Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সুবর্ণলতা || Ashapurna Devi » Page 12

সুবর্ণলতা || Ashapurna Devi

ডান হাতে টুকটুকে করে মাজা তামার ঘটি

ডান হাতে টুকটুকে করে মাজা তামার ঘটি, বা কাঁধের উপর গামছায় মোড়া ভিজে কাপড়ের পুঁটলি।

পিছনে বছর ছয়েকের একটা মেয়ে।

কাশী মিত্রের ঘাটের কাছাকাছি একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন মুক্তকেশী। মেয়েটাকে উদ্দেশ করে বললেন, দোরটা ঠেল দেখি, আমি আর ছোব না।

কারো বাড়ির বাইরের কপাটে হাত দেন-না মুক্তকেশী। কারণ রাস্তার ধাঙড়দের ঝাটার ধুলো যে উড়ে যে উড়ে উড়ে এই সব কপাটে এসে পড়ে, এ কথা আর কারো ইহঁশের মধ্যে না থাকুক, মুক্তকেশীর অবশ্যই আছে।

মেয়েটা দরজাটায় সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে প্রায় হুমড়ি খেতে খেতে রয়ে যায়, দরজাটা আলগা ভেজানো ছিল মাত্র।

মুক্তকেশী ভিতরে ঢুকে এসে হাঁক পাড়েন, জগু, ও জগু, আছিস নাকি?

জগু মুক্তকেশীর ভাইপো, এবং এই পুরনো দোতলাটি মুক্তকেশীর ভাইয়ের বাড়ি। ভাই অবশ্য গত হয়েছেন অনেককাল, আছেন বিধবা ভাজ শ্যামাসুন্দরী। তা জগুর বদলে তাঁর গলাই পাওয়া গেল। ননদিনীর সাড়া পেয়ে অন্যান্য দিনের মত ছুটে এলেন না। তিনি, কোথা থেকে যেন সাড়া দিলেন, থাকবে না তো আর যাবে কোন চুলোয়? পেড়োর মন্দিরে বসে ফোঁটা-চন্নন কাটছে বোধ হয়।

গঙ্গাস্নান-ফেরত প্রায়ই একবার ভাইপোর বাড়ি ঘুরে যান মুক্তকেশী, ভাজের সাহায্য অভ্যর্থনা জোটেই, আজ এ রকম দূরাগত বংশীধ্বনির হেতু?

যেন বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে সাড়া আসছে। মুক্তকেশী অবাক হয়ে বলেন, তুমি কমনে থেকে কথা কইছো বৌ?

এই যে যমের দক্ষিণ দোর থেকে। লক্ষ্মীছাড়া হাড়হাবাতে ছেলে ছেকল তুলে রেখে দিয়ে গেছে।

ওমা সে কি কথা!

মুক্তকেশী এগিয়ে আসেন।

পিছনের মেয়েটা হঠাৎ হি হি করে হেসে ওঠে, মামী-ঠাকুমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে—

মুক্তকেশীর মুখেও একটু হাসি ফুটে ওঠে। তবে সেটা গোপন করে তাড়া দিয়ে ওঠেন, মরণ আর কি! হেসে মরছিস যে— তারপর কপাটের শিকলটা খুলে দেন ছড়াৎ করে।

রান্নাঘরের মধ্যে বসে কুটনো ফুটছিলেন শ্যামাসুন্দর, মুক্তকেশী ঢুকতেই বঁটিটা ঠেলে রেখে

মেয়েটা আর একবার হেসে ফেলে পরনের বৌপাগলা শাড়িখানার আঁচলটা মুখে চাপা দিয়ে বলে, মামী-ঠাকমা বুঝি দুষ্টুমি করেছিলে? তবে জ্যাঠামশাই শাস্তি দিয়ে গেছে?

শ্যামাসুন্দরী এ হাসির উত্তরে হাসেন না-বিরক্তি কুঞ্চিত স্বরে বলেন, দুষ্টুমি কেন, জন্ম জন্ম মহাপাতক করেছিলাম, তাই এত শাস্তি ভোগ করছি।

মুক্তকেশী মেঝোয় বসে পড়ে বলেন, হলো কি?

কী হলো তা জানে যম! আদালতে আজ নাকি মামলার দিন আছে, তাই আমার মাতৃভক্ত সন্তান মায়ের পাদোদক্ খেয়ে যাত্রা করবেন!

মুক্তকেশী মামলা সম্পর্কে কিছুটা অবহিত আছেন। দেশের জমিজমা নিয়ে মায়ের নামে মামলা ঠুকে বসে আছে জগু।

জমিজমা বাগান পুকুর আছে বেশ কিছু। সব জ্ঞাতিরা খাচ্ছে। তাই শ্যামাসুন্দরী সেই জ্ঞাতি দ্যাওর ও ভাসুরপোদের কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, এই জবরদখলটি ত্যাগ করে তোমরা মানে মানে আমার প্রাপ্য অংশের টাকাটি ফেলে দাও।

জগু মাকে চোখ রাঙিয়েছে।

বলে, বলি প্ৰাপ্য কার? তোমার না। আমার? ওসব আমার ঠাকুর্দার বৈ তোমার ঠাকুর্দার নয়! তুমি পরের বাড়ির মেয়ে, উড়ে এসে জুড়ে বসে রমানাথ মুখুয্যের ভিটে থেকে তার বংশধরদের তাড়াবার কে হে?

অতঃপর মায়ে বেটায় লেগে গেছে লোগ। ঝামাঝাম, ফলশ্রুতি নালিশ! শ্যামাসুন্দরী দেবী জগন্নাথ মুখুয্যের ন্যায্য সম্পত্তির উপর অনধিকার হস্তক্ষেপ করছেন।

মুক্তকেশী জানেন এ কথা, কিন্তু দরজা বন্ধের ব্যাপারটা রহস্যজনক। তাই হেসে ফেলে বলেন, মায়ের সঙ্গে মামলা লড়ে মায়ের পাদোদক জল খেয়ে জিততে যাবে? তা বেশ। কিন্তু ছেকল কেন?

শ্যামাসুন্দরী উত্তর দেবার আগেই পিছন থেকে উত্তর দিয়ে ওঠে শ্ৰীমান জণ্ড। বাজখাই গলায় বলে ওঠে, ছেকল কেন? বলুক-বলুক, ওই নিকষা বুড়ী নিজেই বলুক ছেকল কেন? একদণ্ড পূজোয় বসেছি, অমনি ননদের কাছে ছেলের নামে লাগানো-ভাঙানো হচ্ছে, কেমন?

জগু একটা তাচ্ছিল্যের হুঙ্কার ছাড়ে।

পরনে ফরসা হলদেটে রং একখানা খাটো বহরের কেটে ধুতি, লোমশ বুকের উপর একছড়া রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা। পিসির গলার সাড়া পেয়ে নিঃশব্দে এসেছে দোতলা থেকে।

শ্যামাসুন্দরী মুখ বঁকিয়ে বলেন, ওই শোনো ঠাকুরঝি, নদেরচাঁদ ভাইপোর বাক্যি শোনো। তোর নামে লোকের কাছে লাগাতে বসবো, এত সস্তা জিভ আমার নয় রে লক্ষ্মীছাড়া!

শুনে যাও পিসি শুনে যাও—, জগু দরাজ গলায় বলে, দেখো পেটে পেটে কী শয়তানির প্যাঁচ। হবে না? দাদামশাইটি আমার কেমন ঘুঘু ছিলেন! নাম করলে হাঁড়ি ফাটে। তাঁরই কন্যে তো! যেই শুনেছে আজ মামলার দিন, অমনি পা নুকিয়ে বসে আছে! হেতু? না পাছে জবরদস্তি করে পাদোদক জলটুকু নিই।… আমিও বাবা তেমনি বজাত, দিয়েছি। দরজায় ছেকল তুলে। বেরোতে তো হবে একসময়। দেখি তখন কেমন করে পা আটকায়? পূজো সেরে এসে ওই চৌকাঠে জল ঢেলে ওৎ পেতে বসে থাকতাম। ছেকল খোলা পেয়ে যেমনি না বেরোবে, পড়বে তো পা জলের ওপর? সেই জল চেটে মেরে দেব-

নিজের বুদ্ধি-গরিমায় হা হা করে হেসে ওঠে জগু।

শ্যামাসুন্দরী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, ওরে আমার মাতৃভক্ত পুত্তুর রে! চব্বিশ ঘণ্টা মাকে পাশ পেড়ে কাটছেন, মায়ের নামে মামলা ঠুকে রেখেছেন আবার ঢং করে আসেন চন্নামেত্তর খেতে! জুতো মেরে গরু দান!

সমর্থনের আশায় নিনদের দিকে তাকান শ্যামা।

মুক্তকেশী কিন্তু ভ্ৰাতৃবধুর কথায় সমর্থন করেন না। অসন্তুষ্টভাবে বলেন, তা বললে কী হবে বৌ, এ তোমার অনেয্য কথা! তুমি যদি সোয়ামীর মরণকালে তার কানে বিষমন্তর ঝেড়ে পেটের ব্যাটাকে বঞ্চিত করে যথাসর্বস্ব নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে থাকো, ও কেন হকের ধন ছাড়বে? এ হলো নেয্য দাবির কথা। তা বলে ছেলের তুমি মাতৃভক্তির কসুর পাবে না।

শ্যামাসুন্দরী যদিও বড় ননদকে যথেষ্ট খাতির করে চলেন, তবু এতটা অসহ্য সব সময় সইতে পারেন না! গৰ্জন করে বলেন, অমন মাতৃভক্তির ক্যাথায় আগুন! ও ছেলের মুখদর্শন করলে নরক দর্শনের কাজ মেটে। বলি ঠাকুরঝি, সব্বস্ব নিজের নামে লিখিয়ে নেবো না তো কি সব্বস্ব ওই বাউড়ুলে উড়নচণ্ডে অকাল কুষ্মাণ্ড গেঁজেলটার হাতে তুলে দিয়ে ঘুচিয়ে পুচিয়ে দেব? ওর হাতে পড়লে এ ভিটেয় এসে দাঁড়াতে পেতে? একখানা একখানা করে ইট বেচে গাঁজা খেত না? আর ওর সেই গেঁজেল গুরুর সেবায় লাগাত না? আবার উদারতা কতা! জ্ঞাতিরা লুটেপুটে খাচ্ছে খাক! তাদের ঠাকুর্দার সম্পত্তি! নিজের যে তাহলে এরপর মালা হাতে করে ভিক্ষেয় বেরুতে হবে!

শ্যামাসুন্দরী একটু দম নেন।

মুক্তকেশী কিন্তু এহেন বিভীষিকার আশঙ্কাতেও দামেন না। জোর গলায় বলেন, তা হত হতই! ওর বাপের সম্পত্তি ও ওড়াতো! আর কারুর বাপের বিষয়ে তো নোখ ডোবাতে যেতো না! নেশা-ভাঙ আবার কোন বেটা ছেলেটা না করে? তাই বলে হকের দাবি পাবে না?

বিল তো পিসি বল তো!

জগু বুকে থাবড়া মেরে মিটমিটি হাসে।

শ্যামাসুন্দরী বিরক্ত গলায় বলেন, ভাইপোর সুয়ো হয়ে খুব তো বলছো ঠাকুরঝি, বলি আজ যদি আমি ওর হাতে পড়ি, কাল আমায় আঁচল পেতে ভিক্ষে করতে হবে না? আমার কি পেটের আর পাঁচটা আছে যে, ও না খাওয়াক আর একজন খাওয়াবে? আমি যাই মা বসুন্ধরার মতন সহ্যশীলা, তাই ওকে সহ্য করছি। অন্য মা হলে ওই ছেলের মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে চলে যেত।

ভাজকে যে ভালবাসেন না মুক্তকেশী তা নয়। সময়-অসময়ে অনেক করে ভাজ। তবু ঝোল তার কোলে টানেন না। বলেন, নুড়ো তোমার বুদ্ধির মুখেই জ্বালতে হয় বৌ! মামলা-মকদ্দমা হল বাইরের কাজ, বাপে-বেটায় হচ্ছে, ভাই-ভাইয়ে হচ্ছে, এই তোমার মতন গুণবতী মায়ের সঙ্গে হচ্ছে, তাই বলে মানুষ ধর্মাধর্ম ছাড়বে? মায়ে-বোটায় লাঠা-লাঠি বলে কি তুমি মরলে ও হবিষ্যি গিলবে না? না মাথা মুড়োবে না?

জগু এতক্ষণ দুই কোমরে হাত দিয়ে বীরের ভঙ্গীতে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল, এবার পরম সন্তোষের সুরে বলে, এই দেখো জ্ঞানবানের কথা! বুঝলে পিসিমা, এই সহজ কথাটুকু আর ওই নিকষা বুড়ীকে বুঝিয়ে উঠতে পারলাম না! কথায় বলে, স্বৰ্গাদপি গরীয়সী! বলে কিনা? তুমি জ্ঞানবান, বুঝমান, তোমার সঙ্গে কথা কয়ে সুখ আছে!

শ্যামাসুন্দরী টিটকিরি দিয়ে ওঠেন, তা সুখ থাকবে না কেন? কোলে ঝোল টানলে সবাই জ্ঞানবান! বলি, তোমার ছেলেরা এ রকম হলে কী বলতে ঠাকুরঝি! ভাগ্যিগুণে তারা সবাই ভাল, তাই। আমার হচ্ছে এক ব্যানুন নুনে বিষ!

ভাগ্যিগুণে নয় হে-বুদ্ধির গুণে! জগু রায় দেয়, পিসির ছেলেরা কি আমনি ভাল হয়েছে? কথাতুই আছে, যেমন মা, তার তেমন ছা! তা যেমন তুমি তেমনি তোমার পুত

জ্ঞানপাপী!

বলে শ্যামাসুন্দরী মুখ বাঁকিয়ে আবার কুটনো কুটিতে বসেন।

মুক্তকেশী ও সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে বলেন, তাও বলি বৌ, ছেলে কেন বাউণ্ডুলে হবে না? বয়েস পার হয়ে গেল ছেলের, তুমি বিয়ে দিলে না–

কথাটা সত্যি।

বিয়ের বয়েস কোন কালে পার হয়ে গেছে জগুর। মুক্তকেশীর বড় ছেলে সুবোদের থেকেও বড় সে। কিন্তু পাত্র হিসেবে যে সুপোত্র নয় সে কথা বলাই বাহুল্য। লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি দিয়ে ছেলেবেলা থেকে কেমন করে যেন গাঁজার আড্ডায় ভিড়ে পড়েছিল, আবার এখন এক অবধূত বাবার শিষ্য হয়েছে।

মুক্তকেশী আগে বহু চেষ্টা করেছেন হাল ধরতে, কিন্তু নৌকো ঠেলে নিয়ে যেতে সক্ষম হন নি। হন নি। অবশ্য জগুরই প্রবল প্রতিবন্ধকতায়, তবু তিনি যখন তখন ভাজকেই দোষী করেন। এখনো করলেন, বয়সের ছেলে, সময়ে বে-থা না হলে—

থামো ঠাকুরঝি, ওকথা মুখে এনে না। আর—, শ্যামাসুন্দরী গুরুজনের সম্মান ভুলে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, নিজে তো ওই এক ভূত বিইয়ে জ্বলে পুড়ে মরছি। আবার কি পরের মেয়ের কপালে তেঁতুল গুলতে সেই ভূতের বিয়ে দেব? পাগল তো হই নি এখনো!

প্রশ্নটা তামাদি হয়ে গেছে, তবু মুক্তকেশী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, তার মানে তুমি চাও আমার বাপের বংশটা লোপ পাক?

পেলে আর করছি কি! শ্যামাসুন্দরী বলেন কত কত রাজা-বাদশার বংশ লোপ পাচ্ছে!

তবে আর কি! লোকের গলা কাটা যাচ্ছে তো আমার গলাটাও কাটি! তুমি না দাও, আমি এবার জগুর বিয়ে দেব। বলতে কি, সেই উদ্দিশ্যেই আসা আজ। গঙ্গার ঘাটে এক মাগী কেন্দে পড়লো। বলে, গলায় গলায় আইবুড়ো মেয়ে, ইচ্ছে হয় যে গলায় দড়ি দিই! দিদি যদি একটা পাত্তরটাত্তর দেখে দেন! আমার মনে এল জগুর কথা। এখনো যদি ধরে করে একটা বিয়ে দিতে পারা যায়–

জগু বলে ওঠে, এই দেখো পিসির দুর্মতি! বলি নিজেই তো বলে মর, ছেলেগুলো তোমার সব বৌয়ের গোলাম হয়ে আছে, বৌরা কান ধরে ওঠাচ্ছে বসাচ্ছে, আবার এ হতভাগার কানের মালিক আনার চেষ্টা কেন?

মুক্তকেশী সহাস্যে বলেন, শোনো কথা ছেলের! আগে থেকেই বুঝি গোলাম হয়ে বসছিস? বলি, সবাই তা হবে কেন? বৌকে পায়ের পাপোষ করে রেখে দিষ্টান্ত দেখা তুই!

হুঁ, দেখাবো বললেই দেখানো হয়! জগু বিচক্ষণের ভঙ্গীতে বলে, এই বেড়ালই বনে গেলে বন-বেড়াল হয়, বুঝলে পিসি? তার ওপর আবার আমার রক্তে আমার বাপের গুণ!

বটে, বটে। রে হতভাগা পাজী বাঁদর-, শ্যামাসুন্দরী ছিটাফিটিয়ে ওঠেন, দূর হ দূর হ আমার সুমুখ থেকে। মরা বোপকে গাল দিচ্ছিস লক্ষ্মীছাড়া? নরকেও ঠাঁই হবে তোর?

নরকে ঠাঁই চাইতে যাচ্ছে কে? জগু বুকে আর একটা থাবড়া মেরে বলে, সিগাগো থাকতে নরকে যেতে যাব। কী দুঃখে? মরণকালে মা মা করে মরব, মাতৃনামে তরে যাব। তবে ওই বিয়েটিয়ের কথা কইতে এসো না পিসি। বিয়ে করেছি। কি গোল্লায় গেছি!

তা যা বলেছিস-

মুক্তকেশী সহসা নিজ যুক্তি বিস্মৃত হয়ে একগাল হেসে বলেন, তা যা বলেছিস। এ ছোঁড়া দেখছি না পড়েই পণ্ডিত! বলেছিস ঠিক। আমার ছেলেগুলো কি আর মনিষ্যি আছে? বিশেষ করে পেবোটা! যেটা নাকি সব চেয়ে ডাকাবুকো ছিল! সেরেফ ভেড়া হয়ে বসে আছে। বৌ দজ্জালি করলে তেড়ে একবার করে মারতে আসে, আবার কেঁচো হয়ে গুটিয়ে পালায়। লাখোবার বলেছি, ও বৌ ত্যাগ দিয়ে আর একটা বিয়ে কর। সে সাহসও নেই। দিলে একবার বাহাদুরি দেখিয়ে বিদেয় করে, ওমা বৌ। কিনা তৎক্ষণাৎ বাপের সঙ্গে ফিরে এল!

এবার জগু একটু গম্ভীর হয়।

বলে, এটা পিসি তোমার অন্যায্য কথা হচ্ছে। তোমার মেজবৌকে তুমি অন্যায় নিন্দে করা। সুবো। আমায় বলেছে, আমার মায়ের হাতে না পড়ে অন্যত্র পড়লে, ওই বৌয়ের ধন্যি ধন্যি হত।

মুক্তকেশী সহসা যেন আকাশ থেকে হাত-পা ভেঙে ধপাস করে পড়েন।

সুবোধ!

সুবোধ বলেছে এই কথা!

কেন?

রীত-চরিত্তির মন্দ হয়ে যাচ্ছে না তো হতভাগার! ওই জাঁহাবাজ ভাদরবৌয়ের গুণ দেখেছেন তিনি! ভাদ্দরবৌ তাহলে গুণ-তুক করছে!

বড় দুঃখে আর রাগ আসে না-রুদ্ধকণ্ঠে বলেন, বটে! এই কথা বলেছে সুবো?

বলে তো! যখন তখন বলে! তা যাই বল পিসি, তুমিও তো সোজা মায়ের সোজা মেয়ে নও! জানি তো আমার ঠাকমাকে! কী নিধিটি ছিলেন!

মুক্তকেশী এবার ভয় খান।

কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেটা কী বলতে কী বলে ঠিক কি?

উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, দুগৃগা, দুগ্‌গা, গঙ্গাচ্ছন করে এসে মাতৃনিন্দে শুনছি বসে বসে। চললাম বৌ।… এই ছুড়ি, চল। ওমা, কোথায় আবার গেল মুখপুড়ী?

গেছে। ওইদিকে বোধ হয়। পেয়ারা পাড়তে।

রাক্ষুন্সী যেন পেয়ারার যম। আবার এখন—

শ্যামাসুন্দরী আবহাওয়া হালকা করতে বলেন, তা সে আর কোন মেয়েছেলেটা নয়?

তা তো নয়—, মুক্তকেশী। আর একবার তোলা প্ৰসঙ্গ পেড়ে নামান, এই তো বললে তো? আমার মেজ বৌমার কাছে বল গিয়ে? শুনবে পেয়ারা খেলে নাকি পেট কামড়ায় ওঁর ছেলেমেয়েদের? চাপিটাকে সঙ্গে আনা বন্ধ করেছি কি সাধো? মা দজাল, মেয়েটা তো আমার পায়ের কাদা! ঠাকমা তোমার সঙ্গে যাব বলে রসাতল! মেম মা বলেন। কিনা, গঙ্গার ঘাটে বুড়ীদের দলে বসে রাজ্যের পাকা পাকা কথা শিখবে আর রাজ্যের ফল-পাকড় গিলে অসুখ করাবে—

আমি বলি, ও বটে! আচ্ছা! রইল তোমার মেয়ে। মাথা খুড়ে মরলেও আনি না। আর। বড়বৌমার এইটেকে নিয়ে আসি।

জগু বলে, এটা কিন্তু তোমার নিষ্ঠুরতা পিসি।

তা নিষ্ঠুর বলিস নির্মায়িক বলিস, সবই শুনতে হবে। মুক্তকেশী উদাস গলায় বলেন, সেদিন সেই কথার পর প্রবোধ কি এসে পরিবারের হয়ে হাতজোড় করে মাপ চেয়েছে? বলেছে কি মা, তুমি থোঁতা মুখ ভোঁতা করে ড্যাংডেঙিয়ে নাতনীদের নিয়ে গঙ্গাচ্ছনে যাবে, যা ইচ্ছা কিনে খাওয়াবে! বলে নি তো? তবে? তবে আর কিসের মায়া-মমতা আমার?

জগু সহসা উদ্দীপ্ত গলায় বলে ওঠে, তবে যদি বললে পিসি, এ তোমার শিক্ষার দোষ। এ যদি তোমার গোয়ার-গোবিন্দ জগু হত, বৌকে মেপে সাত হাত নাকে খৎ দেওয়াতো। মায়ের ওপর ট্যাফো! স্বৰ্গাদপি গরীয়সী না? আমার মা, আমি পাশ পেড়ে কাটতে পারি, তা বলে পরের মেয়ে উঁচু কথা বলবে? শাস্তরে বলেছে–

শ্যামাসুন্দরী বলেন, থাম খুব ধোষ্টামো হয়েছে! তোর মুখে শাস্ত্ৰবাক্য শুনলে স্বর্গে বসে মুনি ঋষিরা গালে মুখে চড়াবে!

ওই শোনো! দেখছো পিসি, কেন দু-চক্ষের বিষ দেখি বুড়ীকে? দিশে ধর্মে বলেছে কুপুত্ৰ যদ্যপি হয় কুমাতা কদাপি নয়। অথচ আমার ভাগ্যে হলো উল্টো! ভগবানের রাজ্যে একটা বেতিক্রম পটলের মা পলুতাপাতা, আর এই সংসারে এক বেতিক্রম জগার মা শ্যামাসুন্দরী! মাতৃনাম উচ্চারণে পাপ নিও না ঠাকুর। মাগো মা শ্যামা মা! যাক পিসি, বড়মানুষের মেয়েকে তুমি হুকুম করে যাও দিকি, ওই ওখানে শ্বেতপাথরের বাটিতে জল আছে, কৃপা করে একটু চরণ ড়ুবিয়ে রাখতে!

ফের জগা?

শ্যামাসুন্দরী ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, ফের ধাষ্টামো?

চোখ রাঙিও না বলছি মা জননী— জগুও সমান গলায় বলে, বেশি বাড়াবাড়ি করবে তা ওই ঠ্যাঙ দুখানি ভেঙে এইখানে শুইয়ে রেখে দেব।

মুক্তকেশী আপসের সুরে বলেন, তুচ্ছ কথা নিয়ে তুমিই বা কেলেঙ্কার করছে কেন বৌ, দিয়ে দাও না!

শ্যামাসুন্দরী সহসা দুমদুম করে গিয়ে সেই পাথরবাটি-রক্ষিত জলে বা পায়ের বুড়ো আঙুলটা ড়ুবিয়ে আবার এসে বসে পড়েন।

জণ্ড সাবধানে বাটিটা উঠিয়ে নিয়ে সোল্লাসে বলে, ব্যাস, কেল্লা ফতে। দেখি এখন রাবন জেতে কি নিকষা জেতে!

ঝগড়ার শেষ শোনার সময় নেই, বেলা হয়ে যাচ্ছে। মুক্তকেশী ডাকেন, টেঁপি, এই হারামজাদী আয় না?

টেঁপি এগিয়ে আসে।

জগু তার হাতে চারটে পয়সা দিয়ে বলে, পুতুল কিনিস।

আবার পয়সা কেন? মুক্তকেশী অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, নিত্যি তোর পয়সা দেওয়া! ছুড়িও হয়েছে তেমনি লুভিষ্টে! হাত পেতেই আছে। নে চল চল, রোদ উঠে গেল। চলি বৌ। বলি হ্যাঁ গো, থরে থরে কত কুটনো কুটেছে! মা ব্যাটা দুটো মনিষ্যিতে তো খাবে!

শ্যামসুন্দরী চরম বিরক্তির স্বরে বলে, ব্যাটা যে একাই একশো! বাহান্ন ভোগ না হলে গলা দিয়ে ভাত নামবে? মাছ খাবি, চারখানা মাছ-সর্ষে রোধে দেব চুকে যাবে, তা নয়, মার হেঁসেলে নিরিমিষ্যি গিলবো! হাড়মাস পুড়িয়ে খেলো। আজ আবার আদালতের সমন, একথুনি বলবে ভাত দাও! তখন জলে পড়ি কি আগুনে পড়িা!

মুক্তকেশী আর দাঁড়ান না।

বাইরে আগুনের মত রোদ উঠে গেছে। বেলা দশটাতেই এত রোদ। মুক্তকেশীর মনে হয়, পৃথিবীর আবহাওয়াও বুঝি বদলে গেছে। তাঁদের বয়েসকালে আষাঢ় মাসে এত রোদ কখনো ছিল না।

পথে বেরিয়ে টেঁপি আবদারের সুরে বলে, একটা পালকি ডাকো না ঠাকমা, হাঁটতে ভালো লাগছে না।

মুক্তকেশী চড়া গলায় বলেন, ভাল লাগে না তো আসিস কেন লক্ষ্মীছাড়া! গঙ্গাচ্ছান করে মানুষের কাঁধে চড়বো!

আহা, গঙ্গার ঘাটের সেই মুটকি বুড়ীটা রোজ পালকি চড়ে না?

মুক্তকেশী বুড়ীর উল্লেখে হেসে ফেলে বলেন, সে বুড়ীর ক্ষ্যামতা নেই তাই চড়ে। পালকি আর আছেই বা কই? দেখতেই তো পাই না? যাবে, আস্তে আস্তে সবই উঠে যাবে। পালকি যাবে, আরু যাবে, গুরুজনে ভক্তিছেদা যাবে, ধর্মাধৰ্ম পাপপুণ্যি সবই যাবে। স্বদেশীর হুজুগে। দেশ ছারেখারে যাবে পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।… সাহেবের রাজ্যিপাট, তোরা যাচ্ছিস তাদের উৎখাত করতে! বলি ওদের উচ্ছেদ করে করবি কি! রাজ্যি চালাবি? হুঁ! সুখের পৃথিবীতে ইচ্ছে করে আগুন জ্বালা!

এসব কথা নাতনীর জন্যে নয়, মুক্তকেশীর এ স্বগতোক্তি পালকির সূত্রে বেরিয়ে পড়া ভিতরের উন্মা। পথে ঘাটে কেবলই শোনেন কিনা স্বদেশীওলারা সাহেবদের উচ্ছেদ করবার তালে আছে। বোমা করছে, গুলি বন্দুক গোছাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে ওই আলোচনা শুনে শুনে হাড়পিত্তি জ্বলে যায়। ওদের রাজ্যপাট, তোরা কেড়ে নিবি? ওদের সঙ্গে পারবি? বামন হয়ে চাদে হাত?

হঠাৎ স্বদেশীদের ওপর খাপূপা হয়ে ওঠেন কেন মুক্তকেশী কে জানে!

মনে হচ্ছে হঠাৎ যেন নিজের জীবনের একটা মস্ত বড় ফাঁক ধরা পড়ে গেছে তাঁর চোখে।

কিসের এই শূন্যতা?

তাঁর রাজ্যপাট তো পুরোদস্তর বজায় আছে। তবে হঠাৎ সাহেবের রাজ্যপাট বেদখল হবার চিন্তায় মেজাজ ক্ষিপ্ত হয় কেন?

গোঁয়ার-গোবিন্দ জগুর মার ওপর কি সূক্ষ্ম একটা ঈর্ষাবোধ আসছে? কেন? মুক্তকেশীর ছেলেরা কি মাতৃভক্তিতে কম? তাই জগুর অভিনব মাতৃভক্তি তাঁকে ঈর্ষার পীড়িত করেছে?

মাতৃভক্তিতে কসুর কোথায় মুক্তকেশীর ছেলেদের? তবু গভীর। এই শূন্যতার বোধটা ভরাট করে তুলতে পারছেন না বুদ্ধি দিয়ে যুক্তি দিয়ে। মুক্তকেশীর নিজের হৃদয়ে ছেলেদের ঠাঁই নেই, না ছেলেদের হৃদয়ে মুক্তকেশীর ঠাঁই নেই? ঠাঁই থাকলে ভরাটত্ব থাকবে না কেন? শ্যামাসুন্দরীর মধ্যে যে ভরাটত্বটা দেখে এলেন এইমাত্র?

ছেলের বিয়ে দেওয়াটাই কি তাহলে বোকামি? হাতের কড়ি পরকে বিলিয়ে দেওয়ার মত?

অ ঠাকমা, অত জোরে হাঁটছে। কেন? আমি বুঝি পারি?

পারিস না তো আসিস কি করতে? মুক্তকেশী গতিবেগ একটু কমিয়ে বলেন, আমি বুড়ী পারছি, তুমি জোয়ান ছুড়ি পারছি না? তোদের বয়সে লোহা ভাঙতে পারতাম, তা জানিস?

কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়।

অসামান্য গতর ছিল, এখনো আছে। কথায় বলে মারা হাতী লাখ টাকা! আখ, কখনো দাঁতে ছাড়িয়ে ভিন্ন বাঁটিতে ছাড়িয়ে খান না, নিত্য ডালবাটা পোস্তবাটা খেয়ে অবলীলায় হজম করেন। জলের কলের মধ্যে চামড়া আছে, এই বিচারে বিধবা হয়ে পর্যন্ত কখনো কলের জল খান নি। দৈনিক দু ঘড়া করে ভরির গঙ্গাজল তার বরাদ্দ।

নিষ্ঠাবতী বলে বিশেষ একটা নামডাক্ষ আছে মুক্তকেশীর। পাড়ার লোক সমীহর দৃষ্টিতে দেখে। মুক্তকেশীকে পথে বেরোতে দেখলেই রাস্তার ছেলেরা ডাংগুলি খেলা স্থগিত রাখে, মারবেল খেলতে খেলতে চকিত হয়ে দাঁড়ায়।

দোবরা চিনিতে হাড়ের গুঁড়ো আছে বলে কখনো সন্দেশ রসগোল্লাটি পর্যন্ত খান না মুক্তকেশী, রাতে আচমনী খান না। অম্বুবাচীর কদিন অশুদ্ধ বসুমতীর সংস্পর্শ ত্যাগ করে দৈনিক একবার মাত্র গঙ্গাগর্ভে দাঁড়িয়ে মধু আর ডাব পান করেন। এমন আরো অনেক কঠোর কৃচ্ছসাধনের তালিকা আছে মুক্তকেশীর, তাই তার চেহারাতেও রুক্ষ-কাঠিন্য।

মুক্তকেশীর জীবন-দর্শনের সঙ্গে আজকের শূন্যতার মিল নেই। তিনি তো বরাবর ভালোবাসার চেয়ে ভয়কেই মূল্য দিয়েছেন বেশি। ভেবেছেন, ওটাই সংসারের পায়ের তলার মাটি। তবে আজ কেন গোয়ার জগুর মাতৃপাদোদক পান করার মত হাস্যকর ব্যাপারটা বার বার মনে পড়ছে? কেন মনে হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী একটা উঁচু পাথরের বেদীতে বসে আছেন, মুক্তকেশী নীচে থেকে মুখ তুলে দেখছেন?

ও ঠাকমা, পালকি নেবে না?

টেঁপির আবদারের সুর ধ্বনিত হয়।

মুক্তকেশী হঠাৎ যেন নরম হন। বলেন, পয়সা খরচা না করিয়ে ছাড়বি না, কেমন? কই দেখি কোথায় পালকি?

ওই তো। ওখানে বসে রয়েছে—

মুক্তকেশী দেখেন একটা গাছতলায় বসে রয়েছে বটে পালকি নামিয়ে দুটো বেহারা।

হাতছানি দিয়ে ডাকেন।

তারপর তাতে উঠে বলেন, তোর মা যা কঞ্জুষী, আক্কেল করে দেবে ভাড়াটা! দেবে না। চাঁপির মার আর কোন গুণ না থাক এটা আছে।

টেঁপি মুখখানা বোজার করে বলে, চাপির মার হাতে তো রাতদিন পয়সা, আমার মার আছে বুঝি? বলে মার একটা চাবির রিং কেনবার ইচ্ছে কবে থেকে, তাই হয় না!

মুক্তকেশী তাচ্ছিল্যাভরে বলেন, না হলে আর কার কী দোষ? লাখ টাকায় বামুন ভিখিরি! কেন, তোর বাবা কি উপায় কম করে?

হ্যাঁ, এ ধরনের কথা ক্ষুদে ক্ষুদে নাতি-নাতনীদের কাছে হামেশাই বলে থাকেন মুক্তকেশী। যা কিছু বলার ইচ্ছে, যা কিছু বক্তব্য, বেশীর ভাগই তো ওই ছোটগুলোকে মাধ্যম করেই উচ্চারণ করেন। ঠিক জানেন, সরাসরি বলার হাঙ্গামাটা না পুইয়েও সরাসরি বলার কাজটা এতেই হবে।

সঙ্গে সঙ্গেই তো গিয়ে মায়েদের কর্ণগোচর করবে ওরা।

ওরা পাকা পাকা কথা শিখবে?

ওমা, তাতে কী এল গেল!

ক্তকেশীর মেম মেজবৌমার মত আর কে বলতে যাবে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে পাকা কথা শিখবে! কিন্তু মুক্তকেশীর সেই মেজবৌ কি এখনো টিকে আছে তার বাড়িতে? সেদিনকার ঝড়ে উড়ে পড়ে যায় নি। সুবৰ্ণলতার শ্বশুরবাড়ির আশ্রয়?

তাই তো যাবার কথা।

রাগে দুঃখে অপমানে ধিক্কারে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে বেরিয়ে যাবার কথা তো প্ৰবোধের। অথবা নষ্টচরিত্র স্ত্রীকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার কথা!

কিন্তু তার কিছুই হয় নি।

আবার সুবর্ণ রান্নাঘরে এসে হেঁসেলের পালা ধরেছে, আবার খেয়েছ ঘুমিয়েছে, কথা বলেছে।

তারপর?

