Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সোনার কেল্লা (১৯৭১) – ফেলুদা || Satyajit Ray

সোনার কেল্লা (১৯৭১) – ফেলুদা || Satyajit Ray

ফেলুদা হাতের বইটা সশব্দে বন্ধ করে টক্‌ টক্‌ করে দুটো তুড়ি মেরে বিরাট হাই তুলে বলল, জিয়োমেট্রি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতক্ষণ কি তুমি জিয়োমেট্রির বই পড়ছিলে?

বইটায় একটা খবরের কাগজের মলাট দেওয়া, তাই নামটা পড়তে পারিনি। এটা জানি যে, ওটা সিধুজ্যাঠার কাছ থেকে ধার করে আনা। সিধুজ্যাঠার খুব বই কেনার বাতিক, আর বইয়ের খুব যত্ন। সবাইকে বই ধার দেন না, তবে ফেলুদাকে দেন। ফেলুদাও সিধুজ্যাঠার বই বাড়িতে এনেই আগে সেটায় একটা মলাট দিয়ে নেয়।

একটা চারমিনার ধরিয়ে পর পর দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে ফেলুদা বলল, জিয়োমেট্রির বই বলে আলাদা কিছু নেই। যে-কোনও বই-ই জিয়োমেট্রির বই হতে পারে, কারণ সমস্ত জীবনটাই জিয়োমেট্রি। লক্ষ করলি নিশ্চয়ই-ধোঁয়ার রিংটা যখন আমার মুখ থেকে বেরোল, তখন ওটা ছিল পাফেক্ট সার্কল। এই সার্কল জিনিসটা কী ভাবে ছড়িয়ে আছে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে সেটা একবার ভেবে দ্যাখ। তোর নিজের শরীরে দ্যাখ। তোর চোখের, মণিটা একটা সার্কল। এই সার্কলের সাহায্যে তুই দেখতে পাচ্ছিস আকাশের চাঁদ তারা সূর্য। এগুলোকে ফ্ল্যাটভাবে কল্পনা করলে সার্কল, আসলে গোলক—এক-একটা সলিড বুদ্বুদ, অর্থাৎ জিয়োমেট্রি। সৌরজগতের গ্রহগুলো আবার সূর্যকে প্ৰদক্ষিণ করছে এলিপটিভ কার্ভে। এখানেও জিয়োমেট্রি; তুই যে একটু আগে জানালা দিয়ে থুক করে রাস্তায় থুতু ফেললি–অবিশ্যি ফেলা উচিত নয়–ওটা আনহাইজিনিক–নেক্সট টাইম ফেললে গাঁট্টা খাবি–ওই থুতুটা গেল। কিন্তু একটা প্যারাবোলিক কাৰ্ভে-জিয়োমেট্রি। মাকড়সার জাল জিনিসটা ভাল করে দেখেছিস কখনও। কী জটিল জিয়োমেট্রি রয়েছে তাতে জনিস? একটা সরল চতুষ্কোণ দিয়ে শুরু হয় জাল বোনা। তারপর সেটাকে দুটো ডায়াগনাল টেনে চারটে ত্রিকোণে ভাগ করা হয়। তারপর সেই ডায়াগন্যাল দুটোর ইন্টারসেক্টিং পয়েন্ট থেকে শুরু হয় স্পাইরাল জল; আর সেটাই ক্রমশ বাড়তে বাড়তে পুরো চতুষ্কোণটাকে ছেয়ে ফেলে। ব্যাপারটা এমন তাজব যে ভাবলে কুলকিনারা পাবি না। …

রবিবারের সকাল। আমরা দুজনে আমাদের বাড়ির একতলার বৈঠকখানায় বসে আছি। বাবা তাঁর রবিবারের নিয়ম মতো ছেলেবেলার বন্ধু সুবিমল কাকার বাড়িতে আড়া মারতে গেছেন। ফেলুদা সোফায় বসে তার পা দুটো সামনের নিচু টেবিলটার উপর তুলে দিয়েছে। আমি বলেছি তক্তপোশে, দেয়ালের সঙ্গে তাকিয়াটা লাগিয়া তাতে ঠেস দিয়ে। আমার হাতে রয়েছে প্লাস্টিকের তৈরি একটা গোলকধাঁধার ভিতর তিনটে ছোট্ট লোহার দানা। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে সেই দানাগুলোকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোলকধাঁধার মাঝখানে আনবার চেষ্টা করছি। বুঝলাম যে, এ-ও একটা কঠিন জিয়োমেট্রির ব্যাপার।

কাছেই নীহার-পিন্টুদের বাড়িতে পুজোর প্যান্ডেলে কাটি পতঙ্গ ছবির ইয়ে জো মহব্বৎ হ্যাঁয় গানটা বাজছে। গোল গ্রামাফোন রেকর্ডে মিহি স্পাইর‍্যাল প্যাঁচ। অর্থাৎ জিয়োমেট্রি।

কেবল চোখে দেখা যায় এমন জিনিস না, ফেলুদা বলে চলল, মানুষের মনের ব্যাপারটাও জিয়োমেট্রির সাহায্যে বোঝানো যায়। সাদাসিধে মানুষের মন ষ্ট্রেট লাইনে চলে; প্যাঁচালো মন সাপের মতো একেবেঁকে চলে, আবার পাগলের মন যে কখন কোন দিকে চলবে তা কেউ বলতে পারে না–একেবারে জটিল জিয়োমেট্রি।

ফেলুদার দৌলতে অবিশ্যি আমার সোজা-বাঁকা পাগল-ছাগল অনেক রকম লোকের সঙ্গেই আলাপ হবার সুযোগ হয়েছে। ফেলুদা নিজে কীরকম জ্যামিতিক নকশার মধ্যে পড়ে, সেটাই এখন ভাবছিলাম। ওকে জিজ্ঞেস করতে বলল, একটা মেনি-পয়েন্টেড স্টার বা জ্যোতিষ্ক বলতে পারিস।

তুই একটা বিন্দু, যেটাকে অভিধানে বলে পরিমাণহীন স্থাননির্দেশক চিহ্ন।

আমার নিজেকে স্যাটিলাইট বলে ভাবতে ভালই লাগে। তবে সব সময় স্যাটিলাইট থাকা সম্ভব হয় না। এই যা আফশোস। গ্যাংটকে গণ্ডগোলের ব্যাপারে অবিশ্যি ওর সঙ্গেই ছিলাম, কারণ তখন আমার ছুটি ছিল। তার পরের দুটো তদন্তের ব্যাপারে—একটা ধলভূমগড়ে খুন, আরেকটা পাটনায় একটা জাল উইলের ব্যাপার—এই দুটোতে আমি বাদ পড়ে গেছি। এখন পূজোর ছুটি। কদিন থেকেই ভাবছি। এই সময় একটা কেস এলে মন্দ হয় না, কিন্তু সেটা যে সত্যিই এসে পড়বে তা ভাবতে পারিনি। ফেলুদা অবিশ্যি বলে, যে-কোনও জিনিস মনে মনে খুব জোর দিয়ে চাইলে অনেক সময় আপনা থেকেই এসে পড়ে; মোট কথা আজ যেটা ঘটলে সেটা আমার এই চাওয়ার ফল বলে ভেবে নিতে আমার কোনও আপত্তি নেই।

পিন্টুদের বাড়ির লাউডস্পিকারে সবেমাত্র জনি মেরা নাম-এর একটা গান দিয়েছে, ফেলুদা অ্যাশ-ট্রেতে ছাই ফেলে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড কাগজটা হাতে নিয়েছে, আমি একবার রাস্তায় বেরোবি কি না ভাবছি, এমন সময় আমাদের বাইরের দরজার কড়াটা কে যেন সজোরে নেড়ে উঠল। বাবা বারোটার আগে ফিরবেন না, তাই বুঝলাম এ অন্য লোক। দরজা খুলে দেখি, ধুতি আর নীল শার্ট পরা একজন নিরীহ গোছের ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।

এ বাড়িতে প্রদোষ মিত্তির বলে কেউ থাকেন?

লাউডস্পিকারের জন্য প্রশ্নটা করতে ভদ্রলোককে বেশ চেঁচাতে হল। নিজের নাম শুনে ফেলুদা সোফা ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে এল।

কোত্থেকে আসছেন?

আজ্ঞে, আমি আসছি। সেই শ্যামবাজার থেকে।

ভেতরে আসুন।

ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে এলেন।

বসুন। আমিই প্রদোষ মিত্তির।

ওঃ! আপনি এত ইয়ং সেটা আমি ঠিক…

ভদ্রলোক গদগদ ভাব করে সোফার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লেন। তাঁর হাসি কিন্তু বসার পরেই মিলিয়ে গেল!

কী ব্যাপার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

ভদ্রলোক গলা খাকরিয়ে বললেন, কৈলাস চৌধুরী মশায়ের কাছ থেকে আপনার অনেক সুখ্যাতি শুনেছি। তিনি, মানে, আমার একজন খদ্দের আর কী। আমার নাম সুধীর ধর। আমার একটা বইয়ের দোকান আছে কলেজ স্ট্রিটে–ধর অ্যান্ড কোম্পানি–দেখে থাকতে পায়েন হয়তো।

ফেলুদা ছোট্ট করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে দিল। তারপর আমায় বলল, তোপসে–জানলাটা বন্ধ করে দে তো।

রাস্তার দিকের জানালাটা বন্ধ করতে গানের আওয়াজটা একটু কমল আর তার ফলে ভদ্রলোকও আরেকটু স্বাভাবিকভাবে বাকি কথাগুলো বলতে পারলেন।

দিন সাতেক আগে খবরের কাগজে একটা খবর বেরিয়েছিল আমার ছেলের বিষয়ে–আপনি কি?

কী খবর বলুন তো?

ওই জাতিস্মর…মানে…

ওই মুকুল বলে ছেলেটি?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

খবরটা তা হলে সত্যি?

মানে, ও আপনার যে ধরনের কথাবার্তা বলে তাতে তো…

জাতিস্মর ব্যাপারটা আমি জানতাম। এক-একজন থাকে, তাদের নাকি হঠাৎ পূৰ্ব্বজন্মের কথা মনে পড়ে যায়। তাদের বলে জাতিস্মর।

অবিশ্যি পূৰ্ব্বজন্ম বলে কিছু আছে কি না সেটা ফেলুদাও নাকি জানে না।

ফেলুদা চারমিনারের প্যাকেটটা খুলে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিল। ভদ্রলোক একটু হেসে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন তিনি খান না। তারপর বললেন, বোধহয় মনে থাকবে, আমার এই ছেলেটি–আট বছর মাত্র বয়স–একটা জায়গার বর্ণনা দেয়, সেখানে নাকি সে গেছে। অথচ তেমন জায়গায়—আমার ছেলে তো দূরের কথা-আমার বা আমার পূর্বপুরুষদের কারুর কখনও যাবার সৌভাগ্য হয়নি। ছা-পোষা লোক, বুঝতেই তো পারছেন। দোকান দেখি, এদিকে বইয়ের বাজার দিনে দিনে–

একটা দুর্গের কথা বলে না আপনার ছেলে? ফেলুদা ভদ্রলোককে কতকটা বাধা দিয়েই বলল।

আজ্ঞে হ্যাঁ। বলে—সোনার কেল্লা। তার মাথায় কামান বসানো আছে, যুদ্ধ হচ্ছে, লোক মরছে—সে সব নাকি সে দেখেছে। সে নিজে পাগড়ি পরে উটের পিঠে চড়ে বলির উপর বেড়াত। বালির কথা খুব বলে। হাতি ঘোড়া এ সব অনেক কিছু বলে। আবার, ময়ূরের কথা বলে। ওর হাতে একটা দাগ আছে কনুইয়ের কাছে। সেটা জন্মে অবধি আছে–আমরা তো জন্মদাগ বলেই জানতাম। ও বলে যে একবার নাকি একটা ময়ূর ওকে ঠোকর মেরেছিল, এটা নাকি সেই ঠোকারের দাগ।

কোথায় থাকত সেটা পরিষ্কার ভাবে বলে?

না–তবে তার বাড়ি থেকে নাকি সোনার কেল্লা দেখা যেত। মাঝে মাঝে কাগজে হিজিবিজি কাটে পেনসিল দিয়ে। বলে–এই দ্যাখো আমার বাড়ি। দেখে তো বাড়ির মতোই মনে হয়।

বই-টইয়ের মধ্যে এমন কোনও জায়গার ছবি সে দেখে থাকতে পারে না? আপনার তো বইয়ের দোকান আছে…

তা অবিশ্যি পারে। কিন্তু ছবির বই তো অনেক ছেলেই দেখে-তাই বলে কি তারা অষ্টপ্রহর এইভাবে কথা বলে? আপনি আমার ছেলেকে দেখেননি। তাই; সত্যি বলতে কী–তার মনটাই যেন পড়ে আছে অন্য কোথাও। নিজের বাড়ি, নিজের ভাই-বোন বাপ-মা আত্মীয়স্বজন-এর কোনওটাই যেন তার আপনি নয়। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাই বলে না সে ছেলে।

কবে থেকে এই সব বলতে শুরু করেছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

তা মাস দুয়েক। ওই ছবি আঁকা দিয়েই শুরু, জানেন। সেদিন খুব জল হয়েছে, আমি দোকান থেকে সবে ফিরিচি, আর সে আমায় এসে ছবি দেখাচ্ছে। গোড়ায় গা করিনি। ছেলেবিয়সে তো কত রকম পাগলামিই থাকে! কনের কাছে ভ্যানর ভ্যানর করেছে, কান পাতিনি। আমার গিন্নিই প্রথম খেয়াল করে। তারপর কদিন ধরে তার কথা শুনে-টুনে, তার হাবভাব দেখে, আমার আরেক খদ্দের আছে–নাম শুনেছেন কি?–ডাক্তার হেমাঙ্গ হাজরা…

হ্যাঁ হ্যাঁ। প্যারাসাইকলজিস্ট। শুনেছি বইকী। তা তিনি তো আপনার ছেলেকে নিয়ে বাইরে কোথায় যাবেন বলে কাগজে বেরিয়েছে।

যাবেন না, চলে গেছেন অলরেডি। তিনদিন এলেন আমার বাড়িতে। বললেন, এ তো রাজপুতানার কথা বলছে বলে মনে হচ্ছে। আমি বললুম হতে পারে। শেষটায় বলেন কী, তোমার ছেলে জাতিস্মর; এই জাতিস্মর নিয়ে আমি রিসার্চ করছি। আমি তোমার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রাজপুতানায় যাব। ঠিক জায়গায় গিয়ে ফেলতে পারলে তোমার ছেলের নিশ্চয়ই আরও অনেক কথা মনে পড়বে। তাতে আমার খুব সুবিধে হবে। ওর খরচও আমি দেব, খুব যত্নে রাখব, তোমার কিছু ভাবতে হবে না।

তারপর? ফেলুদার গলার স্বর আর তার এগিয়ে বসার ভঙ্গিতে বুঝলাম সে বেশ ইন্টারেস্ট পেয়েছে!

তারপর আর কী–মুকুলকে নিয়ে চলে গেলেন!

ছেলে আপত্তি করেনি?

ভদ্রলোক একটা শুকনো হাসি হেসে বললেন, কোথায় আছেন। আপনি? যেই বললে সোনার কেল্লা দেখাবে আমনি এক কথায় রাজি হয়ে গেল। আপনি তো দেখেননি। আমার ছেলেকে। ও, মানে, ঠিক আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। একেবারেই নয়। রাত তিনটের সময় উঠে বসে আছে। গুন-গুন করে গান গাইছে। ফিলিমের গানটান নয়। মশাই–গোঁয়ে গাঁয়ে সুর—তবে বাংলাদেশের গাঁ নয় এটা জানি। আমি আবার একটু হারমোনিয়াম-টারমোনিয়াম বাজাই, বুঝেছেন…

ভদ্রলোক এত কথা বললেন, কিন্তু ফেলুদার কাছে কেন এলেন, গোয়েন্দার কেন প্রয়োজন হতে পারে তাঁর, সেটা এখনও পর্যন্ত কিছুই বললেন না। হঠাৎ ফেলুদার একটা কথাতেই যেন ব্যাপারটা একটা অন্য চেহারা নিয়ে নিল।

আপনার ছেলে তো কী সব গুপ্তধনের কথা বলেছে না?

ভদ্রলোক হঠাৎ কেমন যেন মুষড়ে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সেইখানেই তো গণ্ডগোল মশাই। আমায় বলেছে বলেছে, কিন্তু কাগজের রিপোর্টারের সামনে কথাটা বলেই তো সর্বনাশ করেছে।

কেন সর্বনাশ বলছেন কেন? প্রশ্নটা করেই ফেলুদা আমাদের চাকর শ্রীনাথকে হাঁক দিয়ে চা আনতে বলল।

ভদ্রলোক বললেন, কেন, সেটা বুঝতেই পারবেন। গতকাল সকালে তুফান এক্সপ্রেসে হেমাঙ্গবাবু আমার ছেলেকে নিয়ে রাজস্থান রওনা দিয়েছেন, আর—

ফেলুদা বাধা দিয়ে বলল, রাজস্থানের কোন জায়গায় গেছেন সেটা জানেন?

সুধীরবাবু বললেন, যোধপুর বলেই তো বললেন। বললেন, যখন কালির কথা বলছে, তখন উত্তর-পশ্চিম দিকটা দিয়ে শুরু করব। তা, সে যাক গে—এখন কথা হচ্ছে কী, কালই সন্ধ্যায় আমাদের পাড়া থেকে একটি মুকুলের বয়সী ছেলেকে কে বা কারা যেন ধরে নিয়ে যায়।

আপনার ধারণা তাকে আপনার ছেলে বলে ভুল করে?

সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। দুজনের চেহারাতেও বেশ মিল আছে। শিবরতন মুখুজ্যে সলিসিটরের বাড়ি আছে আমাদের পাড়ায়, এটি সে বাড়িরই ছেলে, নাম নীলু, মুখুজ্যে মশায়ের নাতি। তাদের বাড়িতে, বুঝতেই পারছেন, কান্নাকাটি পড়ে গেসল। পুলিশ টুলিস অনেক হাঙ্গামা! এখন অবিশ্যি তাকে ফিরে পেয়ে সব ঠাণ্ডা।

এর মধ্যেই ফেরত দিয়ে দিল?

আজই ভোরে। কিন্তু তাতে কী হল মশাই! আমার তো এদিকে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। যারা কিডন্যাপ করেছিল তারা তো বুঝেছে ভুল ছেলে এনেছে। কিন্তু সে ছেলে যে এদিকে তাদের বলে দিয়েছে যে মুকুল যোধপুর গেছে। এখন ধরুন যদি সে গুণ্ডারা গুপ্তধনের লোভে রাজস্থান ধাওয়া করে তা হলে তো বুঝতেই পারছেন…

ফেলুদা চুপ করে ভাবছে। তাঁর কপালে চারটে ঢেউ-খেলানো দাগ! আমার বুকের ভিতর টিপটিপানি। সেটা আর কিছু নয়—এই সুযোগে যদি পুজোয় রাজস্থানটা ঘুরে আসা যায়, সেই আশায় আর কী। যোধপুর, চিতোর, উদয়পুর–নামগুলো শুনেছি কেবল, আর ইতিহাসে পড়েছি। আর অবন ঠাকুরের রাজকাহিনীতে–যেটা আমার নরেশ কাকা আমাকে জন্মদিনে দেয়।

শ্ৰীনাথ চা এনে রাখল টেবিলের উপর। ফেলুদা সুধীরবাবুর দিকে একটা পেয়ালা এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক এবার একটা কিন্তু-কিন্তু ভাব করে বললেন, আপনার বিষয় কৈলাসবাবু যা বলেছিলেন, তাতে তো আপনাকে খুবই ইয়ে বলে মনে হয়। তাই ভাবছিলুম, যদি ধরুন, আপনি যদি রাজস্থানটা যেতে পারতেন! অবিশ্যি গিয়ে যদি দেখেন ওরা নিরাপদে আছে, তা হলে তো কথাই নেই। কিন্তু যদি ধরুন গিয়ে কিছু গোলমাল দেখেন; মানে, আপনার সাহসের কথাও অনেক শুনিচি! অবিশ্যি আমি নেহাত স্থা-পোষা লোক। আপনার কাছে আসাটাই আমার পক্ষে একটা ধৃষ্টতা। কিন্তু যদি ধরুন আপনি যেতে রাজিই হন, তা হলে আপনার, মানে, যাতায়াতের খরচটা আমি আপনাকে নিশ্চয়ই দেব!

ফেলুদা কপালে ভুকুটি নিয়ে আরও অন্তত মিনিট খানেক ওইভাবে চুপ করে বসে রইল। তারপর বলল, আমি কী স্থির করি, সেটা আপনাকে কাল জনাব। আপনার ছেলের একটা ছবি বাড়িতে আছে নিশ্চয়ই? কাগজে যেটা বেরিয়েছিল সেটা তেমন স্পষ্ট নয়।

সুধীরবাবু চায়ে একটা বড় রকম চুমুক দিয়ে বললেন, আমার খুড়তুতো ভাই ছবি-টবি তোলে—সে একটা তুলেছিল মুকুলের ছবি। আমার গিন্নির কাছে আছে।

ঠিক আছে।

ভদ্রলোক বাকি চা-টা শেষ করে হাত থেকে কাপ রেখে উঠে পড়লেন।

আমার দোকানে অবিশ্যি টেলিফোন আছে-৩৪-৫১ ১৬। দশটা থেকে আমি দোকানে থাকি।

আপনি এমনিতে থাকেন কোথায়?

মেছোবাজার। সাত নম্বর মেছোবাজার স্ট্রিট। মেন রোডের উপরেই।

ভদ্রলোক চলে যাবার পর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফেলুদাকে বললাম,আচ্ছা, একটা কথার কিন্তু মানে বুঝতে পারলাম না!

প্যারাসাইকলজিস্ট তো?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

ফেলুদা বলল, মানুষের মনের কতগুলো বিশেষ ধরনের ধোঁয়াটে দিক নিয়ে যারা চৰ্চা করে তাদের বলে প্যারাসাইকলজিস্ট। যেমন টেলিপ্যাথি। একজন লোক আরেকজন লোকের মনের কথা জেনে ফেলল। কিংবা নিজের মনের জোরে আরেকজনের চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে দিল। অনেক সময় এমন হয় যে, তুই ঘরে বসে আছিস, হঠাৎ একজন পুরনো বন্ধুর ক্লথা মনে পড়ল—আর ঠিক সেই মুহুর্তেই সে বন্ধু তোকে টেলিফোন করল। প্যারাসাইকলজিস্টরা বলে যে ব্যাপারটা আকস্মিক নয়। এর পেছনে আছে টেলিপ্যাথি। আরও আছে। যেমন এক্সট্রা সেন্সরি-পারসেপশন–যাকে সংক্ষেপে বলে হুঁ এস পি। ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে সেটা আগে থেকে জেনে ফেলা; বা এই যে জাতিস্মর-পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে যাওয়া। এগুলো সবই হচ্ছে প্যারাসাইকলজিস্টদের গবেষণার বিষয়।

এই হেমাঙ্গ হাজরা বুঝি খুব বড় প্যারাসাইকলজিস্ট?

যে কটি আছেন, তাদের মধ্যে তো বেশ নামকরা বলেই জানি। বিদেশে-টিদেশে গেছে, লেকচার-টেকচার দিয়েছে, বোধহয় একটা সোসাইটিও করেছে।

তোমার এ সব জিনিসে বিশ্বাস হয় বুঝি?

আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটা হল এই যে, প্রমাণ ছাড়া কোনও জিনিস বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করাটা বোকামো! মনটা খোলা না রাখলে যে মানুষকে বোকা বনতে হয়, তার প্রমাণ ইতিহাসে অজস্ৰ আছে। এককালে লোকে পৃথিবীটা ফ্ল্যাট বলে মনে করত। জানিস? আর ভাবত যে একটা জায়গায় গিয়ে পৃথিবীটা ফুরিয়ে গেছে, যার পর আর যাওয়া যায় না। কিন্তু ভূপৰ্য্যটক ম্যাগেলান যখন এক জায়গা থেকে রওনা হয়ে ভূপ্রদক্ষিণ করে আবার সেই জায়গাতেই ফিরে এলেন, তখন ফ্ল্যাট-ওয়ালারা সব মাথা চুলকোতে লাগলেন। আবার লোকে এটাও বিশ্বাস করেছে যে, পৃথিবীটাই স্থির, গ্রহ-নক্ষত্ৰ-সূৰ্য তাকে প্রদক্ষিণ করছে। এক সময় একদল আবার ভাবত যে, আকাশটা বুঝি একটা বিরাট উপুড়া-করা বাটি, যার গায়ে তারাগুলো সব মণিমুক্তোর মতো বসানো আছে। কোপারনিকস প্রমাণ করল যে সূর্যই স্থির, আর সূর্যকে ঘিরেই পৃথিবী সমেত সৌরজগতের সব কিছু ঘুরছে। কিন্তু কোপারনিকাস ভেবেছিল যে, এই ঘোরাটা বুঝি বৃত্তাকারে। কেপলার এসে প্রমাণ করল, ঘোরাটা আসলে এলিপটিক কক্ষে। তারপর আবার গ্যালিলিও… যাক গে, তোকে এত জ্ঞান দিয়ে লাভ নেই। তোর নাবালক মস্তিষ্কে এ সব ঢুকবে না।

ফেলুদা এত বড় গোয়েন্দা হয়েও বুঝতে পারল না যে আমাকে এখন খোঁচা-টোঁচা দিয়ে আমার ফুর্তিটা মাটি করা সহজ হবে না, কারণ আমার মন অলরেডি বলছে যে এবার ছুটিটা রাজস্থানেই কাটবে, আর নতুন দেশ দেখার সঙ্গে সঙ্গে চলবে নতুন রহস্যের জট ছাড়ানো। দেখা যাক আমার টেলিপ্যাথির দৌড় কদ্দূর।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
Pages ( 1 of 12 ): 1 23 ... 12পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress