Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সারান্ডায় শয়তান || Suchitra Bhattacharya » Page 2

সারান্ডায় শয়তান || Suchitra Bhattacharya

০২. কালই ভোরে রওনা

আপনারা কি কালই ভোরে রওনা দিচ্ছেন?

ইচ্ছে তো সেরকমই ছিল। কিন্তু বুকিং পেলাম না যে। কাল পরশু দুদিনই থলকোবাদ ফুল। এটাও রুম খালি নেই।

হুম। এই সময়টায় জঙ্গলে একটু ভিড় থাকে বটে। শীতকালেও লোকজন হয়, তবে এতটা নয়। এখন তো ছেলেমেয়েদের সব পরীক্ষা শেষ, তাই খুব টুরিস্ট আসছে।

আপনার হোটেলও তো ভর্তি?

পুরা ভর্তি। আপনারা আর একটু লেট করে এলে জায়গা দিতে পারতাম না।

শ্ৰীকৃষ্ণ হোটেলের দোতলার বারান্দায় বসে হোটেল-মালিকের সঙ্গে কথা বলছিল পার্থ। এখন বসে বসে গল্প করা ছাড়া উপায়ও নেই। ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বাজ পড়ছে কড়াত কড়াত, বিদ্যুতের চমকে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে আকাশ। হাওয়াও বইছে জোর, অনেকটা ঝড়ের মতো। ভাগ্যিস বারান্দাটা ঢাকা, নইলে এখানে বসা যেত না।

টুপুরেরও ঘরে মন টিকছিল না। সেও এসে বসেছে বারান্দায়। মেজাজটা তার টকে গেছে। ভেবেছিল আজ বিকেল সন্ধেটা চাইবাসার রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে মিতিনমাসির সঙ্গে। বৃষ্টি সব মাটি করে দিল!

হোটেল-মালিকটা বাঙালি। নাম অনন্ত চ্যাটার্জি। বাঙালি বোর্ডার দেখে নিজে থেকেই আলাপ জমাতে এসেছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন পার্থদের। অনন্তর কথায় সামান্য পশ্চিমি টান আছে। সম্ভবত দীর্ঘকাল চাইবাসায় থাকার কারণেই।

টুপুররা চাইবাসা পৌঁছেছে বিকেলবেলায়। জামশেদপুর থেকে সাড়ে বারোটা নাগাদ খেয়েদেয়ে রওনা দিয়েছিল। মাত্ৰ পয়ষট্টি কিলোমিটার রাস্তা, ভেবেছিল গাড়িতে ঘন্টা দেড়-দুই লাগবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়ল প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি। গোটা পথটাই বেজায় খারাপ, খানাখন্দে ভরা। সামলেসুমলে চলেও একবার টায়ার পাংচার হল। গোদের ওপর বিষফোড়া, বুমবুম বারতিনেক বমি করল গাড়িতে। সকাল থেকে চিপস চিবিয়েছে, জামশেদপুরে নেমে একটা কোল্ডড্রিংকসও খেয়েছিল, জোর করে তাকে খানিকটা ভাতও গেলানো হয়েছিল হোটেলে। দফায় দফায় সব উগরে দিল বুমবুম। গোটা পথ নেতিয়ে পড়ে রইল মা মাসির কোলে। একে গাড়ির ঝাঁকুনি তে সকলেরই কোমরের বল-বেয়ারিং খুলে যাওয়ার দশা, তার সঙ্গে অসুস্থ বাচ্চা, চাইবাসায় এসে হোটেল খোঁজাখুঁজির ঝকমারিতে আর যায়নি কেউ। বড় রাস্তার ওপর শ্ৰীকৃষ্ণ হোটেলের হোর্ডিং দেখেই ঢুকে পড়েছে তৎক্ষণাৎ।

এখন অবশ্য দেখছে হোটেলটা মন্দ নয়। অনন্তবাবুর হোটেলে দিব্যি একটা ঘরোয়া পরিবেশ আছে। রুমগুলোও বেশ পরিচ্ছন্ন। জনা তিন-চার কর্মচারী সর্বক্ষণ ছোটাছুটি করছে ঘরে ঘরে। শুধু এই বৃষ্টিটুকু না এলে টুপুরের আর কোনও আফসোস ছিল না। সারাটা পথ ঝকঝক করছিল রোদ্দুর, রাস্তায় চাকা বদলানোর সময়ে গা হাত পা তো ঝলসে যাচ্ছিল, হঠাৎ চাইবাসাতেই যে কোত্থেকে অনাসৃষ্টি মেঘটা এল?

পাহাড়ি জায়গায় অবশ্য এরকম হয়, টুপুর জানে। গত বছর ক্লাস সেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর এই সময়টাতেই গ্যাংটক বেড়াতে গিয়েছিল তারা। সেখানেও এরকম হঠাৎ বৃষ্টি, হঠাৎ রোদ্দুর। তবে চাইবাসার পাহাড় আর হিমালয় কি এক? না কি সব পাহাড়েরই এক নিয়ম? সে কী বা ছোট, কী বা বড়!

পাৰ্থ সিগারেট আনতে ঘরে উঠে গিয়েছিল। ফিরে এসে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিল অনন্তবাবুকে। অনন্ত হাতজোড় করে বললেন, ধন্যবাদ। আমার চলে না।

খুব ভাল করেছেন, বাজে নেশাটা করেননি। বলতে বলতে পার্থ ধরিয়েছে সিগারেট। বারান্দায় খানচারেক বেতের সোফা, মধ্যিখানে কাচের টেবিল। টিউবের আলোয় ঝলমল করছে জায়গাটা। যেন মিনি লাউঞ্জ। কয়েকটা বাঁধানো ছবিও ঝুলছে দেওয়ালে। পাহাড় জঙ্গল জলপ্রপাত…

একটা ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে পার্থ বলল, ওটা কোন ফলস?

হুড্রু।

রাঁচির?

হ্যাঁ। বর্ষাকালে তোলা তো, জল উপচে পড়ছে।

এদিকে কাছেপিঠে কোনও ফল্‌স নেই?

হুড্রুর মতো নেই। তবে আছে। হিরনি ফল্‌স। কাল পরশু তো ফ্রি আছেন আপনারা, ওখান থেকে ঘুরে আসুন না।

টুপুরের মনটা নেচে উঠল। জিজ্ঞেস করল, হিরনি ফলস এখান থেকে কদ্দুর।

কত আর, চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার হবে। বাস যায়, গাড়ি ভি যায়।

মিতিন বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, রুটটা আমি জানি। হেসাডি বলে একটা আদিবাসীদের গ্রাম আছে, সেখানে নেমে দুতিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়।

বিলকুল ঠিক। কাল সারাদিন ওখানেই তবে আউটিং করে আসুন। যদি বলেন তো লাঞ্চও প্যাক করে দিতে পারি।

এখানে কী কী দেখার আছে?

চাইবাসা ছোট টাউন, এখানে আর কী দেখবেন। অনন্ত মৃদু হাসলেন, কয়েকটা বড় বড় তালাও আছে…এখানে তালাওকে বলে বাঁধ। রানিবাঁধ, শিববাঁধ, মধুবাঁধ…। আপার চাইবাসাও সুন্দর। মাঠ বাগান গভর্নমেন্ট বাংলো… হ্যাঁ, মুংগালাল রুংটা গার্ডেন কিন্তু জরুর দেখবেন।

কাল হিরনি ফলস ঘুরে এসে এত সব দেখা যাবে?

জলদি জলদি ফিরলে দেখতে পাবেন। অনন্ত ফের হাসলেন, তাড়াহুড়োর কী দরকার, আপনারা তো পরশু দিনটাও আছেন।

মিতিন ঠোঁট টিপে বলল, আমার একটু অন্যরকম প্ল্যান ছিল। চাইবাসা থেকে সারান্ডা তো প্রায় সওয়াশো কিলোমিটার পথ, আপনাদের এখানে রাস্তার হালও তো খুব সুবিধের নয়, তাই ভাবছিলাম জার্নির গোটা ধকলটা এক দিনে না নিয়ে যদি পরশু সকালে বেরিয়ে পড়ি, এবং রাতে মেঘাতুবুরুতে থেকে যাই..

পার্থ ভুরু কুঁচকোল, হঠাৎ মেঘাতুবুরুতে হল্ট করার শখ জাগল যে? মুকুলবাবুর ভূত ঘাড়ে চাপল নাকি?

মোটেই না। আমি কলকাতা থেকেই ভেবে রেখেছিলাম চান্স পেলে একটা রাত অন্তত মেঘাতুবুরুতে থাকব। ওখানে চমৎকার একটা সানসেট পয়েন্ট আছে। তা ছাড়া মেঘাতুবুরু থেকে গোটা সারান্ডা রেঞ্জটাকেই নাকি ছবির মতো দেখা যায়।

আপনার আইডিয়াটা খারাপ নয় ম্যাডাম। অনন্ত সমর্থন জানালেন মিতিনকে, মেঘাতুবুরু থেকে বরং পরদিন সকালে টুক করে জঙ্গলে ঢুকে পড়বেন।

পার্থ আর গাঁইগুই করল না। উঠে পড়েছে কাঁধ ঝাঁকিয়ে। অলস পায়ে চলে গেল সহেলিদের ঘরে। অ্যাম্বাসাডরের ঝাঁকুনিতে সহেলির কোমরে একটা খটকা লেগেছে, তিনি এখন পেনকিলার খেয়ে শায়িত। অবনী ঘোরাঘুরি করছেন আমাজনের পাড়ে।

বৃষ্টি এখনও থামেনি। বজ্রবিদ্যুতের প্রকোপ কমেছে, তবে ধারাবৰ্ষণ চলছে একই দাপটে। টুপুর ছোট্ট একটা হাই তুলে বলল, তুৎ, কিছু করার নেই এখন। যাই, আমিও শুয়ে পড়ি গিয়ে।

অনন্ত হা হা হেসে উঠলেন, মনখারাপ করছ কেন? দ্যাখো না, বৃষ্টি ধরল বলে। তারপরই আকাশ একদম ঝকঝক করবে।

অসম্ভব। এই বৃষ্টি সারারাতেও থামার নয়।

আর আধা ঘণ্টা দ্যাখো। এখানকার বৃষ্টির নেচারটাই আলাদা। চৈত্র মাসটায় প্রায়ই এরকম হয়। বিশেষ করে দিনের বেলা যদি বেশি গরম থাকে।

মিতিন টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে ওলটাচ্ছিল। রেখে দিয়ে বলল, আপনি এখানে কতদিন আছেন অনন্তবাবু?

জন্ম থেকে।

আপনাদের বরাবরই হোটেলের ব্যবসা?

না। আমাদের ফ্যামিলি বিজনেস আলাদা। বাপ-ঠাকুরদাদার ফার্নিচারের বিজনেস ছিল, আমিই বিপথে এসেছি।

কেন?

রাঁচি থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ করেছিলাম। বিদ্যেটা কাজে লাগানোর সাধ হল, বাবাও কিছু টাকা দিলেন, আমিও নেমে গেলাম নতুন ধান্দায়। ফার্নিচারের দোকান অবশ্য আছে এখনও। ফরেস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে যেখানে বড় রাস্তায় পড়লেন, ওই চকটায়।

তার মানে আপনারা এখানে কয়েক পুরুষের বাসিন্দা?

তিন পুরুষের। আমার ঠাকুরদাদা চলে এসেছিলেন কলকাতা থেকে। নোকরি করতেন গুয়ায়। আয়রন মাইনে। একবার এক লালমুখো সাহেবের সঙ্গে কী ঝগড়া হয়েছিল, নোকরি ছেড়ে দিয়ে সোজা এসে উঠলেন চাইবাসায়। লেখাপড়ায় খুব ইন্টারেস্ট ছিল ঠাকুরদাদার, এখানে একটা স্কুল বানিয়েছিলেন। চাইবাসায় তো বহু বাঙালি আছে, তাদের জন্য বাংলা মিডিয়াম স্কুল। এখন অবশ্য স্কুলটা গভর্নমেন্ট নিয়ে নিয়েছে।

মিতিন শেষ কথাগুলো যেন শুনল না। বলল, আপনি যখন জন্ম থেকেই এখানে, তখন নিশ্চয়ই এদিককার পুরনো লোকজনদের সব চেনেন?

জরুর।

পুরুষোত্তম সিংহকে চেনেন?

জামদার সিংহ? ভালই চিনি। বছর চল্লিশের গাঁট্টাগোট্টা চেহারার অনন্তর চোখে কৌতূহল, আপনি পুরুষোত্তম সিংহকে চিনলেন কী করে?

ট্রেনে আসতে আসতে ওঁর এক ছেলের সঙ্গে পরিচয় হল। মুকুল সিংহ।

ও। এই মুকুলের কথাই বলছিলেন আপনার হাজব্যান্ড?

হ্যাঁ। মুকুলবাবুর মুখে শুনছিলাম ওঁর বাবা নাকি এখানকার খুব নামী ব্যবসায়ী।

শুধু ব্যবসায়ী? পুরুষোত্তম সিংহ একটি ক্যারেক্টার ম্যাডাম। নামেও সিংহ, কাজেও সিংহ। এখন বয়স হয়ে জোশ কমেছে, কিন্তু এককালে কত যে খুন-জখম করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। যার সঙ্গে বনল না তাকেই ফটাস। লাশ ভি হাপিস। আস্ত মানুষটাই নাকি বেমালুম ভ্যানিশ করে যেত, বাবা ঠাকুরদাদার মুখে শুনেছি।

তাই বুঝি? তা মুকুলবাবুকে তো মোটামুটি নিরীহই মনে হল।

মুকুল সিংহ তো রাবণের বেটা রামচরণ।

মানে?

বাপের একেবারে উলটো। অযোগ্য। অপদার্থ। না-লায়েক। ছোটবেলায় একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছিলেন মুকুলবাবু, পুরুষোত্তম সিংহ তাঁকে পাটনা থেকে ধরে আনেন। লেখাপড়াতেও তেমন মাথা ছিল না। বাপ হয়রান হয়ে ছেলেকে পাঠিয়ে দেন খড়্গপুরে, এক বোনের বাড়িতে। সেখানেই মানুষ হয়েছেন মুকুলবাবু। তবে ওঁর ছোট ভাইটা বহুত সেয়ানা। বিলকুল বাপ কা বেটা। চাইবাসাতেই হস্টেলে থেকে পড়ত বিকাশ, আমার থেকে এক ক্লাস জুনিয়ার ছিল। তখন থেকেই তো দেখেছি, মাথা খুব সাফ। বহুত সাহস ভি আছে বিকাশের। এখন দশ হাতে বাপের বিজনেস বাড়াচ্ছে।

তা দাদা বিজনেসে নেই কেন? ছোট ভাই কি দাদাকে আউট করেছে?

না ম্যাডাম। মুকুলবাবুর বিজনেস করার ক্ষমতাই নেই। খুন এক হলেও সব ভাই কি এক টাইপের হয়? যে বেশি কাবিল, সেই ব্যবসা সামলাবে, এটাই তো দুনিয়ার নিয়ম। তা ছাড়া মুকুলবাবুর আরও কিছু প্রবলেম আছে।

কী প্রবলেম?

অনন্ত কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন, আরে ছাড়ুন ম্যাডাম। সবাই আমরা এক মুলুকের লোক, কী হবে মিছিমিছি নিন্দে করে। কোথায় কী উড়ো কথা শুনলাম তাই দিয়ে একজনের বদনাম করা ঠিক হবে না।

কেন, কী শুনেছেন?

বললাম তো, ছাড়ুন। অনন্ত উঠতে উঠতে টুপুরকে বললেন, এই যে মেয়ে, দ্যাখো বাইরে বৃষ্টি থেমে গেছে কি না।

বারান্দার ঘেরাটোপ তুলে দিয়ে টুপুর হাঁ। কোথায় বৃষ্টি, আকাশে দিব্যি তারা ফুটে গেছে। উত্তরে একটু একটু বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বটে, তবে তা অনেক দূরে, আকাশের একেবারে শেষ প্রান্তে।

টুপুর প্রায় নেচে উঠল, মিতিনমাসি, এখন বেরোবে?

অনন্ত বললেন, যান না, ঘুরে আসুন। চাইবাসা বহুৎ পিসফুল জায়গা। সবে সাড়ে সাতটা বাজে, আরামসে নটা-দশটা অবধি বেড়াতে পারবেন।

অনন্ত চলে যাওয়ার পরও মিতিন বসে আছে চুপটি করে। টুপুর ঠেলল তাকে, কী গো, চলো।

মিতিন অন্যমনস্কভাবে বলল, হুঁ, যাই। ঘরে গিয়ে দ্যাখ তোর বাবা-মা বেরোবে কি না।

নগর পরিক্রমার নাম শুনেই সহেলির কোমরের ব্যথা উধাও। অবনী বেরোলেন না, বুমবুম ঘুমাচ্ছে অকাতরে, পার্থ তার কাছে একা থাকে কেন! বরং টুপুররা ঘুরতে গেলে দুই ভায়রাভাই মনের সুখে দাবা খেলতে পারবে।

বাইরেটা এখন ভারী মনোরম। ঝড়বৃষ্টি এসে দিনের উত্তাপটাকে যেন শুষে নিয়ে গেছে। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। বসন্তের হাওয়া, কিন্তু ভেজা ভেজা, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। শরীর জুড়িয়ে যায়। আকাশে চাঁদও উঠেছে। আধখানা চাঁদ। আর দিনসাতেক পরেই পূর্ণিমা।

বড় রাস্তা ধরে হাঁটছিল টুপুররা। খানিক উত্তরে যেতেই এক জমজমাট জায়গা। সার সার অ্যাম্বাসাডর আর জিপ দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়ার গাড়ি। কালকের হিরনি যাওয়া নিয়ে বেশ কয়েকজন জিপের ড্রাইভারের সঙ্গে দরকষাকষি করল মিতিন। শেষমেশ বয়স্ক একজনকে পছন্দ হল, তাকেই গাড়ি নিয়ে সকাল নটা নাগাদ চলে আসতে বলল শ্ৰীকৃষ্ণ হোটেলে। তারপর সোজা বাজার। কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার সময় তাড়াহুড়োতে অনেক কিছু নেওয়া হয়নি, মনে করে করে জিনিসগুলো কিনল মিতিন। মোমবাতি, দেশলাই, দড়ি, ব্লেড, ব্যাটারি, মশা তাড়ানোর ধূপ, ডেটল, ব্যান্ড-এড আর কয়েকটা ওষুধ। বুমবুমের জন্য কালার বুকও নিল একটা, সঙ্গে এক বাক্স রংপেনসিল। পাহাড় জঙ্গল দেখে যদি বুমবুমের ছবি আঁকার সাধ জাগে। ক্যামেরার ফিল্ম কিনল তিন রোল। পার্থ ভরবে ক্যামেরায়।

সহেলি বললেন, চল, এবার একটু শাড়ি-জামার দোকানে যাই।

মিতিন আকাশ থেকে পড়ল, কেন? শাড়ি জামা শর্ট আছে?

আহা, চাইবাসার কিছু স্মৃতি নিয়ে যেতে হবে না?

টুপুর হাসতে হাসতে বলল, মা যেখানেই বেড়াতে যায়, সেখানকার শাড়ি কেনে। কটকে গেলে কট্‌কি, বাঙ্গালোর গেলে বাঙ্গালোর সিল্ক, তামিলনাড়ুতে কাঞ্জিভরম…

মিতিন হেসে কুটিপাটি, এখানে তুই চাইবাসার সিল্ক খুঁজবি নাকি বড়দি? ওরকম কিছু কিন্তু পাওয়া যায় না।

বোন আর মেয়ের হাসিও পুরোপুরি নিরস্ত করতে পারল না সহেলিকে। তিনি ঘুরে ঘুরে স্থানীয় হাতের কাজ কিনলেন কিছু। আদিবাসীদের হাতে তৈরি কাঠের পুতুল, ছোট ছোট মুখোশ…। কলকাতা গিয়ে একে-তাকে উপহার দিতে হবে তো! প্রায় প্রতিটি বস্তুই কলকাতায় পাওয়া যায়, চাইবাসার থেকে শস্তাও, তবুও।

ফেরার পথে একটা সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেল টুপুররা। কলকাতার মতো স্বাদ নয়, তবু মন্দ কী।

হোটেলে এসে টুপুররা দেখল পার্থ আর অবনী তখনও দাবাযুদ্ধে মত্ত। বুমবুম উঠে পড়েছে, সে এখন লাউঞ্জের মতো জায়গাটায় বসে গল্প করছে হোটেলের এক কর্মচারীর সঙ্গে। লোকটা আদিবাসী, বছর আটাশ-তিরিশ বয়স। গোল মুখ, গায়ের রং চকচকে কালো, চোখের মণি দুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। টুপুররা হোটেলে পা রাখার পর থেকেই লোকটা সর্বক্ষণ হাসিমুখে ফাইফরমাশ খাটছিল টুপুরদের। নামটাও বেশ মিষ্টি। ধানুয়া। সে কথা বলে ভাঙা ভাঙা বাংলায়। তবে বুমবুমের সঙ্গে গল্প করতে তার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। কারণ সে শুধু শুনে যাচ্ছে, বুমবুমই বকছে একতরফা।

টুপুরদের দেখেই বুমবুম বলে উঠল, জানো, ধানুয়াটা কী বোকা! কীসব বলছিল!

মিতিন কড়া গলায় ধমক দিল, ও কী ভাষা বুমবুম? ধানুয়া তোমার থেকে বড় না? ধানুয়াদাদা বলো। আর বোকা বলছ কেন? কত করে না শিখিয়েছি, বড়দের বোকা বলতে নেই!

বুমবুম কাঁচুমাচু মুখে বলল, সরি মা। আর বলব না।

মিতিন সামান্য প্রীত হল। জিজ্ঞেস করল, কী বলছিল ধানুয়াদাদা?

ওদের গ্রামে নাকি একটা সাধু এসেছে। সাধুবাবা নাকি যাতেই হাত দেয় সেটাই মিষ্টি হয়ে যায়।

টুপুর বলল, ওমা, সে আবার কী?

রুপোর মতো সাদা দাঁত বার করে হাসল ধানুয়া, হাঁ দিদি। মধুবাবা যাতে হাত দিবেন, সেইটাই মিঠা বনে যাবেন।

মানে?

ধরো পানিতে হাত দিল, পানি মিঠা। তিতা ধরল, তো তিতা মিঠা বনে গেল।

বুঝলাম না।

আমি বুঝেছি। মিতিন বলল, ওদের গ্রামে একজন সাধুবাবা এসেছেন, তিনি যাতেই হাত ছোঁয়াচ্ছেন সেটাই মিষ্টি হয়ে যাচ্ছে। কী ধানুয়া, ঠিক বলেছি?

ধানুয়া মাথা দুলিয়ে বলল, সাধুবাবা না দিদি, মধুবাবা।

বেশ। নয় মধুবাবাই হল। তা এই মধুবাবা এসেছেন কোত্থেকে?

জানি না দিদি। কেউ বলে হিমালয় থেকে, কেউ বলে সাগর থেকে। মধুবাবার ছুঁয়ে দেওয়া মিঠা পানিতে সবার সব বিমারি সেরে যাচ্ছে।

টুপুর অবিশ্বাসের সুরে বলল, তুৎ, যতসব গাঁজাখুরি গল্প।

ওভাবে বলতে নেই টুপুর। সহেলি চোখ পাকালেন, সাধু-সন্ন্যাসীদের কতরকম অলৌকিক শক্তি থাকে তুমি জানো? ওই শক্তি তাঁরা পান যোগবলে। কঠোর তপস্যা করে।

যোগবলটা কী মা? টুপুর ফিক করে হাসল, ফুটবলের মতো কিছু?

ফাজলামি কোরো না। সাধুসন্ন্যাসীদের নিয়ে ঠাট্টা করলে পাপ হয়।

টুপুর ফের কিছু বলতে যাচ্ছিল, মিতিন হাত তুলে থামাল তাকে। ধানুয়াকে প্রশ্ন করল, তোমার গ্রামটা কোথায়?

করমপদা।

সেটা কোথায়?

মেঘাতুবুরুর পরে। জঙ্গলে। আপনারা তো থলকোবাদ যাচ্ছেন, ওই পথেই পড়বে।

তাই নাকি? থলকোবাদ থেকে করমপদা কত দূর?

বেশি নয় দিদি, মাত্র আট মাইল। রোজ কত দূর দূর থেকে লোক আসছে সেখানে। মধুবাবাকে দেখতে।

সহেলি বললেন, আমরাও তো তা হলে একবার করমপদা ঘুরে যেতে পারি। কত অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি করলাম, হাঁটুর ব্যথা তো পুরোপুরি সারছে না। যদি মধুবাবার কৃপায়…

মিতিন বলল, যাওয়াই যায়।

টুপুর অবাক চোখে তাকাল, মিতিনমাসি, তুমিও এসব বিশ্বাস করো?

হালকা হাসল মিতিন, আহা, একটা নতুন অভিজ্ঞতা তো হবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *