সিন্ধুপারের পাখি (Sindhuparer Pakhi) : 03
এটা উনিশ শ’ এগারো সাল।
আঠার শ’ আটান্নতে বন্দি উপনিবেশের পত্তন হয়েছে আন্দামানে। উনিশ শ’ দুই সালে আট শ’ কুঠুরির সেলুলার জেল তৈরি হয়ে গিয়েছে। শহর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে দূরে দূরে গাঁও বসছে। জঙ্গল নির্মূল করে ক্ষেতিবাড়ি বানানো হচ্ছে।
আন্দামানের উপনিবেশ জমে উঠেছে। ভারত-ব্রহ্মেরা মূল ভূখণ্ড থেকে জাহাজ ভরে প্রতি মাসে কয়েদি আসে। দ্বীপের মানুষ বাড়ে। হাজার বছরের অরণ্য সংহার করে মানুষ তার বসবাসের সীমানা বাড়ায়।
কালাপানি পাড়ি দিয়ে শুধু কয়েদিই আসে না। আজকাল আন্দামানের বিভীষিকা কাটিয়ে মেইনল্যান্ড থেকে দুঃসাহসী বেনিয়ারাও আসতে শুরু করেছে এই দ্বীপে।
এই উনিশ শ’ এগারো সালে এবারডিন বাজারে পাঁচখানা দোকান বসেছে। পুরনো কয়েদি সুলেমান মোপলার কাপড়ের দোকান, ফাই মঙ বর্মীর কাঠ এবং বেতের আসবাবের দোকান, মাদ্রাজি চিনা রেড্ডির সরাইখানা, মাড়োয়ারি খুবলালের চাল-ডাল-মশলার দোকান আর বাঙালি খ্রিস্টান গোমেসের প্রবাল-শামুক-শঙ্খ, হরেক রকমের সামুদ্রিক কড়ির দোকান।
পাঁচটা দোকান গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে আছে।
রাত অনেক বেড়েছে।
আকাশে ইতস্তত খণ্ড খণ্ড মেঘ। মেঘের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে খানিকটা অস্পষ্ট ফ্যাকাশে চাঁদের আলো এসে পড়েছে এবারডিন বাজারের মাথায়।
দূর থেকে অশান্ত উপসাগরের শাসানি ভেসে আসছে। টিলার গায়ে নারকেল-বনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নারকেলের পাতাগুলো চাঁদের আবছা আলোয় চিকচিক করে। বিরাট চেহারার রেন-ট্রিগুলোকে ভৌতিক মনে হয়।
ফাই মঙ বর্মীর দোকানের সামনে বাঁশের মাচানে বসে ছিল চান্নু সিং আর মাউ খে। চান্নু সিংয়ের হাতে মুখে মাথায় সমস্ত শরীরে ব্যান্ডেজ আর পট্টি।
চীনা রেড্ডির সরাইখানা থেকে গোটা দুই মুরুকু কিনে এনেছিল মাউ খে। মুরুকুতে এলোপাতাড়ি কামড় বসাতে বসাতে সে বলল, মঙ চোটা অ্যাদ্দিনে এল। এবার দুভাই একসাথ থাকা যাবে।
চান্নু সিং ধমকে উঠল, ছোড় দে তোর মঙ চো। ইদিকে আমার শির ফেটেছে, হাড্ডি তুড়েছে, কত খুন গিরেছে! সিকম্যানডেরার (হাসপাতালের ডাক্তার সাহিব সুঁই মেরে মেরে চামড়া টুটা ফুটা করে দিয়েছে। আর তুই শালা মঙ চোর বাত বলছিস।
মাউ খে জবাব দিল না। শক্ত, ঝাল মুরুকুতে তরিবত করে কামড়ের পর কামড় বসাতে লাগল।
দূরের আর একটা মাচানে বসে জনকতক বর্মী পিনিক যুঁকছে, কেউ শুখা তামাক চিবোচ্ছে। আর ফাই মঙ বর্মীর দোকানের ভেতরে একটা চোরা কুঠুরিতে অন্দর বাহির জুয়ার আড্ডা বসেছে। কাঠের চোঙায় গুটি পুরে গপাগপ করে দান ফেলার আওয়াজ আসছে। মাঝে মাঝে চাপা হল্লার শব্দ হচ্ছে।
মাউ খে বলল, কুত্তাগুলো একদিন নির্ঘাত ধরা পড়বে। সেদিন অন্দর বাহির–
মাউ খের কথা শেষ হওয়ার আগেই চান্নু সিং খেঁকিয়ে উঠল, ছোড় দে শালে অন্দর বাহির। সোনিয়ার জন্যে কত
চান্নু সিংয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফাই মঙ বর্মীর চোরা কুঠুরি থেকে ঢোলা জোব্রা পরা একটা লোক উঠে এল। মুখময় দাড়িগোঁফ, লম্বা লম্বা জট পাকানো চুল, লাল টকটকে একজোড়া চোখ। চুলদাড়ি থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। লোকটা দাঁত বার করে হাসল। তারপর ছড়া আওড়াল।
যো গুলকা জোহিয়া হ্যায়
উসে খারকা ক্যা খটকা।
ছড়া আওড়াবার পর লোকটা বলল, যে গুল ফুল তুলতে চায়, তার কাটার ভয় করলে চলে! খুবসুরতী আওরত চাইবি আর খুন দিবি না! কি রে উল্লু?
লোকটার দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল চান্নু সিং আর মাউ খে। তাদের চোখের পাতা নড়ল না। মাউ খে মুরুকুতে কামড় দিতে পর্যন্ত ভুলে গেল। চান্নু সিংও রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছে।
লোকটা সামনের দিকে আরো খানিকটা এগিয়ে এল। ঢোলা জোক্বা আর চুলদাড়ি থেকে উৎকট দুর্গন্ধের ঝাঁঝ নাকে ঢুকল চান্নু সিং আর মাউ খের।
অসমান দাঁতগুলো মেলে সমানে হাসছে লোকটা। বলল, কি রে, আমাকে চিনতে পারছিস না!
এতক্ষণে চান্নু সিং কথা বলল, বহুত তাজ্জবকি বাত। তুই–
হ্যাঁ, আমি ভাগোয়া কয়েদি।
তুই অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলি জাজিরুদ্দিন?
দাড়ির ফাঁকে হাসিটা অদৃশ্য হল। দুই ঠোঁটের আড়ালে দু’পাটি দাঁত ঢাকা পড়ল। রুক্ষ, গম্ভীর গলায় জাজিরুদ্দিন বলল, কতবার তোদের বলেছি, আমি শুধু জাজিরুদ্দিন না। আমি হলাম মৌলানা জাজিরুদ্দিন হাজী। জানিস, দু দুবার হজে গিয়েছিলাম?
জরুর। সঙ্গে সঙ্গে মাউ খে আর চান্নু সিং মাথা নাড়তে নাড়তে সায় দেয়।
জাজিরুদ্দিনের হাসি এবং দাঁত আবার দেখা দেয়।
এই দ্বীপের সবাই জানে, বছর দুই আগে লখনৌ শহর থেকে তামাম জীবনের সাজা নিয়ে এখানে এসেছিল জাজিরুদ্দিন। আন্দামানের মাটিতে নেমেই নিজের নামের সামনে পেছনে মৌলানা আর হাজী বসিয়ে শোহরত করেছিল। কিন্তু এই দ্বীপের কয়েদিরা কেমন করে যেন টের পেয়ে গিয়েছে জাজিরুদ্দিন কোনোদিন মৌলানা ছিল না, আর কোনো কালেই হজে যায় নি। যারা সত্যিকার মৌলানা আর হাজীর মাহাত্ম্য জানে, প্রথম প্রথম তারা সরাসরি এমন শোহরতে আপত্তি জানিয়েছিল। কিন্তু জাজিরুদ্দিনের মস্ত থাবার ঘুষি খেয়ে দাঁত-নাক থেকে খুন ঝরিয়ে শেষ পর্যন্ত সামনাসামনি কেউ আপত্তি করতে সাহস পেত না।
আড়ালে সব কয়েদিই বলত, মৌলানা হাজী না হোক, শালা বড়ো মরদ হ্যায়। এক ঘুষায় শির ঘেঁচে দেয়।
সেই জাজিরুদ্দিন মাসখানেক কয়েদ খাটতে না খাটতেই একদিন উধাও হল। পয়লা পয়লা জেলখানায় তাকে নারকেলের ছোবড়া কোটার কাজ দেওয়া হয়েছিল। মুগুর। পিটিয়ে পিটিয়ে শুকনো নারকেল-ছোবড়া থেকে ঝুরা ঝরিয়ে রোজ তাকে আড়াই পাউণ্ড তার ছিলতে হত। মুগুরের ঘষায় প্রথমে হাত ফোস্কা পড়ত, তারপর ফোস্কা ফাটত, তারও পর হাতের তেলো থেকে পরতের পর পরত চামড়া উঠে যেত। প্রতি বেলায় ভরপেট খানার বদলে এতখানি তখলিফ আর মেহনত করার মানুষ দুনিয়ায় লাখে লাখে মেলে। কিন্তু জাজিরুদ্দিন যে সে-ধাতের মানুষ নয়, কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝিয়ে দিল।
ছোবড়া কোটার মুগুর ছুঁড়ে ফেলে জাজিরুদ্দিন আগে আগে চিল্লাত, কয়েদি কি সিরকারের কেনা গুলাম?
পাশ থেকে পেটি অফিসার দাঁত খিচাতো, কুত্তীকা বাচ্চা, ঠিকসে কাম কর। বলেই কেতকা হাঁকাত।
দুর্বিনীত ভঙ্গিতে গর্দান বাঁকিয়ে তাকাত জাজিরুদ্দিন। বলত, অ্যায়সা মাত্ মারো। আমি কারো বান্দা না। আমি খুদাবন্দ।
দু-চার দিনের মধ্যেই মেজাজ বদলে ফেলল জাজিরুদ্দিন। রোজ সঠিক আড়াই পাউণ্ড নারকেল ছোবড়ার তার বার করতে লাগল। পেটি অফিসার বেজায় খুশি।
তারপর একদিন পেটি অফিসারকে তোয়াজ করতে করতে জাজিরুদ্দিন বলল, অফসর সাহিব, আপ আন্দামানের মালেক, আমার খুদ বাপজান
পেটি অফিসার খ্যাখ্যা করে হাসে। বলে, কী মতলব রে শালে, এত খুশামুদি করছিস?
মাপা এক হাত জিভ কেটে জাজিরুদ্দিন কানে আঙুল রাখল। চোখ বুজে বলতে লাগল, খুদ বাপজানের খুশামুদি করতে পারি! থোড়েসে মেহেরবানি মাঙছি অফসার সাহিব–
চোখ কুঁচকে তেরছা নজরে তাকাল পেটি অফিসার। বলল, কিসের মেহেরবানি?
হেঁ হেঁ অফসর সাহিব, অ্যাদ্দিন তো ছিলা কোটার কাজ করলাম। এবার দুসরা কাম চাই। জাজিরুদ্দিন সমানে হাত কচলাতে লাগল।
কী কাম?
সড়ক বানানোর কাম।
এক মুহূর্ত কী যেন ভেবেছিল পেটি অফিসার। তারপর বলেছিল, বদ মতলব নেই তো রে?
খুদার নামে বিশ কসম। কোনো বদ মতলব নেই অফসর সাহিব। মাপা আধ হাত জিভ বার করে চোখ বুজে কানে হাত ঠেকিয়েছিল জাজিরুদ্দিন।
ঠিক হ্যায়, কাল থেকে সড়ক বানাতে যাবি।
আন্দামানে আসার পর কয়েদখানায় আটক হয়ে ছিল জাজিরুদ্দিন। নিজের কুঠুরিতে বসেই নারকেলের ছোবড়া ছিলতে কুটতে হত। পেটি অফিসার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিত। একটু নড়াচড়া কি আরাম করার উপায় ছিল না।
পেটি অফিসারের মেহেরবানিতে পরের দিনই কয়েদখানার বাইরে বেরুতে পেরেছিল জাজিরুদ্দিন। সড়ক বানানোর ফাইলে নাম লিখিয়ে হার্দু এসেছিল। হার্দুতে তখন নতুন সড়ক তৈরি হচ্ছে। তামাম দিন অন্য কয়েদিদের সঙ্গে পাথর ভেঙেছে সে, হাত-রোলার টেনে সড়ক সমান করেছে। নিয়মিত দুপুরে কয়েদখানায় এসে খানাও খেয়ে গিয়েছে। তারপর একদিন কাজের শেষে সন্ধেবেলায় পেটি অফিসার যখন সড়ক বানানোর কয়েদিদের গুনতে শুরু করেছিল, তখন আর জাজিরুদ্দিনের পাত্তা মেলে নি। সমস্ত হার্দু এলাকা ছুঁড়েও তাকে পাওয়া গেল না।
যেদিকে তাকানো যায়, টিলায় টিলায় দোল খাওয়া আন্দামানের পাহাড়মালা। সেই সব পাহাড়ে কত শতাব্দীর নিবিড় গভীর জটিল অরণ্য। সেই অরণ্যের কোথায় যে জাজিরুদ্দিন উধাও হয়ে গেল, কে বলবে।
সমস্ত আন্দামান তোলপাড় করেও যখন জাজিরুদ্দিনের হদিস মিলল না, তখন সবাই ভাবল, হয় জংলি জারোয়াদের তীরে তার জান চলে গিয়েছে, তা না হলে উপসাগরের দাঁতাল হাঙররাই তাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। কেউ কেউ বলে, ছোট ডিঙিতে বিপুল বাঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বর্মা মুলুকে চলে গিয়েছে জাজিরুদ্দিন। কারো কারো মতে সুমাত্রায় পালাবার পথে ডিঙি উলটে সমুদ্রে ভেসে গিয়েছে সে।
শেষ পর্যন্ত ভাগোয়া অর্থাৎ পলাতক কয়েদিদের খাতায় জাজিরুদ্দিনের নাম উঠেছিল।
এই হল জাজিরুদ্দিনের কিত্সা। এই দ্বীপের অন্য কয়েদি বাসিন্দারা মাত্র কয়েকদিনই দেখেছে তাকে। তবু আন্দামানের কৌতূহল এবং বিস্ময়ের মধ্যে এই আজব কয়েদি বিরাজ করছে।
অনেকক্ষণ পর জাজিরুদ্দিনই বলতে শুরু করল, কি রে চান্নু, উল্লু কাঁহিকা, সোনিয়াকে শাদি করবি?
দুবছর পর কোত্থেকে যে জাজিরুদ্দিন গভীর রাতে এবারডিন বাজার খুঁড়ে বেরুলো, ভেবে দিশা পায় না চান্নু সিং। পিছনের দুটো বছর কোথায় সে লুকিয়ে ছিল, তা-ও এক অতল রহস্য। তাজ্জব বয়ে গিয়েছে চান্নু সিং। বিস্ময়ের ঘোরটা এখনো কাটে নি। অবাক হয়ে পলকহীন তাকিয়েই থাকে সে।
জাজিরুদ্দিন এবার খেঁকিয়ে উঠল, এই শালে, মুখ দিয়ে বাত বেরুচ্ছে না কেন? বোবা হয়ে গেলি নাকি?
চান্নু সিং হুবহু মনে করতে পারছিল, যে-বছর জাজিরুদ্দিন লখনৌ শহর থেকে দ্বীপান্তরের সাজা নিয়ে সেলুলার জেলে এল সে-বছর সে টিণ্ডাল হয়েছে। অল্প অল্প জান পায়চান হয়েছিল জাজিরুদ্দিনের সঙ্গে।
এই দ্বীপে যারা কয়েদ খাটতে আসে, তাদের সকলের সঙ্গেই তো আলাপ হয়। কিন্তু এই আজব কয়েদিটা মৌলানা আর হাজী বনে পয়লাই সকলের নজরে পড়েছিল। তারপর বিরাট থাবার ঘুষি মেরে অন্য কয়েদিদের যখন সে ঢিট করতে লাগল, তখন সবাই তটস্থ হয়ে উঠল। যত দুর্ধর্ষই হোক, নতুন কয়েদি আন্দামানে এসে পয়লা পয়লা চুপচাপ থাকে। কিন্তু জাজিরুদ্দিনের ধাত একেবারেই আলাদা।
চান্নু সিং ভাবছিল, যে কয়েদি পেটি অফিসারের সতর্ক পাহারা এড়িয়ে সড়ক বানানোর ফাইল থেকে ভাগতে পারে, নিঃসন্দেহে সে বাহাদুর লোক। তার এলেম যথেষ্ট। তাকে সহজে ভোলা যায় না।
জাজিরুদ্দিন আবার বলল, কি রে চান্নু, সোনিয়াকে তুই শাদি করবি?
জরুর। লেকিন তুই সোনিয়াকে জানলি কেমন করে?
জজিরুদ্দিন হাসল। বলল, আন্দামানের সব আদমি জানে। পুট বিলাস (পোর্ট ব্লেয়ার) থেকে ব্যাম্বু ফ্ল্যাট, মিঠা খাড়ি, ডাণ্ডাস পয়েন্ট, এগারাচালান, সব জায়গায় সবাইকে পুছে দ্যাখ। কারো জানতে বাকি নেই।
একটু থামল জাজিরুদ্দিন। তারপর গলাটা খাদে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে শুরু করল, দো রোজ হাবাডিন বাজারে এসে রয়েছি। ফাই মঙ বর্মীর দোকানে আস্তানা গেড়েছি। সোনিয়ার পিছু পিছু ছুটে পাহারাদারদের ডাণ্ডা খেয়ে তোর শির হেঁচল, হাড্ডি তুড়ল, সচ কি না বল?
হাঁ।
সব জানি আমি, সব শুনেছি। রহস্যময় গলায় জাজিরুদ্দিন বলতে লাগল, জঙ্গলে থেকেও এই দো সালে সব শালে লোকের খবর রাখতাম।
হঠাৎ চান্নু সিং উত্তেজিত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল, দো রোজ তুই ফাঁই বর্মীর দোকানে রয়েছিস!
জরুর।
পুলিশলোগ টের পায় নি?
না।
তুই তো ভাগোয়া কয়েদি। একবার তোকে ধরতে পারলে জানে খতম করে ফেলবে। হাবরাডিন বাজারে এসে উঠেছিস। ডর লাগে না?
ডর! না, বিলকুল না। বলে বিকট শব্দে খ্যাখ্যা করে হাসতে লাগল জাজিরুদ্দিন।
চান্নু সিং ও মাউ খে চমকে উঠল। যারা ওপাশের মাচানে বসে পিনিক যুঁকছিল, মুহূর্তের জন্য তাদের ফেঁকা বন্ধ হল। হাসির তোড়ে বিরাট, আখাম্বা শরীরটা বেঁকে দুমড়ে গেল জাজিরুদ্দিনের। একটু পরই টান টান খাড়া হয়ে দাঁড়াল সে। আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, আমার বুকের সিনাটার দিকে তাকা চা। এর অন্দরে ডর নেই-বুঝলি?
চান্নু সিং মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয়।
জাজিরুদ্দিন আবার বলল, ডরের কুছু নেই। পুলিশের হাতে ধরা দিতেই তো এসেছি। চান্নু সিং শিউরে উঠল। গলার ভেতর থেকে একটা অস্ফুট, অমানুষিক আওয়াজ বেরুলো তার। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সে বলল, জরুর তোকে ফাঁসিতে লটকে দেবে।
দেবে না।
অনেকটা সময় কাটল। তুফান মুখে নিয়ে যে অস্থির সমুদ্র পাথুরে দেওয়ালে অবিরাম মাথা কোটে তার শাসানি শোনা যেতে লাগল। নারকেল বনে ঝড়ো বাতাস মাতামাতি করতেই থাকল। চারদিক থেকে বিরাট বিরাট মেঘের চাঁইগুলো দক্ষিণ আকাশে ধাওয়া করেছে। চাঁদটা যুঝে যুঝে আর পেরে উঠছে না।
হঠাৎ চান্নু সিং বলল, এই দো সাল তুই কোথায় লুকিয়ে ছিলি?
বললাম তো জঙ্গলে—
কোন জাজিরার জঙ্গলে?
জাজিরুদ্দিনের গলায় বিরক্তি ফুটল, ও বাত ছোড় দে।
কৌন বাত তবে বলব?
সোনিয়াকে শাদি করবি কিনা বল?
জরুর। লেকিন—
লেকিন কী?
কী করে শাদিটা হবে?
বহুত মুসিবতকি বাত, তাই না রে চান্নু? জাজিরুদ্দিন মিটিমিটি তাকায়। তোয়াজ করে দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে হাসে।
হাঁ। মুখ নিচু করে সমানে মাথা নাড়ে চান্নু সিং।
আমি সব বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।
পারিস! লাফিয়ে উঠে জাজিরুদ্দিনের একটা হাত ধরে চান্নু সিং। খোশামুদির সুর ফোটে গলায়, তাই করে দে। আমি শালে তোর গুলাম হয়ে থাকব। সোনিয়াকে না পেলে আমার দিল ফেটে যাবে।
হঠাৎ জাজিরুদ্দিন বলে, ধরম দিতে পারবি? বিমূঢ় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে চান্নু সিং। তারপর অদ্ভুত গলায় বলে, তুই কী বলছিস!
জানিস তো আমি মৌলানা আর হাজী। দো দোবার হজে গিয়েছিলাম।
জরুর, জরুর। জাজিরুদ্দিনের হাতটা পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরে থাকে চান্নু সিং। আর সমানে বলে যায়, আমি সব জানি। সব জানি।
তুই আমাকে ধরম দিবি, আমি তোকে সোনিয়া দেব। জাজিরুদ্দিন বলে, এর মতলব হল, তুই মুছলমান হবি।
ওয়া গুরুজিকি ফতে। চান্নু সিং চিৎকার করে ওঠে। জাজিরুদ্দিনের হাতটা আরো জোরে চেপে ধরে। বলে, সোনিয়াকে পেলে জান দিতে পারি। ধরম জরুর দেব। লেকিন সোনিয়াকে পাব তো?
পাবি।
চান্নু সিং-এর হাত থেকে জাজিরুদ্দিন নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। তারপর এবারডিন বাজার থেকে যে সড়কটা বেঁকে সেলুলার জেলের দিকে চলে গিয়েছে, সেই সড়কে গিয়ে
ওঠে।
চান্নু সিং হাঁকে, এই জাজিরুদ্দিন–
জাজিরুদ্দিন জবাব দেয় না।
কিছুক্ষণের মধ্যে ভোলা জোব্রা-পরা দীর্ঘ মূর্তিটা সড়কের বাঁকে মিলিয়ে যায়। অনেক দূর থেকে একটা সুর ভেসে আসতে থাকে।
জো গুলকা জোহিয়া হ্যায়,
উসে খারকা ক্যা খটকা।
জাজিরুদ্দিন গাইছে। তার গলা ভারী মিঠা।
দ্বীপের জীবন শুরু হয়েছে।
মাত্র ঘণ্টাকয়েক আগে আন্দামানের মাটিতে নেমেছে লখাই। এখন কত রাত, কে জানে।
মেইনল্যাণ্ডের সঙ্গে সব যোগাযোগ ঘুচে গিয়েছে। বিপুল বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এই বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডে এসেছে লখাই। আন্দামানের কয়েক হাজার দ্বীপান্তরী কয়েদির সঙ্গে সে-ও মিশে গিয়েছে। আন্দামানের জীবনের শরিক হল লখাই।
এত সব লখাই ভাবছিল না। কোনো ভাবনাই সুশৃঙ্খল ও সুষ্ঠু ভাবে ভাবার মতো মনই নয় তার।
মোটা মোটা গরাদের ফাঁকে এক খণ্ড আকাশ দেখা যায়। দু-একটা ইতস্তত তারা আর কালো কালো ভীষণ আকারের হানাদার মেঘ ছাড়া আকাশে কিছুই নেই।
জেলখানাটা এখন একেবারে স্তব্ধ, নিঝুম। এক হাজার দুর্দান্ত খুনি ডাকু সমস্ত দিন ছোবড়া পিটিয়ে, সড়ক সমান করে, ঘানি ঘুরিয়ে, টিণ্ডাল আর পেটি অফিসারদের ডাণ্ডা আর খিস্তি খেয়ে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে।
কয়েদখানার বিরাট বিরাট ইমারতগুলো রাতের অন্ধকার মুড়ি দিয়ে অচেনা রহস্যময় হয়ে গিয়েছে।
পাথুরে দেওয়ালে উপসাগরের শাসানি আর নারকেল-বনে বাতাসের গর্জন ছাড়া কোথাও শব্দ নেই।
ঘুম আসছে না লখাইর। কদিন দরিয়ায় ভেসেছে সমানে। জাহাজের ঝকানি আর দোলানি এখনো সমস্ত শরীরে রয়ে গিয়েছে। মাথাটা টলছে। মনে হয়, গারখানার ইমারতগুলো বুঝি ঢেউ-এর মাথায় দোল খাচ্ছে।
মোটা মজবুত গরাদে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল লখাই আর ভাবছিল। মেইনল্যাণ্ডের কয়েদখানা থেকে দুখানা কম্বল, দুটো আট হাতি ধুতি আর দুটো কুর্তা মিলেছিল।
ধুতি-কুর্তা এখানকার মুন্সিজির কাছে জমা দিয়ে, টিপছাপ মেরে কয়েদি কাপড়া মিলেছে। কয়েদি কাপড়া হল, নীল ধারীওলা ইজের আর কুর্তা। আর মিলেছে খানাপিনার জন্য লোহার বর্তন।
আউটরাম ঘাট থেকে জাহাজে ওঠা, দরিয়ার ঝড়, সোনিয়া, এই আন্দামান, গারখানা–সব কেমন অদ্ভুত একটা ভোজবাজির মতো মনে হয়। যা কিছু ঘটেছে, সব যেন তাজ্জব এক ভেলকি।
লণ্ঠন হাতে ওয়ার্ডারের মুখ দেখা দিল। লখাই চমকে ওঠে।
গোলাকার মুখ, বাঁ চোখটা ছোট, খোঁচা খোঁচা শলার মতো কাঁচাপাকা গোঁফ। মাথায় লাল পাগড়ি।
ওয়ার্ডার খেঁকিয়ে উঠল, এই শালে, কী মতলব রে তোর?
লখাই জবাব দিল না। একদৃষ্টে ওয়ার্ডারটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ওয়ার্ডার আবার গর্জে উঠল, শালে নয়া এসেছিস, এসেই ভাগবার মতলব! টিক (বেত) মেরে মেরে জান পায়মাল করে দেব।
একটুক্ষণ চুপচাপ। তারপর হঠাৎ গলাটা নরম শোনাল ওয়ার্ডারের, ভাগবি আর কেমন করে? গরাদ তো তুড়তে পারবি না। তালাও ভাঙতে পারবি না। তালা তক তোর হাতই যাবে না।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল লখাই। এদিকে সেদিকে অন্য ওয়ার্ডারদের উঁচু গলার কথাবার্তা, পাহারাদারদের ভারী বুটের শব্দ, এমনি বিচিত্র সব আওয়াজ শুনতে লাগল।
নাঃ, ঘুম আসছে না। ঘুম আসবে না।
বাইরে শীতের রাত ঘন হচ্ছে। সমুদ্র ছুঁড়ে যে কনকনে বাতাস উঠে আসে, চামড়া মাংস খুঁড়ে তা হাড়ে গিয়ে ঠেকে।
বিছানা থেকে একটা কম্বল নিয়ে এল লখাই। বেশ ঘনিষ্ঠ করে শরীরে জড়িয়ে নিল। তারপর গরাদ ধরে দাঁড়াল।
আবার ওয়ার্ডরের মুখ দেখা দিল।
লখাই-ই এবার প্রথমে কথা বলল, ঘুম আসছে না ওয়ার্ডারজি। মাথা ঘুরছে।
ওয়ার্ডারাটার গলায় অন্তরঙ্গতার সুর ফুটল, পয়লা রাতে নয়া কয়েদির আঁখে নিদ আসে না। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। কি রে শালে, ডর লাগছে?
আধফোঁটা শব্দ করে কিছু বলল লখাই, কিন্তু তা বোঝা গেল না।
লখাইর জবাবের জন্য দুশ্চিন্তা নেই ওয়ার্ডারটার। আপন মনেই সে বকে চলল, ডর তো লাগবার কথাই। পন্দ্র সাল আগে এই কয়েদখানায় এসেছিলাম। পয়লা রাতে আমারও ডর লেগেছিল। ডরাস না, সব কুছ ঠিক হো যায়েগা।
নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল লখাই।
ওয়ার্ডার এবার অন্য প্রসঙ্গ দল। সরাসরি প্রশ্ন করল, নাম কি তোর?
লখাই।
দেশগাঁও কোথায়?
চব্বিশ পরগনা জিলা। হেতমপুর গাঁয়ের নাম।
ওয়ার্ডারের চোখের তারা দুটো ঝিকিয়ে ওঠে। গলা ফেড়ে এক বিচিত্র উল্লাসের শব্দ বেরুলো, তুই বাঙালি!
হাঁ।
আমিও বাঙালি।
বলে আর দাঁড়াল না ওয়ার্ডারটা, সোজা চলে গেল। বারান্দার এ-মাথা থেকে সে-মাথায় বার কয়েক টহল দিয়ে বেড়াল। কুঠুরিতে কুঠুরিতে কয়েদিদের ডেকে ডেকে পরখ করে দেখল, কেউ জেগে আছে কিনা।
কিছুক্ষণ পর আবার লখাইর কুঠুরির সামনে এসে তার মুখোমুখি দাঁড়াল ওয়ার্ডারটা। বলল, দেশগাঁওয়ে জরু, রিস্তাদার কেউ আছে?
না, কেউ নেই।
খুব ভাল বাত। ও ল্যাঠা না থাকাই ভাল। হঠাৎ ওয়ার্ডারের গলাটা ভারী এবং গাঢ় শোনাল, ও সব থাকলে দিল বরবাদ হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর ওয়ার্ডারের বিরাট বুক তোলপাড় করে দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
লখাই বলল, ওয়ার্ডারজি, আপনি তো বাঙালি–
জরুর। চাটিগাঁর কক্সবাজার আমার মুল্লুক। পন্দ্র সাল দ্বীপান্তরে রয়েছি। একটু থেমে চোখ বুজে কী যেন খুঁজে বেড়াল ওয়ার্ডারটা। তারপর ভাঙা ভাঙা, অদ্ভুত এক বেদনার সুরে বলতে লাগল, আমার নাম মোহর গাজী। পন্দ্র সাল মুল্লুক ছেড়ে খালি জাজিরা দ্বিীপ) দেখছি, সমুন্দর দেখছি, পানি আউর জঙ্গল দেখছি। পন্দ্র সালে বাংলা বুলিটা ভুলে গেছি। তুইও ভুলে যাবি। এখানে এসে সব আদমি আপনা আপনা বুলি ভুলে যায়।
হতাশা আর আক্ষেপের সুরে কথা শেষ করল মোহর গাজী। মুখেচোখে যন্ত্রণার ছাপ পড়ল। যন্ত্রণার ধরনটি বড় খাঁটি। :
লখাইর গলায় চমক খেলল, বাংলা বুলি ভুলব কেন?
পাঠান-পাঞ্জাবি টিণ্ডাল আর পেটি অফিসাররা পিটিয়ে পিটিয়ে ভুলিয়ে দেবে।
হঠাৎ গারখানার স্তব্ধতা আর গভীর রাত্রির শান্তি খান খান করে খসখসে ভাঙা গলায় কেউ একটানা চিৎকার করে উঠল। ডানপাশের কুঠুরি থেকে চিৎকারটা আসছে।
ওয়ার্ডার মোহর গাজীর মুখে বিরক্ত, ভয়ঙ্কর এক ভঙ্গি ফুটল। দাঁতে দাঁত ঘষে সে গর্জে উঠল, শালের জ্বালায় বাতচিত করা যাবে না। হর রোজ কুত্তীকা বাচ্চা সবার নিদ টুটে দিচ্ছে।
লণ্ঠন হাতে মোহর গাজী ডান পাশের কুঠুরিটার দিকে ছুটল। গরাদে হাত রেখে তার হুমকি আর শাসানি শুনতে লাগল লখাই।
মোহর গাজী শাসাচ্ছে, এই পরাঞ্জপে, চুপ মার হারামি। না থামলে কালই তোকে টিকটিকিতে (বেত মারার স্ট্যাণ্ডে) পাঠাব। পাছা যখন ঢিলা করে দেবে, তখন মালুম পাবি। চোপ শালে–
ধমক ধামক আর শাসানিতে কিছুই হল না। পরাঞ্জপের চিৎকার বেড়েই চলল। বুক ফাটা, ভাঙা-ভাঙা, কর্কশ কান্না কয়েদখানার ইমারতে ইমারতে ধাক্কা খেতে লাগল।
মোহর চাপা গলায় হুমকে উঠল, থাম শালে, পাগল সেজে রয়েছিস কামের ডরে! কাল সকালে সব ফাঁস করে দেব।
নিমেষে চিৎকার থামল।
দুলকি চালে পা ফেলে ফেলে আবার এগিয়ে এল মোহর গাজী। গরাদ ধরে তখনো লখাই দাঁড়িয়ে আছে।
মোহর বলল, ও শালে পরাঞ্জপে মারাঠি।
লখাই জবাব দিল না।
মোহর আবার বলল, কামের ডরে হারামিটা পাগল সেজে থাকে।
কাজের ডরে!
হাঁ। লখাইর গলার স্বরটা বুঝবার চেষ্টা করল মোহর গাজী। একটু চুপ। তারপর ফের বলল, কাল থেকে মালুম পাবি, দ্বীপান্তরের কয়েদখানার কাম কাকে বলে–বলে আর দাঁড়ায় না। লণ্ঠন ঝুলিয়ে ডান দিকে চলে যায় সে।
সেলুলার জেল।
ভারত-ব্রহ্মের মূল ভূখণ্ড থেকে কয়েক শ’ মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের এই কয়েদখানা একই সঙ্গে তোমার আমার মত সৎ, ভদ্র মানুষের মনে সন্ত্রাস জাগায়, রহস্য ঘনায়। আন্দামানের এই ভয়াবহ কারাবাস তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল বিগত শতাব্দীর শেষ দশকে। আর শেষ হয়েছিল এই শতকের প্রথম দিকে স্যার রিচার্ড টেম্পলের আমলে।
সেন্ট্রাল টাওয়ার থেকে সাতটা হাতের মতো সাতটা তিনতলা বিশাল ইমারত সাত দিকে ছুটে গিয়েছে। প্রায় আট শ’ সেল। সেন্ট্রাল টাওয়ার থেকে সবগুলি কুঠুরির ওপর নজর রাখা যায়। সেন্ট্রাল টাওয়ারের আরো দু’টি নাম আছে। মেইন টাওয়ার এবং ওয়াচ টাওয়ার।
সেলুলার জেল প্রাচীন স্থাপত্যের সব নিদের্শনই নিজের চেহারায় ফুটিয়ে রেখেছে। সমস্ত পৃথিবীতে এই ধরনের কয়েদখানার মধ্যে এটি তৃতীয়।
বছরের পর বছর ডাণ্ডাস পয়েন্ট আর হার্টুর ব্রিকফিল্ডে পুরনো দিনের কয়েদিরা ইট পুড়িয়েছে। কয়েদিদের বানানো বিশ লক্ষ ইটে সেলুলার জেলের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই জেলেই মাসে মাসে নতুন কয়েদি মেইনল্যাণ্ড থেকে দ্বীপান্তরে সাজা খাটতে আসে।
কয়েদিরা আক্ষেপ করে বলে, আমাদের বানানো কয়েদখানায় আমাদেরই আটক করছে। শালে, আপনা জুতিসে আপকো পিটছে।
আটলান্টা পয়েন্টের টিলায় সেলুলার জেল।
সামনের দিকের সড়কটা ডান পাশে বেঁকে এবারডিন বাজারের ভেতর দিয়ে হার্দু ডিলানিপুর চ্যাথামদ্বীপের দিকে চলে গিয়েছে। আবার ডান পাশে ঘুরে উপসাগরের কিনারা দিয়ে সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানা বাঁয়ে ফেলে হাটন পাহাড়, ব্রুখসাবাদ, করবাইনসে উধাও হয়েছে।
সেলুলার জেলের মাথা থেকে এ-পাশে রস, ও-পাশে চ্যাথামদ্বীপ নজরে পড়ে। অনেক দূরে ধোঁয়ার পাহাড়ের মতো দেখা যায় হ্যাভলক দ্বীপটাকে। এদিকে সিসোস্ট্রেস রে, ওদিকে ফিনিক্স বে। অশান্ত, উদ্দাম উপসাগর মেতেই আছে। ফিনিক্স বের উলটো দিকে মাউন্ট হ্যারিয়েটের খাড়া চুড়াটা দূর থেকে চোখে পড়ে।
সেলুলার জেলে সকাল হল।
ওয়ার্ডার মোহর গাজীকে আজ আর দেখা গেল না। একটা পেশোয়ারি পেটি অফিসার এসে তালা খুলল। তার সঙ্গে একজন কয়েদি জমাদার আর একজন ফ্রি সিপাই এসেছে।
পেটি অফিসার সামনে এসে দাঁড়াল। বাঁ কাধ থেকে বুকের ওপর দিয়ে ডানদিকের কোমর পর্যন্ত কোনাকুনি লাল কাপড়ের পট্টি। বুকে তকমা আঁটা। তাতে ইংরেজিতে লেখা : পেটি অফিসার।
পুরা সাড়ে চার হাত লম্বা রোমশ শরীর, ঘন দাড়ি গোঁফ, ঘোলাটে চোখ আর ঢিলেঢালা কুর্তার মধ্য থেকে পেশোয়ারি পেটি অফিসারের সঠিক উমর (বয়স) বার করা সোজা ব্যাপার নয়।
পেটি অফিসার লখাইর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ দিয়ে জরিপ করে নিল। তারপর বেশ মোলায়েম করে বলল, আমি হলাম পেটি অফসার। আমার নাম নসিমুল গণি, ইয়াদ রাখিস।
নসিমুল গণির হাতে মোটা বেতের পোক্ত একটি ডাণ্ডা ছিল। সেটা উঁচিয়ে বলল, এই ডাণ্ডার কথাও ইয়াদ রাখিস।
লখাই জবাব দিল না।
পেটি অফিসার আবার বলল, যা, বর্তন নিয়ে এবার নিচে যা। কাঞ্জিপানি মিলবে।
চার নম্বর ব্লকের দোতলায় একটা কুঠুরি মিলেছে লখাইর। লোহার একটা থালা নিয়ে অন্য কয়েদি আর জমাদারের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন করল, কাঞ্জিপানি কী?
তালুতে জিভ ঠেকিয়ে অদ্ভুত, লোভাতুর একটা শব্দ করল জমাদারটা। বলল, আ বে বুদ্ধ, কাঞ্জিপানি হল খানা। বহুত বঢ়িয়া চীজ–
মুখ-হাত ধুয়ে লখাই এসে দেখল, চার নম্বর ইমারতের সামনে অনেক কয়েদি এসে জমায়েত হয়েছে। সকলে জোড়া জোড়া বসেছে। কয়েদিদের সবার হাতে লোহার থালা।
একটু পর টিণ্ডাল, পেটি অফিসার, ফ্রি জমাদার, সিপাইরা এসে পড়ল।
জমাদার কয়েদি গোনা শুরু করল। হাঁকল, সাত শ’ বিশ লম্বর—
একটি কয়েদি উঠে দাঁড়াল। সেলাম ঠুকে বলল, সিরকার (সরকার) সালাম।
জমাদার আবার হাঁকল, সাত শ’ একইশ—
আর একটি কয়েদি উঠল, সিরকার সালাম–
একের পর এক কয়েদি গণনা চলল। বিচিত্র সুরে জমাদার নম্বর হাঁকতে লাগল। কয়েদিরা হাজিরা দিতে লাগল।
একসময় জামাদার হাঁকল, সাত শ’ পঁচিশ—
হাজির–
শ’ খানেক কয়েদি চমকে উঠল। পেটি অফিসার, টিণ্ডাল, জমাদার, সিপাই–সবাই দাঁতে দাঁত ঘষল।
জমাদার গর্জে উঠল, এ শালে হরবনস, ইধার আ হারামিকা বাচ্চে। তেরি–
একটা বছর বিশ বাইশের জোয়ান উঠে দাঁড়াল। দু’পাটি ঝকঝকে দাঁত বার করে সে হাসছে।
জমাদারের চোখে হত্যা ঝিলিক দিল। সে বলল, আজ তোকে টিকটিকিতে (বেত মারার স্ট্যাণ্ডে) ফেলে জিন্দেগি চৌপট করে দেব। ইধর আ।
লম্বা লম্বা কদমে জমাদারের সামনে এসে দাঁড়াল হরবনস।
জমাদার আবার বলল, তোকে হর রোজ বলছি না, হাজিরার সময় সিরকার সালাম বলবি?
হরবনস হি হি করে হাসতেই লাগল। বলল, জমাদার সাহিব, সিরকার আমাকে কয়েদ করেছে, লেকিন আমার সালাম তো কয়েদ করে নি। ও বাত আমার মুখ দিয়ে বার হবে না।
মুখের ওপর বিরাট এক ঘুষি এসে পড়ল। পাক খেয়ে ঘুরে পড়ল হরবনস। সঙ্গে সঙ্গে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল।
জমাদার খেঁকিয়ে উঠল, তোর মুখ দিয়ে বার হবে না! শালের বাচ্চে, তোর বাপের মুখ দিয়ে বার করিয়ে ছাড়ব।
ভয়ানক গলায় হরবনস বলল, ও তো ঠিক বাত। লেকিন আমার মুখ দিয়ে বার হবে না।
জমাদার বাঁ চোখটা কুঁচকে ইশারা করল। সঙ্গে সঙ্গে দুটো পেটি অফিসার হরবনসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টেনে হেঁচড়ে তাকে সাত নম্বর ব্লকের দিকে নিয়ে চলল।
এক পাশে বসে শখানেক কয়েদির সঙ্গে দৃশ্যটা দেখল লখাই। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় তার শরীরটা কাঁপছে।
আবার যথারীতি নম্বর হাঁকতে শুর করল জমাদার, সাত শ’ ষাট—
সিরকার সালাম—
এক-ষাট—
কেউ হাজিরা দিল না।
জমাদার কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, কৌন শালে এক-ষাট?
লখাই হরবনসের কথা ভাবছিল। হঠাৎ পাশের কয়েদিটা কনুইর গুঁতো মারল পাঁজরে। বলল, এ বুরবক, তুই তো এক-ষাট–
লখাই চমকে উঠে দাঁড়াল। কাঁপা গলায় হাজিরা দিল, সিরকার সালাম।
সিরকার সালাম! শালে কুত্তীকা বাচ্চা। এতক্ষণ ধরে হাঁকছি! দৌড়ে গিয়ে জমাদারটা এক রদ্দা কষিয়ে দিল লখাইর ঘাড়ে। সমানে খেকাতে লাগল, কানে শুনিস না? আঁখ নেই? টিকিটে লম্বর দেখতে পাস না?
কয়েদিদের গলায় লোহার হাঁসুলিতে কাঠের টিকিট ঝুলানো। টিকিটে কয়েদিদের নম্বর, সাজার তারিখ, মেয়াদ–সব খোদাই করা আছে। টিকিটটা লখাইর নাকের সামনে তুলে ধরে জমাদার চিল্লায়, দ্যাখ শালে। তারপর গর্দানে ঠাসানি দিয়ে বসিয়ে দিতে দিতে বলল, বৈঠ শালে। আপনা লম্বর মনে রাখিস।
কে এক কয়েদি টেনে টেনে, রসিয়ে রসিয়ে বলল, নয়া আয়া জমাদারজি। দেশ গাঁওমে জরু পড়ে রয়েছে। তার কথা ভাবতে ভাবতে শেষ না করেই হাসতে লাগল সে।
হাসিটা এ-মাথা থেকে সে-মাথায় ছড়িয়ে পড়ল। চারপাশের কয়েদিরা হাসতে হাসতে হল্লা বাধিয়ে ফেলল।
জমাদার হুমকে উঠল, চুপ মার শালেলোগ–
কোনো দিকে নজর নেই লখাইর। রক্তচোখে জমাদারটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। চোখের তারা নড়ছে না।
খানিকটা পর কালো মোষের মতো দুটো বিরাট আকারের জোয়ান দুই মস্ত বালতি আর বড় বড় লোহার হাতা নিয়ে এসে পড়ল।
জোয়ান দুটোর কালো দেহ চুঁইয়ে দর দর ঘাম ঝরছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, কালো কালো আলকাতরা বুঝি গলে পড়ছে।
কয়েদিদের হল্লা শুরু হয়ে গেল, কাঞ্জিপানি আ গিয়া—
থালা হাতে তারা কাতার দিয়ে বসে পড়ল।
কুচকুচে কালো দুই জোয়ান–মাথায় ফেট্টি, হাতে পট্টি–দুই হাতা দিয়ে বালতি থেকে কয়েদিদের থালায় সমানে কাঞ্জি ঢালতে লাগল।
কাঞ্জি হল কয়েদিদের সকালের খাদ্য। গুঁড়ো চাল, কুঁড়ো এবং খুদ মিশিয়ে পাকানো গাঢ় থকথকে বস্তুটির রং বিচিত্র। ইঁদুর-নাদি, ধুলোবালি ইত্যাদি নানা আবর্জনার মাহাত্মে এর স্বাদ বর্ণ এবং গন্ধ যা খোলে তার তুলনা নেই।
কয়েদিদের থালায় এক-এক হাতা কাঞ্জি পড়ছে। আগুনে ফুটে ফুটে এই কাঞ্জি থেকে সির্কার অল্প আঁঝ বেরুচ্ছে। অদ্ভুত স্বাদ গন্ধ এবং বর্ণের এই থকথকে তরল পরম তৃপ্তির সঙ্গে কয়েদিরা খাচ্ছে। হুস হাস করে জিভ আর মুখ নাড়ার শব্দ হচ্ছে চারদিকে।
হঠাৎ কাতারের শেষ মাথা থেকে তীক্ষ্ণ, সরু গলায় চিৎকার উঠল, আউর ঘোড়া দে, বহোত ভুখ–
লখাই চমকে তাকাল। দেখল, ভিখন আহির দু’হাতে কাঞ্জির বালতি আঁকড়ে ধরেছে। সমানে চিল্লাচ্ছে, দে ভেইয়া, না হলে ভুখেই ফৌত হয়ে যাব।
ছোড় শালে–
যে-লোকটা কাঞ্জি ঢালছিল, লোহার মস্ত হাতা দিয়ে ভিখনের কাঁধে দশ বিশটা বাড়ি বসিয়ে দিল।
গর্দান গুঁজে ভিখন চেঁচাতে লাগল, মার, মেরে আমার জিন্দেগি চৌপট করে দে। লেকিন কাঞ্জিপানি দে।
হঠাৎ কী ভেবে লখাই চিৎকার করে ডাকল, এ ভিখন, এদিকে আয়।
ভিখন গর্দান খাড়া করল। কাঞ্জির বালতিটা ছেড়ে লোহার থালা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। লখাইকে দেখে তাজ্জব বনে গেল সে। বলল, তুই লখাই ভেইয়া, তুই! কোন কুঠরিতে আছিস?
লখাই আবার ডাকল, এদিকে আয়—
ভিখন দৌড়ে এল। লখাইর পাশে বসতে বসতে বলল, একটু কাঞ্জিপানি মাঙলুম। শালে দিলে না।
লখাই কাঞ্জিতে হাত দেয় নি। লোহার থালাটা ভিখনের দিকে বাড়িয়ে বলল, খা–
থালাটা একরকম ছিনিয়েই নিল ভিখন। তারপর বাঁ হাত দিয়ে দুটো থালা আড়াল করে, বিরাট কদাকার দেহটা ঝুঁকিয়ে থাবার থাবায় কাঞ্জি শেষ করে ফেলল।
ভিখনের খাওয়া দেখছিল লখাই। চোখের পলকে থালা দুটো চেটেপুটে সাফ করে মাথা তুলল ভিখন। পোড়া, বীভৎস মুখে এবং একটিমাত্র চোখে হাসল। সে হাসিতে কৃতজ্ঞতা মিশে রয়েছে।
হঠাৎ ভিখনের কী খেয়াল হয়। সঙ্গে সঙ্গে কদাকার মুখ থেকে হাসি উধাও হল। বড় বিষণ্ণ দেখাল তাকে। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, আমি তো তোর কাঞ্জি খেলাম। তুই কী খাবি?
ও বাত ছোড় শালে—
কিছুক্ষণ চুপচাপ।
তারপর হঠাৎ ভিখন বলল, আমার খেয়াল আছে–
কী খেয়াল?
চারদিকে একমাত্র চোখটার সতর্ক দৃষ্টি ফেলে ভিখন দেখল, কয়েদিরা কাঞ্জি নিয়ে মেতে আছে। অন্য দিকে তাদের নজর নেই। ভিখন নিঃসন্দেহ হয়ে মুখটা লখাইর কানে ঢুকিয়ে দিল, তুই ভাবিস না ভেইয়া, তোর নেশার চীজ জরুর জুটিয়ে দেব। সোনিয়ার খবর এনে দেব। তুই খানা দিয়ে আমার জান বাঁচিয়েছিস। নেশা দিয়ে আমি তোর জান বাঁচাব। সোনিয়ার খবর এনে তোর দিল খুশ করব। বিশ্বাস কর ভেইয়া। ঘাবড়ানা মাত্।
ভিখনের চোখে চোখ রাখল লখাই। দুই কয়েদির তিনটি চোখ মিলল।
তিনটে চোখে পাকা দোস্তির চিহ্ন ফুটে বেরিয়েছে।
পেটি অফিসার নসিমুল গণি লখাইকে ওয়ার্কশপে নিয়ে গেল। দুটো ছোবড়ার বস্তা তার পিঠে চাপিয়ে বলল, তোর কুঠরিতে চল।
সিঁড়ি বেয়ে চার নম্বর ব্লকের দোতলায় নিজের কুঠুরির সামনে এসে পড়ল লখাই।
নাসিমুল গণি বলল, বস্তা নামা।
লখাই বস্তা নামাল।
একটা নারকেল ছোবড়া মুগুর দিয়ে পিটতে পিটতে নসিমুল গণি বলতে লাগল, দ্যাখ শালে, অ্যায়সা করে পিটবি, ঝুরা ফেলবি, তার বার করবি। সন্ধের সময় আড়াই পাউণ্ড তার মেপে নেব। একটু কম হলে হাড্ডি থেকে গোস্ত আলাদা করে ফেলব।
ভীষণ চোখে পেটি অফিসারের দিকে তাকাল লখাই।
নসিমুল গণি গর্জে উঠল, এ হারামি, আঁখ দেখাচ্ছিস! জানে খতম করে দেব।
লখাই জবাব দিল না। দুর্বিনীত ভঙ্গিতে গর্দান খাড়া করেই রইল।
লখাইর পেটে বেতের ডাণ্ডার গুতো দিয়ে পেটি অফিসার এবার বলল, মনে রাখিস শুয়ারকা বাচ্চা, মেরা নাম নসিমুল গণি। তোর মাফিক কয়েদি আমি বহোত দেখেছি। কয়েদি পিটবার জন্যে খুদা আমাকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে। বলতে বলতে নসিমুল উঠে দাঁড়াল, মনে রাখিস শালে, কামে ফাঁকি মারবি না। আমি এখন যাচ্ছি।
নসিমুলের কাছ থেকে ছোবড়া পিটিয়ে তার বার করার প্রক্রিয়া শিখে নিয়েছে লখাই। এবার সে বেঁটে আকারের কাঠের মুগুর বাগিয়ে ধরল।
শীতের রোদ চড়ছে। দ্বীপের নোনা মাটি তেতে উঠছে। খ্যাপা ঢেউয়ে উপসাগর উথালপাতাল হচ্ছে। নিঃসীম দরিয়া পাথরের দেওয়ালে সমানে আছড়ে পড়ে। নারকেল বনে ঝড়ো বাতাস অবিরাম ঘোড়া ছোটায়। গোঁ গোঁ আওয়াজ ওঠে অবিরাম।
এক ঝাক সিন্ধুশকুন সেলুলার জেলের মাথা পেরিয়ে উপসাগরের দিকে উড়ে যায়।
জেলখানায় দিন শুরু হয়েছে অনেক আগে। কয়েদিদের কাজ শুরু হল এই মাত্র।
কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই লখাইর। কাঠের বেঁটে মুগুরটা দিয়ে নাবকেল ছোবড়ায় ঘা বসাতে থাকে সে।
শক্ত, শুকনো, নিরেট ছোবড়া। বাড়ি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুগুরটা লাফিয়ে ওঠে।
এক ঘণ্টা মুগুর পিটিয়ে, ঝুরো ঝরিয়ে, মাত্র গোটাচারেক ছোবড়ার তার বার করতে পারল লখাই।
সারা গায়ে ঘাম ছুটেছে। কুর্তা কামিজ ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছে। মুগুরের দু-চারটে বাড়ি বসাবার সঙ্গে সঙ্গে হাতের চেটোতে বড় বড় ফোস্কা পড়ে গেল। তারপর সেই ফোস্কা ফেটে এক পর্দা চামড়া উঠতে লাগল। হাতের চেটোটা ভয়ানক জ্বলছে তার।
বাঁ হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছল লখাই। কুর্তা খুলে শরীরটাও মুছল। তারপর মুগুরটা ছুঁড়ে ফেলে জিভ বার করে হাঁপাতে লাগল।
হঠাৎ সরু, তীক্ষ্ণ গলার ডাক শোনা গেল, এ লখাই ভেইয়া, এই যে ইধর—
লখাই দেখল, খানিক দূরে একটা কুঠুরির গরাদের এপাশে ভিখন ছোবড়া পিটছে।
করুণ গলায় ভিখন বলল, লখাই ভেইয়া, জরুর মর যায়গা। হাতের চামড়া উঠে গোস্ত বেরিয়ে পড়েছে।
লখাই বলল, আমারও।
ছোবড়া ছিলাকোটা বন্ধ রেখে চুপচাপ বসে ছিল লখাই। ডান হাতটা ভয়ানক টাটাচ্ছে।
পেটি অফিসার লাচাড়ি পড়ার মতো একান্ত অবলীলায় শখানেক খিস্তি আউড়ে গেল, বেশরম, বেতমিজ, নালায়েক, হারামিকা বাচ্চে, কুত্তীকা বাচ্চে! তেরি–
তারপর মোটা বেতের ডাণ্ডাটা দিয়ে লখাইর পাঁজরে প্রচণ্ড গোঁত্তা লাগিয়ে দিল। খেঁকিয়ে বলল, শালে, আরাম করবার জন্য কালাপানি এসেছিস? ডাণ্ডা হাঁকিয়ে পাছার হাড্ডি ঢিলা করে দেব।
মুখ কাচুমাচু করে লখাই বলল, পেটি অফসর সাহিব, হাতে দরদ হচ্ছে। চামড়া উঠে গেছে।
নসিমুল গণির চোখে হত্যা ঝিলিক দিল। দরদ হচ্ছে! চামড়া উঠে গেছে! দাঁতের নিচে কথাগুলোকে চিবিয়ে ছিন্নভিন্ন করতে করতে লখাইর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। কিল থাপ্পড় এবং ঘুষিতে তার দাঁতমুখ ফাটিয়ে আর এক প্রস্থ অশ্লীল খিস্তি আওড়াল। শাসাল, বিকেলে আড়াই পাউণ্ড তার না পেলে টিকটিকিতে চড়াব। ইয়াদ রাখিস। এ হল কালাপানির কয়েদখানা। এখানে দরদ নেই।
সারি সারি কয়েদিরা ছোবড়া নিয়ে বসেছে। একটানা ছোবড়া পিটিয়ে মুগুরের ঘষায় হাতের এক পর্দা চামড়া উপড়ে, যন্ত্রণায় কাঁধ থেকে পুরোপুরি হাতখানা খসিয়ে ফেলার দাখিল করে কেউ কেউ একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। কারো কারো অল্পস্বল্প ঝিমুনিও ধরেছিল।
পেটি অফিসার নসিমুল গণির কিল ঘুষির বহর দেখে সবাই তটস্থ হয়ে উঠল। বিচিত্র তালে আবার ছোবড়ার এপর মুগুর পড়তে লাগল।
গরাদের ওপাশ থেকে সরু, তীক্ষ্ণ গলাটাকে মোলায়েম করে হঠাৎ ভিখন আহীর চেঁচিয়ে উঠল, পেটি অফসর সাহিব–
চোখের ঘোলাটে মণি দুটো ধক করে উঠল নসিমুল গণির, ক্যা বাত রে কুত্তীকা বাচ্চে বিল্লি–
ইধর আইয়ে সাহিব। ঘোড়া জরুরত–গলার স্বর আরো মোলায়েম হল ভিখনের।
নসিমুল ভিশনের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, বাতা, কী হয়েছে—
আপ মেরে মা-বাপ অফসর সাহিব। পোড়া মুখের একটি মাত্র ধূর্ত চোখে যতখানি সম্ভব করুণ দৃষ্টি ফুটিয়ে তাকিয়ে রইল ভিখন।
তোষামুদিতে পেটি অফিসারের নিরেট, কঠোর মনটা সামান্য ভিজেছিল। কিন্তু মুখচোখে তার কোনো লক্ষণ মালুম হল না। খেঁকিয়ে বলল, কি রে শালে, নালায়েক কহিকা! মতলব কী তোর?
মেরে মা বাপ, ছোবড়ায় মুগুর হাঁকালে সেই মুগুর লাফিয়ে উঠে শির ঘেঁচে দেয়।
শির ঘেঁচে দেয়!
হাঁ সাহিব। মেরে মা বাপ।
ভিখন আহিরের একটিমাত্র চোখে শয়তানি, চাতুকারিতা, কুটিলতা–কতরকম ভাব যে খেলে যায়।
নাসিমুল আর কথা বলল না, ক্রুর দৃষ্টিতে ভিখনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গলার স্বরটাকে আশ্চর্য রকমের মোলায়েম করে ভিখন আবার বলল, অফসার সাহিব, মেরে মা-বাপ, ঘোড়া পানি না হলে আপনার লেড়কার জান ফৌত হয়ে যাবে।
পানি দিয়ে কী হবে?
ছোবড়া ভিজিয়ে নেব অফসর সাহিব। শুকনো ছোবড়ায় মুগুর বড্ড লাফাচ্ছে। হাতের চামড়া উঠে যাচ্ছে।
শালে হারামি, উল্লুকা বাচ্চে–অশ্রাব্য খিস্তি করে, শরীরটাকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে, লোহার গরাদের ছোট ফোকর খুলে ওপাশে চলে গেল পেটি অফিসার। সমানে ফুঁসতে লাগল, পানি মাঙছে! পানি দিয়ে ভিজিয়ে ছোবড়া ছিলতে সুবিধা হয়! এটা হল আন্দামানকা কয়েদখানা, এখানে বহোৎ মুসিবৎ। এটা সসুরাকা কোঠি নেহী গাধার বাচ্চা পাঁঠঠে–
মোটা বেতের ডাণ্ডা দিয়ে হাড্ডি থেকে চামড়া মাংস ঢিলা করে দেওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছিল নসিমুল গণি। দাঁতে দাঁতে ঘষে হিংস্র আওয়াজ করে গর্জাতে থাকে, মনে রাখিস শালে, আন্দামানের কয়েদির জিন্দেগি তুড়বার জন্যে খুদা আমাকে পয়দা করেছে। তেরি–
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল ভিখন। দৌড়ে পেটি অফিসারের কাছে ছুটে গেল। পোড়া বীভৎস মুখটা তার কানে ঢুকিয়ে ফিসফিস করে কী যে বলল, আশেপাশের কয়েদিরা শুনতে পেল না।
কয়েদির জিন্দেগি তুড়বার জন্য যে নাসিমুলকে খুদা দুনিয়ায় পাঠিয়েছে, মুহূর্তে তার হিংস্র, সাঙ্তিক মুখে ভাবান্তর দেখা দিল। গলা নামিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল, সচ বলছিস তো শালে!
জরুর মেরে মা-বাপ।
তবে চল।
এখুনি?
জরুর। বেতের ডাণ্ডা দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে ভিখনকে তার কুঠুরিতে ঢোকাল পেটি অফিসার। নিজেও ঢুকল।
একটু পর দুজনেই বেরিয়ে এল।
কোনোদিকে দৃকপাত না করে পেটি অফিসার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। খানিক পর এক বালতি জল নিয়ে ফের উঠে এল। নরম স্বরে বলল, পানি নে ভিখন। আস্তে আস্তে মুগুর পেট। নইলে হাতে চোট লাগবে।
ভিখন আহিরের ওপর পেটি অফিসারের এমন মেহেরবানি দেখে অন্য কয়েদিরা তাজ্জব বনে গিয়েছিল।
নসিমুল গণি কারো দিকে ফিরেও তাকাল না। দুলকি চালে অন্য ব্লকের দিকে চলে গেল।
চারদিক ভাল করে দেখে নিল ভিখন। নাঃ, টিণ্ডাল, পেটি অফিসার, জমাদার, ওয়ার্ডার–কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। সে উঠে পড়ল। গুটি গুটি পায়ে গরাদের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর ফোকর গলে এদিকে এসে লখাইর পাশে বসল।
লখাই কিছুটা আন্দাজ করেছিল। ফিসফিস করে বলল, দেখলাম, পেটি অফসর শালা তোকে পেয়ার করছে।
হাঁ রে লখাই ভেইয়া, করছে। তোর কি মনে হয়, অ্যায়সা অ্যায়সা পেয়ার করছে!
ওকে কিছু দিয়েছিস?
জরুর।
মাঝখানের আঙুলটার নিচে বুড়ো আঙুল রেখে টাকা বাজাবার ভঙ্গি করল ভিখন। এটা তার মুদ্রাদোষ। একমাত্র চোখে বিচিত্র হাসি ফুটিয়ে বলল, এর নাম রুপেয়া। এই চীজ তোর কাছে থাকলে দুনিয়ার সব চীজ মিলবে। আন্দামানের কয়েদখানায় পেয়ার ভি মিলবে।
উপসাগর এখন খুবই শান্ত। যে উদ্দাম তুফান পাথুরে দেওয়ালে অবিরাম মাথা কেটে তার গজরানি কমে এসেছে। সাগর-ফোঁড়া যে বাতাস নারকেলের পাতায় পাতায় এলোপাতাড়ি বাজে তারও সাড়া শব্দ মেলে না।
লম্বা বারান্দায় ছোবড়া পেটার দুপ দাপ আওয়াজ হচ্ছে। এক তালের অদ্ভুত সব শব্দ।
মুগুরটা একপাশে ছুঁড়ে চুপচাপ বসে ছিল লখাই। প্রথমে ডান হাত দিয়ে ছোবড়া পিটেছে। ডান হাতের এক পর্দা চামড়া উঠবার পর বাঁ হাতে মুগুর ধরেছে। এখন বাঁ হাতেরও একই হাল। দুচোখে নিরুপায় আক্রোশ, হাতের চেটোয় সাঙ্তিক জ্বালা আর সমস্ত গায়ে দর দর ঘাম নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে লখাই।
এক ঝাক সিন্ধুশকুন সেলুলার জেলের ওপর দিয়ে উপসাগর ডিঙিয়ে মাউন্ট হ্যারিয়েটের দিকে চলেছে।
মনটা ঠিক বশে নেই। অস্থির, অন্যমনস্ক লখাই সাগরপাখিগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। পাখিগুলো যখন দৃষ্টির বাইরে চলে গেল, তখন সে চোখদুটো ফিরিয়ে আনল।
হাতের সামনে ছোবড়া, মুগুর, ঝুরা এবং তার ছত্রখান হয়ে পড়ে রয়েছে। সকাল থেকে এই দুপুর পর্যন্ত ছোবড়া কুটে পাউণ্ডখানেকের বেশি তার ছিলতে পারে নি লখাই। অথচ পেটি অফিসার নসিমুল গণি শাসিয়ে গিয়েছে, সন্ধের আগে আড়াই পাউণ্ড তার সে কাটায় কাটায় মেপে নেবে। একটু কম হলে হাড় থেকে চামড়া মাংস, আলাদা করে ফেলবে।
নিরেট ছোবড়াগুলো দেখতে দেখতে রক্তাক্ত চোখদুটোতে যন্ত্রণা, আক্রোশ এবং রোষমাখা এক বিচিত্র দৃষ্টি ফুটল লখাইর।
হঠাৎ চাপা, তীক্ষ্ণ গলায় কে যেন ডাকল, এই, এই শালে—
চারদিকে তাকিয়ে তেমন কাউকেই খুঁজে পেল না লখাই। চনমন করে এদিকে সেদিকে তাকাতেই লাগল।
আবার শোনা গেল, এই বুদ্বু, ইধর–
এবার নজরে পড়ল। কয়েদিটাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। একটা কুঠুরির গরাদের ফাঁক দিয়ে অস্বাভাবিক লম্বা একটা হাত বেরিয়ে এসেছে। হাতটা ইশারায় ডাকছে।
যে কুঠুরি থেকে হাতটা বেরিয়ে রয়েছে সেটা লখাইর কুঠুরির ডান পাশে। হঠাৎ লখাইর মনে পড়ল, কাল রাতে এই কুঠুরির কয়েদিই ভাঙা, কর্কশ গলায় একটানা চিৎকার করছিল। আর ওয়ার্ডার মোহর গাজী দৌড়ে এসে তাকে ধমক ধমক দিয়েছিল। লোকটার নামও মনে আছে। মোহর গাজীই বলেছিল–নাম পরাঞ্জপে, মারাঠি।
হাতটা অস্থির হয়ে ক্রমাগত নড়ছে।
লখাই উঠে পড়ে। তারপর গুটিগুটি পায়ে পাশের কুঠুরিটার সামনে এসে দাঁড়ার।
পরাঞ্জপের চিৎকারই শুনেছে লখাই। এই প্রথম তাকে দেখল। পাঁচ হাত লম্বা শরীর। বাজের ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক। কপালে-জানুতে-হাতে-গলায় মোটা মোটা শিরাগুলো সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। বাঁ গালে মেটে রঙের মস্ত জডুল। একেবারেই উলঙ্গ সে। সমস্ত মুখে চোখা চোখা, নোংরা গোঁফ-দাড়ি। কুর্তা-ইজের মাথায় পাগড়ির ধরনে বাঁধা। দুচোখে মারাত্মক ধারাল দৃষ্টি, ঈষৎ তামাটে তারাদুটো ধকধক করে।
সকালে ভাণ্ডারা থেকে যে কাঞ্জিপানি দিয়ে গিয়েছিল, তরিবত করে সারা দেহে সবটুকু মেখে ফেলেছে পরাঞ্জপে। তরল কাঞ্জিপানি শুকিয়ে চড়চড় করছে।
গরাদের ওপর ঝুঁকে অস্বাভাবিক লম্বা হাতটা বাড়িয়ে লখাইর ঘাড়টা ধরে ফেলল পরাঞ্জপে। আঙুলের ডগায় ভাঙা ভাঙা নখ। নখগুলো লখাইর মাংসল ঘাড়ে গেঁথে গেল।
লখাই চমকে উঠল।
অনেকক্ষণ খ্যাল খ্যাল করে হাসল পরাঞ্জপে। হাসির দমকে পাঁচ হাত দীর্ঘ শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে যেতে লাগল। কুণ্ডলী-পাকানো শিরাগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। চোখ থেকে জ্বলন্ত পিঙ্গল তারা দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন।
ভয় অস্বস্তি এবং আতঙ্ক-মেশা অদ্ভুত এক অনুভূতিতে শরীরটা কুঁকড়ে যেতে থাকে খাইর। তবু পরাঞ্জপের থাবা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে না। কেউ যেন পেরেক ঠুকে তার পা দুটো বারান্দায় সেঁটে দিয়েছে।
হাসির দমক কমলে ধনুকের মতো বাঁকানো দেহ টান টান খাড়া হল পরাপের। আরো খানিকটা সামনের দিকে এগিয়ে এল সে। গরাদের ওপর কালো রোমশ বুকটা ঠেকিয়ে বলল, নয়া এসেছিস?
হাঁ।
ভয়ে ভয়ে জবাব দিল লখাই। পরাঞ্জপে যেন বিচিত্র এক ভোজবাজিতে তাকে বশ করে ফেলেছে।
তোর নাম লখাই না?
হাঁ। আমার নাম জানলে কেমন করে?
আবারও খ্যাল খ্যাল করে খানিকটা হাসে পরাঞ্জপে। টেনে টেনে বলে, আমি সব জানি। পাগল হয়েছি বলে কি তোর নামটাও জানব না রে শালে! হারামিকো বাচ্চে বলতে বলতে সে লখাইর ঘাড়ে মাথায় মুখে দমাদ্দম কিল ঘুষি চালাতে লাগল।
একটু পর মারধরের প্রকোপ কমল। এবার নরম গলায় পরাঞ্জপে বলল, তোকে পয়লা দেখেই দিলটা যেন কেমন করছে।
লখাই জবাব দিল না।
পরাঞ্জপে ফের বলল, ইচ্ছে হচ্ছে, তোকে শালে পেয়ার করি। বলেই গোটা কতক ঘুষি লাগাল। তারপর হঠাৎ লখাইর একগোছা চুল বাগিয়ে ধরে মাথাটা গরাদের কাছে টেনে আনল সে। তার কানের মধ্যে মুখটা ঢুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি পাগল, তাই না রে?
লখাই অবাক তাকিয়ে রইল।
লখাইর জবাব না পেয়ে পরাঞ্জপে খেপে উঠল, কি রে কুত্তীকা বাচ্চে, বাতাচ্ছিস না কেন? আমি পাগল?
কে বললে?
মোহর ওয়ার্ডার তোকে বলে নি? পরাঞ্জপে খেঁকিয়ে উঠল। সেই সঙ্গে ফের তার লম্বা হাতের কিল-চড় পড়তে লাগল লখাইর ওপর।
মুখে কথা সরল না লখাইর। অদ্ভুত কয়েদি পরাপের বিচিত্র ব্যবহারে সে তাজ্জব বনে গিয়েছে।
মার খেয়ে নাকমুখ হয়তো ফেটেই যেত লখাইর। তার আগেই দুপুরের খানাপিনার সময় হল। সঙ্গে সঙ্গে পেটি অফিসার নসিমুল গণির মুখ দেখা দিল। কর্কশ গলায় সে হাঁকল, কয়েদিলোগ আ যা–
নারকেলের ছোবড়া, মুগুর, ঝুরা, তার–সমস্ত পড়ে রইল।
নতুন পুরনো সব কয়েদির দঙ্গল হুড়মুড় করে নিচে নেমে এল। সকলের হাতেই লোহার বর্তন।
এক তলাতেই চানের বন্দোবস্ত। পাথুরে চত্বরে ঝপাঝপ দু-চার বালতি জল মাথায় ঢেলে কয়েদিরা ছুটল।
চানের পর দীর্ঘ টানা বারান্দার সামনে সকলে কাতার দিয়ে বসেছে। একপাশে হিন্দু, আর একপাশে মুসলমান কয়েদি। বর্মা মুলুকের বৌদ্ধ কয়েদিরা হিন্দুদের সঙ্গেই বসেছে।
খানিক বাদে হিন্দু এবং মুসলমান, দুই ভাণ্ডারা থেকেই খানা এসে পড়ল। মাথায় ফেট্টি-বাঁধা কালো কালো জন চারেক জোয়ান বিরাট বিরাট বালতি থেকে বড় বড় হাতায় ভাত, ডাল, ঘ্যাঁট কয়েদিদের লোহার থালায় ফেলতে লাগল।
এ-বেলা লখাইর ঠিক পাশেই বসেছিল ভিখন আহির। লখাইর থালায় খানা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পোড়া বীভৎস মুখটা অস্বাভাবিক করুণ করে সে ডাকল, লখাই ভেইয়া–
লখাই জবাব দিল না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
গলার স্বরটাকে যতখানি সম্ভব বিষণ্ণ করে তুলল ভিখন। পাঁজর কুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো তার। আস্তে আস্তে হতাশ স্বরে বলতে লাগল, না খেয়ে খেয়ে শালে ভুখে মরে যাব। আন্দামানে জান জরুর বরবাদ হয়ে যাবে–
নিঃশব্দে লখাই খানিকটা ভাত তরকারি নিজের থালা থেকে ভিখনের থালায় তুলে দিল।
ভিখনের একমাত্র চোখটা খুশিতে জ্বলতে লাগল। লখাইর হাত ধরে তোয়াজ করতে করতে সে বলল, সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছি ভেইয়া–
কিসের ব্যবস্থা?
কানের মধ্যে মুখ ঠেকিয়ে ভিখন বলল, আফিং আর চরস। পেটি অফসর শালে কাল দেবে। বহোত চড়া দাম ভেইয়া। পুরা একটা রুপেয়া খসাতে হল।
সত্যি বলছিস? লখাইর গলায় অবিশ্বাসের সুর।
জরুর সত্যি। একটু থেমে ভিখন বলল, দো-চার রোজের মধ্যে সোনিয়ার একটা খবর ভি মিলবে।
এরপর আর কেউ কিছু বলল না। বাঁ হাতে লোহার থালা আগলে গর্দান গুঁজে বিরাট বিরাট গরাসে মুখে ভাত তুলতে লাগল ভিখন।
খানাপিনা চুকিয়ে ওপরে উঠে এল লখাই। তারপর নিজের কুঠুরিটার সামনে পাকার নারকেল ছোবড়া, ঝুরা আর তারের মধ্যে বসে দুলতে লাগল।
এই শীতের দুপুরেও আন্দামানের আকাশে মৌসুমি মেঘ দেখা দিয়েছে। ছন্নছাড়া, খণ্ড খণ্ড মেঘ। সেলুলার জেলের মাথা থেকে রোদ উধাও হয়ে গিয়েছে। দূরের উপসাগর আর রস দ্বীপ কেমন যেন আবছা, দুর্বোধ্য দেখায়।
এদিকে একে একে সব কয়েদি ওপরে উঠে আসছে।
কয়েদখানার নিয়মে খানাপিনার পর কিছুটা সময় জিরিয়ে নেয় কয়েদিরা। তখন কেউ কিত্সা করে কাটায়, কেউ কিতাব পড়ে, কেউ ঝিমোয়, কেউ ঢোলে। কেউ আবার কিছুই করে না, আশমানের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
কিন্তু টিণ্ডাল, পেটি অফিসারদের দাপটে দুদণ্ড কি নিশ্চিন্ত হওয়ার যো আছে!
কিছুক্ষণ পরেই নসিমুল গণির মুখ দেখা দিল। দাঁত খিঁচিয়ে সে চিল্লায়, এ শালে লোগ, খুব যে আরাম করছিস! সন্ধের আগে আড়াই পাউণ্ড তার এক এক কয়েদির কাছ থেকে
পেলে হাড্ডি গোস্ত আলাদা করে ফেলব। ইয়াদ রাখিস। চিল্লাতে চিল্লাতে লম্বা কদমে অন্য ব্লকের দিকে চলে গেল সে।
আর সঙ্গে সঙ্গে শুকনো ছোবড়ার ওপর ধুপ ধাপ, সমতালে বেঁটে বেঁটে মুগুরের ঘা পড়তে লাগল। চাপা, ভয়ঙ্কর গলায় এক কয়েদি বলল, পেটি অফসর শালা দোজখের কুত্তা।
কথাটা অবশ্য নসিমুল গণির কান পর্যন্ত পৌঁছল না।
হাতের চেটো থেকে চামড়া উঠে গিয়েছে লখাইর। সারা সকাল ছোবড়া পিটিয়ে দু’হাত ফুলে উঠেছে, যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ার উপক্রম। অসহায়, করুণ চোখে একবার ছোবড়া, আর একবার বেঁটে মুগুরটার দিকে তাকাতে লাগল লখাই।
ওপাশের কুঠুরি থেকে সেই ডাকটা শোনা গেল, লখাই, এ শালে লখাই—
গরাদের ফাঁক দিয়ে লম্বা হাত বার করে অস্থিরভাবে নাড়ছে পরাঞ্জপে।
লখাই মুখ ফিরিয়ে তাকাল। চোখাচোখি হতেই পরাঞ্জপে আবার ডাকল, অ্যাই বুদ্ধ, এদিকে আয়।
পরাঞ্জপে যেন জাদু জানে। নিজের অজান্তেই তার কুঠুরিটার দিকে এগিয়ে এল লখাই। নাগালের মধ্যে পাওয়া মাত্র লখাইর চুলের মুঠি বাগিয়ে ধরল পরাঞ্জপে। বাকি হাতটা বার করে কিছুক্ষণ কিল-ঘুষি চালাল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, শালে উল্লু, বুদ্ধ, বুরবক–
গালাগালির কারণটা না বুঝে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইল লখাই।
পরাপে বলল, তোকে দেখে পেয়ার করার ইচ্ছে হয়েছে। তাই কিছু বলছি না, নইলে পয়লাই কোতল করে ফেলতাম, হাঁ–
বাজের ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাকটা গরাদের ফাঁক দিয়ে বার করে টেনে টেনে কী শুকল পরাঞ্জপে। উত্তেজনায় কপাল আর জানুর শিরাগুলি ফুলে ফুলে উঠেতে লাগল। তার।
এতক্ষণে লখাই বলল, কেন, কোতল করতে কেন?
পরাঞ্জপে খেপে উঠল, পয়লা দেখেই তোকে দোস্ত করে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তোর মাথায় মগজ আছে, থোড়া বুদ্ধি আছে। লেকিন কুছু নেই। মাথাটা তোর একটা টাট্টিখানা।
লখাইর মাথার সঙ্গে টাট্টিখানার উপমা দিয়ে নিজেকেই তারিফ করল পরাঞ্জপে। খুব এক চোট হেসে বলল, শালে, ছোবড়া পিটিয়ে জান পয়মাল করছিস কেন?
ছোবড়া পিটব না!
না।
পেটি অফসর তা হলে খতম করে ফেলবে।
ছোড় শালে পেটি অফসরকো। থোড়া বুদ্ধি খরচ করে আমার মতো পাগল সেজে যা। পাগল বনতে পারলে আর কাজ করতে হবে না। লেকিন পুরা খানা মিলবে।
তাজ্জবের গলায় লখাই বলল, পাগল বনব কেমন করে?
আরে বুদ্ধ, আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখ।
লখাই আগে যা দেখেছিল, এখনও তাই। পরাঞ্জপের সারা দেহ নগ্ন, কুর্তা-ইজের মাথায় ফেট্টির আকারে বাঁধা। একটু আগে ভাণ্ডারা থেকে খানা দিয়ে গিয়েছিল। কিছু তার খেয়েছে, বাকিটা সারা গায়ে মেখেছে।
পরাঞ্জপে গলা ফাটিয়ে হা হা করে হাসল। বলল, দেখলি আমাকে? তামাম আন্দামান ছুঁড়লে আমার মতো বুদ্ধি কোনো বুন্ধুর মধ্যে পাবি না। একটু থেমে আবার সে শুরু করল, নয়া এসেছিস কালাপানি। পয়লা তোকে ছোবড়া ছিলতে দিয়েছে। যখন হুইল ঘানিতে চাপাবে, রাম্বাস হেঁচতে দেবে, সড়ক বানাতে দেবে, তখন মালুম পাবি দরিয়ায় কত পানি। বাপের নাম ভুলে যাবি। তোকে দেখেই দোস্ত বানিয়ে নিয়েছি লখাই। তাই বলছি, বেঁচে থাকতে হলে পাগল বনে যা।
লখাই একটা কথাও বলল না।
পরাঞ্জপে বলতে লাগল, বিশ্বাস হচ্ছে না! শালে ঠেলা বুঝবি। কালাপানি এসে পাগল সাজলে ঘানি ঘুরিয়ে, ছোবড়া ছিলে, পাথর ভেঙে জান লবেজান হয়ে যাবে। আমার বুদ্ধি নে লখাই, বেঁচে যাবি।
লখাই একদৃষ্টে আন্দামানের সবচেয়ে চতুর, সবচেয়ে বুদ্ধিওলা কয়েদিটার দিকে তাকিয়ে রইল।