মুক্তকেশীর চার ছেলে
মুক্তকেশীর চার ছেলে।
সুবোধ, প্ৰবোধ, প্রভাস, প্রকাশ।
বড় সুবোধ বাপ থাকতেই মানুষ হয়ে গিয়েছিল, বাপাই নিজের অফিসে ঢুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন, কালক্রমে সেই মাৰ্চেণ্ট অফিসের বড়বাবুর পরবর্তী আসনটিতে এসে পৌচেছে সুবোধ, প্রকৃতপক্ষে তার টাকাতেই সংসার চলে।
মেজ প্ৰবোধ এনট্রান্স পাস করে অনেকদিন খেয়ে খেলিয়ে বেড়িয়ে এই কিছুদিন হল এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা লোহা-লক্কড়ের ব্যবসা ফেঁদেছে। টাকাটা বন্ধুর, খাটুনিটা প্ৰবোধের। সেজ প্রভাস হচ্ছে বাড়ির মধ্যে সেরা বিদ্বান ছেলে, এফ-এ পাস করে ফেলে সে ওকালতি পড়বে পড়বে করছে। আর প্রকাশ গোটা পাঁচ-ছয় ক্লাস পর্যন্ত পড়েই পাড়ার শখের থিয়েটারে স্ত্রীভূমিকা অভিনয় করছে আর চুলের কেয়ারি করছে। সুবর্ণর বিয়ের সময় সংসারের অবস্থা প্ৰায় এই ছিল।
অনেকদিন পর্যন্ত সুবর্ণ এদের সকলের পুরো নাম জানত না। সুবো, পেবো, পেভা, পেকা এই ছিল মুক্তকেশীর সম্বোধনের ভাষা। ছোট ননদ বিরাজকে ডেকে একদিন ধরে বসলো সুবর্ণ, তোমাদের সব নাম কি বল তো শুনি! মা তো তোমায় রাজু রাজু করেন, রাজবালা বুঝি?
শোনো কথা! রাজু অবাক হয়ে বলে, এতদিন বে হয়েছে, শ্বশুরবাড়ির লোকের নাম জানো না? মেজদা বলে নি?
সত্যি বলতে, রাজুর মেজদাকে কোনোদিন এ কথা জিজ্ঞেসও করে নি। সুবর্ণ। মনেও পড়ে নি জিজ্ঞেস করতে। এখনই হঠাৎ মনে পড়লো, জিজ্ঞেস করে বসলো। কিন্তু সেকথা না ভেঙে সুবর্ণ ঠোঁট উল্টে বলে, তোমার মেজদাকে জিজ্ঞেস করতে আমার দায় পড়েছে। তুমি রয়েছে হাতের কাছে, অন্যের খোশমোদ করতে যাবো কেন?
বয়সে তিন বছরের ছোট ননদিকেও এই তোয়াজটুকু করে নেয়। সুবৰ্ণ।
রাজু অবশ্য তাতে প্রীতিই হয়। আঙুল গুনে বলে, বড়দির নাম হচ্ছে সুশীলা, মেজদির নাম সুবলা, সেজদি হচ্ছে সুরাজ, আমি বিরাজ, আর দাদাদের নাম হচ্ছে–
মহোৎসাহেই গল্প হচ্ছিল ননদ-ভাজে। হঠাৎ সমস্ত পরিস্থিতিটাই গেল বদলে। বিরাজ রেগে ঠরঠরিয়ে উঠে গেল সেখান থেকে এবং তৎক্ষণাৎ মেজ বৌয়ের দুঃসাহসিক স্পর্ধার কথা সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল।
ভাসুর-দেওরদের নাম নিয়ে তামাশা করেছে সুবর্ণ, ননদের নাম নিয়ে ভোঙিয়েছে!
করেছে। সত্যই করেছে সেটা সুবর্ণ।
কিন্তু সুবর্ণ কি জানতো একটু কৌতুকে এত দোষ ঘটবে? আর নামের মানে জিজ্ঞেস করলে অপমান করা হয়?
সুরাজ শুনে বলে উঠেছিল সে, ওমা, সুরাজ আবার কি রকম নাম? ও নামের মানে কি?
একে যদি ভেঙানো বলে তো ভেঙানো।
তবে হ্যাঁ, দেওরদের সম্পর্কে বলেছে বটে একটা কথা তামাশা করে। পর পর চারজনের নাম শুনে হি হি করে হেসে বলে উঠেছে, তা চার ভাইয়েরই মিল করে নাম রাখলে হতো!
বিরাজ ভুরু কুঁচকে বলেছিল, সুবোধ-প্ৰবোধের সঙ্গে আর মিল কই?
সুবৰ্ণ হেসে কুটি কুটি হয়েছিল, কেন, অবোধ-নির্বোধ!
সঙ্গে সঙ্গে ঠিকরে উঠেছিল বিরাজ, বয়সের থেকে অনেকখানি জোরালো ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল, এত আস্পদ তোমার মেজ বৌ? সেজদা ছোড়দাকে তুমি নির্বুদ্ধি বলতে সাহস পাও? রোসো, মাকে বলে দিয়ে আসছি!
মাকে বলে দেওয়ার নামে অবশ্য সুবর্ণর মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত হয়ে ওর হাত চেপে বলেছিল, ওমা, তুমি রাগ করছ, কেন, ভাই? আমি তো ঠাট্টা করেছি—
কিন্তু বিরাজ হাত ধরার মান রাখে নি, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মুক্তকেশীর আবির্ভাব।
চেঁচানো না, ধমকানো না, থমথমে গলায় বললেন, কোন লক্ষ্মীছাড়া ঘরে মানুষ হয়েছিলে মেজবৌমা, শিক্ষা-সহবৎ নেই? এদিকে পাকা পাকা কথার জাহাজ? বলি পোবা-পেকার নাম নিয়ে ধিক হয়েছে কেন শুনি?
সুবৰ্ণ এবার সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলে, আমি তো ঠাট্টা করেছি।
ঠাট্টা? ঠাট্টা করেছ? বলি মেজবৌমা, ঠাট্টাটা কাকে করেছ? এই শাশুড়ীমাংগীকে, আর সেই মরা শ্বশুরকে তো? নামকরণ তো। ওরা নিজেরাই করতে যায় নি, এই আমরাই করেছি। সাতজন্মে এমন কথা শুনি নি যে, পুটকে একটা বৌ এসে ঠিকুজি-কুলুজি চাইতে বসে, নাম নিয়ে ব্যাখ্যানা করে। এ্যা, পোবা-পেকা শুনলে কী বলবে গো!
সুবৰ্ণতা বলে ফেলে, সবাইকে যদি শুনিয়ে বেড়ান, তবে আর কি করবো? আমি তো কাউকে শোনাতে যাই নি। ঠাট্টা করে বলেছিলাম, ছোট-ঠাকুরঝি লাগিয়ে দিতে গেল কেন?
বৌয়ের মুখ থেকে এমন স্পষ্ট পরিষ্কার ভাষা শোনার অভ্যাস মুক্তকেশীর নেই। বড় বৌ উমাশশীর মুখ দিয়ে সাত চড়ে রা বেরোয় না। বোনপো-বৌ ভাগ্নে-বৌ তা-ও অনেক দেখেছেন, পেটে পেটে বজাতি, হাড়-হারামজাদা হলেও মুখে এমন খই ফোঁটায় না কেউ।
আরো থমথমে গলায় বলেন, আমার গর্ভের মেয়ের আমন লাগানো-ভাঙানো স্বভাব নয় মেজবৌমা। ভাইদের ঘেন্না দেওয়া দেখে প্ৰাণে বড় লেগেছে। তাই বলে ফেলেছে। তোমার চরণেই কোটি কোটি নমস্কার মা। নামের আবার মানে চাই! বাপের কালে শুনি নি এমন কথা। জানতাম না। তো ঘরে আমার এমন বিদ্যোবতী বৌ আসবে, তা হলে মানে খুঁজে খুঁজে নাম রাখতাম। আচ্ছা! আসুক আজ পেভা, সে তো দুটো পাস করে তিনটে পাসের পড়া ধরছে, শুনছি। নাকি ওকালতি পড়বে। তাকেই জিজ্ঞেস করবো কোন নামের কি মানে? আর বলবো, এত বিদ্যে করেও তোদের
সুবৰ্ণ অভিমানী, কিন্তু সুবৰ্ণ কথায় খই ফোঁটায়, আত্মস্থ থাকতে পারে না। রাগ হলে চাপাবার ক্ষমতা নেই সুবর্ণর। তাই সুবৰ্ণ ফের শাশুড়ীর মুখের উপর বলে বসে, আপনারা বড্ড তিলকে তাল করেন, তুচ্ছ কথা নিয়ে এত হৈ-চৈ করতে ভাল লাগে।
মুক্তকেশী বসে পড়েন।
মুক্তকেশী বলেন, রাজু, এক ঘটি জল আন, মাথায় থাবড়াই। সই-মা আমার কত জন্মের শক্ৰ ছিল গো, এই মেয়ে গছিয়েছে আমায়া!
বিরাজ ছুটে জলের ঘটি নিয়ে আসে, মুক্তকেশী খাবলে খাবলে খানিক মাথায় থাবড়ে বলেন, এ বৌ নিয়ে ঘর করা হবে না। আমার, দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। সেই ভবিষ্যৎ। রাজু দোরটা দে, আমি একবার বাদুড়বাগান ঘুরে আসি। মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল।
মাথার মধ্যে আগুন যখন-তখনই জ্বলে ওঠে মুক্তকেশীর। একটা মাত্র ছেলেকে স্বামী দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, আর তিনটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এই পর্যন্ত। বাকী তিন-তিনটে ছেলেকে টেনে তুলতে হয়েছে, শেষ মেয়েটা বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠল।
এখন তবু দুই ছেলে রোজগার করছে, বড়র মাইনেও বেড়েছে। তখন যে টানাটানিতে চলেছে, ঈশ্বর জানেন আর মুক্তকেশী জানেন। সেই সব কষ্টই আগুনের উপাদান হয়ে মজুত আছে ভিতরে। একটু-ওদিকেই জ্বলে ওঠে সেই আগুন।
কিন্তু ঘরসংসারে তো এতদিন এদিক-ওদিক ছিল না। যা কিছু বাইরে। ঘরে ছেলেরা জোড়হস্ত, বড় বৌ তো মাটির ঘট, মেজ বৌ এসে ঢোকা পর্যন্ত থেকে থেকেই আগুন জ্বলে। আর উঠতে বসতে সেই পরলোকগতা। সইমার উদ্দেশ্যে অভিযোগবাণী বর্ষণ করেন।
তাও কি পার আছে?
মুখরা মেজ বৌ। কিনা বলে বসে, মরা মানুষটাকে আর কত গাল দেবেন? সেখানে বসে জিভ কামড়ে কামড়ে নতুন করে মরবো যে! একে তো আমি পৌত্রী হয়ে রাতদিন শাপ দিচ্ছি—
তুমি শাপ দিচ্ছ! মুক্তকেশী হঠাৎ থতিয়ে গিয়েছিলেন, ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, তুমি শাপ দিচ্ছ কোন দুঃখে?।,
যে দুঃখে আপনি দিচ্ছেন সেই দুঃখে, সুবৰ্ণ আকাশপানে তাকিয়ে উদাস গলায় বলেছিল, আর এখন দোষ দিই না, অদেষ্ট বলে মেনে নিয়েছি।
সুবৰ্ণর এই সব কথা শুধু মেয়েদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, পুরুষদের কানেও ওঠে। মুক্তকেশীই ওঠান, রোজ একবার করে হাতজোড় করে সংসার থেকে ছুটি চান।
শুনে মুক্তকেশীর বড় ছেলে মাঝে মাঝেই বলে, তোমরাই বা মেজ বৌমাকে অত ঘাটাও কেন বুঝি না। বুঝতেই তো পারো, একটু তেজী প্রকৃতির আছেন উনি—
কিন্তু মেজ-সেজ ছোট এই মারে তো এই কাটে করে ওঠে। বয়সে বড় দেবীরদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা কওয়া চলে না, তাই দেবীররা একতরফা গর্জন করে, মাকে অপমান? ভেবেছেন কি মেজ বৌ? মেজদার যাই রাজা দশরথের অবস্থা তাই পার হয়ে যাচ্ছেন, আর কেউ হলে আমন পরিবারের মুখ জুতিয়ে ছিঁড়ে দিত। তেজী প্রকৃতি আছেন উনি বলে তো দাদা তুমি দিব্যি আস্কারা দিলে, বলি মার অপমানটা গায়ে বাজল না তোমার!
সুবোধ সহাস্যে বলে, আহা, এক ফোঁটা মেয়ের কথায় মার আবার অপমান কিসের? গ্ৰাহ্য করেন কেন?
কিন্তু প্ৰবোধ থাকলে দাদার বদলে ছোট ভাইদের সমর্থন করে। বলে, দিয়ে আসতে হবে একদিন বিদেয় করে।
বলে, তবে গলাটা একটু নামিয়ে বলে। বৌকে নেহাৎ চটিয়ে রাখলে অসুবিধে আছে। বৌ বিগড়োলে নিজের স্বভাব-চরিত্র ভাল রাখতে পারা যাবে কি বিগড়ে বসবে কে বলতে পারে? পুরুষমানুষ তো?
বাদুড়বাগানে মুক্তকেশীর সমবয়সী মাসতুতো বোন হেমাঙ্গিনীর বাড়ি। মাথা গরম হয়ে উঠলেই এখানে চলে আসেন মুক্তকেশী। কারণ হেমার কথাবার্তা প্ৰাণ-জুড়োনো, হেমার কাছে জল উঁচু তো জল উঁচু , জল নীচু তো জল নীচু।
মুক্তকেশী যদি বলেন, আমার বড় বেঁটার মত ভালোমানুষ আর হয় না—
হেমা বলেন, আহা তা আর বলতে! বৌ দেখলে চোখ জুড়োয়।
মুক্তকেশী যদি বলেন, আমার বড় বেঁটার মতন বোকা আর ত্ৰিভুবনে নেই-
হেমা বলেন, তা যা বলেছ, দেখছি তো সব! তুই যাই তাই-ওই বোকাকে নিয়ে ঘর করছিস!
তবে মুক্তকেশীর মেজ বৌ সম্পর্কে সুরফের্তা করতে হয় না কখনো হেমাকে। সব সময়েই বলা চলে, সত্যি মুক্ত, কী করে যে তুই বৌ নিয়ে ঘর করছিস!
মুক্তকেশী কপালে করাঘাত করে বলেন, উপায়? পেবোর তো শুধু মুখে হুমকি, ভেতরে ভেতরে রূপুসী বৌয়ের ছিচরণের গোলাম! আমার অবস্থাটি কেমন? সেই যে বলে না—
মেয়ে বিয়োলাম, জামাইকে দিলাম
বেটা বিয়োলাম, বৌকে দিলাম,
আপনি হলাম বাঁদী,
ইচ্ছে হয় যে, দুয়োরে বসে
ঠ্যাং ছড়িয়ে কাঁদি!
সেই তাই, চোর হয়ে আছি।
সমবয়সী হলেও মুক্ত নাকি দু-চার মাসের ছোট, তাই হেমাঙ্গিনীর বর কাশীনাথ তাঁর সঙ্গে ছোট শালীজনোচিত কৌতুক-পরিহাস করে থাকেন, এবং দুই বোনে একত্র হলেই ঠিক এসে জোটেন। ভাল চাকরি করতেন, দিল্লী-সিমলেয় কাজ ছিল, সম্প্রতি রিটায়ার করে সাবেকী বাড়িতে এসে বসবাস করছেন। হেমাঙ্গিনী অবশ্য কখনো স্বামীর সঙ্গে সেই দিল্লী-সিমলের সুখাস্বাদন করতে যান নি। বরের সঙ্গে বাসায় যাওয়ার নিন্দের ভয়েই শুধু নয়, নিজের দিকেও জাত-যাওয়ার ভয় ছিল প্ৰবল। ওসব দেশে গেলে যে জাত-যাওয়া অনিবাৰ্য এ কথা হেমাঙ্গিনীর ছেলেবেলা থেকে শোনা। কাশীনাথের গৃহসুখ ছিল শুধু ছুটি-ছাটায়।–
কাশীনাথ হেসে হেসে বলতেন, জাতটা আর বাঁচলো কই? এই জাত-যাওয়া লোকটার ঘরে এসে তো শুচছ!
হেমাঙ্গিনী ভ্ৰাভঙ্গী করত, যত সব বিটকেল কথা!
আমি চলে গেলে গঙ্গাস্নান করা? না শুধু লুকিয়ে একটু গোবর খেয়ে ফেল?
হেমাঙ্গিনী আরো ভুরু কোঁচকাতো।
বেশি কথা বলতে জানতো না কখনো, এখনো না। সব কথাই মুক্তকেশীর। মাঝে-সাঝে কাশীনাথ এসে জোটেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত।
তুমি চোর হয়ে আছ? বল কি মুক্ত? তা হলে ডাকাত আবার কেমন দেখতে?
হেমাঙ্গিনী বলে ওঠেন, আবার তুমি মস্করা করতে এলে? ও মরছে নিজের জ্বালায়—
কাশীনাথ হুঁকো খেতে খেতে মিটিমিটি হেসে বলেন, লঙ্কাও মরে নিজের জ্বালায়। তার জুলুনি ঘোচাবে, এমন সাধ্যি মা গঙ্গারও নেই! বলি, হচ্ছে তো? পরের মেয়েদের কুচ্ছে হচ্ছে তো? আশ্চয্যি, বুড়ো বুড়ো দুটো গিন্নী তোমরা, আপনি আপন দোষ দেখতে পাও না, ওই দুধের মেয়েগুলোও মধ্যে এত দোষও দেখো!
মুক্তকেশীর মুখ লাল হয়ে ওঠে, তবু বলেন, বুড়ো মাগীদের দোষ দেখতে তো জগৎ আছে জামাইবাবু! এই তুমিই তো কত দোষ দেখছা! তবে ওদেরও শিক্ষেদীক্ষের দরকার। কুচ্ছে। আমরা করি না, হক কথা বলি। এই যেমন তোমাদের ঘরের ছোটটি, তেমনি আমার ঘরের মেজটি, তুল্যমূল্য। ওরা আমাদের দেশত্যাগী করতে পারবে।
তা বললে কী হবে? হেমাঙ্গিনী অসন্তোয্যের গলায় বলেন, বুড়ো বয়সে উনি এখন ক্ষুদে ক্ষুদে বৌদের মানরাখা কথা বলতে আরম্ভ করেছেন! মনে করেছেন তাতে রাখি! আমি মরে গেলে বৌরা যত্ন-আত্তি করবে! মনেও করো না তা, বুঝলে? বাঘিনীর চোখের সামনে আছে, তাই এখন এত ঠাকুরসেবা। মারি একবার, তখন দেখো। বলবে ভাল আপদ হয়েছে, ঘাড়ে একটা বুড়ো শ্বশুর!
কাশীনাথ হেসে ওঠেন, বালাই বালাই, তুমি মরবে। আর আমি জিন্দা থেকে সেই দৃশ্য দেখবো? ছিঃ! তুমি দু-দশ দিন মুক্তর মতন মাথা মুড়িয়ে হাত নেড়া করে স্বাধীনতার সুখটা ভোগ করে নাও। বৈধব্যকালটাই তো মেয়েমানুষের আসল সুখের কাল গো! তাতে আবার যদি বয়েসকলটা একটু ভাটিয়ে আসে! কার সাধ্যি হক কথা বলে!
জামাইবাবুর। যেমন কথা!
মুক্তকেশী কোপ প্ৰকাশ করেন।
কাশীনাথ দামেন না। বলেন, হক্ কথা কও ভাই মুক্ত, ভায়রাভাই যখন বেঁচে ছিল এত পা ছিল তোমার? এত স্বাধীনতা?
এইরকম হাড়জুলানো কথাবার্তা কাশীনাথের। কিন্তু শুনতেই হয়, উপায় কি? হেমা যে তার প্ৰাণের সখী, হেমার সঙ্গেই যত শলা-পরামর্শ। শিষ্যাও বটে।
বৌদের কিসে জব্দ রাখতে হয়, আর ছেলেদের কি করে বশে রাখতে হয়, সে বিদ্যাকৌশল মুক্তকেশী শেখান হেমাঙ্গিনীকে।
আজ কিন্তু মুক্তকেশীই পরামর্শ চান, ওই বেহেড বৌকে কি করে দাবে আনি বল দিকি হেমা?
হেমাঙ্গিনীরও বোধ করি। হঠাৎ গুরুর পোস্ট পেয়ে বুদ্ধি খুলে যায়। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন, দাবে আনা যায় ভাতে মারলে! বরের সোহাগেই তো ধরাখানা সরাখানা। তুমি একটা কোনো কৌশল করে ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে শোবে, দেখো দুদিনে টিট হয়ে যাবে।
মুক্তকেশীর কৌশলটা মনঃপুত হয়, কিন্তু সম্ভব মনে হয় না। বলেন, ছোঁড়া যে তা হলে বুক ফেটে মরবো!
বরং উল্টো রে মুক্ত, ডাকিনীদের খপ্পর থেকে দুদিন সরিয়ে নিয়ে বাঁচবে। তুই একটা বানানো কথা বল। বল যে স্বপ্ন দেখলাম, তোর সময় খারাপ আসছে। মাতৃমন্তর জপিলে আর মায়ের আওতায় থাকলে তবেই রক্ষে।
তবেই রক্ষে বুঝলে বড় বৌমা–, মুক্তকেশী বড় বৌমার কাছে ফিসফিস করেন, এই বাক্যিটি ভালমত করে বুঝিও তো তোমার মেজ জা-টিকে। আমি বলতে গেলে মন্দ হবো। তবে আমাকে তো ছেলের কল্যেণ-অকল্যেণ দেখতে হবে।
না, তখনো সুবৰ্ণলতার চোদ্দ বছর বয়েস হয় নি, তখনো তার অন্তরালে একটি প্ৰাণকণা আশ্রয়লাভ করে নি। তখনো সুবৰ্ণরা সেই তাদের পুরনো বাড়িতে ছিল, যে বাড়ির উঠোনে দেয়াল তুলে তুলে তার জেঠশ্বশুর-খুড়শ্বশুররা নিজ নিজ সীমারেখা নির্দিষ্ট করে নিয়ে বসবাস করতেন এবং শাশুড়ীকুল খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলেই এ বাড়িতে বেড়াতে এসে সংসারের সর্বত্র শ্যেনদৃষ্টি ফেলতেন।
কিন্তু সকলেই এক দলে নয়।
ছোট খুড়শাশুড়ীর শ্যেনদৃষ্টি এই নতুন ব্যবস্থার ওপর পড়তেই তিনি মুক্তকেশীকে এসে চেপে ধরলেন, হ্যাগো নাদি, এ আবার কি আদিখ্যেতা তোমার? ঘরে ডবকা বৌ, প্ৰবোধ কেন তোমার আঁচলতলায় শুতে আসে?
মুক্তকেশী যদিও দজাল, তবু জা-ননদকে কিছুটা মেনে চলেই আসছেন। তাই বেশ করেছি তোমার তাতে কি-না বলে সংক্ষেপেই বলেন, স্বপন পেয়েছি।
স্বপন পেয়েছ? ওমা! স্বপন পাবার বস্তু-বিষয় পেলে না তুমি? কী স্বপন পেয়েছ শুনি?
মুক্তকেশী আরো সংক্ষেপে বলেন, স্বপন বলা নিষেধ।
ছোট বৌ ব্যঙ্গের সুরে বলে, জেগে স্বপন দেখলে বলতে নিষেধ হবে বৈকি। তবে এও বলে রাখছি। নদি, বজ্রআঁটুনি করলেই গেরো ফসকায়। এখন তোমার বৌ মনের খেদ মনে চেপে তোমার অন্যায় বিধেন মেনে চলছে, ভবিষ্যতে এর শোধ নেবে তা জেনো। বুড়ো তো হতে হবে, ওদের হাতে তো পড়তে হবে।
মুক্তকেশী সদৰ্পে বলেন, কেন? মানুষের হাতে পড়তে যাবো কেন? মা গঙ্গা নেই? যতক্ষণ চক্ষুছরদ থাকবে, ততক্ষণ দাপট করে সংসারে থাকবো। ক্ষ্যামতা গেলে গঙ্গা-গৰ্ভে ঠাঁই নেব। তবে এ কথাটি বলে রাখি ছোট বৌ, যার দুঃখে চোখে নোনাপানি ঝরিছে তোমার, সেটি সোজা নয়। খেদা! খেদে তো মরে যাচ্ছে! বড়বৌমার কাছে কী বলেছে জানো? আঃ, শুনে বাঁচলাম, হাড়ে বাতাস লাগলো। কিছুদিন তবু ঘুমিয়ে বাঁচবো। মা-দুগ্গার কাছে বর চাইবো সময় ওর যেন বরাবর খারাপ থাকে। শুনলে? এর পরও করবে। খেদ?
ওটা তেজ করে বলেছে, ছোটগিনী হেসে ফেলে বলেন, দুঃখু জানিয়ে খেলো হবে না। এই আর কী! তা তোমার ছেলের অবস্থা কি?
মুক্তকেশীও তেজী।
মুক্তকেশী খেলো হবার ভয়ে মটমটিয়ে কথা বলেন। তবু আচমকা মুক্তকেশী একটু অসতর্ক হয়ে যান। বলে ফেলেন, ছেলের কথা আর বলিসনে, কামরূপ কামিখ্যের জন্তু। ছটুফটিয়ে মরছেন, সারারাত্রি ঘুম নেই। এই উঠছে, এই জল খাচ্ছে, আমি তেমন মড়া হয়ে ঘুমোলে পারলে পালায়। আমিও বাবা তেমনি ঘুঘু, যেই উসখুসি করে সাড়া করি, জল খাবি? মশা কামড়াচ্ছে? গরম হচ্ছে?
ছোট গিন্নী হেসে ফেলে বলেন, তা মা হয়ে তো কম শাস্তি করছ না তুমি ছেলের?
সেই তো! সেই তো হয়েছে জ্বালা, কুলাঙ্গার হয়েছে একটা। আমার সুবো। অমন নয়। এই হতভাগার জন্যেই আবার মান খুইয়ে ঘরে পাঠাতে হবে। মানিনী তো গরবে আছেন। শুনলে অবাক হবে, রাজুকে কাছে শুতে বলেছিলাম, নিল না ঘরে! বলে একলা খিল দিয়ে বেশ শোবো!
হ্যাঁ বলেছিল সুবর্ণ।
তেরো বছরের সুবর্ণ।
আমার আমন ভূতের ভয় নেই। একলা বেশ শোবো। বরং সুখে ঘুমুবো, সারারাত একজনকে বাতাস করে মরতে হবে না।
কিন্তু মুক্তকেশীর গর্ভের কুলাঙ্গার এই অপমানের পরও মান খোয়ায়। আড়ালে আবডালে হাত ধরতে আসে। বলে, তোমার প্রাণে কী একফোঁটা মায়া-মমতা নেই মেজ বৌ? ফাঁদে-ফন্দীতে একবার দেখা করতেও ইচ্ছে হয় না?
সুবৰ্ণ হাত ধরতে না দিয়ে বলে, কেন, দেখছি না নাকি? সর্বদাই তো দেখতে পাচ্ছি।
আহা সে দেখা আবার দেখা! রাতেই না হয়। ঘরে আসা বারণ, অন্য সময় একটু দেখা করতে দোষ কী?
আমার অতি সাধ নেই।
ভারি নির্মায়িক তুমি।
তোমাদের সবাই তো খুব মায়াবান!
আহা, মায়ের একটা কারণ ঘটেছে তাই—
আমিও তো তাই বলছি। তুমিই হাঁপাচ্ছ।
হাঁপাচ্ছি সাধে মেজ বৌ? মানুষের কলজে আছে তাই হাঁপাচ্ছি।
আমার তবে নেই সে কলজে! হল তো?
দোহাই তোমার, কাল দুপুরে একটিবার যেন চিলেকোঠার ঘরে দেখা পাই।
দুপুরে? আপিস নেই?
আপিস পালিয়ে চলে আসতে হবে, উপায় কি?
তোমার মাথা খারাপ বলে তো আর আমার খারাপ হয় নি?
ওঃ, আচ্ছা! তার মানে স্বামীর প্রতি মন নেই। তার মানে মনে অন্য চিন্তা আছে। বেশ আমিও পুরুষমানুষ।
শুনে বাঁচলাম। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় কিনা।
প্রবোধ ক্রুদ্ধস্বরে বলে, এইটুকু বয়সে এত কথা শিখলে কি করে বল তো?
কি জা—নি!
হঠাৎ দালানে কার ছায়া পড়ে। প্ৰবোধ তাড়াতাড়ি চলে যেতে যেতে বলে, আচ্ছা আচ্ছা, ঝগড়া থাক। দোহাই তোমার, মনে থাকে কাল দুপুরে, চিলেকোঠার ঘরে! আপিস পালিয়ে এসে যেন হতাশ না হই!
কিন্তু আশা কি পূর্ণ হয়েছিল প্ৰবোধের? চিলেকোঠার ঘরে এসেছিল সুবৰ্ণ?