ছেলেটি এল পরদিন সকালে
ছেলেটি এল পরদিন সকালে। বেশ লম্বা ছিপছিপে চেহারা। একটু যেন রোগাটেই। চোখে পড়ার মতো চেহারা নয় বটে, তবে চোখ দুটি বেশ উজ্জ্বল। গায়ে একটা ফর্সা সাদা ফুলহাতা শার্ট, পরনে নীল জিনস। পায়ে স্পোর্টস শু। নমস্কার করে বলল, “আমার নাম পলাশ রায়। গজপতিবাবু আমাকে পাঠিয়েছেন।”
বাবু মিত্তির খুব শান্ত হিসেবি চোখে ছেলেটিকে দেখে নিয়ে বললেন, “তুমিই সেই বডিগার্ড তো! বোসো।”
ছেলেটি বসবার পর বাবু মিত্তির বললেন, “তোমাকে বিপদের মধ্যে টেনে আনার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। তোমার বয়স অল্প, সামনে কত সম্ভাবনা। গজপতি চাপাচাপি করায় রাজি হতে হল। তুমি কি সব জেনেশুনে কাজটা করতে এসেছ?”
ছেলেটি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে হেসে বলল, “গজপতিবাবু আমাকে সবই বলেছেন।”
বাবু মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “গজপতি হয়তো বিপদটা কীরকম তা আন্দাজ করতে পারছে না। নয়তো ভাবছে, চিঠিটা একটা রসিকতা।”
পলাশ ভুটা একটু কুঁচকে বলল, “বোধ হয় তা নয়। গজপতিবাবুকে খুব উদ্বিগ্নই মনে হল।”
বাবু মিত্তির পলকহীন চোখে পলাশের দিকে চেয়ে থেকে একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, “চিঠিটা কোনও রসিকতা নয়। এটা মনে রেখো। “
“রাখব।”
“তুমি স্পোর্টসম্যান?”
“মিলিটারিতে থাকতে আমাকে প্রচুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং করতে হয়েছে।”
“বক্সিং জানো?”
ছেলেটি হাসল, “না। তবে আপনি যে খুব বড় বক্সার ছিলেন তা জানি।”
“কুং ফু, ক্যারাটে, ওসব জানো নাকি?”
“না।”
বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “জেনেও এক্ষেত্রে লাভ ছিল না। আমি অবশ্য কুং ফু, ক্যারাটে তেমন পছন্দও করি না। তোমার প্রিয় স্পোর্টস কী?”
“আমি ভাল দৌড়ই। এ ছাড়া মাউন্টেনিয়ারিং আর সাঁতার।” বা
বু মিত্তির একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “ওঃ, একশো মিটার কত সেকেন্ডে দৌড়তে পারো?”
“সাড়ে বারো সেকেন্ড বা তার একটু বেশি।”
বাবু মিত্তির সময়টাকে তত গুরুত্ব দিলেন না। বললেন, “আমাকে তোমার কিছু জিজ্ঞেস করার আছে কি?”
পলাশ খুব সঙ্কোচের সঙ্গে বলে, “একটা কথা জানতে চাই। চিঠি কোথা থেকে এসেছে?”
“কোথা থেকে! কেন গোয়েন্দাগিরি করবে নাকি? আতশ কাঁচটাচ দিয়ে সূত্র আবিষ্কার করতে চাও না তো! ওসব করে লাভ নেই। তবু দেখতে চাইলে দেখ। ওই টেবিলের ওপর একটা সাদা খাম পড়ে আছে। ওটাই। এদেশেই কোথাও ডাকে ফেলা হয়েছে।”
পলাশ উঠে গিয়ে খামটা উলটে-পালটে দেখে বলল, “সিলটা ভাল বোঝা যাচ্ছে না। তবে মনে হচ্ছে, বোম্বাই থেকে পোস্ট করা।”
“তা হবে। চিঠিটা তোমার কাছেই রাখতে পারো। ওটাতে আমার প্রয়োজন নেই। আর কিছু জানতে চাও?”
“আপনি বেশি কথা পছন্দ করেন না বলে জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছি। একটা ব্যাপার জানতে চাই। ডেল্টার লিডার এখন কে?”
বাবু মিত্তির উদাসভাবে ঠোঁট উলটে বললেন, “কে জানে? আমি যখন ডেল্টার অপারেটর ছিলাম তখন সেটা ছিল ছোট একটা অর্গানাইজেশন। রিং-লিডার ছিল পল। সেটা তার আসল নাম ছিল কি কে জানে। তবে এসব অগানাইজেশনের রিং-লিডাররা বেশিদিন টিকতে পারে না। খুনটুন হয়ে যায়। আর একজন এসে হাল ধরে।”
“রিং-লিডার বদল হলে তারা এতদিন বাদে কি প্রতিশোধ নিতে চাইত?”
বাবু মিত্তির পলাশের দিকে চেয়ে চিন্তিতভাবে বললেন, “তা বটে। হয়তো পল এখনও আছে। আমি আর খোঁজ রাখি না। কিন্তু ওসব জেনে কী হবে বাবা? পল আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সারা পৃথিবীতে তার হাজারটা অপারেটর কাজ করে যাচ্ছে। ডেল্টা এখন একটা ভয়জাগানো নাম। মাফিয়াদের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়। ডেল্টা যখন কাউকে টারগেট করে, তখন কারও সাধ্য নেই যে, রক্ষা করবে। এমনকি পুলিশ আর মিলিটারি দিয়ে ঘিরে রাখলেও লাভ হয় না। কেন জানো? ডেল্টা ওই সিকিউরিটির ভেতরেও নিজের লোক রেখে দেয়। ওই পুলিশ বা মিলিটারির মধ্যেই তাদের লোক থাকে। যখন তাও না থাকে তখন কী করে জানো? ওই সিকিউরিটি গার্ডদের মধ্যে কারও ছেলে বা মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় আর মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে লোকটাকে বাধ্য করে নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করিয়ে নিতে। এই যে তুমি আমাকে পাহারা দিতে এসেছ, হতে পারে তুমিই ডেল্টার লোক।”
পলাশ হাসল, “না। আমি ডেল্টার লোক নই।” বাবু মিত্তির বিরক্ত চোখে চেয়ে থেকে বললেন, “নও বলছ? আজ হয়তো নও। কিন্তু ডেল্টা ইচ্ছে করলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তোমাকে দিয়ে তাদের কাজ হাসিল করিয়ে নিতে পারে। প্রথম টোপ ফেলবে প্রচুর টাকা দিয়ে। তাতে কাজ না হলে তোমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটাকে অ্যাটাক করবে। ধরো, তোমার প্রিয় একটি ভাই বা বোন বা ভাইঝি, ভাইপো, যাকেই হোক তুলে নিয়ে যাবে। তাকে বাঁচানোর জন্য তখন তুমি কি এই বুড়ো বাবু মিত্তিরের লাশ ফেলতে দ্বিধা করবে? অপরাধ জগতের ভেতরকার খবর যদি তোমার জানা থাকত তা হলে ভয়ে-ঘেন্নায় শিউরে উঠতে।”
পলাশ সত্যিই শিউরে উঠল। কেননা তার একটা ফুটফুটে তিন বছর বয়সী ভাইঝি আছে, যাকে সে প্রাণাধিক ভালবাসে। তার ছোট একটা স্কুল-পড়া বোন আছে, ভীষণ ভক্ত তার। ডেল্টা তাদের কিডন্যাপ করবে নাকি সত্যিই?
দুটি চোখ সরু করে পলাশের ভাবান্তর লক্ষ করছিলেন বাবু মিত্তির। এবার বললেন, “ভাল করে ভেবে দ্যাখো বাবা। তোমাকে সুখে থাকতে ভূতে কিলোচ্ছে না তো! এ কাজে সত্যিই বিপদ আছে। শুধু তোমার একার নয়। তোমার গোটা পরিবারের বিপদ। আরও একটা কথা জেনে রাখো, ডেল্টার অপারেটররা সবসময়ে যে বীরের মতো বন্দুক-পিস্তল নিয়ে আসবে তাও নয়। তাদের খুনের পদ্ধতি খুবই বাস্তববোধ সম্পন্ন। তারা প্রয়োজনে জলে বা খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে, রাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট ঘটাতে পারে, সাজানো আত্মহত্যা অ্যারেঞ্জ করতে পারে, আমার বিছানায় গোখরো সাপ বা মারাত্মক কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারে মৃত্যু যে কোনদিক দিয়ে আসবে তুমি তার আন্দাজই পাবে না।”
পলাশ চিন্তিত হয়ে পড়ল। তার মুখ দেখে বাবু মিত্তির একটু হাসলেন। বললেন, “বুঝেছ তো ব্যাপারটা?”
পলাশ বলল, “তার মানে কি আপনাকে ডেল্টার হাত থেকে রক্ষা করার কোনও উপায়ই নেই?”
বাবু মিত্তির মাথা নেড়ে বললেন, “না। গজপতি অবশ্য মাত্র কয়েকটা দিন আমাকে বেঁচে থাকতে বলেছে, যাতে আমার বিষয়-সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। হয়তো একটা বা দুটো অ্যাটেম্পট থেকে আত্মরক্ষা করতে পারলে তিন-চারদিন সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু ডেল্টা তার বেশি সময় আমাকে দেবে না। একটা-দুটো অ্যাটেম্পট কার্যকর না হলে ওরা আমাকে বোম মেরে উড়িয়ে দেবে, কোনও ল্যাটা রাখবে না।”
পলাশ চিন্তিত মুখে বলল, “কবে থেকে খুনের চেষ্টা করবে বলে আপনার মনে হয়?”
ক্লান্ত গলায় বাবু মিত্তির বললেন, “ওদের মোডাস অপারেন্ডি যতদূর জানি, ওরা সবরকম খোঁজখবর নিয়ে কাজে হাত দেয় না। চিঠিটা এসেছে গতকাল। চিঠি দেওয়ার আগেই ওদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হয়েছে। আমি কী খাই, কখন খাই, কখন বেরোই, কোন যানবাহন ব্যবহার করি, আমার সঙ্গে কে থাকে, বাইরের কোন-কোন লোক নিয়মিত আমার বাড়িতে যাতায়াত করে, এইসব। আমার স্বভাব, চরিত্র, অভ্যাস, বাতিক, শখ, অসুখ, আমার ডাক্তার, রজক, পরামানিক, খবরের কাগজওয়ালা, দুধওলা, কাজের লোক, আমার পোষা পশুপাখি, আত্মীয়, বন্ধু, সব খবর ওরা নিয়ে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, আজকেই কোনও সময়ে ওরা প্রথম আক্রমণটা করবে। আমি যখন ডেল্টার অপারেটর ছিলাম তখন আমাকেও এসব হোমওয়ার্ক করতে হত। ডেল্টা কোনও বেইমান বা বিশ্বাসঘাতক বা তাদের বিচারে কোনও ঘৃণিত লোককে মারবার আগে তার কোনও প্রিয়জন, তার ছেলে বা মেয়ে বা স্ত্রী–এদের কাউকে মারে। লোকটাকে প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট দিয়ে তারপর তাকে খুন করে। ভাগ্যের কথা, আমার আজ সেরকম কেউ নেই। রকি নিরুদ্দেশ না হলে ডেল্টা আগে তাকেই মারত।”
পলাশ বলে, “আপনার ছেলেকে ডেল্টা কিডন্যাপ করেনি তো!”
বাবু মিত্তির মাথা নাড়েন, “না। কিডন্যাপ করলে তারা সেটা আমাকে জানিয়ে দিত। তাদের সব কাজের পেছনেই উদ্দেশ্য থাকে। রকি আমাকে পছন্দ করত না বলেই মায়ের মৃত্যুর পর চলে যায়। তোমার আর কিছু জানবার আছে কি? না থাকলে আমি একটু নীচের তলার জিমনাসিয়ামে যাব। আমার দু’জন ছাত্র ট্রেনিং করতে আসবে।”
পলাশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে। তবে আমি আগে জিমনাসিয়ামটা একটু চেক করব।”
বাবু মিত্তির হাসলেন, “স্বচ্ছন্দে।”
পলাশ চলে যাওয়ার পর তিনি রাখালকে ডাকলেন। রাখালের বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। মেদিনীপুরের একটি গাঁয়ে তার বাড়ি। প্রায় সাত-আট বছর বাবু মিত্তিরের কাছে আছে। খুব বিশ্বাসী লোক। তবে বিশ্বাসীকে আজ আর বিশ্বাস নেই বাবু মিত্তিরের। ডেল্টা যে কাউকে কিনে নিতে পারে বা অন্যভাবে নিজেদের কাজ করিয়ে নিতে বাধ্য করতে পারে।
বাবু মিত্তির ভাল করে রাখালের মুখোনা দেখে নিলেন। কোনও পরিবর্তন ঘটলে চোখে তা ধরা যাবে। কিন্তু রাখালের চোখ আজ সকাল অবধি স্বাভাবিক। বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “টাইগার কোথায়?”
“আজ্ঞে, বাঁধা আছে।”
“ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়।” রাখাল গিয়ে টাইগারকে ছেড়ে দিতেই সে একটা উল্লাসের শব্দ করে কয়েক লাফে দোতলায় উঠে সোজা বাবু মিত্তিরের কাছে চলে এল।
বিশাল এই অ্যালসেশিয়ানটাই শুধু আজ বাবুর সবচেয়ে বিশ্বাসের পাত্র। ডেল্টা কিছুতেই একে বাবু মিত্তিরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু ডেল্টা আর একটা কাজ করবে। বাবুকে মারার আগে টাইগারকে মারবে। কারণ, টাইগারই বাবুর সবচেয়ে প্রিয়পাত্র।
বাবু টাইগারের মাথাটা বুকের কাছে চেপে ধরে একটু আদর করলেন। বেশিই আদর করলেন। অবোলা জীব। বিনা দোষে ওকে মরতে হবে। ওকে বাঁচানোর এক শেষ চেষ্টা অবশ্য বাবু মিত্তির করবেন।
টাইগারের মাথাটা বুকে চেপে রেখেই তিনি টেলিফোন তুলে বোম টিপে একটা নম্বর ডায়াল করলেন। কেনেল হাভেন-এর রায় কুকুর নিয়ে ব্যবসা করে বটে, কিন্তু ওর কাছে কুকুরের যত্নের অভাব হয় না। রায়ের কাছ থেকেই টাইগারকে বছর-পাঁচেক আগে কিনে এনেছিলেন তিনি।
“রায় নাকি? আমার একটা উপকার করবে রায়?”
“আরে, মিস্টার মিত্তির, আমি তো সবসময়েই অ্যাট ইওর সার্ভিস। বলুন কী করতে পারি।”
“তোমার কাছে টাইগারকে কিছুদিন রাখবে?”
“কেন, বাইরে যাচ্ছেন কোথাও?”
“হ্যাঁ, তা বলতে পারো।”
“ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিন।”
“না, পাঠানোর উপায় নেই। অসুবিধে আছে। ওকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তোমাকে করতে হবে। টাকা যা লাগে দেব।”
“ঠিক আছে, আমার ডগ-ভ্যান তো আছেই। পাঠিয়ে দেব।”
“শোনো রায়, আমার একটু তাড়া আছে। ভ্যানটা তুমি এখনই। পাঠিয়ে দাও।”
“বেশ তো, আধ ঘণ্টার মধ্যেই যাবে।”
“তোমার ওখানে এখন ক’টা অ্যালসেশিয়ান আছে রায়?”
“সব মিলিয়ে পনেরো-ষোলোটা হবে। কেন?”
“এমনিই। আমি অপেক্ষা করছি কিন্তু।”
ফোন ছেড়ে বাবু একটু নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। রায়ের কাছে পনেরো-ষোলোটা অ্যালসেশিয়ান আছে, টাইগার ওদের মধ্যে থাকলে ওকে আলাদা করে চেনা যাবে না। হয়তো টাইগার বেঁচে যাবে।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই ডগ-ভ্যান চলে এল! বাবু মিত্তির ভাল করে দেখে নিলেন ভ্যানটা সন্দেহজনক কি না। ড্রাইভারকেও দু-একটা প্রশ্ন করলেন। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে টাইগারকে ভ্যানে তুলে ভেতরে হুকের সঙ্গে শিকলটা আটকে দিয়ে নেমে পড়লেন। টাইগার প্রচণ্ড চেঁচাল। বাবু মিত্তির কানে হাত চাপা দিলেন। তাঁর চোখ জলে ভরে এল।
কিছুক্ষণ বাদে রায়কে আবার ফোন করলেন। রায় বলল, “চিন্তা করবেন না, আপনার টাইগার পৌঁছে গেছে। অনেক সঙ্গী-সাথী পেয়ে আনন্দেই আছে। আপনি নিশ্চিন্তে বাইরে থেকে ঘুরে আসুন।”
জিমনাশিয়ামে তাঁর তিন-চারজন ছাত্র অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে।
এরা এশিয়াডের ট্রায়ালে যাবে। ঘষামাজা করতে বাবু মিত্তিরের কাছে আসে।
বাবু মিত্তিরের অবশ্য আজ কোচিংয়ে মন নেই। মনটা বড্ড খারাপ। তবু জিমনাসিয়ামে এলেন। ছেলেদের কিছুক্ষণ মৌখিক তালিম দিলেন।
ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই লক্ষ করলেন, জিমনাসিয়ামের র্যাকে রাখা তাঁর গ্লাভসগুলো খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছে পলাশ। ছোকা সাবধানী আছে। গ্লাভসের ভেতরে কিছু একটা ঢুকিয়ে রাখা সোজা ব্যাপার।
কিছুক্ষণ ছেলেদের প্র্যাকটিস করালেন বাবু মিত্তির, কয়েকটা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে ওপরে উঠে আসবার সময় শুনতে পেলেন, ওপরের বসবার ঘরে ফোন বাজছে।
ফোন তুলে হ্যালো বলতেই রায়ের গলা পাওয়া গেল, “মিস্টার মিত্তির, কেনেল হাভেন থেকে রায় বলছি। আচ্ছা, আজ সকালে টাইগারকে কী খাওয়ানো হয়েছিল বলুন তো?”
বাবু মিত্তিরের মজবুত হৃৎপিণ্ড হঠাৎ প্রবলভাবে ধকধক করতে থাকে। সামান্য কাঁপা গলায় তিনি বললেন, “কেন, কী হয়েছে?”
“খুব স্যাড কেস। এখানে আসার ঘণ্টাখানেক বাদেই টাইগার অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ ক্লিয়ার কেস অব ফুড পয়জনিং।”
“তোমাদের ওখানে কিছু খায়নি তো!”
“না মিস্টার মিত্তির। আমরা কুকুরকে একবার খাওয়াই, বেলা দুটোয়।”
বাবু মিত্তির বাঁ হাতে নিজের বুকের বাঁ দিকটা চেপে ধরে বললেন, “টাইগার কি বেঁচে আছে?”
“আধ ঘণ্টা আগে এক্সপায়ার করেছে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত, কিন্তু দোষটা অবশ্যই আমাদের নয়। বিশ্বাস করুন।”
বাবু মিত্তিরের মাথাটা শূন্য লাগছিল। চারদিকটা বড় ফাঁকা। ধীরে রিসিভারটা রেখে দিলেন তিনি, চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।
পলাশ নিঃশব্দে সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু কোনও কথা বলল না। চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল।
বাবু মিত্তির চোখ মুছলেন। বড় ক্লান্ত, বড় হতাশ, বড় শূন্য লাগে তাঁর। শরীরের সব শক্তি যেন কেউ সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে বের করে নিয়েছে। ইজিচেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে পলাশের দিকে মড়ার মতো চেয়ে থেকে বললেন, “ডেল্টা স্ট্রাইকস।”
পলাশ স্থির দৃষ্টিতে বাবু মিত্তিরের দিকে চেয়ে থেকে বলে, “কখন?”
“আধ ঘণ্টা আগে।”
পলাশ সোজা গিয়ে রাখালকে ধরল, “সকালে টাইগারকে কী খাইয়েছ রাখাল?”
রাখাল একটু অবাক হয়ে বলে, “রোজ যা খায়। দুধ আর ভিটামিন ক্যাপসুল।”
“ক্যাপসুল! কই শিশিটা দেখি!”
রাখাল শিশিটা এনে দিয়ে বলে, “কেন, কী হয়েছে?”
“টাইগার মারা গেছে।”
রাখালের মুখটা ফ্যাকাসে, বিহ্বল হয়ে গেল, “মারা গেছে! টাইগার!”
“বিষক্রিয়া। এ-শিশিটা কোথায় থাকে?”
রাখালের ঠোঁট কাঁপল, তারপর মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল। জবাব দিতে পারল না।
পলাশ বুঝল, এই পরিস্থিতিতে তার গোয়েন্দাগিরির কাজ এগোবে না। বোধ হয় লাভও নেই। তার ঘোরতর সন্দেহ, বিষটা ছিল ক্যাপসুলের মধ্যে। একটু বিলম্বিত ক্রিয়ার ক্যাপসুলই হবে, যা পেটে গিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে গলে যায় না। একটু সময় নেয়। কিন্তু এ-তথ্য জেনেই বা লাভ কী? ডেল্টা তার উপস্থিতি তত ভালরকমেই জানান দিয়েছে।
পলাশ আবার বাবু মিত্তিরের কাছে ফিরে এল। সে যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছে। বুদ্ধি স্থির রাখতে পারছে না।
বাবু মিত্তির কিন্তু ইতিমধ্যে সামলে গেছেন। চোখ-মুখ গম্ভীর বটে, কিন্তু অসহায় ভাবটা নেই। পলাশের দিকে চেয়ে বললেন, “কিছু বুঝলে?”
“ভিটামিন ক্যাপসুলের শিশিটা কেউ বদল করে দিয়ে গেছে। বিষ ছিল ক্যাপসুলের মধ্যেই।”
বাবু মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা হলে তো রাখালকে সন্দেহ করতে হয়। কিন্তু আমি ওকে যতদূর লক্ষ করেছি, ডেল্টা এখনও ওকে হাত করেনি।”
“তা হলে?”
বাবু মিত্তির হাসলেন, “বিষটা দুধের মধ্যেও থাকতে পারে। দুধটা বাইরে থেকে আসে।”
পলাশ একটু স্তব্ধ হয়ে থেকে সপ্রতিভ মুখে বলল, “তা বটে। কিন্তু দুধে বিষ থাকলে টাইগার তো তখনই মারা যেত।”
বিষ হাজারো রকমের হয়। যাকগে, লক্ষণ যা দেখছি, গজপতিকে আর সময় দিতে পারব না। ডেল্টা আমার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। শুধু ছোবলটা দেওয়া বাকি।”
“আমাদের কি কিছুই করার নেই কাকাবাবু?”
“আছে। রাখালকে গিয়ে বলল, দুধওয়ালা যে দুধটা দিয়ে গেছে সেটা যেন ফেলে দেয়। কাককুকুরেও যেন মুখ দিতে না পারে।”
পলাশ দৌড়ে গিয়ে রাখালকে কথাটা বলে এল। তারপর বলল, “আর কিছু কাকাবাবু?”
“আর কিছু মাথায় আসছে না। তবে ওভারহেড ট্যাঙ্কের জলটা আজ ব্যবহার না করাই ভাল। ডেল্টা বিষে বিষক্ষয়ের চেষ্টা করছে বলে মনে হয়। জলে বিষ মেশানো কঠিন কাজ নয়। আজ যেন সবাই টিউবওয়েলের জল ব্যবহার করে। দরোয়ান রাম পহলওয়ানকে বোলো, কাউকে যেন বাড়িতে ঢুকতে না দেয় আমার হুকুম ছাড়া।”
পলাশ এসব জরুরি কাজ করতে চলে গেলে বাবু মিত্তির উঠলেন। একটা ছোট চিরকুট লিখে একটা কৌটোয় ভরলেন। তারপর নিঃশব্দে ছাদে উঠে এলেন। চিলেকোঠার গায়ে পায়রার জন্য খোপ করা আছে। অনেকগুলো খোপের মধ্যে বিশেষ একটি খোপ থেকে তিনি একটি পায়রাকে বের করে আনলেন। পোষা, বাধ্য পায়রা। তার পায়ে কৌটোটা সাবধানে বেঁধে বাবু মিত্তির আকাশে উড়িয়ে দিলেন। পায়রাটা একবার একটা চক্কর খেল আকাশে। তারপর সোজা দক্ষিণ-পুব দিকে সুনির্দিষ্ট একটা রেখায় উড়ে যেতে লাগল।
বাবু মিত্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কালীপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর আজও এইভাবেই যোগাযোগ হয়। সহজ এবং নিশ্চিত যোগাযোগ। কালীপ্রসাদই পায়রাটা দিয়েছিল তাঁকে।
বাবু মিত্তির দোতলায় নেমে এসে শোওয়ার ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। জানলাগুলো আগে থেকেই বন্ধ এবং ভারী পরদা টানা। ঘর একরকম অন্ধকার, বাবু মিত্তির বালিশের পাশ থেকে টর্চটা তুলে নিয়ে দেওয়ালের গায়ে তাঁর বিশাল ওয়ার্ডরোবটা খুললেন, ভেতরে বিস্তর স্যুট, প্যান্ট, শার্ট, টাই ঝুলছে। একসময়ে এসব পোশাক ব্যবহার করতেন। এখন পড়েই থাকে। ওয়ার্ডরোবের বাঁ ধারে একটা সুইচ টিপে ধরলেন বাবু মিত্তির। টুক করে একটা ইলেকট্রনিক লক খুলে গেল। ছোট একটা ঢাকনা পট করে ঝুলে পড়ল। ভেতরে একটা নম্বর-লেখা চৌকো বোর্ড। অভ্যস্ত আঙুলে মুখস্থ কয়েকটা নম্বর ছুঁতেই মৃদু আর-একটা শব্দ হল। বাবু মিত্তির বাঁ দিকের সাইড প্যানেলের গায়ে লাগানো একটা ছোট আংটা ধরে টান দিতেই গোপন একটি খোপ উন্মোচিত হল। তিনি খোপের ভেতরে হাত দিয়ে একটা পুরনো হার্ড টপ মাঝারি মাপের সুটকেস বের করলেন।
কম্বিনেশন লক খুলে ডালাটা তুলতেই দেখা গেল, ওপরে একটা সবুজ তোয়ালের ওপর একটি নয় মিলিমিটার বোরের পিস্তল শুয়ে আছে। ব্যারেল কিছুটা ভোঁতা, হাতলের ভেতরে এগারো গুলির ম্যাগাজিন পোরা আছে। বেশ ভারী ও বিপজ্জনক অস্ত্রটি সস্নেহে তুলে নিলেন তিনি। তোয়ালে সরিয়ে একবার দেখলেন, মেক্সিকো থেকে আনা তাঁর বিপুল নগদ ডলারের রাশি। যা এনেছিলেন তার বেশির ভাগই খরচ হয়েছে কারখানা করতে গিয়ে। কিন্তু এখনও লাখ কুড়ি ডলার তাঁর আছে। শুধু এই সুটকেসেই আছে লাখচারেক ডলার।
পিস্তলটা বের করে সুটকেস যথাস্থানে রেখে ওয়ার্ডরোব বন্ধ করে দিলেন বাবু মিত্তির। পিস্তলটার কোনও লাইসেন্স নেই। এটা তিনি চোরাই পথে এনেছেন। ডেল্টার সঙ্গে তাঁর শেষ অ্যাসাইনমেন্টে এটাই ছিল তাঁর অস্ত্র। রাউল আক্রান্ত হলে তাকে বাঁচানোর জন্য বাবু মিত্তির একটিও গুলি চালাননি সিকিউরিটি গার্ডদের লক্ষ্য করে। চালালে লাভও হত না। একজন বা দুজনকে মারতে পারতেন, কিন্তু তাদের গুলিতে নিজে ঝাঁঝরা হয়ে যেতেন। গুলি চালাননি বলে ধরাও পড়েননি। নিরাপদে পালাতে পেরেছিলেন। তাতে তেমন দোষ হয়নি তাঁর, পরিস্থিতি বুঝে ঠিক কাজই করেছিলেন। কিন্তু নিয়মানুসারে তাঁর উচিত ছিল ডেল্টার হেডকোয়াটারে গিয়ে ঘটনাটা রিপোর্ট করা।
পিস্তলটার দিকে চেয়ে তাঁর আজ সেইসব কথা দ্রুত মনে পড়তে লাগল। যদিও সঙ্গে পিস্তল রাখলে এখন আর বিশেষ লাভ নেই। ডেল্টা তাঁর পিস্তলের পাল্লায় বোকার মতো এসে তো হাজির হবে না। তবু চামড়ার শোলডার হোলস্টারটা বের করে গলায় পরে নিলেন। পিস্তলটা রইল বাঁ বগলের একটু নীচে, খাপের মধ্যে। গায়ে জামা থাকলে বাইরে থেকে বোঝাই যাবে না জিনিসটার অস্তিত্ব।
জামা গায়ে দিয়ে যখন দরজা খুলে বেরোলেন, তখন দেখলেন পলাশ বিবর্ণ মুখে বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে।
“কাকাবাবু!”
বাবু মিত্তির শান্ত গলাতেই বললেন, “কী হয়েছে?”
“রাম পহলওয়ান তার ঘরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। মুখে গ্যাঁজলা উঠছে। এখনই হাসপাতালে নেওয়া দরকার।”
বাবু মিত্তির দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন, “আমার একার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কতজনকে করতে হবে তা বুঝতে পারছি না। অ্যাম্বুলেন্সে একটা খবর দাও।”
“দিয়েছি। এখন আর কী করব?”
“তুমি ঘাবড়ে গেছ। মাথা ঠাণ্ডা রাখো। ডেল্টার সঙ্গে পাল্লা টানতে আসা তোমার উচিত হয়নি। আমি বলি কি, তুমি বরং ফিরেই যাও। আমার পরিণতি তো বুঝতেই পারছ।”
“পারছি। তবু ব্যাপারটার শেষ দেখতে চাই।”
“একেবারে ড্রপসিন পড়ার পর যাবে? কিন্তু ততক্ষণে যদি তোমার জীবনেও ড্রপসিন নেমে আসে?”
“প্রাণের ভয় আমার ততটা নেই। কিন্তু ভয় পাচ্ছি, আমার অসহায় অবস্থাকে। ডেল্টার সঙ্গে একটু লড়াই হল না, বিনা যুদ্ধে এ তো একেবারে কাপুরুষের মতো মরতে হবেই দেখছি।”
“বীরের মতো লড়লেও লাভ ছিল না। ডেল্টা বীরদেরও ঢিট করতে জানে।”
একটু বাদে অ্যাম্বুলেন্স এল এবং রাম পহলওয়ানের অচেতন দেহটা তুলে নিয়ে চলে গেল। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখলেন বাবু মিত্তির। চোখের কোণে জল টলটল করছিল।