Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra » Page 14

সাহেব বিবি গোলাম || Bimal Mitra

১৮৯৭ সাল। ব্ৰজরাখাল রাত্রে বাড়ি আসেনি। আগের দিন রাত্রে বলেছিল—খুব ভোরে উঠবে বড়কুটুম-নইলে হয় তো দেখতে পাবে না। ভিড়ও হবে খুব—এখন তো আর নরেন দত্ত নয়—এখন স্বামী বিবেকানন্দ। ট্রেনটা বোধ হয় সকাল সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যেই এসে পৌঁছোবে, তার আগেই গিয়ে হাজির হয়ো–-আমি থাকবে।

স্বামী বিবেকানন্দ! কথা বলতে বলতে ব্ৰজরাখাল থর-থর করে কাঁপে। বলে—যাবার আগে নরেন বলেছিল—“I go forth to preach a religion of which Buddhism is nothing but a rebel child and Christianity but a distant echo.” হলোও তাই।

খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছে ভূতনাথ। বড়বাড়িতে একটু দেরি করে সকাল হয়। তবু অন্ধকারে স্নান সেরে নিয়ে জামাটা গায়ে দিয়ে চাদর জড়িয়ে নিলে। কনকনে শীত। তখনও বাড়ির আনাচ-কানাচের আলোগুলো নেবেনি। নাথু সিং পাহারা দিতে দিতে বুঝি একটু ক্লান্ত হয়ে এসেছিল। পায়ের আওয়াজ পেয়েই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সমস্ত বাড়িটা নিদ্রাচ্ছন্ন। এখন বৌঠান কী করছে! এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। সারা রাত জেগে কী করে কে জানে! আশ্চর্য হয়ে যায় ভূতনাথ।

ব্ৰজরাখালের কথাগুলো তখনও কানে বাজছিল—বিবেকানন্দ আমেরিকা থেকে এসে বলেছেন—এসো, মানুষ হও, তোমার আত্মীয়স্বজন কাঁদুক, পেছনে চেও না—সামনে এগিয়ে যাও, ভারতমাতা অন্তত এমনি হাজার হাজার প্রাণ বলি চান, মনে রেখো-মানুষ চাই, পশু নয়।

সাত টাকা মাইনের কেরানীকে চায় না কেউ। পরান্নভোজী ভূতনাথ। এতদিন কলকাতায় এসে কী দেখেছে সে? মানুষ দেখেছে ক’টা! বড়বাড়ির মানুষগুলো যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। ওদের গায়ে কোনো ছোঁয়া লাগে না। সমস্ত ঘরগুলোর ভেতরে ঢুকলে যেন অশান্তির আবহাওয়ায় দম আটকে আসে। বৌঠান বলেছিল—অবাক বাড়ি এটা, বড় অবাক বাড়ি।

অবাক বাড়িই এটা সত্যি। সেদিন বদরিকাবাবুর কাছ থেকে এই কথাই শুনেছিল ভূতনাথ।

ডান পাশের ঘরটা খাজাঞ্চিখানা আর বাঁ দিকের বড় ঘরখানা খালি পড়েই থাকে।

দরজাটা খোলা ছিলো বুঝি। চিত হয়ে তক্তপোশের ওপর কে যেন শুয়ে ছিল। অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে শব্দ এল—কে যায়?

—আমি।

‘আমি’ বলে চলে আসছিল ভূতনাথ। কিন্তু আবার যেন ডাক এল—শুনে যাও, শুনে যাও হে।

আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকেছিল ভূতনাথ। ঘরে ঢুকে দেখলে একটা তুলোর জামা গায়ে মোটাসোটা বৃদ্ধ মানুষ। ভূতনাথকে দেখে উঠে বসলো। বংশীর কাছে শুনেছিল এর কথা। এরই নাম বদরিকাবাবু।

বংশী বলেছিল—ওদিকে যাবেন না বাবু, বদরিকাবাবু দেখলেই ডাকবে—ওই ভয়ে কেউ যায় না।

কিন্তু ভয়টা কিসের!

–বোসো এখানে। ভূতনাথ বসলো।

-নাম কী তোমার?

শুধু নাম নয়। বাবার নাম। জাতি। কর্ম! নাড়ী-নক্ষত্রের পরিচয় খুটিয়ে খুটিয়ে নিলেন। সব শুনে বললেন—ভালো কয়রানি ছোকরা, গেঁজে যাবে।

ভূতনাথ কিছু বুঝতে পারলে না।

–হ্যাঁ, গেঁজে যাবে। বদরিকাবাবু মিছে কথা বলে না হে। যদি ভালো চাও, পালাও এখনি, নইলে গেঁজে যাবে! মুর্শিদকুলী খা’র আমল থেকে সব দেখে আসছি। লর্ড ক্লাইভকে দেখলুম, সিরাজউদ্দৌলাকে দেখলুম, এই কলকাতার পতন দেখলুম-হালসীবাগান দেখলুম। শেষটুকু দেখবার জন্যে এই ট্যাকঘড়ি নিয়ে বসে আছি সময় মিলিয়ে নেবে বলে। তারপর দেয়ালের দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন—ওই দেখো, তাকিয়ে দেখো—সব কুষ্ঠি-ঠিকুজি সাজানো রয়েছে, সব বিচার করে দেখেছি—মিলতে বাধ্য।

ভূতনাথ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলে দেয়ালের গায়ে আলমারিতে সাজানো সার সার বই সব। মোটা মোটা বই-এর মিছিল। সোনালি জলে লেখা নাম-ধাম।

—সব বিচার করে দেখেছি—মিলতে বাধ্য। যদি না মেলে তো আমার টাকঘড়ি মিথ্যে। কেল্লার তোপের সঙ্গে রোজ মিলোই ভাই—একটি সেকেণ্ড এদিক-ওদিক হবার জো নেই। বলে টাক থেকে বার করলেন ঘড়িটা। মস্ত গোলাকার ঘড়ি। চকচক করছে। ঘড়িটাকে নিয়ে কানে একবার লাগিয়ে আবার টাকে রেখে দিলেন। বললেন—১৩৪৫ সালে তৈরি আর এটা হলে গিয়ে ১৮৯৭। পাঁচ শ’ বাহান্ন বছর ধরে ওই একই কথা বলছে ঘড়িটা।

ভূতনাথ মুখ খুললে এবার। বললে—কী বলছে?

—বলছে, সব লাল হয়ে যাবে!

—লাল?

-হ্যাঁ, নীল নয়, সবুজ নয়, হলদে নয়, শুধু লাল। দিল্লীর বাদশা বুঝেছিল, রণজিৎ সিং বুঝেছিল, সিরাজউদ্দৌলা, আলীবর্দি খাঁ, জগৎ শেঠ, মীরজাফর, রামমোহন, বঙ্কিম চাটুজ্জে সবাই বুঝেছে শুধু ‘বঙ্গবাসী’ বুঝলে না।

-বঙ্গবাসী?

—খবরের কাগজ পড়িস না? নইলে ওই লোকটাকে, ওই বিবেকানন্দকে বলে গরুখোর, মুর্গীখোর? নইলে সাত শ’ বছর মোছলমান রাজত্বে ছ’ কোটি মোছলমান হয় আর এক শ’ বছর ইংরেজ রাজত্বে ছত্রিশ লক্ষ লোক খৃস্টান হয়। ও কি ওমনি-ওমনি? নেমকহারামির গুনোগার দিতে হবে না? পালা এখান থেকে ভালো চাস তো পালিয়ে যা, নইলে গেঁজে যাবি, আর যদি না-যাস তোমর এখেনে। যখন এই বড়বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে যাবে, শাবল গাঁইতি নিয়ে বাড়ি ভাঙবে কুলী মজুররা, তখন কড়িকাঠ চাপা পড়বি, পাঁচ শ’ বাহান্ন বছরের ঘড়ি দিনরাত এই কথা বলছে, আমি শুনি আর চিৎপাত হয়ে শুয়ে থাকি।

এ এক অদ্ভুত লোক। ভূতনাথ সাইকেল চড়ে চলতে চলতে ভাবে, সেই এক অদ্ভুত লোক দেখেছিল জীবনে। সারা জীবন শুধু স্থবিরের মতো শুয়ে শুয়ে বিড় বিড় করে ভাবতো। ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ কেমন করে সেই উন্মাদ লোকটার মস্তিকে আবির্ভাব হয়েছিল কে জানে!

অনেকদিন ভূতনাথ ভেবেছে, বদরিকাবাবুর কোথায় যেন একটা ক্ষত আছে। বাইরে থেকে দেখা যায় না।

বংশী বলে—এই বাড়িতে যত ঘড়ি দেখছেন, সব ওই বদরিকাবাবুর জিম্মায়। দম দেন উনি, আর ন’টার সময় কেল্লার তোপের সঙ্গে ট্যাকঘড়িটা মিলিয়ে নেন।

সে অনেক কালের কথা। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ। দিল্লীর বাদশা’র কাছে রাজস্ব পৌঁছে দিতে যাবে জবরদস্ত নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ। দর্পনারায়ণ তখন তার প্রধান কানুনগো। তার সই চাই, নইলে বাদশা’র সরকারে রাজস্ব অগ্রাহ্য হবে। জমিদারদের রক্ত চোষা টাকায় তখন মাটিতে পা পড়ে না মুশিদকুলী খাঁ’র। একদিন খাজনা দিতে দেরি হলে জমিদারদের ‘বৈকুণ্ঠ’ লাভ। সে-বৈকুণ্ঠ নরকের চেয়েও যন্ত্রণাকর।

দর্পনারায়ণ বেঁকে বসলেন। বললেন—তিন লক্ষ টাকা চাই, তবে সই দেবো।

মুর্শিদকুলী খাঁ বললেন—এখন সই দাও, ফিরে এসে টাকা দেবো।

দর্পনারায়ণও সোজা লোক নন। বললেন—তবে সইও পরে দেবো।

শেষ পর্যন্ত মুর্শিদকুলী খাঁ সই না নিয়েই চলে গেলেন দিল্লী। সেখানে গিয়ে ঘুষ দিয়ে কার্য সমাধা করলেন। কিন্তু অপমান ভুললেন না। ফিরে এসে তহবিল তছরূপের দায়ে জেলে পুরলেন দর্পনারায়ণকে। সেই জেলের মধ্যেই না খেতে পেয়ে মারা গেলেন দর্পনারায়ণ। ইতিহাস ভুলে গেল তাঁকে।

সেই দর্পনারায়ণের শেষ বংশধর বদরিকাবাবু আজ বড়বাড়ির ঘরে ঘরে ঘড়িতে দম দিয়ে বেড়ান। বোধ হয় ঘড়ির টিকটিক শব্দের সঙ্গে তাল রেখে কালের পদধ্বনি শোনেন।

তারপর কতকাল কত পুরুষ পার হয়ে গিয়েছে। কোথায় গেল নাজির আহম্মদ আর কোথায় গেল রেজা খাঁ। কোথায় গেল মধুমতী তীরের সীতারাম, আর ফৌজদার আবুতোরাপ। নেই পীর খাঁ, নেই বক্স আলী। এক এক পুরুষের পর আর এক পুরুষ উঠেছে আর শেষ হয়েছে। কিন্তু দর্পনারায়ণের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি আজও। সে-বংশ এবার নির্বংশ হতে চললো। তবু বড়বাড়ির বৈঠকখানা ঘরটার ভেতরে বসে দুর্বল বদরিকাবাবু ইতিহাস পড়েন, আর অভিশাপ দেন। অভিশাপ দেন সমস্ত পৃথিবীকে। যে-পৃথিবী অত্যাচার করে, অন্যায় করে, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয় না। যে-পৃথিবী শুধু টাকার গর্ব করে। সেই সামন্ত সভ্যতার শিরে প্রতি মুহূর্তে দুর্বল আঘাত হেনে হেনে একটি দুর্বলতর মানুষ শুধু আরো দুর্বল হয়ে যায়।

বলেন—ঘড়ি বলছে—সব লাল হয়ে যাবে—দেখিস—

পাঁচ শ’ বাহান্ন বছর আগেকার সৃষ্টি যন্ত্রযুগের প্রথম দান ঘড়ি। ঘড়ির মধ্যেই যেন যন্ত্রসভ্যতার সমস্ত বাণী সঙ্কুচিত হয়ে আছে। ও বলছে— কিছুই থাকবে না। সব লাল হয়ে যাবে। অমৃতের পুত্র মানুষ, মানুষের জয় হবেই।

বদরিকাবাবু বলেন—একদিন দেখবি তুই, জয় হবেই আমাদের, আমি হয় তো সেদিন থাকবে না—এই বড়বাড়ি থাকবে না, এই মেজবাবু, ছোটবাবু তুই আমি কেউই থাকবে না। এই ছোটলাট, বড়লাট, ইংরেজরাজত্ব, কেউ নয়—কিন্তু আমার কথা মিথ্যে হবে না, দেখে নিস।

শীতের মধ্যে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে ভূতনাথ চলছিল।

রাস্তার দু’পাশের দোকানপাট বন্ধ। অন্ধকার ভালো করে কাটেনি। চারদিকে শুধু ধুলো আর ময়লার গন্ধ। অন্ধকারে চলতে চলতে ভূতনাথের কেবল মনে হয়েছিল, বদরিকাবাবু পাগল হোক, কিন্তু তার ভবিষ্যৎবাণী যেন সত্য হয়।

শেয়ালদা স্টেশনের সামনে তখন বেশ ভিড় জমেছে। আবছা অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না মুখ। তবু ব্ৰজরাখালকে খুঁজে খুঁজে দেখতে লাগলো। এক-এক জায়গায় দল বেঁধে জটলা করছে লোকজন। বেশির ভাগ যেন ছেলের দল। চারদিকে প্রতীক্ষমান মানুষ। এই দেশেরই এক ছেলে মহাবাণী বহন করে নিয়ে আসছে। যে বলেছে—জগতের একটা লোকও যতদিন অভুক্ত থাকবে, ততদিন পৃথিবীর সমস্ত লোকই অপরাধী। যে বলেছে—“আজ হতে সমস্ত পতাকায় লিখে নাও—যুদ্ধ নয়, সাহায্য,—ভেদ বিবাদ নয়, সামঞ্জস্য আর শান্তি। যে বলেছে—তোমরা পাপী নও, অমৃতের সন্তান, পৃথিবীতে পাপ বলে কিছুই নেই, যদি থাকে তবে মানুষকে পাপী বলাই এক ঘোরতর পাপ। তুমি সর্বশক্তিমান আত্মা, শুদ্ধ, মুক্ত, মহান! ওঠো জাগগা স্ব স্বরূপ বিকাশ করতে চেষ্টা করো, উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত।

ক্রমে ভোর হলো। আরো ভিড় জমলো। ভূতনাথ চারদিকে চেয়ে দেখলে সমস্ত শেয়ালদা’ স্টেশনের আশেপাশে শুধু মানুষের মাথা। এরা কোথায় ছিল এতদিন! কারা এরা। এরাও কি বিবেকানন্দের ভক্ত ব্রজরাখালের মতন?

হঠাৎ জনসমুদ্র উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। ইঞ্জিনের বাঁশি শোনা গেল। চিৎকার উঠলোজয় রামকৃষ্ণদেব কী জয়জয় বিবেকানন্দ স্বামিজী কী জয়।

ভিড়ের স্রোতের সঙ্গে ভূতনাথ ঢুকলো স্টেশনে।

ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে। বিপুল জনতা ঘন ঘন মহামানবের জয় ঘোষণা করছে। তারপর সেই অসংখ্য জন-সমুদ্রের কেন্দ্রে আর এক দিব্যপুরুষ আবিভূত হলো। মাথায় বিরাট গেরুয়া পাগড়ী, গেরুয়ায় ভূষিত সর্বাঙ্গ। দুই চোখে অস্বাভাবিক দীপ্তি। ভূতনাথের মনে হলো—মানবের সমাজে যেন এক মহামানব এসে দাঁড়ালেন। সমস্ত ভারতবর্ষের আত্মা মথিত করে নবজন্ম গ্রহণ করলে যেন এক অনাদি পুরুষ। হিমালয়ের ভারতবর্ষ, বৈদিক ভারতবর্ষ, উপনিষদের ভারতবর্ষ, আজ যেন নরদেবতার রূপ নিয়েছে। মানুষ বুঝি অমৃতের সন্তান হয়ে আবার জন্মগ্রহণ করলো। ভূতনাথের মনে হলো—যেন শেয়ালদা স্টেশনের স্বল্পপরিসর প্ল্যাটফরম এটা নয়। অশ্রান্ত-কল্লোল বারিধির বুকে বুঝি প্রথম জেগেছে একখণ্ড ভূমি। হিমালয়ের শীর্ষ জেগে উঠেছে বুঝি মহাসম্ভাবনার ইঙ্গিত নিয়ে। এইবার জন্ম হবে মানুষের। নতুন মানুষের হৃদস্পন্দনের মধ্যে ধ্বনিত হবে সেই আদি প্রশ্ন—কে আমি? কোথা থেকে আমি এলাম? তারপর গ্রহ নক্ষত্র সূর্য পৃথিবীর সমস্ত সঙ্গীত স্তব্ধ করে এক মহাবাণী উচ্চারিত হবে আবার। আবার নতুন করে সৃষ্টি হবে নতুন পৃথিবীর। নতুন মানুষ আর এক নতুন উত্তর পাবে মহামানবের মহাবাণীর মধ্যে! মানুষ অমৃত, মানুষ আর কেউ নয়। মানুষ অমৃতস্য পুত্রাঃ-মানুষ অমৃতের। সন্তান।

ঠিক এই কথাগুলোই যে বর্ণে বর্ণে সেদিন মনে হয়েছিল তা নয়। কিন্তু পরে যখন অনেক শিখে অনেক পড়ে তার মনের তৃতীয় নয়ন খুলে গিয়েছিল তখন সে ভেবেছে তার অপরিণত মনের কল্পদৃষ্টিতে সেদিন তার এই ভাবনা হওয়াই উচিত ছিল।

জনস্রোত ততক্ষণে বাইরে চলে এসেছে। ভূতনাথ মন্ত্রচালিতের মতো জনতাকে অনুসরণ করে এল। বাইরেও এক বিপুল সমুদ্র, কিন্তু প্রতীক্ষায় অস্থির অশান্ত।

ঘোড়ার গাড়িতে উঠলেন মহামানব। চারঘোড়ার গাড়ি।

হঠাৎ ছেলেরা চঞ্চল হয়ে উঠলো। ঘোড়াগুলোকে খুলে দিলে তারা। তাদের উপাস্যকে তারা নিজেরা বহন করবে। স্বামিজীকে তারা মাথায় তুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। তাদের অন্তরের উৎস আজ অবারিত।–জয়, স্বামী বিবেকানন্দ কী জয়।

শেয়ালদা স্টেশনের বাইরে সেই উল্লাসধ্বনিতে সমস্ত শহর প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে গাড়ি গিয়ে হাজির হলো একটা গলির সামনে। রিপন কলেজের ভেতর স্বামিজীকে কিছু বলতে হবে। অন্তত একটু বিশ্রাম। তারা সবাই দু’চোখ ভরে দেখবে।

মনে হলো, হঠাৎ যেন ব্ৰজরাখালকে দেখা গেল এক মুহূর্তের জন্যে। তাড়াতাড়ি ভূতনাথ ভিড় সরিয়ে কাছে যাবার চেষ্টা করতেই আবার কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল ব্রজরাখাল। এ-দিক ও-দিক কোথাও দেখা পাওয়া গেল না তাকে।

কিন্তু হঠাৎ এক আশ্চর্য উপায়ে দেখা হয়ে গেল আর একজনের সঙ্গে। আবার এতদিন পরে এমন ভাবে দেখা হবে ভাবা যায়নি।

ননীলাল! ননীলালও চিনে ফেলেছে। বললে—তুই? তুই এখেনে?

প্রথমটা যেন বিশ্বাস হয় না। সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। কী এক অদ্ভুত চেতনা। ননীলালের সে চেহারা আর নেই। সেই কেষ্টগঞ্জের স্কুলের সহপাঠী, ডাক্তারবাবুর ছেলে ননীলাল। এর দেখা পাওয়ার জন্যে কী কষ্টই না একদিন স্বীকার করেছে ভূতনাথ। ননীলাল সিগারেট টানছে। ছোটবড় চুল। গোফ দাড়ি উঠেছে।

—তারপর?

—এখানে কী করতে? স্বামিজীকে দেখতে?

—দূর, ও-সব দেখবার সময় নেই আমার। বলে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লে লম্বা করে। তারপর বললে—যত সব বুজরুক—

একটা প্রচণ্ড আঘাত লাগলো ননীলালের কথায়। কিন্তু কিছু বলতে পারলে না। তারপর জিজ্ঞেস করলে—কী করছিস এখন?

—বি-এ পাশ করেছি। এবার ল’ পড়ছি—তুই?

—আমার পড়াশোনা হলো না, পিসীমা মারা গেল। এখানে আমার ভগ্নীপতি থাকে। তার কাছেই আছি, একটা ভালো চাকরি পেলে করি, ঘোরাঘুরি করছি।

—চল, চা খাস?

–না, এখনও ধরিনি।

—এখনও পাড়াগেঁয়েই রয়ে গেলি-বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে চললল ননীলাল। ননীলালের গা থেকে এসেন্সের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। সুন্দর জামাকাপড় পরেছে। ননীলালের কাছে নিজেকে যেন বড় বেশি দরিদ্র মনে হলো আজ। কিন্তু কেন কে জানে, ভূতনাথের মনে হলো—ননীলাল যেন আর আগেকার মতন নেই। সেই আগেকার ননীলালই যেন ছিলো ভালো। এখন যেন চোখে কালি পড়েছে। চোখের সে জ্যোতি কোথায় গেল তার। যেন অনেক ‘বয়স বেড়ে গিয়েছে তার এই ক’বছরের মধ্যেই।

—চা না খাস তো অন্য কিছু খা।

একটা দোকানের সামনে এসে ভূতনাথকে নিয়ে ঢুকলো ভেতরে।

—ডিম খাস?

—হাঁসের ডিম তো।

-কলকাতা শহরে এসে এখনও তোর বামনাই গেল না-ইয়ং বেঙ্গল আমরা, এই করে করে দেশটা গেল, গায়ে শক্তি হবে কী করে? বিফ খায় বলেই তো সাহেবরা অত দূর দেশ থেকে এদেশে এসে রাজত্ব করতে পেরেছে—আর তোরা পৈতে টিকি নিয়ে তাদের গোলামি করে মরছিস, ছাড় ও-সব, আমার সঙ্গে দু’দিন থাক, মানুষ করে দেবো তোকে-তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে আর একটা সিগারেট ধরালে ননীলাল। বললে—আছিস কোথায় বললি?

—বৌবাজারে, বড়বাড়িতে।

—চৌধুরীদের বাড়ি? তা ওদের ওখানে আছিস, ওরা তো জমিদার, শুনেছি ও-বাড়ির বোঁগুলো খুব সুন্দরী, না?

—তুই জানলি কেমন করে? কেমন একটা রহস্যময় হাসি হাসলো ননী। বললে—রূপ আর গুণ কখনও চাপা থাকে রে?

কী জানি কেন, ভূতনাথের মনে হলো—সেই ননীলালের এমন পরিবর্তন হওয়া উচিত হয়নি যেন।

ননী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আরম্ভ করলে—চূড়ামণিকে চিনিস, যার ডাক নাম ছুটুক? ওই তো আমার ক্লাশ ফ্রেণ্ড ছিল রে। দু’বার ফেল করে এখন সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ছে— বাড়ির ঝি-টি কাউকে আর বাদ দেয়নি। শেষে একদিন অসুখ হলো, কিন্তু মিথ্যে বলবো না ভাই, বহু টাকা খরচ করেছে আমাদের জন্যে—এখন দেখা হয় না বটে, কিন্তু রোগ হবার পর থেকে…রোগটা সেরেছে?

রোগ? ভূতনাথ কিছু বুঝতে পারলে না।—জিজ্ঞেস করলে কী রোগ?

ননীলালের মুখে রোগের নামটা শুনে শিউরে উঠলো ভূতনাথ। ননীলাল কেমন বেপরোয়াভাবে রোগের নাম উচ্চারণ করে গেল, যেন ম্যালেরিয়া কিম্বা ইনফ্লুয়েঞ্জা। ও-রোগ ভদ্রলোকদের হয় ভূতনাথের জানা ছিল না।

ননীলাল সিগারেট ফুকতে ফুকতে বললে হবে না রোগ? চেহারাটা দেখছিস তো—আগে আরো লাল টুকটুকে ছিল, ক্লাশে বসে আমরা ওর গাল টিপে দিতুম, তা আজকাল কত রকম ওষুধ বেরোচ্ছে, ডাক্তার-ফাক্তার কাউকে দেখালে না, একদিন সারা গায়ে দাগড়া দাগড়া দাগ বেরোলো—শেষে একদিন আর হাঁটতে পারে না। আর একটু মাংস নিবি?

—না।

—তা সেই অসুখের সময় গিয়েছিলুম ওদের বাড়িতে। অনেক চেষ্টা করেছিলুম ভাই দেখতে—কিন্তু এমন আঁটা বাড়ি, কিছছু দেখা গেল না, যারা ঘন ঘন যেতো, তারা বলতো-ওর কাকীদের নাকি পরীর মতন দেখতে—দেখেছিস তুই?

ভূতনাথ উত্তরটা এড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে বললে-দেখেছি, পরীদের মতো তো নয়।

—পরীদের মতো নয়, তবে কীসের মতন? ভূতনাথ যেন কী ভাবলে। তারপর বললে–জগদ্ধাত্রীর মতন।

ননীলাল হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—তুই আবার এত ভক্ত হয়ে উঠলি কবে?..

ভূতনাথ বললে—পরী তো দেখিনি কখনও, জগদ্ধাত্রী দেখেছি যে।

—জগদ্ধাত্রী কোথায় দেখলি?

—কেন, ছবিতে।

—পরীর ছবি দেখিসনি?

পরীর ছবি কোথাও দেখেছে কিনা ভাবতে লাগলো ভূতনাথ।

ননীলাল বললে—পরী যদি দেখতে চাস, তো দেখাবো তোকে—আমার বিন্দী যাকে বলে ডানাকাটা পরী।

—বিন্দী কে?

—আজ বিন্দীর বাড়ি যাবি? চল তোকে পরী দেখিয়ে নিয়ে আসি। ছুটুক ওকে দেখে একরাতে পাঁচ শ’ টাকা খরচ করে ফেলেছিল—শেষে বিন্দী ওরই মুঠোর মধ্যে চলে যেতো, কিন্তু আমার বাবাও তখন তিপ্পান্ন হাজার টাকা রেখে মারা গিয়েছেআমাকে পায় কে?

—বাবা মারা গিয়েছেন তোর?

বাবার মৃত্যুর সংবাদ এমন করে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতে কেউ পারে, এ-যেন ভূতনাথ বিশ্বাস করতে পারে না।

–বাবা মারা গিয়েছে বলেই তো বেঁচে গেলুম ভাই, নইলে কি ছুটুকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি পারি? ওরা কি কম বড়লোক। ওরা হলো সুখচরের জমিদার বংশ, প্রজা ঠেঙানো পয়সা, এখানে বসে কর্তারা শুধু মেয়েমানুষ নিয়ে ওড়ায়—ওদের সঙ্গে তুলন? ছোটবেলায় ওর কাকীমা’র পুতুলের বিয়েতে কত নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছি, তা এখন শুনতে পাই চূড়ামণি নাকি বাড়িতেই আচ্ছা বসিয়েছে, গান-বাজনা নিয়ে থাকে, আর একটু একটু মালটাল খায়, কিন্তু রক্তের দোষ ওদের যাবে কোথায়, তোকে বলে রাখছি ভূত, তুই দেখে নিস, চূড়ামণির ও অভ্যেস-দোষ যাবে না, অমৃতে কখনও অরুচি হয় ভাই?

আরো অনেক কথা বলতে লাগলো ননীলাল। ননীলাল তত আগে এমন কথা বলতো না। বিশেষ মুখচোরা লাজুক ছেলে ছিল। কেমন করে এমন হলো কে জানে!

ননীলাল আবার বলতে লাগলো—তা আমার এখন একটা নেশা আছে ভাই, তোকে বলেই ফেলি, একটা বেশ বড়লোক গোছের লোকের মেয়েকে যদি বিয়ে করে ফেলতে পারি, তত আর কাউকে ভয় করি না আমি। বাবার টাকাগুলো সব ফুরিয়ে এল কিনা-ও-পাড়ার দিকে আছে কোনো সন্ধান?

সেদিন যতক্ষণ ননীলালের সঙ্গে গল্প করেছিল ভূতনাথ, ততক্ষণই কেবল অবাক হয়ে ভেবেছিল। কই ব্রজরাখালও তো রয়েছে। এখানে। স্বামী বিবেকানন্দর চার ঘোড়ার গাড়ি যারা কাধে করে টেনে নিয়ে গেল, যারা গলা ফাটিয়ে ‘বিবেকানন্দ স্বামিজী কী জয়’ বলে চিৎকার করলো, যারা ভোরের শীত উপেক্ষা করে শেয়ালদা’ স্টেশনে মহাপুরুষকে দেখবার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে, তারা তবে কারা? তারাও কি বাঙলা দেশের ছেলে? কলকাতার ছেলে? তারাও কি ননীলালের ক্লাশ ফ্রেণ্ড? তারা কি তবে ছুটুকবাবু কিম্বা ননীলালের মতন নয়? তাদের জাত কি আলাদা?

যাবার সময় ননীলাল বললে-সন্ধ্যে বেলা হেদোর ধারে দাঁড়িয়ে থাকবে, ঠিক আসিস—বিন্দীর বাড়ি যাবো বুঝলি? আর ছুটুককে যেন আমার কথা বলিসনি।

ভূতনাথ বললে—কেন?

-পরে বলবো তোকে—এখন আবার ক্লাশ আছে আমার।

কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, যার হাতের ছোঁয়া লাগলে একদিন ভূতনাথের শরীরে রোমাঞ্চ হতো, যাকে দেখবার জন্যে ছুটির দিনেও কত ছুতো করে সাত মাইল হেঁটে গিয়েছে ইস্কুল পর্যন্ত,

সেই ননীলাল!

বাড়িতে গিয়ে ভূতনাথ নিজের বাক্সটা খুললে। অনেক পুরোনো জিনিষ জমে আছে ভেতরে। পিসীমা’র হরিনামের মালা একটা। পুরোনো মনি-অর্ডারের রসিদ কয়েকটা। দেশের বাড়ির সদর দরজার চাবি, তারই মধ্যে থেকে একটা চিঠি বেরোলো। বহুদিন আগের ননীলালের লেখা। সেখানা খুলে ভূতনাথ আবার পড়তে লাগলো।

“প্রিয় ভূতনাথ,

আমরা গত শনিবার দিন এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছি। কলিকাতা বেশ বড় দেশ, কী যে চমৎকার দেশ বলিতে পারিব না। এখানে আসিয়া অবধি বাবার সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। বড় বড় বাড়ি আর বড় বড় রাস্তা। খুব আনন্দ করিতেছি। তোমাদের কথা মনে পড়ে। তুমি কেমন আছো জানাইও, উপরের ঠিকানায় চিঠি দিও”।

পড়তে পড়তে সেদিনকার ননীলালের সঙ্গে আজকের দেখা ননীলালের তুলনা করে দেখলে ভূতনাথ। কিন্তু কেন এমন হলো। একবার মনে হলো দরকার নেই, চিঠিটা ছিঁড়েই ফেলে। কিন্তু আবার বাক্সের ভেতরে রেখে দিলে সে। থাক। সে-ননীলাল হয় তত সত্যিই মরে গিয়েছে। কিন্তু শৈশবের সে ননীলালের স্মৃতি যেন অক্ষয় হয়ে থাকে সারাজীবন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress