Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সুভদ্রার ‘নাথ’ ডাক শুনে

সুভদ্রার ‘নাথ’ ডাক শুনে সুরপতি চোখ মেলে তাকাল। ঘনঘোর অন্ধকার। এ কী, সে কোথায়? কিছুই তো সে দেখতে পাচ্ছে না!

সে ডাকল, সুভদ্রা? আমি –আমরা এ কোথায়?

সুভদ্রা বলল, অরণ্যে।

অরণ্যে? অরণ্য কেন? সু

ভদ্রা বলল, অরণ্যই তো আমাদের আশ্রয়।

সুরপতি কিছুই বুঝতে পারল না। সে অনুভব করল, সে সুভদ্রার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। কিন্তু অরণ্যে কেন? সে তো ছিল বাসবদত্তের কক্ষে।

সে ধড়মড় করে উঠে বসল।

সুভদ্রা বলল, উঠবেন না। আপনি শুয়ে থাকুন আর একটু। রাত পোহাতে আর দেরি নেই।

সুরপতি জিজ্ঞেস করল, সুভদ্রা, এ কোন অরণ্য? এখানে আমরা এলাম কোথা থেকে?

সুভদ্রা বলল, এ তো বল্লারপুরের অরণ্য।

দস্যু বুধনাথের দল আমাদের সর্বনাশ করে গেছে। আপনার মনে নেই?

সুরপতি বিস্মিত ভাবে বলল, বুধনাথ? সে আবার সর্বনাশ করবে কী করে? বুধনাথ তো মরে গেছে। আমিই তাকে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছি!

আপনি বুধনাথকে কী করে মারকেন? সে মহাপরাক্রমশালী। আবার যে-কোনও সময়ে সে এখানে আসতে পারে। আমি সারাক্ষণ দেবতাদের পায়ে মাথা খুঁড়েছি। আপনার জ্ঞান না ফিরলে যে কোনও সময় আবার বিপদ ঘটতে পারে। আপনার জ্ঞান ফিরেছে, কাল ভোরেই আমরা এ স্থান ত্যাগ করে চলে যাব।

কী, বুধনাথ মরেনি? সে কি সেই প্রবল নদীর স্রোত থেকেও আবার বেঁচে উঠেছে? ঠিক আছে, আসুক সে। আমি আর তাকে ভয় পাই না। তার এখন একটি মাত্র চক্ষু, তার এক চক্ষু নেই, সে আজ আমার সঙ্গে লড়াইয়ে পারবে না।

নাথ, আপনি আর একটু শুয়ে থাকুন। আপনার স্নায়ু দুর্বল।

না, আমি এখন ঠিক আছি। কিন্তু এই অরণ্যে কী করে এলাম তা তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না। সুভদ্রা, একটু আলো জ্বালতে পারো? আমি দেখতে পাচ্ছি না কিছুই।

কেন, এই তো বেশ চন্দ্রালোক রয়েছে। সব কিছুই তো দেখা যায় এর মধ্যে!

আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

আপনি আর একটু সুস্থ হয়ে নিন। আপনি ঘুমোন, আমি আপনার কপালে হাত বুলিয়ে দিই।

সুরপতি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সত্যিই তার স্নায়ু দুর্বল।

ভোর হতে সুরপতির যখন ঘুম ভাঙল, তখন সে আরও বিমুঢ় হয়ে গেল।

সে শুয়ে আছে এক বনের মধ্যে। পাশেই ঘুমন্ত ধ্রুবকুমার। তার বয়স অনেক কম, তিন-চার বছর মাত্র। ধ্রুবকুমারের বয়স এ-ভাবে কমে গেল কী করে?

সুভদ্রা একটা বৃক্ষে হেলান দিয়ে বসে আছে, তার ক্রোড়ে সুরপতির মাথা।

সুরপতি উঠে বসে সুভদ্রাকে জাগিয়ে তুলে জিজ্ঞেস করল, আমার কী হয়েছিল? আমরা এখানে কেন?

সুভদ্রা বলল, আপনার মস্তিষ্কে চোট লেগেছিল। আপনার দীর্ঘদিন সংজ্ঞা ছিল না।

তোমার আর একটি সন্তান কোথায় সুভদ্রা? ধ্রুবকুমারের কনিষ্ঠ ভাই?

এ আপনি কী বলছেন? আমাদের তো একটিই সন্তান!

বুধনাথ তোমার সর্বনাশ করেনি? আমি নিজের চোখে দেখেছি।

হ্যাঁ, করেছিল। তারপর আমি স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করব ভেবেছিলাম। শুধু আপনার আর ধ্রুবকুমারের কথা চিন্তা করে আমি নিরস্ত থেকেছি। এখন আপনার চেতনা ফিরেছে, এখন আপনিই ধ্রুবকুমারের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন। এবার আমি প্রাণত্যাগ করতে পারি।

সুরপতি ব্যাকুল ভাবে বলল, না না, সুভদ্রা, সে-কথা চিন্তাও কোরো না। তুমি অশেষ পুণ্যবতী। সামান্য একটা পশুর স্পর্শে তোমার ধর্মনাশ হতে পারে না কখনও। তাছাড়া তুমি চিন্তা কোরো না, বুধনাথকে আমি শাস্তি দিয়েছি।

সুভদ্রা চুপ কবে রইল।

সুরপতি আবার জিজ্ঞেস করল, আমরা কত দিন ধরে এখানে আছি?

সুভদ্রা বলল, জানি না। দিন পনেরো-ষোলো। হিসাব রক্ষা করার তো কোনও উপায় ছিল না। তবে অনুমানে মনে হয় এক পক্ষকাল তো হবেই। বুধনাথ যে-দিন আমাদের সর্বনাশ করে গেল, সে-দিন আপনার মাথায় খুব চোট লেগেছিল, তারপর থেকে আপনার আর সংজ্ঞা ফেরেনি।

কী বলছ এসব কথা, আমরা দারুকেশ্বরে যাইনি?

দারুকেশ্বর কোথায়?

তুমি দারুকেশ্বর চেনো না? তুমি বলভদ্র নামে কারুকে চেনো না?

নাথ, আপনি আর একটু বিশ্রাম নিন। আপনার মস্তিষ্ক এখনও দুর্বল।

সুভদ্রা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আমি কি সবই স্বপ্নে দেখলাম? এ কি কখনও স্বপ্ন হয়? একটা কথা বলো তো, এখানে এক পক্ষকাল যে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে রইলাম, তখন তোমরা কী করলে?

সুভদ্রা বলল, সেই কালরজনী প্রভাত হওয়ায় আমি প্রথমে দেখলাম আমার চারপাশে শুধু কতকগুলি মৃতদেহ। আপনিও নেই ধ্রুবকুমারও নেই। আমার তখন আর বাঁচাব ইচ্ছা ছিল না, তবু আমি আপনাদের সন্ধানে বেরুলাম। শেষ পর্যন্ত এক প্রান্তরে পেলাম আপনাদের, দুজনই অচৈতন্য। ধ্রুবকুমাবের জ্ঞান যদি ফিরল, আপনার আর ফেরেনা। আমি অবলা নারী। তখন আর কী করি! কোনও ক্রমে আপনাকে বয়ে বয়ে নিয়ে এলাম এই ঘোর অরণ্যে। এখানে লোকচক্ষুর আড়ালে রইলাম।

এত দিন তোমরা খেলে কী?

বণিকদের কিছু খাদ্যদ্রব্য সেই লুণ্ঠনের স্থানে ছড়ানো ছিল। আমি তার কিছু কিছু এনেছি। আর আছে বনের ফলমূল।

সুরপতি বলল, কিছুই বুঝি না! কিছুই বিশ্বাস করি না।

সুরপতি নিজের শরীরের দিকে তাকাল। তারপর আবার উত্তেজিত হয়ে উঠল। তার ডান বাহুতে একটা চৌকো পোড়া ছাপ। সে বলল, এই দেখো, কারাগারে আমার গায়ে এই ছাপ দেওয়া হয়েছিল। যে কারাগার থেকে আমি বুধনাথের সঙ্গে পালিয়েছিলাম!

সুভদ্রা বলল, লুণ্ঠনের দিনে আপনার হাতের ওই জায়গায় ছ্যাঁকা লেগেছিল।

না না, তা হতেই পারে না। তুমি শপথ করে বললো, আমরা এখান থেকে আর কোথাও যাইনি? তুমি দারুকেশ্বরে সরাইখানায় ছিলে না?

দারুকেশ্বর কোথায়?

চলো চলো, এক্ষুনি চলো।

কিন্তু কয়েক পা গিয়েই সুরপতি আবার মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেল। আবার তার জ্ঞান ফিরল একটু পরেই।

সে একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। তার মন কিছুতেই শান্ত হয় না। এ কখনও স্বপ্ন হতে পারে? স্বপ্নের মধ্যে মানুষ এত কষ্ট পায়?

সে সুভদ্রাকে বলল, সুভদ্রা, সুভদ্রা। মাঝে মাঝে আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছি। এক-একবার তোমাদের দেখছি, আবার সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।

সুভদ্রা বলল, আপনি আমার হাত ধরুন। আমি আপনাকে শক্ত করে ধরে থাকব।

বালক ধ্রুবকুমার, সে-ও এসে সুরপতির অন্য হাত ধরে বলল, বাবা, আমিও তোমার হাত ধরব।

স্ত্রী ও পুত্রকে দু’পাশে নিয়ে হাঁটতে লাগল সুরপতি। মাঝে মাঝেই তার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে, তখন সে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে। একটু পরেই আবার উঠে দাঁড়ায়, আবার চলে।

খানিক দূর এসে একটা গোচক্রযান মিলল। তাতেই উঠে বসল ওরা। গাড়িটি দারুকেশ্বর যাবে। তার আগে আর তেমন কোনও বড় শহরগঞ্জ নেই। তবু এর মধ্যে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম পড়ল, সে-গ্রাম সুরপতির চেনা। সুরপতি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু মুখে কিছুই বলল না।

সারা দিন ধরে চলার পর সন্ধ্যার সময় তাদের একটি অরণ্য পার হতে হল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, শীঘ্রই বুঝি বৃষ্টি নামবে।

অরণ্যটি পার হবার পর আবার কিছু দূরে গিয়ে পথের পাশে একটি সাদা রঙের দ্বি-তল গৃহ চোখে পড়ল। ধক্ করে উঠল সুরপতির বুক। এই তো সেই গৃহ! প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সুরপতি এসে আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। হঠাৎ সেই গৃহের ভেতর থেকে ভেসে এল ব্যাঘ্রের হুঙ্কার।

সুরপতির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। সে শকট চালককে বলল, শীঘ্র চলো, শীঘ্র এ জায়গাটা পার হয়ে যাও!

শকটচালক বলল, ভয় পাবেন না। এই কুঠিতে একটি ব্যাঘ্র আছে আমি জানি, কিন্তু সে কখনও বাইরে আসে না।

সুরপতি মুখ ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর কে কে আছে এই গৃহে?

শকটচালক বলল, দুই সুন্দরী মুসলমান রমণী। তাদের এক জনের গলার গান কোকিলকে হার মানায়। আর এক জনের মাথার ঠিক নেই।

সুরপতি নিজের মাথা চেপে ধরে বেদনা দমন করে সুভদ্রাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বলছ কেন? কেন বলেছ যে আমরা ওই অরণ্য ছেড়ে কোথাও যাইনি?

সুভদ্রা বলল, কোথাও যাইনি, এটাই তো সত্য। দস্যুর হাত থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য আপনি এসেছিলেন, এক জন আপনার মাথায় ডাণ্ডা মারে, আপনি অজ্ঞান হয়ে যান। আর জ্ঞান ফেরেনি।

অনেক রাত্রে গোযানটি এসে পৌঁছল দারুকেশ্বরে। নগরে প্রবেশের মুখে সেই প্রথম সরাইখানাটি। একনজর মাত্র তাকিয়েই সুরপতি চিনতে পারল। সে সুভদ্রাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই সরাইখানাটি চেনো না?

সুভদ্রা অবাক মুখে উত্তর দিল, আমি তো এখানে কখনও আসিনি।

তবে আমি এলাম কী করে?

সুভদ্রা নীরব।

সুরপতি চিৎকার করে ধ্রুবকুমারকে জিজ্ঞেস করল, ধ্রুব, তুমি এখনে কখনও থাকোনি?

বালক ধ্রুবকুমার কিছুই বুঝতে পারল না।

সরাইখানার সামনে সেই পরিচিত মাংসের দোকানটি ঠিকই আছে। সেই পরিচিত কশাই সেখানে বসে আছে। এবং সরাইখানার মালিক যখন বেরিয়ে এল, তখন দেখা গেল সে আর কেউ নয়, সেই বলভদ্র।

সুরপতি তাকে জিজ্ঞেস করল, কী বন্ধু, চিনতে পারো?

বলভদ্ৰ সামনে এগিয়ে এসে ভাল করে সুরপতিরমুখ নিরীক্ষণ করে বলল, কে আপনি? বংশীলাল?

সুরপতি বলল, ফের বংশীলালের কথা? সেসব তো মিটে গেছে। আমি সুরপতি।

বলভদ্র অপ্রসন্ন ভাবে বলল, আপনি বংশীলাল হন বা যে-ই হন, আমার এখানে স্থান নেই।

এই সময় বালক ধ্রুবকুমার বলল, বাবা, আমার খিদে পেয়েছে, আমার ঘুম পেয়েছে।

সুরপতি আবার চক্ষে অন্ধকার দেখল। আবার সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সরাইখানার চত্বরে।

জ্ঞান ফিরে দেখল, সরাইখানারই একতলার একটি ছোট ঘরে সে শুয়ে আছে। পাশে সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমার। অনেক দিন পর তারা নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে।

তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। সুরপতি বাইরে এসে দাঁড়াল। তার মন এক বিষণ্ণ অবসাদে ভরে আছে। এর আগে যা যা ঘটেছিল, তা সবই কি স্বপ্ন? তাহলে এই বলভদ্রের সরাইখানা সে চিনল কী করে? স্বপ্নে এমন অপরিচিত সব স্থান ও মানুষজন কি হুবহু দেখা যায়? তবে কি স্বপ্নে যে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলো এবার তার জীবনে ঘটবে?

এ-কথা মনে হতেই সুরপতির শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল।

বেলা বাড়ার পর বলভদ্র এসে তাকে বলল, আপনার দেখছি মৃগীরোগ আছে। আপনি চিকিৎসা করান, সেরে যাবে। আমাদের এখানে এক জন খুব ভাল চিকিৎসক আছেন, প্রায় ধন্বন্তরি বলা যায়।

সুরপতি শ্লেসের সঙ্গে বলল, নিশ্চয়ই তার নাম রাজবৈদ্য বাসবদত্ত।

আপনি তাঁর নাম জানেন নাকি? তা জানতেই পারেন, দেশ-বিদেশের নাম ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু তার তো বেঁচে থাকার কথা নয়।

এ কী কথা বলছেন? রাজবৈদ্য বাসবদত্ত যমকে জয় করেছেন, তিনি অমর।

সুরপতি পাগলের মতো হা-হা করে হেসে উঠল। তারপর বল, আচ্ছা দেখাই যাক না। আমি যাব সেখানে।

সুভদ্রাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়ল সুরপতি। পথতার চেনা। বাসবদত্তের গৃহ খুঁজে বার করা তার পক্ষে কিছুই নয়। কিন্তু কিছুটা এসেই সুরপতি থমকে দাঁড়াল। তার কোমরের কাছে তার টাকার পুঁটুলিটা রয়েছে। সুভদ্রার কাছে আর কিছুই নেই। যদি সে আর না ফেরে কোনও কারণে, তাহলে সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমার সেই রকম অসহায় অবস্থায় পড়বে।

না, এ-রকম ভুল সে আর দ্বিতীয় বার করবে না। সুরপতি আবার ফিরে এল। ঘরে এসে দেখল সুভদ্রা মাথায় দীর্ঘ অগুণ্ঠন টেনে বসে আছে। ধ্রুবকুমার খেলা করছে একটা ভাঙা মৃৎ-শকট নিয়ে।

সুরপতি ধ্রুবকুমারকে ঝট করে কোলে তুলে নিয়ে সুভদ্রাকে বলল, চলো আমার সঙ্গে।

কোথায়?

রাজবৈদ্যের কাছে। আমি যে মাঝে মাঝে চোখে অন্ধকার দেখি তা সারিয়ে তুলতে হবে। নইলে আমি নতুন কাজকর্ম শুরু করব কীভাবে।

চলুন।

তুমি সবসময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তুমি চিকিৎসক ডাকবার জন্যও কোথাও যেও না। মনে রেখো তুমি অন্য কোথাও গেলেই বিপদ হতে পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এসে পৌঁছল রাজবৈদ্য বাসবদত্তের প্রাসাদের সামনে, সেখানে অসংখ্য মানুষ। ঘরের ভেতর ভরতি করে, বাইরেও বহু মানুষ অপেক্ষা করছে।

সুরপতি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, বাসবদত্ত কি বেঁচে আছেন?

অমনি কয়েক জন লোক হা-হা করে উঠল। তারা সুরপতিকে ধমক দিয়ে বলল, তুমি তো আচ্ছা বেকুব হে! মহাপ্রাণ বাসবদত্তসম্পর্কে এমন কুকথা উচ্চারণ করতে আছে? তিনি বেঁচে থাকবেন না কেন?

সুরপতি বুঝতে পারুল, তার ভুলই হয়েছে। প্রথম দৃশ্যে বাসবদত্ত তো বেঁচেই ছিলেন।

সুরপতি বলল, তিনি কখন নিচে নামবেন?

এক জন বলল, তিনি আগে যাবেন রাজার কাছে। রাজা লোক পাঠিয়েছেন, তাঁর শরীর অসুস্থ।

সুরপতি হাসল। সে খুব নিচু গলায় বলল, জানতাম। আমি সবই জানি।

ঘরের মধ্যে বেশ গরম। বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, তাই সুরপতি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বাইরে এল। সামনে একটি সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তর। সেদিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। অদূরে রয়েছে একটি নদী।

একটুখানি ভ্রমণের জন্য সুরপতি সবেমাত্র সেই প্রান্তরের মধ্যে এগিয়েছে, এমন সময় দেখল চার জন রাজপুরুষ তার দিকে আসছে। তারা সবাই সশস্ত্র।

তারা সুরপতির সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রশ্ন করল, কে? বংশীলাল না?

সুরপতি আঁতকে উঠল। এরপর কী হবে, তা-ও সে জানে। সে যে অতি সাংঘাতিক!

সে দু’হাতে মুখ ঢেকে উন্মাদের মত চিৎকার করতে লাগল, না, আমি বংশীলাল নয়, সব মিথ্যে, সব মিথ্যে–সুভদ্রা, আমাকে বাঁচাও।

সুরপতির যখন আবার জ্ঞান ফিরল, তখন দেখল তার চারপাশে একটা বিরাট জনতা হয়ে গেছে। সে প্রথমেই সুভদ্রাকে খুঁজল। সুভদ্রা তার পাশেই দাঁড়িয়ে তার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে।

সে কান্না-মেশানো গলায় বলল, আমি বংশীলাল নয়, এই আমার স্ত্রী-পুত্র, এরা সাক্ষী আছে।

জনতার মধ্য থেকে কয়েক জন বলল, মহাশয়, আপনার ভয় নেই, রাজপুরুষেরা তাদের ভুল স্বীকার করেছেন। আপনি তো মুক্তই আছেন।

সুরপতি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, সুভদ্রা চলল, আমরা এক্ষুনি এ-দেশ থেকে চলে যাই। দারুকেশর বড় সাংঘাতিক স্থান, অন্তত আমাদের পক্ষে। এখানে বংশীলাল আছে। তার জন্য আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

অবিলম্বে একটি অশ্বশকট ডাকা হল। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তাতে উঠে বসে সুরপতি বলল, আমরা আবার তাম্রলিপ্তেই ফিরে যাব। সেখানে আমার পূর্বপুরুষের বাস। সে আমার নিজের স্থান। যদি মরি তো সেখানেই মরব। এ-দেশে আর নয়।

স্ত্রী ও পুত্রের হাত শক্ত করে ধরে রইল সুরপতি। এই তার ছোট্ট সংসার। এদের নিয়েই তার পৃথিবী। সে আর এদের ছাড়বে না।

শকট ছুটে চলল তাম্রলিপ্তের দিকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9
Pages ( 9 of 9 ): « পূর্ববর্তী1 ... 78 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress