সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 09
তা হলে এই! দাদুর শেষ উপলব্ধি যদি ঠিক হয় তা হলে একদিকে স্বার্থপরতা আরেক দিকে শুকনো কর্তব্যপরায়ণতার উত্তরাধিকার আমাদের। কাকা চলে গেছেন, দাদা চলে গেল, বাবা থেকেও নেই। কিন্তু কর্তব্য, শুধু শুকনো কর্তব্য? এ সব কথা সম্পূর্ণ মেনে নেওয়া শক্ত। মা? দাদাও মাকে উদাসীন বলেছিল। আমি দেখেছি মায়ের সুখদুঃখের অনুভূতি দৃশ্যত কম। ভেতরটায় কী? স্বল্পবাক মানুষের ভেতরটা জানা কঠিন।
কাকার চিঠি। গোটা চারেক। দাদুর ক্যাশবাকসো থেকে নিয়ে পড়ি। একই কথা। ছেলে এখন হাইস্কুল। তাঁর চাকরি খুব কম সময় দেয় তাঁকে। ফিনকি এলে সব দিক রক্ষা হয়। আমরাও বাড়ন্ত একটি মেয়ের দায় থেকে বাঁচি, কাকারও সুবিধে হয়।
জ্যাঠার অ্যাসাইলাম থেকে চিঠি। তাঁদের ফিজ বাড়ছে, তা ছাড়া দেবকুমারবাবু ভাল আছেন। ওঁকে আমরা নিয়ে আসতে পারি।
এ চিঠিটা দেখাই বাবাকে।
—এত ফিজ তো আর দেওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে সরকারি গারদে রাখবার কথা চিন্তা করা যেতে পারে।
—কিন্তু দাদু বলেছেন ওঁকে নিয়ে আসতে।
—বাবার ভীমরতি ধরেছিল। এসব ঝামেলা বাড়িতে ঢোকাতে নেই।
—তুমি একবার না হয় দেখে এসো— আমি বলি।
—আমি খুব নার্ভাস হয়ে যাই এসব ব্যাপারে সমু। দেখতে হয় তুমি দেখে এসো।
—মা, কী করব!
—তোমার দাদু যা বলে গেছেন তাই করা উচিত। ভাসুরঠাকুরের ওপর আমাদের কিছু কর্তব্যও তো আছে!
সুতরাং দক্ষিণ শহরতলি প্রান্তে সেই অ্যাসাইলামে আমি যাই। চতুর্দিকে কোল্যাপসিবল গেট। দারোয়ান। আমাকে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে বলা হয়। ঘরটা বেশ বড়, উঁচু সিলিং-এর। টেবিল চেয়ার নিয়ে একদিকে গম্ভীর মুখ এক ভদ্রলোক ফাইল খুলে বসে আছেন। এত শক্ত মুখ কেন ওঁর? পাগল সামলাতে কী কী লাগে? গায়ের জোর, দৃঢ়তা দরকার, বুঝি। কিন্তু দরদ? একটু সমবেদন নরম মুখ, শান্ত আশ্রয়শীল ব্যবহার লাগে না এসব? সাতপুরনো জাবদা খাতার মতো এমন মুখ?
চারদিকে পিঠ তোলা কাঠের বেঞ্চি পাতা। ব্যবহারে ব্যবহারে তেলতেলে হয়ে আছে।
আমার সামনেই দু’তিনটে ‘কেস’ ঢুকে গেল। রীতিমতো জবরদস্তি করে নিয়ে গেল দু’ তিন জন লোক। সবাই উর্দিপরা। চোখ লাল, বিড়বিড় করছে মানুষটি। আমার চেয়ে হয়তো সামান্য বড় হবে। ও কি বুঝেছে? এই পৃথিবী এই সব মানুষ খুব অন্যরকম? ওর সঙ্গে মিলছে না? কে জানে হয়তো ও-ই ঠিক। ওর ভাষা কেউ বুঝছে না, তাই…। না, দেবকুমারকেও নিশ্চয়ই এমনি ভাবেই নিয়ে আসা হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন মানুষের ওপর। গ্রহান্তরের কোনও ব্যাপার—ছিল না তো!
অন্য দুজন নিশ্চুপ। কোনও প্রতিরোধ নেই। নিজেদের অন্যদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। যা হয় হোক। তবে যা হয় হোক। এক ব্যাখ্যাতীত হতাশা সমস্ত শরীরে। হাতে পায়ে স্বাভাবিক অথচ আচরণে আলাদা মানুষগুলিকে দেখতে দেখতে মনে হল ওরা কিছু একটা মেলাতে পারেনি। কোনও অঙ্ক। ওদের দুয়ে দুয়ে চার হয়নি। প্রাণপণে হাতড়েছে, হাতড়েছে। এখন হতভম্ব হয়ে গেছে—তা হলে এ প্রশ্নের উত্তর কী? উত্তর যদি না-ই থাকবে তবে প্রশ্ন কেন?
শীর্ণ এক ভদ্রলোককে নিয়ে আসে গার্ড। পাজামা আর ফতুয়া পরা। এক মাথা পাকা চুল। চোখে খুব ভীত দৃষ্টি। দাদুর সঙ্গে, আমার বাবার সঙ্গে, এমনকী আমার সঙ্গেও মিল স্পষ্ট। আমি এঁকে জীবনে সেভাবে দেখিনি। আমার পুরো জ্ঞান হবার আগেই ইনি স্থানান্তরিত হয়েছেন। দাদা দেখেছে, দাদার এঁর সম্পর্কে স্মৃতি খুব তিক্ত।
—বাবা কই? বাবা? ভদ্রলোক দিশেহারা ভাবে বললেন। তারপর আমার দিকে চোখ পড়ল।
—রাজ, তুমি এসেছ? —এগিয়ে এসে খুব আদরে উনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। একটা অস্বস্তিকর গন্ধ। আমি শক্ত থাকবার চেষ্টা করি। তার মানে বাবার চেহারা ওঁর মনে আছে।
—এখানে এরা আমাকে রোজ চারাপোনা খেতে দেয় রাজ, আমাকে দিয়ে জামাকাপড় কাচায়, একটা লোককে সারাক্ষণ হাত-পা টিপে দিতে হয় আমায়। জানো ভাই, আমার ঘরে একটা লোক গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ভয়ে মরি। পুলিশ-টুলিশ! যত বলছি আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করছে না। —উনি কাঁপতে থাকেন। আমি ওঁকে আস্তে আস্তে চেয়ারে বসিয়ে দিই। বলি— আপনি বাড়ি যাবেন?
—বাড়ি? উনি অবাক হয়ে তাকান — আমার বাড়ি আছে?
—আছে।
—তা হলে এদের এই অত্যাচার থেকে আমায় বাঁচাও ভাই। নিয়ে চলো। বাবার কাছে।
একটু অপেক্ষা করি, তারপর বলি— আমি কিন্তু আপনার ভাই রাজকুমার নই। আমি আপনার ভাইপো। আমার নাম সমুদ্র।
উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকান। —আমার ভাই কি বেঁচে নেই?
—না না, উনি আছেন।
—বাবা? বাবা আসেনি কেন?
একটু চিন্তা করতে হয় আমাকে। খবরটা এখানে দেব, না বাড়িতে গিয়ে দেওয়া ভাল? বাড়িতে গিয়ে যদি প্রতিক্রিয়া খারাপ হয়, তো আমরা কি সামলাতে পারব? এখানে যদি বলি— ওঁর রাতটা খুব যন্ত্রণায় কাটবে। কিন্তু এখানে অন্ততপক্ষে সামলাবার লোক আছে। আমি আস্তে আস্তে বলি— দাদুর তো অনেক বয়স হয়ে গেছে। একাশি-বিরাশি পার।
—বাবার বয়স? একাশি? বিরাশি? তাতে কী হয়েছে! বাবাই তো আমার দেখাশোনা করেন!
তখন আমি বলি— এখন আপনি ভাল হয়ে গেছেন। আর আপনাকে দেখাশোনা করতে হবে না। আপনি নিজেই পারবেন। পারবেন না?
উনি ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চান।
আমি বলি— এত বয়সে কি আর কেউ বেঁচে থাকে জেঠু! দাদু কিন্তু মারা গেছেন।
—অ্যাঁ? আঁক করে উঠলেন। তারপরে চুপ করে গেলেন, একেবারে চুপ। মুখের কালি গাঢ়তর। চোখে যন্ত্রণার ছাপ।
—আমার জন্যেই। আমি বাবাকে কষ্ট দিয়েছি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
একসময়ে ওঁর কান্না থেমে গেল। জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছলেন উনি। আমি বললুম— জেঠু আপনি এখন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। দাদু বলে গেছেন— এবার থেকে আপনিই আমাদের দেখবেন। আপনিই অভিভাবক।
—তোমরা জানো না আমার মাথা খারাপ?
—মানুষের কত রকমের অসুখ হয়, আবার সেরেও তো যায়! এঁরা খবর দিয়েছেন আপনি একেবারে সেরে গেছেন। ওষুধপত্র খেতে হবে অবশ্য। নিয়ম করে …
—চলো তা হলে যাই — উনি উঠে দাঁড়ালেন।
—আমি কালকে আপনাকে নিয়ে যাব। আপনার ঘর-টর ঠিক করতে হবে তো?
—ঠিক নিয়ে যাবে তো? —করুণ সুরে উনি বললেন।
—ঠিক — আমি ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি।
বাবা সেদিন রাতে খেলেন না। সিঁড়ির ওপর পায়ের শব্দ হতে লাগল ধম ধম ধম ধম। মায়ের দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগল। এঁর ভার দুর্বহ। সারা জীবন ধরে বইছেন, আমি আরও ভার চাপাতে চাইছি। আমার উপায়ই বা কী!
ফিনকির সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলি।
—তোর কি ভয় করছে?
—কামড়ে দেবেন না তো!
—না, সেরকম কিছু নয়।
—জেঠুর কথা কখনও শুনিনি কেন রে ছোড়দা?
—কী জানি, আনপ্লেজেন্ট বলে তোকে কেউ বলেনি হয়তো!
—ঠিক করেনি। আমার কিন্তু সত্যিই খুব ভয় করছে। ওঁকে হাসপাতালেই রাখলে ভাল হত না?
—ফিনকি, এখন আর হাসপাতালের খরচ চালাবার সাধ্য আমাদের নেই। আর ওঁর দিকটাও ভেবে দ্যাখ, উনি ভাল হয়ে গেছেন। এখন অ্যাবনর্ম্যাল লোকেদের সঙ্গে থাকা কি খুব ভয়ানক নয়?
—আমাকে যত শিগগির সম্ভব পাশ-টাশ করে একটা চাকরি করতে হবে। বুঝলি ছোড়দা!
—যত শিগগিরই হোক, যা সময় লাগার তা তো লাগবেই — আমি হেসে বলি, তারপর ওর চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বলি— তোর অবশ্য একটা বিকল্প আছে।
—বিকল্প? মানে?
—মানে, কাকা তোকে কানাডা নিয়ে যেতে চাইছেন। ওখানে তুই অনেক ভাল ভাল সুযোগ পাবি। ধর তোর জীবনটাই বদলে যাবে।
—হঠাৎ? ওর ভুরু কুঁচকে গেছে।
—হঠাৎ-ই। আসলে কাকিমা আর ওঁর ছোট ছেলে মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বাড়িতে উনি আর ওঁর বড় ছেলে। তাই …
—তাই বলো! —ঠোঁট বেঁকে গেল ওর — স্বার্থ। কিছুদিন পরে দাদার যখন অসুবিধে হবে, ধর বাচ্চাকে কার কাছে রেখে যাবে, দুজনেই চাকরি করে, তখনও আমি এরকম একটা অফার পেতে পারি। তাই না?—আমি হাসি।
—তোকে ছেড়ে, মা-বাবাকে ছেড়ে, দিদুদের ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
—বিয়ে হয়ে গেলে?
—সে যখন হবে তখন দেখা যাবে। আপাতত আমি এখান থেকে নড়ছি না।
পরদিন ফিনকিকে সঙ্গে নিয়ে জেঠুকে আনতে গেলুম।
দাদুর ঠিক ওপরের ঘরে ওঁর থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। চারিদিকে দাদুর ছবি, ওঁর যৌবনের ছবি, বাবা উনি আর কাকা একসঙ্গে, স্কুল বয়, পাশ করে সবে চাকরিতে ঢুকেছেন, উজ্জ্বল চেহারা, যত পারি দেয়ালে দেয়ালে টাঙিয়েছি, টেবিলের কাচের তলায় কিছু। ভেবেচিন্তে। চেনা মানুষদের চেনা চেহারা তো আর জীবনে দেখতে পাবেন না। অচেনা ফাঁকগুলোর মধ্যে চেনাগুলো যদি ফিট করে দেওয়া যায় তা হলে হয়তো একটু সহনীয় হবে নতুন জীবন।
সবই অবশ্য করেছে ফিনকি। আমি বলেছি, ও করেছে। ছবি সাজাতে সাজাতে বলল— মাঝখান থেকে পঁচিশ ছাব্বিশ বছর হারিয়ে গেছে, ছোড়দা, কী ভয়ংকর না?
খুব সংকুচিত হয়ে ট্যাক্সির এক ধারে বসে উনি বাড়ি এলেন। ঘরের মধ্যে যে ঢুকে গেলেন, বাস। দিদারা কান্নাকাটি করে জড়িয়ে ধরলেন, মা প্রণাম করলেন, পা কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন উনি। তারপর ঘরে ঢুকে নিশ্চিন্ত।
আর ঠিক তিনদিন পরে আমাকে অফিস জয়েন করতে হবে। বেশির ভাগই পেয়েছিলুম কলকাতার বাইরে। কিন্তু সেগুলো নেওয়ার পরিস্থিতি নেই।
এই যে কতকগুলো সিদ্ধান্ত নিলুম, এগুলো কি আমার? না কি দাদুর? দাদার কথা শুনতে দিল্লি যাওয়া, জেঠুকে নিয়ে আসা, ফিনকির কাছে কানাডা যাবার প্রস্তাব রাখা, এবং এই দূরে চাকরি না নেওয়া! দাদুকে অনুসরণ করেছি, ঠিকই। কিন্তু আমি তো মানতে না-ও পারতুম। বাবা তো আমার সঙ্গে কথাই বলছেন না। দিদারা সিঁটিয়ে আছেন। অশান্তি কে চায়? মা যন্ত্রের মতো তাঁর কর্তব্যের রুটিন পালন করে যাচ্ছেন। দাদুর জায়গা নিয়েছেন জেঠু। সেই বারবার খাবার দিয়ে আসা, বসা, নিয়ে আসা, প্রতিদিনের জামাকাপড় গুছিয়ে রেখে আসা, ছাড়া কাপড় কাচতে দেওয়া। দাদুর সঙ্গে মায়ের কথোপকথনের মধ্যে যে উদ্দীপক অংশটুকু ছিল সেটা শুধু আর নেই। জেঠু সসঙ্কোচে চুপ করে থাকেন।
প্রথম রবিবারে আমি নিজের খাবার থালা নিয়ে জেঠুর ঘরে যাই। টেবিলের কাচের ওপর দুটো থালা রাখি খবরের কাগজ বিছিয়ে। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছেন উনি। আমি লক্ষ করি না।
বলি— জেঠু আমাদের রান্না আপনার ভাল লাগছে?
অনেকখানি ঘাড় নাড়েন উনি।
—কী কী ভালবাসেন?
—সব। তোমার মা যা দ্যান …। উনি চারাপোনা দ্যান না। খেসারির ডাল দ্যান না।
এগুলো হাসপাতালে দিত বুঝতে পারি। সম্ভবত রোজ।
—আমি কিছু করি না।
—খান। এই দেখুন আপনার সঙ্গে খাব বলে আমার থালা নিয়ে এসেছি।
—রাজ আসে না। ও বেঁচে আছে?
—হ্যাঁ। আসলে বাবার অফিসে ভীষণ কাজ পড়েছে।
—আমরা দুজনে সিনেমা দেখতে যেতুম। মহল, কবি, গ্যাসলাইট, জোন অব আর্ক, আমরা একই ক্লাবে খেলতুম।
—কী খেলতেন জেঠু? কী নাম আপনাদের ক্লাবের?
—বন্ধুদল। সব রকম খেলা। টেনিস ছাড়া সব। রাজ ইনডোর ভালবাসত। ক্যারম। ওপরে আলো টাঙিয়ে— জেঠু ওপরে হাত দ্যাখান। —এখন খেলে? ক্যারম? চেস?
—কী জানি! আপনি জিজ্ঞেস করবেন।
—না, না, আমি সে পারব না। তুমি জিজ্ঞেস করো। তুমি সাগর, না?
—আমি সমুদ্র, জেঠু। সাগর দিল্লিতে থাকে।
—মেয়েটি কে?
—আমার বোন, ফিনকি।
—ভাল মেয়ে?
—খুব ভাল।
আমি অফিস যাই। ফিনকি কলেজ যায়। বাবা অফিস যান। বাড়িতে দুই বৃদ্ধা এক মানসিক রোগগ্রস্ত বৃদ্ধের দায়িত্ব একলা মায়ের ওপর। প্রতিদিন যাই অপরাধবোধ নিয়ে, প্রতিদিন ফিরি অপরাধবোধ নিয়ে। দেখতে পাই ফিনকি আস্তে আস্তে জেঠুকে ওষুধ খাওয়ানো, তাঁকে একটু-আধটু সঙ্গ দেওয়ার কাজটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। রাত্তিরে ঠিক ন’টার সময়ে খাওয়া-দাওয়া হলে ওঁকে ঘুমোতে দেওয়া হয়। বাবা ফিরলে বাবা আর ফিনকি খেতে বসে, আমি মায়ের সঙ্গে বসি। বাবার খাওয়ার সময়টা আমি অনেক সময়েই দিদাদের ঘরে একটুখানি বসি। খুব নিপাট পরিষ্কার চন্দনের গন্ধ বেরোয়। একদিকে দেয়ালে গাঁথা ছোট্ট একটু তাক মতো। তার ওপর বালগোপালের রুপোর সিংহাসন। দুটো খাটে দুটো কম্বলের আসন পাতা। ওখানে বসে ওঁরা জপতপ করেন। দুজনেই নিঃসন্তান, আমাদের ছোটবেলা কেটেছে মোটামুটি ওঁদেরই তত্ত্বাবধানে। কিন্তু বড় তাড়াতাড়ি ওঁরা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। আমার নিজের ঠাকুমা হলে কি পারতেন? কেন এমন হল? ওঁরা যেন এ পরিবারের কেউ নয়। আমি যদ্দূর জানি দুজনেই উইডো পেনশন পান। তাতে দাদু কোনওদিনই হাত দেননি। মাঝেমধ্যে নিজেদের ইচ্ছেয় সংসারের জন্য কিছু খরচ করেন, উপহার দেন। মাকে পুজোয় একটা শাড়ি, আমাদের পাশ করবার পর একটা কলম। দাদাকে হাতঘড়ি দিয়েছিলেন। ফিনকিকে ছোটবেলায় ফ্রক কিনে দিতেন। এখন কি দ্যান? আমি জানি না। এসব কথা আমার মাথায় আসেনি এতদিন। দাদার কথা, দাদুর কথা, মায়ের ভাবনা এইসব থেকে ইদানীং আসছে। ভাসমান দুটি দ্বীপ। অনেক দিন দেখেছি বাবার খাওয়ার সময়ে দুজনের একজন গিয়ে বসেছেন। কিন্তু বাবার নিত্যদিনের চেঁচামেচি বোধহয় সহ্য হত না, আস্তে আস্তে বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি এই জলধির নির্জন দ্বীপগুলির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবার চেষ্টা করে যাই। দুই দিদা, জেঠু, এমনকী মা …। আমরা সবাই কি এক জায়গায় বাস করি? বোধ হয় না। এক বাড়ি, কিন্তু আলাদা ঘর, প্রত্যেক ঘরে ঢুকতে হাওয়া নিজেকে একটু পাল্টে নেয়। এ যেন পান্থনিবাস। একসঙ্গে অথচ আলাদা আলাদা আমরা কোথায় চলেছি?
হঠাৎ শুনি— খাবার ঘরে যেন একটু জোর গলা শোনা যাচ্ছে। দুই বৃদ্ধা চকিত হয়ে উঠলেন। গলাটা কিন্তু বাবার নয়। একটু শুনে বুঝতে পারি ফিনকির।
—এর কোনও মানেও হয় না, ক্ষমাও হয় না —ফিনকি বলছে। ওর কানের রিং দুলছে। গাল চকচক করছে। এক হাত দিয়ে ওড়নাটা পিঠে ফেলল। ও বাবাকে একটুও ভয় বা সমীহ করে না।
—আমার যদি ইচ্ছে না হয় … বাবার গলার স্বর এমনিতেই গম্ভীর। এখনও গম্ভীর শোনাল। কিন্তু তার ভেতরে কোথাও একটা দুর্বলতা আছে। ফিনকির ক্রুদ্ধ মূর্তির সামনে বাবা নিরস্ত্র।
—আমারও যদি ইচ্ছে না হয় তোমার সঙ্গে এরকম গল্প করি, মায়ের যদি ইচ্ছে না হয় প্রতিদিন তোমার ফরমাশ খাটতে, ছোড়দার যদি ইচ্ছে হয় দাদার মতো বিদেশে চাকরি নিতে …
—মানে? সমু কি অন্য জায়গায় …
—ছোড়দা জামশেদপুর কি বম্বে গেলে অনেক বেশি মাইনে পেত। যায়নি। কেন সেটা তোমার বোঝা উচিত। সবাইকার কথা ভেবে কিছু কিছু জিনিস অনিচ্ছাসত্ত্বেও করতে হয়। জেঠু আজও তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। উনি ভাবছেন উনি কাজকর্ম করেন না বলে তুমি রাগ করেছ। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি বাবা, রোজ তোমার ওই একঘেয়ে গল্প শুনতে আমার ভাল লাগে না, লাগে না, লাগে না। শুধু তোমার ভাল লাগবে বলে শুনি।
মায়ের গলা শুনি— আঃ, ফিনকি!
—কাল থেকে আর শুনব না। আসব না। আমার কী দরকার! তা ছাড়া ইচ্ছে হলেই তো আমি কানাডায় চলে যেতে পারি।
—অ্যাঁ? বাবা একটা ফ্যাঁসফেঁসে চিৎকার করলেন।
—হ্যাঁ, কাকা আমাকে অফার দিচ্ছেন, আমি যেতেই পারি, আমার জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যাবে।
হাতে গরস বাবা, লুচির ঝুড়ি হাতে মা স্থাণু হয়ে বসে এবং দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমি সেই সময়ে ঢুকি। ফিনকিতে এসে বাবার পথ মায়ের পথ মিলে গেছে। ফিনকিই আমাদের একমাত্র ভরসা।
—আমার ভয় করে। সে সময়ে দাদার বাই চাপলে আমাকে মেরে পাট করে দিত। পাঁজরে চিড় খেয়েছিল একবার। সমু তুমিই বলো আমার ভয় করাটা কি অন্যায্য?
—কীসের ভয়? —কীসের কথা হচ্ছে, মা?
বাবা বললেন— তোমাদের জেঠুর কথা হচ্ছে। তোমরা তো নিয়ে এসে খালাস। এখন আমাকে জোর করছ কাছে যেতে। আই ডিটেস্ট হিম।
—একবার গেলে হয়তো আর অতটা …. থাকবে না, তুমি গিয়েই দেখ না। আজ জেঠু ঘুমিয়ে পড়েছেন। কাল একবার যেয়ো। ফিনকিকে সঙ্গে করেই না হয় যেয়ো। —আমি খুব হালকা চালে বলি।
—তোমরা আমাকে … বাবা রাগে আবেগে থরথর করতে করতে উঠে গেলেন। আমি ফিনকিকে বললুম— তুই বাবার খাবার সময়ে কথাটা তুললি কেন?
—আর কখন পাই? এক খাওয়ার পরে ওপরে বাবার ঘরে গিয়ে বলতে হয়। কাছেই জেঠুর ঘর, জেঠুর কানে গেলে কী হবে বল তো! বাবা তো আস্তে কথা বলবে না!
বলে ফিনকি ফিক করে হেসে ফেলল—বাবার খাওয়া প্রায় হয়েই এসেছিল, দ্যাখ একটা মাত্র লুচি পড়ে আছে, বাটিতে একটাই আলুর দম। মা, এবার তোমার পাখির আহার নিয়ে এসো, ছোড়দাও এসে গেছে।
—আমার একটু পড়া আছে মা, উঠি? একটু পরেই ফিনকি উঠে গেল। তখন মা, একটু ইতস্তত করে বললেন— সমু, কানাডার কথা ও কী বলছিল!
—দাদুর বাক্সে কাকার চিঠি পেয়েছি কতকগুলো। উনি ওকে নিয়ে যেতে চাইছেন।
—ও কি জানে?
—না। আমার মনে হয়েছিল অফারটার কথা ওকে জানানো দরকার। ওটা ওর প্রাপ্য মা।
—ঠিকই বলেছ। ওটা ওর প্রাপ্য — কথাগুলো কেমন মন্ত্রের মতো আউড়ে গেলেন মা। মা’র মুখ সাদা হয়ে গেছে। থালার ওপর একটা হাত, থেমে গেছে।
—ও অফারটা নিতে চায়নি মা। ওর ধারণা, হয়তো ঠিক ধারণাই। যে কাকা এখন একটু বিপাকে পড়েছেন, তাই-ই নিয়ে যেতে চাইছেন।
—তা হলে বলল কেন?
—হয়তো বাবাকে ভয় দেখাতে।।
—কিন্তু ও যদি জানতে পারে আসল কথাটা ও তো রাগ করতে পারে আমাদের ওপর। তখন? তা ছাড়া নবকুমারের অধিকারটা তো বেশি বটেই।
—মা, সেই আসল কথাটাই এখন নকল হয়ে গেছে। অবান্তর। ওগুলো বলার ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই। আর অধিকারের কথা যদি বলো— ফিনকির আঠারো বছর বয়স হয়ে গেছে। এখন ডিসিশন ওর। একটু খেয়ে বলি— যেমন চলছে চলতে দাও। ভেবো না।
—না, ভাবব আর কী! আমার ভাবনার কী-ই বা মানে?