সোনার হরিণ নেই (Sonar Harin Nei) : তেরো
আবু রব্বানী আর দুলারি ধরেই নিয়েছে গায়ত্রী রাইয়ের এত বড় ব্যবসার কর্তৃত্ব এখন আস্তে আস্তে বাপী ভায়ের হাতে চলে যাবে। রাতারাতি কিছু হবে না। চালিহাকে কোন রকম সন্দেহ করার সুযোগ মেমসায়েব দেবে না। তাছাড়া চারদিকের কাজকর্মের হদিস পেতেও বাপীভাইয়ের কম সময় লাগবে না। চোখ কান খোলা রেখে সব দেখে শুনে বুঝে নিতে হবে। তারপর বাপীভাইয়ের ওপর মেমসায়েবের বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয়ে উঠলে তখন আস্তে আস্তে মেয়েছেলের বুদ্ধির খেলা দেখা যাবে। তাই গোড়া থেকে খুব সাবধান বাপীভাই, খুব সাবধান।
একই সঙ্গে ওদের আনন্দ উৎসাহ আবার উৎকণ্ঠা দেখে বাপী তরফদারের হাসি পায়। সেই সঙ্গে অস্বস্তিও একটু। মেমসাহেবের মনে কি আছে সেটা বাপীর বোকামির জন্যে এরা টের পেয়ে গেছে। প্রথম সন্ধ্যায় গায়ত্রী রাইয়ের সঙ্গে এই বোঝাপড়ার ঝকাঝকিটা আবুর চোখের ওপর দিয়ে ঘটে না গেলে ওরা এতটা হয়তো বুঝত না। কোন্ ভবিষ্যতের দিকে চোখ রেখে মহিলা নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত লোক খুঁজছে, আর কেন ছ’মাসের জন্য ওকে ট্রায়েল দেবার আগ্রহ—বাপী সেটা তার মুখের ওপর বলেই দিয়েছিল। আবু রব্বানী সত্রাসে মেমসায়েবের প্রতিক্রিয়া দেখেছে আর বিমূঢ় বিস্ময়ে তার ফলাফলও দেখেছে। তার পরে মেমসায়েবের সঙ্গে বাপীর প্রতিটি সাক্ষাতের বৃত্তান্তও খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছে। তাই ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ছবিটা ওর স্পষ্ট আঁচ না করতে পারার কথা নয়। আর আবু জানে বলেই দুলারি সব জানে।
এখন ওরাই তাকে উপদেশ দিচ্ছে, সাবধান করছে। এর পিছনে আন্তরিকতাটুকুই সব। তবু পর পর দু’তিন দিন এ-রকম শোনার পর বাপী সেদিন বলল, তোমাদের মেমসাহেবের মতলব কি সেটা আমি গোড়া থেকেই জানি, কিন্তু তা নিয়ে তোমরা এ-রকম খোলাখুলি আলোচনায় বসলে শুরুতেই সব ভেস্তে যাবে—
দুলারি আর আবু দুজনেই অবাক।—এখানে তো ঘরে বসে নিজেদের মধ্যে কথা কইছি, কে জানবে?
—এ-সব কথা ঘরের দেয়ালের জানা বা শোনাটাও ভালো নয়। খুব হাল্কা—ভাবেই জিগ্যেস করল, মেমসায়েবের মতলব আর কে বুঝছে—রেশমা?
আবু জবাব দিল, রেশমার সঙ্গে তো ক’দিনের মধ্যে দেখাই হয় নি—এক ওর মেমদিদি যদি বলে থাকে, খুব ভালবাসে ওকে…
একটু ভেবে বাপী বলল, সে রেশমাকে এ-সব কিছু বলবে মনে হয় না, তার মা-ই তাকে বারণ করবে। যা-ই হোক, তোমাদের কাছ থেকে কিছু না শোনাই ভালো।
সঙ্গে সঙ্গে আবুর মুখ বিরস একটু।—রেশমাকে তুমি অবিশ্বাস করো বাপী ভাই। তুমি জানো না, ওই চালিহার ওপর আমাদের থেকে ওর ঢের বেশি রাগ, ইচ্ছে করে ওর ওপর সব থেকে বেশি অবিচার করছে। মওকা পেলে রেশমা কোন্ দিন সাপের মতোই ওকে ছুবলে দেবে—
যত সেয়ানা হোক, আবু যে ওর তুলনায় সাদা মনের মানুষ বাপী জানে। যে সংশয়ের ছায়াটা মনের তলায় উকিঝুঁকি দিয়ে যায় সেটা ওকে বলা যাবে না। বিরক্তি চেপে জবাব দিল, বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোনো কথা হচ্ছে না—তুমি যা বললে সেটা সত্যি হলেও মেমসাহেবের মতলব ওর না জানা ভালো—ওই রাগের মাথাতেই বেফাঁস কিছু হয়ে বসতে পারে।
দুলারির গম্ভীর চাউনিটা মুখের ওপর আটকেছিল। বাপীর কেমন মনে হল, শুধু শুনছে না, একই সঙ্গে ভেতর দেখে নেবার চেষ্টা। চোখাচোখি হতে ও আবুর দিকে ফিরল। দাবড়ানির সুরে বলল, বাপীভাইয়ের ছটাক বুদ্ধিও ধরো না সেই জ্ঞান তোমার আছে? যা বলছে মন দিয়ে শুনে রাখো, আখেরে সকলেরই তাতে ভালো মন্দ হবে না—বুদ্ধির ঢেঁকি!
এই ধমকের মধ্যে আবুকে নিরস্ত করার কোনো ইশারা ছিল কিনা বাপী ঠিক ধরতে পারেনি। বিমূঢ় মুখে আবু তার বিবিকে দেখেছে। তারপর মোলায়েম গলায় প্রসঙ্গ বাতিল করেছে। —ঠিক আছে, ঠিক আছে, একেবারে মাটি চাপা দিলাম।
কিন্তু আবু চাপা দিলেও সে-মাটি একটু অন্যভাবে খুঁড়ে দিয়ে গেল গায়ত্ৰী রাইয়ের মেয়ে ঊর্মিলা রাই। বন্ধুত্ব হবার ফলে বাপী ওকে ডলি নামে ডাকবে কি ঊর্মিলা, তাই নিয়েও ভেবেছিল। ডলি মিষ্টি নাম, কাছের নাম। সতর্কতার তাগিদে সেই কারণেই ডলি বাতিল। এমন কি মনে মনে বন্ধুত্বও বাতিল। নিজেকে অবিশ্বাস, গায়ত্রী রাইকে আরো বেশি।
বানারজুলির চা-বাগান এলাকায় গায়ত্রী রাইয়ের ব্যবসায় আপিসও একটা আছে। ছোট বড় তিন ঘরের আপিস। বড় সাজানো গোছানো ঘরটা চিফ একজিকিউটিভ চালিহার। এখানে থাকলে সকালের দিকে এক দেড় ঘণ্টা সে এই ঘরে এসে বসে। অন্য সময় শুধু পার্টির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকলে তাকে ও—ঘরে দেখা যায়। এই আপিসে সাড়ে ন’টা পাঁচটা নিয়মিত হাজিরা বরাদ্দ শুধু অ্যাকাউনটেন্ট আর টাইপিস্টের। একজন বেয়ারারও। কর্ত্রী অর্থাৎ গায়ত্রী রাইয়ের আপিসে কখনো পদার্পণ ঘটেছে শোনে নি। কারণ আসল আপিস বাপীর দুঘরের বাড়িতে যে নতুন ঘর উঠেছে, সেটা। আর সামনের ওই বারান্দাটা দরকারী ফাইল-পত্রের বেশির ভাগ সেইখানে। সেখানে ছোট্ট একটা টাইপ রাইটারও দেখেছে বাপী। ওটা মালিকের নিজস্ব। তেমন জরুরী চিঠিপত্র টাইপ করার দরকার হলে গায়ত্রী রাই নিজেই করে নেয়, টাইপিস্টের আশায় বসে থাকে না। প্রয়োজনীয় দুটো একটা নৈমিত্তিক লেনদেন বা হিসেবের ফাইল সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে অ্যাকাউনটেন্টকে প্রায় রোজই একবার করে দুপুরের দিকে মালিকের আপিস ঘরে হাজিরা দিতে হয়।
এ দু’ সপ্তাহের মধ্যে বাড়ির আপিস ঘরে বাপীর একদিনও ডাক পড়ে নি। পড়বে জানে কিন্তু সেটা কোন ভবিষ্যতে, মহিলার মুখ দেখে আঁচ করা শক্ত। এখন পর্যন্ত কাজের কোন রকম হদিসও তার কাছ থেকে মেলে নি। শুধু বলে রেখেছে, ফাঁক পেলে মাঝে মাঝে এসো। কিন্তু কোন্ সময়টা মহিলার কাছে ঠিক ফাঁক বলে গণ্য হতে পারে বাপী এখন পর্যন্ত ঠাওর করে উঠতে পারে নি। সন্ধ্যায় রণজিৎ চালিহার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক কথাবার্তার বা গল্প করার সময়। সেই অন্তরঙ্গ পরিবেশে এসে হাজির হবার ফলে মহিলার সাদাটে ভুরুতে বিরক্তির ভাঁজ দেখেছে। বারান্দায় ওঠারও অবকাশ না দিয়ে বলেছে, দরকার নেই—
অর্থাৎ, যেতে পারো। দু’দিন বাদে এক সকালের দিকে আসার সঙ্গে সঙ্গে কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখেছে মহিলা। গলার স্বর নীরস। চান খাওয়া সেরে এসেছ।
বাপী অপ্রস্তুত।—না।
—এখন ন’টা বাজে, মিস্টার চালিহা দশটায় আপিসে হাজির থাকেন, তিনি দেরির কৈফিয়ৎ চাইলে আমি সদয় থাকব ভেবো না।
বাপীর পত্রপাঠ প্রস্থান। মেয়েটার সামনে ওই কথা শুনে অপমানিত বোধ করার কথা। কিন্তু বাপীর ধারণা খুব স্পষ্ট বলেই গায়ে মাখে নি। আরো অপ্রস্তুত পরের রবিবারের ছুটির দিনে বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ এসে। ছুটির দিন, সকাল থেকে আবুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তারপর দুজনে গল্প করতে করতে চলে এসেছিল। সেদিন অন্তত কোনো বিরূপ আপ্যায়ন আশা করে নি।
কিন্তু ওদের দেখামাত্র মহিলার ভ্রুকুটি। পাশে মেয়ে বসে। মালিকের মুখের দিকে চেয়েই আবু ঘাবড়েছে একটু। আর বাপী ভেবেছিল, মেয়ের কোনো কারণেই মহিলার মেজাজ ভালো নয়। আবুর বিনীত আদাবের জবাবে মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করল একটু। তারপর জিগ্যেস করল, কিছু বলবে?
এ-রকম অভ্যর্থনার জন্য আবুও প্রস্তুত ছিল না। জবাবদিহির সুরে সে বলল, দোস্ত আসছে দেখে সেও মালকানকে শুধু সেলাম জানাতেই এসেছে, আর কোনো কারণে নয়।
মেমসায়েবের মেজাজ এখন পর্যন্ত বাপীর থেকে ঢের ভালো বোঝে আবু বলল, চন্দ্রার নতুন চারা বেড়টা খাসা হয়েছে মেমসায়েব, পারেন তো একবার দেখে আসবেন। আচ্ছা, আমি চলি–আদাব।
আবু চলে যেতে গায়ত্রী রাইয়ের অপ্রসন্ন দু’চোখ বাপীর মুখের ওপর।— তোমার কি?
—এলাম…যদি কিছু বলেন।
—যদি কিছু বলি শোনার জন্যে সঙ্গে লোক নিয়ে আসতে হবে? এ বাড়ির রাস্তা তুমি চেনো না?
দোষের হদিস বাপী পেয়েছে, কিন্তু এ কথার আর জবাব কি দেবে। গায়ত্রী রাই আবার বলেছে, এখানে কাজ করতে হলে দোস্তি ভুলতে হবে।
নিরীহ মুখে বাপী জিগ্যেস করেছে, কাজের বাইরেও?
—কাজের বাইরে তোমার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক আছে আমার?
বাপী বিনয়-বিনম্র। মাথা নেড়েছে, নেই।
—এখন আমি তোমাকে কিছুই বলব না। যা বলার মিস্টার চালিহা বলবেন। তোমার কিছু জিজ্ঞাসা থাকলে তাঁকেই বলবে।
বাপী এরপর অনায়াসে ফিরে প্রশ্ন করতে পারত, ফাঁক পেলে তাকে মাঝে মাঝে আসতে বলা হয়েছিল কেন। জিগ্যেস করল না। আনুষ্ঠানিকভাবে কাজে জয়েন করার পর থেকেই মহিলার এমনি কড়া মেজাজ দেখছে। আবুর ভাষ্য অনুযায়ী এক চালিহা ছাড়া আর সব কর্মচারীর সঙ্গে এই গোছের আচরণ ঠাকরোনের। বাপীর ধারণা অন্য রকম। ওকে নেবার উদ্দেশ্যটা বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলেই শুরুতে লাগামের মুখে রাখছে। দরকার বুঝলেই ছপটি চালাতে পারে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর একই সঙ্গে চালিহার মর্জির ওপর ছেড়ে দিয়ে যোগ্যতা যাচাইয়ের মহড়াও নিচ্ছে বোধ হয়। ক’দিন আগের সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা লোককে শুধু মুখের কিছু কথা শুনে একটু বেশি প্রশ্রয়ই দিয়ে ফেলা হয়েছে ভাবাও বিচিত্র নয়।
অতএব বাপী বুদ্ধিমাদের মতোই নরম মুখে বাংলো থেকে নেমে এসেছে। পরের এক সপ্তাহের মধ্যে আর ও-মুখো হয় নি। গায়ত্রী রাইও তার অস্তিত্ব ভুলেছে যেন। একবারও ডাকে নি। এই কারণেই বাপীর আরো বদ্ধ ধারণা, সে তার লক্ষ্যের মধ্যেই আছে, আর তার প্রতিদিনের খুঁটিনাটি হিসেবও মহিলা রাখে। হিসেব কে দেয় বাপী সঠিক না জানলেও আঁচ করতে পারে। রণজিৎ চালিহা খুব সম্ভব। তাই যদি হয় তো এটা মহিলার যে সূক্ষ্ম সপটু চাল একটা, বাপী অস্বীকার করবে না।
টাইপিস্টকে তার ঘর ছেড়ে মেশিনপত্র নিয়ে অ্যাকাউনটেন্টের ঘরে চলে .. যেতে হয়েছে। তার ছোট ঘরখানা বাপীকে মোটামুটি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। রণজিৎ চালিহার তুলনায় সে-সজ্জা কিছুই নয়। তার মতো ওর ঘরের দরজায় নামের ফলকও কিছু বসানো হয় নি। কি পোস্ট বা কি চাকরি, সে সম্পর্কে এক কর্ত্রী ছাড়া আর কারোরই হয়তো ধারণা নেই। পশ্চিম বাংলার জন্য কাজকর্ম শেখানো হবে শুনেছিল, কিন্তু কাজে লাগার পর আর কিছু কানে আসে নি।
সকাল দশটার পাঁচ-দশ মিনিট আগেই হাজিরা দেয়। অ্যাকাউনটেন্ট আর টাইপিস্ট আসে সাড়ে ন’টায়। চালিহা এলে বাপী তরফদার কর্তব্যবোধে সামনে এসে দাঁড়ায়। তার ফর্সা মুখের মিটিমিটি হাসির অর্থও খুব অস্পষ্ট নয়। গায়ত্ৰী রাই তাকেও নিশ্চয় ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে সে-ই আসল মুরুব্বি ওর।
রণজিৎ চালিহা আগে তাকে ফার্মের ফাইল পড়তে হুকুম করেছে। কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে, ফাইল পড়লে মোটামুটি ধারণা হবে। আর বলেছে, জঙ্গলটা ভালো করে স্টাডি করো, জঙ্গল থেকেই আমাদের যা-কিছু। জঙ্গলের প্রসঙ্গে সাপ ধরা আর কেনা-বেচার ব্যাপারটা আরো ভালো ভাবে অর্গ্যানাইজ করা দরকার সে-কথাও বলেছে।
উড়ো খই গোবিন্দের পায়ে। ওকে নিয়ে চালিহার হাবভাবও অনেকটা সেই রকমই। সকালে সামনে এসে দাঁড়ালে মুচকি হেসে জিগ্যেস করে, ফাইল দেখছ?
বাপী সবিনয়ে মাথা নাড়লে বলে, বেশ। তারপরেই নিজের কাজে ব্যস্ত ভাব।
দ্বিতীয় সপ্তাহের তৃতীয় দিনে আপিসে ঢুকতেই অ্যাকাউনটেন্ট বলল, আপনার সাইকেলটা একবার দেখে নিন—
ঈষৎ অবাক চোখে ঘরের দেয়ালের গায়ে বাপী একটা ঝকঝকে নতুন সাইকেল ঠেস দেওয়া দেখল। দামী ভালো সাইকেল। অ্যাকাউনটেন্ট জানালো মালিকের হুকুমে এটা তার জন্য কেনা হয়েছে। এগিয়ে এসে বাপী ওটা নাড়াচাড়া করে দেখল একটু। অ্যাকাউনটেন্টকে বলল, ঠিক আছে। সে তার চেয়ারে গিয়ে বসার পরেও বাপী ওটার দিকে চেয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে। পুরনো স্মৃতি ব্যথার মতো ভেতর থেকে ঠেলে উঠছে।…নতুন নয়, একটা পুরনো সাইকেলের স্বপ্ন দেখেছে কত দিন। সাইকেল-সাইকেল করে পিসীকে জ্বালাতন করে মেরেছে আর গরিব বাপের গালাগাল খেয়েছে। মিষ্টিরা আসার পর সাইকেলের লোভ আরো বেড়েছিল। ও সাইকেল চালাবে…পিছনের ক্যারিয়ারে মিষ্টি থাকবে।
চালিহা আসতে সচকিত। অ্যাকাউনটেন্ট আর টাইপিস্ট শশব্যস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই মাঝারি ঘরের ভিতর দিয়ে তার ঘরে ঢোকার পথ। বাপীরও। একটা নতুন সাইকেলের সামনে ওকে দেখে সেও দাঁড়িয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, ওটা কার?
অ্যাকাউনটেন্ট জানালো, মিস্টার তরফদারের জন্য কেনা হয়েছে।
কার নির্দেশে কেনা হয়েছে সেটা বুঝে নিতে চালিহার এক মুহূর্ত সময় লাগল না। সপ্রতিভ তৎপরতায় মাথা নাড়ল।—ও, হ্যাঁ…। যেন জানাই ছিল—সাইকেল একটা কেনা হবে। মুরুব্বির সুরে চালিহা বলল, ঘরে বসা কাজ নয় আমাদের, ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য তৈরি হও।
নিজের ঘরে ঢুকে গেল। আর তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নিজের তৎপরতা দেখালো। তার সইয়ে একটা টাইপ করা চিঠি এলো বাপীর টেবিলে। কারো নামে চিঠি নয়। ব্যবসায়ের প্রতিনিধি হিসেবে বাপী তরফদারের নামে পরিচয়পত্র। এটা পাঠিয়ে রণজিৎ চালিহা যেন একপ্রস্থ রসিকতা করল ওর সঙ্গে। অর্থাৎ, সাইকেল পেয়েছ, পরোয়ানাও দিলাম, এবারে চরে খাও দেখি কেমন মুরোদ
রণজিৎ চালিহা এক পা-ও এগোতে সাহায্য করবে এ-রকম প্রত্যাশা বাপীর কোনো সময় ছিল না। কর্ত্রীরও নেই নিশ্চয়। কিন্তু তার যাচাইয়ের রীতি বিচিত্র। ওপরঅলার মতো চালিহাকে সামনে রেখে পায়ে পায়ে ঠোক্কর খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কাজকর্ম সম্পর্কেও কোনো আদেশ নেই, কিন্তু সাইকেল দেবার পিছনে কিছু ইঙ্গিত আছে। সেই ইঙ্গিত রণজিৎ চালিহাও বুঝেছে। তাই সাততাড়াতাড়ি পরিচয়-পত্র পাঠিয়ে দায়িত্ব সেরেছে। এখন বাপী শূন্যে ঝোলে কি হাল ছাড়ে, দু’জনার কাছেই সেই পরীক্ষা।
পায়ের নিচে মাটি চাই বাপীর। এখানে যা ফাইল আছে সব তার খুঁটিয়ে পড়া আছে। এবারে নিজস্ব ফাইলে মাইল দশেকের একটা গণ্ডী টেনে নিয়ে কাজ শুরুর ছক ঠিক করে নিল। এই এলাকার মাল বানারজুলির গোডাউন থেকে চালান যায়। ভুটানের এলাকা পর্যন্ত ধরলে আরো দুটো গোডাউন আছে। এখানকারটাই বড়। এখান থেকে উত্তর বাংলা আর তার বাইরেও অনেক জায়গায় মাল চালান যাচ্ছে। কিন্তু বাহন সাইকেল, দূরের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। খুচরো মালের কারবার নেই যখন, এই দশ মাইল পরিধির পাইকিরি খদ্দেররাই তার লক্ষ্য। তাদের নাম-ধাম বার করে কে কত মাল আর কত রকমের মাল নিয়ে থাকে তার একটা খসড়া করে নিল। যারা আগে মাল নিত, কিন্তু এখন নিচ্ছে না বা কম নিচ্ছে—তারাও এই নিজস্ব ফাইলে এলো।
সাপ চালানের ব্যবসা দেখার ব্যাপারে জোর দিয়েছিল রণজিৎ চালিহা। এর ফাইল কটাও খুঁটিয়ে দেখে নিল বাপী। কারা যোগান দিচ্ছে, কারা কিনছে, আর কত চাহিদা। চাহিদা বলতে গেলে আরো ঢের বেশি। এদিকেও নজর দেওয়া ঠিকই দরকার। এ-ব্যাপারে আবুর সঙ্গেই পরামর্শ করতে হবে। আবু বাড়িয়ে বলে নি, এখনো যে পর্যায়ের সাপ যে দামে কেনা হচ্ছে আর যে দরে বিক্রি করা হচ্ছে তার মধ্যে অনেক ফারাক। অর্থাৎ লাভ অনেক।
মদ বিক্রি আর নেশার গাছ-গাছড়া ফলমূল বিক্রি থেকেও বছরে এন্তার টাকা আসে বাপী শুনেছিল। কিন্তু এ-সবের কোনো ফাইলের চিহ্ন নেই এই দপ্তরে। এ—সব সুড়ঙ্গ পথের কারবার, থাকবে না জানা কথাই। এই কারবারে মালিকের একমাত্র দোসর সম্ভবত রণজিৎ চালিহা। আবু রব্বানীও কিছু ভাগ পায় কিনা সঠিক জানে না।
সেদিন শনিবার। টাইপিস্ট আর অ্যাকাউনটেন্ট দুটোর পরে চলে গেছে। চালিহা আপিসেই আসে নি। বেয়ারাটা এই আপিসেই থাকে বলে সে আছে। আর নিজেরই গরজে বাপী আছে।
বেলা পাঁচটা নাগাদ হাতব্যাগ দোলাতে দোলাতে যে ঘরে ঢুকল তাকে এখানে দেখে বাপীর অবাক হবারই কথা। ঊর্মিলা রাই। পরনে হাল্কা সবুজ শাড়ি। গায়ে সবুজ ব্লাউজ। কপালে সবুজ টিপ। সুন্দরই লাগছে। কিন্তু বাপীর চোখ সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করছে না। এখানে আসার হেতু বুঝতে চেষ্টা করছে।
ঊর্মিলা এগিয়ে এসে টেবিলে ছড়ানো ফাইল কটা দেখল। তারপর বাপীর দিকে তাকালো। গম্ভীর। বলল, বাপী ইজ এ গুড বয়, শনিবারে বিকেল পাঁচটার পরেও কাজ করছে। মা জানলে খুশি হবে।
বাপী জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার?
—ব্যাপার কিছু না। বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। বেয়ারাটা রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, তুমি এখনো আপিসে আছ। তাই ইন্সপেকশনে এলাম। আমিও কাগজে কলমে ব্যবসার পার্টনার একজন জানো তো?
—জাগা না ঘুমন্ত?
—তার মানে?
—স্লিপিং পার্টনার কিনা জিগ্যেস করছিলাম।
—এখন পর্যন্ত স্লিপিং। মা জাগাতে চেষ্টা করছে।
বাপী বলল, তাহলে দয়া করে বসা হোক।
টেবিলের উপরেই ধার ঘেঁষে বসল ঊর্মিলা। বসার এই অন্তরঙ্গ চিত্রটা বরদাস্ত
করার ইচ্ছে নয় বাপীর। বলল, চেয়ারগুলো কি দোষ করল?
—কেন, তোমার অসুবিধে হচ্ছে?
— হচ্ছে।
—কি অসুবিধে?
—দেখতে ভালো লাগছে না, এই অসুবিধে…
টেবিল থেকে নেমে ছদ্ম কোপে মেয়েটা চোখ পাকালো প্রথম। তারপর হেসে ফেলে একটা চেয়ার টেনেই বসল। বলল, এ-রকম অসুবিধে হতে দিতে আমিও রাজি নই।
বাপী জিজ্ঞেস করল, একলা বেড়াতে বেরিয়েছ?
সঙ্গে সঙ্গে রাগ।—কেন, আমি বাচ্চা মেয়ে না বাঘ-ভালুকে খাবে?
—তুমিই সেদিন বলেছিলে, মা একলা বেরুতে দেন না, সঙ্গে কেউ একজন থাকেই।
মনে পড়ল। তার পরও বিরক্তি চাপা থাকল না।—আজও ড্রাইভার আছে, মায়ের গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। মা-কে আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি, বেশি আগলাতে চেষ্টা করলে আবার বাড়ি ছেড়ে পালাব।
বাপীর মুখে নিরীহ বিস্ময়।—আবার বলতে?
ঊর্মিলা থমকালো। তারপর হেসেই জবাব দিল, একবার রাগ করে শিলিগুড়ি পালিয়ে গিয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে দু’দিন ছিলাম। তার পরেই এ-প্রসঙ্গের ওপর যবনিকা। কাজ কি-রকম বুঝছ?
—চেষ্টা করছি।
—আঙ্কলের কাছ থেকে ক্ষমতা-টমতা কিছু আদায় করতে পেরেছ?
—এখন পর্যন্ত কিছু না।
—সে কি! কাল রাতেই তো আঙ্কল মা-কে বলছিল, তোমাকে একেবারে ফ্রি-হ্যান্ড দিয়েছে।
এটা কত নম্বরি চাল চালিহার বাপী ঠাওর করে উঠতে পারল না। সাদা মুখ করে বলল, ফাইল পড়তে বলেছেন আর জঙ্গল স্টাডি করতে বলেছেন। আর গত পরশু ফার্মের রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে একটা অ্যাক্রেডিটেশন দিয়েছেন। তোমার মা না চাইলে ক্ষমতা পাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না—
বাধা দিয়ে ঊর্মিলা বলে উঠল, মা কিছুই বলবে না বা কিছুই করবে না। চুপচাপ বসে তোমার মুরোদ দেখবে শুধু। একটু থেমে আবার বলল, তবে তুমি যখন আমার ফ্রেন্ড, তোমাকে চুপি চুপি বলে রাখতে পারি…তোমার ওপর মায়ের অনেক আশা—
বাপীর নিরীহ মুখ। চুপচাপ চেয়ে আছে —
—সব জেনে বুঝেও হাঁ করে চেয়ে থেকে বোকা সাজছ কেন? হাসল।— সত্যিকারের বন্ধু হলে আমিও তোমাকে কিছু কিছু সাহায্য করতে পারি।
মায়ের আশা আর নির্ভরতা আছে বলেই মেয়েও বন্ধুত্ব পাতিয়ে ওকে হাত করতে চায় এটুকু স্পষ্ট। সাহায্যের কথায় বাপী ঔৎসুক্য দেখালো।— কি রকম?
—মা তো চায়ই আমি একটু-আধটু কাজকর্ম দেখি। দেখব। কিন্তু আসলে আমার দ্বারা এ-সব কিচ্ছু হবে না। আঙ্কল তো মাসের মধ্যে সতের দিন টুরে কাটায়—আজও চার দিনের টুরে বেরুলো। সে না থাকলে এখানকার কাজে কি অসুবিধে হয়, আর কত রকমের গলদ দেখা দেয় সেটা বুঝতে তোমার আর কত সময় লাগবে? তুমি আমাকে বলবে, আর আমি তোমার একান্ত প্রশংসা করে মা-কে বলব। দায়িত্ব তখন তোমার হাতে সেধে আসবে দেখে নিও।
ওই মায়ের মেয়ের বুদ্ধি নেই কে বলবে।
হাসি মুখেই ঊর্মিলা আবার বলল, আমার প্রশংসার অনেক দাম আছে বুঝলে ফ্রেন্ড! এক রেশমা ছাড়া মা আমার মুখে আর কারো প্রশংসা শোনে নি কখনো—
—রেশমার অত ভাগ্য কেন?
—ও সত্যিকারের ভালো মেয়ে বলে। ভালো কথা, ওর মজুরিটা তুমি চটপট বাড়িয়ে দাও দেখি—
—কিসের মজুরি?
—সাপ ধরার। প্রাণের মায়া ছেড়ে জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়ায়, অথচ পাওনার বেলায় ওর ওপর অনেকদিন ধরে অবিচার হচ্ছে শুনেছি।
—আমি মজুরি বাড়িয়ে দেব?
—নিশ্চয় দেবে, যার যা পাওনা তাকে তা দেবে না কেন?
—রেশমার ওপর অবিচারের কথা তোমার মা-কে বলো না কেন?
—বলতে বাকি রেখেছি! মায়ের মতো রেশমাও দু’ চক্ষে মদ খাওয়া দেখতে পারে না বলে মা ওকে পছন্দও করে, বিশ্বাসও করে—আমি বলতে ওকে রূপোর গয়নাও গড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দেনা-পাওনার ব্যাপারে কখনো আঙ্কলের কাজে মাথা গলাবে না।
—আঙ্কলকে বলো না কেন?
হুঁঃ। বলা হয়েছে—তার কি মতলব কে জানে।
বাপী ভাবল একটু। বলল, সকলকে ছেড়ে প্রথমেই একটা মেয়ের জন্য আমার মাথাব্যথা দেখলে তোমার মা কি ভাববেন।
যুক্তিটা মেনে নিয়েও ঊর্মিলা হেসে উঠল।—ভাববে তুমি মজে গেছ। মরুকগে, আঙ্কলকে আমার কথা বলেই না হয় ওর মজুরিটা বাড়াতে চেষ্টা করো—অবিচার হচ্ছে বলে গত বছর থেকে মেয়েটা রাগে ফুঁসছে।
—ঠিক আছে। এবারে আলতো করে বাপী জিজ্ঞেস করল, তোমার সত্যিকারের বন্ধু হতে হলে আমাকে কি করতে হবে সেটা বললে না তো?
জবাবে ভূকুটি। সেই সঙ্গে ঠোঁটে হাসি।——ধরে বাঁদর নাচ নাচাতে চাইলেও সেটা বরদাস্ত করতে হবে।
.
সাপ চালানো আর চাহিদার হিসেব শুনে আবু রব্বানী বিড়ি দাঁতে চেপে এমন ভাবে তাকালো যার অর্থ, বাপীর বুদ্ধির দৌড় দেখে সে অবাকই হয়েছে। বলল, যত সাপ ধরা হয় আর চালান যায় তার সব হিসেব খাতায় ওঠে তুমি ভাবো নাকি! এর মধ্যে কালো ব্যাপার কিছু নেই?
বাপী এ-দিকটা ভাবে নি বটে। তবু চাহিদার ব্যাপারটা আবু অস্বীকার করল না। সাপ ধরার পার্টি আরো গোছালো ভাবে বড় করা যায় এও ঠিক। কিন্তু লাভের কড়ি আরো কিছু না খসালে তা হবে কেন? লাভের খবর এখন আর কে না রাখে? এ-ব্যবসায় তো মালিকদের শুধু মুনাফা লোটা ছাড়া আর কোনো কষ্ট করতে হয় না, তাহলে লাভের ন্যায্য ভাগ ওদের দেবে না কেন? আর এ-কাজে মেহনত বাড়ালে আবুরই বা বাড়তি লাভটা কি? মাস গেলে দুলারির নামে দিচ্ছে তো মাত্র পঞ্চাশটি টাকা।
আর কিছু অসুবিধের কথাও শুনল বাপী। গরীব বেদে-বেদেনীরা সাপ ধরলেই নগদ টাকা আশা করে। সেই ব্যবস্থাও দরকার। ম্যানেজার কত সময় থাকে না, তখন এক পাওনা পেতে ওদের কতদিন ঘুরতে হয়। অবশ্য টাকা অনেক সময় মালকান আগাম দেন, কিন্তু ম্যানেজারের সই না হলে হিসেব মেটে না। আবার অনেক সময় মেমসায়েবও পাহাড়ের বাংলোয় বা এ-ধার ও-ধার চলে যান। এই লোকগুলো তখন বিরক্ত হয়ে আবুকেই পাঁচ কথা শোনায়। বড় দল যে করবে, সম্বৎসরে কটা টাকা ওরা পায়—বছরের মধ্যে শীতের পাঁচ মাস মনসা মায়ের সন্তান-সন্ততিরা তো গর্তেই সেঁধিয়ে থাকে, আর বর্ষায় ওঁরা বাড়েন বটে কিন্তু ধরা পড়ে কম। সময়ে ভালো রসদ না পেলে দল বেঁধে ওরা জানের ধকল পোহাতে আসবে কেন?
বাপী কথা দিল, মালিকের সঙ্গে আলোচনা করে যতটা সম্ভব সুব্যবস্থা করবে। কিন্তু ওর মুখ চেয়েও এ বছর সাপের চালান বাড়ানোর কথা আবুকে ভাবতে হবে। তারপর জিগ্যেস করল, রেশমার মজুরি নিয়ে অবিচার হচ্ছে শুনলাম, সেটা কি ব্যাপার?
আবুর একটা চোখ ছোট মানেই রসের খোরাক পেয়েছে।—অবিচারের কথা কে বলল?
—ঊর্মিলা রাই।
আবু হেসে মাথা নাড়ল।—অবিচার হচ্ছে আর সেটা হচ্ছে ওই ম্যানেজারের বজ্জাতির জন্য।
কি বজ্জাতি তাও শুনল। সাপ ধরতে সাধারণত দু’জন করে লোক লাগে। বেদেদের সঙ্গে অনেক সময় বেদেনীরাও থাকে, কিন্তু মজুরির হিসেব হয় পুরুষের নামে। রেশমার বেলায় হিসেব হয় ওরই নামে। সঙ্গীকে রেশমা ছ’আনা বখরা দেয়। ও-ই মুরুব্বি। চালিহার বিবেচনায় সব জায়গাতেই পুরুষের তুলনায় মেয়ের মজুরি কম। রেশমার রাগ কম কেন হবে, চালানের সময় কি সাপের গায়ে লেখা থাকে এটা মেয়েছেলে ধরেছে! এদিকে গুনলে রেশমাই সব থেকে বেশি যোগান, দেয়। ও সাপের গর্ত চেনে, শীতের সময় শুধু ও-ই খুঁজেপেতে মাস গেলে দু—পাঁচটা সাপ ধরে আনে।
—তাহলে ওর ওপর এই জুলুম কেন?
আবুর এক চোখ ছোট আবার।—একটু বাড়তি তোয়াজ তোষামোদের আশায়। এবার বুঝেছ?
হাসতে গিয়েও আবুর মনে পড়ল কি। গলা খাটো করে বলল, সেদিন তুমি চলে যেতে দুলারি আমাকে বকাঝকা করছিল। সে-ও বলেছিল তোমাকে নেবার ব্যাপারে মেমসায়েবের মতলব রেশমারও না জানাই ভালো।…মেয়েটাকে দুলারিই সব থেকে বেশি ভালবাসে, কিন্তু ওর মেজাজ-মর্জির ওপর বিশ্বাস নেই। তোমার ওপর কখনো রেগে গিয়ে ওই শালার ম্যানেজারকে তোষামোদ করার জন্য যদি কিছু লাগিয়ে দেয় তাহলে চিত্তির। আবু বড় করে তাকালো বাপীর দিকে, এই জন্যই তুমি রেশমাকেও জানাতে বারণ করেছিলে, তাই না?
বাপী অস্বীকার করতে পারে নি। কিন্তু দুলারি যে এত চতুর ধারণা ছিল না। রবিবারের এই দুপুরেই রেশমার সাপ ধরা দেখেছে বাপী। ভয়ডর ওর নিজেরও কম, কিন্তু রেশমার আর তার সঙ্গীর দুঃসাহস দেখে বার বার গায়ে কাঁটা দিয়েছে। হাতের মুঠোয় জীবন নিয়েই ওরা বেরোয় বটে।
শুনল এই মৌসুমে এর মধ্যে আর একদিন মাত্র বেরিয়েছিল ওরা। কিন্তু তখনো শীতের আমেজ ছিল বলে একটাও মেলেনি। আজ এই দ্বিতীয় দফা বেরুলো। আবুর মুখে খবরটা শুনে বাপী আগেই রেশমার ঘরে এসে হাজির হয়েছিল। খুশি মুখে রেশমা টিপ্পনী কেটেছিল, ভয় পেয়ে আবার কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাঁধাবে না তো?
কেলেঙ্কারি শব্দটা খট্ করে কানে লাগল বাপীর। সেটা বুঝেই রেশমা আবার বলল, ওই হারমা’র আগে যাকে কাজ শেখাতে গেছলাম প্রথম দিন একটা কেউটে ফণা তুলে ফোঁস করে উঠতেই ভয়ে আমাকে একেবারে জাপটে-মাপটে ধরেছিল।
দু’চোখ জোর করেই অন্যদিকে ফিরিয়েছে বাপী। এ কথার পর মেয়েটা আরো বেশি চোখ টানছিল। সাপ ধরতে বেরুনোর পোশাক বলতে পরনে একটা আঁট জাঙ্গিয়া আর গায়ে তেমনি আঁট গেঞ্জির মতো জামা একটা। পায়ে ফিতে বাঁধা জুতো ব্যস। মেয়েটার এই যৌবন শাসনে রাখা ওই বেশের সাধ্যের বাইরে।
রেশমার এই সঙ্গীর নাম হারমা। এদিকেরই আদিবাসী। সমবয়সীই হবে দু’জনে। স্বাস্থ্য ভালো, হাবাগোবা মুখ। কিন্তু চাউনি সন্দিগ্ধ। প্রথম দেখেই বাপীর মনে হয়েছে রেশমার কাছে বাবুমানুষ আসাটা পছন্দ নয়। জঙ্গলের পথ ভাঙার ফাঁকে হেতুও বুঝেছে। ভক্ত মুগ্ধ হয়ে যা হয়, তাই। মুখে কথা নেই, কিন্তু চোখ দুটো নারী-অঙ্গ ছেড়ে নড়ে না। শিকারের সময়েও কি এই মুগ্ধ ভক্ত ওর দিকেই চেয়ে থাকে নাকি! তাহলে তো ছোবল খেয়ে মরার কথা।
সাপ ধরার সরঞ্জামও সাদাসিধে। হাতে এক ইঞ্চি মোটা আর দু’ হাত লম্বা একটা করে লাঠি। লাঠির এক মাথায় কম্বলের টুকরোর মতো ছোট জাল আটকানো। আর বিপাকের হাতিয়ার হিসেবে কোমরে ছোরা গোঁজা। হারমার বগলে সরু আর গোল বেতের ঝুড়ি একটা, তার মধ্যে ছোট ছোট কতগুলো দড়ির ফাঁক লাগানো থলে।
প্রথমেই অনায়াসে বড়সড় একটা নির্বিষ সাপ ধরে থলেতে পুরল ওরা। নির্বিষ সাপে পয়সা অনেক কম, কিন্তু বউনি ছাড়তে নেই। রেশমা ছুটে গিয়ে লাঠির মাথায় আটকানো কম্বলের জাল মাথায় ফেলতেই হারমা শক্ত দুহাতে ওটার গলার কাছটা চেপে ধরে ঝুড়িতে ঢুকিয়ে দিল। তারপর থেকেই গায়ে কাঁটা বাপীর। একটা সাদা-কালো শাঁখামুটের পেছনে তাড়া করেছে ওরা। এরও ফণা নেই, কিন্তু অতি বিষাক্ত। এবারে লাঠির জালের দিকটা ওদের হাতে। তরতর করে একটা গাছের দিকে এগোতে যাচ্ছিল, তার আগেই রেশমা লেজের ওপর লাঠির ছোট ঘা বসালো একটা। সাপটা ওর দিকে তেড়ে আসতেই পিছন থেকে হারমা তেমনি লেজে ঘা মারল। এই চলল মিনিট কতক। রেশমাকে তাড়া করে তো হারমা লেজে ঘা মারে। আর হারমাকে তাড়া করে তো রেশমা। বিষাক্ত সাপের বেলায় দেখা গেল শেষ কাজ রেশমার। ফাঁক বুঝেই খপ করে এক হাতে গলার কাছটা চেপে ধরে মাটি থেকে তুলে ফেলল, আর গায়ে জড়ানোর আগেই অন্য হাতের মুঠো আর আঙুল সাঁড়াশির মতো খানিকটা নিচের দিকে চেপে ধরেছে। চোখের পলকে হারমার লাঠির জালের দিকটা শাঁখামুটের মুখের ওপর। বিষদাঁত এই কম্বলের জালে আটকে গেল। তারপর ঝাঁপি থেকে থলে বার করে জাল সরিয়ে ওটার মুখে ধরলেই হল—তখন লেজ ওপরে মুখ নিচে। থলেতে না ঢুকে যাবে কোথায়?
এই দেখেই ঘাম ছুটেছিল বাপীর। তারপর দেড় ঘণ্টার মধ্যে পঁচিশ মিনিটের ফারাকে দু’দুটো গোখরো ধরা দেখে শরীরের রক্ত জল। প্রথমটা কম করে ছ’ফুট লম্বা হবে, পরেরটাও পাঁচ ফুটের কম নয়। আর তেমনি চক্কর বসানো বীভৎস ফণা। ধরার কায়দা একই, তবে ফণা আছে বলে আরো হুঁশিয়ার ওরা। ছোবল দেবার জন্য একজনের দিকে ফণা তুললেই অন্যজন লেজে বাড়ি দেয়। সেদিকে ফণা তুললেই অন্যজন তাই করে…রেশমার বুকের পাটা সম্পর্কে আবু বলেছিল, বিষাক্ত সাপগুলোর খপাখপ টুটি টিপে ধরা দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে। একটুও বাড়িয়ে বলে নি। দেখেই বাপীর কালঘাম ছুটেছে। টুটি যখন চেপে ধরে তখন রক্তবর্ণ মুখ রেশমার, আর চোখ দুটোও তখন সাপের মতোই ভয়াবহ। এক হাতে এই সাপ মুঠোয় ধরে রাখা যায় না, একটু বাদেই দু’হাতে লাগাতে হয়। ততক্ষণে সাপের তলার দিকটা হারমার এক হাতের মুঠোয়। মুখে জাল লাগিয়েই অন্য হাতে ঝাঁপি থেকে থলে বার করবে।
রেশমা হাঁপাচ্ছে আর বুকটা ফুলে ফুলে উঠছে। আবার হাসছেও। মুখ এখনো লাল। কাজ সারা হতেই ভক্ত শুরমার মুগ্ধ দু’ চোখ আবার ওর দিকে তন্ময়।
বাপীর দিকে চেয়ে রেশমা বলল, রোসো, ওটার জোড়টাও এক্ষুনি এ-দিকে এলো বলে। সম্ভব হলে বাপী রেশমাকে টেনে নিয়ে চলে যেত। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, মিনিট পঁচিশের মধ্যে কোথা থেকে বেরিয়ে সাপটা সোজা তেড়ে এলো। কি ঘটেছে আঁচ করতে পেরেই হয়তো এই হিংস্র আক্রোশ। এটাকেও থলেতে পোরার পরে এই দিনের মতো ক্ষান্ত হল রেশমা।
খুশিতে আটখানা। তুমি আমার খুব পয়মন্ত লোক দেখি যে বাপীভাই! দু’—ঘণ্টার মধ্যে তিন-তিনটে জাতসাপ ধরে ফেললাম। তোমার পয়ে একটা শঙ্খচূড় পেলে হত—একটাতেই ডবল টাকা।
রেশমার হুকুমে ঝুড়ি মাথায় হারমা আগে আগে চলেছে—আবু সাহেবকে দেখিয়ে ওটা সাপ-ঘরে রেখে আসবে।
বাপী বলল, ভালো টাকা রোজগার হল আজ তাহলে?
—হলই তো। সঙ্গে সঙ্গে চোখেমুখে রাগের ঝলক।—অন্য লোকে ধরলে আরো বেশি টাকা পেত, আমি বলে ওই ম্যানেজারের বজ্জাতির জন্য কম পাই। এই তিনটে বিষাক্ত সাপের জন্য অন্য লোকে কম করে তিন-পাঁচে পনের টাকা পাবে।
—আর তুমি?
—আমাকে দেবে বারো টাকা। এর থেকে হারমাকে ছ’আনা ভাগ দিলে আমার কি এমন থাকে?
অর্থাৎ একটা সাপের জন্য চার টাকা। ওর ভাগে থাকে আড়াই টাকা। বুকের তলায় মোচড় পড়ছে বাপীর। মাত্র আড়াইটে টাকার জন্য এক-একবার হাতের মুঠোয় প্রাণ!
রেশমার আবারও ঝাঁঝালো গলা—ওই ম্যানেজারকে বলে আমার পাওনাটা এবারে তুমি ঠিক করে দাও না, অন্যের থেকে আমি কম পাব কেন?
—আমি বললে বেশি দেবে?
—হাড় পাজি ওটা, এমনি বললে দেবে না, একটু তোষামোদ করে বলতে হবে।
বাপী জবাব দিল, আমার দ্বারা ওটাই তো হয় না…
—হয় না মানে, নিজের জন্যে তো বেশ তোষামোদ করতে পারো!
কি মনে পড়তে বাপীর স্নায়ুগুলো সজাগ হয়ে উঠল হঠাৎ। ভালো করে মুখখানা দেখে নিতে ইচ্ছা করল। কিন্তু খানিক আগের ভয়াল উত্তেজনা কমে আসার পর এই মেয়ের পাশাপাশি চলাটাই অস্বস্তিকর। হারমা হয়তো রাগ বা অভিমান করেই অনেকটা এগিয়ে গেছে।
সাদা মুখেই বাপী জিগ্যেস করল, তুমি পারো না তাকে তোষামোদ করতে?
—আমি? আমি ওর ঘরে কেউটে বা গোখরো ছেড়ে দিয়ে আসতে পারি।
—সেই রাতে তাই ছাড়তে গেছলে?
এক ঝটকায় সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল রেশমা।—কোন্ রাতে?
—পনের-ষোল দিন আগে যে রাতে আবুকে সঙ্গে করে আমি নিজের জন্য তোষামোদ করতে গেছলাম?
কয়েক মুহূর্তের জন্য হতচকিত মুখ। তারপরেই দু’ চোখ ঝলসে উঠল।— তোমাকে কে বলল?
—কেউ না। আমার ধারণা তুমি তখন ম্যানেজারের ভিতরের ঘরে ছিলে। বাপী হাসছে অল্প অল্প। অত চোখ লাল কোরো না, সরো!
ছিটকে সরে গিয়ে রেশমা দ্রুত হেঁটে চলল। একটু বাদেই গাছগাছড়ার আড়ালে।
বাপী সেখানেই আরো খানিক দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মাস্টার মশাই ললিত ভড়ের মেয়ে কুমকুমের মুখখানা মনে পড়ল। পেটের দায়ের সেই মুখের সঙ্গে রেশমার এই মুখের অনেক তফাৎ।
রেশমা বারবর্ণিনী নয়। রেশমা ফণিনী।