সম্পর্ক
রাত প্রায় দু’টো । সুনন্দ একমনে লিখে চলেছে সন্ধ্যেবেলায় মাথায় জমে থাকা শব্দমালা দিয়ে তার নতুন কবিতা । ধীরে ধীরে অবয়ব ফুটে উঠছে , হটাৎ ছন্দপতন , ফেসবুকের নোটিফিকেশনের আওয়াজ তার চিন্তাসূত্রের তার যেন কেটে দিল । আজ অফলাইন হতে ভুলে গেছে সুনন্দ । বিরক্তি নিয়ে মোবাইলের ওপরের প্যানেলের দিকে দেখল , একটু কৌতুহলীও হলো , পল্লবী তাকে মেসেজ পাঠিয়েছে । কে এই পল্লবী , সুনন্দর ফ্রেন্ড লিস্টে তো এই নামে কেউ নেই , তবে ? লেখাটা সেভ করে ম্যাসেঞ্জার খুললো দেখল পল্লবী সিনহা বলে কেউ তাকে মেসেজ দিয়েছে । ” প্রিয় বন্ধু , শুভেচ্ছা নেবেন । আপনি আর আমি সাহিত্যমূল গ্রুপে জুন মাসের গল্প প্রতিযোগীতায় যৌথ প্রথম হয়েছি । আমি জানিনা আপনি আমার লেখা গল্পটি পড়েছেন কি’না , তবে আমি আপনার লেখাটি পড়েছি এবং অনেককে পড়িয়েছি । সকলেই মুগ্ধ আপনার লেখার মুন্সিয়ানায় । আপনার কলমে জাদু আছে । আপনার কাছ থেকে আরও এইরকম লেখা আমরা চাই । শেষে অনুরোধ করি যদি সম্ভব হয় সাহিত্যমূল গ্রুপে গিয়ে আমার লেখাটি পড়ে মন্তব্য করার । আপনার মতন লেখকের মন্তব্য আমার কাছে মূল্যবান । ফের একবার অভিনন্দন । ধন্যবাদ । শুভ রাত্রি “। মনে পরলো সুনন্দর , জুন মাসে সে ঐ গ্রুপের গল্প প্রতিযোগীতায় যুগ্ম প্রথম হয়েছিল, তবে তার কাউন্টারপার্টের নাম মনেও ছিল না আর তার লেখা পড়েও নি । তবে একজন লেখিকা ছিলেন তা মনে আছে । ও , ইনিই তবে সে। মনুষ্য কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সুনন্দ পল্লবীর ইনফরমেশন ট্যাবে ক্লিক করে ওর প্রোফাইল দেখতে গিয়ে হতাশ হ’ল । প্রোফাইল পিকচারে একটা গোলাপ ফুলের ছবি । ভাবলো থাক পরে উত্তর দেবে । নেট অফ করে ফের ছিঁড়ে যাওয়া কবিতার তার জুড়তে বসলো সুনন্দ । না , লেখাটা আর জমলো না । বিরক্তিতে একটা সিগারেট ধরিয়ে মোবাইলর পাট শেষ করলো আজকের মত।
অভ্যাস মত সকাল ছ’টায় ঘুম থেকে উঠে সুনন্দ পাশের বাড়ির ছোটনকে ডাকলো ,ওরা দুই বন্ধু সকালে হাঁটতে যায়, চা খেয়ে ঘন্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরে আসে । আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। স্নান , প্রাত:রাশ সেরে অনলাইন হতেই ফের চমক ,পল্লবীর বার্তা। সুনন্দর মাথায় দুষ্টুমি চাড়া দিয়ে উঠলো । সে প্রভাতী শুভেচ্ছার সঙ্গে এটাও লিখে দিল যে প্রোফাইল ছবি না দেখতে পেলে সে উত্তর আর দেবে না কারণ তার মনে হচ্ছে এই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা ভুয়ো। কয়েক মিনিট মাত্র ,উত্তর পেল। মূল বক্তব্য একটা সাহিত্য সংক্রান্ত গ্রুপ কখনোই সদস্যদের প্রোফাইল চেক না করে পুরস্কার দেয় না , সেই অর্থে সে আদৌ ভুয়ো অ্যাকাউন্ট নিয়ে চলে না। সুনন্দ আজ লেখালিখি করে নাম করেছে বলে এই কথাগুলো বলতে পারলো। তার পরেই নিজের একটা ছবিও সে পাঠিয়েছে । সুনন্দ খুব লজ্জা পেল । সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিতে বসলো। লিখলো ব্যাপার হচ্ছে ইদানীং বন্ধুত্বের নাম করে বেশ কিছু লোক তার প্রোফাইলে ঢুকে তার নামে কুৎসা করতে চাইছে বলেই সে এই কথা বলেছিল ,কাউকে অপমান করার উদ্দেশ্য তার ছিল না , তার কথায় যদি কেউ দু:খ পায় তার জন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী । ম্যাজিকের মত কাজ হলো । পল্লবী , সুনন্দ কে দাদাভাই বলে ডাকতে শুরু করলো । পল্লবী বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান,ভাই বা দাদার অভাব সে অনুভব করে । ঠিক এই কারণে সে সুনন্দকে দাদার আসনে শ্রদ্ধার আসনে বসাতে চায় । সুনন্দ অত্যন্ত খুশি হলো । এতদিনের অভিজ্ঞতা তাকে দেখিয়েছে একটা বড় সংখ্যার মহিলাকুল যারা তার ফেসবুক বন্ধু ইনিয়ে বিনিয়ে প্রেম নিবেদন করে । পল্লবী যেন তাদের থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রম । সুনন্দ উত্তরে লিখলো সে’ও খুব খুশি হয়েছে এমন একটা বোন পেয়ে । আরও জানতে চাইলো পল্লবীর ফোন নম্বর । বিনাবাক্যব্যয়ে পল্লবী দিয়েও দিলো । দিন কেটে যেতে লাগলো পৃথিবীর নিয়ম মেনে।ইতিমধ্যে সুনন্দ আর পল্লবী আরও কাছাকাছি এসেছে ।
সুনন্দ ওদের বাড়িতে গেছে । মধ্যবিত্ত পরিবার ,পল্লবী বাংলা নিয়ে মাস্টার্স করছে । বাবা সাধারণ চাকুরিজীবি। আর্থিক আসাচ্ছন্দ্য থাকলেও যে জিনিসটা সুনন্দকে আকৃষ্ট করেছে তা হলো পল্লবীদের আন্তরিকতা । সুনন্দ পল্লবীকে তাদের বাড়িতে নিয়েও এসেছে । সুনন্দর বাবা মা নেই , দাদা বৌদি , ভাইপো আর সে একটা কোঅপারেটিভের দু’টো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে । সুনন্দর একটা জামাকাপড়ের দোকান আছে আর ওর দাদা সরকারী ঠিকাদার ,নির্মাণ কাজের ব্যবসা। যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি আছে ওদের। সুনন্দর বৌদি কিন্তু বেঁকা চোখে সম্পর্কটা দেখে । কথায় কথায় বলে ” ভাই তোমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে এবার বিয়েটা করে ফে’ল “। সুনন্দ মুচকি হেসে বলে মেয়ে কৈ যে বিয়ে করবো। বৌদির চটজলদি উত্তর কাছেই আছে সবই জানো ,সবাই জানেও , ন্যাকামি করছো কেন ! সুনন্দ থমকায়। ওদিকে পল্লবীর বন্ধুরা বলে সে না’কি বোকা । একজন মোটামুটি নামকরা উঠতি কবি আবার দোকানদার পয়সাকড়ির অভাব নেই এই যুগে আর কি চাই ! আরও বলে ভার্চুয়াল জগতের সম্পর্কের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই ,পল্লবী নিজের পায়ে কুড়ুল মারছে।
একদিন সুনন্দর আমন্ত্রণে পল্লবী ওর মা’কে নিয়ে সুনন্দর বাড়িতে এলো । সারাদিন ছিল, সুনন্দদের ঘরবাড়ির প্রশংসা করলেন ,দাদা বৌদিকে ওদের গরীবখানায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ করলেন। পল্লবীর জন্মদিন , সুনন্দদের সবার নিমন্ত্রণ ,দাদা যাবে না । সুনন্দ একটা ঢাকাই জামদানি শাড়ি কিনে আনলো পল্লবীর জন্য, বৌদির জন্যও একটা কিনলো । পল্লবীর গায়ের রং চাপা সুনন্দ কিনেছিলো লাল রঙের শাড়ি আর বৌদির জন্য হালকা আকাশী রঙের । বৌদির পরিমর্শে শাড়ি বদলে গেল । পল্লবীর বাবাও ছিল ,খুব মজা হলো । পল্লবীর মা খুব খাতির যত্ন করলো । হটাৎই সুনন্দ লক্ষ্য করলো যে বৌদি পল্লবীর বাবার সঙ্গে খুব গম্ভীর ভাবে কিছু একটা আলোচনা করছে । কৌতুহলী হয়েও সুনন্দ চুপ করে থাকলো । বাড়ি ফেরার সময় ব্যাপারটা কি জানতে চাওয়াতে বৌদি ফুৎকারে ” ও কিছু নয় ” বলে উড়িয়ে দিল । কি আলোচনা হচ্ছিল জানতে পারলো পরের দিন । পল্লবী ফোন করে ডেকে পাঠালো সুনন্দকে ইউনিভার্সিটিতে। শতবার্ষিকী বিল্ডিং-এর সিঁড়িতে বসে পল্লবী যা বললো শুনে সুনন্দর আক্কেল গুড়ুম। বৌদি না’কি পল্লবীর বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে এসেছে । ওর বাবা রাজি , মা তো এক পায়ে খাড়া । শেষে প্রশ্ন ভেসে এলো ,সুনন্দ যদি এই চিন্তাই করে থাকে তবে এতদিন চুপ করে কেন ছিল । পল্লবী যে তাকে দাদার আসনে বসিয়েছে । সুনন্দর মাথা দপদপ করছিল । কোনও রকমে ” আসি ” বলে চলে এলো । দোকানে গেল না ,অনেক চিন্তা করে সল্ট্ লেকের সেন্ট্রাল পার্কে গিয়ে বসে থাকলো অনেকক্ষণ । ভাবনায় চিন্তায় মাথা তোলপাড় । নিজের মনের গভীর অন্ত:স্থলে পৌঁছে জানতে চাইলো সে’ও কি অবচেতন মনে একই কথা ভেবেছিল ? সাত পাঁচ ভেবেও কোনও কূল কিনারা পেল না সুনন্দ । বাড়ি ফিরে এলো । রাতে খাওয়ার সময় দাদা জানতে চাইলো তিনি গতরাতে যে’টা বলেছেন তাই নিয়ে সুনন্দ কিছু ভাবনা চিন্তা করেছে কি’না। বৌদি যথারীতি ঐ একই মন্তব্য করলো । সারারাত সুনন্দ ভেবেই চললো , দু চোখের পাতা এক করতে পারলো না । শেষে সিদ্ধান্ত নিল , সে চুপ করে থাকবে , পল্লবীর সঙ্গে যে দহরম মহরম হয়েছে তাই নিয়ে আর উচ্ছ্বাস দেখাবে না । বরং পল্লবী কি করে তা দেখবে । সেই মতই সুনন্দ দিনের সাথে এগিয়ে চলতে থাকলো । পল্লবীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও যোগাযোগ রয়েছে পুরোদস্তুর ফোনেতে । এদিকে দূর্গা পুজো চলে এলো । পল্লবী একটা পার্কার পেন উপহার দিল সুনন্দকে । সুনন্দ দিল ফের একটা শাড়ি । পল্লবী শালোয়ার কামিজ পরে না ।
পুজো এলো , পুজো গেল । একদিন দু’জন মিলে কলকাতা ঘুরলো । পথে বহু মানুষের সঙ্গে দেখা হলো ওদের । পল্লবী লক্ষ্য করলো সুনন্দর চাহিদা , বিশেষ করে মহিলা মহলে চরম পর্যায়ে । সুনন্দ ঝানু কূটনীতিবিদদের মত করে সামলেছিল। কিছু মহিলা তো তাকে সুনন্দর সঙ্গে দেখে দস্তুরমত জ্বলতে শুরু করেছিল । অবাক করা কান্ড, সুনন্দ তাকে বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছিল, বোন বলে নয় । ক্রমে কালী পুজো এলো । সুনন্দ ভেবে রেখেছিল এইবারেই সম্পর্কটা একটা চরম রূপ নেবে । না পল্লবীর তরফ থেকে হেলদোল নেই । ভাইফোঁটা , সুনন্দর বোন নেই । বৌদি বাপের বাড়ি গেছে । সুনন্দ একা । দরজায় বেল বাজলো। সুনন্দ দরজা খুলেই অবাক । পল্লবী ,হাতে একটা ব্যাগ । দীর্ঘদিন ধরে আসার ফলে সুনন্দর ফ্ল্যাটের সবকিছুই পল্লবীর জানা । কড়া হুকুমে সুনন্দকে ঘরে প্রায় আটকে রেখে সব জোগাড় করে পল্লবী সুনন্দকে ঘর থেকে টেনে ডাইনিং স্পেসে নিয়ে এলো পল্লবী । সুনন্দ দেখলো সুন্দর ভাবে সাজানো প্লেটে মিষ্টি , বাড়ি থেকে চন্দন বেটে এনেছে , এনেছে প্রদীপ , সেইটা জ্বলছে । সুনন্দকে চেয়ারে জোর করে বসালো পল্লবী। আর তার পরেই একহাতে শাঁখ বাজাতে বাজাতে অন্য হাতে ফোঁটা দিতে দিতে পল্লবী বিড়বিড় করে মন্ত্র বলতে লাগলো। ফোঁটা দিয়ে উঠতেই সুনন্দ দেখলো পল্লবীর চোখ দুটো জলে ভরা । সুনন্দর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো ” আমাকে ছেড়ে যাবে না তো দাদা ? । সুনন্দ গভীর স্নেহে পল্লবীকে বুকে টেনে বলল — তুই আমার শুধু বোন আর নেই , তুই আমার গার্জেন । পৃথিবীতে শুরু হলো এক নতুন সম্পর্কের ।