সৈয়দ আবুল মকসুদ (বাংলাদেশের সাংবাদিক,কলামিস্ট,গবেষক ও প্রাবন্ধিক)
সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৪৬ সালের ২৩শে অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ও মা সালেহা বেগম। তাঁর জন্মের দুই বছর পর ১৯৪৮ সালের ২০ই নভেম্বর তার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর তার বিমাতা বেগম রোকেয়া আখতার তাকে সন্তান স্নেহে লালনপালন করেন। তিনিও ১৯৮০ সালে মারা যান। তার বাবা কাব্যচর্চা করতেন। তাই শৈশব থেকে তিনি দেশি বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। তার বাবা বাড়িতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য স্টেটসম্যান ও ইত্তেহাদ এবং পরে ঢাকার দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা রাখতেন।
আবুল মকসুদের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয় তাদের বাড়ির নাপিত লোকনাথ শীলের কাছে। তিনি তাকে ‘বর্ণবোধ’ ও ‘আদর্শলিপি’র পাঠ দিতেন। এরপর তিনি পড়েন তাদের ডাক্তার নিবারণচন্দ্র সাহা পোদ্দারের কাছে। তিনি সপ্তাহে তিন-চার দিন তাকে পড়াতেন। তিনি ঝিটকা আনন্দমোহন হাই স্কুলে একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এ পড়াশুনা করেছেন।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৪ সালে এম আনিসুজ্জামান সম্পাদিত সাপ্তাহিক নবযুগ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। এটি ছিল পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির মুখপত্র। পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থিত সাপ্তাহিক ‘জনতা’য় কাজ করেন কিছুদিন। পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ বার্তা সংস্থায় যোগ দেন। ২০০৮ সালের ২রা মার্চ বার্তা সংস্থার সম্পাদকীয় বিভাগের চাকরি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক প্রথম আলোর একজন নিয়মিত কলামিস্ট ছিলেন। এই দৈনিকে ‘সহজিয়া কড়চা’ এবং ‘বাঘা তেঁতুল’ শিরোনামে তিনি সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কলাম লিখতেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় ষাটের দশকে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ দিয়ে। তখন তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লিখতেন। ১৯৮১ সালে তার কবিতার বই ‘বিকেলবেলা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৭ সালে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা’ প্রকাশিত হয়। মানবাধিকার, পরিবেশ, সমাজ ও প্রেম নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিকধর্মী গবেষকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবনী ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন। আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে তিনি লিখেছেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর জীবন, কর্মকাণ্ড, রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৬ সাল) ও ভাসানী কাহিনী (২০১৩ সাল)। ভাসানী কাহিনীতে তিনি ভাসানীর বৈচিত্র্যময় ও ঘটনাবহুল দীর্ঘ জীবন এবং তার রাজনৈতিক দর্শন বর্ণনা করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (২০১১ সাল) ও স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ (২০১৪ সাল)। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থে তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে লিখেছেন। এছাড়া তৎকালীন সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। স্মৃতিতে ওয়ালীউল্লাহ গ্রন্থে তিনি তাকে চিনতেন এবং জানতেন এমন সব মানুষদের কাছ থেকে নানা উপাদান সংগ্রহ করেছেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে এবং পাকিস্তানে গিয়েছিলেন।
আবুল মকসুদের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ -য়ে। তাদের দুই সন্তান। মেয়ে জিহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং মাস্টার্স করে ব্যাংকে চাকরি করছেন। ছেলে নাসিফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করে দুই বছর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে চাকরি করছেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ২৩শে ফেব্রুয়ারি , ২০২১সালে, মঙ্গলবার বিকেলে অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি আবাসিক মেডিকেল অফিসার ফয়সাল হক জানিয়েছেন, সৈয়দ আবুল মকসুদকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তারপরও নিশ্চিত হতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটা ৯ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর সক্রিয়তার বছর – ১৯৬১ সাল থেকে ২০২১সাল।
[ তাঁর গ্রন্থতালিকা ]
( কবিতা )
১). বিকেলবেলা (১৯৮১)
২). দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা (১৯৮৭ সাল)
৩). সৈয়দ আবুল মকসুদের কবিতা (২০১২ সাল)
( প্রবন্ধ )
১). গণআন্দোলন ১৯৮২-৯০ (১৯৯১)
২). যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা (১৯৮৮)
৩). গান্ধী, নেহেরু ও নোয়াখালী (২০০৮)
৪). ঢাকার বুদ্ধদেব বসু (২০১১)
৫). রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, প্রভৃতি (২০১২)
৬). প্রতীচ্য প্রতিভা
৭). কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী
৮). ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা
৯). অরণ্য বেতার
১০). বাঙালি জাতি বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ
১১). রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতি
১২). রবীন্দ্র রাজনীতি
১৩). নির্বাচিত প্রবন্ধ
( জীবনী )
১). মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানীর জীবন, কর্মকাণ্ড, রাজনীতি ও দর্শন (১৯৮৬)
২). সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য (২০১১)
৩). ভাসানী কাহিনী (২০১৩)
৪). স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (২০১৪)
৫). গান্ধী মিশন ডায়েরি
৬). পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
৭). বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশ দার্শনিক
৮). পথিকৃৎ নারীবাদী খায়রুন্নেসা খাতুন
৯). মোতাহের হোসেন চৌধুরী জীবন ও সাহিত্য
১০). হরিশচন্দ্র মিত্র
( ভ্রমণকাহিনী )
১). জার্নাল অব জার্মানি
২). ভ্রমণ সমগ্র
( কলাম সংকলন )
১). সহজিয়া কড়চা
[ পুরস্কার ও সম্মাননা ]
১). বাংলা একাডেমি পুরস্কার – ১৯৯৫ (সামগ্রিক অবদান)
২). প্রথম আলো বর্ষসেরা বই (১৪২২)
————————————————————–
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত। তথ্যসূত্র – উইকিপিডিয়া,
সূত্রনির্দেশিকা –
“কলামিস্ট, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই”। The Daily Star Bangla। ২৩ ফেব্রুযারী ২০২১ সাল। সংগ্রহের তারিখ – ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২১ সাল।
সেলিনা হোসেন, নুরুল ইসলাম ও মোবারক হোসেন, সম্পাদক (২০০০ সাল)। Bangla Academy Dictionary of Writers। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ১৮৩। আইএসবিএন 984-07-4052-0.
( সাপ্তাহিকে সৈয়দ আবুল মকসুদের আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকার: আমার আমি – সৈয়দ আবুল মকসুদ )
“সৈয়দ আবুল মকসুদ”। বাণী চিরন্তণী। ৯ই নভেম্বর ২০১৬ সালে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।
এমরান কবির (২৩শে অক্টোবর , ২০১৬ সাল)। “শুভ জন্মদিন সৈয়দ আবুল মকসুদ”। চিন্তাসূত্র। সংগ্রহের তারিখ – ৩১শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।
“সৈয়দ আবুল মকসুদ – ভাসানী কাহিনী”। দৈনিক ইত্তেফাক। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সাল। সংগ্রহের তারিখ ৩১শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।
ওয়াসিফ ওয়াহিদ (১লা অক্টোবর ২০১১ সাল)। “A literary life in retrospect”। দ্য ডেইলি স্টার। সংগ্রহের তারিখ ৩১শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।
বিশ্বজিৎ ঘোষ (৬ই জুন , ২০১৪ সাল)। “ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে যত কথা”। দৈনিক প্রথম আলো। ৩১শে মে ২০১৮ সালে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১শে অক্টোবর ২০১৬ সাল।
“সৈয়দ আবুল মকসুদ আর নেই”। বাংলাদর্পণ। ২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০২১ সাল। সংগ্রহের তারিখ ।২৩শে ফেব্রুয়ারী ২০২১ সাল।