তারপর তো আরো দুই মেয়ে আর দুই ছেলে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল সুবৰ্ণর এ বাড়ির নীচের তলার সেই ঠাণ্ডা স্যাৎসেঁতে আঁতুড়ঘরটায়। যে ঘরে বছরে অন্তত পাঁচ-সাতবার সদ্যোজাতের কানু ওঠে।

অদৃশ্য অন্ধকার জগতে অবস্থিত যে সব বিদেহী আত্মারা পৃথিবীর আলো-বাতাসের আকাঙ্ক্ষায় লুব্ধ হয়ে ঘোরে, তাদের মুক্তির মাধ্যমে তো এই সুবৰ্ণলতার দল! ইচ্ছায় অনিচ্ছায় যারা মা হতে বাধ্য হয়! তাদের নিম্বফল নভেল পড়াটা বন্ধ করা দরকার। ও থেকেই যত অনিষ্ঠ এসে ঢোকে সংসারে!

অতএব কালীর দিব্যি দিয়েছে প্ৰবোধ স্ত্রীকে, দিয়েছে নিজের দিব্যি। রাত্রিকালে নিশ্চিন্ত অবকাশে বুঝিয়েছিল, নভেল পড়ার কি কি দোষ।

কিন্তু বেহায়া সুবৰ্ণ সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তেও এক অদ্ভুত কথা বলে বসেছিল। বলেছিল, বেশ, তুমিও একটা দিব্যি গালো!

আমি? আমি কি জন্যে? আমি কি চোরদায়ে ধরা পড়েছি?

না, তুমি কেন পড়বে, সব চোরদায়ে ধরা পড়েছে মেয়েমানুষ! কেন বলতে পারো? কেন?

কেন? শোনো কথা!

এর বেশি আর উত্তর যোগায় নি প্ৰবোধের।

সুবৰ্ণ হঠাৎ প্ৰবোধের একটা হাত ঘুমন্ত ভানুর মাথার ওপর ঠেকিয়ে বলে উঠেছিল, তুমিও দিব্যি কর। তবে, আর কখনোও তাঁস খেলবে না?

তাস খেলবো না! তার মানে?

মানে কিছু নেই। আমার নেশা বই পড়া, তোমার নেশা তাস খেলা। আমাকে যদি ছাড়তে হয় তো তুমিও দেখো, নেশা ছাড়া কী বস্তু। বল আর কখনো তাস খেলবে না!

প্ৰবোধের সামনে আসন্ন রাত্রি।

আর বহু লাঞ্ছনায় জর্জরিত স্ত্রী সম্পর্কে বুক-দুরু-দুরু আতঙ্ক।

আবার কী না কি কেলেঙ্কারী করে বসে কে বলতে পারে! তবু সাহসে ভর করে একবার বলে ফেলে, চমৎকার! মুড়ি-মিছরির সমান দর!

সুবৰ্ণলতা তীব্ৰস্বরে বলে উঠেছিল, কে মুড়ি কে মিছরি, তার হিসেবই বা করেছিল কে, আর তাদের দর বেঁধে দিয়েছিলই বা কোন বিধাতা, বলতে পারো?

আশ্চর্য, এত লাঞ্ছনাতেও দমে না মেয়েমানুষ। উল্টে বলে, লজ্জা আমার করার কথা, না। তোমাদের করার কথা সেটাই বরং ভাবো!

প্ৰবোধ। অতএব বলে বসেছিল, ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে, করছি দিব্যি!

খেলবে না। আর কখনো তাস?

খেলবো না। হল তো! তা আমার বেলায় তো বেশ হলো, নিজের প্রতিজ্ঞা?

বলেছি তো, তুমি যদি আর তাস না খেলো, আমিও বই পড়বো না।

আমার সঙ্গে কি তা তো বুঝলাম না! হলো পরপুরুষের সঙ্গে মাখামাখি-

খবরদার! আর একবারও যেন ওকথা উচ্চারণ করতে শুনি না, ইতর ছোটলোক!

বাঃ, বাঃ, একেই তো বলে পতিব্ৰতা সতী! সতী স্ত্রীলোকেরা–

তোমাদের হিসেবমতন সতী আমি নই, নই, নই। হলো!

সুবৰ্ণ ক্রুদ্ধগলায় বলে, ছেলের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করেছে। মনে রেখো। পয়সা বাজি ধরে তাস খেলা! ও তো জুয়া খেলা! জুয়া খেললে পাপ হয় না তোমাদের? নাকি পুরুষের পাপ বলে কিছু নেই?

পুরুষের আবার পাপ নেই! প্ৰবোধ বলে, মহাপাপ হচ্ছে বিয়ে করা। বলেই সবলে আকর্ষণ করে সুবৰ্ণলতার পাথর-কঠিন দেহটাকে।

তারপর?

গড়িয়ে চলে দিনরাত্রি।

যথানিয়মে সকালে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়, মুক্তকেশী গঙ্গাস্নানে যান, মুক্তকেশীর ছেলেরা প্রতিদিন সন্ধায় আর ছুটির দিন সারাদিন তাসের আড্ডা বসায়, বড়বৌ রাশি রাশি পান সেজে বৈঠকখানায় পাঠায়, বাড়ির ছেলেরা ঘন ঘন তামাক সাজে।…

আজকাল আবার আর এক নতুন ফ্যাসান উঠেছে চা খাওয়া। চায়ের সাজসরঞ্জাম কেনা হয়েছে, মহোৎসাহে চা বানিয়ে তাসের আড্ডায় সরবরাহ করা হচ্ছে।

চলছে যথারীতি।

কিন্তু মুক্তকেশীর মেজছেলে!

সে কি যোগ দিচ্ছে তাসের আড্ডায়?

তার চরিত্র কোন কথা বলে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress