তাসের আড্ডা রোজই বসে
তাসের আড্ডা রোজই বসে, সন্ধ্যে থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত চলে। বাড়ির মেয়েরা হাঁড়ি আগলে বসে থাকতে থাকতে হয় ঝিমোয়, নয়। ঘুমিয়ে নেয় এক পালা।
তবে নিশ্চিন্তের ঘুম তো নয়, কখনও যে বৈঠকখানা থেকে হুকুম আসে চারটি পান। সেজে পাঠিয়ে দিতে, তার তো ঠিক নেই!
বৌরা ঘুমিয়ে পড়েছে খবর পেলে তো গর্দান যাবে।
তাছাড়া ভাত গরম রাখার উদ্বেগও তো আছে। উনুনের উপর হাঁড়ি দমে বসিয়ে রেখে রেখেও তো বেদম ঠাণ্ডা মেরে যাবে। আর অতিক্ষণ তাস পিটিয়ে এসে ক্ষুধার্ত পুরুষ যদি দেখে ঠাণ্ডা ভাত, তা হলে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা তাদের পক্ষে শক্তি বৈকি।
তবু ছুটির দিনের সঙ্গে অন্য সব দিনের তুলনাই চলে না। ছুটির দিনে আড্ডাটা বসে মধ্যাহ্ন-ভোজনের পরমুহূর্তে থেকেই, চলে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। পান সাজতে সাজতে বৌদের এবং তামাক সাজতে সাজতে ছোট ছেলেগুলোর প্রাণ বেরিয়ে যায়।
মুহুমুর্হু হুকুম আসে, আর তামিল করতে তিলার্ধ দেরি হলেই আসে হুঙ্কার।
সুবোধ বাদে বাকী তিন ভাই তাসের পোকা। সুবোধ একটু ঘুম-কাতুরে, সকাল সকাল খেয়ে ঘুমোয়, আর ঘুমোতে যাবার আগে বলে যায়, তাস দাবা পাশা, তিন কর্মনাশা! তোদের এই এক কর্মনাশা নেশায় ধরেছে!
প্রভাস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, তা বটে। এর থেকে ঘুমটা অনেক মূল্যবান বস্তু, কি বল लाम्राl?
সুবোধ লজ্জিত হয় না, বলে, একশোবার! ঘুম হচ্ছে মগজের আহার। দেহের যেমন অন্ন, মগজের তেমনি ঘুম!
প্রভাস অবশ্য এই নতুন জ্ঞানলাভে ধন্য হয় না। বলে, অতিভোজনটাও ভাল নয়।
সুবোধ হাসে, অতি মানে? ভগবান ক ঘণ্টা দিবালোক দিয়েছে, আর ক ঘণ্টা অন্ধকার সে হিসেব করা?
তুমি কর! বলে প্ৰভাস।
প্রভাসের কথাবার্তার ধরনই ওই।
গুরুজনের সঙ্গে বাক্যালাপে যে নম্রতার নীতি বলবৎ আছে, প্ৰভাস সেটা কদাচিৎ মানে। প্ৰভাসকেই সকলে সমীহ করবে। এই নীতিই চালু হয়ে গেছে সংসারে।
এমন কি মুক্তকেশীও তার উকিল-ছেলেকে রীতিমত সমীহ করছেন, ওর বৌয়ের দোষের দিকে দৃষ্টিক্ষেপটা কম করছেন, এবং ছেলেকে প্রায়শই তুমি করে কথা বলছেন।
প্রভাস যদি তাস খেলার বিরোধী হতো, নিৰ্ঘাত বাড়িতে তাসের আড্ডা বসবার স্বপ্ন কেউ দেখত না। কিন্তু প্ৰভাসই এ যজ্ঞের হোতা! অতএব আড্ডা ক্রমশই আয়তনে বাড়ছে, দর্শক-বন্ধুর সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে।
ছুটির দিনে পূর্ণিমার জোয়ার।
তবে অন্য দিনেও কম নয়।
প্ৰবোধ যখন ঘোড়ার গাড়ি করে মেজবৌকে নির্বাসন দিতে গেল, তখন প্ৰভাস বন্ধুদের মধ্যে থেকে খেলোয়াড় নির্বাচন করে বাজার বজায় রেখেছিল। তার মধ্যে যথারীতি পান দু ডাবর শেষ হয়েছে। রাতও প্রহর হয় হয়।
প্ৰবোধ বৌকে পৌঁছে দিয়ে এসে মার কাছ থেকে ঘুরে সবে জুৎ করে বসেছে।
এমন সময় দরজায় গাড়ি থামার শব্দ। বিতাড়িত হয়ে তাড়িত আবার ফিরে এসেছে।
কিন্তু দর্জিপাড়ার গলির মধ্যেকার এই রুদ্ধ কপাটের ভিতর পিঠে প্ৰবেশ-অধিকার কি সহজে মেলেছিল সুবৰ্ণর?
মেলে নি।
মাতৃভক্ত ছেলে প্ৰবোধ সদ্য জমে-ওঠা খেলায় জল ঢেলে শ্বশুরের সামনে এসে দরজা আটকে দাঁড়িয়ে ঘাড় গুঁজে ঘোৎ ঘোৎ করে বলেছিল, না, এমনি ঢুকে পড়া চলবে না, আমার সাফ কথা, আমার মায়ের পায়ে ধরে মাপ চাইতে হবে।
খেলা ফেলে প্ৰভাসও উঠে এসে বলেছিল, তালুইমশাই কি মেয়েকে এক সন্ধ্যেও দুটি খেতে দিতে পারলেন না?
পারলাম নাই বলতে হবে–, বলে গাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন নবকুমার।
ক্ষুব্ধ ক্ৰন্দন-বিজড়িত সেই কণ্ঠস্বর ভিতরের ইতিহাসের আভাস প্রকাশ করল।
সুবৰ্ণ খায় নি। জলটুকু পর্যন্ত না।
গাড়িতে ওঠার সময়ে বলেছিল, কী দরকার বাবা? দর্জিপাড়ার সেই গলিটাতে যদি আবার গিয়ে ঢুকতেই হয়, তাদের হাঁড়ির অন্ন খেতেই হয়, তবে আর একবেলার জন্যে জাত নষ্ট করি কেন?
সৌদামিনী গালে হাত দিয়ে বলেছিলেন, তুই যে দেখি তোর মায়ের ওপর গেছিস সুবৰ্ণ, বাপের ঘরে খেলে তোর জাত যাবে?
সময় বিশেষে তাও যায় বৈকি পিসিমা।… যাক গে বাবা, গাড়ি একখানা ডাকো, বেশি রাত হবার আগেই পৌঁছে দিয়ে এসো। অনেক কষ্ট তোমাকে পেতে হল। এই যা!
তা দরজা আটকানোর নাটকটা পাড়ার লোকে দেখেছিল বৈকি।
যারা তাস খেলছিল তারা, যারা আশেপাশের জানলায় মুখ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। আর নিজ নিজ বাড়ির সামনের রোয়াকে যারা বসে ছিল গা খুলে, বাড়ির বাচ্চা মেয়েদের একটা পাঁচ–ছ হাতি শাড়ি পর, তারা তো বটেই।
শেষ পর্যন্ত সে নাটকে যবনিকাঁপাত করলেন স্বয়ং মুক্তকেশীর তো আর এখন আব্রুর বালাই নেই, তাই দরজার কাছে এসে বলেছিলেন, দোর ছাড় পেবো, লোক হাসাস নে। মেজবৌমা, যাও বাছা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ো, আর কেলেঙ্কারী বাড়িও না।
না, সেদিন আর মুখে মুখে চোপা করে নি। সুবর্ণ। বলে নি, কেলেঙ্কারিটি তো ঘটালেন আপনিই!
সুবৰ্ণ শুধু ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল।
বাবার দিকে আর তাকায় নি।
মুক্তকেশী উদাত্ত গলায় বলেছিলেন, কত ভাগ্যে বেয়াইয়ের পায়ের ধুলো পড়ল, দোর থেকে ফিরে যাবেন বেয়াইমশাই? একটু জল খেয়ে যেতে হবে—।
আজ থাক, আজ থাক। বলে বোধ করি চোখের জল চাপতে চাপতেই গাড়িকে চালাতে বলেছিলেন নবকুমার।
খেলাটাই মাটি হল আজ, যত সব ঝামেলা— বলে প্ৰভাস ফের গিয়ে তাস ভাঁজতে বসলো, চক্ষুলজার দায়ে অগত্যা প্ৰবোধও।
মনের মধ্যে একটা আহ্লাদের ঢেউ বইছিল বৈকি।
ঝোঁকের মাথায়, আর স্ত্ৰৈণ অপবাদ ঘোচাতে, করে বসেছিল কাজটা, মনের মধ্যে তো বিছে কামডাচ্ছিল!
ԳO
যে সাংঘাতিক সিংহরাশি মেয়েমানুষ, কে বলতে পারে এ বিচ্ছেদ সত্যিই চিরবিচ্ছেদ হল। কিনা! তেমন কাণ্ড ঘটলে কতদূর জল গড়াতো কে জানে? দ্বিতীয় পক্ষ এসে কি আর ভানুকানুকে দেখতো? না চাঁপার সঙ্গে বনিয়ে থাকতো?
সে দুর্ভাবনা গেল।
এখন মান-ভাঙানোর খাটুনি।
রাতটা ওতেই যাবে আর কি!
কিন্তু সে রাতটা কি ওতেই গিয়েছিল প্ৰবোধের?
সেই রাত্রের মধ্যভাগে ভয়ানক একটা শোরগোল ওঠে নি বাড়িতে?
হ্যাঁ, ভয়ানক শোরগোলই উঠেছিল সুবর্ণর শাশুড়ীর আফিমের কৌটো চুরি করে মুক্তি পাবার হাস্যকর প্রচেষ্টায়।
হলো না কিছুই, হলো শুধু ধাষ্টিামো। তবুও কেলেঙ্কারিটা তো হলো। ডাক্তার আনতে হলো সেই মাঝরাত্তিরে, আর থানা-পুলিশের ভয়ে ডাক্তারকে দর্শনীর ওপর আবার ঘুষ দিতে হলো। যদিও গেলাস গেলাস নুনজল খাওয়ানো ছাড়া আর কিছুই করলো না ডাক্তার।
সে নির্লজ্জ খৃষ্টতার প্রসঙ্গে জীবনভোর অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা খেতে হয়েছে সুবৰ্ণাকে।
এমন কি যে ভাসুর কখনো কিছু বলে না, সে পর্যন্ত বলেছে, বস্তা বস্তা নাটক নভেল পড়ে এইটি হয়েছে আর কি!
তা সত্যিই হয়তো পড়েছে সুবর্ণ, বস্তা বস্তাই পড়েছে। সেই বস্তা বস্তার কল্যাণে বস্তা বস্তা কথাও হয়তো শিখেছে, কিন্তু আফিমের মাত্ৰাটা কতখানি হলে সেটা ধাষ্টামো না হয়ে মুক্তিফলপ্ৰসূ হয়, সে কথা শেখে নি!
তা যদি শিখতে পারতো, তা হলে সুবৰ্ণলতার জীবন-নাট্যে সেখানেই যবনিকা পড়ে যেত।
বিয়ের মাত্রা সম্পর্কে কোনো দিন কোনো জ্ঞানই যদি থাকতো সুবৰ্ণলতার! কিন্তু ওকথা থাক। এখন প্ৰবোধচন্দ্র আর সুবৰ্ণলতার যে বৃহৎ ফটোগ্রাফ দুখানা মুখোমুখি টাঙানো রয়েছে ওদের বড় ছেলের ঘরে, তাদের বেষ্টন করে ফুলের মালা দুলছে।
প্রতি বছর শ্ৰাদ্ধবার্ষিকীতে শুকনো মালা বদলে নতুন মালা দেওয়া হয়।
সার্থক জীবনের প্রতিমূর্তি ওই ছবিটা দেখে কে বলতে পারবে গায়ে কেরোসিন ঢালা বাদে আত্মঘাতী হবার যত রকম পদ্ধতি আছে, সবই একবার করে দেখে নিয়েছে মানুষটা!
কিন্তু আশ্চৰ্য, আশ্চর্য!
শেষ পর্যন্ত ক্ৰটি থেকে গিয়েছে সমস্ত পদ্ধতিতেই। হয়তো। ওটাই বিধিলিপি সুবৰ্ণর! নইলে কে কবে শুনেছে। ছাত থেকে লাফিয়ে পড়েও বাঁচে মানুষ!
অবিশ্যি রান্নাঘরের ছাত, একতলা, নিচু—তবু ছাত তো!
পড়েছিল সেই ছাত থেকে!
তদবধি ছাতের সিঁড়ির দরজাটা বন্ধ করা থাকতো। চাবি থাকতো মুক্তকেশীর হাতে।
মুগ্ধই কি দয়াদাক্ষিণ দেখিয়েছেন, কিছু?
কিছু না।
যোগে গঙ্গাস্নানের বায়না নিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গে চুপি চুপি গঙ্গাস্নানে গিয়ে দেখেছে—হয় নি।
লাভ হয় নি!
কেউ কোনোদিন এ সন্দেহ করে নি, সুবৰ্ণ স্রেফ তলিয়ে যাবার জন্যে আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে।
তাই চেষ্টা সফল হতো না।
সঙ্গে যারা যেত তারাই সহসা ওর হাত ধরে টান দিত, যাচ্ছ কোথায়? এই ঘাটের কাছে কাছে থাক না? অত এগোবার দরকার কি?
কিন্তু এতই বা অতিষ্ঠ কেন সুবৰ্ণলতা?
উমাশশী, গিরিবালা, বিন্দু, এরাও তো থেকেছে ওই একই পরিবেশে? কই, ওরা তো রাতদিন মরণের বাসনায় উদ্বেল হয় নি?
হয়তো সত্যিই মূল কারণ ওই বস্তা বস্তা নাটক-নভেল! আর তো কারণ দেখা যায় না!
কিন্তু সেই বস্তা বস্তার আমদানিকারক ছিল কে? ওই যুগের থেকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে থাকা বাড়িটার অন্ধকার অন্তঃপুরে এসে ঢুকতো তারা কোন পথে? নতুন নতুন বই আর পত্র-পত্রিকা এসে এসে ঢুকতোও তো!
চলতি সাহিত্যের ওই খবরটা কি সে রাখতো? ওই যোগানদার? নাকি সুবৰ্ণলতার নির্দেশে খুঁজে আনতো?
সুবৰ্ণলতার নির্দেশ!
সুবৰ্ণলতা আবার নির্দেশ দিতে যাবে কাকে?
তা ছিল একজন।
যে নাকি সুবৰ্ণলতার নির্দেশ মানতে পেলে কৃতাৰ্থ হতো।
ক্ষ্যাপাটে ক্ষ্যাপাটে ছেলেটা, ভালো নামের ধার কেউ ধারতো না, দুলো নামেই বিখ্যাত। স্কুলে ক্লাসে প্রমোশন পাওয়া ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে হারাতে দেখা যেত না তাকে। অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা ধরতো দুলো।
সুশীলার কোন এক দূর সম্পর্কের ভাগ্নে, সেই সূত্র ধরে এদের বাড়িটাকে বলতো, মামার বাড়ি, সুবৰ্ণকে বলতো মামী।
সুবৰ্ণকে বই যোগাবার ভার নিয়েছিল সে।
কেন নিয়েছিল কে জানে!
হয়তো তার ক্ষ্যাপাটে বুদ্ধিতে অপরকে খুশি করবার প্রেরণাটাই এর কারণ। সবাইকে খুশী করতে সাধ হতো তার। তা ছাড়া মেজমামীর উপর অহেতুক একটা টান ছিল দুলোর।
বোধ করি হৃদয়ের ক্ষেত্রে কোথায় কোনোখানে তারা ছিল সমগোত্র। এ বাড়ির মেজবৌও যে একটু ক্ষ্যাপাটে, এ তো সর্বজনবিদিত।
কোথা থেকে যে দুলো নানাবিধ বই কাগজ সংগ্রহ করে আনতো দুলোই জানে। সুবৰ্ণলতা প্রশ্ন করলে বলতো, মল্লিকবাবুর বাড়ি থেকে আনি। মল্লিক। বাবু যে সক্কল বই কেনে গো! টাকার তো অধিবাদি নেই ওনার! আর বলে, দুলো রে, লক্ষ্মী সার্থক হয়। সরস্বতীকে কিনে।
কী সূত্রে যে দুলো সেই লক্ষ্মীর বরপুত্র ও সরস্বতীর প্রিয় পুত্র মল্লিকবাবুর বাড়িতে ঢুকে পড়বার ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছিল, সে কথা বোধ হয়। দুলো নিজেই ভুলে গেছে। তবে দেখা যায় দুলোর সেখানে অবাধ গতিবিধি। দুলো যথেচ্ছ বই আনে।
ব্যাপারটা সন্দেহজনক।
সুবৰ্ণরও হয়েছিল সন্দেহ। চুরি নয় তো?
সে সন্দেহ ব্যক্ত করেছিল সুবর্ণ অন্য প্রশ্নে। বলেছিল, তুই তো নিজে পড়তে লিখতে জনিস না, বই চাইলে রাগ করে না?
দ্যুলোকে কেউ কখনো তুমি করে না।
সুবৰ্ণও করলো না।
বলল, তুই তো পড়িস না? ওরা রাগ করে না?
দুলো মেয়েদের মত গালে হাত দিত, রাগ করবে, কী বল? যারা বই পড়তে ভালবাসে, মল্লিকবাবু তাদের খুব ভালবাসে। মেয়েছেলেরা পড়লে তো আরোই। বলে, মেয়েছেলেরা যতদিন না। মানুষ হচ্ছে, ততদিন আর আমাদের দেশের দুঃখু ঘুচিবে না। ওনার বাড়ির সবাই তো ক অক্ষর গো-মাংস! বলে, তুই একটা আমার ভক্ত জুটলি, তাও মুখ্যু! আমার কপোলই এই। আমি যদি পড়তে ভালবাসতাম, মল্লিকবাবু বোধ হয় আলমারি সুন্ধু সব বই দিয়েই দিত। আমায়! … আচ্ছা! মেজমামী, রাতদিন যে দেশের দুঃখু দেশের দুঃখুটা করে মল্লিকবাবু, দেশের দুঃখুটা কী?
আছে দুঃখু, তুই বুঝবি না—, সুবর্ণ উত্তেজিত হত, দেশের কথা আর কি বলেন তোর মল্লিকবাবু?
কত বলে! একগাদা লোক আসে, আর ওই গপপোই তো হয় বৈঠকখানায়া!
তুই শুনিস না সেসব কথা?
সুবৰ্ণলতার স্বর চাপা, উত্তেজিত।
দুলো মেজমামীর এই ভাবের কারণটা বুঝতে পারে না। হেসে ফেলে বলে, শুনবো না কেন? এক কান দিয়ে শুনি, এক কান দিয়ে বার করি।
কেন তা করিস? মনে রাখতে পারিস না?
দুলো অবাক হয়ে বলে, শোনো কথা, আমার কিসের দুঃখ যে ওই শখ করে টেনে আনা দুঃখুকে বরণ করতে বসবো? এ তো বেশ আছি!
না, বেশ নেই! সুবর্ণ উত্তেজিত গলায় বলে, আছে দুঃখু। বুঝতে হবে সেটা।
দুলো মনে মনে বলতো, মল্লিকবাবু আর আমাদের মেজমামীটা দেখছি। একই জাতের পাগল। তারপর বলে বসতো, মল্লিকবাবু ঠিক তোমার মতন কথা বলে। তোমাকে যদি দেখতে পেতো, নিৰ্ঘাত খুব ভালবাসতো। দেখার ইচ্ছেও রয়েছে—
সুবৰ্ণর গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে।
সুবৰ্ণ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, দূর বোকা ছেলে। বলতে নেই। ও-কথা। খবরদার আর ও-কথা কখনো মুখে আনিস নি।
দুলো ভয়ে ভয়ে বলে, বাবু বলছিলো কিনা সেদিনকে-
কি বলছিল?
বলছিল, মেয়েমানুষ হয়ে এত শক্ত শক্ত বই এত তাড়াতাড়ি পড়ে ফেলে, দেখতে আহ্লাদ হয়। তোর মেজমামীকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে দুলো!
চুপ চুপ, একদম চুপ!
ক্ষ্যাপা ছেলেটাকে থামিয়ে দিত সুবর্ণ। কিন্তু থামাতে পারতো না নিজের ঘরটাকে, আর সে ঘরের মালিককে দেখতে? যাকে সুবৰ্ণ দেবতারূপে কল্পনা করে রেখেছে?
তা দেবতা ছাড়া আর কি?
যে ব্যক্তি বোঝে লক্ষ্মীর সাথীর্কতা সরস্বতীকে আহরণ করায়, আর দেশের দুঃখ যার মনকে স্পর্শ করে, দেবতাই সে!
সংসারে এইসব মানুষও আছে।
তিনি নাকি এই দুঃখ নিয়ে আলোচনা করেন, বক্তৃতা দেন, সুরেন বাঁড়ুয্যে, বিপিন পাল এঁদের সঙ্গে নাকি চেনা-জানা আছে তার, রবি ঠাকুরকে নাকি অনেকবার দেখেছেন তিনি। কী অলৌকিক কথা!
অথচ ওঁর বৌ নাকি ওসব দুচক্ষের বিষ দেখে। নাকি রাতদিন বাড়িতে গোবরজলের ছড়া দিয়ে বেড়ায় সে, ভিজে কাপড় পরে।
আশ্চর্য! আশ্চর্য! পৃথিবীটাই কি তাহলে এই রকম?
একখানা পত্রিকায় প্ৰবন্ধ পড়ছিল সুবর্ণ, ময়াল সাপের কথা নিয়ে।
ময়াল সাপ নাকি হিমশীতল আলিঙ্গনে গায়ের উপর পাকে পাকে এঁটে বসে, চোখে ধরা পড়ে না এমন আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকে, সে চাপ ক্রমশ বজকঠিন হয়ে বসে।…সেই অদৃশ্য নিষ্ঠুর পেষণে বাইরের চেহারাটা অবিকল রেখেও—চুর্ণ করে ফেলে অধিকৃত শিকারের হাড়গোড়।
পড়তে পড়তে উত্তেজিত হচ্ছিল সুবৰ্ণ, অন্য আর একটা কিসের সঙ্গে যেন ওই সাপটার প্রকৃতির মিলা খুঁজে পাচ্ছিল।…
ঠিক ঠক করে জানলায় টোকা পড়লো।
উৎফুল্ল মুখে উঠে বসলো সুবর্ণ।
আবার বই!
দুলোর ওপর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। সুবর্ণর এতটা বয়সে একমাত্র ক্ষ্যাপাটে ছেলেটার মধ্যে অকারণ ভালবাসার প্রকাশ দেখেছে।
জানলায় টোকা, এটা বই আনার সঙ্কেত। একতলার একটা গলির পাশের ঘর বেছে নিয়েছে সুবৰ্ণ দুপুরবেলার বিশ্রামালয় হিসেবে।
এখান থেকে এই পদ্ধতিটায় কাজ সহজে হয়। দুলো জানলায় টোকা দেয়, সুবৰ্ণ জানলা খুলে দেয়, সেই পথে বই প্রেরণ করে দুলো।
এ ছাড়া উপায় কি?
নিত্য এত নাটক-নভেল সরবরাহ করছে দেখলে দুলোকে পাশপেড়ে কাটবে না। এ বাড়ির গিন্নী আর তার ছেলেরা?
এ ঘরটা প্রকৃতপক্ষে বাড়ির যত আপদ-বালাইয়ের ঘর! সিঁড়ির ওপর চিলেকোঠা তো নেই, তাই এই প্ৰায়-পাতাল ঘর!
ভিতরের অন্ধকার-অন্ধকার দালানের দিকে একটামাত্র দরজা, আর পিছনের অন্ধকার-অন্ধকার গলির দিকে দুটো জানলা। আয়তনের অনুপাতে যাদের গবাক্ষ বলাই সঙ্গত।
এই জানলা দিয়ে সরু যে দুটি আলোকরেখা ঘরে প্রবেশ করে, সেই হচ্ছে সুবর্ণর আলোকবর্তিকা।
ওইটুকুকে সম্বল করে যে পড়তে পারে, সে বোধ করি সুবর্ণ বলেই।
একদা ভাড়ারঘর থেকে একটা নড়বড়ে চৌকি বাতিল করে এ ঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেটাই সুবর্ণর রাজশয্যা।
এ ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা, গোলমাল নেই। এই ছুতো দেখিয়ে দুপুরে এই ঘরেই পড়ে থাকে সুবর্ণ।
না, এখন আর দুপুরের অবসরে সুপুরি কাটা কি চাল-ডাল বাছার কাজ করতে হয় না বৌদের, তাদের মেয়েগুলো তো ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে, তারাই করে।
তা ছাড়া আর যে করে সে করে, সুবর্ণ কিছুতেই না। সুবর্ণর এই মৌতাতটি চাই।
চৌকির মাথার কাছের জানলা খুলে বই পড়ছিল সুবর্ণ, বাকি জানলাটা বন্ধ ছিল। টোকা পড়েছে সেটাতে।
সহাস্য মুখে চৌকি থেকে নেমে এসে জানলাটা খুলে দিয়ে চুপি চুপি বলে, আবার পেয়েছিস আজ?
চারটে-, দুলো বিগলিত আনন্দে বইগুলো বাড়িয়ে ধরে।
দুলোর মুখে যেন একটা চাপা আনন্দোচ্ছাস!
এ কী শুধুই বইয়ের আহ্লাদ।
সরু জানলা, ঘোষাৰ্ঘেষি গরাদে, একটি একটি করে বই টেনে নিতে হয়।
বইগুলো শেষ করেই বলে ওঠে দুলো, কপাটটা হাট করে খুলে এখানটায় দাঁড়াও তো মেজমামী!
কেন রে?
বিস্মিত প্রশ্ন করে সুবর্ণ।
দুলো ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে নিচুপের ইশারা করে। নিচু গলায় বলে, আছে। মজা, দাঁড়াও!
কাঠের গরাদেতে মুখটা চেপে ধরে সুবর্ণ বাইরেটা দেখবার চেষ্টা করে, কোথায় দুলোর মজা অবস্থান করছে।
ইতস্তত চাইতেই চমকে উঠলো। সিঁদুরের মত লাল হয়ে উঠলো মুখটা।
পরীক্ষণেই মাথাটা সরিয়ে নিয়ে চৌকির উপর এসে বসে পড়ল!
এই মজা!
বোকা ছেলেটার এ কী কাণ্ড!
কাকে ডেকে এনেছে ও জানলার নিচেয়?
সন্দেহ নেই। ওই মল্লিক। বাবু!
না বলে দিলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না।
ছি ছি! এ কী করে বসলো দুলো!
অথচ অনেক বুদ্ধি খাঁটিয়ে এই ঘটনাটি ঘটিয়ে বসেছে দুলো।
এই দুটো মানুষই যে পরস্পরকে দেখতে পেলে খুশী হবে, এমন একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল তার, অতএব ভেবে নিয়েছিল সেই খুশিটা করতে হবে।
চালাকি একটু করতে হয়েছে।
মল্লিকাবাবুকে বলতে হয়েছে, মেজমামীর একান্তো। ইচ্ছে তোমায় একবার দেখে। বলে, এত বই কেনে, আবার অপরকে পড়তে দেয়, কেমন সেই মানুষটি একবার দেখতে সাধ হয় রে দুলো!
প্রায়ই বলেছে।
রোজই বলেছে।
এ কথাও বলেছে, মেজমামী যদি মেয়েমানুষ না হোত নিজেই আসতো। ওরাও তো আবার আপনার মতন দেশের দুঃখুর বাই!
অবশেষে এই ঘটনা।
ভদ্রলোক হয়তো ভদ্রতার বশেই এমন অভদ্র কাজটা করতে স্বীকৃত হয়েছেন।
কিন্তু সুবর্ণর সে-সব জানিবার কথা নয়, তাই সুবর্ণ ভাবে, ছিছি, উনিই বা কেমন!
তবে কি সুবর্ণ যা ভাবে তা নয়?
বোকা ছেলেটাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বই ঘুষ দেওয়াটাও কি তাহলে এই উদ্দেশ্যে?
কিন্তু তাই কি?
সেই মুহূর্তের দেখাতেও উজ্জ্বলকান্তি সেই মানুষটার দুই চোখে যে দৃষ্টি দেখেছে সুবর্ণ, সে কি অসৎ চরিত্র পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টি?
তা তো নয়।
সে দৃষ্টিতে যেন সসম্ভ্রম পূজো!
সে দৃষ্টি আর কবে কোথায় দেখেছে সুবৰ্ণ?
দুলো ভেবেছিল ঘটনান্তে ঘুরে সদর দরজা দিয়ে বাড়ি এসে ঢুকবে সে, এবং মহোৎসাহে রসিয়ে রাসিয়ে গল্প করবে। কেমন করে এমন কৌশলটি করেছে। দুলো!
কিন্তু মেজমামীর সেই মুহূর্তের ভঙ্গিতেই সব সাহস উবে গেল তার।
সর্বনাশ করেছে!
মেজমামী রাগ করেছে!
অথচ বেচারা কত আশায় স্বপ্ন দেখতে দেখতে আসছে। পলায়ন করা যাক বাবা!
কিন্তু দুলোর সেদিন পলায়ন করা হয় নি।
এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডটি চোখে পড়েছিল। আর কারো নয়, প্রভাসচন্দ্রের চোখে।
শরীরটায় তেমন জুৎ ছিল না বলে, অসময়ে কোর্ট থেকে ফিরে আসছিলো, দূরে থেকে দেখলো দুটো লোক যেন গলিতে ঢুকলো।
একটা তো দুলো, আর একটা?
ধীরে ধীরে ওদের পিছু নিয়েছিলো প্ৰভাস।
তার পরেই চোখে পড়ল। এই দুর্নীতিপূর্ণ দৃশ্য!
একটি সুকান্তি ভদ্রলোক ফিন্ফিনে আদির পাঞ্জাবি গায়ে, মিহি ধুতির লম্বা কোঁচা, মেজবৌয়ের বিশ্রামঘরের জানলার নিচে গিয়ে দাঁড়ালো—যেন জুলিয়েটের রোমিও! যেন যমুনাতীরের কেষ্ট!
দুলো হারামজাদা কী যেন একটা জিনিস। পাচারও করলো জানলা দিয়ে! এতেও পুরুষের রক্ত টগবগিয়ে ফুটে উঠবে না? বংশমর্যাদার চেতনা নেই মুক্তকেশীর ছেলেদের?
এ যদি প্ৰবোধ হত, খুন একটা হয়েই যেত আজ মুক্তকেশীর গলিতে! হয়। দুলো, নয়। ওই প্ৰেমিকটি!
প্ৰভাস বলেই প্ৰাণে বাঁচালো!
লোকটার গায়ে হাত দিতে বেধেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বড়লোকের ছেলে। পরে মোচড় দিয়ে উঁকিলের ঘরে কিছু এনে ফেলতে হবে।
তাই শুধু রূঢ় কথা, নাম-ঠিকানা জেনে নেওয়ার উপর দিয়েই গেল।
কিন্তু দুলো?
কুটুমের ছেলে বলে কি রেয়াৎ করা হোল তাকে?
না, তা হয়নি।
দুলোর বুদ্ধিটা কম, গতরটা কম গতরটা কম নয়। পাড়ার লোক তাকে গুণ্ডা নামে ডাকতো। সেই দুলো সেদিন মার খেতে খেতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
চান্দা করে মেরেছিল পাড়ার লোকেরাও।
জ্বরো কুকুরের মত জিভ বার করে হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ পর্যন্ত লটকে পড়েছিল ছেলেটা।
কিন্তু ওইটুকুই কি ঝড়?
মরে তো আর যায় নি যে ঝড়কে ঝড় বলা হবে?
গায়ের ব্যথা মরতে কদিন লাগবে?
ঝড়টা অন্য মূর্তিতে বাড়ির ওপর আছড়ে পড়েছিল।
এ বাড়ির মেজবৌ রাস্তায় বেরিয়ে এসে আধমরা ছেলেটাকে ওই হিংস্রতার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। মাথার ঘোমটা খুলে আর গলা তুলে বলেছিল, তোমরা মানুষ না কসাই?
বলেছিলো, ওকে কেন? মারো আমাকে মারো! এ মার তো দুলোর প্রাপ্য নয়, আমার প্রাপ্য!
বলেছিল, আমায় যদি মেরে শেষ করতে, তোমরাও রেহাই পেতে, আমিও রেহাই পেতাম।
শুধু যে গলাই খুলেছিল। তাই নয়, ছেলেটাকে হিচড়ে টেনে নিতে নাকি পাড়ার পুরুষদের হাতে হাত ঠেকেছিল তার।
এর পর যে একটা ভয়ানক ঝড় উঠবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
সে ঝড়ের তুলনা মেলে চৈত্র-বৈশাখের সন্ধ্যায়। কালবৈশাখীতে।
সে ঝড়ে গাছ পড়ে, চাল ওড়ে, পাকাবাড়ির দেওয়াল সুদ্ধ দোলে।
যেমন ঝড়ে দর্জিপাড়ার এই গলিটা উদ্দাম হয়ে ওঠে, বীভর্ৎস হয়ে ওঠে। দশ-বারোটা বাড়ির বাসি উনুনের ছাই উচ্ছিষ্ট ভাত আর এঁটো শালপাতায় উপচে ওঠা ডাস্টবিনটা উল্টে গড়াগড়ি খেতে থাকে, পাতা আর নোংরা কাগজের টুকরো ঝাঁপটে এসে গৃহস্থের ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে, সমস্ত গলিটা আবর্জনার কুণ্ডে পরিণত হয়।
সেই কালবৈশাখীর ঝড় উঠল। সেদিন মুক্তকেশীর বাড়িতে।
এতদিনে টের পেয়ে গেছে। সবাই, নির্জনে নিচের তলার ঘরে বিশ্রাম করার বাসনা কেন সতীলক্ষ্মী মেজবৌয়ের!
তেজী পাজী হারামজাদী এটাই জানতো সবাই, এখন তো দেখা গেল। কতখানি নষ্ট, কত বড় জাঁহাবাজ ও!
মুক্তকেশী বলেছিলেন, মানুষের রক্ত যদি তোর গায়ে থাকে তোও বৌকে লাথি মেরে মেরে ফেল পেবো। আর যদি জন্তু-জানোয়ার হোস তো পরিবারকে মাথায় করে ভেন্ন হয়ে যা। নষ্ট মেয়েমানুষ নিয়ে ঘর করতে মুক্ত-বামনী পারবে না।