কালীপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস
কালীপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস হল তার কালীবাড়ি। বাদা অঞ্চলের এই দুর্গম গাঁয়ে লোকজনের যাতায়াত কম। তবু লোকে ওই কালীবাড়ির টানে কষ্ট সয়েও আসে। শোনা যায় পর্তুগিজ বোম্বেটের আমলে একজন দেশি ডাকাতও খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। তার নাম তারাপ্রসাদ। এ-গাঁয়ের প্রতিষ্ঠাতা সে-ই। কালীবাড়িও তার প্রতিষ্ঠা করা। ডাকাত তারাপ্রসাদ গরিবের বন্ধু ছিল, দানধ্যান ছিল প্রচুর। পর্তুগিজ বোম্বেটেদের সঙ্গে লড়াইও সে করেছে এলাকা দখলের জন্য। তখনকার শাপদসঙ্কুল সুন্দরবনে সে অকুতোভয়ে দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াত নৌকো এবং ছিপে। লোকে বলত, তারাপ্রসাদ পিশাচসিদ্ধ।
তারাপ্রসাদ নেই, তবে তার প্রতিষ্ঠিত গাঁ এবং কালীবাড়ি আছে। আর আছে তার এক বংশধর। কালীপ্রসাদ। তারাপ্রসাদকে লোকে ভয় পেত। কালীপ্রসাদকেও সবাই দারুণ ভয় খায়। তার কারণ কালীপ্রসাদ অতিশয় রহস্যময় পুরুষ। যেমন গম্ভীর তেমনই অমিশুক, কালীপুরের মায়ের মন্দিরের পিছনে কয়েক ফার্লং দূরে কালীপ্রসাদের বিশাল বাগানঘেরা পাকা বাড়ি। সেই বাড়িতে কালীপ্রসাদ ছাড়া আর থাকে একজন রান্নার লোক এবং একজন কাজের লোক। এ-দু’জন কালীপুরের বাসিন্দা নয়, কালী প্রসাদ অন্য জায়গা থেকে এদের আনিয়েছেন। কাজের লোকটি বোবা এবং কালা, পাঁচক ঠাকুরটি অত্যন্ত কম কথার মানুষ। কালীপ্রসাদের সঙ্গে গাঁয়ের লোকের বিশেষ ভাবসাব নেই। তাঁর বাড়িতে কেউ কস্মিনকালে যায় না। পুজোর চাঁদা তুলতে বা বিজয়ার কোলাকুলি করতেও নয়। কারণ কালীপ্রসাদ ওসুব পছন্দ করেন না।
কালীপ্রসাদ সম্পর্কে গাঁয়ে নানা কিংবদন্তি আছে। তার মধ্যে একটা হল, কালীপ্রসাদ ভূত পোষেন। তাঁর পোষা ভূতের সংখ্যা কারও মতে সাত, কারও মতে সতেরো। কালী প্রসাদের বাড়িতে নিশুত রাতে হঠাৎ-হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি দেখা যায়, লাল-নীল ধোঁয়া ওড়ে, বিচিত্র সব শব্দ হয়। অনেকে দেখেছে, অনেকে শুনেছে। কালীপ্রসাদ ভূত পোষেন কি না তা হলফ করে বলা যাবে না, তবে একসময়ে বাঘ পুষতেন। সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল বাঘের একটা বাচ্চা জঙ্গলের কোথাও কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে আসেন। সেটা ধীরে ধীরে বিরাট আকারের কেঁদো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কয়েক বছর আগেও সেটা স্বাধীনভাবে বাড়ির ভেতরে ঘুরে বেড়াত। সেটা মারা গেছে। এখন কালীপ্রসাদ পায়রা পোষেন। তাঁর নানারকমের অনেক পায়রা আছে।
যৌবনকালে কালীপ্রসাদ কলকাতায় থাকতেন। বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। খুবই ভাল ফুটবল খেলতেন। কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা বাবু মিত্তির। দুজনের দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পরে বাবু মিত্তির বিদেশে চলে যান। কালী প্রসাদের সঙ্গে তারপর থেকে আর যোগাযোগ ছিল না। দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে বাবু মিত্তির ফিরে এসে যখন সংসারী হতে চাইলেন, তখন তাঁর বিয়ের নেমন্তন্ন পেয়ে কালীপ্রসাদ গিয়েছিলেন। দুই বন্ধুতে তখন খুব পুরনো দিনের কথা হয়। তারপর থেকে আবার কালীপ্রসাদ যাওয়া-আসা করতেন, বাবু মিত্তিরও সপরিবারে এসে কয়েকবার কালীপুরে কাটিয়ে গেছেন। চণ্ড রাগ আর দুর্ব্যবহারের জন্য বাবু মিত্তিরকে কেউ পছন্দ করে না বটে, কিন্তু কালীপ্রসাদকে বাবু মিত্তির বরাবরই একটু আলাদা খাতির করেন।
চিরকাল সমান যায় না। বাবু মিত্তির ব্যবসা করে হঠাৎ টি বড়লোক হয়ে গেলেন, ব্যস্ততা বাড়ল। কালীপ্রসাদও আর ঘন-ঘন যেতেন না। মেলামেশাটা কমে গেল। তারপর একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।
বছরদশেক আগে হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলা শোকার্ত চেহারায় একটি কিশোর এসে হাজির হল।
“আমাকে চিনতে পারছেন?”
কালীপ্রসাদের বুদ্ধি, স্মৃতি ও অনুমানশক্তি অত্যন্ত প্রখর। তিনি চিনতে পেরে চমকে উঠে বললেন, “তুই তো রকি! কী হয়েছে?”
রকি অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করল। তারপর মায়ের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে বলল, “বাবার সঙ্গে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব। বাবা আমাকে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান বক্সার করতে চায়। আমি তা চাই না। মা মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছে, তিনি যদি না বাঁচেন তবে তাঁর মৃত্যুর পর আমি যেন আপনার কাছে চলে আসি। কালীকাকা, আপনি আমাকে যদি আশ্রয় নাও দেন তবু দয়া করে বাবাকে আমার খোঁজ দেবেন না। বাবা তা হলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।”
কালীপ্রসাদ এই দুর্বলচিত্ত ছেলেটির সমস্যা বুঝতে পারলেন। বাবু মিত্তির যে জেদি ও অবুঝ মানুষ তাও তিনি ভালই জানেন। তাই বললেন, “তোর ভয় নেই। আমার কাছেই থাক। বাবু জানতে পারবে না।”
রকি সভয়ে বলল, “বাবা যদি খুঁজতে-খুঁজতে এখানে চলে আসে?”
কালীপ্রসাদ মাথা নেড়ে বললেন, “আসবে না। তার কারণ তুই যে কালীপুরের রাস্তা চিনে আসতে পারবি সেটাই তার বিশ্বাস হবে না। তুই তো বোধ হয় পাঁচ-ছয় বছর বয়সে এখানে শেষবার এসেছিস। চিনলি কী করে?”
“কালীপুর নামটা মনে ছিল। মা বলে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করে করে চলে এসেছি।”
কালীপ্রসাদ একটু চিন্তা করে বললেন, “এসে যখন পড়েছিস তখন আর ভাবনা নেই। তবে গাঁয়ে থাকার দুটো অসুবিধে আছে। নতুন লোক দেখলে গাঁয়ের মধ্যে কথা উঠবে আর সেটা ছড়িয়ে পড়তেও দেরি হবে না। দ্বিতীয় অসুবিধে হল, এখানে থাকলে তোর লেখাপড়া হবে না। কয়েকটা দিন থাক, তোর মায়ের শ্রাদ্ধশান্তি এখানেই কর। তারপর কিছু একটা ঠিক করা যাবে।”
কালীপ্রসাদ রকিকে কালীপুরে রাখেননি। তাঁর পয়সার অভাব নেই। তারা-ডাকাতের কল্যাণে সোনাদানা, হিরে-জহরত, রুপোর বাঁট, বাসনকোসন যা ছিল তার দাম লাখ-লাখ টাকা। পাপের রোজগার বলে কালীপ্রসাদ তাতে হাত দেননি, বিলিয়েও দেননি। তারাপ্রসাদের সেই গুপ্ত সম্পদ এবার রকির কাজে লাগালেন। তাকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন লেখাপড়া করতে। পরে রকি নিজের মোগ্যতাতেই বিদেশে চলে যায়। সম্প্রতি সে ফিরে এসে কালীপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করে। এখন সে মস্ত এঞ্জিনিয়ার। লম্বা-চওড়া চেহারা হয়েছে।
এসে বলল, “বাবা হয়তো এখনও আমার ওপর রাগ করে আছে। আমার হুট করে তাঁর কাছে যেতে সাহস হয় না। তবু আমি বাবাকে জানাতে চাই যে, আমি বেঁচে আছি এবং বক্সার না হলেও আমি আমার মতো হয়েছি।”
কালী প্রসাদ একটু ভেবে বললেন, “যতদূর জানি বাবুর শরীর ভাল নয়। পারকিনসন্স ডিজিজ হয়েছে। হার্ট খুব মজবুত নয়। হুট করে খবর দিলে হয়তো ভীষণ শক লাগবে। হঠাৎ করে আনন্দটাও ভাল ব্যাপার নয়। তুই ভাবিস না। খবরটা আমি সইয়ে-সইয়ে দেব’খন।”
রকি আমেদাবাদে তার কর্মস্থলে ফিরে গেল। কালীপ্রসাদ তাঁর পোষা দুটি শিক্ষিত পায়রা নিয়ে দেখা করতে গেলেন বাবুর সঙ্গে।
অনেক কথা হল দুজনে। কালীপ্রসাদ বুঝতে পারলেন, হারানো ছেলের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে আছেন বাবু মিত্তির। কিন্তু সেই উৎকণ্ঠাটা এতই প্রবল যে, ছেলের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবু মিত্তির হয়তো হার্টফেল করবেন।
সুতরাং কালীপ্রসাদ নানা কথা ফাঁদলেন। বললেন, “হ্যাঁ রে, তুই কি ভূতে বিশ্বাস করিস?”
বাবু মিত্তির অবাক হয়ে বললেন, “হঠাৎ ভূতের কথা কেন?”
“করিস কি না বল না।”
“আগে করতাম না। আজকাল মন্ত্র-তন্ত্র, ভূত-প্রেত সব বিশ্বাস করি। রকির খোঁজে আমি তো দু দফায় দু’জন তান্ত্রিককেও লাগিয়েছিলাম। জ্যোতিষীরাও কম পয়সা নেয়নি।”
“কালীপুরে সবাই বলে, আমার নাকি পোষা ভূত আছে।”
বাবু মিত্তির হাসলেন। বললেন, “সেটা শুনেছি।”
“বিশ্বাস করিস?”
“তোর যে পোষা ভূত আছে সেটা কি তুই নিজেই বিশ্বাস করিস?”
কালীপ্রসাদ খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “যদি বলি আছে, বিশ্বাস করবি?”
বাবু মিত্তির হেসে বললেন, “তোর অনেক খ্যাপামি আছে জানি। ওই অজ পাড়াগাঁয়ে ল্যাবরেটরি বানিয়ে নানা আজগুবি এক্সপেরিমেন্ট করিস, গাঁয়ের লোক সেটাকেও ভৌতিক ব্যাপার বলে ভয় খায়। আমাকেও কি ওদের দলে ফেলতে চাস?”
“আমি কোনও আজগুবি এক্সপেরিমেন্ট করি না। বিকল্প বিদ্যুতের উৎস খোঁজার জন্য আমি প্রাণপাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কোটি-কোটি টাকা খরচ হচ্ছে এই গবেষণায়। মাটির নীচে কয়লা আর তেল ফুরিয়ে আসছে। একুশ শতকের গোড়ায় যদি বিকল্প শক্তির উৎস না বের করা যায় তা হলে মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের অত টাকা নেই। আমি শস্তা এবং সহজ উপায়ে কিছু করা যায় কি না সেই চেষ্টা করছি। হয়তো লাভ হবে লবডঙ্কা, কিন্তু কাজ একটু এগিয়ে রেখে যাচ্ছি। তার রেকর্ডও থাকছে। যদি কেউ আমার কাজের ফাঁক-ফোকর-ত্রুটি শুধরে পরবর্তীকালে কিছু করতে পারে তাতে আখেরে মানুষের লাভই হবে।”
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু এর মধ্যে ভূত আসছে কোথা থেকে?”
কালীপ্রসাদ হাসলেন। বললেন, “ভূতের ব্যাপারটা কিছুদিন হল ঘটছে। বিয়ে-টিয়ে করিনি, আমার সংসার বলতেও কিছু নেই। একা মানুষ তো, নানারকম বাতিক দেখা দেয়। আমি কিছুদিন আগে নিশুত রাতে একা-একা প্ল্যানচেট করার চেষ্টা করতাম। কীরকম করে করতে হয় তা জানি না। একা ঘরে বসে একটা মোম জ্বেলে খুব একাগ্রতার সঙ্গে আমার দাদু শিবপ্রসাদকে ভাবতে শুরু করি। রোজ একই প্রসেস। দিন-সাতেক রোজ একইভাবে তাঁকে চিন্তা করতে করতে এবং তাঁকে
চাক্ষুষ করার আগ্রহ বাড়াতে বাড়াতে একদিন হঠাৎ বন্ধ ঘরের মধ্যে মোমবাতির শিখাটা কেমন যেন এঁকেবেঁকে লতিয়ে উঠতে লাগল। তারপর নিভে গেল। আমি চুপ করে শ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল, ঘরে আমি একা নই। আরও কেউ একজন আছে। ভয় বলে আমার কিছুই নেই। তবে একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, যা অনুভব করছি তা সত্য কি না। খানিকক্ষণ পর হঠাৎ খুব ক্ষীণ একটা ফিসফিসানি শুনতে পেলাম, ‘আমি তোমার দাদু শিবপ্রসাদ। কী জানতে চাও বলো! আমি ভয় পাইনি, তবু কেমন যেন শরীরটায় ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। আমার নিজের অনেক কিছু জানার আছে। তাই প্রথমেই জিজ্ঞেস করলাম, পৃথিবীতে বিকল্প শক্তির আবিষ্কার সম্ভব হবে কি না।’ দাদু জবাব দিলেন, “আমি সবজান্তা নই। আরও কয়েকটা প্রশ্ন করে বুঝলাম, দাদু জবাব দিতে চাইছেন না। তখন প্রশ্ন করলাম, আমার বন্ধু বাবু মিত্তিরের নিরুদ্দেশ ছেলে রকি কি বেঁচে আছে? দাদু এবার কিন্তু বেশ জোর গলায় বললেন, ‘আছে।’ শুনে খুব একটা আনন্দ হল। বললাম, ‘কোথায় এবং কেমন আছে? দাদু বললেন, ‘বেশি বলা সম্ভব নয়। তবে ভাল আছে।”
বাবু মিত্তির ঘটনাটা শুনতে-শুনতে কেমন যেন লাল হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ উঠে দ্রুতবেগে পায়চারি করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে হাঁফাতে লাগলেন। সবাঙ্গ ঘামে ভেজা।
কালীপ্রসাদ বন্ধুর অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ছেলের জন্য নীরবে গোপনে দুশ্চিন্তা করতে করতে বাবু যে নিজের জীবনীশক্তিকে নিংড়ে দিয়েছেন, তা খুব গভীরভাবে বুঝতে পারলেন কালী প্রসাদ।
বাবু মিত্তির স্বাভাবিক হতে অনেক সময় নিলেন। তারপর ফ্যাঁসফ্যাঁসে হাঁফধরা গলায় বললেন, “কালীপ্রসাদ, তুই যা বলছিস তা যে সত্যি তা আমাকে ছুঁয়ে বল।”
কালীপ্রসাদ নির্দ্বিধায় বন্ধুর হাত স্পর্শ করে বললেন, “তোর ছেলে যে বেঁচে আছে তাতে আমার কোনও সন্দেহ নেই।”
“আমি তার খবর চাই।”
“খবর পেলেই আমি তোকে জানাব, দাদুর সঙ্গে আমি আবার কথা বলবার চেষ্টা করব।”
“তুই থাকিস সুন্দরবনে, দুর্গম জায়গায়। আমি খবর পাব কী করে?”
কালীপ্রসাদ হাসলেন, বললেন, “সেইজন্যই আমার পায়রা-দূত নিয়ে এসেছি। তুইও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবি, আমিও পারব।”
বাবু মিত্তিরকে রকির খবরটা পুরো জানাতে কেন যেন ইচ্ছে হল না তাঁর। কেন যেন মনে একটা বাধা অনুভব করছিলেন কালীপ্রসাদ। তাড়া নেই, খবরটা দু-চারদিন পরে দিলেও হবে।
কলকাতা থেকেই তিনি আমেদাবাদে ট্রাঙ্ককল করে রকিকে সব জানিয়ে বললেন, “ভূতের গল্প বানিয়ে বলতে হয়েছে। সাধারণভাবে বাবুর পক্ষে গল্পটা বিশ্বাস করা সম্ভব হত না। কিন্তু এখন মানসিক অবস্থা এত খারাপ যে, বিশ্বাস করেছে।”
রকি করুণ গলায় বলল, “বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কালীকাকা।”
“কষ্ট হোক, তবু দুম করে ফোনটোন করে বসিস না যেন। ও তোর গলা শুনলে না হার্টফেল করে। ক’দিন একটু সয়ে যাক। সময় বুঝে আমি যা করার করব।”
কালীপ্রসাদ গাঁয়ে ফিরে এলেন। আর এসেই পড়লেন মুশকিলে।
কালীপ্রসাদ বিজ্ঞানী মানুষ। ভূতের গল্প বানিয়ে বললেও তাঁর বাস্তবিক ভূতে কোনও বিশ্বাস নেই। ওসব নিয়ে চিন্তাভাবনাও করেননি কখনও। থাকেন নিজের কাজ নিয়ে। বিশাল বাড়ির একতলার হলঘরে ল্যাবরেটরি। সেখানেই তাঁর দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে। নানারকম রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া, পাথর, ধাতু, গাছ-গাছড়া সবকিছু নিয়েই তিনি কাজ করেন। প্রতিদিনকার কাজের নোট রাখে। এসব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, অন্য কিছু নিয়ে ভাববার অবকাশই তাঁর নেই।
কিন্তু যেদিন বাবু মিত্তিরকে ভূতের গল্প শুনিয়ে গাঁয়ে ফিরে এলেন সেই রাতেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।
অনেক রাতে ল্যাবরেটরির কাজ শেষ করে যখন ওপরে দোতলায় শোওয়ার ঘরে ঘুমোতে এলেন, তখন কালীপুর এক শব্দহীন ঘুমের পুরী। বেশ শীত পড়েছে। চারদিকে ঘন কুয়াশা। শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ হচ্ছে।
ঘরের দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে লেপের তলায় ঢুকবার পরই তাঁর হঠাৎ মনে হল, ঘরে তিনি একা নন। আর কেউ আছে। কোনও শব্দ হয়নি বা কিছু চোখেও পড়েনি। তবু মনে হল। তিনি টর্চ জ্বেলে ঘরটা দেখলেন। কেউ কোথাও নেই। খাটের তলাও ফাঁকা। তবে কি মনের ভুল? তাই হবে। কালীপ্রসাদ চোখ বুজলেন। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি হতেই লাগল।
একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ হল কি? কালীপ্রসাদ উঠে বসলেন। হাতে টর্চ। মৃদুস্বরে বললেন, “কে?”
কেউ জবাব দিল না। কিন্তু দেওয়ালঘড়িতে টং করে একটা শব্দ হল। রাত একটা বাজে কি? নাকি সাড়ে বারোটা? নাকি দেড়টা? ঘড়ি দেখে চলার অভ্যাসই নেই কালী প্রসাদের। বাদা অঞ্চলের গাঁয়ে ঘড়ি ধরে চলার কোনও কারণও তো নেই। কালী প্রসাদ কদাচিৎ ঘড়ির দিকে তাকান। সময়টা তাই ধরতে পারলেন না। খাট থেকে নেমে চারদিকটা তন্ন-তন্ন করে দেখলেন টর্চ জ্বেলে। কোথাও কেউ নেই।
বারান্দায় এসে দেখলেন, বাইরে কুয়াশায় মাখা জ্যোৎস্নায় বনে-জঙ্গলে যেন এক অপ্রাকৃত কিছুর সঞ্চার হয়েছে। এ যেন চেনা কালীপুর নয়। স্বপ্নে দেখা কোনও জায়গা।
সিঁড়ি দিয়ে একটা অস্পষ্ট পায়ের শব্দ নেমে যাচ্ছে কি? কালীপ্রসাদ তাড়াতাড়ি গিয়ে সিঁড়ির মুখ থেকে নীচে আলো ফেললেন। কাউকে দেখা গেল না। কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলেন একজোড়া ভারী চটির শব্দ যেন সন্তর্পণে নীচে নেমে একতলার দরদালান দিয়ে ল্যাবরেটরির দিকে যাচ্ছে।
কালীপ্রসাদ সাহসী মানুষ। তবু একটু বিহ্বল বোধ করতে লাগলেন। এরকম অভিজ্ঞতা তাঁর নতুন। তিনি ঘরে এসে তাঁর মোটা লাঠিগাছটা নিয়ে একতলায় নেমে এলেন। এ-অঞ্চলে এমন কোনও চোর নেই, যে কিনা তাঁর বাড়িতে হানা দেওয়ার সাহস রাখে। কালী প্রসাদকে সবাই
ভয় খায়। তবে আজ কোন চোরের এমন বুকের পাটা দেখা দিল?
তিনি পায়ের শব্দ না করে ল্যাবরেটরির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দরজা ভেজানোই থাকে। তালা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ, একতলার সদর দরজা বন্ধ থাকলে কেউ ঢুকতে পারে না। বাইরে থেকে কান পেতে ভেতরে কোনও শব্দ হচ্ছে কিনা শোনার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এমন সময়ে কে যেন তাঁর কাঁধে খুব মৃদু একটা চাপড় দিল।
কালীপ্রসাদ চমকে ফিরে তাকালেন। কেউ নেই। একটু হতভম্ব বোধ করলেন তিনি।স্পষ্ট টের পেয়েছেন, কাঁধে কেউ চাপড় দিয়েছে! লোকটা কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? কালীপ্রসাদ শরীরে একটা শীতল শিহরন অনুভব করেও লজিক হারালেন না। এমনও হতে পারে একটা চামচিকে উড়তে-উড়তে তাঁর পিঠে পাখার ঝাঁপটা দিয়েছে। ব্যাখ্যাটা খুব মনঃপূত হল না তাঁর, তবু লজিক্যাল বলে মনে হল।
ল্যাবরেটরির মধ্যে কোনও শব্দ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ খুব ক্ষীণ একটা কাঁচের শব্দ শুনে কালীপ্রসাদের দৃঢ় ধারণা হল, ল্যাবরেটরিতে চোর বা আগন্তুক কেউ ঢুকে পড়েছে। তিনি দরজাটা আস্তে করে খুলে ভেতরে ঢুকলেন।
ঘর নিরেট অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাঁচের পাত্র নাড়াচাড়ার একটা ক্ষীণ শব্দ শুনেছিলেন, এখন অবশ্য কোনও শব্দ নেই। কালীপ্রসাদ টর্চ জ্বেলে দেখলেন, তারপর ইনভার্টার চালু করে আলো জ্বেলে তন্ন-তন্ন করে খুঁজলেন। কেউ কোথাও নেই। চিন্তান্বিত কালী প্রসাদ আলো নিভিয়ে যখন ল্যাবরেটরি থেকে বেরোতে যাবেন, ঠিক তখনই কে যেন আবার তাঁর পিঠে খুব আলতো করে একটা চাপড় দিল। কালীপ্রসাদ আবার চমকে উঠলেন। টর্চ জ্বেলে, বাতি জ্বেলে ফের দেখলেন। কেউ কোথাও নেই।
চামচিকেই হবে, ভেবে নিয়ে কালীপ্রসাদ দরদালানে বেরিয়ে এসে যখন দোতলায় উঠতে যাবেন তখন আর চাপড় নয়, কে যেন তাঁর কাঁধে আলতো করে হাত রাখল। কালীপ্রসাদ হাতটা ধরার জন্য একটা থারা দিলেন। হাতটা সরে গেল।
বাদা অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁয়ে তাঁর জন্ম, বাঘ অবধি পুষেছেন, অসমসাহসী কালীপ্রসাদ ভয় কাকে বলে তা জানতেনই না। কিন্তু এখন হঠাৎ ভয় যেন বাঘের মতোই সাপটে ধরল তাঁকে। শরীরটা কেমন ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে যেতে লাগল। ভেতরে একটা কাঁপুনি। মাথাটা ঝিমঝিম। তাঁর দু’জন কাজের লোক তিনতলার ছাদে দুখানা ঘরে থাকে। তাদের ডাকার মতো ক্ষমতাই নেই কালী প্রসাদের। এমনকী সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় অবধি উঠতে পারছেন না। শরীরটা যেন সাতমন ভারী হয়ে গেছে। এই অবস্থাকেই কি স্তম্ভন বলে? নাকি তাঁর স্ট্রোক হয়ে গেল? মাথায় কোনও গণ্ডগোল হয়ে যায়নি তো!
সিঁড়ির গোড়ায় কালীপ্রসাদ অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পাও নড়তে পারলেন না। হঠাৎ টের পেলেন, তাঁর কানের কাছে অনেক মশা যেন পিনপিন শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। এত মশা কোথা থেকে এল তা বুঝতে পারলেন না। চাষবাসে পোকা মারার ওষুধ দেওয়ার ফলে আজকাল আর এ-অঞ্চলে মশা বিশেষ নেই। তার ওপর কালী প্রসাদের বাড়িতে রোজ রিপেলেন্ট স্প্রে করা হয়।
হঠাৎ কালীপ্রসাদের মনে হল, মশা বলে যাদের ভাবছেন তারা মশা নয় হয়তো। কারণ পিনপিন শব্দটা একটু অন্যরকম। কালীপ্রসাদ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে মনোযোগ দিয়ে শব্দটা শুনবার চেষ্টা করলেন। খানিকক্ষণ চোখ বুজে প্রায় ধ্যানস্থ থাকার পর তিনি বুঝতে পারলেন, মশার শব্দ বলে যা মনে হয়েছিল আসলে তা খুব চিকন, খুব মিহি, খুব মৃদু একটা গলার স্বর। এই অপ্রাকৃত ঘটনায় তাঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তবু প্রাণপণে নিজেকে সংযত রাখলেন। ভাবলেন, যা হওয়ার হবে।
চোখ বুজে ফের ধ্যানস্থ হয়ে গলার স্বরটাকে শোনার ও বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন কালী প্রসাদ। দোতারা বা ওই ধরনের তারের যন্ত্রের মতো স্বরটা প্রথমে সঙ্কেতধ্বনি বলে মনে হচ্ছিল। তারপর একটা-দুটো শব্দ ওর মধ্যেই বুঝতে পারলেন। কে যেন বলছে, তুমি মিথ্যাচারী! তুমি মিথ্যাচারী!
কালীপ্রসাদ অস্ফুট গলায় বললেন, “আপনি কে?”
“তারাপ্রসাদ।”
কালীপ্রসাদ সভয়ে বললেন, “আমার প্রণাম। আমি কী অপরাধ করেছি?”
“বন্ধুর কাছে পূর্বপুরুষের মিথ্যে গল্প বলেছ।”
“বন্ধুকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছি। ক্ষমা করুন।”
“তোমার ঠাকুদার আত্মার অপমান হয়েছে।”
“অপরাধ হয়েছে। আর করব না।”
“তুমি অকৃতজ্ঞ। তুমি জানো যে, তোমার পূর্বপুরুষেরা সর্বদাই তোমাকে ঘিরে থাকেন! সর্বদাই তোমার মঙ্গলের জন্য চেষ্টা করেন!”
“আজ্ঞে, জানতাম না।”
“তোমার বন্ধু পাপী লোক। তার কর্মফল ফলবেই। তুমি ওর মধ্যে যাবে না।”
“যে আজ্ঞে। কিন্তু তার ছেলেটা যে ভাল।”
“বাবু মিত্র অপঘাতে মরবে। দিন ঘনিয়ে আসছে।” কালীপ্রসাদ শিহরিত হলেন। বাবু মিত্তিরের অতীতের কিছুটা যে ভাল নয় তা তিনি জানেন। কিন্তু বন্ধুর প্রতি তাঁর একটা গভীর ভালবাসাও আছে। করুণ স্বরে বললেন, “তাঁকে বাঁচানোর কি কোনও উপায় নেই?”
“তুমি তাকে বাঁচাতে চাও?”
“চাই।”
“তা হলে একেবারে চুপ করে থাকো, তার উপকার করতে গেলে অপকারই হবে। মিথ্যাচার করে বংশে কালি দিয়ো না।”
“যে আজ্ঞে।”
“পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে কিছুই করতে পারবে না। তুমিই আমাদের বংশের শেষ বংশধর। তোমার পর এই বংশ লুপ্ত হয়ে যাবে। তাতে আমরা দুঃখিত নই। শেষ বংশধর হিসেবে তোমার গুরুত্ব অনেক। সেটা ভুলে যেয়ো না।”
“যে আজ্ঞে। কিন্তু বাবু মিত্তিরের কী ব্যবস্থা হবে?”
“যথাসময়ে দেখা যাবে।” কানেব পিনপিন শব্দ হঠাৎ মিলিয়ে গেল। তারাপ্রসাদ বিদায় নিলেন। কালীপ্রসাদও ফের স্বাভাবিক হলেন। প্রথমটায় প্রচণ্ড ভয় পেলেও ধীরে ধীরে তারাপ্রসাদের সঙ্গে বাক্য বিনিময় করতে গিয়ে ভয়টা কেটে গেছে। কালীপ্রসাদ রাতটা আর ঘুমোলেন না, সাধন-ভজন করে কাটিয়ে দিলেন।
এই ঘটনার বেশ কিছুদিন বাদে বিকেলের দিকে তাঁর বাতাবাহী পায়রাটা উড়ে এল। পায়ে কৌটোয় বাঁধা চিরকুট। তাতে লেখা, “আমার জীবন সংশয় দেখা দিয়েছে। ডেল্টা তার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। মৃত্যু ঘনিয়ে এল। আমার ছেলেটার খবর দয়া করে যদি দিস তা হলে এ-সময়ে সেইটেই হবে আমার সবচেয়ে বড় পাওনা। ডেল্টা ইতিমধ্যে আমার কুকুরটাকে মেরেছে। তুই দেরি করিস না।”
কালীপ্রসাদ চিরকুটটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। কী করবেন তা ভেবে পেলেন না। কিন্তু তারাপ্রসাদের আদেশ অগ্রাহ্য করা যে উচিত হবে না সেটাও তিনি জানেন। রকিকে কি খবরটা দেবেন? বুঝতে পারলেন না।
রাত গম্ভীর হল। কালীপ্রসাদ তাঁর ল্যাবরেটরিতে অনেকক্ষণ কাজ করে ক্লান্ত বোধ করছেন। প্রায় তিনদিনের গবেষণার কথা লিখতে লিখতে আঙুল ব্যথা করছে। শোবেন বলে উঠতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর ডান হাতটা এগিয়ে গিয়ে কলমটা তুলে নিল। তারপর সাদা কাগজের ওপর কলমটা যেন কিছু লিখতে লাগল। এই অদ্ভুত অবৈজ্ঞানিক কাণ্ড দেখে কালীপ্রসাদ প্রথমটায় হতচকিত হয়ে পড়লেও সামলে নিলেন। ডান হাতকে তার কাজ করে যেতে দিয়ে নিজে চুপ করে বসে রইলেন।
মিনিটপাঁচেক দ্রুতবেগে লেখার পর হাতটা থামল।
কালীপ্রসাদ ঝুঁকে পড়ে দেখলেন, কাগজে লেখা হয়েছে :
বাবু মিত্তিরের আশঙ্কা অমূলক নয়। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি তো আছেই। ডেল্টা তাকে সহজ উপায়ে মারবে না। মারবে কষ্ট দিয়ে। সে যা অনুমান করছে, সেভাবে নয়। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে তার মৃত্যু আসবে। ধীরে-ধীরে তিল-তিল করে যন্ত্রণা সয়ে মরতে হবে তাকে। তুমি তার উপকার করতে চাও জানি। তুমি আমাদের শেষ বংশধর। তোমাকে আমরা সাহায্য করতে চাই। কাল সকালে পায়রা মারফত তুমি তাকে লিখে পাঠাও, যেন সে কোনওক্রমেই কাল তার বিছানায় না শোয়। কাল তার চাঁদরের তলায় একটি ছুঁচের মতো জিনিস রাখা থাকবে। এটি সাধারণ জিনিস নয়, একটি তেজস্ক্রিয় শলাকা। যদি সে বিছানায় শোয় তবে অবধারিত তার কর্কট রোগ দেখা দেবে। ওটি যেন বেশ সাবধানে চিমটে দিয়ে ধরে মাটিতে গভীর গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়। বিছানাটাও ফেলে দেওয়া উচিত। কিন্তু সবটাই করতে হবে গোপনে। কেউ জানতে পারলে বাবু মিত্তিরের ঘাতকরাও জেনে যাবে। খুব সাবধান। তাকে কিছুতেই তার ছেলের খবর দিয়ো না।
.
কালীপ্রসাদ চমৎকৃত হলেন। পূর্বপুরুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর মাথা নত হয়ে এল। তিনি এটাও বুঝতে পারলেন, রকির খবর কেন বাবুকে জানানো উচিত নয়। কারণ, বাবু মিত্তির যদি জানতে পারে তা হলে সে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য উদ্যোগ নেবেই। আর তখন তার ঘাতকরাও জেনে যাবে যে, তার ছেলে বেঁচে আছে। হৃদয়হীন ডেল্টা তখন প্রথমেই মারবে বাবুর ছেলেকে। বোধ হয় এইজন্যই তিনি বাবু মিত্তিরকে রকির খবর দিতে গিয়েও দিতে পারেননি। ভেতরে-ভেতরে একটা বাধা পেয়েছিলেন। সেও কি তাঁর পূর্বপুরুষদেরই কাজ? তাই হবে।
চিন্তা-ভাবনায় রাতটা আর ঘুমোতে পারলেন না কালীপ্রসাদ। ভোরবেলা উঠেই পায়রার পায়ে চিরকুট বেঁধে ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তবু নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। নিজেও তৈরি হয়ে নিলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লেন।
কলকাতায় এসেই তিনি প্রথমে ট্রাঙ্ককল করলেন আমেদাবাদে, রকিকে।
তাঁর গলা শুনেই রকি শঙ্কিত গলায় বলল, “কী খবর কালীকাকা? বাবা ভাল আছে তো!”
“আছে রে আছে। ভালই আছে। তবে তোকে একটা ব্যাপারে একটু সাবধান করে দিতেই টেলিফোন করছি।’
“কী ব্যাপার কালীকাকা?”
“তই কিন্তু কিছুতেই, কোনওক্রমেই তোর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করিস না।”
“কেন কাকা? কী হয়েছে?”
“সব তো টেলিফোনে বলা যায় না। তবে আমার কথাটা শুনিস।”
রকি একটু চুপ করে থেকে বলে, “কিন্তু …”
“কিন্তু কিসের?”
“আমি যে একটা অন্যায় করে ফেলেছি কাকা। বাবার জন্য মনটা সবসময়ে ভীষণ খারাপ লাগে। পৃথিবীতে আমার তো আপনজন বলতে বাবা আর আপনি। বাবাকে অনেকদিন দেখিনি, তাই তিন-চারদিন আগে হঠাৎ বাবাকে একটা চিঠি দিয়েছি।”
কালীপ্রসাদ আর্তনাদ করে উঠলেন,”সর্বনাশ!”
“কী হয়েছে আমাকে একটু বলবেন কাকা? চিঠিতে আমি বাবাকে শুধু জানিয়েছি যে, আমি বেঁচে আছি, ভালই আছি।”
“চিঠিতে তোর ঠিকানা দিয়েছিস?”
“দিয়েছি। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে বাবার একটা কিছু হয়েছে। আমাকে বলবেন না?”
“অত বলার সময় নেই। তবে তো বাবার চেয়ে তোরই বিপদ এখন বেশি। শোন, কোনও ওজর-আপত্তি করিস না, তুই আজকেই এবং পারলে এখনই আমার কাছে চলে আয়। খবরদার, কোথায় যাচ্ছিস, কার কাছে যাচ্ছিস তা কাউকে জানাবি না। তোর বাবাকেও না। সোজা কালীপুরে চলে আসবি।”
রকি অবাক হয়ে বলে, “সে কী! আমার যে নতুন চাকরি, অনেক দায়িত্ব, কোম্পানি ছাড়বে কেন?”
“ওরে, যা বলছি শোন। চাকরি যদি যায় তো যাবে। তোর যা কোয়ালিফিকেশন তাতে ফের ভাল চাকরি পাবি। প্রাণের চেয়ে তো আর চাকরিটা বেশি নয়।”
“প্রাণ! প্রাণের কথা উঠছে কেন কাকা?”
“আগে আয়, তারপর ডিটেল্স শুনবি। কিন্তু একটা মুহূর্তও দেরি করিস না। তোর সত্যিই বিপদ। ডেল্টার নাম শুনেছিস?”
“শুনেছি। ডেল্টা তো খুব ডেঞ্জারাস অর্গানাইজেশন!”
“তোর পিছনে ডেল্টা লেগে গেছে। ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বললাম। চলে আয়।”