সিঁড়িতে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়ালো প্ৰভাস
সিঁড়িতে উঠতে উঠতে থমকে দাঁড়ালো প্ৰভাস।
ওটা কি হচ্ছে?
একটা মেয়েলী গলায় স্পষ্ট উচ্চারণে কী শোনা যাচ্ছে ওসব মেজদার ঘরের ওদিক থেকে?
পদ্য।
পদ্য আওড়ানো হচ্ছে!
কিন্তু এ তো ছোট ছেলেমেয়ের পড়া মুখস্থ নয়! এ যে নাটক!
বল বল বল সবে,
শত বীণা বেণু রবে,
ভারত আবার জগৎসভায়
শ্ৰেষ্ঠ আসন লবে।
সিঁড়ি থেকে নয়, পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেজদার দরজার কাছেই এসে পৌঁছায় প্রভাস, আর দুটোই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার কাছে। শোনা এবং দেখা।
মেজাগিনী ইস্কুলই খুলেছেন।
তিনি একখানা বই খুলে ধরে খানিকটা আওড়াচ্ছেন, আর তার পর কটা ছোট ছেলেমেয়ে তার দোয়ার দিচ্ছে। সুবর্ণর ছেলেমেয়ে আছে, উমাশশীর আছে।
ইস্কুলই বা কেন, কের্তনের দল বললেও তো হয়।
তাই পরবর্তী ঝঙ্কারে যখন ছোটরা ভুল-ভাল উচ্চারণে বলে ওঠে–
ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে।
নব দিনমণি উদিবে আবার–
পুরাতন এ পূরবে—
তখন চৌকাঠে পা রেখে চেঁচিয়ে ওঠে। প্ৰভাস, বাঃ বাঃ! কেয়াবাৎ! এ যে একেবারে পুরোপুরি কোত্তনের দল! মূল গায়েন সুর দিচ্ছেন, চেলাচামুণ্ডারা দোয়ার দিচ্ছেন, শুধু তবলার বোলটাই বাকি! তবে তোদের মাকে বলে দে চন্নন, পাশের ঘরে তোদের সেজখুড়ির ভাই এসেছে। শুনে শুনে তাজ্জব হচ্ছে বোধ হয়। ভদ্রলোকের ছেলেটা!
বলা বাহুল্য চুপ হয়ে গিয়েছিল সকলেই।
প্রভাসও এতেই যথেষ্ট হয়েছে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাচ্ছিল, সহসা শুনতে পেল বড়দার একটা নিতান্ত ছোট ছেলে বলে উঠলো, সেজকাকা, মেজখুড়িমা আমাদের আবার গাইতে বলছেন। বলছেন, এটা কোত্তন নয়।
প্রভাস শেষ কথাটা শোনে না, প্রথমটাই শোনে।
অসহ্য বিস্ময়ে বলে, আবার গাইতে বললেন!
হ্যাঁ গো। বলছেন এ গান সবাইয়ের শেখা দরকার। এর পরে বন্দেমাতরং শেখাবেন।
খবরদার! প্রভাস হঠাৎ গর্জন করে ওঠে, ভেবেছেন কি তোদের মেজখুড়ি? হাতে দড়ি পরাতে চান আমাদের? বলে দে, চলবে না ওসব। এ ভিটেয় বসে এত বাড়াবাড়ি চলবে না।
ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভিতর থেকে জবাব দেয়, মেজখুড়িমা বলছেন, বাড়িসুদ্ধ সকলের ওপর আপনার শাসনই চলবে? আর কারুর কোনো ইচ্ছে চলবে না?
ছেলেটা কথা শিখেছে তোতাপাখীর মত। কথার গুরুত্ব কি, ওজন কি, তা শেখে নি, তাই বলতে পারে এত কথা। আর সব কটা আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে। সেজকাকার মুখের ওপর কথা! এ কি ভয়ঙ্কর অঘটন!
তা সেজকাকা নিজেও সেই বিস্ময়েই প্রথমটা স্তব্ধ হয়ে যান। তার মুখের ওপর কথা! অবশ্য স্তব্ধতাটা মুহূর্তের। পরীক্ষণেই মাটিতে পা ঠুকে চীৎকার করে ওঠেন। তিনি, বটে! বাড়িতে তা হলে এখন এইসব কুশিক্ষার চাষ চলছে? তা নিজের ছেলেদের মাথা খাচ্ছেন খান, পরের ছেলের মাথাটি চর্বণ করা হচ্ছে কেন?… খোকা, উঠে আয় বলছি! চলে আর ও ঘর থেকে. আর বলে আয় তোর মেজখুড়িকে, না, চলবে না। যার না পোষাবে, সে যেন পথ দেখে।
এরপরই বজ্রপতন হয়।
এবার আর খোকা নয় স্বয়ং মেজবৌ-ই দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। খোকাকে মাধ্যম মাত্র করে বলে, খোকা, জিজ্ঞেস কর তোর সেজকাকাকে, উনিই কি এ বাড়ির কর্তা? ইচ্ছেমত কাউকে রাখতে পারেন, কাউকে তাড়াতে পারেন? তা যদি হয়, বলুন পষ্ট করে, কালই পথ দেখবো। কিছু না জোটে, গাছতলা তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!
তা অঘটনও ঘটে পৃথিবীতে।
নইলে এই দুঃসহ স্পর্ধা প্রকাশের পরও সুবৰ্ণ সোজা সতেজে দাঁড়িয়ে থাকতে পায়? আকাশের বাজ তো পড়েই না তার মাথায়, স্বয়ং সেজকর্তাও তেড়ে গিয়ে মেরে বসেন না। বরং হঠাৎ যেন লোকটা ভাষা হারিয়ে মূক হয়ে যায়।
তারপর কথা যখন কয়, যেন শিথিল সরল ভঙ্গীতে। চলে যেতে যেতে বলে, আমারই ঘাট হয়েছে, তাই শাসন করতে এসেছিলাম। পাশের ঘরে একটা কুটুমের ছেলে বসে, লজ্জা হল, তাই আস্পর্দা প্রকাশ করতে এসেছিলাম। যাক, তোদের খুড়ি চৈতন্য করিয়ে দিয়েছে। রাতদিন বই কাগজ নিয়ে পড়ে থাকা বিদূষী মেয়েমানুষ, হবেই তো এসব! তবে বলে দে খোকা তোর খুড়ীকে, এ বাড়িতে তার ভাগ রয়েছে বলেই যে যা খুশি করতে পারেন তা হয়, তা হলে তো বোমাও করতে পারেন। তিনি।
চলে যায় প্রভাস, তীব্র বিদ্বেষে মুখ কালি করে।
বলা বাহুল্য, পদ্য মুখস্থর পাঠশালা আর বসানো যায় না, সুর কেটে যায়।
কিন্তু শুধুই কি সেদিন?
নাকি শুধু পদ্যর ক্লাসের সুর?
কান্না! কান্না!
কটু কুৎসিত কদৰ্য কান্না!
শুনলে করুণা আসে না, মায়া আসে না, আসে বিতৃষ্ণা।
গিরিবালা পোস্ত বাটতে বাটতে বলে, মেজদির এই শেষ নম্বরেরটি যা হয়েছে—উঃ! গলা বটে একখানি। মানুষের ছা কাঁদছে। কিন্তু জন্তু জানোয়ার চেঁচাচ্ছে—বোঝবার জো নেই।
জন্মাবধি রুগ্ন যে–, বলে উমাশশী।
তুমি আর জগৎসুদ্ধ সবাইয়ের দোষ ঢেকে বেড়িও না দিদি, গিরিবালা ঠেস দিয়ে বলে, কে যে তোমায় কি দিয়ে রাজা করে দিচ্ছে, তুমিই জানো!
দোষ ঢাকা আবার কি! উমা অপ্ৰতিভ হয়, রুগ্ন তাই বলছি।
গিরিবালা কাজ সেরে শিল তুলে রাখতে রাখতে বলে, আমার এই হয়ে গেল বাবা, চললাম এবার। উনুন দুটো তো জ্বলে-পুড়ে খাকি হয়ে গেল, যার পালা তার হঁশ নেই!
উমার ধারণা ছিল এবেলার পালাটা আজ ছোটবৌয়ের, তাই বলে, কোথায় ছোটবৌ?
ছোটবৌ? কেন ছোটবোঁ কি করবে? পালা তো মেজদির!
ওমা সে কি! আজি বুধবার না?
বুধবারই! কিন্তু গেল হস্তায় ছোটবৌয়ের বাপের বাড়ি যাবার গোলমালে পালা বদলে গেল না?
উমাশশী বড়ো, উমাশশী নির্বোধ, উমাশশী গরীবের মেয়ে। আবার উমাশশী কিছুটা প্ৰশংসার কাঙালীও। তাই উমাশশী একাই সংসারের অর্ধেক কাজ করে।
প্রতিদিন সকালে এই রাবণের গোষ্ঠীর রান্না সে একাই চালায়। আর তিনজনে পালা করে বিকেলে।
সুবৰ্ণ অনেকবার প্রস্তাব করেছে একটা রাধুনী রাখবার। মাইনে সে একলাই দেবে। একটা ভদ্র বামুনের ঘরের আধাবয়সী বিধবা খুঁজে না মেলে তা নয়। কি উমাশশী শাশুড়ীর সুয়ো হতে সে প্রস্তাব নাকচ করেছে। বলেছে, ওমা, আমরা হাত পা নিয়ে বসে থাকবো, আর বামনীতে রাধবে, ছিঃ!
সুবৰ্ণ বলেছে, তবে মরো রোধে রোধে! আমার দ্বারা তো একদিনও সকালে সম্ভব নয়। ওদের লেখাপড়া তাহলে শিকেয় উঠবে।
উন্নবিপুলত গ্রেহে বলেছে, ওমা, আমি থাকতে সকালবেলা আবার তোরা কেন? সকালবেলা তো আমিই–
জানি, তুমিই চালাচ্ছে! হাড়-মাস পিষছো! কিন্তু সেটা বারো মাস দেখতেও ভাল লাগে না। তোমার মেজদ্যাওর তো করছে বেশি বেশি রোজগার, দেবে অখন মাইনেটা—
উমাশশীই না না করেছে।
অতএব সুবর্ণর আর বিবেকের দংশন নেই। কিন্তু কে বলবে কেন উমাশশীর এমন বোকামী! কেন সে অবিরত সংসারে সকলের মন রাখার চেষ্টা করে মরে? মন কি সত্যিই কারো রাখতে পেরেছে?
মন রেখে রেখে কি কখনো কারো মন রাখা যায়?
যায় না।
শুধু সেই মনের দাবি আর প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেওয়া হয় মাত্র। আর সেই ব্যর্থ চেষ্টা অবিরতই তাকে অবজ্ঞেয় করে তোলে।
উমাশশী বৃথা চেষ্টার বোঝা চাপিয়ে চাপিয়ে জীবনটাকে শুধু ভারাক্রান্তই করে তুলেছে, মন কারো রাখতে পারে নি। মুক্তকেশী সর্বদাই তার উপর ব্যাজার! মুক্তকেশী তোয়াজ করেন উকিল ছেলের বৌকে!
কেন করেন সেটাই আশ্চর্য!
এও এক মনস্তত্ব।
নচেৎ টাকার সচ্ছলতা যদি কেউ তাকে দেয়, সে তো মেজছেলে। তবু সেজবৌকে ভয় করেন, তোয়াজ করেন।
ছোঁয়াচ লাগার মত উমাশশীও করে। তাই ভয়ে ভয়ে বলে, মেজবৌয়ের মেয়ে আজ যা কাণ্ড করছে, ও আর পেরেছে!
না পারেন, যে পারে করুক! আমি বাবা উনুনের ছায়াও মাড়াচ্ছি না। আমার পালার দিনে কি কেউ হাঁড়ি ধরতে আসবে? বলে দুম দুম করে চলে যায় গিরিবালা।
সুবৰ্ণ নামে না।
খবরটা দোতলায় ছড়িয়ে পড়ে। অসন্তোষ আর সমালোচনার কলগুঞ্জন প্ৰবল হয়ে ওঠে। এবং সব ছাপিয়ে প্রবলতর হয়ে ওঠে কান্না।
কান্না, কান্না, কুৎসিত কান্না!
ওই আর্তনাদ যেন এই অন্ধকূপ থেকে আকাশে উঠতে চায়।
বাড়িতে কি হচ্ছে কি? তীব্ৰ চীৎকার শোনা যায় প্রভাসচন্দ্রের। তাসের আড্ডা থেকে উঠে এসেছে লজায় আর বিরক্তিতে। মেজাজ। তাই সপ্তমে।
বুলি, কাঁদছে কোনটা মেজবৌয়ের শেষ নম্বরেরটা না? মেজবৌ বাড়ি নেই নাকি?
বাড়ি!
থাকবেন না। আবার কেন?
বাড়ি ছেড়ে আবার যাবেন কোথায়?
মেয়ে কোলে নিয়েই বসে আছেন।
কোলে নিয়ে বসে আছেন? প্রভাস বিরক্তির সব বিষটা উপুড় করে দিয়ে চলে যায়, তবু গলা বন্ধ করতে পারছে না? মেয়ের গলায় এমন শাখের বান্দ্যি? মুখে একমুঠো নুন দিতে বল, বন্ধ হয়ে যাবে!
চলে যায়।
ঈশ্বরের দয়া, সুবৰ্ণলতার কানে পৌঁছয় না। এই হিত পরামর্শটুকু। সুবৰ্ণলতার কানের পর্দা কান্নার শব্দে ফেটে যাচ্ছে তখন।
ওদিকে রান্নাঘরে ঝড় উঠেছে।
উমাশশীই হাঁড়ি চড়াবার ভার নিচ্ছিল, প্রবল প্রতিবাদ উঠেছে। সেজবৌ আর ছোটবৌয়ের পক্ষ থেকে। সুবৰ্ণকেই বা এত আস্কারা দেবে কেন উমাশশী? যার পাঁচ-সাতটা ছেলেমেয়ে তার ঘরে তো নিত্যি রোগ লেগে থাকবেই, তাই বলে ওই ছুতোয় সে দিব্যি পার পেয়ে যাবে?
কই বলুক দিকি কেউ, সেজবৌ ছোটবৌ কোনোদিন পালা ফাঁকি দিয়েছে! তাদের নিজেদের ঘর হেজে যাক মজে যাক, তবু সংসারের কাজ বাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে। মেজগিনীই বা কী এমন সাপের পাঁচ পা দেখেছে যে ইচ্ছামত চলবে?
উমাশশী যদি এইভাবে একচোখোমি করে, তারাও ছেলের সর্দিটি হলেই কাজে কামাই দেবে, এই হচ্ছে শেষ কথা!
উমা ভয়ে ভয়ে হাঁড়িখানাকে তাক থেকে নামিয়ে, চালের গামলা হাতে নিয়ে কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। জোর করে কর্তব্য করবার সাহসও তার নেই।
একথা বলবার সাহস নেই, তোমাদের তো কর্তে হচ্ছে না বাপু, তবে অত গায়ের জ্বালা কেন?
কিন্তু কেন যে গায়ের জ্বালা, সে কথার উত্তর কি নিজেরাই জানে ওর?
যেখানে ছোট কথা ছাড়া আর কোনো কথার চাষ হয় না, সেখানে বড় কথা, মহৎ কথা। তারা পাবে কোথায়? ছোট কথাই জ্বালার জনক।
মেয়ে নিয়ে ঘরে বসে সোহাগ হচ্ছে? তোমার না। আজ রান্নার পালা?
ঘরের মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘায়ের মত একটা হুমকি এসে পড়ে।
নিরবচ্ছিন্ন ক্ৰন্দনে শক্ত হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে চুপ করাবার বৃথা চেষ্টায় নিজেই কেঁদো-কাঁদো। হচ্ছিল সুবর্ণ, এই শব্দে চমকে পিছন ফিরে তাকায়। তার পরই অগ্রাহ্যাভরে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে, পালা বজায় রাখতে যাবার মত অবস্থা দেখছো যে!
এইমাত্র নীচে বহুবিধ বিরুদ্ধ সমালোচনা শুনে এসে প্ৰবোধচন্দ্রের মেজাজ খাপ্পা, তাই ক্রুদ্ধস্বরে বলে, তোমার অবস্থা অপারে শুনবে কেন শুনি? ফেলে রেখে দিয়ে চলে যাও। মেয়ে নিয়ে এত আদিখ্যেতা!
সুবৰ্ণলতা তেমনি আগ্রহের গলায় বলে, কার কাছে ফেলে যাবো শুনি? তুমি সামলাবে?
আমি? আমি সামলাতে বসবো তোমার ওই গুণধারী মেয়েকে? আমায় তো ভূতে পায় নি?
আমার মেয়ে! একা আমার মেয়ে! সামলাতে ভূতে পায় তোমায়? বলতে লজ্জা করল না? উগ্ৰমূর্তি সুবৰ্ণলতা উঠে বসে, আর যদি এ ধরনের কথা বল, মান-মর্যাদা রাখবো না বলে দিচ্ছি!
প্ৰবোধ এ মূর্তিকে ভয় পায়।
তত্ৰাচ ভয় পাওয়াটা প্ৰকাশ করে না। বলে, ওঃ, মান-মৰ্যাদা রেখে তো উল্টে যোচ্ছ! এখন যাও নিজের মান রাখো তো, পালাটা সেরে দিয়ে এসো!
আমার মান এমন ঠনকো নয় যে তাও বজায় রাখতে পিশাচী হতে হবে!
মেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে সুবৰ্ণ।
ভঙ্গীতে অবহেলা অবজ্ঞা।
প্ৰবোধচন্দ্রের গায়ের রক্ত ফুটে ওঠে, তীব্ৰস্বরে বলে, শুলে যে? ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? রোজ রোজ তোমার ভাগের কাজই বা অন্যে করে দেবে কেন শুনি? যাও উঠে যাও। একটু কাঁদলে মেয়ে মরে যাবে না।
সুবৰ্ণলতা তথাপি ওঠে না।
শুয়ে শুয়েই বলে, একটা রাতে না খেলেও কেউ মরে যাবে না।
না থেয়ে!
এ কি সাংঘাতিক শব্দ!
তার মানে উঠবে না! শক্ত পাথর মেয়েমানুষ!
অতএব অন্য সুর ধরতে হয় প্রবোধকে। নরম সুর।
পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে, গায়ে পেতে নেবেই বা কেন? এতে তোমার লজ্জা হয় না?
সুবৰ্ণ আবার উঠে বসে।
উঠে দৃঢ়কণ্ঠে বলে, না হয় না! আমার লজ্জা-সরমের জ্ঞানটা তোমাদের সঙ্গে মেলে না। আমার কাছে তার চাইতে অনেক বেশি লজ্জার, নিন্দুকের মুখের দুটো কথা শোনার ভয়ে রুগ্ন সন্তানের দুর্দশা করা! যারা আমন করে তা মা নয়, শয়তান, মা নয়, পিশাচী।
তারা শয়তান? তারা পিশাচী!
নিশ্চয়! শয়তান, স্বার্থপর, মহাপাতকী!
তোমার সবই সৃষ্টিছাড়া!
হ্যাঁ, আমার সবই সৃষ্টিছাড়া। কী করবে? ফাঁসি দেবে?
আমি বলছি তুমি যাও, মেয়ে আমি দেখছি—
ন!
না, সুবৰ্ণ সেদিন রাঁধতে নামে নি।
উমাশশীই বেধেছিল শেষ পর্যন্ত।
আর আশ্চৰ্য, বাড়িসুদ্ধ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে নেমে এসে অম্লান বদনে সেই ভাত খেয়ে গিয়েছিল সুবর্ণ! ডাকতে পর্যন্ত হয় নি, হঠাৎ এক সময় রান্নাঘরে এসে জল-কাদার উপর মাটিতেই ধপাস করে বসে পড়ে বলেছে, এইবেলা আমায় চারটি দিয়ে দাও তো দিদি। অনেক কষ্টে ঘুম পাডিয়েছি।
এত বড় বেহায়া মেয়েমানুষ, তবু মুক্তকেশী। আশা করেছিলেন, আজ হয়তো সকালবেলার রান্নার ভারটা মেজগিনী নেবে। কিন্তু সে আশা ফলবতী হল না।
সকালবেলায় দেখা গেল মেয়েটার গায়ে হাম বেরিয়েছে।
কান্নার হদিস পাওয়া গেল।
এবং রান্নার ভরসাও গেল।
একদিন আধাদিন নয়। এখন অনেক দিন।.
বলবার কিছু নেই। এ রোগ। কারো হাতধারা নয়!
কিছু নেই।
তবু বলাবলি হয়। সকলের মধ্যেই হয়।
কিন্তু সেই বলার মুখে এক প্রকাণ্ড পাথর পড়লো। বেলা বারোটা নাগাদ জণ্ড এসে হাজির হলো, একটা আধাবয়সী বিধবা বামনী সঙ্গে নিয়ে।
কই গো পিসি, এই নাও তোমার রাধুনী। কি করতে-টারতে হবে দেখিয়ে শুনিয়ে দাও। মা বলেছে কাজকর্ম ভাল হবে।
মুক্তকেশী অবাক গলায় বলেন, রাধুনী আনতে হুকুম করলো কে তোকে?
জগু মেয়েলী ভঙ্গীতে বলে ওঠে, শোন কথা! তোমার নিজের ব্যাটাই তো বলে এলো গো! মেজ পুত্তুর! বললো, মেজবৌমার খুকীর হাম বেরিয়েছে, ওদিকে বড়বৌমার খেটে খেটে জানি নিকলোচ্ছে, সংসারের অচল অবস্থা, রান্নাবান্নার জন্যে একটি বামুনের মেয়ে চাই। তোমার দেখি সাত কাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা কার পিতা!
মুক্তকেশী একবার জ্বলন্ত দৃষ্টিতে মেজবৌয়ের ঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, বুঝেছি! কামরূপ কামিখ্যের ভেড়াটা ছাড়া এ কাজ আর কার হবে! তবে এখনো মারি নি জগা, আমার জীবদ্দশায় রাধুনী ঢুকতে দেব না বাড়িতে!
জগা বীরদৰ্পে বলে, দেবে না? বললেই হল? তুমি ওদের আঁশ-হাঁড়ি নাড়বে?
আমি? আমার মরণ নেই?
তবে?
যারা করবার তারাই করবে! লোকের দরকার নেই জগা! মিথ্যে বামুনের মেয়েকে আশা দিয়ে নিয়ে এসে নিরাশা করা!
জগু যে জগু, সেও এ পরিস্থিতিতে থাতমত খায়।
অনুরোধ মাত্র লোক জুটিয়ে আনার মহিমায় উৎফুল্ল হচ্ছিল, কিন্তু এ কী?
বোকার মত বলে, তাহলে বলছো দরকার নেই?
মুক্তকেশী সেই কথাই বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বলা হয় না। সহসা সেই ভরদুপুরে শুকনো আকাশ থেকে বজ্রাপাত হয়।
সেই বজ্রে ধ্বংস হয়ে যায় সভ্যতা, ভব্যতা, সামাজিক নিয়মনীতি।
আর ধ্বংস হয়ে যায় মুক্তকেশীর পদমর্যাদার মহিমা।
হঠাৎ দরজার ওদিক থেকে সুবর্ণর পরিষ্কার গলার দ্বিধাহীন ভাষা উচ্চারিত হয়, আছে দরকার! মা, ভাসুর ঠাকুরকে বলে দিন যে রেখে যান ওঁকে!
মুক্তকেশী স্তম্ভিত বিস্ময়ে বলেন, আছে দরকার! রেখে যাবে! আমি মানা করছি, তার ওপর তুমি এলে হুকুম চালাতে!
স্তম্ভিত বিস্ময়ে বলেন, আছে দরকার! রেখে যাবে! আমি মানা করছি, তার ওপর তুমি এলে হুকুম চালাতে!
হুকুম চালাচালির কথা নয় মা! অবুঝের মতন রাগ করলে তো চলবে না। দিদি একা আর কত দিক দেখবেন? বামুনের মেয়ের কথা আমিই বলে পাঠিয়েছি।… বামুনদি, তুমি এসো তো এদিকে-
জীত রহো। চেঁচিয়ে ওঠে মুখ্যু জগু, এই তো চাই! আমার পিসিটির এই রকম শিক্ষারই দরকার ছিল।
মুক্তকেশীর সংসারে যুগ-প্ৰলয় ঘটে।
মুক্তকেশীর কলমের উপর নতুন কলম চলে।… মুক্তকেশীর সংসারে মাইনে করা রাঁধুনী ঢোকে! এ যেন অনিবাৰ্য অমোঘের একটা চিহ্ন!
তা বোধ করি এই প্রথম বিন্দু আর আর গিরিবালা সুবৰ্ণলতার তেজ আসপর্দার সমালোচনা না করে তার উপর প্রসন্ন হয়।
বাঁচা গেল বাবা!
শুধু উমাশশীরই মনে হয় সে যেন সর্বহারা হয়ে গেছে!
দুগ্ধ থেকে ছাত হলে কিসের দামে বিকাবে উমাশশী। মূলহাৱা এই দিনগুলোকে নিয়ে করবে কি?
যখন তখন চোখে জল আসে তার।
আর বামুনব্দির পায়ে পায়ে ঘোরে তার সাহায্যার্থে।
তবু তো বোঝা যাবে, কিছুটা প্রয়োজন আছে উমাশশীর!
সুবৰ্ণলতার মত সে নিজের উপস্থিতির জোরেই নিজেকে মূল্যবান ভাবতে পারে না।