সমুদ্র যাত্রা (Samudra Jatra) : 15
দেয়ালের ধার ঘেঁষে পিঁপড়ে চলেছে। লম্বা সারি। লাল-পিঁপড়ে। গরম পড়েছে খুব, তাই ওরা বেরিয়ে আসছে। দেয়ালের কোণ বরাবর ওপর দিকেও যতদূর চোখ যায় পিঁপড়ে। কোথাও নিশ্চয় এর একটা আদি আছে, অন্তত। কিন্তু সেটা কই দেখতে পাই না। কোথাও কোনও চিনি, মধু, সন্দেশের গুঁড়ো কিচ্ছু না। তবে খাটটা দেয়ালের ধার থেকে সরিয়ে আনতে হয়। একেবারে মাঝখানে, পাখার তলায়। নইলে পিঁপড়েরা সার বেঁধে বিছানায় উঠে আসবে এবং তখন আমিই ওদের চিনি হয়ে দাঁড়াব। কত লক্ষ যুগ ধরে এই কীটেরা ঠিক এক রকম আছে। একই শৃঙ্খলাবোধ, একই দলবদ্ধতা, একই খাদ্যম্পৃহা, বাড়ি বানাবার রীতি। কোনও বিবর্তন হয়নি ওদের। আরশোলাও শুনতে পাই এ রকমই আর এক আদিম সৃষ্টি। ওদের চোখের সামনে দিয়ে কত তুষারযুগ পার হয়ে গেছে। কত মহাজাগতিক বিস্ফোরণ, কত ধ্বংস, কত সৃষ্টির প্রক্রিয়া অবিরাম চলেছে। এদের তো দেখতে পাচ্ছি। যাদের পাচ্ছি না! কত শত সহস্র ব্যাকটিরিয়া ভাইরাস! ঠিক কীভাবে এই বিপুল প্রাণিময় পৃথিবী চলেছে? কোনও নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হচ্ছে না কেন আর? মানুষই কি বিবর্তনের, প্রকৃতির উদ্ভাবনার শেষ ধাপ? আমি কি সেই ধাপের অন্তর্গত? আমার মধ্যে এত প্রতিক্রিয়ার অভাব কেন? এই এক সময়ে ঘুম থেকে ওঠা। প্রাতঃকৃত্য, চা, মধ্যাহ্নভোজন যা ঠিক মধ্যাহ্নে হয় না। এই অফিস যাওয়া, পুলকারে, অভ্যস্ত নিপুণতায় যে বিদ্যা শিখেছি তার প্রয়োগ সারাদিন ধরে, কারও সঙ্গে তেমন আদানপ্রদান নেই, আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায় ফিরে আসা, সবার প্রতি যা করণীয় তেমন ব্যবহার করা… এর মধ্যে একটা যান্ত্রিকতা নেই? আমার মা, দিদারা, বাবা এঁদের মধ্যেও, এমনকী আমার প্রবাসী দাদার মধ্যেও একটা যান্ত্রিকতা নেই? না, দাদা নয়। দাদা বোধহয় একটা দুঃসাহসিক অন্যরকম কাজ করেছে, স্বার্থপর কাজ কিন্তু অন্যরকম। জেঠুর ছিল তুমুল প্রতিক্রিয়ার জগৎ। অ-যান্ত্রিক ভাবে ভালবেসেছিলেন, প্রতারিত হওয়া সহ্য করতে পারেননি, দুঃখ, লজ্জা, ক্ষোভ, বিশ্বাসঘাতকতার অপমান— তাই তিনি উন্মাদ হয়ে গেলেন। সেই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ার জগৎ থেকে উনি আবার আস্তে আস্তে যান্ত্রিকতায় ফিরে আসছেন। প্রতিক্রিয়াহীনতাই তা হলে যান্ত্রিকতা! ফিনকি কিন্তু যান্ত্রিক নয়। অভ্যস্ত রুটিনের বাইরেও ওর একটা চিন্তাজগৎ আছে। কাকার সম্পর্কে নিঃশব্দে ভাবনা-চিন্তা করে ও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ওর একটা আলাদা আলাদা সম্পর্ক। তার বাইরের ফিনকি, স্কুল-কলেজের গবেষণা-ঘরের ফিনকি কেমন সে ব্যাপারে আমার কোনও ধারণা নেই। কিন্তু আমি আন্দাজ করতে পারি, সেখানেও ও অগতানুগতিক, অযান্ত্রিক। যদি দীপাকে বিয়ে করে ফেলতে পারতুম, তা হলে নিঃসন্দেহে আমার এই প্রতিক্রিয়াহীন যান্ত্রিকতারই বিস্তার হত। মুম্বইয়ের ওই অঘটন বা অতিঘটনের পরেও তো আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠিনি! কোনও রকম উপছে পড়া তো ছিল না আমার মধ্যে! আহার-নিদ্রা-ঔপার্জনিক কর্ম-মৈথুন— এই চক্রে বাঁধা আমি এক মানুষ পিঁপড়ে। তাই, সেটাই বুঝতে পেরে দীপা সরে গেছে, তাকে দোষ দিতে পারি না।
মানুষ স্বপ্ন দেখে। কেরিয়ার নিয়ে। বিবাহ নিয়ে, সন্তান নিয়ে। আমি তো কোনওদিন কোনও স্বপ্ন দেখলুম না! আমার কোনও দিবাস্বপ্ন নেই। যা আছে তা রাতের ঘুমে। যখন আমার যান্ত্রিক উপর-চৈতন্য ঘুমিয়ে পড়ে ভেতর থেকে জেগে ওঠে প্রাচীন প্রত্ন বাড়ি সব এবং স্বাধীন এক অস্তিত্বের ছায়া-উড়ান, সে কখনও চার চৌকো ঘর কখনও বাদামি সাপের আয়ত্ত ছাড়িয়ে উড়ে যায়।
দীপা, দীপা কী অসাধারণ বুদ্ধিমতী তুমি। কীভাবে আমাকে খুঁটিয়ে দেখেছ, বিশ্লেষণ করেছ, না কি এটা বুদ্ধির ব্যাপারই নয়। ইনস্টিংক্ট! বাহবা দীপা, বাহবা। তাই আমার মধ্যে যেটুকু লোভনীয় সেটা নিয়ে আমাকে ফেলে দিয়েছ। ঠিক যেমন বহু পুরুষ মানুষ বহু সুন্দরী মেয়েকে ভোগ করে ফেলে দেয়! আমি সাধারণ বাড়ির মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছেলে। আমার ধারণা দৈহিক মিলনের সঙ্গে বিবাহের একটা অবিসংবাদী সম্পর্ক রয়েছে। তাই ধরেই নিয়েছিলুম দীপা ও আমি বিয়ে করব। ভেবে দেখিনি দীপাকে আমার কতটা ভাল লাগবে। তার প্রতি দৈহিক আকর্ষণটাই বা আমার কতটা গভীর। সে আমার নারী কি না। ভাবিনি, কিন্তু দীপা চমৎকার ভেবেছে। বেশ পরিকল্পনা করে আমার কৌমার্যভঙ্গ করে দীপা এক রাত্রির উন্মাদনা ভেতরে নিয়ে নির্ধারিত পাত্রের গলায় মালা দিতে চলে গেল। তার ভেতরে কোনও দংশন নেই। তার চেয়েও বড় কথা, দংশন আমারও নেই। দীপার অর্থে নয় অবশ্য। প্রথমে বিস্ময় কিছুটা রাগ এসব তো হয়েছিলই। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি সেটা কাটিয়ে উঠেছি। দীপা নামে একরাত্রির বনিতার জন্যে আমার কোনও বিরহবোধ নেই। প্রত্যাখ্যানে তেমন কোনও জ্বালা নেই। খালি টের পাচ্ছি, আমি একটু অদ্ভুত, যাকে আমি যান্ত্রিক বলছি, তাকেই কি দীপা আনরিয়্যাল বলছে? তুমি কী রকম আনরিয়্যাল সমুদ্র… যে কোনও মুহূর্তে কর্পূরের মতো উবে যেতে পার।
আমি আনরিয়্যাল কী? চারপাশের জগৎটাকেই তো আমার আনরিয়্যাল লাগে! ক্রমাগত হর্ন বাজাতে বাজাতে ঝড়ের বেগে ট্যাক্সি চলে গেল। কিছু লোক রাস্তা পার হচ্ছে, কেউ দেখে-শুনে, কেউ হাত তুলে গাড়ি থামাতে থামাতে। পুলুর ফোন— ‘সমু কেমন আছিস রে? আমাদের এখানে কেউ কাজ করে না। খালি ইউনিয়নবাজি, টিকতে পারব কিনা জানি না, সুযোগ পেলেই বাইরে চলে যাব, তুইও চেষ্টা কর।’ সমু বলে একটি ছেলে ছিল। পুলু বলে আর একটি ছেলে ছিল। পুলু খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। অনেক সময়েই রক্ষকের ভূমিকা নেয়। সমু? সমু কোনও ভূমিকা নেয় না। তার কোনও উদ্যোগ নেই। পুলু অন্যত্র চাকরি পেয়ে চলে গেল। মাঝে মাঝে তার কথা মনে হতে হতে সমু একদিন পুলুকে একেবারে ভুলে গেল। তখন একদিন জয়ন্তী বলল— পুলককে চেনেন? আমার কাজিন। তাই তো? —অবশ্যই পুলু সমুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। একদিন পুলু ফোন করল—‘সুযোগ পেলেই বাইরে চলে যাব, তুইও চেষ্টা কর।’
পুরোটাই একটা গল্প। তার খুঁটিনাটি ভুলে গেছি। সেই সমুকে, সেই পুলুকে মনে আছে ঠিক যেমন ভাবে ছোটবেলায় পড়া গল্পের অনুভূতিটা মনে থাকে, আবছা-আবছা। আবার পড়তে গেলে সেরকম ভাল লাগে না আর।
জেঠু খুক খুক করে সন্তর্পণে কাশছেন, কোনও গল্পের জেঠু। মা, বাবাকে খেতে দিয়েছেন। সমু ঢুকছে। মা মুখ তুলে না তাকিয়েই বললেন—বসো সমু, ডালটা সম্বরা দিতে বাকি। —একটা ছবি, ভিডিয়োতে তুলেছি কোনও সময়ে, দেখছি আবার। অ্যামবাসাডারের সামনের সিটে অনিন্দ্য, পেছনে জয়ন্তী, আমি ঢুকে যাচ্ছি। ঠ্যালাগাড়ি লোহার বোঝা চাপানো— লোহার রড। এগুলো আমাদের দরকার হয়, সামনে দুজন পেছনে দুজন ঘামে চুপচুপ হয়ে টানছে, পেছনে এসে ধাক্কা মারে। শুয়োরের মতো মুণ্ডু নিচু করে একটা নির্দিষ্ট গতিতে আসছিল, টাল সামলাতে পারেনি। ড্রাইভার নেমে যাচ্ছে। প্রচণ্ড হুঙ্কার দিচ্ছে। গাড়ির সাইডটা টাল খেয়ে গেছে। অনিন্দ্য নেমে দাঁড়ায়— ‘আঃ সুদর্শন। ছাড়ো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে করতে ঢোকে সুদর্শন— জানেন না সার, মারুতি হলে সাইড ফুটো হয়ে যেত। মেমসাহেবের গায়ে সোজা এসে ফুঁড়ে যেত… নেহাত… গোঁ-ও-ও করে স্টিয়ারিং ঘোরায় সুদর্শন যেন ম্যাটাডরের হাতের লাল কাপড় দেখা খ্যাপা মোষ শিং বাঁকিয়ে ছুটে যাচ্ছে।
আমি মৃদু হেসে বলি— জয়ন্তী আজ খুব বেঁচে গেলে কিন্তু।
—ঠাট্টা নয় সমুদ্র, সত্যি! মৃত্যুর থেকে মোটে আড়াই ইঞ্চি দূরে।
—রিয়্যালি, আজ জয়ন্তীর একটা ফাঁড়া গেল। অনিন্দ্য বলল, তবে তোমারও স্বস্তিতে থাকবার কিছু নেই সমুদ্র! ভেবে দেখ ঠিক কী ছিল মোমেন্টামটা, গাড়ির খোলটার রেজিস্ট্যান্স কতটা, ব্যাটা জয়ন্তীকে ফুঁড়ে তোমার দিকে এগোত, না ওকে জাস্ট একটা ঝটকা মেরে তোমার দিকে এগোত… কষে না ফেললে তো বোঝা যাবে না?
যতীন্দ্রমোহন থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ পার হয়ে আমরা এসপ্ল্যানেড ঢুকে যাই। কে যেন কোথাও থেকে বলেছিল ‘অ্যাকশন রিপ্লে’, এখন বলল— ‘কাট’। সারা দিন ধরে কাজে, অকাজে, অফিসে, বাইরে, একা, সহকর্মীদের সঙ্গে, ক্যান্টিনে, ইউরিন্যালে… দুঃশ্রাব্য কণ্ঠ নিচু স্বরগ্রামে অমোঘ স্বরস্থাপনা করে যায়— ‘অ্যাকশন’, ‘অ্যাকশন রিপ্লে’ ‘কাট’ —‘ওভার।’
‘মৃত্যুর থেকে আড়াই ইঞ্চি দূরে’ —এই শব্দযূথ আমার মাথা থেকে কিছুতেই যেতে চায় না। সারাদিন ঘুরে ফিরে কথাগুলোর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। এমন ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে যাই যে ক্যান্টিনে বেয়ারাকে আর একটু হলে বলে ফেলেছিলুম, ফিসফিস করে।
শিবেন বলল— কী বললেন সার, আড়াই ইঞ্চি দূরে?…
—উঁহু,— আমি সজোরে মাথা নাড়ি, আড়াই ইঞ্চি পুরু বুঝলে? ওমলেটটা করবে আড়াই ইঞ্চি পুরু।
—সে আবার হয় না কি সার? চার পাঁচটা ডিম দিয়ে সে যে একটা ছোট মতো যাচ্ছেতাই হবে…
—আহা হা, তোমরা ময়দা দিয়ে ডিম দিয়ে কী যে একটা করো না?
—ও, মোগলাই পরোটার কথা বলছেন? তাই বলুন সার, ওপরে কিমা দেব তো!
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো বুঝেছ… আমি ওকে ভাগাই।
—হঠাৎ আজ তোমার মোগলাই পরোটার শখ?— পাশের টেবিল থেকে সুমিত বলল।
—হল… আমি প্রশ্নটাকে ওইখানেই থামিয়ে দিই। ওই যে বললুম কারও সঙ্গে আমার ঠিক জমে না। শুধু শুধু বেকার কথা কতকগুলো… আসে না। মোগলাই পরোটার সুতো ধরে অনেক দূর যাওয়া যেত। সুমিত তো অনায়াসে পারত। তৈরি হয়েই ছিল। ক্যান্টিনের রান্নার কোয়ালিটি। অফিসার গ্রেডের জন্যেই বা একটা সার্টন পার্সেন্টেজ সাবসিডি থাকবে না কেন? সেটা কি আমাদের পার্কস-এর অন্তর্গত হওয়া উচিত নয়? …এর থেকে মোগলাই কোথায় কোথায় ভাল করে, কোন রেস্তরাঁয় আলাদা করে মোগলাই ঘর খুলছে… এই মতো এক শব্দ-শৃঙ্খল, অবসর কাটানোর, শুধু সময় কাটানোর একটা খেলার মতো। এ একটা বলল, ও আর একটা যোগ করল। সে একটা… যে কোনও প্রসঙ্গ ধরে চলতে পারে এই খেলা— মোগলাই কুইজিন, অসুখ, মোজা, ফিলম, এন্টার দ্যা ড্রাগন, এম্পারার… ডাক্তার, নারী, লায়েবিলিটি, ভ্রমণ, ট্রাম-বাস, রাজনীতি, যুদ্ধ, পারমাণবিক অস্ত্র। যে কোনও, যে কোনও বিন্দু থেকে এক অনন্ত শব্দঘর তৈরি হতে পারে, হয়ে চলেছে অবিরাম। গমগম করছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণ এই রকম নানান অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গে। হয়তো অপ্রাসঙ্গিকও নয়। আসলে খুব দায়িত্বহীন লঘু জল্পনা, শব্দ থেকে শব্দে বয়ে যাচ্ছে শুধু। কোনও সিদ্ধান্ত বা সমাধানের ঘাটে ভিড়ছে না।
কে যেন বলে ওঠে জীবনটা তো শুধু সিদ্ধান্ত নয়। সমাধানও নয়। সমাধান হলে তো হয়েই গেল। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে তো মন-মগজের আর কোনও কাজ থাকে না।
—তা হলে কী? তা হলে কী?
—তাই এই টেবিল। চারপাশে চেয়ার। উৎসাহী মুখ, তাই-ই এই শব্দযোগ। এ কোনওদিন শেষ হবে না। এটাই মজা এ খেলার।
—অর্থহীন মনে হয় যে! আধ-পাগলের সিকি-পাগলের প্রলাপ।
—অর্থ নেই। মানে নেই, শেষ মানে কে বলবে? অথচ বেঁচে থাকতে হলে, ভাবতে হয় মানে আছে। শব্দ শুধু শব্দ নয়, তার পেছনে মানে, তার পেছনে আইডিয়া। এমন একটা মোহচক্র তৈরি করতে পারাই বেঁচে থাকা।
ক্রমাগত তারিখ পেছোতে পেছোতে শেষ পর্যন্ত আজ ত্রিমূর্তি— সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় অর্থাৎ জয়ন্তী, মুকুলিকা ও দীপা আমাদের বাড়ি এসেছে। মেয়ে বলতে এতদিন আমি কয়েকটা রকম বুঝতাম। মা-রকম বোন-রকম সহকর্মী-রকম আর যৌনটান-রকম। তাই কোনওদিন তাঁদের দিকে ভাল করে তাকাইনি। কেন না মা একটা বলয়, তেল-হলুদ-ধনে-জিরে-সাবান-সিঁদুর, মৌন নম্রতা যাকে ইদানীং আর নম্রতা নয় উদাসীনতা বলে মনে হয়। বোন অবশ্য, বিশেষ করে আমার বোন, ঠিক শুধু একটা বলয় নয়। সে সমকেন্দ্রিক বৃত্তের মতো। মধ্যবিন্দুতে সেখানে ভালবাসা, যেখানে বিশ্বস্ততা সেখানে ঠিক আছে। কিন্তু তার বাইরে যে তরঙ্গ ক্রমাগত বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে তার সবটা আমি চিনি না। তবু জানি এইখানে একটা অনুকূল হাওয়া বয়, সারা দিন-রাত, ইচ্ছে করলেই সেই হাওয়ায় আমি স্নান করতে পারি। আমি ইচ্ছে করি না যখন-তখন। কিন্তু ফিনকি এখনও পর্যন্ত আছে। জয়ন্তীরা এতদিন ঠিক অনিন্দ্যদের মতোই ছিল, কেবল মেয়ে বলে তাদের সঙ্গে একটু বেশি সৌজন্য, বেশি দূরত্ব ছিল, দূরত্ব তো সবার সঙ্গেই। সৌজন্যেরও কোনও কমতি নেই। তবু জয়ন্তীরা লেডিজ সিট, লেডিজ ফার্স্ট। আর যৌন-টানটা ছিল নারী-নিরপেক্ষ। এক সময়ে, এখনও মাঝে মাঝে নিজের ভেতর থেকেই সেই টান অনুভব করি। ঠিক অন্য দৈহিক টানগুলোর মতো। মেয়েদের সংস্পর্শে যে যৌনতা জাগে তার সম্পর্কে আমি খুব সতর্ক। সেই চুম্বক কোথাও টান মারছে বুঝলেই আমি সরে যাই। দীপা আমাকে নারীস্পর্শের সম্মোহনের কথা দারুণ চিনিয়ে দিয়েছে। তাই আমি আর একটু চক্ষুষ্মান হয়েছি। ব্যক্তিস্বরূপিণী নারী কে কী সে সম্পর্কে আমি আর অত অবোধ অত অন্ধ নেই। তাই-ই বললাম সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়।
জয়ন্তী সব সময়ে আগে এগিয়ে আসে। তার সমস্ত ধরনের মধ্যে একটা সরল আহ্বান আছে যা এক ভারহীন সম্পর্ক তৈরি করে। — আপনি পুলককে চেনেন? —আমার কাজিন… ওর কাছ থেকে আপনার কথা কত শুনেছি।… একদিন আপনাদের বাড়ি নিয়ে যাবেন…উঁহুহু বলে নয়… না বলে… ফিনকি কে?… ঠিক আছে ওকে, শুধু ওকে… এই রকম আধা-অন্তরঙ্গ কথায় জয়ন্তীর উপস্থিতি। ফর্সা, একটু মোঙ্গলীয় ধরনের চাপা মুখ। বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা চোখের বাঁকে, নাকের টানে। মুকুলিকাকে আমি আগে কোনওদিন দেখিনি ভাল করে, কেন না ও খুব চুপচাপ, নিজেকে লুকিয়ে রাখে। খুব হালকা রঙের শাড়ি পরে, প্রসাধন করে না, রং উজ্জ্বল কিন্তু ফর্সা নয়, ওর চুল কাঁধের একটু নীচে পর্যন্ত ঢেউ খেলানো। একটা ক্লিপ দিয়ে আটকে রাখে। মুখটা একটুও ভাল মানুষ ভাল মানুষ নয়। অথচ আন্তরিক। ও কিন্তু সোজা মুখের দিকে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। যেন কিছু বলতে চায়। বলবার আছে। কিন্তু বলবে না। নিজের ভেতরে রেখে দেবে। না বলা কথার রহস্য মুকুলিকাকে কী রকম দুর্বোধ্য করে রেখে দিয়েছে। দীপা আজ এসেছে মোহিনী বেশে নয় একেবারেই। তার ছোট চুল একটু বড় হয়েছে বুঝি বা। চৌকো গড়নের মুখে স্মার্টনেস খেলা করে বেড়াচ্ছে, সাদা শাড়ি পরেছে একটা। তাতে ওকে খুব অধ্যাপক-অধ্যাপক লাগছে দেখতে।
জয়ন্তী বলল— জানেন তো মাসিমা, পুলু যে আমাকে সমুদ্রর কথা কত বলেছে! কত বলেছে! এক অফিসে কাজ করবি তো, দেখবি কী ম্যাচিওর, সব ঠিক করে দেবে।
মা মৃদু হাসলেন— কী ঠিক করে দেবে? ঠিক করে দেবার কী আছে!
—বাইরে তো আর বেরোননি মাসিমা, কর্মক্ষেত্র যে একটা কী জিনিস। —দীপা বলল।
—তা সমু সব ঠিক করে দিয়েছে? মা মুকুলিকার দিকে তাকিয়ে বললেন। ও শুধু হাসল। সে হাসির অনেক রকম মানে হতে পারে। হয়তো বলতে চায়। —হ্যাঁ সব ঠিক করে দিয়েছে। হয়তো বলতে চায়— ঠিক করে দেবে? অত সহজ? আবার হয়তো কোনও মতামত দিতে চায় না। কোনটা আমি বুঝতে পারিনি।
মা বললেন— হ্যাঁ আমার ছেলে খুব করিৎকর্মা।
এই প্রথম আমি মায়ের মুখে কোনও বিশেষণ, আমার কোনও বর্ণনা শুনলাম। ‘আমার ছেলেটুকু প্রথমে একটা তীব্রতায় এসে আছড়ে পড়ল আমার বেলাভূমিতে। তাই তো! মা তা হলে জানেন, স্বীকার করেন আমি মায়ের ছেলে? ‘আমার ছেলে’ না বলে তো ‘ও’ বলতে পারতেন, ‘সমু’ বলতে পারতেন, তা হলে আমার কিছুই মনে হত না। কিন্তু ‘আমার ছেলে’ বলার মধ্যে একটা মালিকানার স্বীকৃতি এমনকী অহঙ্কার আছে সেটা একটু পরে আরও স্পষ্ট হয়— ‘করিৎকর্মা’। এই বিশেষণটা আমার সম্পর্কে আদৌ প্রযোজ্য তা কখনও মনে করিনি তো? কোনও হীনম্মন্যতা আমার নেই। কিন্তু আমি একটা করিৎকর্মা মানুষ। মানে অনেক কিছু চটপট পারি? কী-ই বা পেরেছি আমি কতকগুলো রুটিন কাজ ছাড়া? কীই বা পারতে চাই?
দীপা বলল— সেটা কিন্তু আমরা প্রথম-প্রথম একেবারেই বুঝতে পারিনি। হি নেভার শোজ অফ্। কিন্তু কাজের সময়ে দেখি জাস্ট দু-চারটে কথা দিয়ে সব ঠান্ডা করে দিল।
ফিনকি চোখ বড় বড় করে বলল, ঠান্ডা করে দিয়েছিস? ছোড়দা? তেড়ে মেরে ডাণ্ডা, না কি?
সেটাই তো— জয়ন্তী হাসল— সমুদ্রকে ডাণ্ডা ধরতে হয় না। ওই যে দীপা বলল জাস্ট দু-চারটে কথা!
—তা-ও উঁচু গলায় না, রেগেমেগেও না, এতক্ষণে মুকুলিকা বলল। এই মেয়েটিও তা হলে সব লক্ষ করেছে! আমি রাগি না, উঁচু গলায় কথা বলি না। ইত্যাদি ইত্যাদি।।
—তাই তো আমরা বলাবলি করি— দীপা বলল—একজন ডিপ্লোম্যাট হবার সব গুণ আছে সমুদ্রর। কী? কিছু বলো সমুদ্র? আমরা এত কিছু বললাম।
আমি মৃদু হেসে শুধু বলি— ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।’
দীপার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রংটা ফর্সা বলে ফ্যাকাশে হওয়াটা চট করে সবাই বুঝতে পারবে না। কিন্তু ওর মুখ-চোখ, কথা-বলা, চলন সবকিছুর মধ্যেই একটা উচ্ছ্বাস, সজীবতা আছে। সেটাই নিভে গেল। তবে সে-ও ডিপ্লোম্যাট কম নয়। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল— বাপ রে কতক্ষণ ধরে আর এই তেলানো চলবে তোদের জয়ন্তী! মাসিমা স্যরি। একেবারে কবিতা-টবিতা, সেন্টিমেন্টালিটির চরম। চলো চুমকি তোমাদের বাড়িটা খুব ইন্টারেস্টিং। তুমি কোন ঘরে থাক, চলো দেখে আসি।
—চুমকি নয়, ফিনকি।
—এমা, স্যরি ভাই।
—স্যরি হয়ে আর কী করবে! এই ভুল অনেকেই করে। আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। চলো, দেখবে তো! ছোড়দা তোর বন্ধু, তুইও আয়।
ফিনকি ওদের নিয়ে এগিয়ে যায়। আমি মায়ের দিকে চাই— কিছু আনব টানব? শিঙাড়া কচুরি মিষ্টি…
—না, ফিনি তো খুব কষেটষে মাংস রাঁধল। আমাকে বলে গেল। লুচি করতে। আমি রান্নাঘরে যাই। তুমি ওপরে যাও। —যাবার সময়ে মা বলে গেলেন— মেয়েগুলি বেশ।
আমার দিকে বিশেষ ভাবে তাকালেন না। অথচ কথাগুলোর মধ্যে কোথাও একটা বিশেষ সুর আছে। মা যেন তাঁর সম্মতি জানাচ্ছেন। হ্যাঁ ঠিক আছে। গো অ্যাহেড।
আমাদের এই সব পুরনো বাড়ির এই রকমের সেকেলে ধাঁচ। বাড়িতে কোনও মেয়ের আগমন হলেই এঁরা ভাবেন, এটা বিয়ের জন্য দেখতে আসা, দেখাতে আসা। চাপা বিরক্তিতে আমার গা গুলিয়ে ওঠে। সেই কোন কাল থেকে মেয়েদের সঙ্গে ক্লাস করছি, ওয়ার্কশপ করছি, এখন চাকরি করছি। মেয়ে-বন্ধু মানেই প্রেমিকা এই বস্তাপচা ধারণাটার বাইরে আমাদের অন্দরমহল কিছুতেই আর ভাবতে পারল না। অন্তত পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে এখনও। আমি বেরিয়ে যাই। কাছাকাছি এক বিখ্যাত দোকান থেকে দু’ রকম মিষ্টি কিনি, এই সন্দেশগুলো খেতে খুব ভাল। ভেতরে বাদামের পুর দেওয়া, ওপরে গোলাপ গন্ধ। আর লেডিকেনি এরা করে একেবারে বিয়েবাড়ির ভিয়েনের মতো। মিষ্টিগুলো মায়ের কাছে জমা দিই। মাকে বলি— একটা প্লেটে কিছু মিষ্টি দিতে। জেঠুকে দেব। উনি মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসেন।
মিষ্টি নিয়ে জেঠুর ঘরে ঢুকছি, পাশের ঘর থেকে ঝনঝনে হাসির ঝঙ্কার এসে কানে লাগল।
আমাকে দেখে জেঠু ভিতু খরগোশের মতো মুখ তুলে বললেন— কে সমু। কে, ওরা কে?
—ওরা তিনটি মেয়ে জেঠু, আমার কলিগ। জাস্ট বেড়াতে এসেছে।
—ফিনকির মতো?
—হ্যাঁ। আর একটু বড় হবে। আপনার জন্যে মিষ্টি নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিন।
—খুব মাংসের গন্ধ পাচ্ছি।
—হ্যাঁ। রাতে খাবেন। লুচি দিয়ে।
—না, না রুটি। গ্যাস ভাল না। আমার গ্যাস হয়। সমু, ওঁদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেবে না?
—আপনি করে বলছেন কেন? ওরা আপনার মেয়ের মতো।
—তবু…
—তবু নয়, আপনার মতো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ আপনি-আপনি করলে কারও ভাল লাগবে না।
উনি আমার মুখের দিকে ব্ল্যাঙ্ক চেয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ। তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—ওখানে কোনও মেয়ে ছিল না, জানো। রাঁধুনি না, ঝি না, নার্স না, সব ধুম্বো ধুম্বো ব্যাটাছেলে। কী বলব আমার দম আটকে আসত সমু। একেবারে রিভোল্ট করত মনটা…
—আরে এখানে?…
মুখটা আস্তে আস্তে নরম হয়ে এল— এখানে মা আছেন, মেয়ে আছে, ঠাকুমা আছেন, আহ্— কী শান্তি! কী শান্তি! আমি বড় শান্তিতে ঘুমোই সমু।
কী বলতে চাইলেন জেঠু। মেয়ে থেকে ওঁর আর ভয় নেই? পুরনো বিশ্বাসাঘাতের জ্বালা জুড়িয়ে গেছে? উনি কি এখন মেয়েদের প্রকৃত মূল্য, মানুষের জীবনে কোথায় তাদের স্থান—তা উপলব্ধি করেছেন? কে জানে? তবে আমার সামান্য একটু দ্বিধা ছিল সেটা কেটে গেল। যদিও ওঁর কথা আমি পুরোপুরি বুঝেছি বললে ভুল হবে।
হইচই করতে করতেই ওরা ফিনকির সঙ্গে এ ঘরে এল। জেঠু তখনও তাঁর লেডিকেনি শেষ করেননি।
চট করে উঠে উনি হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। হাত থেকে স্টিলের রেকাবি আর চামচ ঝনঝন করে পড়ে গেল। আধখানা লেডিকেনিও।
—এমা! ও জেঠু এ কী করলেন? নমস্কার করতে আপনাকে কে বলেছিল? কলকল করে উঠল জয়ন্তী।
—ছি ছি, ফিনি দাঁড়াও মা আমি তুলে দিচ্ছি। —ফিনকিকে কিছুতেই তুলতে দিলেন না ওগুলো।
—খালি অপাট। খালি অপাট— তোমার নমস্কার আগে না লেডিকেনি আগে? কৌতুকের স্বরে ফিনকি বলল, ঝটিতি একটা ন্যাতা নিয়ে এসে মুছে নিল লেডিকেনির রস।
ওরা তিনজনে নিচু হতেই জেঠু কাঠের পুতুলের মতো হাতজোড় করে চোখ বুজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এ রকম একটা গরুড়ের স্ট্যাচু যেন আমি কোথায় দেখেছি।
জেঠুর ঘরে বসে, দাঁড়িয়ে ওরা অন্তত মিনিট দশেক গল্প করল। দেয়ালে সাঁটা বোর্ডের ওপর ফর্মুলাগুলো দেখল। তারপর চলে আসতে আমি বাঁচলুম।
লুচি-মাংস-মিষ্টি ইত্যাদি চেটেপুটে খেয়ে একেবারে বিদায় হতে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি।
—ওফ্ফ্ফ্ ।
—তুই তো এত ভিতু অধৈর্য ছিলি না ছোড়দা!
—তাই বলে বাড়ি এসে ঘরে ঘরে ঢুকে ইন্সপেক্ট করবে? চলো তোমার ঘরটা দেখে আসি। এনক্ৰোচমেন্ট নয়?
—তোর ঘরটা কিন্তু দেখাইনি। বন্ধ করা ছিল। বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া আমি খুলিনি।
—কেন? বলেনি ‘সমুদ্রের ঘরটা দেখব!’ মুখে তো কিছুই আটকায় না! আমি যদি ওদের কারও বাড়ি গিয়ে এর ঘর ওর ঘর দেখতে চাই, শোভন হবে!
লুটিয়ে লুটিয়ে হাসতে লাগল ফিনকি। তারপরে চোখে হাসির জল নিয়ে মুখ তুলে বলল—তুই রাগ করছিস, দিস ইজ গুড়।
কেন কী বৃত্তান্ত আমি আর জিজ্ঞেস করিনি। তখন থেকে অফিসের পোশক পরে আছি। ওদের যার যার বাসে তুলে দিয়ে তবে মুক্তি। চান করি। পাজামা-পাঞ্জাবি চাপাই। বেশ শীত পড়েছে, কিন্তু এমনই আমার অভ্যেস। দরজাটা তখনও খুলি না। কেন না ফিনকি নিশ্চয়ই কৌতূহলে বেলুন হয়ে রয়েছে। আমার বেরনোর যা অপেক্ষা। জানলাগুলো শেষ দুপুরের দিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়, মশার জন্য। এখন সন্ধে উতরে গেছে। আমি জানলা দুটো খুলে দিই। আমার জানলার বাইরে কুড়ি ফুট মতো রাস্তা। তার ওদিকে দোতলা বাড়ি— সামন্তদের। বহুদিন আমাদের প্রতিবেশী। পুলুদের বাড়ি এখান থেকে দেখতে পাওয়া যায় না। শীত মানেই ভারী বাতাস, ধোঁয়া-মেশা, ময়লাটে। এই ময়লাটে হাওয়া ভেদ করে আকাশের আসল মুখ দেখতে পাওয়া যায় না। এ যেন অস্বচ্ছ পর্দার ওপারে কোনও পর্দানশিনের মুখ, উৎসুক হয়ে যাত্রা দেখতে বসেছে। দেখা যায় না। দেখতে খারাপ লাগে। এত বিকৃতি। তবু ওই দিকেই তাকিয়ে থাকি, মনে প্রশ্ন নিয়ে, অস্বস্তি নিয়ে আর কোন দিকেই বা আমরা তাকাতে পারি!
জয়ন্তীকে প্রথম তুলে দিই বাসে, বন্ধুদের দিকে চেয়ে খুব অর্থপূর্ণ হাসি হেসে ও বাসের হ্যান্ডেল ধরে উঠে গেল। শীত বলেই বোধহয় তেমন ভিড় নেই।
মুকুলিকা লাল চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নিল— আস্তে করে বলল —আপনি কি লাকি! বাড়ির লোকেরা সবাই কী ভাল! শুধু আপনার বাবাকে দেখা হল না।
আমি ঘড়ির দিকে তাকাই— আটটা বাজে, আর ঘণ্টাখানেক টেনে থাকতে পারলে শুনতে পেতে!
—শুনতে পেতুম? কী?
—আমার বাবার আগমন বা আবির্ভাব যাই বলো।
—দেখা নয়? শোনা? —দীপা বলল।
—শোনাও শুধু নয়, টের পাওয়া যাকে বলে।
দুজনে দুরকম স্বরে হেসে উঠল।
—তা হলে তো উনি তোমার মতো নয়।
—না, উনি বাড়ির সবার প্রাণশক্তি একাই ধারণ করেন।
—ইন্টারেস্টিং— দীপার উক্তি।
আমি বলি— তোমার দেখাশোনার সবটাই কি ইন্টারেস্টিং আর আন-ইন্টারেস্টিং-এ বিভক্ত?
তাকাইনি তবু বুঝতে পারছি মুকুলিকা মিটি মিটি হাসছে।
—তোমার জীবনের সবটাই যেমন কর্তব্যে আর অকর্তব্যে বিভক্ত।
আমি উত্তর দিতে যাই না আর। কেন না এ তো স্পষ্ট ও জিততে চায়। যা চায় তা ওকে পেতেই হবে। আমাকে চেয়েছিল, পেয়েছে। এখন কথার খেলায় জিততে চাইছে। জিতুক।
মুকুলিকার বাস এসে গেল, ও থাকে উল্টোডাঙার দিকে, সল্টলেকের মুখে।
—তুমি একটা ট্যাক্সি নিলে পার— আমি দীপাকে বলি।
—ওহ্, আর একটুও আমাকে সহ্য করতে পারছ না, না? ঝাঁঝিয়ে উঠল দীপা।
আমি জবাব দিই না। ওর অভিযোগ হোক, অনুযোগ হোক সেটা তো সত্যিই! আমি কি বলব? —ঠিক বলেছ দীপা, তুমি বড় আনইন্টারেস্টিং।
বলা যায় না। এ ধরনের অভদ্রতা, ঝগড়া-কাজিয়া আমার চরিত্রে নেই।
—মৌন মানেই সম্মতি। ঠিক আছে আমাকে সইতে পারছ না। ইটস ন্যাচারাল। যাই হোক, তোমার জেঠু একটু… মানে বই-টইগুলো দেখছিলাম— খুব পণ্ডিত লোক মনে হল, বিয়ে করেননি কেন?
আমি ধীর গলায় বলি— দীপা, যে বাড়িতে তোমার আসার কথা ছিল, অথচ আসনি, সে বাড়ির সব কথায় তোমার এত কৌতূহল কেন? এটা ঠিক নয়।
ও একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে— স্যরি। কৌতূহল নয়। আমার কেমন মনে হল উনি খানিকটা তোমার মতো। চেহারায়, স্বভাবে। তাই—
—হতেই পারে। বাড়ির একজনের সঙ্গে আর একজনের চেহারার, স্বভাবের মিল থাকতেই পারে। কিন্তু তাতে কী? আমার সম্পর্কে জানার প্রয়োজন তো তোমার ফুরিয়ে গেছে। আমার জেঠু আমার মতো না আমার কাকু আমার মতো এ খবরে তোমার কাজ কী!
রাস্তার আলো ওর মুখের ওপর দিয়ে যাওয়া-আসা করছে। আমি বুঝতে পারছি ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিবিষ্টমনে টু বি বাসের আসার পথের দিকে চেয়ে আছি।
—সমুদ্র। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আমার জন্যে না, আমি জয়ন্তী আর মুকুলের জন্যে খোঁজখবর করছিলাম। ওরা দুজনেই তোমাকে দারুণ পছন্দ করে। তুমি বয়স বাড়লে কীরকম হবে…
এইবারে আমার ধৈর্যভঙ্গ হয়। আমি বুঝতে পারি আমার মাথা দিয়ে চিড়িক বিজলি হেনে যাচ্ছে ক্রোধ। আমার তা হলে ক্রোধ আছে!
বলি— তুমি তা হলে একদিকে আমার আর আর একদিকে তোমার দুই বান্ধবীর গতি করতে চাইছ। তুমিই আমার, আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা! স্পর্ধা বটে! তবে শোনো, আমার জেঠু যে রকম ব্রিলিয়ান্ট ছিলেন তাঁর ধারে কাছে আমরা কেউ নেই। কিন্তু তিনি আমার ধাতুতে গড়া ছিলেন না। একটি মেয়ে প্রেমের ভান করে তাঁকে রাম ঠকান ঠকায়, তিনি উন্মাদ হয়ে যান। ভায়োলেন্ট। দীর্ঘ আঠারো বিশ বছর তিনি অ্যাসাইলামে ছিলেন। মানে পাগলা গারদ। প্রাইভেট। সম্প্রতি আমি নিয়ে এসেছি। তোমার বন্ধুদের সুযোগ-সুবিধে মতো এই ভেতরের কথাটা জানিয়ে দিয়ো। নাউ, গেট ইনটু দিস ট্যাক্সি।
আমি একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করাই।
—দেশপ্রিয় পার্ক ভাই, ঠিক সে লে যানা।
ট্যাক্সি ছাড়বার আগেই আমি ছেড়ে যাই।