অন্য ভুবন
অন্য ভুবন।
সুবৰ্ণলতার কাছে এ এক আশ্চর্য নতুন ভুবন! অন্য ভুবন! এ ভুবনে শুধু আকাশেই উদার উন্মুক্ত আলো নেই, মানুষগুলোর মধ্যেও রয়েছে সেই আলো, উদার, উন্মুক্ত, উজ্জ্বল!
পাড়ার লোকের কথা জানে না। সুবৰ্ণলতা, জানে না সেখানে আলো না অন্ধকার, সে শুধু এই সংসারটাকেই জানছে। দেখছে আর জানছে।
ভেবে অবাক হয় সুবৰ্ণ, সুবালাকে বরাবর সবাই গরীব বলে এসেছে। এই সেদিনও ভাসুর গিয়ে বললেন, গরীবের সংসার বটে, তবে অমূল্যাটা পরিশ্রমী আছে তো? খেটেঁপিটে সংসার করে। গোয়ালে গরু, পুকুরে মাছ, বাগানে ফল-তরকারী, গায়ে-গন্তরে খেটে সব বজায় রেখেছে। তাতেই চলে যায় একরকম করে।
চলে যায় একরকম করে!
গরীব!
কিন্তু সুবালা যদি গরীব, তো ঐশ্বর্যবতী কে? হোক আড়ম্বরহীন টানাটানির সংসার, তবু এই সংসারখানির সম্রাজ্ঞী। তো ওই সুবালা। এ সংসার পরিচালিত হচ্ছে সুবালার ইচ্ছানুসারে, সুবালার নির্দেশে। শাশুড়ী নির্লিপ্ত কিন্তু নির্মায়িক নয়। যথাসাধ্য খাটেন। তিনি, কিন্তু সে খাটুনির বেশির ভাগ ছেলে-বৌ নাতি-নাতনীদের যত্ব পরিচর্যা বাবদ।
সুবালা যদি বলে, খাক গে বাবা ঠাণ্ডা দুধ—, ফুলেশ্বরী ব্যস্ত হয়ে বলেন, ওমা কেন? জ্বালানির ঘরে অত নারকেল পাতা, আমি একটা বুড়ী বসে রয়েছি ঠাণ্ডা খাবে কেন? ঠাণ্ডা খেলে শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হয় বৌমা।
সুবালা দিব্যি উত্তর দেয়, শ্লেষ্মা বৃদ্ধি হয় না হাতী বৃদ্ধি হয়! ও কেবল আপনার নাতিনাতনীদের সোহাগ করা।
ফুলেশ্বরী রেগে উঠে যাচ্ছেতাই করেন না, হেসে উঠে বলেন, তো তাই! তোমার নাতিপুতিকেও তুমি করবে সোহাগ!
আমার বয়ে গেছে—
হুঁ, দেখবো!
সুবালা স্বচ্ছন্দ গলায় বলে, দেখবেন তো সেই স্বর্গে বসে! কী দেখলেন তা নিয়ে কে তর্ক করতে যাবে?
রাগারগি নয়, কড়া কথা নয়, সহজ হাস্য-পরিহাস। আশ্চর্য! সুবালার কী সাহস! সুবৰ্ণলতা তো দুঃসাহসের জন্য বিখ্যাত, কিন্তু এ সাহসের সঙ্গে তুলনা হয়? সুবৰ্ণলতার সাহস হচ্ছে-তিক্ততার শেষ সীমানায় পৌঁছে তীব্ৰতায় ফেটে পড়া।
আর সুবালার?
সুবালার সাহস আদরিণীর সাহস, বিজয়িনীর সাহস, প্রশ্রয়ের সাহস।
সুবালার শাশুড়ী সুবালার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন, কারণ তার বৌমা বোঝে বেশি, জানে বেশি, বৌমার বিবেচনা ভালো।
এ কথা স্বীকার করা মানেই তো তাকে অর্ঘ্য দেওয়া।
সুবালার সংসার সুবালাকে সে অর্ঘ্য দিয়েছে। কারণ শুধু ফুলেশ্বরীই নয়, ফুলেশ্বরীর ছেলেও সেই সমৰ্পিত-প্ৰাণ! ফুলেশ্বরীর ছেলে খাটো ধুতি পরে, খালি পায়ে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়, কাঁধে করে ধামা বয়ে আনে, আর কথায় কথায় বলে, অত সব বুঝি না বাপু, মুখ্যু চাষা বৈ তো নাই।
তবু সে শহুরে চাষার মত ভাবে না, মেয়েমানুষকে শাসনে না রাখলেই সে মাথায় ওঠে! মেয়েমানুষের জায়গা হচ্ছে জুতোর নিচেয়! ভাবে না, তাই সে প্রতি পদে বলে, মহারাণীর যা ইচ্ছে… তুমি যা বলবে,… যা বোঝো করো।
পূজার মন্ত্রের চাইতে কি কিছু কম এটা?
কিন্তু সুবৰ্ণলতা তার এতখানি বয়সে যা দেখেছে তা হচ্ছে এই— তোমার বুদ্ধি আছে স্বীকার করবো। এ কথা? হুঁ! গায়ের জোরে প্রতিপন্ন করে ছাড়বো না তুমি নির্বোধ, তুমি মুখ্যু? … তোমার বিবেচনা আছে, মানবো এ কথা? বরং ভুল পথে গিয়ে লোকসান খাবো, তবু তোমার কথা শুনবো না।… তোমার ইচ্ছানুসারে চলবো? গলায় দিতে দড়ি নেই। আমার? তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণই ব্ৰত হোক…ভারী তুমি আত্মসম্মানী, তোমায় পেড়ে ফেলে তবে কাজ আমার!
কারণ?
কারণ তুমি মেয়েমানুষ!
তুমি বৌ মানুষ!
তোমার যে এ হেন বাড়িতে বিয়ে হয়েছে, এই তোমার ভাগ্য!
এই দেখেছে সুবৰ্ণলতা।
কারণ জীবনে একটা বৈ দুটো সংসার দেখে নি সে।
পিতৃগৃহের ছবি তার কাছে অস্পষ্ট। তাছাড়া তার মা ভিন্ন আর কোনো মেয়েমানুষ ছিল না সে বাড়িতে, তার বাবা ভিন্ন আর কোনো পুরুষ। সে সংসারে অন্যকে টেক্কা দিয়ে পৌরুষ দেখানোর চেষ্টা ছিল না, চেষ্টা ছিল না। অন্যকে খেলো করবার জন্যে বাহাদুরি দেখানোর।
সুবৰ্ণলতাদের সংসারে ভাইয়ে ভাইয়ে চলে সেই বাহাদুরির প্রতিযোগিতা।
সেই প্রতিযোগিতার বলি মেয়েমানুষেরা।
যথেচ্ছ অবজ্ঞা করো তাদের, পৌরুষের প্রশংসাপত্ৰ পাবে। নিষ্ঠুর হতে পারলে আরো ভালো, অত্যাচারী হতে পারলে কথাই নেই। ভাইরা বুকুক আমি পুরুষ, আমি স্ত্রী-বশ নই।
মা-বাবার সংসারে এটা ছিল না।
তবু–
মায়ের সেই একলার সংসারেই বালিকা সুবৰ্ণলতার চোখেও ধরা পড়তো, তার মায়ের মধ্যে কোথায় যেন একটা তীব্ৰ জ্বালা, মানে বুঝতে পারত না। হয়তো এখনো সঠিক বোঝে না। মাঝে মাঝেই ভাবে, কেন বাবা অত ভালমানুষ—
আবার ভাবে, হয়তো শুধুই ভালমানুষ। কিন্তু তাকে দিয়ে কি একটা মানুষের হৃদয় ভরাট হয়?
সুবৰ্ণলতার স্বামীও তো এক এক সময় বশ্যতা স্বীকার করে, সুবৰ্ণলতা যদি তার মনের মত হতে পারতো, যদি সুবৰ্ণলতা কৃপণ হত, যদি সংকীর্ণচিত্ত হত, যদি স্বার্থপর হত, যদি স্বামীর কাছে মধুময়ী এবং অন্যের সম্পর্কে মুখরা হত, হয়তো সে বশ্যতা স্থায়ী হত।
যাকে আর পাঁচজন আখ্যা দিত স্ত্ৰৈণ!
কিন্তু অমূল্য কি স্ত্ৰৈণ!
না।
স্ত্রীর প্রতি অমূল্যর যে মনোভাব, তাকে বলা যায় সম্ভ্রম ভাব।
এ কথাটা শুনলে দর্জিপাড়ার গলি হয়তো হাসিতে ফেটে পড়বে! বলবে, আহা তাই তো, জগতে ভক্তি-সম্ভ্রমের যুগ্য আর কে আছে? গুরু-গোসাঁই তুচ্ছ করে পাদ্য-অর্ঘ্য দাও গিন্নীকে।
বলবে, নিশ্চিত এই কথাই বলবে।
কারণ দর্জিপাড়ার সেই গলি সন্ধু কথাটার অর্থ জানে না। কারণ নিজেকে কোনোদিন সম্ভ্রম করে নি সে।
এ সংসার সম্ভ্রম শব্দটার অর্থ জানে।
এ সংসারে কোথাও কোনো জ্বালা নেই।
যদিও সুবালা প্রতি পদে বলে, কী জ্বালা!
বলে। ওটাই ওর মুদ্রাদোষ। সবাইকে বলে। সুবৰ্ণকে বলে, কী জ্বালা, মাত্তর ওই কটা মুড়ি খাবে তুমি? ওই আধ-ছটাকী বাটিতে?
ভাইপো-ভাইঝিকে বলে, কী জ্বালা, চাষাভুষোর মত রোদে বেড়াতে শিখলি যে!
শাশুড়ীকে বলে, কী জ্বালা, আবার আপনি এখন কাঁথা পেড়ে বসলেন? খাওয়া-দাওয়া হবে না?
বরকে বলে, কী জ্বালা! তোমার জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরলাম যে! এই ভরসন্ধ্যোয় আবার বেরোচ্ছে তুমি?
অমূল্যর বেরোনো অবশ্য বন্ধ হয় না। তাতে, হাসতে হাসতে বলে যায়, তা আমার জ্বালায় জুলবে না তো কি পাড়ার গয়লা বুড়োর জ্বালায় জুলবে? একজন আমার জ্বালায় আজন্ম জুলবে বলেই তো বিয়ে করে ঘরে পরিবার আনা।
সুবালা হাড় বার করা মুখে হেসে ওঠে।
এই ভয়ঙ্কর সত্যটা নিয়ে কৌতুক ওর। এইভাবে ওদের জ্বালায় গল্প।
সুবৰ্ণ কি তবে ঈর্ষায় জ্বলবো?
না না, সুবর্ণ এত নীচ নয়। সুবর্ণ এদের সুখ দেখে সুখী। তবু বুকের মধ্যে কোথায় যেন চিনচিন করে ওঠে।
আবার আহ্লাদও হয়। সুবালা যখন তার বাউণ্ডুলে দ্যাওরটাকে বলে ওঠে, কী জ্বালা, এই এতখানি বেলায় এলে তুমি? ভাত যে পান্তো হয়ে উঠলো!
আর অম্বিকাও ওর সুরাটা নকল করে বলে ওঠে, কী জ্বালা! ভাত পান্তো হয়ে উঠলো বলে দুঃখ? ঘরে ভাত থাকলে তবে তো সে পান্তো হবার অবকাশ পাবে?
তখন ভারী একটা আহ্লাদে মনটা খুশি-খুশি হয়ে ওঠে সুবর্ণর।
অথচ এতেও ঈর্ষার কারণ ছিল।
দ্যাওর-ভাজের মধ্যে যে অনাবিল প্ৰীতির সম্বন্ধ, সেটাই বা কবে দেখলো সুবৰ্ণ? দেবীররা ভ্ৰাতৃজায়াদের ব্যাখ্যানা করবে, এটাই তো মুক্তকেশীর বাড়ির নীতি। তারা ব্যঙ্গ করবে, হুল ফোঁটাবে, নিন্দে করবে, এই তো নিয়ম। কে জানে এ নিয়ম শুধুই মুক্তকেশীর বাড়ির, না। আরো অনেক অনেক বাড়ির!
কিন্তু এদের বাড়িতে—?
হ্যাঁ, সুবালার বাড়িতে অন্য নিয়ম।
আই না। অন্য ভুবন!
