Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra » Page 47

সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra

সেদিন ভূতনাথের একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল—বৌঠানকে এই অবমাননা থেকে বাঁচাতে হবে। বড়বাড়ির অতীত গৌরবের অবমাননা নয়। বিংশ-শতাব্দীর নতুন সভ্যতার সঙ্গে যারা খাপ খাওয়াতে পারলো না নিজেদের, তাদের অবমাননা নয়। অপমানটা বৌঠানের ব্যক্তিগত। কেমন যেন ভূতনাথ নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল বৌঠানের ভালো-মন্দর সঙ্গে। এ শুধু কৃতজ্ঞতা নয়। শুধু করুণার ঋণশোধের ব্যর্থ চেষ্টা নয়। শুকনো কর্তব্যও নয়। এ যেন পরমাত্মীয়কে রক্ষা। পরমাত্মীয়ের চেয়েও যদি বড় কেউ থাকে, তাকে।

বৌঠান বলেছিল—আমি যদি মরে যাই, তুই একটু কাঁদিস ভূতনাথ। আমার জন্যে কেউ কাঁদবে, এটা ভাবতেও বড় ভালো লাগে রে!

কিন্তু কাঁদবার অবশ্য প্রয়োজন হয়নি শেষ পর্যন্ত। তেমন দিন সত্যিই যখন এসেছিল—তখন ভূতনাথ নতুন এক উপলব্ধির সন্ধান পেয়েছে। নতুন আত্মানুভূতি। ভূতনাথ তখন নিজেকে জানতে পেরেছে। সুবিনয়বাবুর ভাষায়-আত্মানং বিদ্ধি। পৃথিবীতে কারোর জন্যে কাঁদবার প্রয়োজন তার ফুরিয়ে গিয়েছে। প্রথম-প্রথম জবার বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় ভেতরে যাবার লোভও হয়েছে। আবার মেয়ের গানের শব্দ শুনে অনেকবার দ্বন্দ্ব উদয় হয়েছে মনে। কিন্তু তারপর সে জয় করেছে নিজেকে। সকলকে হারিয়ে সে যে পৃথিবীকে পেয়েছে। নিজেকে জেনে সে যে বিশ্বকে জেনেছে।

কিন্তু সে-কথা এখন থাক।

সেদিন মনে হয়েছিল যেমন করে হোক সে পটলডাঙায় গিয়ে আদালতের পরোয়ানা বাতিল করে আনবেই। সে পা জড়িয়ে ধরবে বাবুদের। বলবে—আপনাদের যেমন করেই হোক এ হুকুম প্রত্যাহার করতেই হবে।

দারোয়ান হয় তো ভেতরে ঢুকতে দেবে না। বাবুর হয় তো বাড়িতে থাকবে না। কিন্তু তবু ভূতনাথ সেই সদর দরজার সামনেই বসে পড়ে থাকবে। প্রত্যাহারের আদেশ না নিয়ে সে ফিরবে না। না প্রত্যাহার হলে সে-ও ফিরবে না এখানে। দিনের-পর-দিন সে ওইখানেই পড়ে থাকবে। দরজার সামনে অভুক্ত থাকবে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত।

সাইকেল-এ চড়ে যেতে-যেতে আবার মনে হলো—কেন সে যাচ্ছে! এও সেই আত্মবোধের তাড়নায়ই সে ছুটে চলেছে। এই আত্মবোধের তাগিদেই সে বৌঠানকে বাঁচাচ্ছে। বৌঠানকে বাঁচানো তার নিজেকে বাঁচানোরই নামান্তর।

কিন্তু বনমালী সরকার লেন তখনও পার হয়নি। হঠাৎ মনে হলো যেন ম্যানেজার আসছে এই দিকে। ভূতনাথ থামলো। নামলো সাইকেল থেকে। ডাকলে—ম্যানেজারবাবু–

ম্যানেজারও হনহন করে আসছিল। হনহন করে হাঁটাই তার অভ্যেস। আস্তে হাঁটতে যেন পারে না ম্যানেজার। ব্যস্ত না হলে যেন বাঁচতে পারে না লোকটা।

আবার ডাকলে ভূতনাথ–ও ম্যানেজারবাবু–

এবার ফিরে দাঁড়ালো। চাইলে ভূতনাথের দিকে একবার। কিন্তু চিনতে পারলে না। হাঁ করে ভূতনাথের মুখের দিকে চেয়ে বললে—আমায় ডাকলে যেন কে?

—আমিই ডাকছিলাম।

—কেন? কে তুমি?

হাতে সেই পেটফোলা ব্যাগ। ছুঁচলো গোঁফ। চিনতে ভুল হবার কথা নয়। কিন্তু কিছুই সহজে চিনতে পারার লোক নয় বুঝি ম্যানেজার। সহজে কাউকে চিনতে পারা বোধ হয় দুর্বলতার লক্ষণ। ননীবাবুর ম্যানেজার হাজারটা কাজের লোক। হাজারটা লোক তার পায়ে ধর্না দিয়ে বেড়ায়। এত সহজে চিনতে পারলে চলবে কেন তার?

ভূতনাথ বললে—আমি বড়বাড়ির লোক—আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম যে।

ম্যানেজার এতক্ষণে বললেও, তা ভালোই হলো—আমিও তো ছুটতে-ছুটতে যাচ্ছি বড়বাড়িতে—সেই সকাল বেলা বেরিয়েছি, আর এই দুপুর বেলা সবে এসেছি ফিরে, এমন সময় হুকুম হলো যাও বউবাজার-হুজ্জতের কাজ হয়েছে বটে।

ভূতনাথ বললে—বাবুরা আছে নাকি কেউ বাড়িতে?

-কেন? বাড়িতে যাবে কেন! সকাল থেকে হাজার জন লোক বাড়িতে দেখা করতে ছোটে। বাবুরা পইপই করে বারণ করে দিয়েছে, কাল সবাইকে খেদিয়ে দিয়েছি, সারাদিন কাজের পর একটু জিরোবে, গল্প করবে, তা না, রাত্তির পর্যন্ত লোকের আর কামাই নেই মশাই।

ভূতনাথ বললে কিন্তু পুলিশ-পেয়াদা এনে বাড়ি চড়াও হয়ে এই যে হলো—এতদিনের বংশ, তা ছাড়া রুগী মানুষ—বাবুদের একটা দয়ামায়া নেই? আর ননীবাবুকে তো চিঠি লেখাই হয়েছে, জবাবটা কী আসে না দেখেই

ম্যানেজার হঠাৎ বললে—সেই চিঠি লিখেই তো এত কাণ্ডরেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো ম্যানেজার। বলেছিলাম চিঠি দিও না সেখানে, চিঠি পেলে সাহেব চটে উঠবে, বলিনি তোমাদের, মনে করে দেখো দিকিনি-বলেছিলাম কিনা? শুধু-শুধু এতগুলো টাকা লোকশান…আমার কী, আমার হুকুম তামিল করা কাজ, বাবুদের লোকশান হয় বাবুরা বুঝবে—আমি কেন মাঝখানে কথা বলতে গেলাম।

তারপর ব্যাগটা খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগলো ম্যানেজার। বললে—সেই সকাল থেকে রদ্দরে তেতেপুড়ে এখন আবার ছোটো বৌবাজার..বাবুদের আমি দেবো দু’কথা শুনিয়ে, তা হলে মিছিমিছি মামলা-মোকদ্দমা আদালতকাছারি করে এত কষ্ট দেওয়াই বা কেন আর এই বুড়ো লোকটার মিছিমিছি হয়রানি।

অনেক কষ্টে বুঝি পাওয়া গেল কাগজটা। রাগের মাথায় কাগজটা নিয়ে বললে—চলো, এখন এই কাজগটির জন্যেই এই হয়রানি।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কীসের কাগজ?

ম্যানেজার তখন আবার হনহন করে চলতে শুরু করেছে। ভূতনাথও সঙ্গে-সঙ্গে চলতে লাগলো। ম্যানেজার বললে—এতক্ষণ বোধ হয় সব মালপত্তোর নামিয়ে ফেলেছে, কি বলে?

ভূতনাথ বললে—তা নামিয়েছে বৈকি! মাল তো আর একটা নয়!

—কিন্তু, যা নামিয়েছে নামিয়েছে, আর নামাবে না, কিন্তু ওঠাতে হবে তোমাদের লোক দিয়ে—তা বলে রাখছি। আমরা নামাবো আবার ওঠাবো, তা হবে না। লোকশানের ওপর লোকশান কেবল—কথা বলতে-বলতে বড়বাড়ির দিকেই চলতে লাগলো ম্যানেজার।

ভূতনাথও চলতে লাগলো সঙ্গে-সঙ্গে। বললে—মালপতত্তার তা হলে কি আর নামাবে না ওরা?

-আরে বাপু, না, না-নামাবে না তো বললুম—এক কথা এক শ’ বারহুজ্জতের কাজ হয়েছে দেখছি। বড়বাড়ির ভেতরে এসে ম্যানেজার ডাকলে—ওরে-এ-ই-ই, কী নাম যেন ওর—কৈলাশ—

কৈলাশ যেন ওদিকে ছিল। মালপত্তোর নামানোতে তারই উৎসাহ বেশি। হাঁক-ডাক হৈ-চৈ করে সে-ই এতক্ষণ সব তদ্বির তদারক করেছে। সকাল থেকে এসে লোকজন পুলিশ-পেয়াদা সেপাই নিয়ে কাজে লেগে গিয়েছিল।

ম্যানেজার বললে—হাতের কাজ সব বন্ধ করতে বল।

—সে কি ম্যানেজারবাবু?

—যা বলছি তাই কর, আমরা হুকুমের চাকর।

—আর এ মালপত্তোর?

–এ-সব থাকবে, যেমন আছে, যাদের মাল তারা ওঠাক— আমরা একবার ওঠাবো, একবার নামাবো, লোকশানের কপাল হয়েছে তাই—নইলে হাতীবাগানের সরকারবাড়িতে এক রাত্তিরে মাল নামিয়ে, সেইখানে বসে সেই মাল আবার নীলেমে বেচে তবে উঠেছিলুম—কিন্তু এমন করলে আর বন্ধকী কারবার চলবে না তাও বলে রাখছি।

ভূতনাথ বললে—তা হলে কি ছোটবাবুরা এখন বড়বাড়িতে থাকতে পাবে ম্যানেজারবাবু?

ম্যানেজার বললে—তা ছাড়া আর কি, সাহেব বিলেত থেকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছে। এর আর নড়চড় হবার উপায় নেই—সাহেবের কাছে চিঠি লিখেই যত গোল করলে তোমরা।

—বরাবর থাকতে পাবে তত?

—বরাবর কেন? এই তো হুকুম-নামা রয়েছে। দেখো না–বলে হাতের কাগজখানা দেখালে।

—যদ্দিন কর্তারা বেঁচে থাকবে, তদ্দিন ভোগদখল করবে এই পর্যন্ত—তারপর…

বংশীও পাশে এসে দাঁড়িয়ে শুনছিল। বললে—তাহলে শালাবাবু, ছোটবাবুকে থাকতে দেবে?

উত্তর দেবার আগেই একটা গাড়ি ঢুকলে সদর দিয়ে। ওপরে কোচবাক্সে বসে ইব্রাহিম গাড়ি চালাচ্ছে। ঢং-ঢং ঘণ্টা বাজালে পা ঠুকে। মেজবাবু গাড়ি থেকে নামলো।

বংশী গিয়ে নিচু হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে।

মেজবাবু জলদ-গম্ভীর গলায় বললে—কই, পটলডাঙার বাবুদের লোক কোথায় রে?

মেজবাবু যেন আরো কালো হয়ে গিয়েছে এদানি। অনেকদিন পরে দেখা। শরীর ভেঙে গিয়েছে আরো। তবু কোঁচানো ধুতি মাটিতে লুটোচ্ছে। পামশু পায়ে। মাথায় বাবরি চুলের ফাঁকে যেন একটু-একটু টাক পড়েছে। গায়ে এসেন্সের গন্ধ। ভুরভুর করতে লাগলো জায়গাটা।

—পটলডাঙার লোক কোথায় গেল রে?

ম্যানেজার সামনে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে প্রণাম করলে।

মেজবাবু বললে কে তুমি? নাম কি তোমার?

মেজবাবুর সামনে ম্যানেজার যেন হঠাৎ ফণা গুটিয়ে নিয়েছে। ছুঁচলো গোঁফ দুটো যেন হঠাৎ বড় ঝুলে এল। মিনমিন করে নিজের নাম বললে ম্যানেজার।

মেজবাবু বললে—বেশ, বেশ, তোমাদের কাছেও টেলিগ্রাম এসেছে, আমাকেও করেছে টেলিগ্রাম, ননীবাবু লোকটি ভালো, তা এবার তোমাদের আর কাজ কি-যেতে পারে। এখন।

মেজবাবুর সঙ্গে বেণীও এসেছিল। বেণীর শরীরটাও খারাপ হয়ে গিয়েছে। ইব্রাহিমেরও গায়ে আর সে উর্দি নেই। মাথার বাবরি কিন্তু পরিপাটি। কাঠের চিরুণী দিয়ে আঁট করে বাঁধা। আর মোম লাগানো গোঁফ।

মেজবাবু বললে—চল তোর ছোটকর্তাকে দেখে আসি, কেমন আছে ও আজকাল?

তারপর ইব্রাহিম, বেণী, বংশী সবাই মিলে আবার সেই সব মালপতোর ওঠানো। ভারী-ভারী মাল সব। সেকালের সামগ্রী। ভারী না হলে যেন মানাতো না। এক-একটা কাঠের পিড়ি চারজনে ধরে তবে নড়াতে পারা যায়। এক-একটা শিল, বাসন, কাটারি, জলচৌকি, তোষক, গদি, সিন্দুক একলা নড়ায় কার সাধ্যি। কোম্পানীর আমলের জিনিষ সব। সস্তাগণ্ডার দিন ছিল তখন। কোম্পানী বাহাদুরের আমলে চল্লিশ মণ চালের দাম ছিল পঁচাত্তোর টাকা। পাঁচ মণ ঘি সাতাত্তোর টাকা, দু’মণ সরষের তেল একান্ন টাকা। এ-সব জিনিষ বড়বাড়িতে মণ-মণ আসতে। খেতেও এবেলা-ওবেলা অনেক লোক। ইংরেজ আমলেই প্রথম এল গোল-আলু। তা তাও সস্তা হলো ক্রমে। শুধু যা বাঁধাকপিটাই ছিল একটু আক্রা। ওটা খেতো সাহেব সুবোরা।

মালপত্তোর উঠতে বিকেল হয়ে গেল। সারাদিন কারোর খাওয়া হয়নি। রান্নার পাট হয়নি সকাল থেকে। যে-কাণ্ড চলেছে বাড়িতে। মাথার ঠিক ছিল না কারো। উনুনে আগুন পড়লো তখন। সেজখুড়ি ভাত চড়ালো। বংশী বাজারে গেল মাছ তরকারি আনতে। যাবার সময় বললে-আপনি যেন বেরোবেন না আজ্ঞে—একেবারে খেয়ে-দেয়ে তবে বেরোবেন।

ভূতনাথ বললে—আমার যে একবার বার-শিমলেয় কাজ আছে বংশী।

-না, না, শালাবাবু, না খেয়ে যাবেন না, ছোটমা জানলে রাগ করবে হুজুর।

—ছোটমা-ও কি না খেয়ে আছে বংশী?

