সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : ২৩
গেজেটের পাতায় ছাপা নামগুলোর ওপর বাপী অনেক বার চোখ বুলিয়ে গেল। ব্যাপারখানা অপ্রত্যাশিত ধাক্কার মতোই। ইতিহাসে এম. এ-র সফল ছাত্রছাত্রীদের নামের মিছিল খুব লম্বা নয়। কিন্তু ফার্স্ট বা সেকেন্ড কোনো ক্লাসে কোনো গ্রুপে যে-নাম খুঁজছে সেটা একেবারে নেই-ই। মালা আছে, মালঞ্চ আছে, মালবী আছে—নন্দী ছেড়ে কোনো মালবিকারও অস্তিত্ব নেই।
গেজেট ফেলে বাপী হাঁ খানিকক্ষণ। এমন একটা ধাক্কা খাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে বানারজুলি থেকে শিলিগুড়ি ছুটে আসেনি। আসতে আসতে বরং অন্য রকমের সম্ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।…মেয়ে বি. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পায়নি। প্রথম তিনজনের মধ্যেও জায়গা হয়নি। এম. এ-তে না যুঝে ছাড়বে না বাপী ধরেই নিয়েছিল। গাড়ি ছুটিয়ে আসার সময় বাপীর চিন্তায় এম. এ-র ফয়সালাটা ফার্স্ট ক্লাসের দিকে ঝুঁকছিল। আর সেই কারণে কেন যেন একটু অস্বস্তিও বোধ করছিল। সেটা ঠিক ঈর্ষা বলে মানতে রাজি নয়। এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বসলে নাগালের ফারাকটা আরো বেশি লম্বা মনে হবে বাপী তা-ও স্বীকার করে না। অস্বস্তির একটা যুৎসই কারণ নিজেই হাতড়ে বার করেছে। ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বসলে মিষ্টির অনেকখানি হয়তো মালবিকা হয়ে যাবে।
…ফার্স্ট ক্লাস যদি পায়ই, বাপীর এবারের টেলিগ্রামের বয়ান কি হবে তা নিয়েও মাথা ঘামিয়েছিল। তারপর ঠিক করেছে, যে-ক্লাসই হোক, ওর কাছ থেকে এক শব্দের অভিনন্দন যাবে। ফিরেও আসবে তেমনি এক শব্দের ধন্যবাদ, জানা কথাই। কিন্তু ধন্যবাদের পর এবার সেই মেয়ে মালবিকা লিখবে না মিষ্টি লিখবে?
এত সব চিন্তা-ভাবনার পরে এই! নামই নেই! কি হল? কি হতে পারে?
হতে অনেক কিছুই পারে। পরীক্ষা দিয়েও কত ফেল করে। কিন্তু মনে মনে মাথা ঝাঁকিয়েই বাপী সেই সম্ভাবনা বাতিল করে দিল। ফেল করার মেয়ে নয়। পরীক্ষার পড়া পছন্দমতো না হলেও অনেক ভালো ছেলে-মেয়ের ড্রপ করার ভূত চাপে মাথায়। সেটা বরং হতে পারে। এছাড়া আর এক সম্ভাবনার কথা মনে আসতেই ভিতরে গনগনে আগুনের ছেঁকা।
‘…বি. এ, এম. এ. পাশ করা দূরে থাক, ওই মেয়েকে ম্যাট্রিকও পাশ করতে হবে না বলে দিলাম।’
এক যুগেরও আগের সবজান্তা আবু ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিল। ফকির—জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎ বচনের জবাবে মিষ্টির সম্পর্কে আবু এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।
তার যুক্তিও কম যুৎসই নয়।—এই বয়সেই —এই বয়সেই চেহারাখানা দেখছিস না মেয়েটার, ষোল-সতের বছরের ডবকা বয়সে এই মেয়ের চেহারাখানা কেমন হতে পারে চোখ বুজে ভেবে দেখ দিকি? তারপর আবু ব্যাখ্যা শুনিয়েছিল।— সেই বয়সে কোনো না কোনো বড় লোকের ছেলের চোখ পড়বেই ওর ওপর। বিয়ে করে ঘরে এনে পুরবে তারপর লুটে-লুটে শেষ করবে—বি. এ. এম. এ. পাশের ফুরসৎ মিলবে কোত্থেকে?
…তবু বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত অন্তত ফুরসৎ মিলেছিল। কিন্তু তার পরেও বাপী নিশ্চিন্ত ছিল কোন্ ভরসায়? একটানা আরো দুটো বছর ওই সম্ভাবনাটা হেঁটে দিয়ে বসে ছিল কি করে? দু বছর আগে অভিনন্দনের জবাবী টেলিগ্রামে ‘মালবিকা’র বদলে মিষ্টি লিখেছিল বলে?
…পীর ফকির ওর মা-কে অন্ন দেখে ঘি আর পাত্র দেখে ঝি দেবার শ্লোক বলেছিল। ওই মেয়ে কোন পাত্রের খপ্পরে পড়ে আছে সেটা নিজের চোখে দেখে আসেনি? দু’বছর আগে বি. এ-র রেজাল্ট দেখে ঘটা করে টেলিগ্রাম না পাঠিয়ে নিজেই কলকাতায় ছুটে গেল না কেন? যা-হোক কিছু হেস্তনেস্ত করে এলো না কেন? গায়ত্রী রাইয়ের দৌলতে দু’বছর আগেই তো ভাগ্যের চাকা বেশ জোর তালে ঘুরতে শুরু করেছিল। তারপরেও দিবাস্বপ্নে দিন কাটিয়ে দিল কেন? বাপী কি ভেবেছিল ভাগ্যের একেবারে চূড়ায় উঠে বসতে না পারা পর্যন্ত ছপ্পরফোঁড়া কোনো মন্ত্রের জোরে সেই মেয়ে তার জন্য হাঁ করে বসে থাকবে?
নিজের বয়েস এখন ছাব্বিশের প্রায় ওধারে। মিষ্টির তাহলে বাইশ তো বটেই। টানা বারো বছরের মধ্যে চার বছর আগে মাত্র দুটো দিন বাপীকে দেখেছে, চিনেছে। তা সত্ত্বেও ওই মেয়ের জগতে নিজেকে এক অমোঘ দুর্বার পুরুষ ঠাওরে বাপী একে একে দুটো বছর পার করে দিল!
এই আবেগের গালে ঠাস ঠাস করে গোটাকয়েক চড় বসালো বাপী। তাইতেই একটা সংকল্পের শর জ্যা-মুক্ত হয়ে ঠিকরে বেরুলো!
কলকাতায় যাবে।
কিন্তু যাবে ঠিক করলেই পাঁচ-সাত-দশ দিনের জন্য কোথাও বেরিয়ে পড়া আগের মতো অতটা সহজ হয় না এখন। এক বছর আগেও ব্যবসা বাড়ানোটাই বোধ হয় গায়ত্রী রাইয়ের জীবনের সব থেকে বড় লক্ষ্য ছিল। সেই উৎসাহে একটু একটু করে ভাটা পড়ছে বাপী সেটা অনুভব করতে পারে। দেহ নিয়ে মহিলার শান্তি নেই খুব, সেটাই হয়তো বড় কারণ। কিন্তু অশান্তির কথা মুখ ফুটে বড় একটা বলে না। বরং বেশির ভাগ সময় চাপা দিতে চেষ্টা করে। জিগ্যেস করলে বলে, ভালো আছি। আবার বেশি জিগ্যেস করলে বিরক্তি। ভালো আছি, এই জোরের ওপর থাকার চেষ্টা। কেমন ভালো আছে বা কতটা ভালো আছে বাপী তা বুঝতে পারে। ওর এই বুঝতে পারার আবেগের দিকটা খুব চাপা।
গায়ত্রী রাইয়ের প্ল্যান মতোই ব্যবসার সাজ বদল হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার এমন কি উত্তর বাংলারও বিশেষ বিশেষ জায়গায় মোটা মাইনের অভিজ্ঞ ম্যানেজার বহাল করা হয়েছে। সকলের মাথার ওপর জেনারেল ম্যানেজার ও পার্টনার বাপী তরফদার। ফলে বাপীর লম্বা লম্বা টুর প্রোগ্রামের ছাঁটকাট বাড়ছে। পাঁচ-সাত দিনের জন্য কোথাও বেরুতে চাইলেও গায়ত্রী রাই ভুরু কোঁচকায়!– এত লোকজন থাকতে তোমাকে এতদিনের জন্য গিয়ে বসে থাকতে হবে কেন? ফোনে খবর নেবে, ইনস্ট্রাকশন দেবে, তারপরও ইন্সপেক্শনের জন্যে যেতে হয় তো একদিন-দুদিনের জন্য এয়ারে যাবে আসবে।
বাপীকে তাই করতে হয়। কর্ত্রীর হুকুম এখনও হুকুমই। কোম্পানির খরচে তেল পুড়িয়ে বাদশা ড্রাইভার তাকে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ছেড়ে দিয়ে আসে বা সেখান থেকে নিয়ে আসে। ট্রেনের চার-পাঁচ গুণ খরচা করে এরোপ্লেনের টিকিট কেটে রাতারাতি বা একদিন-দুদিনের মধ্যে বাপীকে কাজ সেরে ফিরে আসতে হয়। কোনো কারণে ফিরতে দেরি হলে মহিলা খুব একটা জেরা করে না কিন্তু মায়ের চোখের আড়ালে মেয়ে এসে ধমকাতে ছাড়ে না। দেরি হতে পারে বুঝলে বলে যেতে পারো না বা ফোনে জানাতে পারো না? মুখ বুজে মায়ের ছটফটানি দেখলে আমার ভয় ধরে যায় বলেছি না তোমাকে?
এই ধমক কানের ভেতর দিয়ে যেখানে গিয়ে পৌঁছায় তার স্বাদ আলাদা। মহিলার এই নিরুত্তাপ নির্ভরতা বাপীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এই বাঁধনটুকু বড় লোভনীয়। কোনো স্বার্থের দাঁড়িপাল্লায় এর ওজন হয় না।
দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে রাতে খাবার টেবিলে বাপী সেদিন গম্ভীর মুখেই প্রস্তাব পেশ করল।—একবার কলকাতা যাওয়া দরকার।
খাওয়া ছেড়ে ঊর্মিলা বাপীর মুখখানা দ্রষ্টব্য ভাবছে। পশ্চিমবাংলা অর্থাৎ কলকাতা যে এ-ব্যবসার স্বর্গভূমি, গায়ত্রী রাই সেটা কারো থেকে কম জানে না। এক বছর আগের প্ল্যানেও কলকাতার বাজার বড় লক্ষ্য ছিল তার। তখন যাচাইয়ের তাগিদও বাপীকে দিয়েছে। কিন্তু সেই আগ্রহের ছিটেফোঁটাও নেই এখন। নিস্পৃহ মুখে জিগ্যেস করল, কেন?
—দেখেশুনে আসি…।
এক কথায় প্রস্তাব নাকচ করে দিল।—যেতে হবে না। নিজে কিছু দেখতে—শুনতে পারছি না, আর বাড়িয়ে কাজ নেই। একা কত দিক সামলাবে—
ব্যবসার স্বার্থ দেখিয়েই বাপী জোর করতে পারত। বাগডোগরা থেকে আকাশে উড়লে কলকাতা পঞ্চাশ মিনিটের তো পথ মাত্র। কিছুই বলা গেল না ঊর্মিলার জন্য। ওর ঠোঁটের ফাঁকে হাসি ঝুলছে। চোখে দুষ্টুমি চিকচিক করছে।
পরে হালকা ভ্রুকুটি করে বলেছে, হঠাৎ কলকাতা যাবার তাগিদ কেন আমাকে খোলা-খুলি বললে মায়ের কাছে একটু তদবির-টদবির করি—
বাপী গম্ভীর।—নিজের স্বার্থেই বলতে পারো।
অর্থাৎ, বাপীর কলকাতা যাওয়ার সঙ্গে ওরও নিষ্কৃতি লাভের যোগ। কিন্তু ওর কথা সাদা অর্থেও এমন লেগে যাবে যে সেটা কারো কল্পনার মধ্যে ছিল না। পরের তিন সপ্তাহের মাথায় ঊর্মিলার হৃদয়জগতে এমনি তোলপাড় কাণ্ড ঘটে গেল যে বাপীকে কলকাতা পাঠানোর জন্য ও নিজেই উন্মুখ।
এক সকালের দিকে নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে বাপী দূরের ধূসর পাহাড়টার দিকে চেয়ে ছিল। পাহাড়টা খুব দূরে নয়, কিন্তু সকালের হালকা কুয়াশার দরুন দেখাচ্ছে অনেক দূরে। ওই রকমই কিছু একটা স্থির লক্ষ্য বাপীর, কিন্তু ভিতরের অস্থিরতার দরুন যেন ওটাও ঝাপসা আর নাগালের বাইরে।…জঙ্গলের নাংগা ফকির বলেছিল, আগে বাড়লে পেয়ে যাবে। বাপী থেমে থাকেনি, সামনে এগিয়েছে। অনেক পেয়েছে। অনেক পাচ্ছেও। কিন্তু এই পাওয়াই শেষ লক্ষ্য হলে ভেতরটা সুস্থির থাকত, সামনেটা এত ঝাপসা দেখত না। বিত্ত বৈভব নিশ্চয় চেয়েছিল। কিন্তু সব চাওয়ার মূলে এক মেয়ে। সব থেকে বেশি চেয়েছিল সেই মেয়েকে। এই চাওয়ার সঙ্গে এখনো কোনো আপোস নেই। কিন্তু এই ব্যাপারে বাপী কতটা সামনে এগিয়েছে? কতটা আগে বেড়েছে?
ভিতরের একটা অসহিষ্ণু তাপ ঠেলে মাথার দিকে উঠতে লাগল। গায়ত্ৰী রাইকে যা-হোক কিছু বলে বা বুঝিয়ে দুই একদিনের মধ্যেই কলকাতা যাবে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর না।
নিজের ভাবনায় ছেদ পড়ল। সদর রাস্তা ছেড়ে ঊর্মিলা হনহন করে এই পিছনের মাঠ ভেঙে এদিকে আসছে। হাঁপাচ্ছে বেশ। বাপীর তক্ষুনি মনে হল, নিশ্চয় ডাটাবাবুর ক্লাবে গেছল। সেখান থেকে কিছু সংগ্রহ করে বাতাস সাঁতরে ওর কাছে আসছে। পিছন দিক দিয়ে ঘুরে আসার একটাই অর্থ। মায়ের চোখে পড়তে চায় না। বাপীকে জানলায় দেখে থমকে দাঁড়াল একটু। ফিক করে হেসে ফেলল। লালচে মুখ। তারপর ছোট মেয়ের মতোই ছুট্।
জানালা ছেড়ে বাপী সামনের বারান্দার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। শব্দ না করে গেট ঠেলে ঊর্মিলা লঘুছন্দের দ্রুততালে বারান্দায় উঠে এলো। মেয়ের মুখের এমন গোলাপী কারুকার্য দেখলে তার মায়েরও বড় রকমের সন্দেহ কিছু হতই। চোখে মুখে গালে ঠোটে খুশির বন্যা। উত্তেজনাও।
বাপী গম্ভীর।—বিজয় মেহেরা কবে ফিরছে?
হিসেবমতো আর মাস-খানেকের মধ্যে ফেরার কথা বিজয় মেহেরার। সেই সম্পর্কে পাকা খবর কিছু এসেছে বাপী নিঃসংশয়।
ঊর্মিলা থমকে দাঁড়াল। তারপর যা করল, এই উত্তেজনার মুহূর্তে ওর কাছে সেটা সংকোচের ব্যাপার কিছুই নয়। খুব কাছে এসে দুহাতে বুকে একটা ধাক্কা মেরে আগে বাপীকে দরজার কাছ থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। বাপী পড়তে পড়তে সামলে নিল। ততক্ষণে ঊর্মিলাও ঘরের মধ্যে। আনন্দ আর বিস্ময়ের ধকলে দু’চোখ কপালের দিকে।—আর কবে-টবে নয়, বাবুর ফেরা সারা।
শুনে বাপীরও হঠাৎ ফাঁপরে পড়ার দাখিল।—সে কি। কবে? কোথায় আছে?
বলতে গিয়েও ঊর্মিলা থমকালো। লালচে মুখের ওপর আর এক প্রস্থ লালের ছোপ। গরম জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে চিঠিটা বার করে ওর সামনে ধরল।— পাজী ছেলের দু’চারটে দুষ্টুমির কথাটথা আছে, কিন্তু তোমার কাছে আবার লজ্জা কি—পড়ে দেখো কি কাণ্ড!
বাপী গম্ভীর আবার। দুহাতে দুটো কাঁধে চাপ দিয়ে ওকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। টেবিলের ছোট আয়নাটা তুলে মুখের সামনে ধরল।
ঊর্মিলা হকচকিয়ে গেল একটু।—কি?
—গাল দুটো ফেটে এবারে খুশির রক্ত বেরুবে মনে হচ্ছে। আয়না যথাস্থানে রেখে মুখোমুখি খাটে বসল।—আমার পড়ে কাজ নেই, তুমি বলো।
যা শুনল, যে-কোনো মেয়ের মায়ের কাছে সেটা লোভনীয় হবার কথা। আরো তিন মাস আগে ওখানকার হায়ার কোর্স-এ বিজয় মেহেরা ভালো ভাবে উতরে গেছে সে-খবর আগেই এসেছিল। বুক ঠুকে সেখানকার এক মস্ত সংস্থায় ইন্টারভিউ দিয়েছিল। বম্বে আর কলকাতায় তাদের বিরাট শাখা। সেখান থেকে হোম-অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কলকাতায় উড়ে এসেছে সে। ও-ভাবে অ্যাপয়েন্ট—মেন্ট নিয়ে আসতে পারার ফলে খাস সায়েবদের গ্রেডে মাইনে, তাদের মতোই আনুষঙ্গিক সব সুযোগ-সুবিধে। এছাড়া দু’-বছরে একবার করে সপরিবারে হোমে ফেরার বা বাইরে বেড়ানোর ছুটি আর যাবতীয় খরচ-খরচা পাবে। কলকাতায় পা দিয়েই তাকে কাজে জয়েন করতে হয়েছে, আর শুরুতেই কাজের চাপ এত যে এয়ারে বাগডোগরা এসে ঊর্মিলার সঙ্গে একবার দেখা করে যাওয়ারও ফুরসৎ মিলছে না। এবারে বিয়ের তাগিদ। আর সবুর করার ধৈর্য নেই। সব ব্যবস্থা পাকা করে তাকে জানালেই সে ছুটির ব্যবস্থা করবে আর দেশে তার বাবা-মা-কেও চিঠি লিখে চলে আসতে বলবে।
ঊর্মিলা জিগ্যেস করল, এবারে?
সংকটই বটে। বাপী জবাব দিল, তাই তো ভাবছি…।
সঙ্গে সঙ্গে ঊর্মিলার সেই অবুঝ মেজাজ।—দু’বছরের ওপর তো বসে বসে শুধু ভাবলেই। এখন আর ভাবার সময় আছে?
বাপীর একটুও রাগ হল না। এই উদ্গ্রীব উৎকণ্ঠা দেখে বরং মায়া হচ্ছে। ভালও লাগছে। প্রেমের গাছে ফোটা একখানা সুন্দর ফুলের মতো মুখ ঊর্মিলার। সফল হবার বাসনায় অধীর, উন্মুখ। নিজের অদৃষ্টে যা-ই থাক, বাপীরও উদার হবার ইচ্ছে। চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল। জবাব দিল, একেবারেই নেই মনে হচ্ছে।
ঊর্মিলা আবারও মুখ-ঝাপটা দিল বটে কিন্তু অখুশি নয়। এখনো যদি তোমার কানে জল না ঢোকে তাহলে এবারে আমি ঠিক এখান থেকে সঙ্কান দেব বলে দিলাম!
—কোথায়…কলকাতায়?
আবার কোথায়। মুখের কথা খসার আগেই মনে পড়ল কিছু। উৎসাহের ঝোঁকে বসার চেয়ারটা আরো এক হাত কাছে টেনে আনার ফলে দুজনের হাঁটুর মাঝে চার আঙুলেরও কম ফারাক। সামনে ঝুঁকল।—এই। তুমি তো কলকাতা যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়েছিলে, কালই চলে যাও না? যাবে?
—তোমার মা-কে কে রাজি করাবে, তুমি?
—আমি কেন, ব্যবসার কথা বলবে না, বলবে নিজের খুব দরকারী কাজে যাচ্ছ। তুমি চলে যাবার পর মা-কে যা বলার আমি সাফসুফ বলে দেব।
—সাফসুফ কি বলে দেবে?
—যা সত্যি তাই। মিষ্টি নামে এক মেয়ে ছেলেবেলা থেকে তোমার মন কেড়ে রেখেছে—তার সম্পর্কে কিছু খবর পেয়ে তুমি ছুটে চলে গেছ। ব্যস, এই এক চালে মা মাৎ। যাবে?
বাপী চেয়ে রইল খানিক।—ঠিক আছে। যাব।
এত সুবোধ এই ছেলে নয়।—সত্যি বলছ?
—হ্যাঁ, তবে আমি ভেবেছিলাম বিজয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতে বলছ।
ঊর্মিলা কলে পড়ছে বুঝতে পারছে।–বা রে, তার সঙ্গে দেখা তো করতেই হবে, তা না হলে তোমাকে যেতে বলব কেন।
বাপীর নীরস মুখ, গলার স্বরেও তপ্ত ব্যঙ্গ ঝরল।—নিজের স্বার্থ ষোল আনা বজায় রেখে আমাকে গরম তেলের কড়ায় ফেলে মা-কে তুমি মাৎ করতে চাও, এটুকু বুঝতে আমার খুব অসুবিধে হয়নি।
ঊর্মিলা অপ্রস্তুত একটু। তাই চড়া গলা।—তোমার অত ভয়টা কিসের? মায়ের ছেলে নেই, তুমি গুটিগুটি দিব্বি ছেলের জায়গাটি জুড়ে বসেছো এখন— আমাকে ছাড়া যদিও চলে, তোমাকে ছাড়া আর তার চলেই না—সাহস করে সত্যি কথাটা বলে দিলে মা তোমার কি করবে?
একটা নরম জায়গায় মোচড় পড়ল। ঊর্মিলার কথাগুলো সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করার মতো। এটুকুর প্রতি বাপীর কত যে লোভ শুধু সে-ই জানে। ঊর্মিলা জোরের কথা বলছে, কিন্তু এটুকু হারাবার ভয়ও যে কত, ওর কোনো ধারণা নেই।
শিরে সংক্রান্তি। ভয় ছেড়ে বাপী জোরের দিকটাই আঁকড়ে ধরল। রাতে খাবার টেবিলে গম্ভীর। ঊর্মিলার মুখেও কোনো কথা নেই। এমন চুপচাপ ভাবটা খুব স্বাভাবিক ঠেকল না গায়ত্রী রাইয়ের চোখে। একজনের ঝাঁঝ দেখে আর অন্যজনের টিপ্পনী শুনে অভ্যস্ত। থেকে থেকে দুজনকেই লক্ষ্য করল। কিন্তু জিগ্যেস করল না।
খাওয়ার পরে গায়ত্রী রাই আগে ব্যবসার কোনো ফাইল-টাইল খুলে বসত, নয়তো দরকারী চিঠিপত্র লিখত। এ-কাজ অনেকদিন ছেড়েছে। এখন ঘুম না আসা পর্যন্ত বই-টই পড়ে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পাশ থেকে বইটা টেনে নেবার আগেই বাপী ঘরে ঢুকল। হাতের বই রেখে গায়ত্রী রাই আবার সোজা হয়ে বসল। অপ্রিয় কিছু শোনার আশঙ্কা।
বাপীর তেমনি ঠাণ্ডা মুখ।—কাল আমি একবার কলকাতা যাচ্ছি।
বক্তব্য শুনে স্বস্তি একটু। বিস্ময়ও। খানিক চেয়ে থেকে জিগ্যেস করল, কি ব্যাপার?
জবাব দেবার আগে বাপী দরজার দিকে ঘুরে তাকালো একবার। কেউ নেই। ঘরে ঢোকার সময় ঊর্মিলা দেখেছে। কোথাও থেকে আড়ি পেতে শুনছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাপী সোজাসুজি বলল, বিজয় মেহেরা লন্ডন থেকে ফিরেছে। যতটা আশা করেছিল তার থেকেও বড় হয়ে ফিরেছে, কলকাতায় বড় চাকরি নিয়ে এসেছে। একবার গিয়ে দেখেশুনে বুঝে আসা দরকার।
আচমকা প্রচণ্ড একটা ঘা খেলে যেমন হয় প্রথমে সেই মুখ গায়ত্রী রাইয়ের বিবর্ণ, সাদা। সেই সাদার ওপর রাগের লালচে আভা ছড়াতে লাগল। গলার স্বর অনুচ্চ তীক্ষ্ণ।—কে বিজয় মেহেরা? সে কত বড় হয়েছে বা কত বড় চাকরি নিয়ে এসেছে তা দিয়ে আমার কি দরকার?
কোনরকম উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটাও নেই বলেই বাপীর জবাবটা জোরদার শোনালো আরো। বলল, দরকার আছে। দু-তিনদিনের মধ্যে ফিরে এসে আপনাকে বলব। আপনাকে শুধু বিশ্বাস করতে হবে, আপনার বা ডলির কোনরকম ক্ষতির মধ্যে আমি যাব না—যেতে পারি না। উতলা হয়ে শরীর খারাপ করবেন না, বা আমি ফিরে আসার আগে এ নিয়ে ডলির সঙ্গে একটি কথাও বলবেন না।
গায়ত্রী রাই নির্বাক। চেয়ে আছে। এ-ছেলেকে বিশ্বাস করতে না পারলে পায়ের নিচে মাটি থাকে না। এ-কথা শোনার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিছুটা আশ্বস্ত অশান্তি যা-কিছু তার সবটাই নিজের মেয়েকে নিয়ে, এই ছেলেকে নিয়ে নয় এ—বিশ্বাসও অটুট। কলকাতায় যাতায়াতটা মেয়েকে ঠাণ্ডা করার জন্য বা অন্য কোনোরকম বোঝাপড়া করার জন্য ধরে নিয়ে আর জেরাও করল না।
বাপী বেরিয়ে এলো। সামনের বারান্দায় ঊর্মিলা দাঁড়িয়ে। রাগত মুখ। বন্ধুর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে কিছুটা নিষ্কৃতি পাবে ভেবেছিল, উল্টে সব দায় কিনা ওর নিজের ঘাড়ে চাপল। রাগ হবারই কথা।
কিন্তু বাপীর গাম্ভীর্যে ফাটল নেই এখনো। বলল, বিজয়ের আপিস আর বাড়ির ঠিকানা লিখে কোয়েলাকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও। ভালো যদি চাও তোমার মায়ের সঙ্গে এ নিয়ে একটি কথাও বলবে না, তিনি যেন ভাবেন তুমি কিছু জানোই না। আর তাঁর শরীরের দিকে চোখ রাখবে।
বিকেল চারটের ফ্লাইট। মোটরে বানারজুলি থেকে বাগডোগরা দেড় ঘণ্টার পথ। বাদশার হাতে স্টিয়ারিং থাকলে সোয়া ঘণ্টার বেশি লাগে না। কিন্তু বাপী দেড়টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ার জন্য ব্যস্ত।
ঊর্মিলা ঘরের ভিতর। তার মা বারান্দায়। এই বাংলোর ফটকে বাদশা গাড়ি নিয়ে তৈরি।
গায়ত্রী রাই বলল, যাচ্ছ যখন দু’চার দিন বেশি থেকে কলকাতার বাজারটাও দেখে আসতে পারো।
এ-রকম কথা বাপী শিগগীর শোনেনি। ফিরতে দেরি হবার সম্ভাবনার কথা শুনলেই বেজার মুখ দেখেছে।
—টাকা যথেষ্ট নিয়েছ?
—হ্যাঁ, সে-জন্যে ভাববেন না।
—তবু যদি দরকার হয় হোটেলের ঠিকানা দিয়ে টেলিগ্রাম কোরো। ঘরেই অনেক টাকা মজুত আছে…তেমন দরকার বুঝলে আবু রব্বানী এরোপ্লেনে করে গিয়ে দিয়ে আসবে
দুয়ে দুয়ে চার যোগ হল এবার। কলকাতার বাজার দেখার জন্য দু’চার দিন বেশি দেরি হলে আপত্তি নেই, তার মানে, যে-ফয়সলার জন্য যাচ্ছে তাতে আরো বেশি সময় লাগলে লাগবে। আর নিষ্পত্তিটা শেষ পর্যন্ত যদি মোটা টাকার টোপ ফেলে করতে হয় তাতেও কোনো অসুবিধে নেই।
হন্তদন্ত হয়ে বাংলো থেকে নেমে বাপী গাড়ীতে উঠে বাঁচল। এই একজনকে কোন রকম ভাঁওতার মধ্যে রাখতে চায় না। অথচ নিরুপায়।
এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে একটা সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসল বাপী। প্লেন ছাড়তে ঢের দেরি এখনো। সোফায় মাথা রেখে চোখ বুজে পড়ে রইল খানিক। স্নায়ুর ওপর দিয়ে একটানা ধকল যাচ্ছে। চার বছর বাদে আবার সেই কলকাতায় উড়ে চলল বটে, কিন্তু ভিতরটা তার ঢের আগে থেকে অনির্দিষ্টের মতো উড়ে চলেছে। কোথাও ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছে না। ঊর্মিলার সমস্যার নিষ্পত্তি কোথায় জানে না। নিজের তো জানেই না।
মাইকে একটা ঘোষণা শুরু হতে বাপী মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল। না, কলকাতার ফ্লাইট সম্পর্কে কিছু নয়। ঘাড় ফেরাতে গিয়ে বাপী বড়সড় ঝাঁকুনি খেল একপ্রস্থ। ঠিক দেখছে, না ভুল দেখছে?
পাশের দিকের পনের-বিশ হাত দূরে আর একটা সোফায় একটি মেয়ে বসে। বছর বাইশ-তেইশ হবে বয়েস। দীর্ঘাঙ্গী, ফর্সা। নাকে জেল্লা-ঠিকরনো সাদা পাথরের ফুল। সোজা হয়ে বসে ওকেই দেখছে, ওর দিকেই অপলক চেয়ে আছে।
নাকের এই ঝকঝকে ফুল দেখেই বাপী চিনেছে। ড্রইং-মাস্টার ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুম। চার বছর আগে বানারজুলিতে ডাটাবাবুর ক্লাবে দেখেছিল। তারপর এই দেখল। চেহারা বদলায়নি তেমন। দোহারা কাঠামো একটু ভারির দিকে ঘেঁষেছে। আর একটু ফর্সা লাগছে। হাতে আগের মতো একগাদা কালো চুড়ি নেই। এক হাতে একটি শৌখিন খড়ি। অন্য হাতে সরু রুলি একগাছা তাইতে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। পরনে আকাশী রঙের সিল্কের শাড়ি।
সঙ্কোচ কাটিয়ে কুমকুমই উঠল। ঠোঁটের ফাঁকে বিব্রত হাসির রেখা। কাছে এসে বলল, এবারে চিনতে পেরেছ তাহলে বাপীদা!
বাপী মাথা নাড়ল, চিনেছে।
—আমি সেই থেকে তোমাকে দেখছিলাম…ভরসা করে সামনে আসতে পারছিলাম না।… বসব?
বাপী মাথা নাড়তে সামনের সোফাটাতে বসল। আজ বোধ হয় ভয় করার মতো সঙ্গে কেউ নেই। সহজ খুশি-খুশি মুখ। কিন্তু সামনে বসার পর এই খুশি ভাবটা অকৃত্রিম মনে হল না বাপীর। তবে মেয়েটার শ্রী এ ক’বছরে ফিরেছে। বাপী উল্টে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে কেন জানে না। জিগ্যেস করল, কেমন আছ?
হালকা জবাব দিল।—ভালো থাকতে তো চেষ্টা করছি খুব।…ভালো দেখছ? —ভালোই তো। ব্রীজমোহনের খবর কি?
ভুরুর মাঝে ভাঁজ পড়ল একটু।—এতদিন বাদেও ওই নাম মনে আছে তোমার! ভালোই আছে বোধ হয়, অনেককাল দেখিনি।
বাপীর কিছু জানতে বুঝতে বাকি নেই এটা ধরেই নিয়েছে। নইলে গোপনতার আশ্রয় নিত। একটা তিক্ত অনুভূতি ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে বাপীর। এ ক’বছরে আরো কত ব্রীজমোহন এই মেয়ের জীবনে এসেছে গেছে জানা কোনো কৌতূহল নেই।
একটু সামনে ঝুঁকে কুমকুম সাগ্রহে জিগ্যেস করল, তুমি কলকাতা যাচ্ছ বাপীদা?
—হ্যাঁ।…তুমি কোথায়?
জবাব দেবার আগে কুমকুম আর এক প্রস্থ দেখে নিল তাকে। ওরা প্রাচুর্যের গন্ধ পায় বোধ হয়। কার কেমন দিন চলছে মুখ দেখেই বুঝতে পারে হয়তো। কিন্তু জবাব শুনে বাপী অবাকই একটু।
—আমি আজ দু’মাস ধরে কলকাতা যেতে চেষ্টা করছি। হচ্ছে না…। বোধগম্য হল না বুঝে কুমকুম অনায়াসে বলে গেল, এখানকার অফিসারদের সপরিবারে হাওয়া-জাহাজে যাতায়াত করতে পয়সা লাগে না—একজন আমাকে কথা দিয়েছে নিয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতে তার সময় হচ্ছে না, আমি মাসে মাসে খবর নিতে বা তাগিদ দিতে আসি এখানে।
শোনামাত্র বাপীরই কান গরম। একজন ওকে পরিবার সাজিয়ে বিনা পয়সায় কলকাতায় নিয়ে যাবে সেই আশায় দু’মাস ধরে এখানে ধর্ণা দিচ্ছে। বিনিময়ে ওকে কি দিতে হচ্ছে বা হবে ভাবতে ভিতরটা রি-রি করে উঠল। কিন্তু সেই চার বছর আগের মতোই মেয়েটার দু’চোখ চিকচিক করছে। গলার স্বরেও অদ্ভুত অনুনয়।—আমাকে একবারটি কলকাতায় নিয়ে যাবে বাপীদা? আমার যাওয়া খুব দরকার।
বাপী কিছু ভোলে না। চার বছর আগেও ব্যগ্র মুখে এই মেয়ে জিগ্যেস করেছিল, কলকাতা কেমন জায়গা বাপীদা?
মুখে কঠিন আঁচড় পড়তে লাগল বাপীর। চাউনিটাও সদয় নয়। হাতের চকচকে ঘড়ি আর রুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার ওর দিকে তাকাতেই কুমকুম বলে উঠল, এটা খেলনা ঘড়ি বাপীদা, পাঁচ টাকাও দাম নয়, আর এই গয়নাও সোনার নয়, গিল্টি করা—সত্যি বলছি বাপীদা, নিজে যেতে পারলে আমি কারো আশায় বসে থাকতাম না—আমার যাওয়া খুব দরকার।
নীরস স্বরে বাপী জিগ্যেস করল, কেন দরকার?
ঢোঁক গিলে কুমকুম জবাব দিল, আমার ধারণা কলকাতায় গেলে বাবার সঙ্গে দেখা হবে।
বাপীর একটুও বিশ্বাস হল না। আরো রুক্ষ স্বরে বলল, কলকাতা সোনার শহর, কোনরকমে গিয়ে একবার সেখানে পা ফেলতে পারলেই আর ভাবনা নেই—কেমন?
চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে তিরস্কারটুকু মেনেই নিল যেন। কাতর সুরে বলল, ভাবনা তো ছায়ার মতো আমার সঙ্গে ফেরে বাপীদা, তার থেকে রেহাই পাব কি করে।…সকলেই আমাকে ঘৃণা করে, তুমি চেনো বলে তোমার ঘেন্না আরো বেশি বোধ হয়। কিন্তু বাপীদা, যা-ই হই, আমি তোমার সেই মাস্টারমশায়ের মেয়ে—এইজন্যেও কি তুমি আমাকে একটু দয়া করতে পারো না?
বুকের তলায় উল্টো মোচড় পড়ল। যে মুখখানা চোখে ভাসল, আশ্চর্য…সেই মুখ আজও তেমনি কাছের। বাপী ভাবল একটু, তারপর ঠাণ্ডা গলায় জিগ্যেস করল, কাজ পেলে করবে?
অবাক হবার মতোই প্রশ্ন যেন।—কি কাজ?
—যে কাজ করছ তার থেকে অনেক ভালো। নিজের জোরে নিজেকে চালাবে, কারো লোভ বা দয়ার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। করবে?
এমন প্রস্তাবও কেউ দিতে পারে মেয়েটা ভাবতে পারে না। নিজের অগোচরেই সামান্য মাথা নাড়ল। করবে।
ব্যাগ থেকে একটা ছাপানো কার্ড বার করে বাপী ওর হাতে দিল।—আট—দশদিন বাদে বানারজুলিতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে।
বসে আরো দশ-পনের মিনিট কথা বলার মতো সময় ছিল হাতে, কিন্তু বাপী উঠে পড়ল। আর ফিরেও তাকালো না। ঝোঁকের বশে কাজটা ভালো করল, কি মন্দ করল জানে না বলেই নিজের ওপর অসহিষ্ণু। আসে যদি রেশমার জায়গায় বসিয়ে দিতে পারবে।…রেশমার সঙ্গে এই মেয়ের কোনো তুলনাই হয় না। রেশমা দু’জন হয় না। ওর কথা মনে হলে একটা ব্যথা হাড়ে-পাঁজরে টনটন করে বাজে। বুকের ভিতরে বাতাসের অভাব মনে হয়। না, রেশমার মতো আর কেউ আসবে না, আসতে পারে না। চৌকস মেয়ে দুই একজন দরকার। কুমকুম আসে তো আসবে। এতটুকু বেচাল দেখলে বা সততার অভাব দেখলে ছেঁটে দিতে বাপী একটুও দ্বিধা করবে না।
ভিতরটা বিরক্তিতে ছেয়ে আছে তবু। একটা অনিশ্চয়তার পাহাড় নিজের বুকের ওপর চেপে বসে আছে। কলকাতায় ছুটেছে বটে, কিন্তু ওটা শেষ পর্যন্ত কতটা নড়বে কতটা সরবে জানে না। তার মধ্যে মাস্টারমশাই ললিত ভড়ের এই দেহ-পসারিনী মেয়ের সঙ্গে এমন অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ মোটেই শুভ লক্ষণ ভাবতে পারছে না।
কিন্তু দমদম এয়ারপোর্টে নামার দশ মিনিটের মধ্যে সমস্ত সত্তা দিয়ে আঁকড়ে ধরার মতো কত বড় বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করছিল জানে না। ঘড়ি ধরে চারটে পঞ্চাশ ওর ডাকোটা ল্যান্ড করেছে। ঠিক পাঁচটায় বাপী বাইরের বিশাল লাউঞ্জে এসে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। বিজয় মেহেরার ঠিকানার সঙ্গে ঊর্মিলা তার আপিসের টেলিফোন নম্বরও লিখে দিয়েছে। একটা ফোন করতে পারলে এখনও হয়তো তাকে আপিসেই পাবে। পেলে এই রাতেই হোটেলে ওর সঙ্গে দেখা করতে বলবে। চৌরঙ্গী এলাকায় সব থেকে নামকরা অভিজাত হোটেলে উঠবে তাও ঠিক করে রেখেছিল।
লাউঞ্জের সামনের দিকে ছোট বড় অনেকগুলি এয়ার অফিসের কাউন্টার। সবই বে-সরকারী সংস্থা তখন। টেলিফোনের খোঁজে বাপী পায়ে পায়ে সেদিকে এগলো।
তখনি সেই অভাবিত বিস্ময়। পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে গেল। শীতের শেষের সন্ধ্যার আলোয় আলোয় বিশাল লাউঞ্জের এ-মাথা ও-মাথা দিনের মতো সাদা। সেই আলো হঠাৎ শতগুণ হয়ে বাপীর চোখের সামনে দুলে দুলে উঠতে লাগল।
অদূরে এক নামী এয়ার অফিসের ঝকঝকে কাউন্টারের ভিতরে দাঁড়িয়ে হাসি—হাসি মুখে বাইরের কোনো যাত্রীর সঙ্গে কথা কইছে যে মেয়ে তাকে দেখেই বাপীর দুচোখের ডেলা বেরিয়ে আসার দাখিল। তাকে দেখেই এমন দিশেহারা বিস্ময়! কাউন্টারের সামনের দিকে একটা বোর্ডে লেখা, ‘ইনফরমেশন’।
তার ও-ধারে দাঁড়িয়ে মিষ্টি।
বাপী ভুল দেখছে না। মিষ্টি। মিষ্টি মিষ্টি মিষ্টি!
পরনে ধপধপে সাদা শিফন সিল্কের শাড়ি। গায়ে জেল্লা-ঠিকরনো সাদা ব্লাউজ। শাড়ির ওপর বাঁ-দিকের কাঁধে এয়ার অফিসের কালো ব্যাজ। কপালে কুমকুমের ছোট টিপ। এই বেশে আর এই আলোয় এমন ধপধপে ফর্সা দেখাচ্ছে ওকেও। সব মিলিয়ে সাদা আলোয় গড়া রমণী অঙ্গের কপালে শুধু একফোঁটা লালের কৌতুক।
যাত্রীটি তার জ্ঞাতব্য খবর জেনে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চলে গেল। হাসি মুখে পাল্টা সৌজন্য জানিয়ে ওই মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই মাথা নিচু করে তার কাজে মন দিল।
সঙ্গে সঙ্গে আবার একটা আনন্দের ঢেউ এসে বাপীকে যেন মাটি থেকে চার হাত ওপরে তুলে ফেলল। মাঝের সিঁথি মসৃণ সাদা। সেখানে কোনো রক্তিম আঁচড় নেই।
বাপী বুক ভরাট করে বাতাস নিল প্রথমে। তারপর খুব নিঃশব্দে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল।
—ইয়েস প্লীজ? রাঙানো ঠোঁটে অভ্যস্ত হাসি ফুটিয়ে ও-ধারের মেয়ে মুখ তুলল।
হাতে ট্রাভেল সুটকেস, কাঁধে দামী গরম কোট, বাপী সোজা দাঁড়িয়ে তার দিকে শুধু চেয়ে রইল।
প্রথমে ওই মেয়ের ভুরুর মাঝে সুচারু ভাঁজ পড়ল একটু। তারপরেই অভাবিত কাউকে দেখার ধাক্কায় সেও হকচকিয়ে গেল কেমন। তারপর একটু একটু করে বিস্ময়ের কারুকার্যে সমস্ত মুখ ভরাট হতে লাগল।
বাপী চেয়েই আছে।
মিষ্টিও।
কথা বাপীই প্রথম বলল। বলল, ঠিক দেখছি?
স্থির জলে ছোট্ট একটা ঢিল ফেললে তলিয়ে যেতে যেতে ওটা ওপরে ছোট একটা বৃত্ত-তরঙ্গ এঁকে দেয়। তারপর সেই ছোট তরঙ্গ বড় হয়ে ছড়াতে থাকে। ছোট কটা কথা সামনের চারুদর্শনার মন-সরোবরে তেমনি টুপ করে ডুবল। পাতলা দুই ঠোঁটের ফাঁকে একটু হাসির আভাস দেখা দিল। তারপর সেটুকু সমস্ত মুখে ছড়াতে থাকল। বাপী হলপ করে বলতে পারে, এ কোন ইনফরমেশন কাউন্টারে দাঁড়ানো সুদর্শনার পেশাদারি সৌজন্যের হাসি নয়।
মিষ্টিও ঠিক তেমনি করে ফিরে জিগ্যেস করল, আমি ঠিক দেখছি?
কান আর এর থেকে বেশি কেমন জুড়োয় মানুষের বাপী জানে না। দুজনের বিস্ময় দু’রকমের। গেজেটের পাতায় নাম দেখতে না পাওয়ার ফলে যাকে নিয়ে এত ভাবনা-চিন্তা এত বিশ্লেষণ, আকাশ থেকে মাটিতে নেমেই তাকে এয়ার অফিসের ইনফরমেশন কাউন্টারে দেখতে পাবে এ কোনো সুদূর কল্পনার মধ্যে ছিল না বলেই বাপীর বুকের তলায় এমন তোলপাড় কাণ্ড। নইলে চার বছর আগে যে মিষ্টিকে দেখেছিল এ-ও সেই মিষ্টি। এখানে এই বেশে আর এই পরিবেশে আগের থেকেও একটু বেশি চকচকে আর ঝকঝকে দেখাচ্ছে তফাৎ শুধু এইটুকু। কিন্তু মিষ্টির চোখে তফাৎটা যে ঢের বেশি বাপীর আঁচ করতে অসুবিধে হচ্ছে না। চার বছর আগে যাকে দেখেছিল তার পরনে সাদামাটা পাজামা পাঞ্জাবি, টালির বস্তির এক খুপরি তার বাস, ব্রুকলিন আপিসের এক বড়বাবুর মেয়েকে নাকচ করার ফলে লোয়ার ডিভিশনে কেরানীর চাকুরিটুকুও তার খোয়া গেছে। চার বছর আগের সেই ভেসে বেড়ানো ছেলে বুক ঠুকে ওকে বলেছিল, লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হওয়াটা যেমন তার অদৃষ্ট নয়, বস্তিতে থাকাটাও তেমনি আর বেশি দিনের সত্যি নয়। টনটনে আবেগে ঘোষণা করেছিল, সব বদলাবে, একেবারে অন্যরকম হয়ে যাবে—মিষ্টি চাইলেই হবে।
…এয়ারপোর্টে পুরুষের এই বেশে এই মূর্তিতে ওকে দেখে সেই বদলানোর ধাক্কাটাই মিষ্টির কাছে বড় বিস্ময়। দেখামাত্র আর চেনামাত্র কেমন করে বুঝেছে অনেক বড় হয়েছে, অনেক বদলেছে, অনেক অন্য রকম হয়েছে। বাপীর আরও আনন্দ, এই বিস্ময়ের সঙ্গে খুশির মিশেলও তেমনি স্পষ্ট। সকলের চোখের ওপর এভাবে চেয়ে থাকাটা যে-কোন মেয়ের কাছে অস্বস্তিকর। ওর দিকে তাকিয়ে যেতে-আসতে কাছে-দূরের কত পুরুষের জোড়া জোড়া চোখ সরস হয়ে উঠছে বাপী আর কোন দিকে না চেয়েও আঁচ করতে পারে।
মৃদু হেসে বলল, দুজনেই ঠিক দেখছি বোধ হয়।
কোন মেয়ের যদি কোন ছেলেকে দেখামাত্র সুপুরুষ মনে হয় তো সেটা সেই ছেলের চোখেই সবার আগে ধরা পড়ে। চার বছর আগে যখন কলেজে পাজামা পাঞ্জাবি পরা ছেলেবেলার দুরন্ত সঙ্গীকে প্রথম দেখেছিল বা চিনেছিল, তখনও এই মেয়ের চোখে সুপুরষ দেখার প্রসন্ন বিস্ময় উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল বাপীর মনে আছে। সেটুকুই এখন আরও স্পষ্ট।
হাসিমাখা দু’চোখ ওর মুখের ওপর রেখে মিষ্টি মুখেও বলল, আমি ঠিক দেখছি কিনা এখনো বুঝছি না। তুমি কোথাও থেকে এলে, না কোথাও যাচ্ছ?
—আমি বানারজুলি থেকে মিষ্টির কাছে এসেছি।
এতদিন বাদে দেখা হওয়ার এটুকু সময়ের মধ্যে এই লোক আবার এমন বেপরোয়া কথা বলবে ভাবেনি। বিশেষ করে লেকের ধারের সেই অপমান আর হেনস্থার পর। আজ যদি ওকে এখানে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেত তাহলে অস্বাভাবিক কিছু হত না। কিন্তু স্বাভাবিক পথে চলা যে ধাত নয় তাও মিষ্টির থেকে বেশি আর কেউ জানে না। মুখে সুচারু বিড়ম্বনা। কথাগুলো নাকচ করার সুরে বলল, আমার সঙ্গে এখানে দেখা হবে তুমি জানতে?
—এখানে দেখা হবে জানতাম না। কোথাও দেখা হবে জানতাম।…এখানে আর কতক্ষণ কাজ তোমার?
—ছটা পর্যন্ত। হেসেই সামনের কাগজগুলো দেখালো।—তার মধ্যেও সারতে পারব মনে হয় না।
বাপী হাসছে মৃদু মৃদু। ওর হাতের মুঠো আর যে ঢিলে হবার নয় সেটা এই মেয়ে কি করে জানবে। বলল, তার মানে আমাকে বিদেয় হতে বলছ?
বানারজুলির দশ বছরের ফোলা-গাল ঝাঁকড়া-চুল নিরাপদ ব্যবধানে দাঁড়িয়ে কত সময় মুখের ওপর ঝাঁঝিয়ে উঠে ওকে বিদেয় করতে চেয়েছে। এই মিষ্টি চাউনি দিয়েই বুঝিয়ে দিল, বিদেয় করতে চাইলেও বিদেয় হবে বলে মনে হয় না। মুখে বলল, না তা বলছি না—
বাপী মুখের কথাটুকুই আঁকড়ে ধরল তক্ষুনি।—হাতের কাজ তাহলে আজ না সারলেও চলবে?
চার বছর আগে ঠিক এমনি অনুরোধে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসার কথা মনে পড়ল মিষ্টির। চোখে চোখ, ঠোটে হাসি। অল্প অল্প মাথা দুলিয়ে বলল, এ কি কলেজ যে বেরিয়ে পড়লেই হল—চাকরি না?
—তাহলে কাজ সারো, দেখ কত তাড়াতাড়ি হয়। আমি বসছি।
ব্যাগ হাতে লম্বা পা ফেলে বিশ গজ দূরের লাউঞ্জে একটা সোফায় গিয়ে বসল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল মিষ্টি তার দিকেই চেয়ে আছে। ঠোটের ফাঁকে হাসিটুকু এখনও ধরা আছে। পুরুষের গাম্ভীর্যে নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখল। পাঁচটা পনের।
মিনিট দশের মধ্যেই একটা লোক ঝকঝকে পেয়ালা প্লেটে চা এনে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। বাপী বুঝেও জিগ্যেস করল, চা কে পাঠাল?
লোকটা অদূরের ইনফরমেশন কাউন্টার দেখিয়ে দিল। মিষ্টি এখন এদিকেই চেয়ে। চোখোচোখি হতে মাথা নিচু করে কাজে মন দিল।
চা খেতে খেতে বাপী ঘুরে-ফিরে ওকেই দেখছে। সোজাসুজি চেয়ে থাকার লোভ সামলাতে হচ্ছে। একটু পরে-পরেই কেউ এসে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াচ্ছে। ফ্লাইট বা আর কিছুর খোঁজখবর নিয়ে চলে যাচ্ছে। মিষ্টির ঠোঁটের ফাঁকে পেশাদারী সৌজন্যের হাসিটুকু এখন অন্য রকম। বাপীর মনে হচ্ছিল এই মেয়েকে দেখেই হয়ত বেশির ভাগ লোকের কিছু না কিছুর খোঁজ নেওয়াটা দরকার হয়ে পড়ছে। নইলে সে যখন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল তখন তো একজনও আসে নি।
যত দেখছে, বাপীর ভেতরটা লুব্ধ হয়ে হয়ে উঠছে। শিগগীর এমন হয় নি অনেক, অনেক দিন ধরে প্রবৃত্তির এদিকটার ওপর একটা শাসনের ছড়ি উঁচিয়ে বসে ছিল। তার অস্তিত্ব কখনো ভোলে নি বলেই আষ্টে-পৃষ্ঠে তাকে শেকলে বেঁধেছিল।…ভুটানের পাহাড়ের বাংলোয় খসখসে গালচেয় নাক মুখ কপাল ঘষে ছাল তুলে লোভাতুরকে শায়েস্তা করেছিল, তারপর উদ্ভ্রান্ত যৌবনের ডালি রেশমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে প্রায় অমোঘ রসাতলের গহ্বর থেকে নিজেকে টেনে তুলতে পেরেছিল। ঊর্মিলার উষ্ণ ঘন সান্নিধ্যে এসেও তার থেকে অনেক সহজে ওই অন্ধ অবুঝকে শাসনের লাগামে বেঁধে রাখতে পেরেছে। সব পেরেছে এই একজনের জন্য। এই একজনের প্রতীক্ষায়। অথচ চার বছর আগেও এই মেয়েকে যখন কাছে পেয়েছিল, আর ভেবেছিল খুব কাছে পেয়েছে—তখনও চোখে ঠিক এই লোভ চিকিয়ে ওঠে নি। রেস্তরাঁয় মুখোমুখি বসে তাকে লোভের দোসর ভাবতে চায় নি। তার থেকে ঢের বেশি কিছু ভাবতে ইচ্ছে করেছিল।
আজ নিজেকে বশে রাখার তাগিদ নেই। প্রবৃত্তির ওপর ছড়ি উঁচিয়ে বসার চেষ্টাও নেই। চার বছর আগে বড় বেশি বোকা হয়ে গেছল। আবেগের দাস হয়ে পড়েছিল। তার থেকে ঢের বেশি বাস্তবের রাস্তায় হাঁটত বানারজুলির চৌদ্দ বছরের বাপী। দখল বজায় রাখার জন্য সে হিংস্র হতে পারত। চৌদ্দ বছর বয়েসের সেই সত্তাই আজ ছাব্বিশের প্রান্তে এসে দ্বিগুণ পুষ্ট। দ্বিগুণ সংকল্পবদ্ধ। এই সংকল্পে লোভ আছে ক্ষুধা আছে বাসনা আছে কামনা আছে। বাপী এই সব নিয়েই বসে আছে। দেখছে।
ঘড়িতে ছটা বাজতে কুড়ি। সন্তর্পণে উঠল। মিষ্টির সামনে এখন দুজন মাঝবয়েসী মানুষ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে। প্রায় তিরিশ গজ সামনে এগনোর পর পাবলিক টেলিফোন পেল। রিসিভার তুলে চৌকো দো-আনি ফেলে অপারেটারের গলা পেল। কিন্তু বাপী নম্বর জানে না, তা নিয়ে মাথাও ঘামায় না। হোটেলের নাম বললে যে কোনো অপারেটর কানেকশন দিয়ে দেবে। দিল।
চৌরঙ্গী এলাকার সব থেকে অভিজাত হোটেলে একটা ভাল সুইট বুক করে ফিরে এলো। কাউন্টারের ওধারে মিষ্টি তার দিকেই চেয়ে আছে। লাউঞ্জের চেয়ারের দিকে বাপীর পা আর এগোল না। দাঁড়িয়ে গেল।
সামনের কাগজপত্র সব তুলে নিয়ে মিষ্টি ভিতরের দরজা দিয়ে অদৃশ্য প্ৰায় আট-ন মিনিটের জন্য। বাপী সেই খোলা দরজার দিকেই চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টির ওভাবে লক্ষ্য করার মধ্যে গভীর অভিব্যক্তি কিছু আছে, কিন্তু দু-চার লহমায় সেটা ধরা গেল না।
—চলো।
বাপী চমকেই পাশে তাকালো। ওদিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মিষ্টি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুশিমুখে বাপী ঘড়ি দেখল। ছটা বাজতে দু মিনিট বাকি—হয়ে গেল?
—হয়ে গেল না। একজনের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে এলাম।
বাপী হাসল।—তোমার দায় নেবার জন্য কে আর না ঘাড় পেতে দেবে।
—এসো।
প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য ফিরে তাকালো না। সামনে এগলো। ও-দিক থেকে একজোড়া সাদা চামড়ার মেয়ে-পুরুষ এদিকে আসছে। পুরুষের এক হাত সঙ্গিনীর কাঁধ বেষ্টন করে আছে। জোরালো পুরুষের মত মাঝের চারটে বছর একেবারে মুছে ফেলার তাগিদ বাপীর। তার আগের আটটা বছরও। মিষ্টি বাঁ পাশে। বাপীর হাতে সুটকেস। বাঁ কাঁধের কোটটা ডান দিকে চালান করল। তারপর দ্বিধাশূন্য বাঁ হাত মিষ্টির বাঁ কাঁধে।
চলা না থামিয়েও মিষ্টি থমকেছে একটু। মুখও ওর দিকে ঘুরেছে। বাপীর দৃষ্টি অদূরের দরজার দিকে। কিন্তু লক্ষ্য ঠিকই করেছে। বারো বছর আগের সেই দুরন্ত দস্যির হাতে পড়ার মত মুখ অনেকটা। অস্বস্তি সত্ত্বেও কিছু বলল না—অথবা বলা গেল না।
—এরোড্রোম থেকে এত পথ ভেঙে রোজ বাড়ি ফেরো কি করে?
—কোম্পানির গাড়িতে।
—নিয়ে আসে দিয়ে আসে?
— হ্যাঁ।
বাইরে এলো। সামনের আঙিনা পেরিয়ে বিশ-তিরিশ গজ দূরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। তেমনি কাঁধ বেষ্টন করেই সেদিকে চলল। অস্বস্তির কারণেই হয়ত মিষ্টি গম্ভীর। কিন্তু কিছু না বলাটা যে তারও জোরের দিকই, বাপী সেটা অস্বীকার করছে না। এই জোরের ওপর জবর দখলের স্পর্শে ভিতরটা আরও বেপরোয়া। কোন্ কবিতায় না কোথায় যেন পড়েছিল, রমণীর মন জোর করে জয় করে নেবার জিনিস।
মিষ্টি এবার বলল কিছু। আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি এর মধ্যে বাইরে-টাইরে থেকে ঘুরে এসেছ নাকি?
—না তো।
—বানারজুলিতেই ছিলে?
—হ্যাঁ, কেন?
—অত সহজে কাঁধে হাত উঠে আসতে ভাবলাম বিদেশ-টিদেশ গিয়ে ব্যাপারটা রপ্ত করে এসেছ।
হুল ফুটিয়ে এত সুন্দর করে এমন কথা সকলে বলতে পারে না। ফলে লোভ আরও দুর্বার হয়ে উঠল। ছিঁচকে লোভ নয়, পুরুষের লোভ। কিন্তু ভিতরে কেউ বলছে, আর বাড়াবাড়ি ভাল নয়। বিশ্বাস করে এই মেয়ে হয়তো এরপর ওর সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠতে চাইবে না। হেসেই কাঁধ থেকে হাত নামালো। কিন্তু মুখের উক্তি কম মোক্ষম নয়। বলল, না…বারো বছর আগে রপ্তটা শুধু একজনের ওপর দিয়েই হয়ে আছে।
মিষ্টি ঘুরে তাকালো একবার। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির আঁচড় পড়ল কি পড়ল না। কৌতুকের স্মৃতি কিছু নয়, অবুঝপনা দেখেও সহিষ্ণু মেয়ের নিজেকে আগলে রাখতে পারার মত হাসির আভাস একটু। বলল, দু দিক থেকেই ও-সব ভোলার মতো সময় বারোটা বছর কম নয়।
বাপী এ-কথার এক বর্ণও বিশ্বাস করল না। নিজে কেমন ভুলেছে সে তো জানেই। এই মেয়েও ভোলে নি, ভুলতে পারে না। নইলে চার বছর আগে চেনার পর অনার্স ক্লাস বাতিল করে সমস্ত দিন ওর সঙ্গে কাটাত না। পরদিন লেকের ধারে যা ঘটে গেছে, তার মধ্যেও নিজেরও বিপাক বোঝাবার চেষ্টাটাই আসল ছিল। আর ভোলা এত সহজ হলে আজও আচরণ অন্য রকম হত। অন্যের ওপর কাজ চাপিয়ে দিয়ে এভাবে বেরিয়ে আসত না।…কাউন্টারে দাঁড়িয়ে তখন ওর দিকে চেয়ে কি দেখছিল বাপী এখন বোধ হয় তাও আঁচ করতে পারে। অপ্রত্যাশিত যোগাযোগে আগের থেকেও ঢের সবল পুরুষ দেখছিল। পুরুষ পুরুষ হলে কোন মেয়ে তাকে সহজে ভুলতে পারে?
জবাব দেবার ফুরসৎ হল না, পাঞ্জাবী ড্রাইভার ট্যাক্সির দরজা খুলে দিয়েছে।
মিষ্টি এবারে সোজাসুজি তাকালো তার দিকে।—তুমি যাবে কোন্ দিকে?
—তোমার দিকে। ওঠো—বেঘোরে পড়বে না।
ঠোঁটের ফাঁকে আবার সেইরকম হাসির ফাটল একটু। অর্থাৎ বেঘোরে পড়ার মেয়ে সে নয়।
ট্যাক্সিতে উঠে ওধারের কোণের দিক ঘেঁষে বসল। বাপী উঠে দরজা বন্ধ করল। ট্যাক্সিঅলার উদ্দেশে বলল, চৌরঙ্গী।
ট্যাক্সি সোজা রাস্তায় পড়ে বেগে ছুটল। এদিকের অনেকটা পথ বেশ অন্ধকার। গাড়ির ভিতরে আরো বেশি। দুজনের মাঝে এক হাতের মত ফারাক। নড়েচড়ে বসে বাপীর এই ফাঁকটুকু আর একটু কমিয়ে আনার লোভ। কিন্তু পুরুষের এ-রকম চুরির হ্যাংলামো মানায় না। ভিতরে এমনি সাড়া পড়ে আছে সেই থেকে যে এটুকু খুব বড়ও মনে হচ্ছে না। এই সান্নিধ্যেরও এক অদ্ভুত স্বাদে উপোসী স্নায়ুগুলো টইটম্বুর হয়ে উঠছে। এই নীরবতার ঘোরে বাপী আরও অনেক অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু সেটা বিসদৃশ। বলল, তোমাকে এখানে এভাবে পাব ভাবতেও পারি নি। পাব কথাটা কানে বাজল বোধ হয়। অন্ধকারে মিষ্টি ঘাড় ফেরালো।
—এখানে চাকরি করছ কত দিন?
—তা দেড় বছরের বেশি হয়ে গেল।
—এম. এ না পড়ে হঠাৎ চাকরির দিকে ঝোঁক?
—এম. এ পড়ে এর থেকে আর কি এমন ভালো চাকরি পেতাম?
অর্থাৎ পড়ার থেকে চাকরি বড়। চাকরি লক্ষ্য। অন্ধকারে এত কাছে থাকার দরুন মুখ দেখা যাচ্ছে, মুখের রেখা কিছু দেখা যাচ্ছে না।
—এম. এ পাশ করে কলেজে চাকরি করতে পারতে।
—বিচ্ছিরি। তার থেকে এ ঢের ভালো।
—নিজের চেষ্টাতেই জোটালে?
—না তো কি? গলার স্বর তরল একটু।-খবর পেয়ে দরখাস্ত করলাম, ইন্টারভিউ দিলাম, পেয়ে গেলাম। মিষ্টি-হাসির শব্দ।—এর থেকেও ভালো পোস্টে সিলেকটেড হয়েছিলাম, কেউ রাজি হল না।
—কি পোস্ট?
—এয়ার হোস্টেস।
বাপীর গলায়ও আপত্তির আভাস।সেটা এর থেকে ভালো?
—টাকার দিক থেকে তো ভালো। আর পাঁচরকম সুবিধেও আছে।
মিষ্টি টাকা চিনবে এ বাপী কোনদিন ভাবে নি। এখনও কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
—কে রাজি হল না?
—রাজি না হবার লোকের অভাব!
সহজ হাল্কা জবাবটা কানে চিনচিন করে বাজল। বলতে পারত, দাদু রাজি হল না, বা মা-বাবা রাজি হল না। রাজি না হবার ব্যাপারে আর কারও গলা মেলার সম্ভাবনা বাপী ছেঁটে দিল। চার বছর আগে সেই আঠার বছরের মিষ্টির সঙ্গে এই বাইশের মিষ্টির তফাৎ বাপী ভালই অনুভব করতে পারে। মেয়েদের বিকশিত সত্তার জোরটুকুর ওপর আস্থাভরে দু পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে। চৌদ্দ-পনের-ষোল বা আঠার বছরের অনেক মেয়েই প্রেমের দু-চারটে পলকা বাতাসের ঝাপটা এড়াতে পারে না। মিষ্টির মতো মেয়ের এড়ানো আরও কঠিন। তা বলে উল্টো দিকের বাড়ির সেই সোনার চশমা মাখনের দলা ছেলে শেষ পর্যন্ত যে এই মেয়ের জীবনের দোসর হতে পারে না সেটা শুধু ওর চকচকে সাদা সিঁথি দেখেই বুঝছে না। ওর এখনকার এই সত্তার মধ্যেও সেই রকমই ঘোষণা স্পষ্ট। শুধু সেই লোকটাকে নয়, চার বছর আগে লেকের ধারের সেই বিকেলটাকেই ভেতর থেকে ছেঁটে দিয়েছে। আজ অপ্রত্যাশিত নাগালের মধ্যে পেয়ে শুরু থেকেই বাপীর এই আচরণ। অনুমান মিথ্যে হলে মিষ্টিই সুচারু সৌজন্যে ওকে বাতিল করে দিত। অন্যের ওপরে কাজ চাপিয়ে দিয়ে এভাবে ওর সঙ্গে চলে আসতই না
ট্যাক্সি নির্জনতা পেরিয়ে লোকালয়ে এসে পড়েছে। দু’ দিকের রাস্তা আর দোকান-পাটের আলোয় ট্যাক্সির ভিতরটাও অনেকটা পরিষ্কার। খানিক চুপ করে থেকে বাপী ওর দিকে ফিরল।—বানারজুলি থেকে বাগডোগরা এসে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে উড়ে এসেছি বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে?
মিষ্টির এবারের হাসির সঙ্গে বিড়ম্বনার মাধুর্য ছুঁয়ে আছে কিনা ঠাওর করা গেল না। মাথা নাড়ল একটু। জবাবও দিল।—হচ্ছে।
—বিশ্বাস হতে পারে এমন কিছু বলব?
চেয়ে রইল। ভরসা করে সায় দিতে পারছে না। কিন্তু শোনার কৌতূহল।
বাপীর গলার স্বরে আবেগের চিহ্ন নেই। যেন নেহাৎ সাদামাটা কিছু বলছে।—গেজেটে তোমার এম. এ পরীক্ষার ফল দেখতে বানারজুলি থেকে শিলিগুড়ি ছুটে গেছলাম। বি. এ পরীক্ষার ফল দেখতেও তাই করেছি। বি. এ’র ফল ভালো হয় নি, এম-এতে ফার্স্ট ক্লাস পাবে কি পাবে না ভাবতে ভাবতে নিজেই গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছিলাম। কেউ তখন গাড়ি চাপা পড়লেও খুব অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু গেজেট দেখে আমি হাঁ প্ৰথম। নামই নেই।
নিজের অগোচরে মিষ্টি আরও একটু ঘুরে বসেছে। চেয়ে আছে।
বাপী তেমনি ঢিমেতালে বলে গেল, ফেল করতে পারো এ একবারও মনে হল না। প্রথমে ভাবলাম ভাল প্রিপারেশন হয় নি বলে ড্রপ করেছ। তারপর আর যে সম্ভাবনার চিন্তাটা মাথায় এলো তাইতেই আমার হয়ে গেল। তক্ষুনি ঠিক করলাম, কলকাতা যাব। আমার কপাল ভেঙেছে কিনা দেখব। তবু নানা কারণে আসতে আসতে দিন কয়েক দেরিই হয়ে গেল।
মিষ্টি অপলক চেয়েই আছে সে বোধ হয় তারও খেয়াল নেই। দু চোখ চকচক করছে। বাপী অনুভব করছে, শুধু কান দিয়ে শুনলে এমনটা হয় না। কপাল ভাঙার কোন্ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে কলকাতায় উড়ে এসেছে তাও আর ভেঙে বলার দরকার হল না। বুঝেছে
বাপীর ভিতরটা সেই ছেলেবেলার মতই একটু স্পর্শের লোভে লালায়িত। এক হাত ফারাকের এই এক মেয়েকে ঘিরে তার অন্তরাত্মা বাসনাবিদ্ধ। কামনাবিদ্ধ। কিন্তু এটা বানারজুলির জঙ্গল নয়।
তবু একটু সামনে ঝুঁকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, কি দেখছ?
মিষ্টি নিজের ভিতর থেকে নিজেকেই উদ্ধার করে সজাগ হল। ও-পাশের দরজার সঙ্গে আর একটু চেপে বসে সহজ হবার চেষ্টা। হেসেই বলল, তুমি একটা পাগল।
বাপীও হেসেই সায় দিল।—এত দিনে তাহলে বুঝছ।
.
হোটেলের সামনের রাস্তায় ট্যাক্সি থামতে মিষ্টি বুঝল কোথায় যাচ্ছে বা এই লোক কোথায় আস্তানা নেবে। এই বোঝাটাও বিস্ময়শূন্য নয় দেখে বাপীর মজাই লাগছে। এর থেকে নামী আর দামী হোটেল চৌরঙ্গী ছেড়ে সমস্ত কলকাতায়ও আর দুটো নেই। পয়সার হিসেবটা যাদের কাছে বড় তারা বড় একটা এমন জায়গায় আসে না। তখন পর্যন্ত সাদা চামড়া আর অবাঙালী মেয়ে-পুরুষের ভিড় বেশি এখানে।
মিষ্টি পাশে। গালচে বিছানো চওড়া করিডোর ধরে বাপী রিসেপশনে এসে দাঁড়াল। একজন আধবয়সী কেতাদুরস্ত অফিসার এগিয়ে এলো। সুটকেস রেখে বাপী ব্যাগ খুলে ছাপানো কার্ড তার হাতে দিতে লোকটি শশব্যস্তে বলল, ইয়েস সার, গট ইওর মেসেজ ওভার দি ফোন
তার ইশারায় একজন তকমা-পরা বেয়ারা ছুটে এলো। বাপীর সুটকেস আর ঘরের চাবি নিয়ে সে প্রস্তুত। অফিসারকে বাপী জানালো সে কদিন থাকবে ঠিক বলতে পারে না। খাতাপত্র যা সই করার সুইটে পাঠিয়ে দিলে সই করে দেবে, আর আপাতত পাঁচ দিনের চার্জ অ্যাডভান্স করে দেবে।
লিফটে উঠে তিনতলায় সুইট। নরম পুরু গালচে বিছানো বিশাল ঘরের মাঝে শৌখিন হাফ পার্টিশন। একদিকে বসার ব্যবস্থা, অন্যদিকে শোবার। অ্যাটাচড বাথ দু’ দিকে দুটো টেলিফোন। বাপী চারদিক দেখে নিল একবার। উত্তরবাংলা মধ্যপ্রদেশ বা বিহারে টুরে বেরুলে সব থেকে বড় হোটেলেই ওঠে। কিন্তু কলকাতার সঙ্গে তুলনা হয় না।
বাপী মিষ্টির দিকে তাকালো। এই লোকের এমন দিন ফেরার বিস্ময় এখনও কাটে নি। কিন্তু খুশিই মনে হল।
সুটকেস রেখে বেয়ারা চলে গেছে। বাপী বলল, বসো—
পার্টিশনের এধার থেকে কাঁধের কোটটা গদীর বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল বাপী। তারপর নিজেও বসল।—কি খাবে বলো?
মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসছে অল্প অল্প। কিছু খাবে না বললে শুনবে না জানে, আবার কি খাবে তাই বা বলে কি করে।
বাপী ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে রুম-সার্ভিস চাইল। তারপর একগাদা খাবারের অর্ডার দিল।
ফোন রাখতে মিষ্টি আঁতকে উঠল, অত কে খাবে!
ঠোটের ফাঁকে হাসি ছড়াচ্ছে বাপীর।—আমার এখন রাজ্যের খিদে।
জবাবটা একেবারে জল-ভাত সাদা অর্থের নয়। বিড়ম্বনা এড়াবার চেষ্টায় মিষ্টি বলল, যত খুশি খাও, আমার ওপর জুলুম কোরো না।
বাপী কি আরও বেপরোয়া হবে? জুলুম না করলে সেটা না খাওয়ারই সামিল হবে বলবে? বলল না। আরও জরুরী কিছু মনে পড়ল। ফোনের রিসিভারটা তুলে মিষ্টির দিকে বাড়িয়ে দিল।—ফিরতে দেরি হবে বাড়িতে জানিয়ে দাও।
আবারও একটু বিড়ম্বনার ধকল সামনে মিষ্টি জবাব দিল, তোমার পাল্লায় পড়েছি যখন ফিরতে দেরি হবে আগেই জানি। এয়ার অফিস থেকেই ফোন করে দিয়ে বেরিয়েছি।
বাপী রিসিভার জায়গায় রাখল আবার। দু চোখ ওর মুখের ওপর। রক্তে খুশির তাপ ছড়াচ্ছে, লোভেরও। চার বছর আগে কলেজ থেকে বেরিয়ে আশর আগে দাদুকে নিজে থেকে ফোন করে ফিরতে দেরি হবে জানিয়ে এসেছিল মনে আছে।…তার পরের পরিণাম মুছেই গেছে।
এবারে মিষ্টিরই সহজ হবার তাড়না। চারদিক একবার দেখে নিয়ে বলল, ভালো করে মুখ হাত ধুয়ে না এলে আমি কিছুই মুখে দিতে পারব না—মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হাসল একটু, দু-তিন ঘণ্টা পর পর সমস্ত মুখে জল দেওয়াটা বাতিকে দাঁড়িয়ে গেছে আমার।
বাপী তক্ষুনি উঠে পার্টিশনের ওধারে গিয়ে বাথরুমের দরজা খুলল। ঝকঝকে পরিপাটি ব্যবস্থা। যাবতীয় সরঞ্জাম সাজানো।
ফিরে এসে বলল, যাও—
মিষ্টি উঠে গেল। ফিরল প্রায় সাত-আট মিনিট বাদে। সমস্ত মুখে ভালো করে সাবান ঘষে এসেছে বোঝা যায়। তোয়ালে দিয়ে মুছে আসা সত্ত্বেও ভেজা-ভেজা মুখ। ঘাড়ে মাথায়ও জল চাপড়েছে মনে হল। শুকনো চুলে মুক্তোর মতো দু—চারটে ফোঁটা আটকে আছে।
বাপী তাকালো। তারপর দুচোখ ওই মুখের ওপর অনড় খানিক। মিষ্টি আবার সামনে এসে বসার পরেও। এখানেও আলোর ছড়াছড়ি। কিন্তু সাবান দিয়ে সমস্ত প্রসাধন ধুয়ে মুছে আসার ফলে এখন আর অত ফর্সা লাগছে না। অকৃত্ৰিম তাজা বাদামী অনেকটা। ঠোঁটের লাল রংও ধুয়ে-মুছে গিয়ে শুধু লালচে আভা আছে একটু।
হৃষ্টমুখে বাপী মন্তব্য করল, এতক্ষণে ঠিক ঠিক তোমাকে দেখছি। শাড়িটা বদলে অন্য শাড়ি পরে আসতে পারলে আরো ঠিক দেখতাম
মিষ্টি মুখোমুখি সোফায় বসে হেসেই জিজ্ঞাসা করল, এ শাড়ি কি দোষ করল?
বাপী অম্লান বদনে জবাব দিল, বেজায় সাদা, যেন নিষেধ-নিষেধ ভাব।
দরজার বাইরে প্যাক করে শব্দ হতে মিষ্টিরই বাঁচোয়া।
—কাম ইন! বাপী সাড়া দিল।
দরজা ঠেলে দুজন বেয়ারা ট্রেতে গরম খাবার আর টুপী-আঁটা চায়ের পট ইত্যাদি নিয়ে ঘরে ঢুকল। দুজনের মাঝের চেয়ারে সেগুলো সাজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মিষ্টি আগে থাকতে আবার জানান দিল, আমার দ্বারা অত চলবে না, এ তো একেবারে রাতের খাওয়া সারার মতো এনে হাজির করেছে।
—সারলেই না-হয়। শুরু তো করো।
খেতে খেতে প্রথমেই মিষ্টির যার কথা মনে পড়ল সে বনমায়া। উৎসুকও।—টেলিগ্রামে বনমায়া কিল্ড লিখেছিলে—কি করে মরল? কে তাকে মারল?
বাপী সবিস্তারে বলল। মানুষের লোভের কথা বলল। দোসরকে বাঁচানোর চেষ্টায় বনমায়া ওভাবে নিজের জীবন খুইয়েছে সেই বিশ্বাসের কথাও বলল।
মিষ্টির খাওয়া থেমে গেছল। সব শোনার পর বিষণ্ণ।
—ও কি, খেতে খেতে শোনো। একটু থেমে বাপী আবার বলল, সেদিনও আমি শিলিগুড়ি গিয়ে তোমার বি. এ’র রেজাল্ট দেখে ফিরছিলাম বুঝলে? এসে দেখি বানারজুলির লোক ভেঙে পড়েছে বনমায়াকে দেখতে। বনমায়ার সেটা শেষ সময়, শুয়ে আছে। আমাকে দেখে চিনল, শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম করল…
—থামো, আর শুনতে পারি না।
—মিষ্টির মুখে বেদনার ছায়াতে কোনো ভেজাল নেই। বাপী অখুশি নয়। ওর স্মৃতির গভীর থেকে বানারজুলি হারিয়ে যায় নি। একটু থেমে বাপী আবার বলল, ওর মরদটার খবর শুনবে?
মন্দ কিছু শুনতে হবে কিনা মিষ্টির চোখে সেই আশঙ্কা।
—পাগলা গুণ্ডা হয়ে গেছে। সামনে কাউকে পেলে তাকে মেরে মানুষের লোভের শোধ নিচ্ছে। ওটাকে মারবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, এখনো মারা যায় নি, জখম হয়ে আরো শয়তান হয়ে গেছে। গেল বছর আমি ওই যমের মুখোমুখি পড়ে গেছলাম। কি করে যে বাঁচলাম সেটাই আশ্চর্য।
কে বললে মিষ্টির বয়েস বাইশ, হালফ্যাশানের ঝকঝকে এই মেয়ে এয়ার অফিসের চাকুরে। তার চোখে মুখে সত্যিকারের ত্রাস।—ওটার মুখোমুখি পড়লে কি করে—জঙ্গলে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিলে বুঝি?
—বানারজুলির জঙ্গলে নয়, ভুটানের জঙ্গলে। আমি একটা পাথরে বসেছিলাম ওটা আসছে দেখিই নি। আর একজন সঙ্গে ছিল, সে দেখেছে, সে-ই বাঁচালো। ঘাবড়ে গিয়ে আমি সোজা ছুটতে যাচ্ছিলাম, তাহলে আর রক্ষা ছিল না। সঙ্গের সেই একজন আমাকে নিয়ে পাশের পাহাড়ে টেনে তুলল, আর বিশ-ত্রিশ সেকেন্ড দেরি হলেও হয়ে যেত।
ঠোঁটের ডগায় আসা সত্ত্বেও রেশমার নামটা অনুক্তই থাকল। বুক নিঙড়নো একটা বড় নিঃশ্বাস ঠেলে বেরুলো। রেশমার নামটা করল না বলে নিজেকে অকৃতজ্ঞ ভাবছে।
দৃশ্যটা ভাবতে চেষ্টা করে মিষ্টি শিউরে উঠল। তোমার বনে-বাদাড়ে টহল দিয়ে বেড়ানোর অভ্যেস এখনো যায় নি?
রেশমার চিন্তা ঠেলে সরিয়ে বাপী হাসল। জবাব দিল না।
—সেই এক ময়াল সাপের মুখে পড়াটা আমি এখনো ভুলতে পারি নি। কখনো-সখনো স্বপ্ন দেখে ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠি।
কার জন্যে যে সেদিনের সেই মিষ্টিও প্রাণে বেঁচেছিল সেটা মুখে বলল না, চোখের ভাষায় বোঝা গেল। বাপী কিছুই ভোলে নি, কিছুই ভোলে না। মেমসায়েব অর্থাৎ ওর মায়ের সেদিনের কান-মলা পুরস্কারটাও মনে আছে। কিন্তু আজকের বাপী সেই বাপী নয়। অপ্রিয় প্রসঙ্গের ধার দিয়েও গেল না।
খাওয়া আর চা-পর্বও শেষ এই ফাঁকে। মিষ্টি বলল, এত খেলাম, সত্যি রাতের খাওয়া হয়ে গেল।
ওর ডিশ দুটোয় এখনো খানিকটা পড়ে আছে। বাপী তাগিদ দিল না। বেল টিপতে দরজা ঠেলে বেয়ারা এসে ট্রেসুদ্ধ নিয়ে চলে গেল।
মিষ্টি বলল, তোমার দিন অনেক বদলেছে বোঝাই যাচ্ছে—কি করছ? এ পর্যন্ত নিজের পদমর্যাদার জাহির কারো কাছে করেছে মনে পড়ে না। ঠিক জাহির না করলেও আজ লোভ সামলানো গেল না। পকেটের মোটা ব্যাগ খুলে একটা ছাপা কার্ড বার করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল।
মিষ্টি সাগ্রহেই কার্ডের ওপর চোখ বোলালো।—তুমি এখন মস্তলোক তাহলে—জেনারেল ম্যানেজার অ্যান্ড পার্টনার।…রাই অ্যান্ড রাই কিসের ফার্ম? অল্প কথায় বলল। কত জায়গায় ফার্মের শাখা-প্রশাখা আছে জানিয়ে সুবিধেমতো কলকাতায়ও যে জাঁকিয়ে বসার ইচ্ছে আছে তাও বলল।
—তুমি এই ফার্মের সর্বেসর্বা এখন?
—তা ঠিক না, মাথার ওপর কর্ত্রী আছে।
—কর্ত্রী?
ভিতরে বাপীর যে সাড়া জেগেছে, এই একজনকেই সব উজাড় করে বলা যায়। কে কর্ত্রী, কেমন কর্ত্রী বলল। কোথা থেকে কি ভাবে ওকে টেনে তুলেছে তাও বাদ গেল না। আর একই সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে ঊর্মিলার প্রসঙ্গও এলো। মিষ্টি বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। এবারে সহজাত কৌতূহলে জিগ্যেস করল, ঊর্মিলার বয়েস কত?
—তোমারই বয়সী হবে, সামান্য ছোটও হতে পারে। কিন্তু মেয়ের একেবারে রাজেশ্বরী মেজাজ।
—বিয়ে হয়েছে?
মজা করে সত্যি কথা বলতে আপত্তি কোথায় বাপীর? মাথা নেড়ে জবাব দিল, এই নিয়েই তো ফ্যাসাদ। মেয়ে এক ইঞ্জিনিয়ার-এর কাঁধে ঝোলার জন্য তৈরি, তার মা ওদিকে মেয়েকে আমার কাঁধে না ঝুলিয়ে ছাড়বে না। সঙ্কট বোঝো।
নির্লিপ্ত সুরে মিষ্টি বলল, অমন মা যখন সহায়, সঙ্কট আবার কি, ইঞ্জিনিয়ারকে হটিয়ে দাও।
কথার ফাঁকে বাপীর কার্ডটা নিজের হাত-ব্যাগ খুলে তাতে রাখল
কিন্তু পরামর্শটা বেখাপ্পা ছন্দপতনের মতো লাগল বাপীর। চুপচাপ চেয়ে রইল একটু।—ইঞ্জিনিয়ারকে হটিয়ে দেব?
—তাছাড়া আর কি করবে। রাজত্ব-রাজকন্যা দুইই পাবে।
বাপীর একবার মনে হল মিষ্টি মেয়েলি ঠাট্টা করছে। কিন্তু ভিতরের অনুভূতিটা এমন যে তাও বরদাস্ত করার নয়। চাউনি ওই মুখের ওপর চড়াও হয়ে আছে। বলল, রাজত্ব বা রাজকন্যার লোভ নেই, আমার লোভ একটাই। গলার স্বরও ভারী।—বারো বছর ধরে পৃথিবীর সব বাধা আর সঙ্কটকে হটিয়ে আমি একজনের জন্যেই বসে আছি।
হাতের ব্যাগটা নাড়াচাড়া করছিল মিষ্টি। আঙুলগুলো থেমে গেল। দু-চোখ তার মুখের ওপর উঠে এলো। স্থির হল। মুখে যেন অদৃশ্য কঠিন রেখা পড়তে লাগল। হঠাৎ চাপা ঝাঁঝে বলল, তুমি মোস্ট আনপ্র্যাকটিকাল মানুষ
এটুকুতেই ভিতরে তোলপাড় কাণ্ড বাপীর।—কেন?
গলা না চড়িয়ে মিষ্টি আরো ঝাঁঝালো জবাব দিল, একটা মেয়ের দশ বছর বয়েসের সঙ্গে বারোটা বছর জুড়ে দিলে কি দাঁড়ায় আর তার জগতে কত কি ঘটে যেতে পারে—ভেবেছিলে? শুধু নিজের স্বপ্নে বিভোর হয়েই বারোটা বছর কাটিয়ে দিলে?
বাপী স্তব্ধ কয়েক মুহূর্ত। এই মিষ্টিকে সে দেখে নি। সহজ কথা এমন কঠিন করে বলতে পারে তাও ধারণার বাইরে। তার পরেই সচকিত। বুকের তলায় কাটা-ছেঁড়ার যন্ত্রণা। বাপী কি করবে। উঠে হ্যাঁচকা টানে ওই মেয়েকে সোফা থেকে টেনে তুলে তার হাড় পাঁজর নিজের সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবে? তারপর চিৎকার করে বলবে, ভুল-ভ্রান্তি জানি না, কোনো বাধা মানি না, অনেক ঝড়জলের সমুদ্র সাঁতরে ডাঙায় উঠতে সময় লেগেছে বলেই এত দেরি—ডাঙায় না উঠলে কেউ আমাকে বিশ্বাস করত না, তুমিও না। এই করবে? এই বলবে?
আত্মস্থ হল। মিষ্টির মুখের কঠিন লালচে আভা মিলিয়ে গেছে। নরম হয়েছে। চোখের কোণে সদয় কৌতুকের আভাস। ওটুকুতেই একটা দম-বন্ধ-করা জমাট অন্ধকার কিছু ফিকে হয়ে আসছে। তবু সামনে ঝুঁকে বাপী জিজ্ঞাসা করল, বারো বছরে তার জগতে কত কি ঘটে গেছে জানতে পারি?
চোখের কৌতুক ঠোটে ফাটল ধরালো এবার। জবাব দিল, তেমন কিছু না— তুমি সেই বারো বছর আগের মতোই আছো দেখছি, একটুও বদলাও নি।
—কেন?
টিপ-টিপ হাসি ঠোঁট থেকে চোখে আর চোখ থেকে ঠোঁটে নামা-ওঠা করছে।— ছেলেবেলায় রেগে গেলে যেমন দেখাতো, আর আমার ওপর হামলা করার জন্য যেমন ওঁত পেতে থাকতে—ঠিক তেমনি লাগছিল তোমাকে। আমার ভয়ই করছিল—
আবার লোভ লোভ—রাজ্যের লোভ বাপীর। ভয় যে ওর থোড়াই করছিল তাও স্পষ্ট। সেই কারণেই আরো লোভ। তবু একটু আগের ঝাঁঝালো মুখ ঝাঁঝালো কথার অস্বস্তি একটু লেগেই আছে। হাসিতে যোগ না দিয়ে গম্ভীর মুখেই আবার তাগিদ দিল, কিছু যদি হয়ে থাকে আমাকে খোলাখুলি বলো।
—খোলাখুলি কি আবার বলব। বিপরীত তরল ঝাঁঝ এবার।—জেনারেল ম্যানেজার হও আর পার্টনার হও, তোমার প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধির দৌড় কত তাই বলছিলাম। ঘড়ি দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল।—অনেক রাত হয়ে গেল চলি।
অনুনয়ের সুরে বাপী বলল, আর একটু বোসো।
—না, আর না–এমনিতেই এ চাকরি চক্ষুশূল।
অগত্যা বাপীও উঠল। কাল কখন আসছ?
—কাল? কাল তো আমি কলকাতাতেই থাকছি না!
সঙ্গে সঙ্গে বাপীর চাউনি সন্দিগ্ধ আবার।—আমাকে এড়াতে চাও?
হাল ছেড়ে আবারও হাসল মিষ্টি।—তোমাকে নিয়ে মুশকিল। হাত-ব্যাগ খুলে খাম থেকে খোলা একটা টাইপ করা কাগজ ওর দিকে বাড়িয়ে দিল।—এই দেখো, কাল বিকেলের মধ্যে আমি দিল্লিতে। পরশু রাতে ফিরব।
ইন্টারভিউর চিঠি পড়ল বাপী। এয়ারওয়েজের আরো পদস্থ কিছু চাকরি হবে নিশ্চয়। ইচ্ছে হল চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বলে, এর আর দরকার কি আছে? অতটা পারা গেল না। আবার হয়তো স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকার খোঁটা দেবে। শুধু বলল, না গেলে?
—পাগল নাকি! ছুটি নেওয়া হয়ে গেছে। ওখানেও তারা জানে আমি যাচ্ছি।
—তাহলে পরশু আসছ?
মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসছে অল্প অল্প। মাথা নাড়ল।—পরশুও না। রাত দশটার পর প্লেন ল্যান্ড করবে।
—তার পরদিন?
—তার পরদিন বিকেলে হতে পারে।
—হতে পারে? অস্ফুট আর্তনাদের মতো শোনালো।
মিষ্টি অবুঝের পাল্লায় পড়েছে।—আচ্ছা হবে।
—কথা দিচ্ছ?
হাসিমাখা দু চোখ তার মুখের ওপর থেমে রইল একটু। মাথা নাড়ল। কথা দিচ্ছে।
—ঠিক আছে। চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
মিষ্টি শশব্যস্তে বাধা দিল, না-না, পৌঁছে দিতে হবে না, একা চলা-ফেরা করা আমার অভ্যেস আছে।
কান না দিয়ে বাপী বাইরে এসে চাবি দিয়ে বন্ধ করল। বলল, আর্জ অন্তত তোমাদের বাড়ি গিয়ে হামলা করব না, ভয় নেই। দোরগোড়ায় নামিয়ে দিয়ে চলে আসব। এসো—
মিষ্টির নিরুপায় মুখ দেখে এখন বাপীরই মজা লাগছে।