এই অন্য ভুবনে অম্বিকা তার বৌদির কথায় বলে ওঠে, নাও কোথায় তোমার পান্তো-টান্তো আছে বার করো দেখি, পেটকে শান্ত করি। খাণ্ডবদাহন হচ্ছে সেখানে।
বসে পড়ে নিজেই পিঁড়ি পেতে।
সুবালা পরম যত্নে ভাত বেড়ে দিয়ে বলে, ভারী তো ছিরির রান্না, ভাতটা গরম থাকতে খেলে তবু-
অথচ এ ছাড়া আর কিছু ব্যবস্থা হয়ও না।
ঝি-চাকরের তো পাট নেই, সুবালাকেই বাসন মাজতে হয়, রান্নাঘর নিকোতে হয়, এতক্ষণ অবধি আলাদা গরম ভাতের তদ্বির নিয়ে থাকলে সময়ে কুলোয় না।
অম্বিকা বলে, ছিরির মানে?… আচ্ছা মেজবৌদি, আপনার কি আপনার ননদের রান্না বিচ্ছিরি লাগে?
সুবৰ্ণর হঠাৎ খুব ভালো কোনো কথা যোগায় না, তাই তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, কী যে বলেন! আমার তো অমৃত মনে হয়।
হুঁ, দেখুন! আমিও তো তাই বলি, অমৃততুল্য। আহা, যখন জেলের লিপসি খেয়ে দিন কাটবে, তখন আপনার ননদিনীর হাতের এই মৌরল মাছের ঝালের স্মৃতিতে মনটা কেঁদে কেঁদে উঠবে।
থামো তো! সুবালা বকে ওঠে, সব সময় জেল জেল করো না।
আহা, সইয়ে রাখছি। নচেৎ আচমকা ঘায়ে মুর্ছা-টুর্ছা যাবেন।
সুবালা বোঝে সব, তবু বলে, বলি তুমি কি চোর-ডাকাত, না খুনে গুণ্ডা যে জেলে যাবে?
তার থেকে কিছু কমও নয়।
অম্বিকা কড়াই ডাল মাখা ভাতটা শাপ শপ করে মুখে তুলতে তুলতে বলে, বরং বেশি মাতৃভূমিকে মা বলা তো গুণ্ডামির অধিক!
সুবালা বলে, এই হল শুরু। মেজবৌ, তুই শোন বসে বসে। তোর মনের মতন প্রসঙ্গ। আমি বরং ততক্ষণ ওই রাবণের গুষ্টির জলপানিগুলো গোছাই।
সুবৰ্ণ আহত গলায় বলে, ওকি মেজ ঠাকুরবি, নিজের ছেলেদের ওই সব বলতে আছে?
সুবালা হেসে হেসে বলে, সত্যি কথা বলতে দোষ কি? রাবণের গুষ্টি ছাড়া আর কি? ভগবান এক মনে দিয়েছে, আমি একমনে নিয়েছি, গোনাগুণতি করি নি। জ্ঞানচক্ষু হতে দেখি আধ কুড়ির কাছাকাছি!
উঠে চলে যায়।
সত্যিই কাজের তার অবধি নেই।
তাছাড়া সুবর্ণ বসে থাকে বলে স্বস্তি থাকে একটু। বেটা ছেলে একা বসে খাচ্ছে, এটা তো আর হতে পারে না।
সুবালা চলে যায়, অম্বিকা সুবৰ্ণর দিকে তাকিয়ে বলে, এই একটি মহিলা, একেবারে নিৰ্ভেজাল!
সুবৰ্ণ বলে, আপনার মত মানুষের ধারে কাছে থাকতে থাকতে আপনিই বিশুদ্ধ হয়ে যায় মানুষ।
হ্যাঁ, প্ৰবোধের সন্দেহকে করে। এইভাবেই একটা অপর পুরুষে বিমোহিত হচ্ছে সুবর্ণ।
রোদে পোড়া রুক্ষ কালো শীর্ণ একটা ছেলে, তবু তাকে দেখলে সুবর্ণর মনটা আহ্লাদে ভরে ওঠে। তাকে অনেক উঁচু স্তরের মানুষ মনে হয়। মনে হয় কী সুন্দর!
প্ৰশস্তি গাইতে ইচ্ছে করে তার।
অম্বিকা বলে, সেরেছে! পুলিসে ধরে নিয়ে যাবে আপনাকে।
একদিন হঠাৎ বলে বসলো, আচ্ছা, শুনেছি তো আপনার ন বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, আরমনে করবেন না কিছু দাদার শ্বশুর বাড়িটিই যখন আপনার শ্বশুরবাড়ি, তখন সেখানেই স্থিতি, তবে এত সুন্দুকুর কথা লুড়ে খেলুড়ো করে বলুন তো?
সুবৰ্ণ বিমূঢ়ভাবে বলে, সুন্দর করে?
হ্যাঁ, তাই তো দেখি। যা কিছুই বলেন, বেশ বিদুষী-বিদুষী লাগে।
সুবৰ্ণ হেসে উঠে বলে, ওঃ লাগে! যেমন পেতলকেও অনেক সময় সোনা-সোনা লাগে।
অম্বিকা বলে, আপনার মত পেতল যদি আমাদের এই সোনার বাংলার ঘরে ঘরে থাকতো, দেশ উদ্ধার হয়ে যেত, বুঝলেন উদ্ধার হয়ে যেত!
দেশ উদ্ধার!
ব্যস, এই খাতে এসে পড়ে আবেগের বন্যা।
সুবৰ্ণর চোখে এসে যায়। জল, মুখে ফুটে ওঠে। দীপ্তি।
সুবৰ্ণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে বসে স্বদেশী ছেলেদের কথা। কী তাদের কার্যকলাপ, কী তাদের পদ্ধতি, কী বা তাদের সাফল্য!
অম্বিকা হাসে।
গলা নামিয়ে বলে, এই মেজবৌদি, টিকটিকি পুলিসের মত অত জেরা করবেন না, সব কথার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। দেওয়ালের কান আছে।
সুবৰ্ণ লজ্জিত হয়।
বলে, বড্ড ইচ্ছে করে সব জানি।
তার মানে আপনি অনুভব করেন জিনিসটা। অম্বিকা বলে, বুঝতে পারেন। পরাধীনতার গ্লানি কি! সেটাই আশ্চর্য করে আমাকে।
সুবৰ্ণ উদ্দীপ্ত হয়, বলে, আশ্চর্যের কি আছে? পিরাধীনতার যন্ত্রণা আমরা মেয়েমানুষরা বুঝবো না তো আর কে বুঝবে? আমরা যে চাকরেরও চাকরানী।
রাণী হতে হবে। অম্বিকা জোর দিয়ে বলে, মেয়েদেরও এসে হাত মেলাতে হবে!
নেবেন? নেবেন আপনারা? সুবৰ্ণ আরো উদ্দীপ্ত হয়, মেয়েমানুষকে নিতে রাজী আছেন আপনাদের দলে?
দলে!
অম্বিকা ধীর গলায় বলে, বলে কয়ে টিকিট কেটে দলে নেওয়া তো নয়। মেজবৌদি, যে আসতে পারবে সে এসেই যাবে। বৃষ্টি যখন পড়ে, হাজার হাজার গাছের একটা পাতাও শুকনো থাকে না, কিন্তু পাতা ধরে ধরে ভেজাতে গেলে?… দেশ জাগবে, মেয়েদের মধ্যে আসবে সেই প্ৰবল প্রেরণা, আপনিই দলে এসে পড়বে। করছে বৈকি, অনেক মেয়েই দেশের কাজ করছে—কিন্তু থাক। এ আলোচনা।
সুবৰ্ণ হতাশ গলায় বলে, আলোচনাটুকুও যদি করতে নেই তো কি করে এগিয়ে যাবে মেয়েরা? আমি যদি আজ বলি সে প্রেরণা আছে আমার-
অম্বিকা আরো আস্তে বলে, বুঝতে পারছি। অনুভব করছি আছে, কিন্তু আপনার পক্ষে অসম্ভব। আপনার ছেলেমেয়ে রয়েছে-
সুবৰ্ণ হতাশ গলায় বলে, জানি, জানতাম! আমার যে সব দিক থেকে হাত-পা বাধা তা জানি!