–ছোটমা’র খাওয়ার কথা আর বলবেন না শালাবাবু, আজ যে এত কাণ্ড হয়ে গেল, কোনোদিকে খেয়াল নেই তার। জানতেও পারলে না কিছু-সকাল বেলাই এক বোতল খেয়ে শেষ করে দিয়েছে। সকাল থেকে বায়না ধরেছিল চান করবেন না, তারপর চিন্তা বলে-কয়ে চান-টান করিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে দিয়েছে—তা আমি যখন গিয়ে বললুম-ছোটমা, আজ ভাত হতে দেরি আছে—এই জলখাবারটুকু খেয়ে নাও ততক্ষণ।

ছোটমা প্রথমে শুনতে পেলে না। চোখ বুজে শুয়ে পড়ে রইল। আবার যখন বললুম, তখন বললে—খাবো না আমি, নিয়ে যা আমার সামনে থেকে।

বললাম—না খেলে কী করে বাঁচবে—শুধু মদ খেলে পেট ভরবে? ছোটমা বোধহয় রেগে গেল। চোখ খুলে আমার দিকে তাকালে খানিকক্ষণ। আমি ভাবলাম—তাহলে বোধহয় রাগ থেমেছে। পাথরের রেকাবিটা সামনে এগিয়ে দিলাম আজ্ঞে তা সঙ্গে-সঙ্গে ছোটমা পা দিয়ে পাথরখানাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে–মেঝের ওপর পড়ে সেখান ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেল শালাবাবু।

মুখ দিয়ে কিছু কথা বেরুলো না আমার। কোথায় আমার মাথায় ভাবনা, সেই ভোর এস্তোক ওরা এসে জ্বালাচ্ছে, মালপত্তোর নামাচ্ছে, ঘর খালি করতে বলছে, এত করে ঝাঁট দিলুম ঘর, সব ধুলো-কাদায় একসা করেছে—তার ওপর এই কাণ্ড, পাথর-বাটি ভাঙা কি ভালো শালাবাবু, গেরস্তের অকল্যেণ হয় যে—তা আমি আর থাকতে পারলুম না আজ্ঞে, মুখ বুজে থেকেথেকে আমার বুকের ভেতরটা একেবারে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে যে।

—তা, কী বললে তুমি?

বংশী বললে-মুখে যা না-আসে, তাই বলে ফেললাম আজ্ঞে, আমার মুখের রাশ আলগা করে দিলাম একেবারে। আমার তো আর জ্ঞান-গম্যি ছিল না তখন, রাগের ঝোঁকে কী বলছি, তা কি আর মনে আছে ছাই,আমার?…তা দেখি ছোটমা কাঁদছে হুজুর।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কাঁদছিল বৌঠান?

বংশীর চোখ দিয়েও হঠাৎ ঝর-ঝর করে জল পড়তে লাগলো। কাপড়ের খুট দিয়ে জলটা মুছে নিয়ে বংশী বললে—দেখে তো আমার জ্ঞান ফিরে এল—ভাবলাম করছি কী! ছোটমা’র না-হয় জ্ঞান নেই, নেশার ঘোরে যা তা করছে—কিন্তু আমি করছি কী। আমার অন্নদাতা মা’কে আমি নাহাতক গালাগালি দিলাম এমন করে। আমার যে নরকেও ঠাঁই হবে না—তা সেখানেই বসে পড়ে ঠাস-ঠাস করে আমার গালে চড়াতে লাগলাম আজ্ঞে—কিন্তু তাতেও যেন প্রাচিত্তির হলো না আমার, দেয়ালের গায়ে কপালটা ঠুকতেঠুকতে বললাম—আমার মিত্যু হোক—আমার মিত্যু হোক— আমার মিত্যু হোক—আমার মিত্যু হয় না কেন রে—সেইখানে দাঁড়িয়েই আবার ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো বংশী।

বংশী চোখটা কাপড় দিয়ে মুছে নিলে। তারপর বললে–যাই আবার একবার বাজারের দিকে। এ-বেলায় বোতল নেই—শা মশাই-এর দোকান থেকে আবার আনতে হবে একটা—যদি আনতে ‘ভূলে যাই, তাহলেই চিত্তির।

তারপর থেমে বললে-আমার হয়েছে এই জ্বালা শালাবাবু –কাকেই বা বলবে—কে-ই বা বুঝবে। ওদিকে চিন্তা ছোটমাকে দেখেই খালাস, সেজখুড়ির রান্না করেই কাজ শেষ—আর বাকি সব কাজ—ছোটবাবুর ময়লা-মুক্ত থেকে ভেতর-বাইরের সব কাজ, এই বংশীর করতে হবে—আমি তো মানুষ বটে।

ভূতনাথ বললেএকবার ছোটমা’র সঙ্গে এখন দেখা করিয়ে দেবে বংশী? বার-শিমলেয় যাবার আগে একবার শুধু দেখা করতাম—দুটো কথা বলতাম।

বংশী হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বললে—আপনি আর ছোটমা’র সঙ্গে দেখা করবেন না হুজুর।

-কেন?

—আজ্ঞে, আপনার ভালোর জন্যেই বলছি—দেখা করবেন না কখনও।

—কেন, ওকথা কেন বলছো? বংশী রেগে গেল।—ওই আপনার এক দোষ, বড় একগুয়ে, বলছি দেখা আর করবেন না, আপনার নিজের ভালোর জন্যেই না বলছি আমি।

ভূতনাথেরও কেমন যেন রোখ চেপে গেল। বললে—দেখা আমি করবোই।

-তবে করুন, আমাকে আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন তাহলে? আমি বলছি দেখা করলে আপনার ভালো হবে না—ভালো হবে না—ভালো হবে না—এই বলে দিলাম তিনবার।

ভূতনাথ বংশীর মুখের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে। বংশী তার দৃষ্টি তখন অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছে। বললে—কিন্তু কেন দেখা করবে না, আমাকে তা বলবে তো? আমার ভালোটা না-হয় আমাকেই জানালে?

বংশী বললে—সব কথায় আপনার কান দেওয়া চাইনা শুনলেই ভালো করতেন। যা হোক, এই এখন বেণী এসেছিল, সে-ই এখন আমাকে বলে গেল।

-কী বলে গেল?

—আপনি যেন আবার কাউকে বলবেন না, বেণী আমাকে চুপি চুপি বলে গেল—মেজবাবু সব খবর পেয়েছে এ-বাড়ির, আপনাকে মারবার জন্যে গুণ্ডা রেখেছে আজ্ঞে।

ভূতনাথ অবাক হয়ে গেল। বললে—আমাকে মারবার জন্যে। গুণ্ডা রেখেছে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, মেজবাবুকে তো আপনি চেনেন না, গুণ্ডা কি। আজ থেকে আছে? সেকাল থেকে দেখে আসছি মেজবাবু গুণ্ডা। পোষে, মেয়েমানুষ মদ যারা করে,তাদের গুণ্ডাও রাখতে হয় আজ্ঞে, ও বরাবর আছে। ছোটবাবুর গুণ্ডার দল ছিল জানবাজারে, ছেনি দত্তর ছিল, ও সকলেই রাখে, নইলে অত রাত্তির করে ঘোরাফেরা। করে, গুণ্ডা না রাখলে কলকাতা শহরে চলবে কেন।

–-তা গুণ্ডা আমাকে মারবে কেন?

–ওই যে আপনাকে দেখেছিল সেবার ছোটমা’র ঘরে, তারপর খপর তো’সব পায়, গরাণহাটায় চলে গিয়েছে বটে, কিন্তু খপর সব রাখে এ-বাড়ির। কী দিয়ে আমরা ভাত খাই, কী করি, সব খপর যায় গরাণহাটায়।

-কী করে যায়?

—শুধু কি গরাণহাটায়! পাথুরেঘাটায়, ছুটুকবাবুর শ্বশুরবাড়িতে পর্যন্ত এ-বাড়ির রোজকার খপর চলে যায়, আবার গরাণহাটা, পাথুরেঘাটার খপর আমরা জানি। ঝি-চাকর থাকলে এমন খপর–চালাচালি তো হবেই শালাবাবু।

-কিন্তু আমাকে গুণ্ডা দিয়ে কেন মারবে বংশী?

-আমি তো জানি না কিচ্ছু, বেণী এসে আমায় যা বললে তাই বললাম। বললে—শালাবাবু নাকি ছোটমা’র ঘরে যায় রাত্তির বেলা, মদ খায় দুজনে, বাইরে বেরোয় গাড়ি করে—এটা তো ভাল নয়। মেজবাবু বলে—আমাদের বংশে বউরা কখনও সূয্যির মুখ পর্যন্ত দেখেনি, তা কথাটা সত্যি শালাবাবু, আমার মনে আছে, সেকালে আমরা চাকররা পর্যন্ত অন্দরে ঢুকতে পেতুম না। ঝি-এর মারফৎ ফরমাশ আসতো আর হুকুম তামিল করতাম আমরা—তা একালে তো সব বেহ্ম হয়ে গিয়েছে। সাহেব-সুবো এসে খানা খাচ্ছে-রাস্তায়, ঘাটে মেয়েছেলেরা বেড়াচ্ছেতা তাই মেজবাবুর রাগ আপনার ওপর, বলে দিয়েছে রাস্তায় বেরোলে ফাঁক পেলেই একেবারে খুন করে ফেলতে।

ভূতনাথ শুনে চুপ করে রইল।

বংশী বললে—একা-একা রাত-বিরেতে রাস্তায় না-ই বেরোলেন, গুণ্ডার কাণ্ড তো, কখন কী করে বসে!

ভূতনাথ খানিকক্ষণ কী যেন ভাবলে। তারপর বললে—নিজের জন্যে আমার কোনো ভয় নেই বংশী, আমি তো দেখেছি, আমার পেছন-পেছন লোক ঘোরাঘুরি করে—যখন যেখানে যাই, সেখানে যায়। একদিন ভাবলাম জিজ্ঞেস করবে—তা সরে গেল তাই।

—ওই—ওই—ওই, ও ঠিক মেজবাবুর লোক।

—কিন্তু সে তো ভাবছি না আমি, আমি ভাবছি বৌঠানের জন্যে। আমার জন্যে কি বৌঠানের বদনাম হবে-বিপদ হবে— তার চেয়ে আমি চলেই যাই না কেন এখান থেকে মিছিমিছি আমি অন্ন ধ্বংস করছি এ-বাড়ির।

বংশী বললে—এমন কথা বলবেনু না হুজুর—আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি—ছোটমা পর্যন্ত জানে না কিন্তু আপনার টাকাতেই তো এখনও…

ভূতনাথ বললেও-কথা থাক, ওই গুণ্ডার কথা যা বললে, ওটা আর কেউ জানে?

-না, কেউ জানে না হুজুর, কিন্তু বেণী সাবধান করার জন্যেই বললে আমাকে।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু একবার বৌঠানকে নিয়ে যে বরানগরে যেতেই হবে।

-বরানগরে আপনারা কোথায় যান বলুন তো শালাবাবু?

—সে—এক সাধুর কাছে, বৌঠান ছোটকর্তার অসুখের জন্যে পূজো দেবে, আমিও বৌঠানের ভালোর জন্যে পূজো দেবোবাজারেই তো যাচ্ছে, আমাদের দুজনের জন্যে পাঁচ গোছ পান আর পাঁচ পণ করে সুপুরি আনতে পারো?

—তা পারবো না কেন শালাবাবু।

—আনতে পারলে আজই যাই, এই পয়সাটা রাখো।

বংশী বললে–পয়সা আর দেবেন না হুজুর, কত পয়সা আপনি পাবেন আমার কাছে, তারই হিসেব করুন আগে।

ভূতনাথ বললে—আমাকে তবে একবার বৌঠানের ঘরে পৌঁছে দে বংশী।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress