শোভাবাজার টেন্টে
০৬.
বিকেলে কমল শোভাবাজার টেন্টে এল। পল্টু মুখার্জি মারা যাবার খবর সবাই জেনে গেছে। কমলকে অনেকের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব দিতে হল। শোভাবাজারের কোচ সরোজ বলল, কমলদা, কাল রাজস্থানের সঙ্গে খেলা! একবার তো বসতে হয় টিমটা করার জন্য।
বসার আর কী আছে! আগের ম্যাচে যারা খেলেছে, তাদেরই খেলাও। শুরুতেই বেশি নাড়াচাড়া করার দরকার কী?
সলিল বলছে, খেলবে। কিন্তু আমি মনে করি না ও ফিট। সকালে প্র্যাকটিসে দেখলাম, দুটো ফিফটি মিটার প্রিন্ট করার পর লিম্প করছে। লাফ দেওয়ালাম, পারছে না।
অন্তত দু সপ্তাহ রেস্ট দাও।
কিন্তু রাইট স্টপারে খেলবে কে? প্লেয়ার কোথায়? সত্য বা শম্ভু জানেনই তো কেমন খেলে। স্বপনকে হাফ থেকে নামিয়ে আনতে পারি, কিন্তু ফরোয়ার্ড লাইনকে ফিড করাবে কে? রুদ্রকে দিয়ে আর যাই হোক, বল ডিট্রিবিউশনের কাজ চলে না।
তা হলে? কমল চিন্তিত হয়ে সরোজের মুখের দিকে তাকাল এবং ম্লান হেসে বলল, অগত্যা আমি?
সরোজ মাথা হেলাল।
কিন্তু এ সিজনে দু-তিনদিন মাত্র বলে পা দিয়েছি। ভাল মতো ট্রেনিং করিনি।
তাতে কিছু এসে যায় না। সরোজ উৎসাহভরে বলল। এক্সপিরিয়েন্সের কাছে বাধা ভেসে যাবে। আমার ডিফেন্সে সব থেকে বড় অভাব অভিজ্ঞতার। মোহনবাগানের দিন দেখেছেন তো, চারটে ব্যাক এক লাইনে দাঁড়িয়ে, এক-একটা থু পাশে চারজনই কেটে যাচ্ছে। ওরা প্রচণ্ড পেসে খেলা শুরু করল আর এরাও তার সঙ্গে তাল দিয়ে মাঠময় ছোটাছুটি করে আধ ঘণ্টাতেই বে-দম হয়ে গেল। গেমটাকে যে স্লো ডাউন করবে, বল হোল্ড করে করে খেলবে—কেউ তা জানে না।
জানবে, খেলতে খেলতেই জানবে! আচ্ছা, আমি কাল খেলব। কাল সকালে ছেলেদের আসতে বলে দিয়ে মাঠে। একটু প্র্যাকটিস করাব।
খেলার দিনে?
সামান্য। দু-চারটে মুভ প্র্যাকটিস করাব। ভয় নেই, তোমার প্লেয়ারদের এক ঘণ্টার বেশি মাঠে রাখব না।
সরোজের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। কমল বুঝল, ব্যাপারটা ও পছন্দ করছে না। কোচের আত্মমর্যাদায় লেগেছে। কমল সুর বদল করে মৃদু স্বরে এবং বন্ধুর মতো বলল, আমাদের মতো ছোট ক্লাব, সঙ্গতি কিছুই নেই। প্লেয়াররা অত্যন্ত কাঁচা, অমার্জিত, সিজনের শেষ দিকে ম্যাচ গট-আপ করে ফাস্ট ডিভিশনে টিকে থাকতে হয়—এদের নিয়ে আর্টিস্টিক ফুটবল খেলতে গেলে পরিণাম কী হবে তা কি ভেবেছ? এই বছর প্রথম গড়ের মাঠে কোচিং করছ, তুমি কি চাও এটাই তোমার শেষ বছৱ হোক?
সরোজের মুখ ক্ষণিকের জন্য পাণ্ডুর হয়েই কঠিন হয়ে উঠল। আমি ফুটবল খেলাতে চাই, কমলদা। ফুটবল খেলে শোভাবাজার নেমে যাক আমার দুঃখ নেই, আমিও যদি সেই সঙ্গে ডুবে যাই, আফসোস করব না। কিন্তু শুরুতেই আত্মসমর্পণ করব না।
তোমার এই মনোভাব শোভাবাজারের অফিসিয়ালরা জানে? কেষ্টদা জানে?
জানলে এই মুহূর্তে ক্লাবে ঢোকা বন্ধ করে দেবে। সরোজ হাসিটা লুকোল না।
সরোজ, তোমায় বলাই বাহুল্য, তবু দু-চারটে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তোমার থেকে বোধ হয় আমি বেশি খেলেছি, বড় বড় ম্যাচের অভিজ্ঞতাও বেশি। সেই সূত্রে, বরং বলা ভাল, আলোচনা করতে চাই।
কমলদা, এ সব বলছেন কেন, আপনার সঙ্গে আমার তুলনাই হয় না। আপনার। কাছে আমার অনেক কিছু শেখার আছে। সরোজ বিনীতভাবে বলল।
তুমি যেভাবে খেলাতে চাও, সেইভাবে খেলার মতো প্লেয়ার আমাদের আছে। কি?
নেই। সরোজ চটপট জবাব দিল।
তা হলে আমরা একটার পর একটা ম্যাচ হারব। শেষে পয়েন্ট ম্যানেজ করার ননাংরা ব্যাপারে ক্লাব জড়াবেই, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। লাভ নেই সরোজ আর্টিস্টিক ফুটবলে। যতদিন না উপযুক্ত ছেলেদের পাচ্ছ ততদিন তোমার চিন্তা শিকেয় তুলে রাখো। আগে ক্লাবকে বাঁচাও, তারপর খেলা। আগে ছেলে জোগাড় করো, তাদের তৈরি করো। আগে ডিফেন্ড করো, তারপর কাউন্টার অ্যাটাক। সর্বক্ষেত্রে এটাই সেরা পদ্ধতি, জীবনের ক্ষেত্রেও।
তার মানে যেমন চলছে চলুক!
হ্যাঁ, তবু এর মধ্যেই ডিফেন্সটাকে আরও শক্ত করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তোমার যা কিছু ট্যাকটিক্স, সত্তর মিনিটের পুরো খেলাটায়, সব কিছুর মূলেই জমি দখলের, স্পেস কভার করার চেষ্টা। ফাঁকা জমিতে বল পেলে বল কন্ট্রোল করার সময় পাওয়া যায়। স্পেসই হচ্ছে সময়। অপোনেন্টকে জমির সুবিধা না দেওয়া মানে সময় না দেওয়া। তাই এখন ম্যান টু ম্যান টাইট মার্কিং খেলা হয়। আমি তিন ব্যাকে খেলেছি, অনেক গলদ তখন ডিফেন্সে ছিল। চার ব্যাকে সেটা বন্ধ হয়েছে। আগে উইঙ্গাররা পঁচিশ গজ পর্যন্ত ছাড়া জমি পেত, চার ব্যাকে সেটা পাঁচ গজ পর্যন্ত কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু চার ব্যাকেও লক্ষ করেছ, শোভাবাজার সামলাতে পারে না।
আপনি কি পাঁচ ব্যাকে খেলাতে চান।
প্রায় তাই। চার ব্যাকের পিছনে একজন ফ্রি ব্যাক রেখে খেলে দেখলে কেমন হয়। ফরোয়ার্ড থেকে একজনকে হাফে আনা যায়, দুজনকেও আনা যায়। ফরমেশানটা ১৪—৩২ হবে।
আপনি কাতানাচ্চিও ডিফেন্স চাইছেন অর্থাৎ ফুটবলকে খুন করতে চাইছেন?
সরোজ হঠাৎ গোঁয়ারের মতো রেগে উঠল। কমল এই রকম একটা কিছু হবে আশা করেছিল। সে বলল, মোহনবাগানের কাছে আমরা পাঁচ গোল খেয়ে দুটো পয়েন্ট হারাতুম না এই ফরমেশনে খেললে। একটা পয়েন্ট পেতুমই। সেটা কি মন্দ ব্যাপার হত? তুমি মিড ফিল্ড খেলার ওপর বড় বেশি জোর দাও, কিন্তু এখন ওটার আর কোনও গুরুত্বই নেই। এখন লড়াই পেনাল্টি এরিয়ার মাথায়—অ্যাটাকিং অ্যাঙ্গেলকে সরু করে গোলে শট নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে। তুমি এটা বুঝছ না কেন, গোল করাই হচ্ছে খেলার একমাত্র উদ্দেশ্য, খেলা জেতা যায় গোল করেই। শোভাবাজারের ক্ষমতা নেই গোল দেওয়ার কিন্তু গোল খাওয়া তো বন্ধ করতে পারে।
কমলদা, আপনার আর আমার চিন্তাধারা এক খাতে বোধ হয় বইছে না। শোভাবাজার টিম যতদিন আমার হাতে থাকবে, আমি আমার চিন্তা অনুসারেই খেলাতে চাই।
সরোজ কঠিন এবং দৃঢ়স্বরে যেভাবে কথাগুলি বলল তাতে বুঝতে অসুবিধা হয় না, আর তর্ক করতে সে রাজি নয়। কমল মুখটা ঘুরিয়ে আলতো স্বরে বলল, বেশ।
কাল তা হলে খেলছেন?
কমল মাথা হেলিয়ে হাসল।
.
০৭.
দুদিন কামাই করে কমল অফিসে এল। রণেন দাসকে চেয়ারে দেখতে পেল না। খাটো চেহারার ঘোষদা অর্থাৎ বিপুল ঘোষকে অবশ্য প্রতিদিনের মতো কাঁটায় কাঁটায় দশটায় চেয়ারে বসে কাগজে লাল কালিতে শ্রীশ্রীদুর্গা সহায় লিখতে দেখা যাচ্ছে। প্রায় সাড়ে চারশো লোকের বিরাট পাঁচতলা অফিস বাড়িটা হট্টগোলে মুখর। সাড়ে দশটার আগে কেউ কলম ধরে না। কমলদের ডেসপ্যাচ বিভাগে তারা মাত্র তিনজন।
বিপুল তার নিত্যকর্ম সেরে কমলকে বলল, দুদিন আসেননি, অসুখবিসুখ করেছিল?
এক আত্মীয় মারা গেলেন তাতেই ব্যস্ত ছিলাম। ঘোষদা, আপনার কাছে লিভ অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম আছে?
বিপুল ড্রয়ার থেকে ছুটির দরখাস্তের ফর্ম বার করে দিল। কমল তাতে যা লেখার লিখে সেটা নিয়ে নিজেই গেল চারতলায় লিভ সেকশনে জমা দিতে। সেখানে অনুপম ঘোষালকে ঘিরে অল্পবয়সীরা জটলা করছে। অনুপম যুগের যাত্রীর উঠতি রাইট উইঙ্গার। রথীনই চাকরি করে দিয়েছে। কাল অনুপম হ্যাটট্রিক করেছে কুমারটুলির বিরুদ্ধে।
আর একটা গোল কি অনুপমের হত না! সেকেন্ড হাফের শুরুতেই প্রসূন তিনজনকে কাটিয়ে যখন সেলফিসের মতো একাই গোলটা করতে গেল, তখন। অনুপম তো ফাঁকায় গোল থেকে পাঁচ হাত দূরে। প্রসূন ওকে বলটা যদি দিত, তা হলে কি অনুপমের আর একটা গোল হত না? কী অনুপম, হত কি না?
মৃদু হেসে অনুপম বলল, ফুটবল খেলায় কিছুই বলা যায় না।
প্রসূনকে তুই দোষ দিচ্ছিস কেন? অনুপমকে বল দেবে কি, ও তো তখন ক্লিয়ার অফ সাইডে!
বাজে কথা। অনুপম, তুই তখন অফ সাইডে ছিলিস কি?
অনুপম গম্ভীর হয়ে মুখটা পাশে ফিরিয়ে বলল, লেফট ব্যাক আর আমি এক লাইনেই ছিলুম।
তবে, তবে! আমি কতদিন বলেছি প্রসূনটা নাম্বার ওয়ান সেলফিস। বল পেলে আর ছাড়ে না, একাই গোল দেবে। ওর জন্য যাত্রীর অনেক গোল কমেছে। বালী প্রতিভার দিন পাঁচটা গোল হল বটে, কিন্তু প্রসূন ঠিক ঠিক যদি বল দিত অনুপমকে, অন্তত আরও পাঁচটা গোল হত। অনুপম হার্ডলি চারটে বলও প্রসূনের কাছ থেকে পেয়েছে কি না সন্দেহ। কী অনুপম, ঠিক বলেছি কি না?
অনুপম উদাসীনের মতো হেসে বলল, যাকগে ওসব কথা।
হ্যাঁ হ্যাঁ, বাদ দে তো ফালতু কথা। প্রসূন বল দিল কি না দিল তাতে অনুপমের কিছু আসে যায় না। এর পরের ম্যাচ ইস্টার্ন রেল। অনুপম, আগেই কিন্তু বলে রাখছি, আমার ভাগ্নেটা ধরেছে খেলা দেখার জন্য।
সত্যদা, আজকাল ঢোকানো বড় শক্ত হয়ে পড়েছে। ডে-স্লিপ দেওয়ার ব্যাপারেও গোনাগুনতি।
ওসব কোনও কথা শুনব না। তোমায় ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।
অনুপম সেকশনাল ইন-চার্জ নির্মল দত্তর টেবিলের দিকে এগোবার উদ্যোগ করে বলল, আচ্ছা দেখি।
দত্তর কাছে বসে কিছুক্ষণ গল্প করে অনুপম রোজই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে।
অনুপম, ইস্টবেঙ্গলের দিন কিন্তু এই রকম খেলা চাই।
অনুপম এগিয়ে যেতে যেতে হাসল মাত্র।
এবার ওদের চোখ পড়ল কমলের ওপর। দরখাস্তটা হাতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করছে।
কী ব্যাপার কমলবাবু, ক্যাজুয়াল? এই টেবিলে রেখে যান।
কমল রেখে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, একজন ডেকে বলল, আচ্ছা, আপনার কী মনে হয় অনুপমের খেলা সম্পর্কে? দারুণ খেলে, তাই নয়?
হ্যাঁ, দারুণ খেলে।
আপনি ওর এ বছরের সব কটা খেলাই দেখেছেন?
একটাও না।
তা হলে যে বললেন দারুণ খেলে!
আপনারা বলছেন তাই আমিও বললাম।
না না, ঠাট্টা নয়, সত্যি বলুন, ছেলেটার মধ্যে পার্টস আছে কি না। আপনার চোখ আর আমাদের চোখ তো এক নয়।
কমল কয়েক মুহুর্ত ভাবল। তারপর কঠিন স্বরে বলল, শুধু খেলা দেখেই প্লেয়ার বিচার করবেন না। খেলা সম্পর্কে তার অ্যাটিচিউড, চিন্তা, সাধনা কেমন সেটাও দেখবেন। হয়তো ভাল খেলে। কিন্তু গোল থেকে পাঁচ হাত দূরে ফাঁকায় যে দাঁড়িয়ে, সে যদি বলে যে, গোল করতে পারতুম কি না কিছুই বলা যায় না, তা হলে আমি তাকে প্লেয়ার বলে মনে করব না।
পৃথিবীর বহু বড় প্লেয়ার এক হাত দূর থেকেও তো গোল মিস করেছে।
করেছে কি না জানি না, কিন্তু তারা কখনওই বলবে না—পাঁচ হাত দূরের থেকে গোল করতে পারব কি না! এই কি না অর্থাৎ অনিশ্চয়তা, নিজের উপর অনাস্থা, কখনওই তাদের মুখ থেকে বেরোবে না। দুইকে দুই দিয়ে গুণ দিতে বললে, আপনার কি সন্দেহ থাকতে পারে, উত্তরটা চারের বদলে আর কিছু হবে?
ঝোঁকের মাথায় কথাগুলো বলে কমল লক্ষ করল, শ্রোতাদের মুখে অসুখী ছায়া পড়েছে।
আপনার কথাগুলো একদিক দিয়ে ঠিক, তবে কী জানেন, যোগ-বিয়োগটা শিশুকাল থেকে করে করে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো হয়ে যায়, আজীবন দুই দুগুণে চারই বলব। কিন্তু ফুটবল খেলাটা তো তা নয়, একটা বয়সে রপ্ত করে আর একটা বয়সে ছেড়ে দিতেই হয়। যত বড় প্লেয়ারই হোক, একই ভাবে সে খেলতে পারে না চিরকাল। আপনি যেভাবে একদিন চুনী কি প্রদীপ কি বলরামকে রুখতেন, পারবেন কি আজ সেই ভাবে অনুপমকে আটকাতে?
বক্তার বলার ভঙ্গিতে তেরছা বিদ্রুপ ছিল। কমলের রগ দুটো দপদপ করে উঠল। পিছন দিক থেকে কে মন্তব্য করল, নখদন্তহীন বৃদ্ধ সিংহ!
কমলের ইচ্ছে হল ঘুরে একবার দেখে, কথাটা কে বলল! কিন্তু বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বলল, শিক্ষায় যদি ফাঁকি না থাকে, তা হলে যে স্কিল মানুষ পরিশ্রম করে অর্জন করে তা কখনও সে হারায় না, বয়স বাড়লেও।
তার মানে, আপনি আগের মতোই এখনও খেলতে পারেন?
না। কিন্তু অনুপমদের আটকাবার মতো খেলা বোধ হয় এখনও খেলতে পারি।
প্রত্যেকের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠে তারপর সেটি অবিশ্বাস্যতা থেকে মজা পাওয়ায় রূপান্তরিত হল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। কমলের মনে হল সে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে।
বুড়োবয়সে ল্যাজেগোবরে করে ছেড়ে দেবে।
দাঁতে দাঁত চেপে কমল বলল, যাত্রীর সঙ্গে লিগে শোভাবাজারের তো দেখা হবেই, তখন দেখা যাবেখন।
কমল যখন চারতলার হলঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে, শুনতে পেল কে চেঁচিয়ে বলছে, ওরে চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেল। অনুপমকে জানিয়ে দিতে হবে।
কমল নিজের সেকশনে আসামাত্রই রণেন দাস তাকে ডাকল, এই যে, ছিলেন কোথায় এই দুদিন? ডুব মারবেন তো আগেভাগে বলে যেতে পারেন না? লোক তো তিনজন অথচ কাজ থাকে বারোজনের। তার মধ্যে একজন কামাই করলে কী অবস্থাটা হয়? এর উপর তিনটে বাজতে না বাজতেই তো প্লেয়ার হয়ে যাবেন।
যে বিশ্রি মেজাজ নিয়ে কমল চারতলা থেকে নেমে এসেছে সেটা এখনও অটুট। তিক্ত স্বরে সে বলল, দরকার হয়েছিল বলেই ছুটি নিয়েছি। ছুটি নেবার অধিকারও আমার আছে।
অ। অধিকার আছে? রোজ তিনটের সময় বেরিয়ে যাওয়াটাও বুঝি অধিকারের মধ্যে!
কমল জবাব দিল না। রণেন দাসকে সে একদমই পছন্দ করে না। লোকটা অর্ধেক সময় সিটে থাকে না। ক্যান্টিন অথবা ইউনিয়ন অফিসঘরে কিংবা চারতলা বা পাঁচতলায় গিয়ে পরচর্চায় সময় কাটায়, চুকলি কাটে আর ওভারটাইম রোজগারের তালে থাকে। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে, তিরিশ বছর প্রায় চাকরি করছে, এগারোশো টাকা মাইনে পায়, কিন্তু সিগারেটটা পর্যন্ত চেয়ে খায়। রণেন দাস ডেসপ্যাচের কর্তা।
দুপুর দুটো নাগাদ গেমস্ সেক্রেটারি নতু সাহা খাতা হাতে কমলের কাছে হাজির হল।
কাল আপনাকে খুঁজে গেছি, আপনি আসেননি। আজ খেলা আছে বেঙ্গল টিউবের সঙ্গে ভবানীপুর মাঠে। বলতে বলতে নতু সাহা খাতাটা খুলে এগিয়ে দিল। খাতায় টিমের খেলোয়াড়দের নাম লেখা। কমলের নামটি দুজনের পরেই। সকলেরই সই আছে নামের পাশে।
প্রথমেই কমলের মনে পড়ল, আজ শোভাবাজারের খেলা আছে, তাকে খেলতেই হবে। কিন্তু সেকথা বললে নতু সাহা রেহাই দেবে না। রথীনের কথাগুলো মনে পড়ল—অফিসের দুটো খেলায় তুই খেলিসনি—এই নিয়ে কথা উঠেছে…তোকে চাকরি দেওয়ায় ইউনিয়ন থেকে পর্যন্ত অপোজিশন এসেছিল…তোর জন্য এ জি এম পর্যন্ত ধরাধরি করেছি।
কমল খাতায় নিজের নামটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ভাবল, কী করি এখন! শোভাবাজারে আজ তাকে দরকার। সেখানকার টিমেও তার নাম আছে। ওই খেলারই গুরুত্বটা বেশি, কিন্তু এই খেলাটা চাকরির জন্য। অবশ্য খেলব না বলে দেওয়া যায় নতু সাহাকে। তা হলে তিনটে-চারটের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুবিধেটা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে।
কী হল, সইটা করে দিন। একটু পরেই তো বেরোতে হবে। অধৈর্য হয়ে নতু সাহা বলল।
আমাকে আজ বাদ দেওয়া যায় না কি?
না না, আমাদের ডিফেন্সে আজ কেউ নেই। ফরোয়ার্ডে শুধু অনুপম। গোবিন্দ তো এক হপ্তার ছুটিতে গেছে, জহরের পায়ে চোট, আজ তো টিমই হচ্ছিল না।
কমল আর কথা না বলে নিজের নামের পাশে সই করে দিল। সেই মূহুর্তে একবার সরোজের মুখটা সে দেখতে পেল-অসহায় এবং রাগে থমথমে।
.
০৮.
প্রগ্রেসিভ ব্যাঙ্কের ভ্যান ওদের চারটের সময় মাঠে পৌঁছে দিল। কমল লক্ষ করে, ভ্যানের এককোণে অনুপম বসে মাঝে মাঝে তার দিকে তাকাচ্ছিল, তাইতে ওর মনে। হয়, নিশ্চয় কথাটা কানে গেছে! কমল অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। ড্রেস করে মাঠে নামতে গিয়ে সে দেখল, অনুপম ড্রেস করেনি। নতু সাহাকে কমল জিজ্ঞাসা করল, অনুপম নামবে না?
বলছে, দরকার হলে নামব। বড় প্লেয়ার, বুঝলেন না! তির্যক স্বরে নতু সাহা বিরক্তি চাপতে চাপতে বলল, কিছু বলাও যাবে না, সারা অফিস জুড়ে অমনি ভক্তরা হইহই করে উঠবে।
কমল হাসল। তার মনে পড়ল, এমন মেজাজ একদিন সে-ও দেখিয়েছে।
হাফটাইমে প্রগ্রেসিভ ব্যাঙ্ক তিন গোলে হারছে। বেঙ্গল টিউব চারবার মাত্র বল এনেছিল, আর তাতেই তিনটি গোল! একমাত্র রাইট আউট আর সেন্টার ফরোয়ার্ডটিই যা কিছু খেলছে এবং তাদের গোলের দিকে এগোনোর পথ কমল অনায়াসেই বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তা সে করল না ইচ্ছে করেই। দুবার সে ট্যাকল করতে গিয়ে কাঁচা খেলোয়াড়ের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আর একবার হেড করতে উঠল দুসেকেন্ড দেরি করে। তাতেই গোল তিনটি হয়ে যায়।
হাফটাইমে মাঠ থেকে বেরিয়ে এসেই কমলের চোখে পড়ল, অনুপম ড্রেস করে তার জনাচারেক ভক্তর সঙ্গে কথা বলছে। কমল মনে মনে হাসল। নতু সাহা বিরক্ত ও উত্তেজিত হয়ে ছুটে এসে কমলকে বলল, এভাবে গোল খাওয়ার মানে হয়? অ্যালেন লিগের প্লেয়ারও অমন করে চার্জ করে না, আপনি যা করলেন।
কমল কথা না বলে ঘাসের উপর বসে পড়ে লিমনেডের একটা বোতল তুলে নিল।
লোকে যে কেন আপনাকে বড় প্লেয়ার বলত বুঝি না!
মুখ থেকে বোতলটা নামিয়ে কমল হেসে নিচু গলায় বলল, আর গোল হবে না। আপনারা যাকে বড় প্লেয়ার বলেন, তাকে এবার গোল শোধ করতে বলুন।
সেজন্য ভাবছি না। অনুপম খানপাঁচেক অনায়াসেই চাপিয়ে দেবে। কিন্তু দোহাই আর গোল খাওয়াবেন না।
কমল খালি বোতলটা রেখে উঠে দাঁড়াল। একটু দূরে বেঙ্গল টিউবের খেলোয়াড়রা বসে জিরোচ্ছে। কমল লক্ষ করেছে, ওদের লেফট হাফ বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটি এলোপাথাড়ি পা চালায়, পাস দিতে গিয়ে কেমন গোলমাল করে ফেলে, বিন্দুমাত্র কন্ট্রোল নেই বলের উপর কিন্তু প্রচণ্ড দম আর বেপরোয়া গোঁয়ার্তুমিটা আছে। যার ফলে যেখানে বল সেইখানেই ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো গুঁতোতে ছুটছে। বল ধরতে গিয়েও ওকে দেখে অনেকেই বল ছেড়ে সরে যাচ্ছে।
কমল ওর কাছে গিয়ে বলল, দারুণ খেলছো তো। প্রগ্রেসিভকে তো দেখছি তুমি একাই রুখে দিয়েছ।
আনন্দে এবং লজ্জায় ছেলেটি মাথা চুলকোতে লাগল। কমল গুহর কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া সাধারণ ব্যাপার নয়।
তবে এবার তোমার কপালে দুঃখ আছে।
সচকিত হয়ে ছেলেটি বলল, কেন, কেন?
এবার অনুপম নামছে। ও বলেছে—পাঁচখানা চাপাব, বেঙ্গল টিউব আবার টিম নাকি?
কমল লক্ষ করল, ছেলেটির মুখ রাগে থমথমে হয়ে উঠল।
দেখি তুমি কত ভাল প্লেয়ার, এইবার বুঝব। এই বলে কমল সরে এল।
খেলা আবার শুরু হয়ে বল মাঝ-মাঠেই রইল মিনিট পাঁচেক। অনুপম কোমরে হাত দিয়ে ডান টাচ লাইনের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বিরক্ত হয়ে ভিতরে ঢুকে এল বলের আশায়।
বল পেল অনুপম। কাটাল একজনকে, পরের লোকটাকেও। কমল দেখল টিউবের লেফট হাফ প্রায় চল্লিশ গজ থেকে ছুটে আসছে। সামনে তিন ডিফেন্ডার। অনুপম বল থামিয়ে দেখছে কাকে দেওয়া যায়। চোখে পড়ল বুলডোজারের মতো আসছে লেফট হাফ। অনুপম তাড়াতাড়ি বলটা নিজেদের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে ঠেলে দিয়ে সরে দাঁড়াল। লেফট হাফ ব্রেক করতে পনেরো গজ এগিয়ে গেল এবং তারপরই ঘুরে আবার বলের দিকে তাড়া করল।
অনুপমের দেওয়া বল সেন্টার ফরোয়ার্ড রাখতে পারেনি। বল এল কমলের পায়ে। অবহেলায় সে ছোট্ট জায়গার মধ্যে পাঁচ-ছয়বার কাটিয়ে নিতে নিতে দেখে নিল অনুপম ও তার প্রহরী লেফট হাফটি কোথায়। তারপর অনবদ্য ভাবে ঠিক দুজনের মাঝ বরাবর বলটা ঠেলে দিল, যাতে ছুটে গিয়ে অনুপমকে পাসটা ধরতে হয়।
অনুপম ছুটে গিয়ে বলে পা দিতে যাবে, তখন আর একটি পা সেখানে পৌঁছে গেছে। টায়ার ফাটার মতো চার্জের শব্দ হল। বলটা ছিটকে এল প্রগ্রেসিভের হাফ লাইনে। পর পর তিনবার কমল থু দিল অনুপমকে, অবশ্যই লেফট হাফের দিকে ঘেঁষে। সবাই দেখল, অনুপম বল ধরতে পারল না বা ছুটেও থমকে পড়ল। রাইট উইং থেকে সে লেফট উইংয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে লেফট হাফও ডানদিকে চলে এল। মাঠের বাইরে মুখ টিপে অনেকে হাসল। কমল দেখল, অনুপমের মুখে রাগ, বিরক্তি ও হতাশা।
আবার অনুপমকে বল বাড়াল কমল। টিউব যেন জেনে গেছে সব বল অনুপমকেই দেওয়া হবে। তিনজন ওর উপর নজর রেখে ওর কাছাকাছি ঘুরছে। অনুপম বলটা ধরার জন্য এক হাতও এগোল না। বরং দুহাত নেড়ে চিৎকার করতে করতে সে কমলের কাছে এসে বলল, আমাকে কেন, আমাকে কেন। বল দেবার জন্য আর কি মাঠে লোেক নেই?
অবাক হয়ে কমল বলল, সে কী, অফিসে শুনলুম, কাল প্রসূন বল দেয়নি বলে তুমি তিনটের বেশি গোল পাওনি!
অনুপম আর কথা বলেনি। মাঠের মধ্যে সে ছোটাছুটি শুরু করল, লেফট হাফের পাহারা থেকে মুক্তি পাবার জন্য। তার তখন একমাত্র চিন্তা-চোট যেন না লাগে। এর পরই কমল বল নিয়ে উঠল। এগোতে এগোতে টিউবের পেনাল্টি এরিয়ার কাছে পৌঁছে অনুপমকে বল দেবার জন্য তার দিকে ফিরে হঠাৎ ঘুরে গিয়ে একজনকে কাটিয়েই প্রায় ষােলো গজ থেকে গোলে শট নিল। টিউবের কেউ ভাবতে পারেনি, অনুপমকে বল না দিয়ে কমল নিজেই আচমকা গোলে মারবে। বল যখন ডান পোস্টের গা ঘেঁষে গোলে ঢুকছে, গোলকিপার তখনও অনুপমের দিকে তাকিয়ে বাঁ পোস্টের কাছে দাঁড়ানো।
তিন মিনিট পরে ঠিক একই ভাবে কমল আবার গোল দিল। টিউব এবার অনুপমকে ছেড়ে কমল সম্পর্কে সজাগ হয়ে পড়ল। খেলা শেষ হতে চার মিনিট বাকি, রেজাল্ট তখন ৩–২। প্রগ্রেসিভ হারছে। কমল বল নিয়ে আবার উঠতে শুরু করল, তিন জনকে কাটিয়ে সে বল দিল রাইট ইনকে। সে আবার ফিরিয়ে দিল কমলকে। অনুপমের প্রহরী তেড়ে আসছে। কমল বলটা রেখে অপেক্ষা করল এবং শেষ মুহূর্তে নিমেষে বল নিয়ে সরে দাঁড়াল। লেফট হাফ ফিরে দাঁড়িয়ে আবার তেড়ে এল। কমল আবার একই ভাবে এগিয়ে এল। কমল ডান পায়ে বল মারার ভঙ্গি করে। চেঁচিয়ে উঠল, অনুপম!
অনুপম বাঁ দিক দিয়ে এগিয়ে গেল বলের আশায়। তার সঙ্গে গেল টিউবের তিনজন। কমল বাঁ পায়ে বলটা ঠেলে দিল দুজন ডিফেন্ডারের মাঝ দিয়ে পেনাল্টি বক্সের মাঝখানে। আর রাইট ইন, যে বল সে একশোটার মধ্যে আটানব্বইটা গোলের বাইরে মারবে, সে-ই বল গোলে পাঠিয়ে দিল।
খেলা শেষে নতু সাহা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এল কমলের দিকে। কমল থমকে দাঁড়িয়ে অনুপমকে বলল, পাস কখন দেবে, কেন দেবে এবং দেবে না, সেটা প্রসূন জানে। বল। পেয়ে খেলা যেমন,না পেয়েও তেমন একটা খেলা আছে। সেটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনুপমের কাঁধে একটা চাপড় দিয়ে নতু সাহার হাতটা সরিয়ে কমল টেন্টের দিকে এগিয়ে গেল।
বাড়ি ফেরার পথে সে ট্রামে শুনল, শোভাবাজার তিন গোলে রাজস্থানের কাছে। হেরেছে।
.
০৯.
পরদিন অফিসে পৌঁছোনো মাত্র কমল শুনল, রথীন তাকে দেখা করতে বলেছে। ওর চেম্বারে ঢুকতেই রথীন টেলিফোনে কথা বলতে বলতে ইশারায় কমলকে বসতে বলল।
তারপর, রথীন টেলিফোন রেখে বলল, কাল নাকি দারুণ খেলেছিস!
কে বলল! কমল ভাবতে শুরু করল, রথীনকে এর মধ্যেই কে খবর দিতে পারে!
যেই বলুক না। তিন গোল খাইয়ে অনুপমকে মাঠে নামিয়েছিস, এমন থু বাড়িয়েছিস যাতে না ও ধরতে পারে, তারপর গোল দিয়ে মান বাঁচিয়েছিস। সাবাস, অসাধারণ! এক ঢিলে তিন পাখি—একেই বলে।
কমল কথা না বলে ফিকে হাসল। রথীনের মুখ থমথম করছে।
একজন সিনিয়ার প্লেয়ার জুনিয়ারকে মাঠের মাঝে অপদস্থ করবে ভাবা যায় না। আনস্পোর্টিং।
কমল শক্ খেয়ে সিধে হয়ে বসল। রাগটা কয়েকবার দপদপ করে উঠল চোখের চাউনিতে।
ব্যাপারটা কী? অনুপম তোর ক্লাবের প্লেয়ার বলেই কি আমি আনস্পোর্টিং?
আমার ক্লাব বলে কোনও কথা নয়। একটা উঠতি প্রমিসিং ছেলে, তাকে হাস্যকর করে তুললে সাইকোলজিক্যালি তার একটা সেটব্যাক হয়। এবছর যাত্রীর ফরোয়ার্ড লাইনে অনুপম অত্যন্ত ইম্পর্টান্ট রোল প্লে করছে। যাত্রী শিল্ড পেয়েছে কিন্তু লিগ পায়নি কখনও। আমার আমলে যাত্রীকে আমি লিগ এনে দেব। এ বছর নিখুঁত যন্ত্রের মতো যাত্রী খেলছে। আমি চাই না এর সামান্য একটা পার্টসও বিগড়ে যাক। আমি তা হতে দেব না। রথীনের মুঠো করা হাতটার দিকে কমল তাকাল। হিংস্র আঘাতের জন্য মুঠোটা তৈরি। কমল নির্লিপ্ত স্বরে বলল, আমি কি এবার উঠতে পারি?
কঠিন চোখে রথীন তাকাল। কমলও।
আমার কথাটা আশা করি বুঝিয়ে দিতে পেরেছি।
কমল ঘাড় নাড়ল। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, একশো টাকাটা এখনও শোধ দিতে পারিনি, হাতে একদমই টাকা নেই। সামনের মাসে মাইনে পেলেই দিয়ে দেব।
না দিলেও চলবে। একশো টাকার জন্য যাত্রী মরে যাবে না।
কত টাকার জন্য তা হলে মরতে পারে?
মানে?
পাঁচ হাজার?
রথীনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কমল সেটা লক্ষ করে বলল, আমার মনে হয় যুগের যাত্রী খুব একটা স্পোর্টিং ক্লাব।
এখন তুমি যেতে পারো। রথীন দরজার দিকে আঙুল তুলল।
কমল নিজের চেয়ারে এসে বসা মাত্র বিপুল ঘোষ ফিসফিস করে বলল, কাল কী রকম খেলেছেন মশাই, অফিসের ছোকরারা খাপ্পা হয়ে গেছে। আপনি নাকি খুব বড় একজন প্লেয়ারকে খেলতে না দিয়ে একাই খেলেছেন?
হ্যাঁ।
কত বড় প্লেয়ার সে!
মস্ত বড়। আট হাজার টাকা নাকি পায়।
আ—ট! বলেন কী মশাই, সাত ঘণ্টা চোদ্দো বছর ধরে কলম পিষে আজ পাচ্ছি বছরে আট হাজার। আর এরা একটা বলকে লাথি মেরে পাচ্ছে আট হাজার টাকা! তার সঙ্গে চাকরির টাকাটাও ধরুন।
পাক না টাকা। ভালই তো। কলম পেষার থেকে ফুটবল খেলা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়।
কমল আলোচনা বন্ধের জন্য চিঠির গোছা সাজাতে শুরু করল। এগুলোর কুষ্ঠি-ঠিকুজি এখন খাতায় এন্ট্রি করতে হবে। তারপর খামে ভরে দপ্তরির কাছে পাঠানো স্ট্যাম্প দিয়ে ডাকে পাঠাবার জন্য। ভুল হয়ে গেলে একের চিঠি অন্যের কাছে চলে যাবে। চাকরি নিয়ে তখন টানাটানি পড়বে।
রণেন সাহা এতক্ষণ একমনে কাজ করছিল। মাথা না তুলে এবার বলল, আজও তিনটের সময় চলে যাবেন নাকি?
কেন? কমল বলল।
কাল যে দুটো গোল করেছেন।
কমল হেসে উঠল।
ছুটির কিছু আগে ফোন এল কমলের। অরুণার গলা: কমলদা, একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। বেলেঘাটায় একটা স্কুলে টিচার নেওয়া হচ্ছে। তোমাদের ক্লাবের সেক্রেটারির সঙ্গে একবার আলাপ করিয়ে দেবে? উনি ওই স্কুলের কমিটিতে আছেন। যদি চাকরিটা পাই, তা হলে এখন যেটা করি সেটা বরুণাকে দিয়ে দেব।
কমল ওকে জানাল, ক্লাবে গিয়ে কেষ্টদার সঙ্গে সে আজকেই কথা বলবে।
অফিস থেকে বেরিয়ে কমল হেঁটেই ময়দানে যায়। আজ যাবার পথে সারাক্ষণ রথীনের কথাগুলো, তার আচরণের পরিবর্তন এবং সব থেকে বেশি আনস্পোর্টিং শব্দটি কমলের মাথার মধ্যে ঠকঠক করে আঘাত করতে লাগল।
এই যে। আপনার কাছেই যাব ভাবছিলুম। দেখা হয়ে ভালই হল।
চমকে উঠে কমল দেখল, সাংবাদিকটি সামনে দাঁড়িয়ে। হেসে বলল, কেন?
একটা কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি, আপনি কি রিটায়ার করেছেন?
সে কী! কোথায় শুনলেন?
কাল যুগের যাত্রীর টেন্টে গেছলুম। সেখানে প্রতাপ ভাদুড়ি বলল আপনি নাকি রিটায়ার করেছেন।
চলতে চলতে কমল বলল, আচ্ছা, তাই নাকি! আর কী শুনলেন?
যাত্রীর কে যেন কাল অফিস লিগে আপনার খেলা দেখতে গিয়েছিল। তার সঙ্গেই আলোচনা করছিল প্রতাপ ভাদুড়ি। আপনি অনুপমকে নাজেহাল করেছেন শুনে বলল, কমল তো শুনছি রিটায়ার করে গেছে। ওকে কিছু টাকা বেনিফিট হিসাবে দেব ভাবছি, অনেক বছর যাত্রীতে খেলে গেছে তো।
কত টাকা দেবে কিছু বলেছে?
না।
শোভাবাজারের পরের ম্যাচেই আমি খেলছি।
তা হলে রিটায়ার করেননি!
কমল জবাব না দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল বিস্মিত সাংবাদিককে ভিড়ের মধ্যে ফেলে রেখে।
শোভাবাজার টেন্টে ঢোকার মুখেই কমলের সঙ্গে দেখা হল সত্য আর বলাইয়ের।
কাল আপনি এলেন না কমলদা? খেলা আরম্ভ হবার পাঁচ মিনিট আগে পর্যন্ত সরোজদা আপনার জন্য অপেক্ষা করেছে।
অফিস আটকে দিল। কমল অপ্রতিভ হয়ে বলল। খেললি কেমন তোরা?
বলাই হেসে বলল, আর খেলা! আপনার জায়গায় স্বপনকে নামানো হয়েছিল। তিনটে গোল ওই খাওয়াল।
লাস্ট গোলটা, বুঝলেন কমলদা, যদি দেখতেন তো হাসতে হাসতে মরে যেতেন। ওদের শ্যামল বোস দুটো গোল করেছে। রাইট আউট বল নিয়ে এগোচ্ছে। স্বপন ট্যাকল করতে কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে এগিয়ে হঠাৎ ঘুরে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে শ্যামল বোসের কাছে দৌড়ে এসে দাঁড়াল। ওদিকে রাইট আউট ফাঁকায় এগিয়ে এসে গোল করে দিল। আমরা তো অবাক। বললুম—স্বপন, তুই ওভাবে ছেড়ে দিয়ে এদিকে দৌড়ে এলি কেন? কী বলল জানেন! যদি শ্যামল বোসকে বল দিত আর যদি শ্যামল বোস গোল করত তা হলে ওর হ্যাটট্রিক হয়ে যেত না?
বলতে বলতে সত্য হো হো করে হেসে উঠল। বলাইও। বুঝলেন কমলদা, উফফ, স্বপন হ্যাটট্রিক করতে দেয়নি। ওহঃ, গোল খাও, পরোয়া নেই, হ্যাটট্রিক হোনে নেহি দেগা।
কমলও হাসল। তারপর চোখে পড়ল, ভরত টেন্টের মধ্যে চেয়ারে বসে তাদের দিকেই তাকিয়ে। কমল এগিয়ে এসে বলল, সরি ভরত।
আপনি থাকলে কাল গোল খেতুম না।
কী করব, অফিসের খেলা ফেলে আসতে পারলাম না।
কমলদা, শোভাবাজারে নবছর আছি। ফাস্ট গোলি সাত বছর ধরে। এমন জঘন্য টিম কোনও বার দেখিনি। থার্ড ডিভিশনেও এরা খেলার যোগ্য নয়। না আছে স্কিল না আছে ফুটবল সেন্স। পারে শুধু গালাগালি আর লাথি চালাতে। বলাই, সত্য, শ্রীধর তিনজনকেই রেফারি ওয়ার্ন করেছে। স্বপন যতই বোকামি করুক, প্রাণ দিয়ে খেলেছে ওর সাধ্য মতো।
নেস্ট ম্যাচ কার সঙ্গে? বাটা?
হ্যাঁ।
সেক্রেটারির ঘর থেকে এই সময় সরোজ বেরোল। কমলকে দেখেই গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ।
আসতে পারলাম না সরোজ।
জানি, অফিসের হয়ে খেলেছেন।
পরের ম্যাচে অবশ্যই খেলব। তাতে চাকরি যায় যাবে।
সরি কমলদা, টিম হয়ে গেছে। স্বপনই খেলবে।
সরোজ, আমি রিটায়ার করেছি বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। ওটা মিথ্যা রটনা প্রমাণ করতে আমাকে নামতেই হবে মাঠে।
টিম আর বদলানো যাবে না। সরোজ স্বরে কাঠিন্যের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, অন্য ম্যাচে খেলবেন।
শোভাবাজারের মতো নগণ্য টিমের অতি নবীন কোচ যে এভাবে তার সঙ্গে কথা বলবে, কমলের তা কল্পনার বাইরে। কথা না বাড়িয়ে সে সেক্রেটারির ঘরে ঢুকল।
কৃষ্ণ মাইতি বাড়িতে তিন-চার টাকার বেশি বাজার করেন না। বাইরে লুকিয়ে রসনা-তৃপ্তিকর খাদ্য উদরস্থ করাই তাঁর জীবনের একমাত্র শখ। আস্ত চিকেন রোস্ট নিয়ে ধস্তাধস্তি করছিলেন। যখন কমল সামনে এসে বসল, কথা না বলে একবার তাকালেন শুধু তিনি।
সামনের ম্যাচ বাটার সঙ্গে। কেষ্টদা, আমি খেলতে চাই।
বেশ তো, নিশ্চয়ই খেলবি।
সরোজ টিমে আমার নাম রাখেনি।
সে কী! কৃষ্ণ মাইতি চিৎকার করে উঠলেন, সরোজ, সরোজ!
সরোজ ঘরে ঢোকা মাত্র বললেন, কমল বাটা ম্যাচ খেলবে।
কিন্তু— সরোজ কড়া চোখে কমলের দিকে তাকাল।
কিন্তুটিন্তু নয়। কমল কলকাতা মাঠের সব থেকে সিনিয়ার প্লেয়ার। বড় বড় টিম এখনও মাঠে ওকে দেখলে ভয়ে কাঁপে। ও খেলতে চেয়েছে, খেলবে।
কিন্তু কেষ্টদা, আমি টিমটা অনেক ভেবেই করেছি একটা বিশেষ প্যাটার্নে খেলাব বলে। তা ছাড়া কমলদা তো একদিনও প্র্যাকটিস করলেন না ছেলেদের সঙ্গে।
প্র্যাকটিস! কেষ্টদা দারুণ বিষম খেলেন। কয়েকবার ব্রহ্মতালু থাবড়ে নিয়ে ধাতস্থ হয়ে বললেন, প্যাটার্ন, প্র্যাকটিস সব হবে, সব হবে। যা বললুম তাই করো। কমল খেলবে।
আচ্ছা।
সরোজ বেরিয়ে যাবার সময় কঠিন দৃষ্টি হেনে গেল কমলের দিকে।
বুঝলে কমল, বাবুরা কোচিং করে ক্লাবকে উদ্ধার করবে। শেষ দিকে পয়েন্ট ম্যানেজ করে তোত রেলিগেশন থেকে বাঁচতে হবে। ওঠা-নামা যদ্দিন বন্ধ ছিল, বুঝলে, শান্তিতে ছিলুম।
কেষ্টদা, আপনি যে মেয়েদের স্কুলের কমিটি মেম্বার, সেখানে টিচার নেওয়া হচ্ছে। আমার একজন পরিচিত অ্যাপ্লাই করেছে। আপনি একটু দেখবেন?
কে হয় তোর?
পল্টু মুখার্জির বড় মেয়ে।
ভ্রূ কুঁচকে কৃষ্ণ মাইতি আঙুলে লেগে থাকা ঝোল চাটতে চাটতে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা দেখবখন। কিন্তু তোর সঙ্গে একটা কথা আছে। যুগের যাত্রীর সঙ্গে লিগের প্রথম খেলা সতেরোই। পয়েন্ট নিতে হবে। যদি নিতে পারিস, তা হলে চাকরিটা হবে।
কমল অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। চাকরি দেবার এরকম অদ্ভুত শর্তের কারণ সে বুঝতে পারছে না।
কেষ্টদা, তা কী করে হয়!
হতেই হবে। পয়েন্ট দে, আমিও তা হলে চেষ্টা করব। গুলোকে আমি একবার দেখে নেব। গত বছর কথা ছিল, ম্যাচ ছেড়ে দিলে আর গভর্নিং বডির মিটিংয়ে। কালীঘাটের সঙ্গে গণ্ডগোল বন্ধ হয়ে যাওয়া খেলাটা রি-প্লে হওয়ার পক্ষে ভোট দিলে। সাতশো টাকা দেবে টেন্ট সারাতে। ম্যাচ ছাড়ার আর দরকার হয়নি, এমনিতেই যাত্রী চার গোল দিয়েছে। ভোট দিয়েছিলুম কিন্তু যাত্রী জিততে পারেনি। ব্যাস, ব্যাটা আর টাকা ঠেকাল না। যদি পারিস ফাস্ট ম্যাচে পয়েন্ট নিতে তা হলে ভয় খাবে, রিটার্ন লিগ ম্যাচে সুদে-আসলে তখন কান মলে আদায় করে নেব। পল্টু মুখুজ্যের মেয়ের চাকরি, কমল এখন তোর হাতে।
কমল কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না, শুধু তাকিয়ে রইল চশমার পিছনে পিটপিটে দুটো চোখের দিকে। যাত্রীকে পয়েন্ট থেকে বঞ্চিত করার ইচ্ছাটা তারও প্রবল। কিন্তু কৃষ্ণ মাইতির ইচ্ছাটার সঙ্গে তারটির কিন্তু ভীষণ অমিল। সব থেকে অস্বস্তিকর ও ভয়ের ব্যাপার এই শর্তটা। যাত্রীর কাছ থেকে পয়েন্ট নেওয়া একার সাধ্যে সম্ভব নয়। বয়স হয়েছে, দমে কুলোয় না। এজিলিটি কমে গেছে, স্পিডও। শুধু অভিজ্ঞতা সম্বল করে একটা তাজা দলের সঙ্গে একা লড়াই করা যায় না। তার থেকেও বড় কথা, অরুণার চাকরি পাওয়া যদি যাত্রীর সঙ্গে খেলার ফলের উপর নির্ভর করে, তবে সেটা একটা বাড়তি চাপ হবে মনের উপর।
কমলের মনের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল এক বৃদ্ধের ছবি। কী যেন বলছেন, কমল মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, ব্যালান্স! হ্যাঁ পল্টুদা, ব্যালান্স রাখতে হবে।
ব্যালান্স কী রে, পয়েন্ট চাই। কমল উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল, আমি চেষ্টা করব।
.
১০.
কিক অফের বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে কমলের শরীরে হালকা একটা কাঁপন লাগল। গত বছর আই এফ এ শিল্ডের প্রথম রাউন্ডে এই মহমেডান মাঠেই শেষবার খেলেছে। তারপর ঘেরা মাঠে আজ প্রথম। প্রত্যেকবার, গত কুড়ি বছরই, কি অফের বাঁশি শুনলেই তার শরীর মুহূর্তের জন্য কেঁপে ওঠে। স্নায়ুগুলো নাড়াচাড়া খেয়ে আবার ঠিক হয়ে যায়। তারপর প্রত্যেকটা কোষ ফেটে পড়ার জন্য তৈরি হয়ে উঠতে শুরু করে।
কমল অনুভব করল আজকেও সে তৈরি। বাটা আলস্যভরে খেলা শুরু করেছে। বল নিয়ে ওরা মাঝখান দিয়ে ঢুকছিল, রাইট হাফ সত্য চার্জ করে বলটা লম্বা শটে ডান কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে পাঠিয়ে দিল। কমল বিরক্ত হল। অযথা বোকার মতো বলাটা নষ্ট করল। উইং রুদ্র তখন সেন্টার ফ্ল্যাগের কাছে, তার পক্ষে ওই বল ধরা সম্ভব নয়। তবু রুদ্র দৌড়িয়ে খানিকটা দম খরচ করল।
পেনাল্টি এরিয়ার ১৮ x ৪৪ গজ জায়গা নিয়ে কমল খেলতে থাকে। দুবার তাকে বল নিয়ে আগুয়ান ফরোয়ার্ডকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়েছে এবং দুবারই বল দখল। করেছে। নির্ভুল বল দিয়েছে ফরোয়ার্ডদের, কাঁচা ছেলে স্বপন নিজের জায়গা ছেড়ে বলের পিছনে যত্রতত্র ছুটছে, তাকে কোথায় পজিশন নিতে হবে বার বার চেঁচিয়ে বলছে, বল নিয়ে ওঠার মতো ফাঁকা জমি পেয়েও সে প্রলোভন সামলেছে। খেলা পনেরো মিনিটে গড়াবার আগেই কমল নিজের সম্পর্কে আস্থাবান হয়ে উঠল।
সবুজ গ্যালারিতে দুটি মাত্র লোক। হাওড়া ইউনিয়নের মেম্বার-গ্যালারিতে জনা পনেরো লোক। ওরা রোজই আসে, খেলার পরও সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকে। মহমেডান মেম্বার-গ্যালারিতেও কিছু লোক। খেলা চলছে উদ্দেশ্যবিহীন, মাঝ মাঠে। কিন্তু এরই মধ্যে কমল লক্ষ করল, শোভাবাজারের তিন-চারজনের যেন খেলার ইচ্ছাটা একদমই নেই। বিপক্ষের পায়ে বল থাকলে চ্যালেঞ্জ করতে এগোয় না, ট্যাকল করতে পা। বাড়ায় না, বল নিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলে তাড়া করে না। কমল ক্রমশ অনুভব করতে লাগল যে, তার ওপর চাপ পড়ছে। মাঝমাঠে যে বাঁধটা রয়েছে তাতে একটার পর একটা ছিদ্র দেখা দিচ্ছে আর অবিরাম বল নিয়ে বাটা এগিয়ে আসছে।
কিন্তু অবাক হল কমল, রাইট ব্যাকে স্বপনের খেলা দেখে। যেখানেই বল সেখানেই স্বপন। এলোপাথাড়ি পা চালিয়ে, ঝাঁপিয়ে, লাফিয়ে সে নিজেকে হাস্যকর করে তুললেও, কমল বুঝতে পারছে, ওর এই ভাবে খেলাটা ফল দিচ্ছে। নিজের জায়গা ছেড়ে ছোটাছুটি করলেও কমল ওকে আর নিষেধ করল না। তবে ডান দিকের বিরাট ফাঁকা জায়গাটা বিপজ্জনক হয়ে রইল।
হাফটাইমের পর প্রথম মিনিটেই শোভাবাজার গোলকিক পেয়েছে। ভরত বলটা গোল এরিয়ার মাথায় বসাবার সময় কমলকে বলল, সত্য, শম্ভু, বলাই মনে হচ্ছে বেগোড়বাই শুরু করেছে। কমলদা, আপনি রুদ্রকে নেমে এসে ডানদিকটা দেখতে বলুন।
কমল কিক করার আগে শুধু বলল, আর একটু দেখি।
কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই বাটা পেনাল্টি কিক পেল। লেফট ব্যাক বলাই অযথা দুহাতে বলটা ধরল, যেটা না ধরলে ভরত অনায়াসেই ধরে নিত। ভরত তাজ্জব হয়ে বলল, এটা তুই কী করলি?
বলাই মাথায় হাত দিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, একদম বুঝতে পারিনি। ভাবলুম তুই বোধ হয় পজিশনে নেই, বলটা গোলে ঢুকে যাবে।
ভরত বিড়বিড় করে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করে গোলে দাঁড়াল এবং পেনাল্টি কিক হবার পর গোলের মধ্য থেকে বলটা বার করে প্রবল বিরক্তিতে মাটিতে আছাড় মারল।
বলাই! গম্ভীর স্বরে কমল বলল, তুমি রাইট উইংয়ে যাও। আর রুদ্র, তুমি নেমে এসে খেলো।
বলাই উদ্ধতভাবে প্রশ্ন করল, কেন? আমি পজিশান ছেড়ে খেলব কেন?
আমি বলছি খেলবে।
আপনি অর্ডার দেবার কে? ক্যাপ্টেন দেবীদাস কিংবা কোচ সরোজদা ছাড়া হুকুম দেবার অধিকার কারোর নেই।
কমল চুপ করে সরে গেল। সত্য চেঁচিয়ে বলাইকে জিজ্ঞাসা করল, কী বলছে রে?
রাগে অপমানে ঝাঁঝিয়ে উঠল কমলের মাথা। শুধুমাত্র স্বপন আর প্রাণবন্ধুকে দুপাশে নিয়ে সে লড়াই শুরু করল। রুদ্র নেমে এসে খেলছে। এখন বাটাকে গোল দেবার কোনও কথাই ওঠে না। শোভাবাজার গোল না খাওয়ার জন্য লড়ছে সাত-আটজনকে সম্বল করে।
পঞ্চাশ মিনিটের পর থেকেই শোভাবাজার ডিফেন্স ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে শুরু করল। সত্য, শম্ভু, বলাই অযথা ফাউল করছে। তিনটে ফ্রি কিকের দুটি ভরত দুর্দান্তভাবে আটকেছে, অন্যটি ফিস্ট করে কর্নার করেছে। কমল দাঁতে দাঁত চেপে পেনাল্টি এরিয়ার ফোকরগুলো ভরাট করে চলেছে আর চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছে স্বপন আর প্রাণবন্ধুকে। বাটার ছয়জন, কখনও আটজন আক্রমণে উঠে আসছে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আরও তিনটি গোল তারা দিল।
কমলদা, আর আমি পারছি না। হাঁফাতে হাঁফাতে স্বপন বলল। ছেলেটার জন্য কষ্ট হচ্ছে কমলের। কিন্তু সেটা প্রকাশ করার বা ওকে ঢিলে দিতে বলার সময় এখন নয়। চার গোল খেয়েছে শোভাবাজার। বাটার দুজনের জন্য তাদের একজন। সংখ্যার অসমত্ব নিয়ে লড়াই অসম্ভব। খেলাটা এখন এলোপাথাড়ি পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাটা গোল না দিয়ে শোভাবাজারকে নিয়ে এখন ছেলেখেলা করছে।
তোর থেকে আমার ডবল বয়েস। আমি পারছি, তুই পারবি না কেন?
স্বপন ঘোলাটে চোখে কমলের দিকে তাকিয়ে মাথাটা দুবার ঝাঁকিয়ে আবার বলের দিকে ছুটে গেল। কমলের মনে হল, যদি এখন সলিলটাও পাশে থাকত। প্রাণবন্ধু, স্বপন এবং রুদ্রও এখন পেনাল্টি এরিয়ায় নেমে এসে খেলছে। ফরোয়ার্ডরা—দেবীদাস, গোপাল, শ্রীধর হাফ লাইনে নেমে এসেছে। বাটার গোলকিপার পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। কমল কখনও যা করতে চায় না, যা করতে সে ঘৃণা বোধ করে, তাই শুরু করল। সময় নষ্ট করে কাটাবার জন্য, বল পাওয়া মাত্র গ্যালারিতে পাঠাতে লাগল। গ্যালারিতে লোক নেই, বল কুড়িয়ে আনতে সময় লাগে।
চার গোলেই শোভাবাজার হারল। খেলার শেষে মাঠের বাইরে এসেই স্বপন আছড়ে পড়ল। কমল এক গ্লাস জল মাথায় ঢেলে শুধু একবার সরোজের দিকে তাকাল। সরোজ মুখ ঘুরিয়ে নিল। বলাই হাসতে হাসতে সরোজকে বলল, শুধু চিকেন চৌমিনে হবে না বলে রাখছি, এক প্লেট করে চিলি চিকেনও।
কমল ঝুকে স্বপনের হাতটা তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল। গতি অসম্ভব দ্রুত। মনে হল মিনিটে দেড়শোর উপর। ওর পাশে উবু হয়ে বসা রুদ্র আর প্রাণবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কমল স্লান হেসে বলল, রেস্ট নিক আর একটু। পরশু থেকে তোদের নিয়ে প্র্যাকটিসে নামব।
টেন্টে এসে স্নান করে কমল যখন ড্রেসিং রুমে পোশাক পরছে, তখন শুনতে পেল। বাইরে ক্লাবের দুই একজিকিউটিভ মেম্বার বলাবলি করছে:
সরোজ তো তখনই বলেছিল, চলে না, বুড়ো ঘোড়া দিয়ে আর চলে না। মর্ডান ফুটবল খেলতে হলে খাটুনি কত?
কেষ্টদার যে কী দুর্বলতা ওর উপরে, বুঝি না। ইয়াং ছেলেরা চান্স না পেলে টিম তৈরি হবে কী করে, কোচ রাখারই বা মানে কী? পাওয়ার ফুটবল এখন পৃথিবীর সব জায়গায় আর আমরা—।
সরোজ বলছে, এভাবে তার উপরে হস্তক্ষেপ করলে সে আর দায়িত্ব নিতে পারবে না।
কেষ্টদার উপর তো আর এখানে কথা চলে না, ডুবল, ক্লাবটা ডুবল।
কমল ঘর থেকে বেরোতেই ওরা চুপ করে ভ্যাবাচাকার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর একজন তাড়াতাড়ি বলল, অ্যাঁ, তা হলে চার গোল হল!
হ্যাঁ, চার গোল। কমল গম্ভীরভাবে জবাব দিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। টেন্টের বাইরে এসে দেখল, ক্যান্টিনের কাউন্টারে সরোজ চা খাচ্ছে। ওকে ডাকতে গিয়ে কমল ইতস্তত করল, কয়েকটা কথা এখন তার সরোজকে বলতে ইচ্ছে করছে। তারপর ভাবল, থাক, তর্কাতর্কি করে ভিড় জমিয়ে লাভ নেই। কমল বেরিয়ে এল ক্লাব থেকে।
বাসে দমবন্ধ ভিড়ে কমল মাথার উপরের হাতল ধরে দাঁড়িয়েছিল। সামনেই মাঝবয়সী একটি লোক বার বার তার দিকে তাকাতে তাকাতে অবশেষে বলল, আজ খেলা ছিল বুঝি?
হ্যাঁ।
কী রেজাল্ট হল?
বুকের মধ্যে ডজনখানেক উঁচ ফোটার ব্যথা কমল অনুভব করল। ভাবল, না শোনার ভান করে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু লোকটির প্রত্যাশাভরা মুখটি অগ্রাহ্য করতে পারল না। আস্তে বলল, ফোর নীল। তারপর বলল, হেরে গেছি।
লক্ষ করল, সঙ্গে সঙ্গে লোকটির মুখ বেদনায় কালো হয়ে গেল। ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। কমলের দিকে আর মুখ ফেরাল না। মুঠোর মধ্যে হাতলটা দুমড়েমুচড়ে ভেঙে ফেলতে চাইল কমল। হয়তো এই লোকটি তার দশ কি বারো বছর আগের খেলা দেখেছে। তারপর নানান কাজে জড়িয়ে পড়ে আর মাঠে যায় না। কিন্তু মনে করে রেখেছে কমল গুহর খেলা। হয়তো একদিন এই লোকটিও তাকে কাঁধে তুলে মাঠ থেকে টেন্টে বয়ে নিয়ে গেছে খেলার পর।
ভাবতে ভাবতে কমল নিজের উপরই রাগে ক্ষোভে আর অদ্ভুত এক অপমানের
জ্বালায় ছটফট করে বাস থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি ফিরল।
পরদিন অফিসে নিজের চেয়ারে বসতেই চোখে পড়ল, খড়ি দিয়ে তার টেবলে বড় বড় অক্ষরে লেখা: ৪–০া এবং যুগের যাত্রীর সঙ্গেও এই রেজাল্ট হবে।
কমল কিছুক্ষণ টেবলের দিকে তাকিয়ে রইল। লেখাটা মুছল না। চ্যাংড়াদের কাজ। মুছে ফেলুন কমলবাবু। বিপুল তার টেবল থেকে ঝুঁকে বলল!
না থাক। কমল ম্লান হাসল।
আপনি বরং যুগের যাত্রীর দিন খেলবেন না।
কমল শোনা মাত্র আড়ষ্ট হয়ে গেল। বিপুল তার শুভার্থী। বিপুল চায় না সে আর অপমানিত হোক। বিপুল ধরেই নিয়েছে, সে পারবে না যুগের যাত্রীকে আটকাতে, তাই বন্ধুর মতোই পরামর্শ দিয়েছে। কমল মুখ নামিয়ে বলল, আমার ওপর কনফিডেন্স নেই আপনার?
না না, সে কী কথা। আমি তো খেলাটেলা দেখি না, বুঝিও না। তবে আজকালকার ছেলেপুলেরা, বোঝেনই তো, মানীদের মান রাখতে জানে না।
কিন্তু আমি যাত্রীর সঙ্গে খেলব। কমল দৃঢ়স্বরে বলল। আমাকে অন্য কারণেও খেলতে হবে।
এক ঘণ্টা পরেই বেয়ারা একটা খাম রেখে গেল কমলের টেবলে। খুলে দেখল, মেমোরান্ডাম। গতকাল অফিস ছুটির নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কমল বিভাগীয় ইনচার্জের বিনা অনুমতিতে অফিস ত্যাগ করার জন্য এই চিঠিতে তাকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। এ রকম আবার ঘটলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমল দেখল, চিঠির নীচে রথীনের সই। চিঠিটা ভাঁজ করে খামে রাখার সময় লক্ষ করল, রণেন দাস মুচকি মুচকি হাসছে। কমল মনে মনে বলল, ব্যালান্স, এখন আমার ব্যালান্স রাখতে হবে যে।