অম্বিকা ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকায়।
তারপর সহসাই হেসে উঠে বলে, আপনাকে দলে নিই, আর আমাদের মেজদা পুলিস লেলিয়ে দিয়ে আমাদের জন্যে ফাঁসির ব্যবস্থা করুন। ওনাকে তো দেখেই ভয় করছিল।
সুবৰ্ণ ব্যঙ্গ হাসি হাসে।
বলে, কেন? খুব তো সুকান্তি সুপুরুষ!
সে কথা কোনো কাজের কথা নয়, অম্বিকা বলে, বাইরে ভেতরে এক, এ আর কজনের হয়? আমাদের সঙ্গে একটা ছেলে আছে, তাকে দেখলে মনে হবে দাঁড়কাক, কিন্তু তার ভিতরটা চাঁদের মত সাদা সুন্দর!
সুবৰ্ণ খপ করে বলে বসে, আচ্ছা, আমাকে দেখলে আপনার কী মনে হয়? বাইরে ভিতরে দুরকম?
অম্বিকা মাথা নিচু করে বলে, আপনার মত মেয়ে আমি আর দেখি নি মেজবৌদি। শুধু এই ভেবে দুঃখ হয়, আমাদের দেশের কত সম্পদের অপচয় হচ্ছে সর্বদা। আপনি যদি দেশের কাজে আসতে পারতেন–
সুবৰ্ণ অভিমানে ফেটে পড়া মুখে বলে, ওসব আপনার মৌখিক কথা। এক কথায় তো নাকচ করে দিলাম। যার ছেলেমেয়ে ঘরসংসার আছে, সে একেবারে পতিত হয়ে গেছে, এই তো কথা!
এভাবে সাড়া দিতে হলে যে সর্বস্ব পণ করতে হয়। মেজবৌদি, সর্বস্ব ত্যাগ করতে হয়।
তুমি কি ভাবো-
আবেগের মাথায় হঠাৎ তুমি বলে সুবৰ্ণ, তুমি কি ভাবো মেয়েরা পারে না তা? আমি এই বলে রাখছি, এই মেয়েদের কাছেই একদিন মাথা হেট করতে হবে তোমাদের।… বলতে হবে, এতদিন যা করেছি। অন্যায় করেছি। সত্যিই তোমরা শক্তিরূপিণী।
অম্বিকা এবার মাথা তুলে বলে, আপনার কথা বেদবাক্য হোক। দেশ যেদিন একথা বলতে পারবে, সেদিন দেশ এই অপমানের কুণ্ডু থেকে ঝেড়ে উঠবে।… সত্যি ভাবুন, কী অপমান, কী অপমান! সমুদ্রের ওপার থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এক মুঠো লোক এসে এই এত কোটি লোকের উপর প্রভুত্ব করছে, তাই দেখছি বসে বসে আমরা আর নিঃশ্বাস ফেলছি। একসঙ্গে সবাই যদি রুখে উঠতে পারতো! মেয়ে বলে নয়, ছেলে বলে নয়, দেশের সন্তান বলে—
সুবৰ্ণ আরো ব্যগ্রভাবে কী বলতে যাচ্ছিল, অমূল্য এসে হাজির হয়। বলে, এই হয়েছে তো! জুটেছেন দুটি পাগলে!
সুবৰ্ণর তো এখানে এসে খুব বাড় বেড়েছে। অমূল্যর সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলে সে।
বলে, পৃথিবীতে যা কিছু মহৎ কাজ, তা এই পাগলেরাই করে। যা কিছু বড় ঘটনা ঘটেছে, তার মূল মানুষই হচ্ছে পাগল, বুঝলেন?
অম্বিকা সপ্ৰশংস দৃষ্টিতে তাকায়!
অমূল্য হেসে উঠে বলে, বুঝলাম!… কিন্তু অম্বু, তুই যেন আবার তোর ওই মহৎ কাজের মধ্যে এই পাগলটিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করিস নি, তাহলে আমার সেই গুণ্ড শালা এসে তোর মাথা ফাটাবে!
অম্বিকা বোঝে, দাদা তাকে সাবধান করছে। অম্বিকা জানে দাদার তাকে নিয়ে স্বস্তি নেই। তাই মৃদু হেসে বলে, সেই কথাই তো বোঝাচ্ছিলাম মেজবোঁদিকে। তবে দেশের কাজ তো মাত্র একটাই নয়! বাইরে থেকে যেমন এই দুশো বছরের পাপ ধ্বংস করতে হবে, ভেতর থেকে তেমনি আরো অনেক বছরের পাপ ধুয়ে সাফ করতে হবে।…মেয়েদের মধ্যে চেতনা জাগানোও একটা মস্ত কাজ মেজবৌদি। সে চেতনা জাগানো, তাদের বোঝানো কোনটা সম্মান কোনটা অসম্মান। বোঝানো শুধু খেয়ে পরে সুখে থাকাই মানুষের ধর্ম নয়। বোঝানো কেউ খেয়ে উপচে বসে থাকবে। আর কেউ না খেয়ে মরবে, এটা ভগবানের নিয়ম নয়। এই পৃথিবীর অন্ন সবাই সমান ভাগ-বীটোয়ারা করে খাবে, সবাই পৃথিবীর সন্তান।
অমূল্য প্রশংসার গলায় বলে, বললি তো ভালো, শুনলাম ভালো, কিন্তু শুনছে কে?
সুবৰ্ণও বলে, হ্যাঁ, সেই কথাই বলছি, শুনবে কে? পাথরে কি সাড় আসে?
আনতে হবে। অম্বিকা বলে, অসাড় পাথরে প্রাণসঞ্চার করতে হবে। মাটি-পাথরের বিগ্রহে যেমন প্ৰাণ-প্ৰতিষ্ঠা!
সুবৰ্ণ আস্তে মাথা নাড়ে।
বলে, চন্দ্র-সূর্যের মুখ দেখলে রসাতল, পর্দার মধ্যে জীবন, তারা আবার কাজ করবে! শিক্ষা নেই দীক্ষা নেই–
ঠিক! অম্বিকা বলে, এই জন্যেই আপনাকে আমার এত ভাল লাগে। আপনি সব বুঝতে পারেন। এই দেখুন, গলদের ঠিক মূলটি বুঝেছেন। আপনি। শিক্ষা, সকলের আগে চাই শিক্ষা। এই হতভাগা দেশের সব আছে, নেই খালি চোখের দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি এনে দিতে হবে। আমার কোনো সুবিধে নেই, আমার হবে কি করে বললে চলবে না। মাটি কাটতে হয়, পাথর ভাঙতে হয়, তবে তো রাস্তা তৈরি হয়, তবে তো সেই রাস্তা দিয়ে জয়রথ চলে।
ঠাকুরপো! সুবৰ্ণলতা ব্যাকুল গলায় বলে, জানো, একথা আমার মার কথা!
আপনার মারে কথা?
অম্বিকা একটু আশ্চর্য হয়ে তাকায়।
সুবৰ্ণ তেমনিভাবে বলে, হ্যাঁ। মার স্মৃতি আমার কাছে ক্রমশই ঝাঁপসা হয়ে আসছে, তবু এ কথাটা মনে আছে। মা বলতেন এ কথা। আমি জন্মাবার আগে মা মেয়েদের পাঠশালায় পড়াতে যেতেন।
পড়াতে যেতেন! আপনার মা! অম্বিকা অবাক গলায় বলে, তাজ্জব তো! সে তো আরো আগের ব্যাপার। সমাজ আরো কড়া ছিল। তবু নিশ্চয়ই তিনি আরো শক্তিমতী ছিলেন! কতদিন হল মারা গেছেন?
সুবৰ্ণ শিউরে ওঠে।
সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি বলে, মারা যান নি। আছেন, কাশীতে থাকেন।—আমার মায়ের কথা বলবো আপনাকে। আপনিই পারবেন বুঝতে।
অম্বিকা ধীরে বলে, বুঝেছি, এই মন আপনি কোথায় পেলেন ভেবে অবাক হতাম, এখন বুঝতে
অমূল্য বুদ্ধিমান।
অমূল্য সমাজ-সংসারের জীব।
অমূল্য তার এই স্বদেশী ভাইটার জন্যে সর্বদাই চিন্তিত। তাই দুজনের এই বিমুগ্ধ ভাবটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে। সন্দেহ নেই এই মুগ্ধতা অতি পবিত্ৰ, অতি নিৰ্মল, তথাপি এ থেকেও বিপদ আসতে পারে। আসা অসম্ভব নয়। সুবৰ্ণ স্বদেশী করে ক্ষেপে উঠলেই তো সর্বনাশ। সুবর্ণ তার বাড়ির অতিথি।
সুবৰ্ণ সম্পর্কে তাকে বেশি অবহিত হতে হবে।
তাই অমূল্য বলে ওঠে, হ্যাঁ, মেজবৌদির মা অন্য ধরনের ছিলেন। আমিও জানি কিছু কিছু, বলবো পরে। মা ভাল না হলে কি আর ছা ভাল হয়? কিন্তু বসে বসে গল্প করছিস, আজ তোর কোজ নেই?
নাঃ, আজ বেরুব না। আজ শরীরটা একটু ইয়ে আছে।
অমূল্য আর একটু বাঁধ দেয়।
অন্তত ভাবে, বাঁধ দিচ্ছি।
বলে, তবে আর কি, কোটরে বসে পদ্য লিখা গে।
কিন্তু ফল বিপরীত হয়।
এই উল্টো বাঁধে উপচে ওঠে নদীস্রোত। পদ্য? কবিতা লেখেন, আপনি? চমকে ওঠে সুবর্ণ।
আপনি নয়, আপনি নয়, একটু আগে তুমি বলেছেন-
ওমা, কখন আবার?
বলেছেন। অজ্ঞাতসারে। তবে সেটাই বহাল থাক।
আচ্ছা থাক তাই। আমি তো বড়ই। কিন্তু কথা চাপা দিচ্ছ তুমি! তুমি কবিতা বল নি তো?
অম্বিকা হেসে ওঠে, মাইকেলের থেকে সামান্য কম, তাই আর বলি নি! দাদার যেমন কাণ্ড, কবিতা লেখে!
অমূল্য বলে, আহা, কেন? লিখিস তো বাপু সেই ছেলেবেলা থেকে। বুঝলেন মেজুবৌদি, বারো-তেরো বছরের ছেলে, দেশমাতা নিয়ে ইহা বড় এক পদ্য!… তা আপনার ননদিনী তার গুরুদেব দ্যাওরটির গুণগরিমার কথা সব বলেন নি? তোলা আছে বোধ হয় সে পদ্য আপনার ননদের কাছে। দেখবেন?
আমি সব কবিতা দেখবো। ঠাকুরপো, তোমার কবিতার খাতা দেখাতে হবে।
খাতা!
অম্বিকা হেসে ওঠে।
খাতা কোথায় পাবো? ছেঁড়া কাগজের ফালি হচ্ছে আমার ভাবের বাহন। হাতের কাছে যখন যা পেলাম!
তা তাই দেখবো।
কে তুলে রেখেছে!
দেখো, তুমি আমায় ঠকাচ্ছে। বেশ তো, নতুন একটা লেখো।
এই সেরেছে। দাদা, বুঝতে পারছে? বিশ্বাস করছেন না। আমার বিদ্যে। হাতে হাতে প্ৰমাণ চান।
মোটেই না। আমি শুধু দেখতে চাই।
তবে তো লিখতেই হয়—, অম্বিকা হেসে ওঠে, দাদা আবার মাতালকে মদের বোতলের কথা মনে পড়িয়ে দিলেন!
অমূল্য বলে, তবে যা, ঘরে বসে মাতাল হগে যা। চললাম। আমি। ভীষণ কাজ।
দুজনকে বিভোর হয়ে গল্প করতে দিতে অস্বস্তি বোধ করে অমূল্য পাড়ার লোকের চোখের জন্যে। চোখগুলি তো ভাল নয়। সুবালার মত সরল আর কজন আছে?
ভাইকে এই ইঙ্গিতটা দিয়ে কাজে চলে যায় অমূল্য।
অনুমান করতে পারে না, খাল কেটে কুমীর এনে গেল।
অনুমান করতে পারল না, ইঙ্গিতের মর্ম বুঝবে না। এরা। তার পাগলী শালাজ অম্বিকার সেই কোটরে গিয়ে উঠবে কবিতা হাতড়াতে।