রামায়ণ : সুন্দরাকাণ্ড – হনুমান কর্ত্তৃক অমৃত বন ভঞ্জন ও বনরক্ষী রাক্ষসগণের সংহার
দেখান অঙ্গুলি দ্বারা সীতা সেই বন।
নিঃশব্দে চলিল বীর পবন-নন্দন।।
জাল দড়া দিয়া বান্ধা আছে চারি পাশ।
তাহা দেখি মারুতির উপজিল হাস।।
খাইতে না পায় পক্ষী রাক্ষসেরা রাখে।
ধীরে ধীরে হনুমান সেই বনে ঢোকে।।
নেউল প্রমাণ হয়ে বৃক্ষডালে আছে।
তাহারে দেখিয়া পক্ষী নাহি রহে গাছে।।
ফল রাখে হনুমান ডালে ডালে পড়ি।
দেখিয়া রাক্ষস সব হেসে গড়াগড়ি।।
রাক্ষসেরা বলে, এ বানর নাহি মারি।
রাখুক বানর ফল, নিদ্রা আগে সারি।।
বৃক্ষমূলে নিদ্রা যায় সে রাক্ষসগণ।
ফল সব খায় বীর পবন-নন্দন।।
ফল ফুল খায় বীর ছিঁড়ে আরো পাতা।
উপাড়িয়া ফেলে গাছ কোথা বৃক্ষ লতা।।
ডাল ভাঙ্গে হনুমান শব্দ মড় মড়ি।
আতঙ্কে রাক্ষস সব উঠে দড়বড়ি।।
উঠিয়া রাক্ষসগণ চারিদিকে চায়।
অমৃতের বন দেখে কিছু নাহি তায়।।
নানা অস্ত্র ঝকড়া শেল মুষল মুদগর।
বহু অস্ত্র মারে তারা হনুর উপর।।
নানা অস্ত্র রাক্ষসেরা ফেলে অতি কোপে।
লাফে লাফে হনুমান সব অস্ত্র লোফে।।
কুপিলেন হনুমান পবন-নন্দন।
সবার উপরে করে গাছ বরিষণ।।
গাছ লৈয়া হনুমান যায় তাড়াতাড়ি।
গাছের বাড়িতে মারে দশ পাঁচ কুড়ি।।
হনুমান যুঝে যেন মদমত্ত হাতী।
কারে মারে চাপড় কাহারে মারে লাথি।।
দশ বিশ চেড়ী ধরি মারিছে আছাড়।
মাথার খুলি ভাঙ্গি কার চূর্ণ করে হাড়।।
প্রাণ লৈয়া কত চেড়ী পলাইল ত্রাসে।
সীতারে জিজ্ঞাসে বার্ত্তা ঘন বহে শ্বাসে।।
চেড়ী সব কহে সীতা কহ সত্য বাণী।
বানরের সহিত কি কহিলে কাহিনী।।
সীতা বলিলেন কোন্ জন মায়া ধরে।
আমি কি জানিব, সবে জিজ্ঞাস বানরে।।
ভাঙ্গিল অশোক বন, বড় বড় ঘর।
ত্রাসে বার্ত্তা কহে গিয়া রাবণ-গোচর।।
আসিয়াছে কোথাকার একটা বানর।
অমৃতের বন ভাঙ্গে বড় বড় ঘর।।
যে সীতার প্রতি তুমি সঁপিয়াছ মন।
হেন সীতা বানরে করিল সম্ভাষণ।।
সীতা নাড়ে হাতটি বানরে নাড়ে মাথা।
বুঝিতে নারিনু নর বানরের কথা।।
ঝটিতি বান্ধিয়া আনি করহ বিচার।
বিলম্ব হইলে কারো নাহিক নিস্তার।।
কুপিল রাবণ রাজা চেড়ীদের বোলে।
ঘৃত দিলে অগ্নিতে যেমন আরো জ্বলে।।
মার মার শব্দ করে তর্জ্জন গর্জ্জন।
দশানন দশদিক করে নিরীক্ষণ।।
সম্মুখে দেখিল মূঢ় নামেতে কিঙ্কর।
তারে আজ্ঞা দিল রাজা ধরিতে বানর।।
চলিল কিঙ্কর মূঢ় যমের দোসর।
ত্বরা করি গেল হনুমানের গোচর।।
রাক্ষস ধাইয়া যায় বধিতে হনুমান।
প্রাচীরে বসিল বীর পর্ব্বত প্রমাণ।।
জাঠা শেল ঝকড়া মূষল ফেলে কোপে।
লাফে লাফে হনুমান সব অস্ত্র লোফে।।
উপাড়ে ঘরের থাম পর্ব্বত আকার।
থামের বাড়িতে বীর করে মহামার।।
আথালি পাথালি মারে দোহাতিয়া বাড়ি।
পড়িয়া কিঙ্কর মূঢ় যায় গড়াগড়ি।।
পাঠাইল মারিয়া মূঢ়েরে ঘমঘর।
বাছিয়া উপাড়ে গাছ চাঁপা নাগেশ্বর।।
যে স্থানে থাকেন সীতা, তাহা মাত্র রাখে।
আর সব চূর্ণ করে যা দেখে সম্মুখে।।
দশ বিশ জনে ধরি মারিছে আছাড়।
মস্তক ভাঙ্গিয়া কারো চূর্ণ করে হাড়।।
সাগরের কূলে যত বালি খরশান।
তাহার উপরে মুখ ঘষে হনুমান।।
পলাইল বহুজন পাইয়া তরাস।
রাবণেরে বার্ত্তা কহে ঘন বহে শ্বাস।।
দেখিলাম যে কিছু কহিতে করি ডর।
পড়িল কিঙ্কর মূঢ় শুন লঙ্কেশ্বর।।
লঙ্কা মজাইল আজি একটা বানর।
সহিতে না পারি আর করিল জর্জ্জর।।