Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বিরাজবাবু আমার বাবার বন্ধু

বিরাজবাবু আমার বাবার বন্ধু। আমরা বলি বিরাজকাকু। একসময় দুজনে একইসঙ্গে থিয়েটার করতেন। বাবাও তখন অ্যামেচার। বাবা অভিনয়কে পেশা করে নিলেন। বিরাজকাকু একটা চাকরি পেয়ে অভিনয়ের জগৎ থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেলেন। বাবার সঙ্গে মায়ের প্রেম, বিয়ে সব কিছুর পেছনে বিরাজকাকুর হাত ছিল। বিয়ের পরেও বেশ কয়েক বছর বাবার সঙ্গে বিরাজকাকুর অন্তরঙ্গতা ছিল। তারপরই বাবা পেশাদারি অভিনয়ের জগতে যত খ্যাতি পেতে শুরু করলেন ততই তিনি সংসার থেকে, সমাজ থেকে, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন।

বিরাজকাকু বলেন, আমি লাইন দিয়ে বেবি ফুড কিনে এনে তোর দুধ খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ঘাড়ে করে চাইল স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে গেছি। আমিই তোর রিয়েল ফাদার।

মানুষটি বড় ভালো। মাঝে-মাঝে মনে হয় মা কেন বিরাজকাকুকে বিয়ে করলেন না। মা তো দুজনেরই বন্ধু ছিলেন। আমি জানি আমার এই ভাবনাটা খুব দোষের। তবু মনে হয়। বিরাজকাকুকে ভীষণ ভালো লাগে। আসলে আমার মা খুব বোকা। আমাদের নীচের ফ্ল্যাটের শ্যামলীর মতো। সে চঞ্চলকে ভালোবাসে। অথচ চঞ্চল ছেলেটা খুব বাজে ধরনের। চঞ্চলের একমাত্র গুণ ভালো গান গায়। চঞ্চল নেশা করে, চঞ্চল সংসার দেখে না, চঞ্চল কাপ্তেন, চঞ্চলের সব কিছুই বাজে। আমার মা-ও ঠিক শ্যামলীর মতো। কত শ্যামলী যে আছে এই সংসারে।

রাতের দিকে বিরাজকাকু এলেন। আমরা না খেয়ে আছি ভেবে খাবার এনেছেন। শিখা ঘুমিয়ে পড়েছে। শিখার জন্যে আমার খুব দুঃখ হয়। আমি তো ছেলে। আমার আর কি। যেমন করেই হোক চালিয়ে নেব। শিখার কী হবে?

বিরাজকাকু খুব পান খান জর্দা দিয়ে। সুন্দর একটা গন্ধ বেরোয়।

খাওয়াদাওয়া কিছু করেছিস বিনু। করিসনি?

এইবার করব কাকু।

নে, ঠোঙায় খাবার আছে। কাল থেকে অন্তত একবেলা তোদের জন্যে ভাতের ব্যবস্থা করতে হবে। কোথায় করি। নিজেরই চালচুলোর ঠিক নেই। তবু করতে হবে। মেয়েটার ঘাড়টা বেঁকে আছে রে বিনু। সোজা করে দে।

শিখা এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে। পড়ার বই চারপাশে ছড়িয়ে আছে। মেয়েটার গা দিয়ে একটা ছেলেমানুষ-ছেলেমানুষ গন্ধ বেরোচ্ছে। শিখাকে ঠিক করে শোয়াতে শোয়াতে মনে হল আমার বাবা কত নিষ্ঠুর।

বিরাজকাকু চেয়ারে বসতে-বসতে বললেন, ব্যাপারটা কী হয়েছিল বল তো?

খুব বাজে ব্যাপার কাকু।

বাজে তো বটেই। হঠাৎ এত ক্ষেপে গেল কেন?

আমি তো সবটা জানি না। অনেক রাতের ঘটনা। আমরা যখন জেগে উঠে ছুটে গেছি তখন আমার মা মাটিতে পড়ে আছেন। চারপাশ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সিঁড়ির কাছের অল্প আলোতে দু-হাতে মুখ ঢেকে বাবা দাঁড়িয়ে। মুখে তখনও মেকআপ। থিয়েটারের ডায়লগের মতো বলে চলেছেন, এ আমি কী করলুম, এ আমি কী করে ফেলেছি। তারপর হঠাৎ জাহানারার ডায়লগ বলতে শুরু করলেন, উঠুন, দলিত ভুজঙ্গের মতো ফণা বিস্তার করে উঠুন, হৃতশাবক ব্যাঘ্রীর মতো প্রমত্ত বিক্রমে গর্জে উঠুন; অত্যাচারে ক্ষিপ্ত জাতির মতো জেগে উঠুন। তারপর ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে টলতে টলতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।

বিরাজকাকু কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বললেন, তোর বাবা কাঁদতে চায়। দুঃখ দিয়ে দুঃখ পেতে চায়। তোর মায়ের মতো মেয়ে হয় না রে।

তাই তো বাবা অত বাড়তে পেরেছে।

ভুল বললি বিনু। লোকটা মনে প্রাণে সাজাহান হয়ে গেছে। সাজাহানকে যে কাঁদতেই হবে।

তা বলে মাকে মেরে?

তোর মা ছাড়া পৃথিবীতে ওর আপনার লোক আর কে আছে বল?

আপনার কথা আমি কিছুই বুঝি না। বাবা যদি সাজাহানই হবেন আমার মা তো তাহলে মমতাজ। এই কি বাবার তাজমহল!

বিনু তোর বাবার ওপর রাগ করিস না রে। লোকটার মনটা বড় ভালো রে। কত বড় অভিনেতা। ইতিহাসে নাম থাকবে।

আমাদের মনের ইতিহাসে কি থাকবে কাকু? হাসপাতালে গিয়ে মাকে একবার দেখে এলেই বুঝবেন। মাকে কারা হাসপাতালে নিয়ে গেল? জানেন মায়ের হাতে আজ একটাও পয়সা নেই। এই দেখুন কানের দুল দুটো মা আজ বেচে দেওয়ার জন্যে আমার হাতে খুলিয়ে দিয়েছেন।

ও দুটো তোমাকে বেচতে হবে না বিনু, তুলে রেখে দাও। মা হাসপাতাল থেকে ফিরে এলে যে হাতে খুলেছ সেই হাতেই আবার পরিয়ে দিও। জেনে রাখো শিল্পীদের হাতে কখনও পয়সা থাকে না। আসে আর উড়ে যায়। তাদের সংসার এই ভাবেই চলে। পাঁচজনে চালিয়ে দেয়। শিল্পের জন্মভূমি হল অভাব, অশান্তি, হতাশা, বিচ্ছেদ। ওসব বোঝার বয়েস তোর হয়নি। নে উঠে পড়।

কোথায় উঠব কাকু?

যেতে হবে না?

কোথায়?

কোথায় আবার! আমার আস্তানায়। মনে নেই তোকে আমি কি বলেছিলুম একদিন। আমিই তোর রিয়েল ফাদার। তুই ভাবিস না ব্যাটা। আমি কি তোর বাপের চেয়ে কম বড় অভিনেতা ছিলুম! আমার ঔরংজীব দেখেছিস। দেখিসনি। তুই তখন এতটুকু। মায়ের কোলে ট্যাঁট্যাঁ। স্টেজ ছেড়ে চাকরি ধরেছি কেন জানিস, আমি এক নতুন ঔরংজীব। সাজাহানকে আগ্রা দুর্গ থেকে মুক্ত করে দিয়ে বলব, সাজাহান, ওই তোমার মসনদ, ওই তোমার মমতাজ, ওই তোমার জাহানারা। নে জাহানারাকে টেনে তোল, অনেক রাত হল। ভালো তালা আছে?

হ্যাঁ আছে।

নে হৌজখাসে তালা মেরে আমার সঙ্গে চল। মা ভালো হয়ে ফিরে এলে তারপর আসবি।

বিরাজকাকুর সঙ্গে ট্যাক্সি করে আমরা দুই ভাই-বোন মাঝরাতের কলকাতার মধ্যে দিয়ে চলেছি। শিখা আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। মাঝে-মাঝে আলোর রেখা মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। শিখা যেন কেমন হয়ে গেছে। মুখটা ঠিক আমার মায়ের মুখের মতোই। কিন্তু কি ভীষণ ক্লান্ত। ঘটনার রাত থেকে আজ পর্যন্ত শিখার মুখে এতটুকু হাসি নেই। চলে ফিরে বেড়িয়েছে। যেন কলের পুতুল। সত্যিই জাহানারা। সাজাহানের সঙ্গে একই দুর্গে বন্দি। মায়ের জন্যে আমার যেমন দুঃখ হয় শিখার জন্যেও তেমনি দুঃখ হয়। শিখা যেন এই বয়সেই মায়ের মতো বুড়িয়ে গেছে।

বিরাজকাকু একলা মানুষ। দেড় কামরার ফ্ল্যাট। পরিচ্ছন্ন করে সাজানো। ঘরের একদিকের দেওয়ালে বিশাল একটা সিন টাঙিয়ে রেখেছেন। সেই সখের থিয়েটারের স্মৃতি। থিয়েটার গেছে সিনটা আছে। রোজই ঝাড়ামোছা করেন। তা না হলে ঘরটা এমন থাকে কী করে। রং জ্বলজ্বল করছে। দৃশ্যটা বড় সুন্দর, বনে বসন্ত লেগেছে। গাছে-গাছে আগুন। দেখলেই গান গেয়ে উঠতে চায় মন, ওরে ভাই আগুন লেগেছে বনে-বনে।

বিরাজকাকুকে দেখাশোনা করার জন্যে একজন রাঁধুনি আছেন। সেই ভরসাতেই আমাদের তুলে এনেছেন। বয়েস বেশি নয়। বিরাজকাকুর সঙ্গে সম্পর্কটা যেন আপনার লোকের মতো। তাল ঠুকে বললেন, রাতকা খানা লে আও।

আমার বাবাকে আমি কখনও এমন হাসিখুশি দেখিনি। সকালে বিরক্ত বিষণ্ণ। রাতে মাতাল।

বুঝলি বিনু। বিরাজকাকুর হাতে সিগারেট, তোর বাবাকে বুঝতে শেখ।

তার মানে?

শিল্পী মাত্রেই বড় একা।

আমরা তাহলে কী জন্যে আছি কাকু।

তোরা থেকেও নেই। তোরা অন্য গ্রহের মানুষ। জানিস কি?

কি জানিস?

আগামী রবিবার সাজাহানের শেষ অভিনয়। বই উঠে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক নাটক আর পাবলিক স্টেজে চলবে না। এখন এসেছে আধুনিক নাটক। জোতদার মারা রাজনৈতিক নাটক। প্যানপ্যানে সামাজিক নাটক। আর এসেছে ড্যান্স। অভিনেতাদের যুগ শেষ। স্টেজ, লাইট, নাচ, কায়দা। তোর বাবার হতাশাটা কোথায় বুঝেছিস? যে লোকটা রাতের-পর-রাত পাদপ্রদীপের সামনে দাঁড়িয়ে দর্শকদের চমকে দিয়েছে, চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে, সেই লোকটি আর কয়েকদিনের পরেই শূন্যতার জগতে ফিরে আসবে। রাত আসবে, চোখের সামনে দর্শক থাকবে না, হাততালি থাকবে না, এনকোর, এনকোর চিৎকার থাকবে না। পরচুল, মেকআপ, গ্রিনরুম, আলো ঝলসানো আয়না, রং-তুলি কিছুই থাকবে না। নিঝুমরাত, চারটে দেওয়াল, একটা খাট, কয়েকটা চেয়ার, একফালি রাস্তা, ঝাঁপসা আলো, ছায়া ছায়া মানুষ, রিকশার ঠুনঠুন, সাজাহান তখন সত্যি-সত্যিই আগ্রার দুর্গে বন্দি! কে তখন ঔরংজীব? এই সমাজ, তোদের এই আধুনিক রুচি। তাই তো লোকটা মাঝে-মাঝেই খেপে উঠছে পাগলের মতো।

বাবা তো আধুনিক নাটকেও অভিনয় করতে পারে কাকু?

দূর পাগল, ক্ল্যাসিকাল গাইয়ের মেজাজে কি আধুনিক আসে রে পাগল।

তাহলে কী হবে?

তোর বাবা অতীতের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করবে আর তোরা মানুষ হয়ে উঠে সংসারের হাল ধরবি। তবে জানিস তো শিল্পীর ছেলেরা মানুষ হয় না।

কেন হয় না?

সংসার জ্বলতে থাকে, চরিত্ররা পুড়তে থাকে। শিল্পীর সংসার এক জতুগৃহ। তবু চেষ্টা করতে হবে। জয়ে, পরাজয়ে, জয়ে দুলতে-দুলতে ফঁক খুঁজতে হবে, পথ করে নিতে হবে। সাজাহান তো পড়েছিস। মনে পড়ে সেই অংশটা যেখানে মহামায়া যশোবন্তকে বলছে, চেয়ে দেখ ওই রৌদ্রদীপ্ত গিরিশ্রেণি দূরে ওই ধূসর বালুস্থূপ। চেয়ে দেখ ওই পর্বতস্রোতস্বতী যেন সৌন্দর্যে কাঁপছে। চেয়ে দেখ ওই নীল আকাশ যেন সে নীলিমা নিংড়ে বার কচ্ছে। তোকে চেয়ে-চেয়ে দেখতে হবে। দেখতে হবে ছায়ার দিকে নয়, রোদের দিকে। জীবন থেকে নিংড়ে বের করতে হবে আকাশের নীলিমা। নে ওঠ। খেয়ে আসি।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress