সোনার হরিণ -1
” সে যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।
সে যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁধা। “
সত্যিই কোনো এক অদ্ভূত ধাঁধায় বাস্তবের সোনা সোনার হরিণের মতোই তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে যেনো কোনো অদ্ভূত আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে। সুবর্ণর পঁয়তাল্লিশ বছরের বর্ণময় জীবনে অনেক কিছু পাওয়ার মধ্যেও বিশেষ কিছু না পাওয়ার এক অনন্ত অতৃপ্তির বেদনা তাকে বিবশ করে। সোনাকে না পাওয়ার ব্যথা তাকে এখনো কুরে কুরে খায়। ঘর থেকে দূরে এই নিরালা নির্জনে শীতল কুঞ্জের ছায়াবীথি তলে একাকী নির্জনতা উপভোগ করার অবকাশে তার সেই নিতান্ত বালক বয়সের স্মৃতি মেদুর সোনালী দিনগুলো কেমন করে যেনো উঁকি দিয়ে যায়। সুবর্ণ তন্ময় হয়ে স্মৃতির সরণি বেয়ে নির্দ্বিধায় পৌঁছে যায় ভাব জগতের এক অনন্য মায়ায়।
সুবর্ণ তার জীবনের পঁয়তাল্লিশ টা বছর পার করে ফেলেছে। জেলা জজের দায়িত্ব নিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দায়িত্বশীলতা নিয়মানুবর্তিতা ও বিচক্ষণতার জন্য খ্যাতি প্রতিপত্তি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সে নতুন জেলার ডিভিশনাল টাউন পূর্ব মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত শহরে জেলা জজের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন সমৃদ্ধশালী তাম্রলিপ্তই বর্তমানে তমলুক নামে পরিচিত। এখানেই একান্নপীঠের অন্যতমা পীঠদেবী দেবী বর্গভীমার পীঠস্থান। বহু প্রাচীন জাগ্রত দেবী। শঙ্কর আড়া, পদুমবসান, কলেজ পাড়া, কোর্ট পাড়া,মাণিকতলা, হাসপাতাল মোড় ইত্যাদি নিয়েই আধুনিক তমলুক শহর।
জেলা জজের দায়িত্ব নেবার পর থেকে সুবর্ণের পরিশ্রম বহুগুণে বেড়েছে। বলতে গেলে দিনরাত পরিশ্রমে তার সুগঠিত শরীরেও ক্লান্তি দেখা দেয়। আর সেই ক্লান্তি দূর করতেই সে গঙ্গা আর রূপনারায়নের সংযোগ স্থলের কাছে এই বাংলোতে চলে আসে শনি রবি ছুটির দিনে। ছুটি কাটিয়ে এক মুঠো তাজা বাতাস বুকে ভরে সে তার কর্মস্থলে ফিরে যায় নতুম উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। এখানে গঙ্গা আর রূপনারায়ণের সংযোগ স্থলে যেখানে বিপুল জলরাশি সঙ্গমের অসীম পুলকে কলকল ছলছল শব্দ তুলে দূর দিকচক্রবালে বিলীয়মান আকাশকে স্পর্শ করে, বিপুল উন্মাদনায় জল যেখানে ক্রমাগত ঘুরপাকে ঘুরে চলে, সেই সঙ্গমস্থলের কাছাকাছি একপারে ছবির মতো সুন্দর ছিমছাম এক বাংলো, বিশাল জায়গা জুড়ে। আর সেই বাংলোর চৌহদ্দির মধ্যেই তার ভালো লাগার বিভাস ভূমি শীতলকুঞ্জ। বাংলোর চৌহদ্দির মধ্যেই বিশাল বাগান, আর সেই বাগানের একধারে স্বর্ণচাঁপা, মাধবীলতা আর টেম্পেল ঝাউ দিয়ে ঘেরা অসাধারণ সুন্দর এক সাজানো কুটির, নাম শীতলকুঞ্জ। এখানে আসলেই নদী থেকে ধেয়ে আসা হু হু হাওয়ায় শরীর মন যেমন স্নিগ্ধ হয়,তেমনি দিগন্ত বিস্তৃত নদীর জলকল্লোল মনকে করে তোলে আনমনা উদাসী। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের বিভায় সম্মোহিত। এই নিরালা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যই সুবর্ণকে বারে বারে টেনে আনে এখানে।শহরের কোলাহল থেকে দূরে নদীতীরের ছায়াঘন পরিবেশ যেন তাকে নতুন প্রাণের ঈশারায় সম্মোহিত করে ডেকে আনে এই মায়া বিতানে। এখানে পা দিলেই তার ” পুরানো সেই দিনের কথা ” মনে পড়ে যায়। এখানে পা দিলেই সে উদাসী হাওয়ায় বিন্দাস হয়ে যায়।
সুবর্ণর খাস ভৃত্য বনমালী তার সঙ্গী। রান্না বান্না থেকে শুরু করে সাহেবের দেখভালের সমস্ত দায়িত্ব ই তার কাঁধে। সে তার সাহেবকে যেমন ভালোবাসে তেমনই শ্রদ্ধা করে। এই বাংলোর আকর্ষণ তার কাছে একটু বেশীই, কারণ এখান থেকে সামান্য দূরে নন্দকুমারে তার গ্রামের বাড়ি। এখানে আসলে, সাহেবকে বলে, সে একবেলার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ঘুরে আসতে পারে। সাহেব না বলে না।
শনিবার গোছগাছ করে তমলুক থেকে আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। বিকেলের টিফিন আর রাতের খাবার তৈরী করে গুছিয়ে রেখে বনমালী সাহেবের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেছে তার নন্দকুমারের বাড়িতে। সুবর্ণ রাতের খাবার আটটার মধ্যে খেয়ে নিয়ে টর্চহাতে বাংলো থেকে শীতলকুঞ্জের দিকে বেরিয়ে পড়ে। এখানে লেখালেখির জন্যে টেবিল চেয়ার পাতা আছে, একটা ডিভান আছে, আর আছে খুব সুন্দর একটা ইজি চেয়ার। খুব পছন্দের সেই ইজিচেয়ার টেনে নিয়ে নদীর দিকে মুখ করে সে দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে উদাসী হয়।একসময় তার নজরে পড়ে তার সামনে দিগন্ত বিস্তৃত জলরেখা কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলো। গাছেরা পাতা নাড়ানো বন্ধ করে দিলো পরক্ষণেই বুঝলো সামগ্রিক পরিবেশ কেমন থমথমে হয়ে উঠছে। বহুদূর থেকে বাতাসের তীব্র সোঁ সোঁ শব্দ ভেসে আসে, তুমুল বেগে তীব্র ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ে, সঙ্গে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। এমন আকস্মিকতায় সে হতচকিত হয়। বাংলোয় ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। সুবর্ণ একই জায়গায় ঠায় বসে থাকে সেই ইজিচেয়ারে। দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝে বৃষ্টির ফোটা উড়ে আসছে গায়ে। তার ভালো লাগছে, ভীষণ ভালো লাগছে। ধরণী শান্ত হচ্ছে, স্নিগ্ধ হচ্ছে, পবিত্র হচ্ছে। মধুর আবেশে সুবর্ণর চোখ দুটো জড়িয়ে আসে, সে যেন এক অদ্ভূত মায়া নিদ্রায় অভিভূত হতে হতে গভীর প্রশান্তিতে ডুবে যেতে থাকে।
নিদ্রার গভীরে ডুবে যেতে যেতে সে শুনতে পায় যেনো বহু যুগের ওপার হতে অপূর্ব এক রিমঝিম নুপুর ধ্বনি তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করছে। রিমঝিম বৃষ্টি ধারার সাথে সেই নুপুর নিক্কণ যেনো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ঘুমের অবচেতনে সে যেনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেঘপরীদের দেশ থেকে অপূর্ব এক সুন্দরী, অবগুণ্ঠনবতী অপ্সরা প্রমত্ত বাতাসে তার এলায়িত কেশদাম ভাসিয়ে দিয়ে নেমে আসছে মাটির এ ধরণীর বুকের উপরে। ঠিক যেনো সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মেখে নদী তীরে, শীতলকুঞ্জ পারে একাকী উন্মনা এক নারী, তার আলুলায়িত কেশদাম যেনো সত্যিকার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। তবে অবগুণ্ঠনবতী বলেই বোঝা গেলো না, মুখে তার শ্রাবস্তীর কারুকাজ ছিলো কিনা।
তবুও সে সেই নিশীথে যেনো স্পষ্ট শুনতে পায়, সেই নিশীথিনী গাইছে অপূর্ব সুরে,
” দাও আকুলিয়া ঘন কালোকেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ–
কাজল নয়নে, যূথীমালা গলে, এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে। “
স্বপ্নের গভীরে তলিয়ে যেতে যেতে, সুবর্ণও গুণ গুণ করে গেয়ে ওঠে,
“মল্লার গানে তব মধুস্বরে দিক বাণী আনি বনমর্মরে।
ঘন বরিষণে জল কলকলে এসো নীপবনে ছায়া বীথিতলে।”
সুবর্ণর আকুল আহ্বানে সেই সুন্দরী অবগুণ্ঠনবতী তার এলায়িত কেশদাম নিয়ে লীলায়িত ছন্দে নেমে আসে মেঘের মিনার থেকে শীতলকুঞ্জের ছায়াবীথিতলে। অপূর্ব স্বপ্নময় ছন্দে সে এগিয়ে আসে সুবর্ণের দিকে।তার নুপুরের ছন্দে সেই বনভূমি নিনাদিত হয়, স্পন্দিত হয় নিশীথের হৃদস্পন্দন। এক নিবিড় মুগ্ধতায় সুবর্ণের সারাটা মনপ্রাণ আমোদিত হয়। সে প্রাণপনে চেষ্টা করে রহস্যময়ী সুন্দরীর মুখের আবরণ উন্মোচন করতে। কিন্তু কি আশ্চর্য! সে কিছুতেই কেনো রহস্যময়ীর কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারছে না। সে যে হাত বাড়িয়েও নাগাল পাচ্ছে না, এই কি সেই সোনার হরিণ? সে ভাবে এ বুঝি চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা, নাগাল ফেলে পালায় ঠেলে লাগায় চোখে ধাঁধা! ঠিক এমনি সময়ে দমকা হাওয়ায় খসে পড়ে রহস্যময়ীর মুখের আবরণ।
সুবর্ণ চমকে ওঠে, বিস্ময়ের ঘোরে বলে, সোনা! তুমি! তুমি কোথা হতে নেমে এলে এই ঘনঘোর বরিষণ রাতে, মেঘপরীদের বেশে, চলে এলে আমারি এ কুঞ্জের দ্বারে। কোথায় ছিলে? কত যে খুঁজেছি তোমাকে, অন্তরে বাহিরে, দেশে দেশান্তরে। আজ এই শ্রাবণের শিহরণে ঘনঘোর বরিষণে এলে যেনো বিপুল আনন্দভারে, হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে। এসেছ যখন,
“আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি,সখী, অধরে নয়নে, উঠুক চমকি আজি ক্ষণে ক্ষণে। “
যে সোনাকে পাবার এক ব্যাকুল বাসনায় তার হৃদয় সর্বদা হাহাকার করে, সেই হারিয়ে যাওয়া সোনা তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সন্ধ্যার মেঘমালার মতো, তার সাধের সাধনার মতো। বিস্ময়ে তার বাক রোধ হয়ে আসে।চেতনার বিলুপ্তি তার শিরায় শিরায় অস্থি মজ্জায় ছড়িয়ে পড়ে।
পুব আকাশে ঊষার আভাস ফুটে ওঠে। গত রাতের ঝড়ের মাতন আর ধারা বরিষণ স্তব্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। নবীন প্রাতে সোনার বরণী ঊষা সোনার রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত নদীর জল। সেই সোনালী জলের প্রতিচ্ছবি সুবর্ণের গায়ে মাথায় মুখে শরীরের সর্বত্র। তবু্ও সে বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে সেই ইজিচেয়ারে। সে তার স্বপ্নে সোনার পরশনে বিমোহিত হয়ে আছে মনে প্রাণে।
ঝড় বাদলের রাতে বনমালী যতই তার নন্দকুমারের বাড়িতে বসে থাকুক না কেন সাহেবের জন্য তার চিন্তা ছিল ই। সে জানে তার সাহেব যতই কর্ম দক্ষ হোক না কেন নিজের ব্যাপারে তিনি বড়ই উদাসীন। গতরাতে যে প্রলয়কাণ্ড ঘটেছে তাতে সে প্রমাদ গুণছে, সাহেব ঠিকমতো জানালা দরজা বন্ধ করেছে তো? বিছানাপত্তর মায় সাহেব নিজে ভিজে একসা হয়ে যায়নি তো? চিন্তায় চিন্তায় অন্ধকার থাকতে থাকতেই সে বেরিয়ে পড়ে সাহেবের বাংলোর উদ্দেশ্যে।
বাংলোতে ঢুকে বনমালী অবাক হয়ে যায়, ড্রইং, ডাইনিং, লিভিং সব রুমেরই দরজা হাট করে খোলা।কেয়ার টেকার বাবুর্চি কারোরই কোনো পাত্তা নেই। মনে মনে ভাবে সবাই তাহলে তারই মতো সাহেবকে বলে কয়ে ছুটি ম্যানেজ করেছে। তা করুক, কিন্তু সাহেব কোথায়! সে ভাবে সাহেব হয়তো ভোরে উঠে প্রিয় জায়গা নদীর পারে বেড়াতে বেরিয়েছে। সে সাহেবের জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করে।ডাইনিং টেবিল সাজায়, সবকিছু রেডি করে সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
কিন্তু আটটা বেজে যাওয়ায় পরে সে অস্থির হয়ে ওঠে। মর্ণিং ওয়াকে বেরিয়ে সাহেব কখনো এতো দেরি করে না। সে সোজা শীতলকুঞ্জের দিকে এগিয়ে যায়। সে জানে ওই শীতলকুঞ্জের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা নদীর চরের দিকে নেমে গেছে ওটা সাহেবের খুব প্রিয় জায়গা।
বৃষ্টিতে ভেজা সুবর্ণের সেই ছেলেবেলাকার নেশা। কিন্তু গতকালের আচমকা ঝড়বৃষ্টি অনেকদিন পরে সে মনেপ্রাণে উপভোগ করেছে। সে ভিজতে ভিজতেই গাইছিল, ‘ ঝড় যে আমার কেশে বেশে করছে মাতামাতি” তারপর সে আরাম কেদারায় বসে ঝড়বৃষ্টি উপভোগ করতে করতেই এক মায়াবী স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে গেছিলো। সেই স্বপ্নের রেশ এখনো তার অনুতে পরমাণুতে মিশে আছে। যে সোনা তার হৃদয়ের গভীর গোপন কোনে সযত্নে লুকানো ছিল, সেই সোনা প্রাকৃতিক দুর্যোগের এক প্রলয় রাতে মনের মাধুরি নিয়ে সুন্দরী অপ্সরী বধূর সাজে এসেছিল। তার সেই সুমধুর সঙ্গ তার প্রতিটি অঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে আছে। সেই মধুর স্বপ্নের আবেশে এতো বেলা পর্যন্ত আরামকেদারায় সে বিভোর। সোনার সঙ্গসুধায় বিমোহিত সুবর্ণর মুখে স্মিত হাসির রেখা।
বনমালী দাদাবাবু, দাদাবাবু বলে বারবার ডাকতে থাকায় সুবর্ণের ঘুম পাতলা হতে থাকে। তবুও তার কানে দূর থেকে যেনো সোনার গলার সুর ভেসে আসে–
” ওগো, বাতাসে কী কথা ভেসে চলে আসে, আকাশে কী মুখ জাগে।
ওগো, বনমর্মরে, নদীনির্ঝরে কী মধুর সুর লাগে।
ফুলের গন্ধ বন্ধুর মত জড়ায়ে ধরিছে গলে–
আমি এ কথা, এ ব্যথা, সুখ ব্যাকুলতা কাহার চরণতলে দিব নিছনি”—–
স্বপ্নের সোনা মেঘের আড়ালে মিলিয়ে যায়। সুবর্ণ আস্তে আস্তে চোখ মেলে চায়। ধাতস্থ হতে বেশ কিছুটা সময় নেয়। নিজের অবস্থান, পদমর্যাদা, সময়-জ্ঞান, স্থান, কাল, পাত্র সবই একে একে ফিরে আসতে শুরু করে। বনমালী অতি শান্ত ভাবে বলে, দাদাবাবু আপনি কি কাল সারারাত এখানেই ছিলেন?
সুবর্ণ বলে, বনমালী, ব্রেকফাস্ট এখানে আনতে পারবি?
বুদ্ধিমান বনমালী কথা বাড়ায় না, সে ব্রেকফাস্ট আনতে চলে যায়।
আজ সুবর্ণর কি হয়েছে সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না।তার সেই কোন বাল্যকালের খেলার সাথী, সেই হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়া মনের সাথী, সেই কোলে বসিয়ে আদর করে গল্প বলার সোনার সাথী, সেই খাদ না মেশানো সোনার বরণী খাঁটি সোনা, তার সমস্ত অনুভূতির প্রাণকেন্দ্রে, তার শরীরের প্রতিটি শিরায় উপশিরায়, তার প্রতিটি প্রশ্বাস বায়ুতে পরতে পরতে আজও এমন ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। সে বিস্মিত হয় এইভেবে যে, যে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বহুকাল আগে, তার জন্য এতো অশ্রুজল জমা ছিল তার অন্তরে!
সুবর্ণ মনে মনে বলে,
” তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখ সুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গানতো গাইনি।”
রবিঠাকুরের গানে সে যেনো প্রাণের আরাম খুঁজে পায়। কালের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে অতীত ঠিক কতদিন আগে নীরব হয়েছে সে কথা আর মনে পড়েনা, তবু তার মনে হয় অতীত যদি চুপ হয়েই যায়, কীভাবে সোনা তার স্বপ্নে এসে উঁকি দিয়ে যায়! সে কি তাহলে সারাজীবন ধরেই সোনাকে চেয়ে এসেছে? সেই জন্যেই কি তার জীবনে অপ্রাপ্তির একটা হাহাকার রয়ে গেছে!
বনমালী জলখাবার দিয়ে গেছে শীতলকুঞ্জেই। নিতান্ত অন্যমনস্ক হয়ে নাড়াচাড়া করে তার কিছুটা সে গলাধঃকরণ করেছে, তারপর সেই ইজিচেয়ারেই সে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে আবার অতীতে ডুবে যায়।
সুবর্ণের তখন কতই বা বয়স, পনেরোর গণ্ডী ও ভালো করে পেরোয়নি। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হয়েছে,অখণ্ড অবসর। খেলা ধূলার সাথে সাথে ছোট নাটক৷ গীতি আলেখ্য, নৃত্য নাট্য কত কি করত ওরা। ঝর্ণা, রীণা, কৃষ্ণা, মীনা আর সোনাও থাকতো সেই দলে। সোনার নাচের সাথে রবিঠাকুরের একটা গান ছিলো,
” নাই নাই ধুলি মোর অন্তরে।
দেবতা ওগো, তোমার সেবা আমার ঘরে।
ফুল বলে, ধন্য আমি, ধন্য আমি মাটির ‘পরে”।
সোনা তো ফুলের মতো ই সুন্দর, প্রথম থেকেই। সোনার সেই আকুল করা নৃত্যভঙ্গী আজও তার মনে সুরের মূর্ছনায় বিভাসিত হয়। তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে না পাওয়াটাই কি তার সমস্ত অতৃপ্তির মূল কারণ? সোনা তো তাকে কোন সকালেই ডাক পাঠিয়েছিল, সে নিজে বরং সে ডাকের মর্মার্থ বুঝতে পারেনি। আজ সে মনে মনে প্রায়শ্চিত্তের মতো করে বলে, বিশ্বাস করো সোনা, তোমার সে আকুল করা আহ্বানের মানে আমার কাছে স্পষ্ট ছিলো না সেদিন। আর সেইজন্যই আজ কতো কিছু থাকা সত্ত্বেও আমি কতো অসুখী, কতো অতৃপ্ত, কতখানি দিশেহারা আর জীবন যন্ত্রণায় কতটা কাতর।
বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, শত্রু, মিত্র সবাই বলে এতো অল্পবয়সে ডি এম! কতো সুখী! সে ভাবে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে সে সুখী ই তো। টাকা, পয়সা, গাড়ি, বাড়ি, সুন্দরী বউ, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে ছেলে মেয়ে, সে সুখী নয়তো সুখী কে? ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসে সুবর্ণ। মনে মনে বলে, সুখ কারে কয় বিধাতা? উত্তর টা সে ই সাজায়। কেউ দৈহিক সুখে সুখী, কেউ মানসিক সুখে সুখী, আর ভাবে, অন্যকে দুঃখ না দিয়ে যে আনন্দ সেটাই আসল সুখ। বক রূপী ধর্ম যখন যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেছিল, সুখী কে? যুধিষ্ঠিরের উত্তর ছিলো, অঋণী, অপ্রবাসী, যে ব্যক্তি দিনান্তে নিজ গৃহে শাকান্ন গ্রহণ করেন তিনিই সুখী। আর ধনী কে? যুধিষ্ঠির বলেছিল, যে ব্যক্তি অতীত বা অনাগত সুখ, দুঃখ, প্রিয় অপ্রিয় সমতুল জ্ঞান করেন তিনিই সকলের মধ্যে ধনী।
সুবর্ণ মহাভারত থেকে নিজের জগতে ফিরে আসে। সে অঋণী নয়, কলকাতার ফ্ল্যাট এর ই এম আই তাকে আরও পনের বছর টানতে হবে
সে অপ্রবাসী ও নয় , তাকে নিজের দেশের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে, না ছেড়ে উপায় ও ছিলো না, দেশের বাড়ি এখন সুনসান।
সেই কোন বাল্যকাল থেকেই সুবর্ণ বড় স্নেহের কাঙাল– ভালোবাসার ভিখারি। ওদের সেই গ্রামের বাড়িটার চারপাশ টা ছিলো কত মনোরম। পাড়ার লোকেরা আত্মীয় না হয়েও কত নিকটাত্মীয়। সুবর্ণদের বাড়িটার নাম ছিলো বড়ো বাড়ি। ওর বাবার ঠাকুরদাদার বাবা ছিলো বড়োকর্তা। গ্রামের মাথা, সেই থেকে ওদের বাড়িটা বড়ো বাড়ি নামেই পরিচিত। ওদের বাড়ির সব সন্তানই বংশের বড়ো সন্তান, সেটাও বড়ো বাড়ি নামকরণের অন্যতম কারণ। ওদের বাড়ির চারপাশে চারটে পুকুর ছিলো, সেইরকম একটা পুকুরের ওপারে ছিলো সোনাদের বাড়ি।সোনার বাবা ছিলো সৌম্যদর্শন ঋজু ও রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। আর মা ছিলো অসাধারণ সুন্দরী। অমন দুধে আলতা রঙ পাড়ায় আর কারোরই ছিলো না। এই দুই সুন্দর মানুষের প্রথম সন্তান সোনা।যেমন সুন্দরী তেমনই আদুরী। আর কাউকে কোলে না নিলেও সোনাকে কোলে নিতেই হবে।গান শোনাতে হবে, গল্প বলতে হবে। কোনো দিন কোলে নেবোনা বললে, সোনার মুখটা লাল হয়ে থমথমে হয়ে যেতো, যতক্ষণ না তাকে কোলে তুলে আদর করা হচ্ছে ততক্ষণ সেই থমথমে ভাব কাটতো না। সোনা সুবর্ণের থেকে প্রায় দশ বছরের ছোট হলে কি হবে সেই ছোট বেলা থেকে সোনা সুবর্ণের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু শুধু মাত্র জড়িয়ে গেলেই তো হবেনা। নিজেকে সোনার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই বড়ো হবার তাগিদেই প্রথম সুযোগে ই বাড়ি ছাড়ে সুবর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি নিয়ে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে চলে যায় বিহারে দ্বারভাঙ্গা জেলায়, বেশ কিছুদিন বাদে বদলী হয়ে আসে দার্জিলিং এ। তারপর রায়গঞ্জ হয়ে বর্তমানে তমলুক এ। নানান চাকরি ছেড়েছে, আরো ভালো কিছুর আশায়। প্রচন্ড ব্যস্ততায় কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।