রামায়ণ : সুন্দরাকাণ্ড – সীতার সহিত হনুমানের সাক্ষাৎকার ও আত্মপরিচয় প্রদান
হনুমান ভাবে সব চেড়ী ঘরে গেল।
সীতা সম্ভাষিতে মোরে এই বেলা হৈল।।
বৃক্ষডালে হনুমান সীতা ভূমিতলে।
কি বলিয়া সম্ভাষিব মনে যুক্তি বলে।।
বলিলে রামের দূত না যাবে প্রত্যয়।
আমার কারণে হবে দুঃখ অতিশয়।।
তবে ত সকল কার্য্য হইবে বিনাশ।
অসম্ভাষে গেলে হবে রামের নিরাশ।।
সাত পাঁচ হনুমান ভাবেন আপনি।
আপনা আপনি কহে শ্রীরাম-কাহিনী।।
শ্রীরাম বলিয়া সীতা করেন ক্রন্দন।
শ্রীরামের কথা কহে পবন-নন্দন।।
যজ্ঞশীল দানশীল দশরথ রাজা।
দেবলোক নরলোক সবে করে পূজা।।
জ্যেষ্ঠপুত্র রাম, তাঁর বধূ সীতা-সতী।
হরণ করিল তাঁরে রাবণ দুর্ম্মতি।।
কাননে ভ্রমেন রাম সীতা অন্বেষণে।
সুগ্রীবের সহ মৈত্রী করিলেন বনে।।
সে রামের বৃত্তান্ত তোমারে যায় বলা।
মাথা তুলি দেখ যদি সেবক-বৎসলা।।
মাথা তুলি সীতাদেবী সে গাছ নেহালে।
বিঘত প্রমাণ কপি দেখেন সে ডালে।।
সীতা হনুমান দোঁহে হইল দর্শন।
যোড়হাতে মাথা নোঙায় পবন-নন্দন।।
জানকী বলেন, বিধি বিগুণ আমায়।
রাবণের দূত বুঝি আমারে ভুলায়।।
নানাবিধ মায়া জানে পাপিষ্ঠ রাবণ।
বানর রূপেতে বুঝি করে সম্ভাষণ।।
দশ মাস করি আমি শোকে উপবাস।
মম-সঙ্গে কি লাগিয়া কর উপহাস।।
স্বরূপেত হও যদি শ্রীরামের চর।
আমার বরেতে তুমি হইবে অমর।।
অগ্নিতে পুড়িবে নাহি, অস্ত্রে না মরিবে।
রণে বনে তব রক্ষা শঙ্করী করিবে।।
তব কণ্ঠে সরস্বতী হন অধিষ্ঠান।
যেখানে সেখানে যাও সর্ব্বত্র সম্মান।।
বানর কি নাম ধর, থাক কোন্ দেশে।
কি হেতু আইলে হেথা কাহার আদেশে।।
বহুদিন শ্রীরামের না জানি কুশল।
আমার লাগিয়া প্রভু আছেন দুর্ব্বল।।
হইবে রামের দূত, হেন অনুমানি।
তব মুখে শুনিলাম প্রভুর কাহিনী।।
হনুমান বলে, রাম গুণের সাগর।
আকৃতি প্রকৃতি কিবা সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর।।
শালগাছ জিনি তাঁর প্রকাণ্ড শরীর।
আজানুলম্বিত বাহু, নাভি সুগভীর।।
তিলফল জিনি নাসা সদৃশ্য কপাল।
ফল মূল খান তবু বিক্রমে বিশাল।।
দূর্ব্বাদল-শ্যাম রাম গজেন্দ্র গমন।
কন্দর্প জিনিয়া রূপ ভুবনমোহন।।
অনাথের নাথ রাম সকলের গতি।
কহিতে তাঁহার গুণ কাহার শকতি।।
রামের সেবক আমি নাম হনুমান।
বিশেষ করিয়া কহি কর অবধান।।
আপনি যে স্বর্ণমৃগ দেখিলে সুন্দর।
মারীচ রাক্ষস সেই রাবণের চর।।
তাহাকে মারিতে রাম করেন প্রয়াণ।
শ্রীরামের বাণেতে সে হারাইল প্রাণ।।
তোমার দুর্ব্বাক্যে ঘর ছাড়িল লক্ষ্মণ।
শূন্য-ঘর পেয়ে তোমা হরিল রাবণ।।
পর্ব্বত-শিখরে বসি মোরা পঞ্চ জন।
ছিন্ন বস্ত্র অকস্মাৎ পড়িল তখন।।
দিলাম সে ছিন্ন বস্ত্র শ্রীরামের স্থানে।
বহু কাঁদিলেন রাম লক্ষ্মণ দুজনে।।
আছাড় খাইয়া রাম লোটান ভূতলে।
সুহৃদ সুগ্রীব তাঁরে আশ্বাসিয়া তোলে।।
করিল সুগ্রীব সত্য তোমা উদ্ধারিতে।
রাজত্ব দিলেন তাঁরে ম্রীরাম ত্বরিতে।।
আইল বানর সর্ব্ব সুগ্রীব আশ্বাসে।
চতুর্দ্দিকে গেল সবে তোমার উদ্দেশে।।
আসিতে মাসের মধ্যে রাজার নিয়ম।
মাসেক অধিক হৈলে হবে ব্যতিক্রম।।
পাতালে প্রবেশ করি মহা অন্ধকার।
মরিবারে কপি সব যুক্তি করি সার।।
সম্পাতি নামেতে পক্ষী গরুড়-নন্দন।
তার মুখে শুনিলাম তব বিবরণ।।
পর্ব্বতের উপরে তাহার পাই দেখা।
রাম নাম বলিতে তাহার উঠে পাখা।।
তার বাক্যে লঙ্ঘিলাম দুস্তর সাগর।
লঙ্কার সকল স্থান হইল গোচর।।
রাবণের চর বলি না করিহ ভয়।
স্বরূপে রামের দূত জানিহ নিশ্চয়।।
আমার বচনে যদি না হয় প্রত্যয়।
রামের অঙ্গুরী দেখ হইবে নিশ্চয়।।
অঙ্গুরী দেখায় তাঁরে পবন-নন্দন।
অনিমিষে জানকী করেন নিরীক্ষণ।।
রামের অঙ্গুরী দেখি হইল বিশ্বাস।
হস্ত পাতি লইলেন জানকী উল্লাস।।
বুকে বুলাইয়া সীতা শিরে ধরি বন্দে।
রামের অঙ্গুরী পেয়ে সীতাদেবী কান্দে।।
অঙ্গুরীর পানে চাহি কন ঠাকুরাণী।
দিবানিশি কাঁদি আমি জনক-নন্দিনী।।
শুনহ অঙ্গুরী, তুমি রামের নিশান।
দ্বিগুণ তোমায় দেখি কান্দি উঠে প্রাণ।।
যে-কালে জনক পিতা দান কৈলা মোরে।
মোর আগে বরণ সে করিলা তোমারে।।
তাম্রপাত্রে গঙ্গাজল, তিল-তুলসী তাতে।
তোমারে আমারে পিতা সঁপে রাম হাতে।।
তোমায় আমায় দোঁহে লৈলা রঘুমণি।
সেই হৈতে হৈলে তুমি আমার সতিনী।।
বিধি বাম হইলেন, আমি অভাগিনী।
রাবণ হরিল মোরে, সঙ্গে রৈলা তুমি।।
পড়িলাম যবে আমি শ্রীরামের মনে।
আমার অভাবে রাম চান তব পানে।।
অঙ্গুরী, দোসর তুমি ছিলে রাম-সনে।
রামকে রাখিয়া একা হেথা এলে কেনে।।
আর এক কথা আমি বলি তব স্থান।
অভাগিনী বলে মনে করেন শ্রীরাম।।
আমা-ছাড়া হয়ে রাম রন বহুদিন।
আমার বিহনে কত হয়েছেন ক্ষীণ।।
এত বলি জানকী কপালে মারে হাত।
দাসী-হেতু এত দুঃখ পাও রঘুনাথ।।
জানকী বলেন, শুন পবন-কুমার।
আমার দুঃখের আর নাহি দেখি পার।।
যেদিন হতে সঙ্গ ছাড়া হলেন গোঁসাই।
সেদিন হতে ফল-জল কিছু খাই নাই।।
বাঁচে কি না বাঁচে আর জনক-ঝিয়ারী।
কোথা রাখি বাছা হনু, রামের অঙ্গুরী।।
এত বলি অঙ্গুরীকে লৈলা ঠাকুরাণী।
অঙ্গুরী পরিতে চান জনক-নন্দিনী।।
অঙ্গুরী পরিলা সীতা দৃঢ় করি মন।
অঙ্গুরী হইল ঠিক হাতের কঙ্কণ।।
ইহা দেখি কান্দিয়া বিকল হনুমান।
রাম সীতা দুই ক্ষীণ একই সমান।।