দেবার ব্যবস্থা করা উচিত। নুটুদা চট করে গম্ভীর হয়ে গেলেন।

তার আগে একটু খাওয়াদাওয়া হোক। কী প্রসূন, পরোটা আর মাংস হবে নাকি?

মা তখুনি টাকা দিলেন। বিশু দত্তই বাজারে গেল। সারা বাড়ির নেমন্তন্ন। নীলিমাকে বললাম, এবার আমার সব ধার শোধ করব। এখন আমিও কলেজে ভর্তি হয়েছি ফুটবলের কলেজে।

বাবা অনেক রাত্রে ফেরেন। আমি জেগে শুয়ে ছিলাম। মা নিশ্চয়ই বাবাকে বলবেন। উত্তরে বাবা কী বলবেন? দারুণ খুশি হবেন, না যথারীতি মুখ ফিরিয়ে চুপ করে থাকবেন! এক সময় বাবা ফিরলেন। ও ঘরে মার কথা বলার শব্দ পেলাম। তার পর আলো নিভে গেল। সকালে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম—বাবাকে বলেছ? মা বললেন, উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, আমি সাত বছর খেলেও এত টাকা পাইনি।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress