সিন্ধুপারের পাখি (Sindhuparer Pakhi) : 01
কথামুখ
‘Life is not a series of gig-lamps symmetrically arranged.’
পূর্বদেশীয় উপকথার উল্লেখ আছে, এক অজ্ঞাতনামা সওদাগর দুস্তর সমুদ্রে সপ্তডিঙা মধুকর ভাসিয়ে ‘আন্ধারমাণিক্যে’ পৌঁছেছিলেন। সম্ভবত এই ‘আন্ধারমাণিক্য’ই আন্দামান।
অতীত-কথা মাত্রেই অমৃতসমান। কিছু মোহ, কিছু আবেশ এবং কল্পনার কিছু বিলাস মিশিয়ে চোখ বুজে যে অস্পষ্ট, ধূসর অতীতের ধ্যান করি, তা অতি রমণীয়। তার স্বাদ মধুর।
বঙ্গোপসাগরের দু শ’ চারটি দ্বীপের সমষ্টি আন্দামান। তার অতীত কুহেলিবিলীন। ইতিহাসের ফাঁকগুলি কল্পনা আর অনুমান দিয়ে রিফু করে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কয়েক বছর আগেও আন্দামানের সঙ্গে কালা পানি নামে একটা ভয়ানক শব্দ মিশে ছিল। আর এই কালা পানির সঙ্গে মিশে ছিল বিভীষিকা, নিগ্রহ, দ্বীপান্তর এবং কুখ্যাত সেলুলার জেল। কিন্তু এ তো মাত্র বিগত কয়েক দশকের ইতিহাস, আমাদের সকলেরই জানা। সবার জানাশোনার পেছনেও আন্দামানের একটা বিপুল অতীত আছে। এখানে এসেছে বহু দেশ, বহু জাতির মানুষ। নাবিক-বণিক-পরিব্রাজকের মুখে মুখে প্রচলিত হাজার রূপকথায়, কিংবদন্তিতে এবং উচ্চারণভঙ্গিতে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার নাম ছড়িয়ে রয়েছে।
পোর্ট ব্লেয়ারের ফুঙ্গি চাউঙে বসে অনেক কথাই শুনেছিলাম।
মেজো ফুঙ্গি লা ডিন ত্রিকালদর্শী পুরুষ। সে কাল দেখেছেন, এ-কাল দেখছেন এবং যে বোধি থাকলে আগামী কালকে দেখা যায়, তা তার আছে।
বিচিত্র মানুষ লা ডিন। প্রথম জীবনে সুমাত্রা-জাভা-বলিদ্বীপে, শ্যাম-কাম্বোডিয়া মালয়ে-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরে বন্দরে নিরুদ্দেশ হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আঠার-শ’ চুরাশি পঁচাশিতে তৃতীয় বার ইংরেজদের সঙ্গে ব্রহ্মদেশের যুদ্ধ বাধে। হঠাৎ ব্রহ্মরাজ থিবোর পক্ষে লড়াই করে বন্দি হয়ে তিনি আন্দামান এসেছিলেন।
প্রথম জীবনের দুঃসাহসী পরিব্রাজক, মধ্য জীবনের সৈনিক, শেষ জীবনে কেমন করে ফুঙ্গি হলেন, সে কাহিনী অন্য। সে-কথা অনেক পরের। তবে সত্তর বছরের জীবনে অনেক দেখেছেন, অনেক শুনেছেন লা ডিন। দেখা এবং শোনার চেয়ে অনেক বেশি বুঝেছেন। বিশাল অভিজ্ঞতা আর বিরাট উপলব্ধির কথা সহৃদয় সমঝদার পেলে তিনি অনর্গল শোনান।
তাঁর কাছেই আন্দামানের অতীত-কথা শুনেছিলাম।
প্রথমেই লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, ঐতিহাসিক টলেমি আন্দামানকে আগাথু ডাইমনস নেসস (উত্তর আত্মার দ্বীপ) বলেছিলেন। আমার মনে হয়, ভুল তিনি করেন নি। খুব খাঁটি কথাই বলেছিলেন। এই দ্বীপে ইনসানিয়াতের বিচার চলছে। হাঁ বাবুজি, নয়া ইনসাফ। এই দ্বীপে একদিন মহান আত্মা জন্ম নেবে।
বর্মী লা ডিনের মুখে হিন্দি এবং উর্দু একাকার হয়ে অদ্ভুত শোনায়। এই বিচিত্র ভাষার মহিমা অনেক পরে বুঝেছিলাম।
এবার আন্দামানের ইতিহাস দেখা যাক। কোথায় যেন শুনেছিলাম, পুরাতত্ত্বের তুল্য সরস আখ্যান আর নেই। সময়ের মতো কাহিনীকার মেলা দুষ্কর। গাল্পিক ঘটনা বুনে বুনে গল্প বানান। কিন্তু ইতিহাস হল জাত গল্প। প্রয়োজনের খাতিরে সেখানে ঘটনা ঘটে, চরিত্র সৃষ্টি হয়। সেখানে তাল-মান-মাত্রা বজায় রেখে কল্পনার মিশেল দিয়ে নিটোল কাহিনি ফাঁদবার হাঙ্গামা নেই।
আন্দামানের ঐতিহাসিক কাহিনি অপূর্ব।
অনুমানের ওপর নির্ভর করলে দেখা যায়, খ্রিস্টজন্মের হাজার খানেক বছর আগে চিনা এবং জাপানিরা আন্দামানের কথা জানত। চৈনিক উচ্চারণে আন্দামান ইয়েঙ-ততা-মাঙ হয়েছিল। জাপানিরা বলত আন্দাবান।
বঙ্গোপসাগরের নাবিকরা হাজার হাজার বছর ধরে যে রূপকথা বানিয়েছে তাতে আছে, এক ঝক সাগর-পাখি দিক ভুল করিয়ে দুজন আরব নাবিককে আন্দামানে নিয়ে এসেছিল। আন্দামানের মাটিতে বিদেশি মানুষের সেই বোধ হয় প্রথম পদক্ষেপ। তারপর কত মানুষই না এল, কত দেশের কত জাহাজই না ভিড়ল!
পূর্বদেশীয় উপকথার সওদাগরই শুধু নন, সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় এবং আরব বণিকেরা, বৌদ্ধ ভিক্ষুণী ও শ্রমণেরা বার বার পূর্ব সমুদ্রে পালের জাহাজ ভাসিয়েছেন। সমাপ্তিহীন বঙ্গোপসাগরের মধ্যপথে আরাম-বিশ্রাম-খাদ্য আর স্বাদু জলের সন্ধানে আন্দামান দ্বীপমালায় তাদের বহর থেমেছে।
সে-সব দিনে মালয়ী ও চিনা জলদস্যুরা আন্দামানের উপকূলে হন্যে হয়ে ঘুরত। সুযোগ পেলেই এখানকার আদিম অধিবাসীদের ধরে নিয়ে শ্যাম, কম্বোডিয়া এবং ইন্দোচিনের রাজদরবারে বিক্রি করে দিত।
আন্দামানের উপকূলে কত জাহাজডুবি হয়েছে, এই সব দ্বীপের আদিম বাসিন্দাদের তীরে কত নাবিক প্রাণ হারিয়েছে, তার হিসাব কে রাখে। তবু নানা দেশ থেকে এখানে জাহাজ আসার বিরাম ঘটে নি। বিদেশিরা এসে একদিন এই দ্বীপপুঞ্জ দখল করে বসেছিল।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, আন্দামানের মিট্টিতে পঞ্চাশটা বছর কেটে গেল। এই দ্বীপের হরেক চীজ দেখলাম। জঙ্গল সাফ হয়ে শহর হল। সেলুলার জেল তৈরি হল। রস্ দ্বীপে রোশনি ফুটে উঠল, আবার নিভেও গেল। কত জাতের কত ধাতের মানুষই দেখলাম! মোপলা দেখলাম, পাঠান-পাঞ্জাবি-কারেন দেখলাম, বর্মী বাঙালি-চিনা দেখলাম।
হ্যাঁ, অনেক দেখেছেন লা ডিন। প্রিয়জন-পরিজনহীন এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে দিনের পর দিন কাটিয়ে কত কয়েদি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। অতিষ্ঠ হয়ে কেউ সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে হাঙরের দাঁতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে। ভাগোয়া কয়েদি গভীর অরণ্যে পালিয়ে জারোয়াদের তীরে প্রাণ দিয়েছে। অত্যাচার আর পীড়ন সইতে না পেরে কেউ কেউ ছোট ডিঙিতে বিপুল সমুদ্র পাড়ি দিতে চেয়েছে। তারপর পাহাড়-প্রমাণ ঢেউয়ের মর্জিতে কোথায় ভেসে গিয়েছে, পৃথিবীর কেউ খোঁজ রাখে নি।
অনেক, অনেক দেখেছেন লা ডিন। কয়েদির রক্তে, ঘামে এখানে সড়ক তৈরি হয়েছে। কয়েদির হাড় সাজিয়ে সমুদ্রের দেওয়াল বাঁধা হয়েছে। আন্দামানের মূক মাটিতে অনেক দীর্ঘশ্বাস, অনেক লোহু, অনেক স্বেদ এবং অভিশাপ গোপন হয়ে আছে।
সবই জানেন লা ডিন।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, দেখলাম তো বহুত, পেলাম কী? পেয়েছি বাবুজি, বহুত পেয়েছি, একদিন আপনাকে বলব।
কিন্তু পরের কথা অনেক আগে এসে গেল। এখন উজান ঠেলে না পিছিয়ে উপায় নেই।
বঙ্গোপসাগরের দু শ’ চারটি দ্বীপের স্থানমাহাত্ম্য যত, নামমাহাত্ম্য তার চেয়ে তিল পরিমাণ কম নয়। কোত্থেকে কিভাবে আন্দামান নামের উদ্ভব, তার হদিস পাওয়া দায়। চিনাদের ইয়েঙ-তো-মাঙ, জাপানিদের আন্দাবান না হয় বাদই দেওয়া গেল।
মার্কো পোলো বঙ্গোপসাগরে ‘আঙ্গামানিয়ান’ নামে দ্বীপমালা দেখেছিলেন। সপ্তম শতকে চৈনিক ভিক্ষু তি সিঙ এই দ্বীপে এসেছিলেন। সে-সময় এর নাম ছিল ‘আগদামান’। ক্লডিয়াস টলেমি এই দ্বীপকে ‘আগমাটে’ নামেও জানতেন। চোদ্দ শ’ চল্লিশে পরিব্রাজক নিকলো কন্টি আন্দামানকে স্বন্দ্বীপ আখ্যা দিয়েছিলেন। যোড়শ শতকে মাস্টার ফ্রেডরিক নিকোবর থেকে পেগু পর্যন্ত এক সারি দ্বীপ দেখেছিলেন। এখানকার বন্য অধিবাসীরা তাদের এই দ্বীপপুঞ্জকে নাকি ‘আণ্ডেমেওন’ বলত। মালয়ীরা আন্দামানের আদিম বাসিন্দাদের বলত ‘হণ্ডুমানী’।
এই নামাবলির কোনটি থেকে ‘আন্দামান’-এর উৎপত্তি, কে বলবে।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, এই আন্দামান সহজ জায়গা নয়। কোতল-রাহাজানি ডাকাতি না করলে এখানে আসা যায় না। যেদিকে তাকাবেন, যে মুখটি দেখবেন, হয় সে হত্যারা, নয় ডাকু। সে জন্যে মনে ঘৃণা রাখবেন না। একটু দরদি হবেন। সকলের বুকে কান রেখে দিলের কথা শুনবেন, তারপর তাদের মুখের দিকে তাকাবেন। দেখবেন, তারা খুব খারাপ নয়। কয়েদিরাও মানুষ।
মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
লা ডিন আবার শুরু করেছিলেন, বাবুজি, খুনি আর ডাকু ছাড়া অন্য মানুষও আছে। ইণ্ডিয়ার আজাদের জন্য যে-সিপাহিরা.প্রথম লড়াই করেছিল, তাদের নিয়েই আন্দামানের বন্দি কলোনির পত্তন। বর্মাকে আজাদ রাখার জন্যে রাজা থিবোর হয়ে যারা লড়েছিল, তাদেরও এখানে পাবেন। ইণ্ডিয়ার স্বদেশি বাবুদেরও খোঁজ নেবেন। সবারই সাধ ছিল, নিজের নিজের দেশকে আজাদ করবে। কিন্তু–
হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন লা ডিন। সামনেই বিরাট বুদ্ধমূর্তি। প্রসন্ন, ক্ষমাসুন্দর, ভগবান তথাগত। তন্ময় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন লা ডিন। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন। শুনতে পেলাম না।
আন্দামানের হাল আমল শুরু হল সতর শ’ আটাশি সালের সেপ্টেম্বর মাসে। লর্ড কর্নওয়ালিস লেফটেনান্ট কোলব্রুক এবং লেফটেনান্ট ব্লেয়ারকে আন্দামান দ্বীপমালায় সার্ভের জন্য পাঠান। তার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে একটি উপনিবেশ পত্তন করা।
ব্লেয়ার এবং কোলব্রুক সার্ভে রিপোর্ট পেশ করলেন। পরের বছরই সেটেলমেন্টের কাজ আরম্ভ হল। কতকালের দুর্ভেগ্য অরণ্য সংহার করে চ্যাথামে এবং বর্তমান পোর্ট ব্লেয়ারে কলোনি তৈরি হল। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই সেটেলমেন্টের কাজ উত্তর-পূর্ব দিকের পোর্ট কর্নওয়ালিসে তুলে আনা হয়। বন্দর এবং সুরক্ষিত পোতাশ্রয়ের পক্ষে পোর্ট কর্নওয়ালিস নিরাপদ। কিন্তু এই দ্বীপটি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর এবং মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হওয়ায় চার বছরের মধ্যেই সেখানকার কলোনি উঠে যায়।
পুরাতন নথিপত্রে পরবর্তী ষাট বছরের বিশেষ উল্লেখ নেই।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, দুনিয়ার হরেক কিসিমের পাপীতাপীর আস্তানা এই আন্দামান। এখানে দেখবেন মদের নেশায় চুর হয়ে কয়েদি নিজের আওরতকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে। এক রতি আফিমের জন্যে মানুষ এখানে চাকু চালায়। এখানে কথায় কথায় কোতল, কথায় কথায় ছোরাছুরি। তবু এই দ্বীপের একটা আত্মা আছে, বড় সন্দুর আত্মা। সেই আত্মাকে খুঁজবেন। তার খোঁজ না পেলে আপনার আন্দামানে আসা বৃথা হবে।
অবাক হয়ে লা ডিনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই মানুষটিকে যত দেখছি ততই বিস্মিত হচ্ছি।
চোখ বুজে লা ডিন আবার শুরু করেছিলেন। তার কথাগুলি সাজিয়ে নিলে এমন দাঁড়ায়। সমুদ্রের অতল থেকে এই দ্বীপমালা কবে উঠেছিল, কবে যে নিবিড় অরণ্যের ঘাগরায় নিজেকে সাজিয়েছিল, কে বলবে। সুদূর অতীত, গহীন অরণ্য, চারপাশের গর্জমান সমুদ্র, পাপ-তাপ, আকাশ বাতাস-অন্তরীক্ষ এবং আলো-অন্ধকারের মধ্যে এইদ্বীপের সুন্দর আত্মাটি সঙ্গোপন হয়ে আছে। অতি সন্তর্পণে তাকে খুঁজে নিতে হবে। বার বার হয়তো ব্যর্থ হতে হবে। সে-আত্মা ধরা দিয়েও দেবে না। তবু অসহিষ্ণু হলে চলবে না।
লা ডিন বলেছিলেন, বাবুজি, নিরাকাঙক্ষ না হলে আত্মাকে ধরা যায় না। যোগী-সন্ত ভিক্ষু বাসনা–মুক্ত হয়েই আত্মার মহিমা বুঝতে পারে। আপনি লেখক, মনে মনে আপনিও
তো সাধক–
হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন লা ডিন।
পোর্ট কর্নওয়ালিসের কলোনি উঠে যাওয়ার পর একটি একটি করে ছোট-বড়-মাঝারি, অনেকগুলি কারণ জমা হচ্ছিল। মালয়ী জলদস্যুদের উপদ্রব, জাহাজডুবি, নাবিকদের ওপর দ্বীপবাসী আদিম মানুষগুলির আক্রমণ, এমনি অসংখ্য। সর্বপ্রধান এবং সর্ববৃহৎ কারণটি পাওয়া গেল আঠার শ’ সাতান্নতে। এই বছরটা সিপাহি বিদ্রোহের বছর। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিদ্রোহীদের বহুদূরে নির্বাসন দেওয়ার একান্ত প্রয়োজন দেখা দিল।
আঠার শ’ আটান্ন সালের চৌঠা মার্চ আন্দামানের ইতিহাস অবিস্মরণীয় তারিখ। এই তারিখেই ডক্টর জে. পি. ওয়াকার দু শ’ জন বন্দি, একজন নেটিভ ওভারসিয়ার, দুজন ডাক্তার এবং ওল্ড ন্যাভাল ব্রিগেডের পঞ্চাশটি রক্ষী নিয়ে সেমিরামিস জাহাজে আন্দামান যাত্রা করলেন।
বঙ্গোপসাগরের বিচ্ছিন্ন দ্বীপমালায় স্থায়ী উপনিবেশ পত্তন সম্ভব হল। জীবনের সীমানা দীর্ঘ হল।
লা ডিন বলেছিলেন, ওই যে বললাম বাবুজি, নিরাকাঙ্খ না হলে আত্মাকে ধরা যায় না। কথাটা মনে রাখবেন।
বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে ছিলাম। সেদিকে তাকিয়ে ভাবলাম, নিরাসক্ত এবং নির্লিপ্ত হয়ে আন্দামানের আত্মাকে খুঁজব। এ এক দুরূহ ভাবনা, বড় কঠিন পরীক্ষা। জানি না বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার ঘুরে ঘুরে পাহাড় বনস্পতি-সমুদ্র, মানুষ এবং নিসর্গের মধ্যে তার গহন গোপন আত্মাকে খুঁজে পেয়েছি কিনা।
সে-দিন ফুঙ্গি চাউঙ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
মেজো ফুঙ্গি লা ডিন তন্ময় হয়ে তখন বুদ্ধপদ আবৃত্তি করছিলেন। তার কণ্ঠের ঝঙ্কার অনেকক্ষণ ধরে আমার কানে বাজছিল।
ন নগ্গচরিয়া, না জটা, ন পঙ্কা।
অনাসকা থণ্ডিলা সায়িকা বা।
রজোব জল্লং উকুটি কপ্পধানং,
সোধন্তি মচ্চুং অবিতিন্ন কঙ্ক্ষং।
–
আখ্যান
উনিশ শ’ এগার সালের এক দিন।
আউটরাম ঘাট থেকে আড়াই শ’ কয়েদি নিয়ে একটি জাহাজ আন্দামানে পাড়ি দিল। জাহাজটির নাম এস. এস. এলফিনস্টোন।
কাল সমস্ত দিন হুগলি নদীর গৈরিক জল দেখা গিয়েছে। অস্পষ্ট হলেও দু’পারে তীর দেখা যাচ্ছিল। এক ঝক সাগরপাখি মাস্তুলের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে আসছিল। দুই তীরের বাঁধনে আকাশটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাকে মাপা না গেলেও তার সম্বন্ধে ধারণা বিরাট ছিল না।
আকাশে শীতের রোদ ছিল, রোদে মাধুর আমেজ ছিল, দিগন্তে ঘন কুয়াশার স্তর ছিল। নদীর ঢেউ কুঁড়ে কুঁড়ে বাতাস উঠছিল, বাতাসে হিম মিশে ছিল। ঠাণ্ডায় মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে তীব্র কনকনানি ছুটে যাচ্ছিল যেন।
কিন্তু শীতের এই রোদ, আকাশ, নদীতীর, কুয়াশা–সবই বড় চেনা। এই কনকনানির অনুভূতি বড় পরিচিত।
তারপর একটি রাতের কারসাজিতে এমন বিস্ময় ঘটে গেল। এক ফুঙ্কারে পরিচিত পৃথিবীটা কোথায় অদৃশ্য হল। কোথায় পড়ে রইল রূপনারায়ণের মোহানা আর কোথায় রয়ে গেল সাগদ্বীপ!
ডায়মণ্ড হারবার পেরিয়ে গেরুয়া জল যখন সবুজ হল, তখনও শীতের বেলাশেষ নিভু নিভু আলো দিচ্ছিল। একটু পরেই ছায়া ছায়া অন্ধকার নেমেছিল। তারপর স্যান্ড হেডের মুখে এসে বৃত্তাকারে বাঁক নিয়ে নদী কখন সঙ্গমে মিশল, কখন সবুজ জল নীল হল, নীল কখন কালাপানি হয়ে নিঃসীম সমুদ্র হয়ে গেল–সে কথা আড়াই শ’ কয়েদি একবারও ভাবে নি। এমন বিপুল বিস্ময় তারিফ করার মতো মনই নয় তাদের।
আজ আর পারাপার নেই, দিকচিহ্ন নেই। ভরসা দেওয়ার মতো আকাশের কোথাও একটা সিন্ধু-শকুনকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কালকের চেনাজানা তীর, গৈরিক জলের নদী, কালকের আকাশ বাতাস আজ নেই, কোথাও নেই।
বিশাল সমুদ্র এখানে গর্জায়, গহীন সমুদ্র এখানে অবিরাম ফেঁসে। পাহাড়প্রমাণ তরঙ্গ মালা ফুলে ফুলে যেদিকে আকাশ আর সমুদ্র একাকার হয়ে মিশেছে, বিচিত্র আক্রোশে সেদিকে ধাওয়া করে।
ওপরে অবাধ আকাশ, নিচে অবারিত নোনা সমুদ্র। আকাশ আর সমুদ্র এখানে পাল্লা দিয়ে দিগ্বিদিকে ছোটে।
এর নাম বঙ্গোপসাগর।
বঙ্গোপসাগর–গভীর, গম্ভীর, ভয়ঙ্কর, কখনও বা প্রমত্ত। মুহূর্তে মুহূর্তে এর রূপ বদলায়, মেজাজ বদলায়। এর হঠকারিতার অন্ত নেই, এর খামখেয়ালকে বিশ্বাস নেই। কখন যে কালা পানি মেতে উঠবে, ঝড় তুলবে, কখন যে ফুলে ফুলে জল আকাশ-সমান উঁচু হবে, আর কখন যে একান্ত অবলীলায় মহাকায় জাহাজ ডুবিয়ে অথৈ অতলে টেনে নেবে, আগে থেকে হদিস মেলে না।
বিরাট একটা জলচর মাছের মতো ঢেউ কেটে এগিয়ে চলেছে এস. এস. এলফিনস্টোন। জাহাজ এখন দক্ষিণগামী।
অনেক আগেই সকাল হয়েছে।
অগাধ সমুদ্র থেকে একটি সোনালি গোলক একটু একটু করে আকাশের গা বেয়ে জাহাজের মাথায় এসে উঠেছে। দরিয়ার সূর্য, তার তেজ ভয়ানক।
নীল আকাশটা ঝকঝক করে। টুকরো টুকরো হালকা মেঘ উত্তর থেকে দক্ষিণে, আড়াআড়ি পাড়ি জমায়। নিচে নোনা জলের দরিয়া ফুঁসতে থাকে। সমস্ত সমুদ্র জুড়ে যতদূর দৃষ্টি চলে, শুধু কোটি কোটি ঢেউয়ের মাথা ঝকমক করে।
চার নম্বর হ্যাচে তিন কয়েদি ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে ছিল। মাঝখানের কয়েদিটির মাথা দু’হাঁটুর মধ্যে গোঁজা। কোমর থেকে শরীরের ওপরের অংশটা নগ্ন। পরনে লম্বা লম্বা কালো দাগকাটা ইজের। গায়ের রং পোড়া তামার মতো। চওড়া কাঁধ, মজবুত গর্দান। বিরাট দেহে থরে থরে কঠিন পেশি। মাথার চুল নিরপেক্ষ ভাবে ছোট এবং সমান করে ছাঁটা। দু’পায়ে লোহার বেড়ি। নাম লখাই।
ডান পাশ থেকে একটা গলা শোনা গেল, লখাই ভাই–
লখাই মাথা তুলল। ঘোর ঘোর রক্তাভ চোখ, মণি দু’টি লাল। উদ্ধত চোয়াল, চোখের নিচে হনু দু’টি অতি প্রকট। রোমশ বুক, চ্যাপ্টা নাক, মাংসল কাঁধ। সমস্ত শরীরে মোটা
মোটা শক্ত হাড়।
ডাইনে তাকাল লখাই। দেখল, তোরাব আলি সমুদ্রের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।
সারা মুখে হিংস্র ভঙ্গি ফুটল লখাইর। ভাঙা, কর্কশ গলায় সে বলল, আঁই হারামী, কী কইচিস?
কালা পানি রে লখাই ভাই! ফিসফিস স্বরে তোরাব আলি বলল। তার গলায় কাঁপুনি ধরেছে।
হুঁ। সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে আবার হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজল লখাই।
আকারে প্রকারে তোরাব আলি লখাইর মতো মারাত্মক নয়। বেঁটেখাটো দোহারা চেহারা। কিন্তু ছোট ছোট গোলাকার চোখ দুটো অতি ধূর্ত, অতি কুটিল। ঠোঁটের পাশ থেকে কান পর্যন্ত ডান গালে পুরু কাটা দাগ। এই দাগটা এবং কুটিল একজোড়া চোখ তার মুখটাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
তোরাব আলি ফের ডাকল, লখাই ভাই–
লখাই জবাব দিল না।
আপন মনেই এবার তোরাব বলতে লাগল, সমুন্দরের পার কূল নাই। দরিয়া দেখে বুকের লৌ যে পানি হয়ে যায়। হা আল্লা, কোথায় জন্ম দিলে আর কোথায় মারতে নিয়ে চলেছ। তোমার মর্জি বুঝি না।
অনেকটা সময় কাটে।
লখাই কথা বলে না। এই বিপুল সমুদ্রের মতোই আল্লার মর্জির পারকুল না পেয়ে চুপচাপ বসে থাকে তোরাব।
জাহাজটা মুহূর্তের জন্য থামে না। ধক ধক অদ্ভুত শব্দ করে অবিরাম ছুটতে থাকে। চাকার ঘা লেগে লবণসমুদ্র গেঁজে ওঠে। কালো দরিয়ায় পুঞ্জ পুঞ্জ তুষারের মতো সাদা
ফেনা ফোটে।
চারদিকে শুধু জল, কালো কুটিল জল। নিঃসীম, অফুরন্ত বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর তো কোনোদিন শুকোয় না, কোনোকালে ফুরোয় না। এর জলতলের মাটি কেউ কখনও দেখে নি, চিরকাল গোপন হয়েই আছে।
তোরাব হঠাৎ বলে, জবর ডর লাগে লখাই ভাই–
ডর লাগে! দু’হাঁটুর ফাঁক থেকে মুখ তুলে তাকায় লখাই। বলে, কেন?
দরিয়া দেখে, কালা পানি দেখে।
লখাই খেপে ওঠে। রক্তাভ চোখজোড়া জ্বলতে থাকে। সে বলে, মানুষের খুন দেখে ডর লাগে না, পানি দেখে লাগে! চুপ মার কুত্তা, এটুন ঘুমুতে দে।
জাহাজের দোলানিতে কাল সারারাত এক দণ্ড ঘুমাতে পারে নি লখাই। কপালের দু’পাশে সরু সরু রগগুলো যন্ত্রণায় ফুলে উঠেছে, দাপাদাপি করছে। মোটা মোটা আঙুলে টিপেও তাদের বাগ মানানো যাচ্ছে না।
বিরক্ত চোখে ভোরাবের দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাঁটুর ফাঁকে মাথা নামায় লখাই।
আর সঙ্গে সঙ্গে বাঁ পাশ থেকে আর্তনাদ ওঠে।
চমকে তাকায় লখাই। লোকটা দু’হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কাঁদছে। আউটরাম ঘাটেই প্রথম দেখেছে, লোকটা বর্মা মুলুকের। নামটাও জেনে নিয়েছে লখাই। মঙ চো।
ধারাল কনুইটা দিয়ে মঙ চোর পাঁজরে সজোরে খোঁচা দিল লখাই। তারপর খেঁকিয়ে উঠল, কি রে শালা, চিল্লাচ্ছিস কেন?
মুখ থেকে হাত নামায় মঙ চো। কুতকুতে চাপা চোখ দুটো কান্নায় বুজে গিয়েছে। মুখটা বিকৃত দেখাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় হাউ হাউ করে কী যে সে বলে, কিছুই বোঝা যায় না। হাত বাড়িয়ে বার বার সে সামনের সমুদ্র দেখায়।
লখাই চেঁচায়, হারামীটা কী বলে রে, এট্টুও বুঝি না।
তোরাব বলে, দরিয়া দেখে বুঝি ডর লেগেছে বর্মীটার।
ডরপোক। বিদ্রুপে পুরু পুরু কালো ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল লখাইর। নিরোম দ্রুর তলায় হিংস্র চোখজোড়া কোঁচকাল। লখাই গর্জে উঠল, কুত্তা কঁহাকা, ভাগ এখান থেকে। আমার পাশে বসে মাগীদের মত ফাঁচফাঁচ করতে পারবি না।
বলতে বলতে মঙ চোর কাঁধ ধরে প্রবল ঝকানি দিল লখাই। আবার বলল, কাদলে অ্যায়সা কুনুই হাঁকাব–
মঙ চো কী বুঝল, সে-ই জানে। একবার লখাইর দিকে তাকাল। কাল জাহাজ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিদারুণ কান্না জুড়েছে। এখনও থামে নি। পুরা একদিন সে কিছু খায় নি, শোয় নি, সমানে কাঁদছে। চোখ দুটো ফুলে উঠেছে।
মঙ চোর ফোলা ফোলা কুতকুতে চোখে কাতর দৃষ্টি ফুটল। তার পরই দু’হাতে মুখ ঢাকল সে। আর শব্দ করল না। শুধু শরীরটা থরথর কাঁপতে লাগল।
মঙ চোর দিকে থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে অনেক উঁচুতে তুলল লখাই। আশ্চর্য! একটা সাদা সাগরপাখি মাস্তুলের ডগায় বসে রয়েছে।
লখাই রুক্ষ স্বরে গজগজ করে, খালি ডর আর ডর। অতই যদি ডরাস, তবে কালা পানি যেতে চেয়েছিলি কেন রে হারামীর বাচ্চারা! আই–
একটু থামে লখাই। আবার শুরু হয়, সমুদুর দেখেই মড়াকান্না লাগিয়েছিস! শালা আন্দামানে নেমে যে দম ফেটে খতম হয়ে যাবি। বিশ সাল ঘানি ঘোরাবি কেমন করে!
সময় কাটতে থাকে, রোদের তেজ বাড়ে। মাস্তুলের ডগায় সাগরপাখিটা যেন ঝলসে যাচ্ছে।
এবার মঙ চোর কাঁধে হাত রাখে লখাই। নরম গলায় বলে, কাঁদবিই যদি, তবে খুন করেছিলি কেন? জানিস না, খুন করলে হয় কঁসি, নয় কালা পানি। ওই সব কঁদুনি ভুলে যা মঙ চো। আন্দামান হল জাহান্নাম জায়গা। সেখানে কার কাছে কাঁদবি মানিক? ঘরের মাগ আছে সেখানে?
আরো অনেকটা সময় কাটে। কেউ আর কিছু বলে না। রোদের রং হলদে হয়ে আসে।
একসময় তোরাব বলে ওঠে, তার গলাটা বড় করুণ শোনায়, লখাই ভাই, তা হলে আমরাদ্বীপান্তরেই চললাম!
ভারী গলায় লখাই বলে, হাঁ রে, হাঁ। যাচ্ছিস আর মালুম পাচ্ছিস না?
শালার দিলটা জবর খারাপ হয়ে গেছে। লখাইর দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করে তোরাব। চোখ দুটো সামান্য চিকচিক করে।
লখাই বলে, কী হল আবার?
বিবির কথা মনে পড়ছে। ভাঙাভাঙা, অদ্ভুত গলায় তোরাব বলতে থাকে, বিবির পেটে ছানা রয়েছে। আসার সময় জাহাজঘাটে খুব একচোট কাদল সে, বলল। ছেলে জন্মে কুনোদিন তার বাপজানের মুখ দেখতে পাবে না। একটু ছেদ, তারপর বলে, ঠিকই বলেছে বিবি, আন্দামান থেকে আর কুনোদিন ফিরতে হবে না। আর ছেলেও শালা বাপজনের মুখ দেখবে না।
লখাই জবাব দেয় না। খুনখারাপি, রাহাজানি–দুনিয়ার সব রকম ভীষণতার সঙ্গে তার পরিচয় আছে। লালসা, মত্ততা–এগুলির মহিমা সে পুরোপুরি বোঝে। কিন্তু বিষাদে মন যখন নরম হয়, তার মুখে উপযুক্ত জবাব যোগায় না।
তোরাব আবার বলে, দিলটা গোরস্থান হয়ে গেছে। কিছুই ভাল লাগে না। খেয়ে শুয়ে বসে জুত পাই না। খালি বিবির পেটের ছানাটার কথা ভাবি।
লখাইর গলাটা বিষণ্ণ শোনায়, আন্দামান যাচ্ছিস তোরাব। ঘর-সংসার বিবি-বাচ্চার কথা ভুলে যা। যত ভাববি, দিল তত বিগড়োবে।
ভুলতেই তো চাই। কিন্তুক খোদা কি ভুলতে দেবে? কোতল করেছি–হিসেব করে গুনাহর সাজা দেবে না? একটু থামে তোরাব। বড় বড় শ্বাস টানে। অল্প অল্প হাঁপায়। তারপর বলে, দরিয়ার এ-পারে থাকবে বিবি, অনেক ফারাকে দরিয়ার ও-পারে থাকব। আমি। খোদার ইচ্ছা, দিনরাত বিবির কথা ভাবিয়ে ভাবিয়ে আমাকে খতম করবে।
এবার লখাই উত্তর দেয় না। স্থির দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। তার চোখের পাতা পড়ে না।
তোরাব বলে, কী করি বল দিকি লখাই ভাই? বিবির কথা ছেলের কথা ভেবে কুননা কালে তত দিলটা এমন বিগড়ে যেত না!
বড় করুণ দেখায় তোরাবকে। তার কদাকার মুখখানা এই মুহূর্তে তত খারাপ মনে হয় না।
দিলকে ফুর্তি দেওয়ার মতো একটি মাত্র অমোঘ প্রক্রিয়ার কথাই জানা আছে লখাইর। ভড়ে ঊড়ে নির্জলা তাড়ি গিলে, ভাড়া-করা কোনো মেয়েমানুষের ঘরে উন্মত্ত রাত্রি কাটানো। তাড়ির উগ্র ঝাঁঝাল স্বাদে এবং তীব্র উত্তেজক নারীমাংসে যে মৌতাত জমে, তাতে ঝুঁদ হয়ে থাকলে বিগড়ানো দিল আপনিই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। আন্দামানগামী এই জাহাজে ওই বস্তু দু’টি নেহাতই নাগালের বাইরে। তা ছাড়া, হাঠাৎই লখাইর মনে হয়, দুনিয়ার সব মন-খারাপের প্রতিকার বোধ হয় নেশায় এবং নারীমাংসে নেই।
বলি বলি করেও দিলকে ফুর্তি দেবার মতো অমোঘ উপায়টার কথা তোরাবকে বলতে পারে না। অদ্ভুত বিষাদে মনটা ভরে যায়। উদাস চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে লখাই।
তোরাব ডাকে, লখাই ভাই–
আচমকা লখাই খেঁকিয়ে ওঠে, চুপ মার। সেই থেকে ঘ্যানঘ্যান লাগিয়েছে! শালা যেন একাই বিবি ছেড়ে এসেছে–
বঙ্গোপসাগরের ঢেউ ফুঁড়ে খুঁড়ে জাহাজ ছোটে। বিপুল সমুদ্র পেরিয়ে কবে যে আন্দামানের কূল মিলবে, কে জানে।
তিনটে কয়েদি চার নম্বর হ্যাচের ওপর নির্বাক, নিস্পন্দ বসে থাকে।
আউটরাম ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়ার পর দু’দিন পার হল। ডেরিকের নিচে বসে সমুদ্র দেখছিল লখাই।
জাহাজের শব্দে উড়ুক্কু মাছগুলি জল ছুঁড়ে কুঁড়ে উড়ছে। সাঁ করে খানিকটা উড়ে । আবার সমুদ্রে মিলিয়ে যাচ্ছে। তাদের ফিনফিনে রুপোলি ডানা রোদে চিকচিক করে।
দু’দিন ধরে পাটকিলে রঙের যে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ভাসছিল, আজ তারা বদলে গিয়েছে। কালো মেঘ দক্ষিণ আকাশে পাহাড়ের মতো জমতে শুরু করেছে। এতটুকু ফাঁক নেই, রন্ধ্র নেই। দরিয়ার এই মেঘ–নিরেট, কঠিন এবং বিপজ্জনক।
এখন বিকেল।
দক্ষিণ দিকের বিশাল জমাট মেঘ ফুলতে শুরু করেছে। চতুর্দিকে তার শুড় বেরিয়েছে। বাকি তিন দিকের খণ্ড খণ্ড মেঘগুলিকে খুঁড় দিয়ে টেনে এনে মিলে মিশে একাকার হয়ে আকাশ ঢেকে ফেলছে।
সামনের মাস্তুলটার দিকে তাকাল লখাই। আশ্চর্য! সাগরপাখিটা উধাও হয়েছে। থেকে থেকে পাখিটা কোথায় যে পালায়, ঠিক করে উঠতে পারে না সে। তা ছাড়া, পাখির ভাবনা ভাবার সময়ও এটা নয়। আর তেমন মনও নয় লখাইর।
পায়ের বেড়ি বাজাতে বাজাতে ভিখন আহীর এল। লোকটার মাথা এবং বাঁ গালটা সমেত একটা চোখ পোড়া। মাথায় চুল নেই। বাঁ গালে কালো কালো, পোড়া মাংস কুঁচকে রয়েছে। মুখটা বীভৎস দেখায়।
ভিখনের একটি মাত্র চোখ। সেই চোখটার ওপর লালচে ভুরু। নাক নেই, দুটো গোলাকার গর্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ চালায়।
এমন ভয়ানক চেহারা ভিখনের, কিন্তু তার গলার স্বর বড় সরু, বড় সুরেলা। সে বলল, কী করছিস লখাই?
দরিয়া দেখছি।
লখাইর পাশে বসে পড়ে ভিখন। ফিসফিস করে বলে, এই দুরোজ পেটে কুছ পড়েছে? তার একটি মাত্র চোখে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ফোটে।
লখাই দু’পাশে মাথা নাড়ে। মুখে বলে, না। জাহাজে নেশার চিজ পাব কোথায়? ভাঙায় নেমে খোঁজ করতে হবে। একটু থেমে আবার শুরু করে, ও-সব না পেলে শালা সমুদুর সাঁতরেই আন্দামান থেকে ভাগব।
আমার দিকে তাকা। ভিখন নিচু স্বরে বলে। তার মুখে মিটিমিটি রহস্যময় হাসি ফোটে।
লখাই ঘুরে বসে। চারদিক ভাল করে দেখে নেয় ভিখন। খানিকটা সময় কাটে। কান সজাগ করে জাহাজের সমস্ত শব্দ শোনে। শব্দগুলির মর্ম বুঝবার চেষ্টা করে। তারপর নিঃসন্দেহ হয়। নাঃ, আশপাশে কেউ নেই।
কোমরের খোঁজ থেকে একটা কাগজের মোড়ক বার করে ভিখন। তীব্র মাদক গন্ধে স্নায়ুগুলো ঝিমঝিম করে ওঠে লখাইর। প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সে। ঘোর কাটলে লাফিয়ে উঠল, মুহূর্তের মধ্যে ভিখনের থাবা থেকে মোড়কটা ছিনিয়ে নিল। উত্তেজনায় তার বিরাট দেহ অল্প অল্প কাঁপছে, চোখদুটো ঝকঝক করছে।
লখাই চেঁচিয়ে ওঠে, আফিং–কোথায় পেলি?
তালু এবং জিভের যোগাযোগে অদ্ভুত শব্দ করে ভিখন। তারপর বলে, সামাল দাদা। নেশা হাতে পেয়ে মাথা বিগড়ে গেল! চিল্লাচ্ছিস যে, লাল পাগড়িওলারা টের পাবে না?
এখন পৃথিবীর অন্য কোনো ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই লখাইর। তার সব উৎসাহ, সব কৌতূহল ওই মোড়কটার মধ্যে। পরতের পর পরত কাগজ খুলে কালো রঙের আফিম বার করল লখাই, ক্ষিপ্র নিপুণ হাতে গোলাকার পিণ্ড পাকিয়ে চক্ষের পলকে মুখে পুরে দিল।
একদৃষ্টে সব দেখল ভিখন। হুস করে ফুসফুসে বাতাস টানল। পর মুহূর্তেই বাতাসটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল।
কর্কশ মোটা জিভটা একবার বার করল ভিখন। ফাটা ফাটা ঠোঁট দুটো চাটল। মুখেচোখে কেমন এক ধরনের আক্ষেপ ফুটল। ভাবল, আফিমের কথাটা লখাইকে না জানালেই হত।
চোখ বুজে আসছে লখাইর। আফিমের নেশা জমতে শুরু করেছে। শিরায় শিরায় ঝিমঝিম উত্তেজনা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে।
আফিমের প্রথম ধাক্কাটা সামলে লখাই বলল, আফিং পেলি কোথায় ভিখন?
তোকে বলেছিলুম না লখাই, আমি এই সমুন্দরেও সব চীজ জোটাতে পারি।
সত্যি?
হাঁ, সচ।
চোখ বুজেই লখাই তারিফ করে, তুই শালা আসলী হিরে। এই জন্যেই তো তোকে এত পেয়ার করি। কিন্তুক মানিক, আফিং কেমন করে জোটালি তা তো বললি না।
আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখ।
চোখের পাতা ফাঁক করে লখাই তাকায়। আর ভিখন অদ্ভুত কৌশলে মুখে আঙুল ঢুকিয়ে একটা টাকা বার করে। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ধাতুমুদ্রাটি বাজায়। ঠং করে শব্দ হয়। সে বলে, ভেইয়া রে, এই চিজ হল রুপেয়া। এই চিজ তোর কাছে থাকলে, তুই দরিয়াতেই থাক আর আসমানেই থাক, দুনিয়ার হর চীজ তোর হাতে আসবে।
সত্যি?
সচ।
সব চীজ?
জরুর।
মুহূর্তে মনের কথাটা বুঝে নেয় ভিখন। একমাত্র চোখটা কুঁচকে ফিসফিস করে বলে, আওরত ভি মেলে।
এবার পুরাপুরি চোখ খুলে ফেলে লখাই। আফিমের নেশা স্নায়ুতে স্নায়ুতে ঘা মারছে। কাঁপা, তীব্র গলায় সে বলে, দরিয়ায় মেয়েমানুষ কোথায় মিলবে?
মিলবে রে ভেইয়া, মিলবে। চারদিকে তাকিয়ে ভিখন বলে, নগদা চৌআনি খসিয়ে হাবিলদারজির কাছ থেকে খবরটা জুটিয়েছি।
কী খবর?
বহুত বঢ়িয়া।
লখাইর কানে মুখটা গুঁজে তীক্ষ্ণ, সরু গলায় ভিখন বলে, এই জাহাজে পঞ্চাশটা আওরত কয়েদি চলেছে।
সত্যি! উত্তেজনায়, উল্লাসে চোখদুটো ঝিকঝিক করে লখাইর। সে বলে, ঠিক বলছিস?
জরুর।
অনেকটা সময় কাটে। কেউ কথা বলে না, শব্দ করে না। শুধু দুটো কয়েদির তিনটে চোখ ধিকিধিকি জ্বলে।
হঠাৎ ভিখন বলে, তোকে আফিং জুটিয়ে দিলাম, আওরতের খবর বাতলে দিলাম। আমার কথাটা মনে আছে তো?
তোর আবার কী কথা?
সাবাস ভেইয়া, এর মধ্যেই ভুলে গেলি!
পোড়া বীভৎস মুখখানা যতদূর সম্ভব করুণ করে ভিখন বলে, রোজ তোর খানা থেকে একটা করে রোটি দিবি বলেছিলি না?
লখাই জবাব দেয় না। নির্বিকার ভঙ্গিতে সমুদ্র দেখতে থাকে। নেশাটা জমে ওঠার মুখে হঠাৎ যেন ফিকে ফিকে লাগে।
ভিখন আবার বলে, আমার ভুখটা বহুত হারামি, জেলের খানায় পেট ভরে না। শুনেছি আন্দামানে খানা ঘোড়া মেলে। রামজির কসম লখাই, আন্দামানে তোকে রোজ নেশা জুটিয়ে দেব, লেকিন রোটি দিবি তো?
দেব।
মুখে বলে বটে, কিন্তু মনে মনে লখাই ভাবে রুটির বদলে নেশার কথাটা ভিখনকে না বললেই হত।
রুটির বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলে ভিখন। বলে, ইয়াদ রাখিস লখাই, নইলে মরে যাব।
চুপ মার। লখাই গর্জে ওঠে।
তবু ভিখন বিড়বিড় করে বকে যায়, দুরোজ জাহাজে চিড়ে চিবিয়ে রয়েছি। তকদির জবর খারাপ। রুপেয় হলে জাহাজে নেশা মেলে, লেকিন খানা মেলে না। পেটে আগুন জ্বলছে। শালারা আমাদের ভুখাই খতম করবে।
এই দু’দিন চিড়ে, মরিচ আর সামান্য নিমক ছাড়া কিছুই জোটে নি কয়েদিদের। খিদের তাড়নায় ভিখনের পোড়া কদাকার মুখটা হিংস্র দেখায়।
বিরক্ত চোখে তাকায় লখাই। চড়া গলায় বলে, কী কইছিস?
ভুখাই মরব।
খালি ভুখ আর ভুখ। দুনিয়া খেয়ে ফেললেও তোর ভুখ মিটবে না। লখাই বলতে লাগল, শালা দ্বীপান্তরে গিয়ে আন্দামানটাকেই গিলে ফেলবে।
ভিখন জবাব দেয় না।
লখাই আবার বলে, রুপেয়া হলে তো হর চীজ মেলে। বাড়তি খানা জুটল না?
খানা তো আছে। লেকিন খেতে পারলাম না। কেন?
জাহাজিরা খানা পাকাচ্ছিল। ছুঁড়ে কুঁড়ে সেখানে গেলাম। লাল পাগড়িওলারা টের পেয়ে আমাকে ধরে আনলে। হারামিরা খেতে দিলে না। অ্যায়সা রদ্দা হাঁকালে, এই দ্যাখ গদান চুরচুর হয়ে গেছে। একটু থেমে দম নেয় ভিখন। তারপর চাপা, ক্রুদ্ধ গলায় অশ্রাব্য খিস্তি করে।
অনেকটা সময় কাটে।
হঠাৎ মোলায়েম গলায় লখাই ডাকে, এই ভিখন—
কী?
মাগী কয়েদিগুলো কোথায় রে?
জানি না।
ঠিক বলছিস?
হাঁ।
দুচোখের ফাঁদ পেতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে লখাই। নাঃ, ভিখনের মুখে ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে না। মনে হয়, সত্যিই মেয়ে কয়েদিদের খবর তার জানা নেই। তবু চড়া, কর্কশ গলায় সে বলে, ঝটা বলবি না ভিখন। শালা অ্যায়সা কোতকা হাঁকাব–
ঝুট বলছি না। মাপা আধ হাত জিভ কাটে ভিখন। কানে হাত ঠেকিয়ে বলে, আওরত কয়েদিরা কোথায় আছে, হাবিলদারজি বাতায় নি। সচ বলছি, রামজি কসম।
যা, ভাগ এখান থেকে। লখাই খেঁকিয়ে উঠল।
ভিখন চলে গেল।
প্রথমে খেয়াল করেনি লখাই। হঠাৎ আকাশ এবং সমুদ্রের চেহারা দেখে তার অন্তরাত্মা চমকে উঠল।
দক্ষিণ দিকের কালো জমাট মেঘ একটু একটু করে অর্ধেক আকাশটাকে কখন যেন ঢেকে ফেলেছে। তুফান উঠছে সাঁই সাঁই। ওপরে কালো মেঘ ফুলছে, নিচে লবণ দরিয়া উথলে উথলে উঠছে, সমানে ফুঁসছে। পশ্চিমা বাতাস শূন্যে পাক খেয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আকাশটাকে ফালা ফালা করে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়। কড়কড় শব্দে বাজ পড়ে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যেন প্রলয় ঘটে গেল।
সামনের ফোরমাস্টটা মড়মড় করে। যে কোনো সময় সেটা ভেঙে পড়তে পারে। এলফিনস্টোন জাহাজটা বিরাট বিরাট ঢেউয়ের মর্জিতে একবার আকাশে উঠছে, পর মুহূর্তেই পাতালে নামছে। উন্মাদ দরিয়া দু’পাশ থেকে তাকে এলোপাথাড়ি ঝাঁকাচ্ছে।
রোলিং এবং পিচিং শুরু হয়েছে।
আকাশের কোথাও এখন সূর্যটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতটুকু আলো নেই। কালো, কুটিল, ভয়ঙ্কর অন্ধকার আকাশ এবং সমুদ্রকে গিলে ফেলেছে।
আসন্ন বিপদের সঙ্কেত জানায় জাহাজের যে ঘণ্টাটা, সেটা অবিরাম বাজছে। দূরে মেইন ডেকে, ব্রিজে, এঞ্জিন রুমে খালাসি-সারেঙ-সুখানিরা সমানে চিৎকার করছে। কিন্তু কিছুই শোনা যায় না। মেঘ, সমুদ্র আর কড়কড় বাজের গর্জন সব শব্দকে ঢেকে দিয়েছে।
কালাপানি মেতেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে আপার ডেকের ওপর জল উঠছে। জাহাজের আলোগুলো একবার জ্বলছে, একবার নিভছে।
চারদিকে তাকাতে লাগল লখাই। যাত্রী বলতে এই জাহাজে একমাত্র কয়েদিরাই। আর যারা জাহাজ চালায় তারা। ডেকের কোথাও তাদের চিহ্নমাত্র নেই। কী এক ভোজবাজিতে সবাই উধাও হয়েছে। সদাব্যস্ত খালাসি, যারা কাজে অকাজে জাহাজময় ছোটাছুটি করে, তাদেরও দেখা গেল না।
জাহাজের এ-অংশটা নির্জন। জাহাজিদের গোটাকতক কেবিন, একটা হ্যাঁচ, মাল তোলার একটা ডেরিক, ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড আর খোলা ডেক–এ ছাড়া কিছুই নেই।
ডেরিকের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল লখাই। কিন্তু পরমুহূর্তে তুফান আর বাতাসের ঝাঁপটা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। আবার উঠবার চেষ্টা করল, আবারও পড়ল। কয়েক বার চেষ্টার পর উঠল না লখাই।
সমুদ্র থেকে অবিরাম লবণ জলের ঢেউ উঠে আসছে। জল আর বাতাসের যা জোর, উঠলে হয়তো সমুদ্রে উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই। তা ছাড়া পায়ে মোক্ষম বেড়ি পরানো। হাঁটলে একবারে বিঘত-খানেকের বেশি এগোনো অসম্ভব, লম্বা করে পা ফেলতে গেলেই বেড়িতে টান পড়ে।
পুলিশ হাবিলদারদের চোখ এড়িয়ে ডেরিকের নিচে এসে বসে ছিল লখাই। দরিয়ার দিকে তাকিয়ে মনে হল, না এলেই ভাল হত।
বসে থাকারও উপায় নেই। জল আর ঝড় ডেরিকের মোটা মোটা লোহায় আছাড় মেরে তাকে গুঁড়িয়ে ফেলবে যেন। এখান থেকে ডান দিকে কমপক্ষে শখানেক হাত যেতে পারলে তাদের লোয়ার ডেকের সিঁড়ি মিলবে। আর বাঁ দিকে হাত পঞ্চাশের মধ্যেই ছাদ ঢাকা আর একটা ডেক, জাহাজিদের কেবিন।
মুহূর্তে স্থির করে ফেলল লখাই, বাঁ দিকেই যাবে। যেমন করে হোক, সেখানে পৌঁছতে হবে। আপাতত একটা নিরাপদ আশ্রয় চাই।
দাঁতে দাঁতে চাপল লখাই। তারপর উবু হয়ে শুয়ে পড়ল। অকারণ আক্রোশে চোখদুটো তার জ্বলছে।
জাহাজটা অবিরাম ভো বাজিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে বিপুল সমুদ্রে নিজের অসহায়, ক্ষীণ অস্তিত্বটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঝড় এবং তুফানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়ছে।
খোলা ডেকের ওপর বুকে হাঁটতে হাঁটতে জল আর বাতাসের সঙ্গে সমানে যুঝছে লখাই। শরীরটা ভিজে গিয়েছে। শীতে হাড়ের মধ্যে কাঁপন ধরেছে। বুকটা ছিঁড়ে জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে যাচ্ছে। তবু এগোবার বিরাম নেই।
পিছল ডেকে বুক ঘষে চলতে চলতে হঠাৎ ভাল লেগে গেল লখাইর। এই উন্মাদ দরিয়ার সঙ্গে তার স্বভাবের কোথায় যেন একটা সাঙ্ঘাতিক মিল আছে।
একবার চোখ মেলবার চেষ্টা করল লখাই। পারল না। লোনা জলের ঝাঁপটায় চোখদুটো কর কর করছে। আন্দাজে বুঝল, আর একটু যেতে পারলেই জাহাজিদের কেবিনগুলো পাওয়া যাবে।
সমুদ্রের মত্ততা বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে ঝড়ের তাণ্ডবও। উত্তর থেকে যে বাতাস দক্ষিণমুখি ছুটছিল, মাঝ দরিয়ায় অসহায় জাহাজটাকে পেয়ে খুব একচোট নাস্তানাবুদ করে যাচ্ছে। তুফান আর বাতাস একযোগে কারসাজি করেছে, জাহাজটা না ডুবিয়ে ছাড়বে না।
অনেকক্ষণ পর ছাদ-ঢাকা ডেকে এসে হাঁফাতে থাকে লখাই। এতক্ষণ উথাল পাতাল দরিয়ার সঙ্গে প্রাণ বাঁচাবার উত্তেজনায় সমানে যুঝেছে। এখন ক্লান্তিতে শরীরটা কাহিল হয়ে আসছে। বুকটা তোলপাড় করে শ্বাস উঠছে, নামছে।
দু’পাশে ক্রুদের কেবিন। মাঝখানের প্যাসেজে নিস্পন্দ পড়ে রইল লখাই। জাহাজের এলোপাতাড়ি দোলানির সঙ্গে দু ধারের কেবিনের দেওয়ালে ক্রমাগত ঘা খেতে লাগল। নাক-মুখ ফেটে তাজা রক্তের ফোয়ারা ছুটল। জাহাজের বাড়ি ঠেকাবার মতো সামর্থ্যটুকু পর্যন্ত সে হারিয়ে ফেলেছে।
দু’ পাশের কেবিনে টাল সামলাতে সামলাতে একটা লোক প্যাসেজের ভেতর দিয়ে আসছিল। লখাইর কাছাকাছি এসে সে থমকে দাঁড়াল। ঝড়ের দরিয়ায় ডেকে লোক থাকে না। সবাইকে জাহাজের হোলে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়াটা দস্তুর। লখাইকে বাইরে দেখে লোকটা চমকে উঠল। বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল, কে রে?
মাথা তুলবার চেষ্টা করল লখাই। দেখল, সামনেই ডাংরি-পরা একটা খালাসি দাঁড়িয়ে রয়েছে। নির্জীব গলায় কী যেন বলতে চাইল লখাই, পারল না।
দুর্বোধ্য স্বরে তড়বড় করে অনেকগুলো কথা বলে গেল খালাসিটা। ছাইক্লোন ছাড়া বাকি একবর্ণও বোঝা গেল না। তবে লখাই আন্দাজ করল, খালাসিটা প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠছে।
উৎকর্ণ হয়ে লখাইর জবাব শুনবার জন্য দাঁড়িয়ে রইল খালাসিটা। যখন জবাব মিলল না, তখন দুই ঠ্যাং ধরে টানতে টানতে তাকে প্যাসেজের শেষ মাথায় নিয়ে এল। এটা জাহাজের দক্ষিণ প্রান্ত। লোয়ার ডেকের দরজাটা খুলে ফেলল সে, মুহূর্তে লখাইকে ভেতরে ঢুকিয়ে পাল্লা বন্ধ করে দিল।
লোহার খাড়াই সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে এসে পড়ল লখাই। অতি কষ্টে একবার চোখ মেলল। নিচের এই পাতালটাকে বুঝবার চেষ্টা করল সে। জাহাজের এই অংশটা একেবারেই অচেনা। পেছনের ডেরিকের নিচে এসে বসেছে কতবার, অথচ তারই পঞ্চাশ হাতের মধ্যে এমন একটা বিস্ময়কর দুনিয়া ছিল, গত দু দিনে কি একবারও ভেবেছিল লখাই?
পোর্ট হোলের কাঁচ সমুদ্রের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। উইন্ড ব্লোয়ার দিয়ে তীব্র বেগে বাতাস আসছে। বাতিগুলো একবার জ্বলছে, একবার নিভছে।
হঠাৎ চোখে পড়ল, লোয়ার ডেকের এক কোণে অনেকগুলো মেয়েমানুষ জড়াজড়ি করে বসে রয়েছে। ভীষণ চমকে উঠল লখাই। তবে তো পশ্চিমা ভিখনটা মিথ্যে স্তোক দেয়নি! পঞ্চাশ আওরত কয়েদি সত্যিই আন্দামান চলেছে। এইটুকুই মাত্র ভাবতে পারল লখাই। এই মুহূর্তে এর বেশি ভাববার মতো শক্তিই তার নেই। জাহাজের বাড়ি খেয়ে নাক-মুখ ফেটেছে, উন্মাদ সমুদ্রের সঙ্গে যুঝে যুঝে শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে আসছে। মাথার রগগুলো একসঙ্গে দাপাদাপি শুরু করেছে।
একসময় নিজের অজান্তে চোখ বুজে এল লখাইর। লোয়ার ডেকের আলো, মেয়েমানুষ–সব নিরাকার, অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। দরিয়ার গর্জন, মেঘের ফেঁসানি, কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে।
লখাই বেহুশ হয়ে পড়ে রইল।
অনেকটা সময় কেটে গেল।
সমুদ্র এখনো সমানে ফুঁসছে। কালো আকাশটাকে আড়াআড়ি চিরে বিদ্যুৎ চমকায়। ঝড়ের আক্রোশ ক্রমাগত বেড়েই চলে।
লবণ দরিয়া একবার খেপে উঠলে সহসা থামতে চায় না।
একসময় লখাইর জ্ঞান ফিরল।
পোর্ট হোলের কাঁচ এখনো সমুদ্রের নিচে তলিয়ে রয়েছে। বাতিগুলো জ্বলছে, নিভছে। নিভছে, জ্বলছে। জাহাজটা একবার বাঁ পাশে হেলছে, পরমুহূর্তেই ডান পাশে ঝুঁকছে। একবার বিপুল তরঙ্গের মাথায় উঠেই আবার কোন অতলে নেমে যাচ্ছে। কখন যে কালা পানি জাহাজটাকে গ্রাস করে ফেলবে, কে জানে।
জাহাজের দোলানির সঙ্গে সঙ্গে লটবহর-বোঁচকা-কুঁচকি, বিছানা-গাঁটরি, হরেক কিসিমের মালপত্র ডাইনে বাঁয়ে সামনে পেছনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একপাশে গোটাকয়েক মুরগির ঝুড়ি রয়েছে। নিরীহ প্রাণীগুলো দরিয়ার গর্জন শুনতে শুনতে একটানা ককিয়ে চলেছে।
হঠাৎ লোয়ার ডেকের এক কোণ থেকে কান্নার রোল উঠল।
একটু আগে জ্ঞান ফিরেছে লখাইর। স্নায়ুগুলো এখনো বড় দুর্বল। মাথার রগগুলো কেউ যেন ধারাল নখে ছিঁড়ছে। শিরায় শিরায় অসহ্য যন্ত্রণা ছোটাছুটি করছে। একবার তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিক দেখল লখাই। সঙ্গে সঙ্গে অপরিসীম ক্লান্তিতে চোখ দুটো আবার বুজে এল।
এইসময় অনেকগুলো গলার কান্না একসঙ্গে তুমুল হয়ে উঠতে লাগল। কান্নার রোলটি তীব্র, করুণ এবং অসহায়।
কিছুক্ষণ পড়ে পড়ে দরিয়ার সোনির সঙ্গে মানুষের কান্নামেশা এক অদ্ভুত শব্দ শুনল লখাই। তারপর হাতের ভর দিয়ে ধীরে ধীরে অতি কষ্টে উঠে বসল। মাথাটা টলছে। নাক-মুখ ফেটে যে রক্ত ঝরেছিল, তা এখন জমে গিয়েছে। খোলা ডেকে বুকে হেঁটে আসার সময় ঘষায় ঘষায় চামড়া ছিঁড়ে গিয়েছিল। বুকটা এখন জ্বলছে।
কিছুটা সামলে নিয়ে লখাই ফের তাকায়।
লোয়ার ডেকের এক কোণে যে মেয়েমানুষগুলো জড়াজড়ি করে বসে ছিল, তারা চিৎকার করে কাঁদছে। একটানা কান্নার বিরাম নেই, ছেদ নেই। উন্মাদ দরিয়ার তাণ্ডব দেখে, ডুবে মরার আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। খুব সম্ভব সকলে মিলে ডাক ছেড়ে কেঁদে কেঁদে তারা মরার ভয় ঠেকাতে চাইছে।
কী করবে, কী বলবে, হঠাৎ কিছুই ভেবে উঠতে পারল না লখাই। হতবাক বসে রইল সে।
একটু পর কান্নার রোল ঝিমিয়ে এল।
একটি নারীকণ্ঠ শোনা গেল, দরিয়া বাওরা হয়ে উঠেছে, জানে মরে যাব। জরুর জাহাজ ডুবে যাবে।
কান্নাটা থেমে এসেছিল, আবার সেটা তুমুল হয়ে উঠল।
মেয়েমানুষগুলো ভয়ার্ত গলায় সমানে চেঁচাতে লাগল, জরুর জাহাজ ডুবে যাবে।
জরুর ডুবে মরব।
হে রামজি কিরপা কর।
এ খোদা, দোয়া কর।
একটা বিরাট ঢেউ ফুলে ফুলে আকাশের দিকে উঠছিল। তার মাথায় চড়ে জাহাজটাও অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিল। আচমকা সমুদ্রের কী খেয়াল হল, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে জাহাজটাকে ঢেউয়ের চড়াই থেকে অথৈ উতরাইতে আছড়ে ফেলল।
লোয়ার ডেকের এই পাতালে কেমন এক ধরনের ভয় ঘনিয়ে এল। আকাশ-বাতাস বজ্রপাত-বিদ্যুৎ–সব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। উন্মত্ত সমুদ্র ছুঁড়ে সাঙ্তিক এক ভয় উঠে এসে জাহাজটাকে গ্রাস করতে লাগল।
প্রকৃতি এখানে নিরাবরণ, নগ্ন। পারাপারহীন সমুদ্রের মতো তার ক্রুরতার অন্ত নেই। কালাপানির হিংসা বড় ভীষণ।
নিচে গহিন দরিয়া, ওপরে কালো, কুটিল আকাশ। বিপুল অন্ধকারে কোথাও একবিন্দু আলো নেই, যাকে বিশ্বাস করা চলে।
প্রাণ বাঁচাবার অন্ধ তাড়নায় এলফিনস্টোন জাহাজটা দিশাহারা হয়ে ছুটছে। কোথাও কূল নেই, পার নেই, দিকচিহ্ন নেই, আলো নেই, নিশানা নেই। তবু জাহাজটা ছুটছে। ছোটার বিরাম নেই।
পোর্ট, হোলগুলো একবার জলতলে ডুবছে, আবার ভেসে উঠছে। বিদ্যুতের আলোয় পোর্ট হোলের কাছে উথালপাতাল দরিয়া আর আকাশ দেখা যায়। ডাইনে বাঁয়ে হাজার। দিকে আকাশময় চিড় ধরছে। আর সেই ফাটলের মধ্য দিয়ে লিকলিকে বিজুরি চমকায়।
লোয়ার ডেকের এক কোণে গোটাকয়েক প্রাণী দলা পাকিয়ে বসে রয়েছে। এখন আর তারা কাঁদছে না, শব্দ করছে না। অপরিসীম ভয়ে শিরায় শিরায় ছুটন্ত রক্ত তাদের হৃৎপিণ্ডে প্রবল ঘা দিচ্ছে। অসাড় হয়ে পোর্ট হোলের কাঁচের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছে তারা।
লখাই হঠাৎ বলে উঠল, তার গলাটা বড় কাতর শোনায়, এটু জল, বড় তিয়াস–লোয়ার ডেকের ওই কোণে চাঞ্চল্য দেখা দিল। একটা তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, কৌন রে?
আমি–
হামি কৌন রে হারামি?
নির্জীব গলায় লখাই সাড়া দিল, আমি লখাই। কয়েদি–
টালমাটাল জাহাজ। দু’পাশের বাঙ্কে টাল সামলাতে সামলাতে দুটো মেয়েমানুষ লখাইর সামনে এসে দাঁড়াল।
লখাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। একেবারে সামনে যে রয়েছে, তার চোখের সাদা অংশে দুটো আড়াআড়ি লাল দাগ, তারা দুটো কটা। গায়ের চামড়া মাজা কালো, মসৃণ এবং পিছল। চিকন কোমরের ওপর সুঠাম ছিপছিপে শরীর। ঘন রোমশ ভুরু দুটো জোড়া। ছোট চাপা কপালে গোলাকার শ্বেতির চিহ্ন। পরনে মোটা শাড়ি, দেহের ওপর দিকে নীল ধারী আঁকা কুর্তা।
বিবির বাজারের মোতি প্রায়ই একটা কথা বলত, কাল ভুজঙ্গী। মেয়েমানুষটাকে দেখতে দেখতে কেন যেন সেই কথাই মনে পড়ল লখাইর। তাকিয়েই রইল সে। চোখে পলক পড়ল না।
হিন্দি এবং উর্দু মেশানো কিম্ভুত ভাষায় মেয়েমানুষটা বলল, কি রে শালে, কী মতলবে এখানে ঢুকেছিস?
এট্টু পানি, বড় তিয়াস–ঢোক গিলে এটুকুই মাত্র বলতে পারল লখাই।
হারামি, পানি গিলবার আর জায়গা পাসনি! পেছনে থেকে একটা কর্কশ, বাজখাঁই গলা শোনা গেল, কুত্তীকা বাচ্চা, জানিস না এখেনে আওরত কয়েদিরা রয়েছে? এই সোনিয়া হঠ তো–
সোনিয়াকে ঠেলে, কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে যে মেয়েমানুষটা সামনে এগিয়ে এল, তার দিকে তাকিয়ে অমন যে দুর্দান্ত লখাই, তার অন্তরাত্মাও মুহূর্তের জন্য আঁতকে উঠল। মাপা চার হাত খাড়াই শরীর। গলাটা সেই অনুপাতে অস্বাভাবিক খাটো। হাত জানু ছাড়িয়ে নিচে নেমেছে। কোটরের মধ্যে গোল চোখ দুটো ঝিকঝিক করছে। চৌকো মুখ, উদ্ধত চোয়াল। ভাঙা গালে হনু দুটো ফুঁড়ে বেরিয়েছে। মাথার আধাআধি পর্যন্ত টাক, পেছন দিকে কয়েক গাছা খোঁচা খোঁচা, তামাটে চুল।
পরনের কাপড়টা পায়ের পাতা পর্যন্ত নামেনি, হাঁটুর খানিকটা নিচে এসে ঝুলছে।
মেয়েমানুষটা আবার হুমকে উঠল, আমরা আওরত–বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল।
বিড়বিড় করে লখাই বলে, তুমি শালী আওরত! তুমি আওরত হলে মরদকা বাপ কে?
সন্দিগ্ধ চোখে লখাইর দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েমানুষটা। তারপর বলল, কি রে শুয়ারকা বাচ্চা, গালি দিচ্ছিস?
না।
তবে কী বলছিস?
এট্ট পানি মাঙছি।
উল্লু কহিকা, এখানে পানি মিলবে না।
বড় তিয়াস–করুণ গলায় বলে লখাই।
সচ বলছিস?
হাঁ।
তবে ঠার, পানি নিয়ে আসছি। জলের সন্ধানে লম্বা মেয়েমানুষটা কোণের দিকে চলে গেল।
কাল ভুজঙ্গী এক দৃষ্টে লখাইর দিকে তাকিয়ে ছিল। মৃদু, নরম গলায় এবার সে বলল, তোর নাম তো লখাই?
হাঁ, তোর?
সোনিয়া।
যে পানি আনতে গেল, ও কে?
হাবিজা। এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল সোনিয়া, তারপর বলল, জোড়া খুন করে কালাপানি চলেছে।
পৌরুষে কোথায় যেন ঘা লাগে। লখাই ফুঁসে উঠল, আমিও পাঁচ-পাঁচটা খুন করে এসেছি।
খানিকটা চুপচাপ।
কেউ স্তব্ধতা ভাঙে না। সোনিয়া আর লখাই মুখ ঘুরিয়ে ঢেউয়ে টাল-খাওয়া জাহাজের দেওয়ালে কী দেখে, কে জানে।
হঠাৎ লখাই বলে, তুই কালা পানি এলি যে সোনিয়া?
সোনিয়ার কটা চোখের তারা দুটো জ্বলে উঠল। বিষাদ, হিংস্রতা এবং রোষমেশানো অদ্ভুত এক ভঙ্গি ফুটল মুখে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, তা শুনে তোর কী দরকার?
শান্ত, নির্বিকার গলায় লখাই বলল, তুইও আন্দামানে যাচ্ছিস, আমিও যাচ্ছি। জান-পয়চান হল। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। কসুর হল?
না। কঠিন গলায় সোনিয়া বলল, শুনতেই যখন চাস, তখন বলছি। কোতল করেছিলাম। বিশ সাল কালাপানি হয়েছে।
লখাই হাসল, আন্দামান যেতে হলে খুন করে যাওয়াই ভাল। ওসব ডাকাতি ফাঁকাতি, উঁচড়ামি করে লাভ নেই। কি বলিস সোনিয়া?
আচমকা ফুঁসে উঠল সোনিয়া। ছিপছিপে, কালো শরীরটা ঈষৎ বাঁকিয়ে দাঁড়াল। মাথা অল্প অল্প দুলছে। চোখের তারা দুটো সাপিনীর মতো হিংস্র হয়ে উঠেছে। সে ধমকে উঠল, চোপ হারামি–
খিস্তি খেয়ে শরীরের সমস্ত রক্ত লাফিয়ে তালুতে চড়ল লখাইর। মেজাজটা বদখত হয়ে গেল। রক্তচোখে সোনিয়ার দিকে তাকাল সে। দু’হাতের বিরাট থাবায় গলাটা টিপেই ধরত সোনিয়ার, কিন্তু তার আগেই ঘটনাটা ঘটল।
দরিয়ার আক্রোশ এখনো পড়েনি। জাহাজের দক্ষিণ প্রান্তে যে উঁচু মাস্তুলটা আকাশের দিকে মাথা তুলেছে, সেটায় চড়চড় শব্দে চিড় ধরল।
জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রমাদ গোনে, ভয় পেয়ে প্রচণ্ড শব্দে ভো বাজায়।
লোয়ার ডেকের কোণ থেকে মেয়েমানুষগুলো ডুকরে কেঁদে উঠল। লখাই চমকে সেদিকে তাকায়।
বিড় বিড় করে সোনিয়া বলে, কালাপানি বাওরা হয়ে উঠেছে। ডর পেয়ে ওরা কাঁদছে।
কান খাড়া করে কান্নার শব্দ শুনল লখাই। তারপর বলল, তুইও তো এতক্ষণ কাঁদছিলি।
সাঁ করে ঘুরে দাঁড়াল সোনিয়া। বলল, ঝুট। আমি আর হাবিজা কাঁদি নি।
আমি যে দেখলাম।
জরুর নেহী। সোনিয়া বলতে লাগল, পেছনের দো সাল আমি একবারও কাঁদি নি। আমার আঁখোমে কেউ আঁশু দেখে নি।
অনেকটা সময় চুপচাপ কাটে।
হঠাৎ লখাই বলে বসে, তোর মুল্লুক কোথায় সোনিয়া?
কয়েদখানায়।
কয়েদখানা কারো মুল্লুক হয়?
হয়। কঠিন গলায় বলে সোনিয়া।
স্থূল মনোধর্মের মানুষ লখাই। কথার সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ সে বোঝে না। যে বুদ্ধি এবং তীক্ষ্ণতা থাকলে সামান্য রহস্যও বোঝা যায়, সেটুকুও তার নেই। জীবনে যা কিছু সরাসরি এবং মোটা দাগের, একমাত্র সেগুলির মাহাত্মই সে বুঝতে পারে। বিরাট দেহের ভেতর তার মন অত্যন্ত শ্লথ গতিতে ক্রিয়া করে। তবু সোনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে এই মুহূর্তে তার সংশয় জাগে। ধীরে ধীরে লখাই বলে, ঠিক বল তো, দুনিয়ায় কে কে আছে তোর?
কেউ নেই, কুছ নেই।
হঠাৎ লখাইর পাশে বসে পড়ে সোনিয়া। দু’হাতে মুখ ঢাকে। সুঠাম শরীরটা ফুলে ফুলে কাঁপতে থাকে।
লখাইর মুখে সহসা জবাব যোগায় না। অথৈ দরিয়া যখন মেতে উঠেছে, তখন আন্দামানগামী এই জাহাজে এমন এক তাজ্জব নারীর দেখা মেলবে, একথা কি কস্মিনকালে ভেবেছিল লখাই!
লখাই শুধু এটুকুই বলতে পারে, তুই কাঁদছিস সোনিয়া?
হাঁ। দো সালে এই পয়লা কাঁদলাম।
কেন?
দিল হল।
সোনিয়া মুখ তুলল। বাইরে অশান্ত, অফুরন্ত লবণ-সমুদ্র, ভেতরে সোনিয়ার দুগালে লবণ-জলের দরিয়া। লখাই ভেবেই পায় না, যে নারী কোতল করে সাজা নিয়ে আন্দামান চলেছে, দুবছরে যার চোখ একবারও ভেজেনি, সে কেন কাঁদে?
বহুদিন পর লখাই যখন জীবনের দুজ্ঞেয় রহস্যের মহিমা বুঝতে শিখেছিল, মানুষের মনের গহন গোপন কথাটি পড়তে পেরেছিল, সেদিন সোনিয়ার কান্নার অর্থ বুঝেছিল। লখাই জেনেছিল, পশ্চিমের এক দেহাতি গাঁও থেকে নিজের মরদকে খুন করে সোনিয়া আন্দামান এসেছে। কিন্তু সে কথা অনেক, অনেক পরের।
সোনিয়ার মুখের দিকে হতবাক তাকিয়ে ছিল লখাই। সমস্ত জীবনে নারীর একটি মহিমাই সে জেনেছে। যে নারী তার কামাতুর দেহ দিয়ে পুরুষকে মাতিয়ে তোলে, ছলাকলা দিয়ে বিচিত্র এক নেশায় তাকে বুঁদ করে রাখে, একমাত্র তাকেই সে চেনে, বুঝতে পারে। কিন্তু যে নারী খুন করে এসে দুবছর পর আন্দামানের জাহাজে দুচোখের আঁশুতে দরিয়া ভাসায়, তার দুজ্ঞেয়, দুর্বোধ্য মন বোঝা লখাইর সাধ্য নয়। তাকে সে আদপেই বুঝতে পারে না।
খানিক পরে হাবিজা জল নিয়ে ফিরল। কর্কশ গলায় ডাকল, এই সোনিয়া—
কী? সোনিয়া চোখ তুলল।
হারামিটাকে পানি গেলা। সোনিয়ার দিক থেকে গোল গোল দুটো কোটরে-ঢোকা চোখ লখাইর ওপর এনে ফেলল হাবিজা। তীব্র গলায় বলল, এই শালে, তুই এখেনে ঢুকলি কেমন করে?
একটা খালাসি দু ঠ্যাং ধরে ঢুকিয়ে দিল যে–
সন্দিগ্ধ চোখে একবার লখাইর দিকে তাকাল হাবিজা। ডান পায়ের বুড়ো আঙুল তার পাঁজরে গেঁথে দিল। তারপর খেঁকিয়ে উঠল, পানি গিলেই ভাগবি। নইলে শির ঘেঁচে দেব। সোনিয়াকে বলল, পানি গেলা হলেই কুত্তাটাকে লাথ মেরে ভাগাবি।
লখাই রুখে উঠল, গালি দিবি না
কোটরের মধ্যে দুটো চোখ ঝিকিয়ে উঠল হাবিজার। চড়া গলায় সে বলল, শালে, আওরতের গায়ের গন্ধ শুকবে আর গালি খাবে না! সব অ্যায়সা অ্যায়সা, মাগনা? বদখত মুখটা হিংস্র হয়ে উঠল হাবিজার। জলের ললাটাটা লখাইর মাথার ওপর তুলে গর্জে উঠল, হাঁকাব–
সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারত। কিন্তু তার আগেই সোনিয়া হাবিজার হাত থেকে লোটাটা ছিনিয়ে নিল। বলল, তুই ওধারে যা হাবিজা–
হারামিটার জন্যে তোর দেখি বহুত দরদ–
দরদ নেই। পানি গিলিয়েই ভাগাচ্ছি। সোনিয়ার গলা শান্ত এবং কঠোর শোনায়। হাবিজা এক মুহূর্ত কী ভাবল, সে-ই জানে। কপালে অসংখ্য পাচালো রেখা ফুটল। গলার একটা শিরা ফুলে ফুলে মোটা হতে লাগল। ভুরু দুটো কুঁচকে রইল। সে বলল, আচ্ছা, ইয়াদ রাখিস সোনিয়া, ওটাকে না ভাগালে তোদের দুটোকেই কোতল করব। আমি ওদিকে যাচ্ছি। দরিয়ার ঝকানিতে মাগীগুলো বমি করতে শুরু করেছে। খিদমত করতে হবে।
হাবিজা চলে গেল। কয়েক ঢোক জল খেয়েই বমি করে ফেলল লখাই। পাকস্থলীতে যা ঢুকছে, জাহাজের অবিরাম দোলানিতে সব ঠেলে বেরিয়ে আসছে। নির্জীব, অসাড় হয়ে শুয়ে পড়ল সে।
একটু পর কাতর গলায় লখাই গোঙাতে থাকে, বড় কষ্ট হচ্ছে। বুকের কাছটায় বহুত দরদ, বুকটা চেপে ধর সোনিয়া। চেপে ধর—অঁ—অঁ—অঁ– লখাইর মুখটা যন্ত্রণায় বিকৃত দেখায়।
সোনিয়া বাঙ্কের রড ধরে পেছন দিকে ঘুরল। ডাকল, এই হাবিজা–
কী কইছিস?
ইধারে আয়।
উধার থেকেই বল।
আদমিটার বুকে দরদ হচ্ছে।
খিক খিক শব্দ করে হাসে হাবিজা। হাসলই শুধু, কথা বলল না। তার হাসিতে অনেক কিছু ছিল। হাসি দিয়েই তা বুঝিয়ে দিল সে।
সোনিয়াও আর কথা বলল না। ঘুরে বসে লখাইর বুকটা দু’হাতে চেপে ধরল। একদৃষ্টে লখাইর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে পলক পড়ল না। শুধু হাতের পাতায় একটি কঠিন পাথুরে বুকের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি অনুভব করতে লাগল।
অনেকক্ষণ পর সোনিয়ার নরম হাতের ডলায় যন্ত্রণার বেগটা কমে এল লখাইর। চোখ বুজে ছিল, মেলল। ঘন ঘন শ্বাস টানল। তারপর টেনে টেনে বলতে লাগল, খুব যত্ন করলি, বহোত খিদমত। সারা জিন্দেগি তোকে মনে রাখব।
সোনিয়া জবাব দিল না।
লখাই আবার বলতে লাগল, শুনেছি, আন্দামানের কয়েদখানায় এক এক কয়েদির এক এক কুঠরি মেলে। তুই আমার পাশের কুঠরিতে থাকবি?
সোনিয়া নিরুত্তর বসে রইল।
আরো খানিকটা পর দরিয়ার আক্রোশ কমে এল। উন্মাদ কালাপানি শান্ত হল। উমড়ঝুমড় মেঘের ডাক থামল। আকাশের মেঘ উড়ে উড়ে কোথায় যেন উধাও হতে লাগল। রাশি রাশি তারা দেখা দিল আকাশে। সমুদ্র জুড়ে, যে-দিকেই তাকানো যায়, এখন কোটি কোটি ঢেউয়ের মাথায় ঝিকমিক করতে থাকে ফসফরাস। জাহাজের দোলানি থেমে এল।
এখন রাত কত, কে জানে। হঠাৎ সিঁড়ির মাথায় লোহার দরজাটা ঘটাং করে খুলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে ভারী ভারী বুটের শব্দ নামতে থাকে। দুটো পুলিশ আর একটা পাঠান হাবিলদার লোয়ার ডেকে ঢোকে। পেছনে পেছনে আসে ভিখন আহির।
ভিখন অদ্ভুত হাসে। তার একমাত্র চোখটা ধিকিধিকি জ্বলে। সে বলে, কি হাবিলদারজি, বলেছিলুম না, লখাই ভেইয়া পরীস্তানে রয়েছে। বেফায়দা তামাম জাহাজ টুড়লেন।
লখাইর দিকে তাকিয়ে ভিখন বলে, হাঁ ভেইয়া, বহোত তখলিফ দিলি। ইধারে দরিয়া খেপে উঠেছে, উধারে তুই ভাগলি। সিপাইজিরা আমাদের কথা বিশোয়াস করে না। খালি বলে, লখাই শালেকো কোথায় সরিয়ে দিয়েছিস, বল। পিটিয়ে পিটিয়ে কয়েদিদের হাড্ডি চুরচুর করে দিলে সিপাইজিরা। লেকিন আমরা কেমন করে জানব, তুই ভেইয়া এখেনে ভেগে এসেছিস।
পাঠান হাবিলদারটা লখাইর পেটে বুটের ঠোক্কর দিয়ে বলল, এ জনাব, সারা রাত তো বেহেস্তে কাটালেন, এবার চলিয়ে। একটু থেমে আবার, শালে, বহোত ভুগিয়েছিস!
করুণ চোখে একবার সোনিয়ার দিকে তাকায় লখাই। তারপরেই দৃষ্টিটা ভয়ানক হয়ে পাঠান হাবিলদারটার মুখে এসে পড়ে।
একটা পুলিশ টিপ্পনি কাটাল, শালে, এর মধ্যেই জমিয়ে নিয়েছিস! এলেমদার আদমি। আভি ওঠ ওঠ–
দুটো পুলিশ লখাইকে টেনে ওপরে তুলল। একটু পর সকলে অদৃশ্য হল। সঙ্গে সঙ্গে ঘটাং করে লোহার পাল্লাটা বন্ধ হয়ে গেল।
যতক্ষণ লখাইকে দেখা গেল, সেদিকে তাকিয়ে রইল সোনিয়া। চোখে পলক পড়ল না।
আচমকা লোয়ার ডেকের এই পাতালপুরী চমকে দিয়ে তীক্ষ্ণ, ভীষণ একটা হাসির রোল উঠল। হাবিজা হাসছে। হাসির দমকে তার দীর্ঘ, কদাকার শরীরটা বেঁকে দুমড়ে একাকার হয়ে যেতে লাগল।
সোনিয়া শিউরে উঠল।
হাবিজা টেনে টেনে বলল, একটা আদমি কোতল করে কালাপানি এলি। আর একটা আদমি দিলের কাছে এসে ভেগে গেল। বহুত খারাপ তকদির।
সোনিয়া সাড়া দিল না, নিরুত্তর বসে রইল।
ঝড়ের দরিয়ায় দিক ভুল করে জাহাজটা পুব দিকে চলে গিয়েছিল। এবার কোনাকুনি দক্ষিণমুখি পাড়ি জমাতে হল।
আরো দুটো দিন কাটল সমুদ্রে।
উনিশ শ’ এগার সালের এক নতুন সকাল।
আড়াই শ’ কয়েদি নিয়ে এলফিনস্টোন জাহাজ আন্দামানে পৌঁছল।
ওদিকে রসদ্বীপ, এদিকে এবারডিন জেটি। মাঝখানে নীল জলের উপসাগর, নাম সিসোস্ট্রেস বে। সিসসাস্ট্রেস বে অর্ধবৃত্তের আকারে ঘুরে সাউথ পয়েন্টের পাশ দিয়ে নিঃসীম সমুদ্রে মিশেছে।
উপসাগরের জল এখন আশ্চর্য শান্ত।
খানিক আগেই সকাল হয়েছে। শীতের রোদ বড় স্নিগ্ধ, মনোরম। উপসাগরের ছোট ছোট ঢেউগুলো চিকমিক করছে।
সিসোস্ট্রেস বের নীল জলে সবুজ রঙের এলফিনস্টোন জাহাজটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফোরমাস্টের মাথায় এক ঝাঁক সাগরপাখি সমানে চক্কর দিচ্ছে।
এবারডিন জেটি। পাথরের ছোট জেটিটা সরু হয়ে উপসাগরে ঢুকে গিয়েছে।
এলফিনস্টোন জাহাজটা সিসোস্ট্রেস বেতে ঢুকে নোঙর ফেলেছে ভোরবেলায়। কাল বিকেলেই জাহাজ আসার খবরটা সমস্ত পোর্টব্লেয়ার, পোর্টব্লেয়ার ছাড়িয়ে ব্রুখসাবাদ, পাহাড়গাঁও, গারাচামারা–দূর দূর গাঁওয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার পুরনো একদল কয়েদি এবারডিন জেটিতে জমায়েত হয়েছে। জন দুই টিণ্ডাল এবং তিনটে পেটি অফিসার ধমকে, চেঁচিয়ে তাদের সামাল দিয়ে রাখতে পারছে না।
একটা কয়েদি বলল, এবার দুমাহিনা বাদে জাহাজ এল।
অনেকগুলো গলার সায় মিলল, হাঁ হাঁ–
আর একজন বলল, দু’মাহিনা মুল্লুকের খবর পাই না।
এরপর সকলে মিলে হল্লা শুরু করল।
মুল্লুকসে চিট্ঠি জরুর এসেছে।
লেড়কার বোখারের খবর এসেছিল আগের জাহাজে। জিন্দা আছে কিনা খোদা মালুম।
হামকো ভি খবর এসেছিল, বহুটা না কি কার সঙ্গে ভাগবার মতলব করছে। এই জাহাজের চিট্ঠিতে সব জানতে পারব। শালীকে পেলে–
বিবি লেড়কা ছোড় শালে, পচাশ আওরত কয়েদি এসেছে এ জাহাজে–সমস্ত গলার স্বর ছাপিয়ে একটা কর্কশ, লোলুপ কণ্ঠস্বর চড়তে থাকে, সব মাগী বাহারি গুল।
শোরগোল যখন তুমুল হয়, একটা টিণ্ডাল ঘুরে দাঁড়িয়ে খেঁকিয়ে ওঠে, অ্যাই উল্ললোগ, চিল্লাও মাত্।
কিছুক্ষণের জন্য হল্লা থামে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিগি লাইন, ডিলানিপুর, ফিনিক্স বে–পোর্ট ব্লেয়ারের নানা বস্তি থেকে, দূর দূর গাঁও–মোঙলুটন, হামফ্রেগঞ্জ, মিঠাখাড়ি থেকে, বিজন এবং টাপুগুলো থেকে ঝাঁকে ঝকে কয়েদি এবারডিন জেটিতে আসতে লাগল।
প্রতি মাসে একবার জাহাজ আসে আন্দামানে। এ-মাসে যদি কলকাতা থেকে আসে, পরের মাসে আসবে রেঙ্গুন থেকে, তার পরের মাসে মাদ্রাজ থেকে। কলকাতা থেকে এসে জাহাজটা সোজা রেঙ্গুনে পাড়ি জমায়। এক মাস পর আসে আন্দামানে। আন্দামান থেকে এবার মাদ্রাজ। মাঝখানে আর একটা মাস। তারপর ফের এখানে এসে কলকাতায় ফেরার পালা।
আন্দামানের জাহাজ, পারাপারের বাহন। মেইন ল্যাণ্ডের সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ। বিপুল সমুদ্রের ওপার থেকে জাহাজ আসে। সেই সঙ্গে আসে রসদ, দেশ গাঁও আর মেইন ল্যাণ্ডের খবর। আর আসে নতুন কয়েদি। বঙ্গোপসাগরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপমালায় মানুষ বাড়ে, জীবন তার দখল প্রসারিত করে।
জাহাজ আসা না-আসার সঙ্গে এই দ্বীপের উদ্বগ-উৎকণ্ঠা, আশা-উল্লাস, মরা-বাঁচা জড়িয়ে থাকে। দরিয়ার ওপর থেকে যে জাহাজটা এক মাস পর পর মাত্র কয়েকদিনের জন্য এখানে ভেড়ে, তার সঙ্গে এই দ্বীপের ভবিষ্যৎ জড়ানো। এই দ্বীপের ভাগ্য সে-ই নিয়ন্ত্রণ করে। আন্দামানের জীবনে জাহাজের ভূমিকা অসাধারণ।
জাহাজ আসার দিনের সঙ্গে আন্দামানের অন্য সব দিনের মিল নেই। এই দিনের স্বাদ গন্ধই আলাদা। এই দিনটা বিচিত্র।
এই দিনটিতে চাঞ্চল্য বাড়ে, ব্যস্ততা বাড়ে। দলে দলে কয়েদি জেটিতে এসে হইচই করতে থাকে। আন্দামানের ঢিমে তালের জীবনের বেগ দ্রুত হয়।
এই দিনটা সবাই আসে জেটিতে। যে কয়েদির তামাম দুনিয়ায় কোথাও কেউ নেই, মেইন ল্যাণ্ড থেকে চিঠি আসার কোনো সম্ভাবনাই যার নেই, যার কোনো কিছু সম্বন্ধে আদৌ আগ্রহও নেই, সে-ও সকলের সঙ্গে আসে।
এই দিনটার জন্য কয়েদিরা উন্মুখ হয়ে থাকে। দেশ গাঁওয়ের কী খবর আসবে, নতুন কয়েদিরা কেমন মানুষ, কোন মুল্লুক থেকে আসছে–এ-সব সম্বন্ধে একমাস ধরে জল্পনা চলে, জাহাজ আসার পর সেটা থামে। জাহাজ চলে যাওয়ার পর আবার নতুন করে জল্পনা শুরু হয়। এটুকুই তাদের বিলাস।
দিন যায়, মাস যায়, বছর কাটে। ঋতুচক্রে সময় পাক খায়। মাসে মাসে নতুন কয়েদি আসার বিরাম ঘটে না। তারপর একদিনের নতুন কয়েদি কিছুদিনের মধ্যে পুরনো হয়। যাদের দ্বীপান্তরের দীর্ঘ মেয়াদ ফুরোয়, তাদের কেউ কেউ ওই জাহাজেই দেশে ফেরে। কেউ কেউ মেয়াদ ফুরোলেও আন্দামানের মাটি আঁকড়েই পড়ে থাকে। বিয়ে-শাদি করে, সংসার পাতে। সন্তান-সন্ততিতে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের জীবনস্পন্দন বাড়িয়ে চলে।
তবু জল্পনা থামে না। জাহাজ আসাও বন্ধ হয় না। নতুন পুরনো, মেয়াদ-ফুরানো, মেয়াদ–ফুরানো–সব কয়েদিই এই দিনটিতে জাহাজঘাটে ভিড় জমায়। এই দিনটিকে ঘিরে উন্মাদনার শেষ থাকে না।
এই দিনটির মহিমাই আলাদা।
এবার জাহাজ এসেছে দু’মাস পর।
এই দুমাসে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মেইন ল্যাণ্ড থেকে যে-সব ভয়ঙ্কর হত্যাকারীর দল বঙ্গোপসাগরের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে দণ্ড ভোগ করতে আসে, তাদের মনেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। জাহাজ বুঝি আর আসবে না। দেশগাঁওয়ের খবর মিলবে, সাজার মেয়াদ ফুরোলেও ফেরা যাবে না। আন্দামানের দরিয়া দেখে দেখেই জিন্দগি ফৌত হয়ে যাবে।
কিন্তু জাহাজ এল।
অল্পবিস্তর ভয় সবার মনেই ধরেছিল। কিন্তু দুটো কয়েদির বিন্দুমাত্র বিকার নেই। তাদের একজন পাঞ্জাবি চান্নু সিং। অন্যটা বর্মী–মাউ খে।
এবারডিন জেটির একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল তারা।
মাউ খে বলল, এ চান্নু—
কিয়া বাত?
এই জাহাজে মঙ চো আসছে।
মঙ চো কৌন?
তোকে কতবার বলেছি–আমার ভাই।
মাউ খের বর্মী উচ্চারণে হিন্দুস্তানী শব্দগুলো অদ্ভুত শোনায়।
হাঁ হাঁ, মনে পড়েছে।
আমার এই ভাইটার চাকুর হাত খুব সাফ। আমাদের পেগু শহরে কত কোতল যে করেছে, এক ফায়া (বুদ্ধ) মালুম।
খানিকটা সময় কাটে।
এবারডিন জেটিতে ভিড় আরো বাড়ে, হল্লা তুমুল হয়ে ওঠে।
সূর্যটা মাঝ-আকাশের দিকে পাড়ি জমিয়েছে। তির্যক ধারাল রোদ এসে পড়েছে উপসাগরে। সিসোস্ট্রেস বের নীল জল,লতে থাকে।
মাউ খে আবার ডাকে, এ চান্নু–
ক্যা বাত?
মুল্লুকে ভাইটা ছাড়া কেউ ছিল না। বহোত ফিকর (চিন্তা) ছিল। এবার আন্দামানে এক সাথ থাকব। মুল্লুক শালে জাহান্নামে যাক। মাউ খে বিড়বিড় করে।
চান্নু সিং মাথা নেড়ে সায় দেয়।
একটু পর চান্নু সিং আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে। তার মুখে অদ্ভুত হাসি ফোটে। সে বলে, আই মাউ খে–
আঁ–ক্যা চান্নু?
মুন্সিজির কাছে বহোত আচ্ছা বাত শুনেছি। কাল বিকেলে সে বাতালে–বলতে বলতে চান্নু সিং থামে। তার চোখজোড়া জ্বলতে থাকে।
মাউ খে’র ছোট ছোট চোখ পিটপিট করে। আর একটু ঘন হয়ে দাঁড়ায় সে। ফিস ফিস করে বলে, কী বাতালে মুন্সিজি?
পচাশ আওরত কয়েদি এসেছে এই জাহাজে।
কেমন একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ফোটে মাউ খের গোলাকার তামাটে মুখে। নিরাসক্ত গলায় সে বলে, বহোত পুরানা বাত। ও বাত পুট বিলাসের (পোর্ট ব্লেয়ারের) সব আদমি জানে। এগারচালানসে শুরু করে বাদাকাঁচাঙ–সব গাঁওয়ের সবাইকে পুছে দ্যাখ।
ও বাত তো জানে। আউর এক বাত আছে, সে বাত কেউ জানে না।
কী বাত?
কাউকে যদি না বলিস, তবে বলব।
বিলকুল নেহী। কাউকে বলব না।
দুশমনি করবি না তো?
না। ফায়া (বুদ্ধ) কসম।
কাঠের চিরুনি দিয়ে লম্বা লম্বা চুল আঁচড়ায় চান্নু সিং। আর তেরছা নজরে মাউ খের মুখচোখের ভঙ্গি লক্ষ করে। তারপর বলে, এ শালে মাউ খে–
ক্যা—
মুন্সিজি পয়লা আমাকে বলেছে।
জরুর। লেকিন কী বলেছে?
বিহার মালুম? ইন্ডিয়াকো বিহার?
নেহী।
উন্মু কাঁহিকা। মাউ খের অজ্ঞতায় কয়েক মুহূর্ত চোখে পলক পড়ে না চান্নু সিংয়ের। অবজ্ঞাভরা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর খুব এক চোট গালিগালাজ করে। তারও পর বলতে থাকে, ইন্ডিয়ার বহুত বড় গাঁও বিহার। বুঝলি মুরুখ?
মাউ খে মাথা নাড়ে।
চান্নু সিং আবার বলে, বিহার থেকে খুবসুরত এক আওরত এসেছে এই জাহাজে। বহোত খুবসুরত।
চান্নু সিংয়ের চোখ বুজে আসে। খুব সম্ভব চোখ বুজেই সে সুন্দরী এক রমণীর রূপ জরিপ করার চেষ্টা করে। একটু পরে বলে, মুন্সিজি নাম ভি বলেছে–সোনিয়া।
মাউ খে বলে, উ আওরত কি কয়েদি?
চান্নু সিং খেঁকিয়ে ওঠে, বুদ্ধ কাঁহিকা! কয়েদি না হলে কালাপানি আসবে কেন?
খানিকটা চুপচাপ।
ইতিমধ্যে বেলী এবং রস নামে দুটো মোটর বোট উপসাগরের জল কেটে কেটে এলফিনস্টোন জাহাজটার দিকে ছুটেছে। ভট ভট আওয়াজে জাহাজের চারপাশ থেকে সাগরপাখিগুলো উড়ে উড়ে মাউন্ট হ্যারিয়েটের দিকে পালাচ্ছে।
চান্নু সিং আবার শুরু করল, বুঝলি মাউ খে, আন্দামানে আমার দশ সাল কাটল।
মাথা নাড়ল মাউ খে। হ্যাঁ কিংবা না, কিছুই বোঝা গেল না।
চান্নু সিং বলল, এক মাস হল আমি টিকিট (সেলফ সাপোর্টার্স টিকিট) পেয়েছি।
ও তো জানি।
সিরকার (সরকার) এবার আমাকে শাদি করতে দেবে।
জরুর।
এক মুহূর্ত কী যেন ভাবে মাউ খে। তার ছোট ছোট, চাপা চোখে ধূর্ত চাউনি। আবার বলে, লেকিন শাদি তো একবার করলি এতোয়ারীকে!
চান্নু সিং খেঁকিয়ে ওঠে, ও শালীকে নিয়ে ঘর করা যায়! এতোয়ারী সাত দিনে আমার জিন্দেগি বেচাল করে দিয়েছিল! উঃ, কুত্তীটা জেনানা না মরদানা, সাত দিনেও মালুম পাই নি। এই দ্যাখ মাউ খে, লোটা দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে আমার পিঠের হাড্ডি চুরচুর করে দিয়েছে। এতোয়ারীকে ভাগিয়েছি। গুরুজির নামে তিন কসম, অ্যায়সা আওরত শাদি করব না। আমার পিঠটা দ্যাখ মাউ খে—
কুর্তা খুলে উদোম পিঠটা দেখায় চান্নু সিং। বলে, বহোত আপশোশের কথা, আমার এতগুলো রুপেয়া বরবাদ হয়ে গেল।
চান্নু সিং-এর আক্ষেপের পেছনে একটু ইতিহাস আছে। মাসখানেক আগে সে সেলফ সাপোর্টার্স টিকিট পেয়েছিল। এবার সে শাদি করতে পারবে। শাদির জন্য ডেপুটি কমিশনারের অফিসে আর্জিও পেশ করেছিল। তারপর এক মঙ্গলবার সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায় ম্যারেজ প্যারেড হল। একপাশে দাঁড়াল জেনানা কয়েদিরা, আর একপাশে টিকিট-পাওয়া পুরুষ কয়েদিরা। এতোয়ারীর মনে ধরল চান্নু সিংকে, চান্নু সিং-এর মনে ধরল এতোয়ারীকে।
এদিকে দাঁড়িয়ে ছিল মেম জেলার, সাহেব জেলার, ডাক্তার, টিণ্ডালান, জমাদারনী ওয়ার্ডারনীরা।
একটু দূরে একান্তে এতোয়ারীর সঙ্গে বাতচিত করেছিল চান্নু সিং।
খাটো খাটো করে ছাঁটা চুল, থ্যাবড়া নাক, চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, গালের মাঝামাঝি পর্যন্ত মস্ত হাঁ–এই হল পাঠান এতোয়ারীর চেহারার নমুনা। তবু সেদিন দুচোখে নেশা লেগেছিল পাঞ্জাবি মরদ চান্নু সিং-এর। নারীসঙ্গহীন এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে দশ দশটা বছর কাটাবার পর এতোয়ারীকে বড় মোলায়েম, বড় খুবসুরত মনে হয়েছিল।
চান্নু সিং জিজ্ঞাসা করেছিল, নাম কী তোমার?
এতোয়ারী। তোমার?
চান্নু সিং।
বহোত বঢ়িয়া নাম। তোমার কে কে আছে মেইনল্যাণ্ডে?
কেউ নেই।
বহোত আচ্ছা। আমারও বিলকুল কেউ নেই।
একটুক্ষণ চুপচাপ। তারপর এতোয়ারীই শুরু করল, এ মারদ–
শাদি তো করবে। লেকিন আচ্ছা আচ্ছা কাপড়া আর গয়না দিতে হবে।
হ্যাঁ–
জরুর। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চান্নু সিং বলেছিল, কয়েদখানায় আমি এখন দুধ যোগান দিই। ভাবছি, হাবরাডিন (এবারডিন) বাজারে একটা চায়ের দোকান খুলব। অনেক রুপেয়া হবে।
বহোত ভাল হবে। এতোয়ারীকে খুশি দেখাচ্ছিল।
শাদির ব্যাপারে চান্নু এবং এতোয়ারী–দুজনেই রাজিবাজি হয়ে যায়।
দিনকতক পর গোরুর গাড়ি নিয়ে এসেছিল চান্নু সিং। নয়া নয়া বাহারি কাপড় এনেছিল। রুপোর টিকলি, কাঙনা (কঙ্কণ), বিছা, মল এনেছিল। তারপর ডেপুটি কমিশনারের অফিসে টিপছাপ দিয়ে এতোয়ারীকে নিয়ে সিধা গারাচারামা গাঁওয়ে চলে গিয়েছিল। সেখানে খানাপিনা হল। অন্য সব কয়েদি যারা সেখানে ঘরবসতি করেছে, তারা এল। তামাম রাত ফুর্তিফার্তা, রং তামাশা চলেছিল। পয়লা রাতটা মজায় মজায় কেটে গিয়েছে।
আন্দামানে কয়েদিদের শাদির কানুন অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনারের অপিসে টিপছাপ দিয়ে জেনানা নিয়ে যাওয়ার সাতদিন পর আবার আসতে হয় রসদ্বীপে, চিফ কমিশনারের অফিসে। এই সাতদিনে যদি জেনানা আর মরদের বনিবনা না হয়, কারো যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তা হলে সেই শাদি বাতিল হয়ে যায়। জেনানা কয়েদিকে আবার ফিরে যেতে হয় সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায়।
পয়লা রাতটা মজায় মজায় কেটেছিল। কিন্তু তার পরদিন থেকেই শুরু হয়েছিল ঝামেলা। এতোয়ারী ঘরের কাজ করবে না। সারাদিন অন্য অন্য কয়েদিদের সঙ্গে রংবাজি করবে, শরাব গিলবে। আন্দামান আসার আগে দু দুটো রেণ্ডিপাড়া চালাত এতোয়ারী। শান্ত ঘর-সংসার তার দিল বশ করবে কেমন করে?
দুরোজ তার চালচলন লক্ষ করে চান্নুর মাথার খুন চাপল। সে বলেছিল, আমি শালা পয়সা খরচা করে তোমায় খিলাব, কাপড় গয়না দেব। তুমি শালী দুসরা কয়েদির সঙ্গে রংবাজি করবে! অ্যায়সা চলবে না।
এতোয়ারীর দুচোখে হত্যা ঝিলিক দিয়েছিল। পেতলের একটা বর্তন তুলে সে ছুঁড়ে মেরেছিল। বুক থেকে খানিকটা মাংস উপড়ে গিয়েছিল চান্নুর। এর পরেই হাতাহাতি, চুলোচুলি শুরু হয়েছিল চান্নু আর এতোয়ারীর।
পাঠান এতোয়ারীর রক্তে ঘরের মোহ নেই, স্নেহ নেই। তার দিলে মমতা নেই। তার রক্তে শুধু ক্রুরতা, হিংসা, আদিম মাতামাতি পিছল সরীসৃপের মতো কিলবিল করে। শাদি না হলে জেনানা কয়েদি কয়েদখানার বাইরে আসতে পারে না। এতোয়ারী চেয়েছিল চাল্লুকে শাদি করে কয়েদখানার বাইরে আসবে। তারপর শরাবে পুরুষসঙ্গে নেশায় তামাশায় চুরচুর হয়ে আন্দামানে আসার আগের সেই বীভৎস জীবনের স্বাদ নেবে। নেশাহীন, পুরুষসঙ্গহীন গারখানার জীবন তার কাছে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু শাদির ছদিনের মাথায় শাদি খারিজের আর্জি পেশ করল চান্নু সিং। এতোয়ারী চলে গেল সাউথ পয়েন্ট কয়েদখানায়। যাওয়ার আগে এতোয়ারী কেঁদেছিল। বলেছিল, মরদ, তোমার দিলে এই ছিল! ফের আমাকে গারখানায় পাঠালে!
চান্নু সিং-এর হৃদয় টলে নি। সে ভাবছিল, এতোয়ারী শালীকে শাদি করে তার এতগুলো টাকা বরবাদ হয়ে গেল। ….
বড় রকমের একটা শ্বাস ফেলে ভুরু কুঁচকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে মাউ খের দিকে তাকায় চান্নু সিং। ডাকে, এই মাউ খে–
হাঁ হাঁ–
ভাবছি, হাবরাডিন (এবারডিন) বস্তিতে একটা চায়ের দোকান খুলে বসব।
বহোত আচ্ছা।
তোর কি মনে হয়, এটা ঠিক হবে?
হাঁ হাঁ—
হঠাৎ চান্নু সিং বলে, লেকিন তার আগে আবার শাদি করব।
এ তো ভাল কথা। মাউ খে সঙ্গে সঙ্গে সায় দেয়।
কিছুক্ষণ খুবই চিন্তিত দেখায় চান্নু সিংকে। তারপর ধীরে ধীরে সে বলতে থাকে, সোনিয়াকেই শাদি করব। মুন্সিজি বলেছে, লেড়কি বড়ী খুবসুরত।
ঠিক হ্যায়। বলতে বলতে আচমকা চেঁচিয়ে ওঠে মাউ খে, লেকিন এ শাদি তো এখন হবে না।
কিউ? হিংস্র চোখে তাকায় চান্নু সিং।
সোনিয়া তো আজ এখানে এসেছে। ঢাই সাল (আড়াই বছর) এখানে না কাটালে আওরত কয়েদি তো শাদি করতে পারে না।
ঠিক, ঠিক বাত। আমার ইয়াদ ছিল না। চাম্বু সিংকে হঠাৎ বড় বিমর্ষ দেখায়। একটু পর বিষণ্ণ গলায় সে বলে, কালাপানিতে যে সব আওরত কয়েদি আসে, তারা জেনানা না মরদানা সমঝনা মুশকিল। মুন্সিজির কাছে সোনিয়ার কথা শুনে দিল বিগড়েছে। কী করি বল তো মাউ খে?
ঢাই সাল বাদেই শাদি করিস।
চান্নু সিং সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। খানিক পরে বলল, সোনিয়াকে তো চিনি না। ওর সঙ্গে জান-পয়চান করি কেমন করে?
আওরত কয়েদিরা যখন জেটিতে নামবে, তখন সবাইকে নাম পুছে পুছে সোনিয়াকে বার করবি।
ও তো ঠিক বাত।
মনে মনে মাউ খের খাসা বুদ্ধির তারিফ করে চান্নু সিং।