Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সমুদ্রমেখলা || Buddhadeb Guha » Page 2

সমুদ্রমেখলা || Buddhadeb Guha

০৫.

এখনও অন্ধকার আছে। তবে পুবের আকাশ এতক্ষণে চাল-ধোওয়া সাদা রঙে আভাসিত হয়ে যেত, যদি না মেঘ থাকত আকাশে।

চুমকির পরিচিত এক ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সাদা-রঙা একটি কেবিনওয়ালা বোট এ করে ওরা বেরিয়ে পড়েছে পোর্ট ব্লেয়ার-এর জেটি থেকে দ্য হর্নেটস নেস্ট আইল্যাণ্ড-এর উদ্দেশে। বোটটার নাম ওঙ্গে।

যেহেতু সেই পান্ডবর্জিত দ্বীপে আহুক বোস একাই থাকেন, তাই ওরা কিছু ফল, পাউরুটি, মাখন চিজ এবং স্যুপ-এর প্যাকেট নিয়েছে সঙ্গে।

চালিয়াতি বলতে চুমকির একটাই চালিয়াতি আছে, দার্জিলিং-এর চা ছাড়া খেতে পারে না। তাই চা-এর প্যাকেটও নিয়েছে একটা। কনডেনসড মিল্কও।

হু-হু করে জোলো-বাতাস লাগছিল চোখেমুখে। বোটটা বেশ দ্রুতগতিতেই চলেছে। সারেং ছাড়া আরও দুজন সাহায্যকারী আছে। চারধারে কালো জল। আলো নেই বলে কালো নয়, এমনিতেই কালো।

এইজন্যেই কি আন্দামানে যখন বন্দিদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে পাঠানো হত তখন বলা হত কালাপানির দ্বীপে দ্বীপান্তরিত করা হল?

রংকিনী জিজ্ঞেস করল।

তা জানি না। কিন্তু সত্যিই এখানের সমুদ্রের জল কালো।

কেন রে?

সব জায়গায় কি আর কালো? যেখানে জল খুব গভীর সেখাইে কালো দেখায় হয়তো।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অধিকাংশ দ্বীপেই কিন্তু তটভূমি বলতে যা বোঝায় তা নেই। গভীর নিথর সমুদ্রের মধ্যে মধ্যে পাহাড় উঠেছে আর সেই পাহাড়গুলোই দ্বীপ। লক্ষ করেছিস, এইসব পাহাড়ে পাথরও বিশেষ নেই কিন্তু। গভীর জঙ্গল, নানারকমের আদিম গাছ, লতা, গুল্ম। মানুষের লাগানো নারকোল গাছ। এখানে নারকোল কিন্তু স্বাভাবিকভাবে হয়নি।

লক্ষ করেছিস? সব দ্বীপের মাটিই লাল। সিঁদুর-রঙা।

সব জায়গাতেই যে সিঁদুর-রঙা তা নয়। গেরুয়া লাল, ভগুয়া লাল, লামা লাল।

ঠিক বলেছিস। পাথর আছে স্যেশেলস-এর দ্বীপগুলোতে। গ্র্যানাইটের দ্বীপ সবই। বেশিই কালো, কিছু সাদা। চাঁদনি রাতে বা অন্ধকারেও গা-ছমছম করে সেইসব দ্বীপে চাইলে, এমন সব কিম্ভুতকিমাকার প্রকান্ড প্রকান্ড পাথরের চাঙড় চারিদিকে। কিন্তু অমন সব সুন্দর সমুদ্রতট পৃথিবীর মধ্যে খুব কম জায়গাতেই আছে। আর প্রবালের কী বাহার! এখানের জলিবয় আইল্যাণ্ডে দেখলি তো প্রবাল। হলদেটে, ছাইরঙা এবং সবুজাভ। সিনক আইল্যাণ্ডসেও আছে। আর ভারত মহাসাগরের স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের প্রবালদের যে কতরকমের রং। ফিরোজা, লাল, নীল, সবুজ, ফিকে হলুদ। সত্যিই মনে হয় কোনো স্বপ্নের দেশেই এসেছি। আমি তো ঠিকই করে ফেলেছি, বুঝলি রংকি, যে, বিয়ে যদি কখনোই করি, তবে স্যেশেলস-এই যাব হানিমুন করতে।

যদি!

রংকিনী বলল, ছোট্ট করে।

ইয়েস। যদি। আর তুই কোথায় যাবি? হানিমুনে?

চুমকি বলল।

যদি যাই নদীতে।

বল-না। ইয়ার্কি কেন করছিস?

হানিমুনে হানি নেই, মানিব্যাগে মানি। কবে বিয়ে, কার সঙ্গে বিয়ে, তার ঠিক নেই, তার হানিমুন। ছাড় এসব কষ্টকল্পনা। পাগলের প্রলাপ যত্ত।

তার পরে বলল, আমার মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে এবারে সিনক আইল্যাণ্ডস-এ যেতে পারলাম না বলে। নামটা অদ্ভুত তো! তোর দ্য হর্নেটস নেস্ট-এরই মতো। দ্য হর্নেটস নেস্ট নিশ্চয়ই ইংরেজ নাবিকদের দেওয়া নাম। ভয় পাওয়ার মতো এই দ্বীপে অবশ্যই কিছু ছিল। নইলে কি মিছিমিছি এই নাম দেয় ইংরেজ জলদস্যুরা? ওরা কথাতে বলে না–To stir a hornests nest.

ঠিক।

সিনক আইল্যাণ্ডস-এর নাম দিয়েছিল ফরাসি নাবিকেরা। ফরাসিতে সিনক মানে হচ্ছে। পাঁচ।

বানান কী?

Cinque। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ছাব্বিশ কিমি। ওয়াপুর থেকেও যাওয়া যায়। সিনক আইল্যাণ্ডসও ম্যারিন স্যাংচুয়ারি। কী সুন্দর যে, সব প্রবাল আছে। প্রবাল প্রাচীর। কতরকমের মাছ, কত-রঙা শ্যাওলা, অ্যালগি, ফাঙ্গি, প্ল্যাংকটন। যখন ভাঁটি দেয়, তখন এক দ্বীপ থেকে অন্য চারটি দ্বীপেই স্বচ্ছ জল পেরিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কী যে সুন্দর, তা তুই নিজে না গেলে বিশ্বাস করবি না। তবে নিজেদের বোট ভাড়া করে গেলেই ভালো। ভাঁটা তো আর বেশিক্ষণ থাকে না! জল বাড়বার আগেই উঠে আসতে হয় জল ছেড়ে। অবশ্য তখন সাঁতার কাটে অনেকেই, স্নরকেলিংও করে। রাবারের স্নরকেল ভাড়াও পাওয়া যায়। তবে অক্সিজেন সিলিণ্ডার নইলে স্কুবা-ডাইভিং করা যায় না। জলিবয় আইল্যাণ্ডে যেমন দেখলি লেখা আছে Leave only your foot prints behind. সিনক আইল্যাণ্ডস-এও তেমনই লেখা আছে। কোনো জিনিসই ওইসব দ্বীপে ফেলে আসার নিয়ম নেই, সে স্যাণ্ডউইচের বাক্সই হোক কি সিগারেটের প্যাকেট কি কোকা-কোলা বা বিয়ারের টিন।

এই সুঅভ্যেস তো সব জায়গাতেই বয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। কী বলিস তুই?

তা তো বটেই। বিশেষ করে আমাদের, মানে ভারতীয়দের। যাদের অধিকাংশ অভ্যাসই কু। যত সুন্দর জায়গাতেই যাক না কেন, খেয়ে, ফেলে, ছড়িয়ে জায়গাটাকে নোংরা করাই আমাদের চরিত্র। অন্য কেউ যে সেখানে আসবে আমাদের পরে সেকথা আমরা ভাবিই না। স্বার্থপরতার চরম একেবারে।

আমার কিন্তু চিড়িয়া টাপ্পু বেশ লেগেছে। যাওয়ার পথটিই ভারি সুন্দর। কী বিশাল বিশাল মহীরুহ দু-পাশে। পুরো পথটাই পাহাড়ি। আবার মাঝে মাঝে সমুদ্র এসে পথপাশে এক একবার সুন্দর মুখ দেখিয়েই লুকিয়ে পড়েছে। উলটোদিকে আবার নদী, ব্যাকওয়াটার। আশ্চর্য প্রকৃতি কিন্তু এখানের। এমনটি অন্য কোথাও দেখিনি।

তাই?

হ্যাঁ। তোকে বলেছিলাম আগে।

টাপ্পু মানে কী রে? রংকিনী বলল।

টাপ্পু মানে পাহাড়। আন্দামানি ভাষায়। চিড়িয়া টাপ্পু মানে পাখি-পাহাড় বলতে পারিস। চিত্ত দে নামের এক পাগল ভদ্রলোক অযোধ্যা পাহাড়ে অগণ্য পাখি খোদাই করছেন দল-বল নিয়ে। তারও নাম দিয়েছেন পাখি-পাহাড়।

অযোধ্যা পাহাড় মানে? যে-অযোধ্যাতে বাবরি মসজিদ?

চুমকি হেসে বলল, আরে না রে না। আমাদের পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়। ভারতবর্ষ দেশটা এতই বড়ো যে, একই নামের জায়গা তুই সারাভারত খুঁজলে হাজারটা করে পাবি। ইউনাইটেড স্টেটসও সেরকম। সে তো ভারতের চেয়েও বহুগুণ বড়ো।

বাবাঃ। চিড়িয়া টাপ্পুতে কী আদিম সব রেইন ফরেস্টস! কত বিচিত্র তাদের রং। কতরকম লতা-পাতা। নিশ্চিদ্র জঙ্গল। দিনমানেও আলো ঢোকে না ভেতরে। গা-ছমছম করে। তাইনা?

কিন্তু যাই বলিস, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে কোনো মাংসাশী শ্বাপদ নেই বলেই ভয় নেই। আর যাই বলিস আর তাই বলিস, ভয় না থাকলে রহস্যও থাকে না। থাকে কি? বল? আমার তো মনে হয় না।

ভয় নেই বলছিস কেন? সাপ তো আছে অনেকইরকম। জলে আছে, ডাঙায় আছে। কেউটে, চন্দ্রবোড়া, নানা-রঙা সব চিত্রবিচিত্র সাপ। আর তাদের ধরে খাবার জন্যে গা ঘিনঘিন করা ঘন-ঘন জিভ বের-করা ইয়া বড়ো বড়ো গোসাপ।

যাই বলিস চুমকি, তোকে আমি ঈর্ষা করেছি, আজ স্বীকার করছি, ছেলেবেলা, থুড়ি মেয়েবেলা থেকেই নানা কারণে। কিন্তু তুই যে এমন জলের রানি, দ্বীপের রানি তা জানার পর থেকে তোর প্রতি ঈর্ষাটা একলাফে অনেকই বেড়ে গেল। ভাবা যায়! একটা আস্ত দ্বীপের মালকিন তুই!

হলে কী হয়! কী সাংঘাতিক দ্বীপ তা তো জানিস না। এই দ্বীপে অনেক জাহাজডুবি নাবিক আর জলদস্যুদের আত্মা আছে। কত খুন-খারাপি হয়েছে একসময়ে। আফ্রিকা, বার্মা, মানে এখনকার মায়ানমার এবং থাইল্যাণ্ডের কত মেয়েরা অত্যাচারিত হয়ে মরেছে একদিন এখানে। অনেকই প্রেতাত্মার বাস দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ।

ভাগ।

ভাগ কী রে? তুই ভীরাপ্পানকে জিজ্ঞেস করিস। তাকে বলব আমি তোকে সেসব গল্প করতে, কোনো অন্ধকার রাতে। যদি কেউ এখানে ক-দিন থাকে তবে নিজেই কত সব শব্দ শুনবে রাতে। অন্যকে কিছুই বলতে হবে না। আলো-ঝলমল কলকাতাতে বসে যা সহজেই গাঁজা-গুল বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়, তা এই সমুদ্র-ঘেরা নির্জন দ্বীপের আদিম অরণ্যের অন্ধকারে বসে করা যায় না।

আহা! রাতে গল্প শোনার জন্যে কে থাকবে এখানে? ফিরে তো আসব আমরা আজই দিনে দিনে।

তা কী করে বলব! যাওয়াটা তোমার হাতে অবশ্যই। ফেরাটা তো নয়! বোস সাহেব প্রায় ছ-বছর এই দ্বীপে ভীরাপ্পানের সঙ্গে একা রয়েছেন। মাঝে মাঝে মাতৃভক্ত ভীরাপ্পানও তো চলে যায় ওঁকে একেবারেই একা রেখে। মাসের মধ্যে একবার তো যায়ই। জানি না, আজও গিয়ে তাকে দেখতে পাব কি না।

তার পরে বলল, পোর্ট ব্লেয়ারের বে-আইল্যাণ্ড হোটেলে না থেকে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এই থেকে যা-না বাকি ক-টা দিন। এক্সপিরিয়েন্স অফ আ লাইফ টাইম হবে। সারাজীবন মনে রাখতে পারবি এই কটা দিনের অবিস্মরণীয় দুর্মর স্মৃতি। এমন সুযোগ কি রোজ আসে কারো জীবনেই? বল তুই। ইউ উইল বি দ্য কুইন অফ অল উসার্ভে।

ভালোই বলেছিস। রংকিনী বলল। দ্বীপের নাম দ্য হর্নেটস নেস্ট। আমার অচেনা একমাত্র দ্বীপবাসীর নাম আহুক বোস, ওরফে রবিনসন ক্রুসো। তাঁর ভ্যালের নাম ভীরাপ্পান, ওরফে ফ্রাইডে। এবং বলছিস যে, সে-দ্বীপে অনেক প্রেতাত্মাও বাস করে বিষাক্ত সাপ আর বিকটদর্শন গোসাপদের সঙ্গে। এই নইলে বন্ধু তুই!

তার পর বলল, তোর এই ভীরাপ্পান কি চন্দনগাছ আর হাতির যম তামিলনাড়ু আর কর্নাটকের সেই কুখ্যাত ভীরাপ্পানের কাজিন-টাজিন হয় নাকি?

হলেই বা ক্ষতি কী? এই দ্য হনেটস নেস্ট-এর আশ্চর্য সব প্রকান্ড প্রকান্ড আদিম গাছ, ফুল, পাখি, প্রজাপতি, এর আশ্চর্য সুন্দর জনহীন তটভূমি, যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় এই পৃথিবীতে নয়, অন্য কোথাওই পৌঁছে গেছি। আর তার ওপরে আহুক বোস-এর মতন একজন পূর্ণ মানুষের সঙ্গ। তুই জানিস না, তুই কী হারাইতেছিস।

বলেই, হাসল চুমকি।

রংকিনীর মনে হল, ও ঠাট্টা করছে।

পূর্ণ মানুষ মানে? কী বলতে চাইছিস? বুড়ো? ঝুনো নারকেল?

ইডিয়ট। তুই কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ এত কপচাস আর রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ মানুষের কনসেপ্ট-এর কথাই জানিস না? পৃথিবীর সব মানুষেরই ওইরকম মানুষ হয়ে ওঠারই প্রার্থনা হওয়া উচিত।

ওইরকম মানে পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার প্রার্থনা।

তুই দিনে দিনে বড়ো গোলমেলে হয়ে উঠছিস। যাকে বলে, কমপ্লিকেটেড। তোর মিস্টার আহুক বোস একজন পূর্ণ মানুষ?

পূর্ণ পুরুষ। তাঁর সংস্পর্শে, তাঁর সঙ্গে থেকে, তুই-ও পূর্ণা হতে পারিস, পূর্ণা হতে পারে যে-কোনো নারীই।

আমি ভাই রংকিনী আছি, পূর্ণা রংকিনীই থাকতে চাই। আমার পূর্ণতা অন্য কারো দয়ানির্ভর নয়। নিজে ভগ্নাংশ হয়ে থাকলেও আপত্তি নেই কোনো।

পূর্ণা হওয়াই তো প্রত্যেক নারীরই জীবনের ব্রত হওয়া উচিত। স্বীকার করিস আর নাই করিস, ইচ্ছে কি করে না?

না। করে না। তাই তুই নিজে হলি না কেন? তুই-ই পূর্ণা হ! কে তোকে মানা করেছে? তোর দ্বীপ, তোর ম্যানেজার, তোকে ঠেকাচ্ছেটা কে? পরিপূর্ণ হয়ে ওঠ এখানে পূর্ণ মানুষের সঙ্গে থেকে। পরিপূর্ণ হয়ে উপচে যা। পৃথিবীর সব Art-এর জন্মই তো এই উপচে-যাওয়া থেকে, Superfluity থেকে।

চুমকির মুখে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। বলল, দ্য হর্নেটস নেস্ট যে সকলকে, গ্রহণ করে না প্রসন্ন মনে। যাদের করে না, তাদের প্রাণ বিপন্ন হয়।

নইলে, এখানে কি জলদস্যু আর জাহাজডুবি হওয়া মানুষদের অগণ্য বদ্ধ-আত্মা এমন হাঁড়ির মধ্যে শিঙি মাছের মতো খলবল করে!

রংকিনী বলল, কপট রাগের সঙ্গে।

বোকা-বোকা কথা বলিস না।

না রে! আমার ভীষণই ভূতের ভয়। আমি এই দ্বীপে সেজন্যেই একরাতও কাটাইনি।

চুমকি বলল।

আমার ভূতের ভয় নেই একটুও।

তাহলে তো ফাস্টক্লাস। থেকে যা। না থাকলে, ইউ উইল রিপেন্ট। সারাজীবন আপশোস করবি রংকি।

ভূতের ভয় না থাকলেও অন্য ভয় আছে আমার।

রংকিনী বলল।

কীসের ভয়? বোস সাহেবের? আহা! হি ইজ আ ফাইন জেন্টেলম্যান।

কী জানি। পুরুষদের মধ্যে জেন্টেলম্যান তো খুব বেশি দেখিনি এপর্যন্ত। বিশ্বাস হয় না। তবে তোর বোস সাহেবকে ভয় পাওয়ার কী আছে? একজন সামান্য পুরুষই তো! তিনি পূর্ণই হোন কী ভগ্নাংশ, আমার কোন ক্ষতি করতে পারেন? আই অ্যাম নট মেড অফ সাচ স্টাফ।

তিনি সামান্য আদৌ নন। তবু, ওঁকেই যদি না হয় ভয়, তাহলে তোর ভয় কাকে?

ভয় আমাকেই। আমি নিজেকে বড়োই ভয় পাই।

কী যে হেঁয়ালি করিস, তুই-ই জানিস।

আমি হেঁয়ালি করি না। আমি নিজেই হেঁয়ালি। তুইও হেঁয়ালি। হেঁয়ালি যে, তা তুই জানিস না হয়তো, এই যা। আমরা প্রত্যেক নারী ও পুরুষই এক একটি হেঁয়ালি বলেই তো এত ইন্টারেস্টিং। একথা কি তোর কখনো মনে হয়নি?

চুমকি জলের দিকে চেয়েছিল। সূর্যর আলোয় লক্ষ লক্ষ সোনালি সাপ কালো জলে কিলবিল করছিল দ্রুত ধাবমান বোটের দু-পাশে। পেছনে বোট-এর প্রপেলর মথিত সাদা ফেনা সেই সোনার সাপগুলোকে ইরেজার-এর মতো মুছে দিচ্ছিল অনুক্ষণ।

চুমকি রংকিনীর প্রশ্নর কোনো উত্তর দিল না। সে নিজেও যে হেঁয়ালি তা যেন এতদিনে বুঝতে পারল চুমকি। এবং বুঝতে পেরে চুপ করে রইল।

ততক্ষণে মেঘ একেবারেই সরে গিয়ে ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ওদের অলক উড়ছে হাওয়ায়, দু-কানের পাশে, যদিও টুপি পরে আছে ওরা দুজনেই। চুমকি পরেছে ফেডেড জিনস। হালকা নীল রঙা। আর উধ্বাঙ্গে কমলা-রঙা গেঞ্জি। রংকিনী পরেছে জংলা কাজের ফিকে-সবুজ সালোয়ার-কামিজ। ওকে জংলা-রাগে বাঁধা ধীরা আলাপের বন্দিশ-এর মতো ভালো ছবি যেমন শোনা যায়, ভালো গান-বাজনাও দেখা যায়।

আরও বেলা বাড়লে জংলা থেকে রামকেলি হয়ে যাবে জংলা কাজের সবুজ সালোয়ার কামিজ পরা রংকিনী। তারও পরে ভরদুপুরে, রাগ পটদীপ।

আর কতক্ষণ লাগবে রে? রংকিনী জিজ্ঞেস করল।

হাত-ঘড়ি দেখে চুমকি বলল, ঘণ্টাখানেক তো হল। ধর, আরও ঘণ্টাখানেক। তবে আমাদের নিজেদের বোটে আসতে তিন ঘণ্টা লাগে। এই বোটটার গতি অনেক বেশি।

কোনো দিকেই কোনো ভূখন্ড আর চোখে পড়ে না এখন। চারদিকেই নীল দিগন্তে আকাশ নেমে এসে চুমু খাচ্ছে সবজে-কালো সমুদ্রকে, আর সমুদ্র-আকাশকে। কেমন যেন ভয় ভয় করে। মানুষ যে তার এতকিছু আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের পরও, চাঁদে পা দেওয়ার পরেও, মঙ্গলগ্রহের ফোটো তোলার পরেও প্রকৃতির প্রেক্ষিতে এখনও পুরোপুরি অসহায়, এই কথাটাই এমন এমন সময়ে মনে আসে।

চুমকি গলাতে একটি সুন্দর ডিজাইনের রুপোর হার পরেছিল। পোর্ট ব্লেয়ারের জেটির পথে হোটেল থেকে গাড়িতে আসবার সময়ে সকালেই লক্ষ করেছিল রংকিনী। তবে হারের লকেটটা দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ-ই নিজের গেঞ্জির মধ্যে ডান হাতের আঙুল ঢুকিয়ে লকেটটা টেনে বের করল। তখন রংকিনী দেখতে পেল যে, সেটা লকেট নয়, একটি কম্পাস।

দেখতে জানিস?

রংকিনী জিজ্ঞেস করল চুমকিকে কম্পাসটার দিকে চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নাকি, গয়না?

অবশ্যই জানি। এই কম্পাস তো যে-কোনো বাচ্চাও দেখতে পারে। খুবই সোজা। তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি এখনই।

তার পর একটু চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু যে অদৃশ্য কম্পাস দেখতে জানলে কাজের মতো কাজ হত তা তো দেখতে শিখিনি। আমিই শিখিনি তার তোকে কী করে শেখাব বল?

অদৃশ্য কম্পাসটা আবার কী জিনিস? এটা কি নকল নাকি?

না রে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের গন্তব্য যে-কম্পাস ঠিক করে দিতে পারে, শুধরে দিতে পারে ভুল পথের পথিককে, বাতলে দিতে পারে ঠিক পথের হদিশ, সেই কম্পাস। জাহাজ বা এরোপ্লেন বা মরুভূমিতে বা জঙ্গলে পথ-হারানো যান বা মানুষকে পথ দেখাতে পারে এই কম্পাসটি সহজেই কিন্তু জীবনের গন্তব্যে, চাওয়া-পাওয়ায়, যে পদে পদে পথভ্রষ্ট হই আমরা, সেই পথের সঠিক হদিশ যে-কম্পাস দিতে পারে, তা কি আমরা কেউই দেখতে জানি?

এবার রংকিনী চুপ করে রইল। উত্তর দিল না চুমকির কথার।

বড়ো বেশি কথা বলেছে ওরা দুজনে আজ সকাল থেকে।

নৈ:শব্দের চেয়ে বড়ো শব্দ আর নেই, নীরবতার মতো বায় সম্ভবত আর কিছুই নেই। ওরা দুজনেই যেন এই অমোঘ সত্যটি হৃদয়ংগম করে দু-পাশ দিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া সমুদ্রের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।

ওদের সঙ্গে বোটটি এগিয়ে চলল অসীম জলরাশির উপর দিয়ে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর দিকে। বোটের ডিজেল এঞ্জিনের আরোহণ-অবরোহণ হীন এক স্কেলে বাঁধা স্বর, বোটের মুখের সঙ্গে জলের সংঘাতের ছলাৎছলাৎ শব্দ, আর দু-পাশের দ্রুত সরে যাওয়া জলের সড়-সড় শব্দের একঘেয়েমিতে কেমন ঘুম ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল রংকিনীর।

.

০৬.

সকাল আটটাতে এসেছিল। এখন রাত আটটা। চুমকি চলে গেছে বিকেল চারটেতে। কাল সকালের প্লেন ধরবে কলকাতার। এরইমধ্যে রংকিনীর মনে হচ্ছে যেন কতদিন হল এই দ্বীপেই আছে।

কোথায় বে-আইল্যাণ্ড হোটেলের পাঁচ কোর্স-এর ডিনার আর কোথায় এই খাওয়া!

রংকিনীর মনের কথাটি বুঝতে পেরেই যেন আহুক বোস বললেন রংকিনীকে, কী করবে? নিজেই যদি নিজেকে কষ্ট দাও তো তোমাকে বাঁচাবে কে?

কেন? মসুর ডালের খিচুড়ি কি খারাপ খাবার? তার সঙ্গে কড়কড়ে করে আলু ভাজা, ডিম ভাজা। আমার খুবই পছন্দের খাবার। তা ছাড়া, আপনি রান্নাটাও যা করেছিলেন। অপূর্ব।

কাল তুমিই রান্না কোরো দুপুরে। আমার রান্না যে কী উপাদেয় তা তো আমি জানিই।

আমি? এই রে! রংকিনী বলল।

কেন?

আমি তো চা আর ওমলেট ছাড়া আর কিছুই রাঁধতে জানি না।

বল কী? সংসার যখন করবে তখন কী করবে?

রুটি-মাখন খাব। সংসার আমাকে চাইলে না আমি সংসার করব! এসব আর হবে না।

আহুক-এর মুখে এসে গেছিল, তোমার বয়েস কত?

পরক্ষণেই সামলে নিলেন। মহিলাদের বয়েস তো জিজ্ঞেস করা যায় না।

তার পর বললেন, সংসার করার সময় তো পড়ে আছে অঢেল। হবে না বলছ কেন?

সংসার-এর কনসেপ্টটাই তো বদলে গেছে। যদি তেমন একজন সচ্চরিত্র সাধারণ ভালো মানুষ পুরুষ পেতাম যে আমার সন্তানদের মানুষ করত, বাড়িঘর দেখত, ভালো রান্না করত চাকর-আয়া ম্যানেজ করত তবে বিয়ে করতাম।

ঈশ। আগে জানলে তো আমিও তোমার পাণিপ্রার্থী হতাম। আমি না হয় বাদই গেলাম কিন্তু তুমি সাধারণ, সচ্চরিত্র, ভালোমানুষ পুরুষ একজনও কি পেলে না?

পুরুষদের মধ্যে সচ্চরিত্র খুঁজতে যাওয়া আর ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করা একই ব্যাপার।

কিন্তু চরিত্রহানি তো পুরুষ একা একা ঘটাতে পারে না। শুধু পুরুষদের দোষ দেওয়া কি ঠিক?

এই কথাতে, হেসে ফেলল রংকিনী।

যাকগে। তুমি যদি না রাঁধো তো আমার রান্না অখাদ্য-কুখাদ্যই খেতে হবে। কষ্ট হবে কিন্তু তোমার খুবই! ভীরাপ্পান এলে অবশ্য তোমাকে গরম-গরম দোসা এবং শুঁটকি মাছ খাওয়াতে পারবে।

শুঁটকি মাছ? মরে গেলেও খাব না।

তার পরে বলল, কী কষ্ট আর কী আনন্দ তার ব্যাখ্যা এক একজনের কাছে এক একরকম। আপনি নিজেও খুব ভালো করেই জানেন যে, ভালো লাগবে যে, সে-বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলাম বলেই শেষমুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলে আপনার এই হর্নেটস নেস্ট-এ থেকে গেলাম। এখন ভীরাপ্পান আসার সময়ে যদি আমার স্যুটকেসটা নিয়ে আসে, তবেই বাঁচোয়া। আসবে তো? নইলে এই একটি সালোয়ার-কামিজ পরে তো থাকতে পারব না।

কিছু না পরে থাকলেই বা কী? এই দ্বীপে আকাশ আর সমুদ্র আর কিছু পাখি আর সাপ ছাড়া তোমাকে দেখার মতো আর কেউই নেই।

কেন? আপনি?

আমি একটা অশক্ত বুড়ো। আমাকে কি তুমি মানুষ বলে গণ্য করবে নাকি! আমাকেও সাপ বা পাখির মতোই মনে কোরো। আর তা যদি মনে করতে পারো তবে না হয় তোমার দিকে চাইবই না। অথবা দু-চোখ বেঁধে রেখো আমার।

ভীরাপ্পান যদি কাল না আসে তবে তাই হয়তো করতে হবে।

তাই কোরো। এখন চলো, বাইরে গিয়ে বসি। প্রকৃতির মধ্যে থাকবে বলেই তো, এত কষ্ট করতে হবে জেনেও রয়ে গেলে হর্নেটস নেস্ট–এ। ঘরের মধ্যে থেকে কী করবে?

এঁটো বাসনাগুলো ধুয়ে দিতে হবে-না? চামচ-টামচ?

তোমার কিছুই করতে হবে না। তুমি অতিথি। ভারতীয় অতিথি। আমি তো আর সাহেব নই যে, অতিথিকে দিয়েও কাজ করাব। রোজই করি। করে নেব। যে ক-দিন আছ এখানে, তোমাকে কোনো কাজই করতে হবে না। তুমি শুধু আনন্দ করো।

তা কি হয় নাকি?

হয় হয়। হওয়ালেই হয়।

আহুক বোস-এর সঙ্গে রংকিনী বাংলোর বাইরে এল। নামেই বাংলো। কাঠের ছটি মোটা থাম-এর ওপরে একটা চালা। প্রায় এক মানুষ উঁচু। তার ওপরে একটিমাত্র ঘর। তবে তিনদিকে ঘোরানো বারান্দা আছে কাঠের রেলিং-দেওয়া। ঘরটিতে মাথাতে কাঠের ফ্রেম-এর ওপরে করোগেটেড শিট দেওয়া। ভেতরে বাঁশের চাটাই-এর ফলস সিলিং। তেল চকচকে। বড়ো বড়ো জানালা। একটা দিকের দেওয়ালে শুধুই কাঁচ। পা থেকে মাথা অবধি। এখানে উনি একা থাকেন তাই মনে হল প্রাইভেসির কোনো বালাই নেই। উলঙ্গ হয়ে শুয়ে থাকলেও আকাশ, আকাশের পাখি, জল আর জলের পাখি আর সমুদ্রের মাছেরা ছাড়া কেউই দেখবে না।

ভীরাপ্পানের কুঁড়েটা, আহুক বললেন, পাহাড়ের অন্য দিকে। তার নির্দেশমতোই নাকি তা বানানো হয়েছে। বাংলো থেকে কুঁড়ে অথবা কুঁড়ে থেকে বাংলো, দেখাই যায় না। ভীরাপ্পানও তার মনিবেরই মতো নির্জনতা এবং গোপনীয়তাবিলাসী মনে হয়। সত্যিই ভাবা যায় না যে, প্রায় পৌনে দুই বর্গমাইল এই গভীর এবং আদিম জঙ্গলময় দ্বীপে ওই দুজন একা পুরুষ এমনভাবে মাসের পর মাস বছরের পর বছর থাকতে পারেন! দুজনের শিক্ষা-দীক্ষা এবং ভাষারও ব্যবধানের কারণে দুজনের মধ্যে কথাবার্তাও বেশি হয় বলে মনে হয় না। তাতে নির্জনতা নিশ্চয়ই আরও গম্ভীর হয়। এঁরা দুজনে এতদিনে পাগল হয়ে যাননি যে, কেন তা কে জানে!

বাইরে একটা ধূনিমতো জ্বলছে। তার দু-পাশে দুটি বেতের চেয়ার। তার ওপরে স্থানীয় কোনো ঘাসে-বোনা আস্তরণ। চেয়ারগুলো মনে হয় বাইরে পড়েই থাকে, রোদে-জলে-চাঁদে।

বোসো।

বললেন, আহুক।

তার পর বললেন, একেবারে চুপটি করে বোসো৷ দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর তোমাকে কী বলার আছে তাই শোনো চুপচাপ বসে। প্রকৃতির বুকের কোরকে একবার পৌঁছে গেলে মৌনী হয়ে যেতে হয়। তবেই তো প্রকৃতি মুখ খোলেন।

আজকে বোধ হয় শুক্লা-অষ্টমী। চাঁদ যখনই বেরিয়ে পড়ছে মাঝে মাঝে, মেঘের আড়াল থেকে, তখনই নীচের আধো-চাঁদা তটভূমি আর তার উপরের ঢেউ-ভাঙা সাদা ফেনার ছলাৎছলাৎ বিজ-বিজ-বিজ শব্দ ভেসে আসছে সামুদ্রিক হাওয়াতে। দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র চারদিকেই। আশ্চর্য এক অনুভূতি। এই সমুদ্রকে পোর্ট প্লেয়ারের বে-আইল্যাণ্ড হোটেলের সমুদ্রমুখী ঘরের লাগোয়া বারান্দাতে বসেও দেখা যেত কিন্তু এখানে বসে যেন রংকিনীর মনে হচ্ছে সে একজন জাহাজডুবি হওয়া নারী। এই দারুচিনি দ্বীপে কাষ্ঠখন্ড ধরে কোনোক্রমে বুঝি-বা ভেসে এসেছে আর তার চারদিকে তাথৈ তাথৈ করছে বারিধি।

হঠাৎ-ই পেছনের গভীর জঙ্গল থেকে কী একটা গুড়ুম গুডুম শব্দ হল। কামানের গোলা কি? জলদস্যুরা কি আক্রমণ করল দ্য হর্নেটস নেস্টকে?

ভয় পেয়ে চমকে উঠল রংকিনী। ও চমকে উঠতেই আহুক বোস বললেন, আন্দামানি পেঁচা ডাকল। এই পেঁচাগুলো মূলভূখন্ডর, মানে, ভারতের পেঁচাঁদের থেকে অনেকই বড়ো হয়। হুতুম পেঁচার চেয়েও বড়ো। জানো তো যে এখানের, মানে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বেশিরভাগ গাছগাছালি পাখপাখালিরই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা Endemic।

Endemic শব্দর মানে?

মানে, এদের শুধু এখানেই দেখা যায়, অন্য কোথাওই দেখা যায় না।

তাই? যাক বাবা। ওই বুক-কাঁপানো দুরগুম-দুরগুম আওয়াজ শুনে আমি যা-ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম, জল-ডাকাত পড়ল বুঝি দ্বীপে। এখানে যারা থাকেন, মানুষেরা, তারাও কি Endemic?

হ্যাঁ। তারাও। মানে আদিম বাসিন্দারা। যেমন ওঙ্গে, আন্দামানি, জারোয়া বা নিকোবরের শোম্পেনদেরও অন্য কোথাওই দেখা যাবে না।

আর নিযুক্ত আহুক বোসের মতো মানুষ?

বলেই, হাসল রংকিনী।

আহুকও হেসে ফেললেন।

বললেন, তাও ভালো যে, তুমি আমাকে আন্দামানি পেঁচা বা ইগুয়ানো বা নিকোবরি মেগাপড পাখিদের থেকে আলাদা করে একজন মানুষ বলে স্বীকৃতি দিলে। মানুষ পরিচয় তো আমার কবেই হারিয়ে গেছে।

মানুষ নয়তো আপনি কী?

কী জানি! হয়তো দ্বীপবাসী কোনো প্রাণী, কোনো বনমানুষ।

তাই?

বলল, রংকিনী।

বলেই, চুপ করে গেল।

আহুক বললেন, ডাকাতেরা এখানে এখন না এলেও ভিনদেশি জাহাজ-ট্রলার সব ঢুকে পড়ে বই কী। নানা ধান্দাতে তারা আসে। ভারতবর্ষের তো শত্ৰু কম নেই। তবে বেশিই আসে চুরি করে মাছ ধরতে।

আমাদের সামনে যে-সমুদ্র তাই তো বঙ্গোপসাগর?

না। বঙ্গোপসাগর বাঁ-দিকে। বে-আইল্যাণ্ড হোটেল থেকে যে-সমুদ্র দেখা যায় তা বঙ্গোপসাগর। কিন্তু আমাদের এই দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর সামনে যে সমুদ্র দেখতে পাচ্ছ তা হচ্ছে আন্দামান উপসাগর।

তা কোন দেশের থেকে ওইসব জাহাজ বা ট্রলার আসে? শুধু আন্দামান উপসাগরেই আসে?

না, না, তারা বঙ্গোপসাগরেও আসে। বার্মা, মানে এখনকার মায়ানমার থেকেও আসে। ইরাবতী নদীও আমাদের গঙ্গারই মতো অনেক ব-দ্বীপ সৃষ্টি করে নানা নামে নানা শাখা উপশাখাতে ভাগ হয়ে সমুদ্রে এসে পড়েছে। ম্যাপ যদি দেখো, তাহলে দেখবে, গঙ্গার মুখ আর মায়ানমারের ইরাবতীর মুখের চেহারা প্রায় একইরকম। মাছধরা ট্রলার ও জাহাজ যে এদিকে আসে তাই নয়, তারা গঙ্গার মুখের সামনের বঙ্গোপসাগরেও চলে যায়। আরও আসে থাইল্যাণ্ড থেকে। উত্তর আন্দামানের কোকো দ্বীপ থেকে মায়ানমারের প্রেপারিস দ্বীপ খুবই কাছে। বাল্ক অফ মার্তাবন হয়ে আসে চোরা মাছ-শিকারিরা। যেমন মধ্য আন্দামানেরও।

ওরা চুপ করতেই সমুদ্রের শব্দ জোর হল। চাঁদটাও মেঘমুক্ত হল। হেসে উঠল চাঁদের আলোয় ক্লোরোফিল উজ্জ্বল প্রকৃতি। আর ভেসে আসতে লাগল চারধারের ঝুঁকে-পড়া চাঁদের আলো-নিকোনো হরজাই-বন থেকে নানারকম ঝিঁঝির শব্দ, রাতচরা পাখির সংক্ষিপ্ত চকিত ডাক, বনের পাদদেশে নানা সরীসৃপের নড়াচড়ার আওয়াজ। যেন, ঘুমপাড়ানি গান শুনছে রংকিনী। ইংরেজিতে যাকে বলে Soporific, তাই এখানের পরিবেশ। ভারি শান্ত নির্লিপ্ত এখানের প্রতিবেশ। টানটান। স্নায়ু আলগা হয়ে আসে। ঘুম পায়। ঘুমোনো, বই পড়া, খাওয়া, বনের মধ্যে ঘোরা, সমুদ্রে-স্নান করা, তটে শুয়ে থাকা, তার পর আবার খাওয়া, গান শোনা, আবার ঘুমোনা এবং ঘুম থেকে উঠে কারো আদর খাওয়া বা কারোকে আদর করা, এই হওয়া উচিত এখানের রুটিন। শহরের মানুষের জীবন থেকে, একদিন যেসব সাধারণ এবং প্রাকৃতিক সব আনন্দে মানুষ-মানুষী অভ্যস্ত ছিল, তার সব কিছুই এখন অন্তর্হিত হয়েছে। মানুষ আর মানুষ নেই। সারাক্ষণ খাই-খাই, চাই-চাই, আরও চাই-এর Robot হয়ে গেছে। অথচ ঈশ্বর সম্ভবত তাঁর সৃষ্ট সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষের এমন করুণ পরিণতি হোক আদৌ তা চাননি। শহুরে মানুষ-মানুষীর জীবন থেকে পূর্বিতা এবং পূর্বাপর জ্ঞানও অবলুপ্ত হয়েছে।

চুমকি বোধ হয় এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছিল যখন অন্য কম্পাস-এর কথা বলছিল, সমুদ্রের মধ্যে মোটর বোটে করে দ্য হর্নেটস নেস্ট-এর দিকে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসতে আসতে। রং

রংকিনী বলল অনেকক্ষণ পরে, আপনি যে মেগাপড় পাখির কথা বললেন, চুমকির মুখেও শুনেছি, এখানে মেগাপড-এর নামে হোটেল এবং একটা দ্বীপও আছে। কিন্তু সেটা কী পাখি? দেখিনি তো।

দেখবে কী করে? মূল ভারতীয় ভূখন্ডে এ পাখি নেই। Megapod তো এখানেই শুধু পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বলা বোধ হয় ঠিক নয়, প্রায় অবলুপ্তই হয়ে গেছে। মেগাপড় যে ডিম পাড়ে তা থেকে বাচ্চা ফুটে বেরোয় স্বাবলম্বী হয়ে। মহা অকালপক্ক তারা। মেগাপড় পাখি কিন্তু উড়তে পারে না। বিধাতার কী বিচ্ছিরি রসিকতা এল তো? আমরা যদি হাঁটতে না পারতাম, শুধুই উড়তে পারতাম এবং রাতে গাছের ডালে বসে ঘুমোতাম তবে আমাদের যেমন অবস্থা হত মেগাপডদেরও তেমনই অবস্থা প্রায়।

পাখি, অথচ উড়তে পারে না, এ আবার হয় নাকি?

হয় হয়। সব হয়। এই প্রকৃতিতে কী না হয়? তোমার মতো সুন্দরী, বিদুষী যুবতী এইসব অভাবনীয় অসুবিধে সত্ত্বেও এই জঙ্গলে-ভরা দ্বীপে সাত দিন সাত রাত থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে তাও কি হয়? কিন্তু হল তো! কত কী হয়। প্রকৃতির বুকের কোরকের মধ্যে কী হয় আর কী যে হয় না, তা কি কেউই বলতে পারে? শেষপর্যন্ত ক-দিন ক-রাত থাকবে সেটা এখনও অনিশ্চিত কিন্তু একটা রাত তো থাকছ নিশ্চিতই। এও কি আদৌ ভাবনীয় ছিল? একটি রাত যেকোনো মানুষ বা মানুষীর জীবনকে যেমন লন্ডভন্ড করতে পারে তেমন সমাহিতও করতে পারে, বিন্যস্ত।

রংকিনী কথা না বলে চুপ করে আহুকের চোখে চেয়ে রইল। ধুনির আগুনে আহুক বোস এর দুটি চোখের উজ্জ্বল তারা নানারকম রং উড়োচ্ছিল। একবার সবুজ, একবার লাল, জঙ্গলে বড়ো বাঘের চোখে রাতে আলো পড়লে যেমন হয়। দেখেছিল, বান্ধবগড়ে।

আহুক বললেন, আন্দামান নিকোবরের মেগাপড-এর মতোই মালয়েশিয়াতে এরকম পাখি আছে, সেও প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে, প্রায় কেন, হয়তো অবলুপ্তই হয়ে গেছে পুরোপুরি এতদিনে, যার নাম ডোডো। যে-মানুষ পৃথিবীতে থাকে অথচ হাঁটতে পারে না তার পক্ষে বাঁচা যেমন মুশকিল, তেমনই যে-পাখিরা উড়তেই পারে না শুধু হেঁটে বেড়ায়, তাদের পক্ষেও বাঁচা মুশকিল।

কোন কোন পাখি উড়তে পারে না? তিতির বা নানাধরনের পাট্রিজও তো উড়তে পারে না। রংকিনী বলল।

কে বলল? তারা উড়তে অবশ্যই পারে তবে খগচর বলতে আমরা যেমন উড়ন্ত পাখি বোঝাই তেমন পাখি নয়। মাটিতেই বেশি সময় থাকে, যেমন ময়ূর, যেমন বন-মুরগি। মালয়েশিয়ার ডোডোরই মতো হাওয়াইয়ান দীপপুঞ্জেও এক রকম বড়ো পাখি দেখা যায়, এখন তারাও প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে, যাদের নাম নেনে। ডোডো এবং নেনেও কিন্তু Endemic। সেশ্যেলস দ্বীপপুঞ্জেও এক রকমের Rails দেখা যায় তারাও উড়তে পারে না।

Rails কী?

পাখি একরকমের।

সেশেলস-এর কথা চুমকিও বলছিল। আপনিও কি গেছেন?

হ্যাঁ। গেছি বই কী। সারাপৃথিবীতেই তো ঘুরে বেড়িয়েছি।

কেন? কীসের খোঁজে? গুপ্তধন?

আহুক হেসে বললেন, না, তা নয়। তবে পেলে মন্দ হত না। তা ছাড়া গুপ্তধন তো। সবসময়ে নিষ্প্রাণ পদার্থ নাও হতে পারে।

মানে?

অনেক প্রাণবন্ত গুপ্তধনও থাকে, যা অন্য মানুষ অথবা মানুষীকে প্রাণিত করে।

তাই? করে বুঝি?

করেই তো।

হেসে বললেন, আহুক।

তার পর বললেন, তোমাদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বিশেষ হয়নি, যা শিখেছি তা নানা দেশ ঘুরেই। ট্র্যাভেলিং ইজ দ্য বেস্ট এডুকেশান। যদি অবশ্য চোখ-কান-নাক খুলে ট্রাভল করো। তুমিও যেয়ো সেশেলস-এ একবার। হানিমুন করতে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়।

আপনিও চলুন আমার সঙ্গে।

হানিমুন করতে?

হেসে, কিন্তু বোকার মতো এবং কিঞ্চিৎ ভয় পেয়েও যেন বললেন, আহুক।

আমার আপত্তি নেই। আপনার আপত্তি না থাকলেই হল। যেখানে পূর্ণচাঁদ সেখানেই তো হানিমুন।

আমি যে তোমার বাবার বয়েসি। কোনো বাবার বয়েসি মানুষ কি পারে মেয়ের বয়েসি কারো সঙ্গে জীবনে দৌড়োতে? তাকে সুখী করতে?

জীবন মানে কি শুধুই দৌড়?

কে জানে! জীবন মানে যে কী? তা যদি জেনেই ফেলতে পারতাম তবে তো আমি লেখক হতাম। একটি মাত্র বই লিখেই নোবেল প্রাইজ পেতাম। জীবনের মানে জানা আর হল কই? ক-জনই বা তা জানতে পারে?

এত দেশ যে দেখলেন, তার মধ্যে কোন দেশ সবচেয়ে ভালো লেগেছে আপনার?

নিজের দেশ। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি। শুধু দেশের নেতারা যদি আন্দামানি পেঁচা না হয়ে মানুষ হত তবে এই পঞ্চাশ বছরে এ দেশের চেহারা যে কী হতে পারত তা তোমরা ধারণাও করতে পারো না। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আমার পা পড়েছে বলেই তুলনা করতে পারি আমি।

তুলনা করে কী মনে হয়?

কী আর মনে হবে? দু-চোখ জলে ভরে যায়।

বলেই, আহুক চুপ করে গেলেন।

এরপরে দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।

খুব কাছে থাইল্যাণ্ডের টেনাসেরিস অঞ্চল। সারগুই দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসে জাহাজগুলো। মগ দস্যুদের নাম শুনেছ তো? মগ বাবুর্চি? মগের মুল্লুক কথাটা শুনেছ? বর্মিদেরই আর এক নাম তো মগ। বাংলাদেশের চাঁটগার আর মায়ানমারের আরাকানের বাবুর্চিদের হাতের খানা যে না খেয়েছে তার জীবনই বৃথা।

ইশ। জীবনটা তাও শুধু একটা কারণেই বৃথা হলেও না হয় বুঝতাম। তাহলে তার প্রতিকারের কোনো বন্দোবস্ত করার চেষ্টাও না হয় করা যেত। কিন্তু কারো জীবন যদি এতগুলো কারণে বৃথা হয় তবে তো জাহাজডুবি হওয়ার চেয়েও খারাপ।

বলেই হেসে উঠল রংকিনী।

আহুকও হাসলেন।

আগুনটা ধিকি ধিকি জ্বলছিল। ষাটোর্ধ্ব হলেও অত্যন্ত সুগঠিত চেহারার, সুস্বাস্থ্যর আহুককে সেই আগুনের কম্পমান আলোতে বাদামি-রঙা দেখাচ্ছিল। একদিন তাঁর গায়ের রং যে ফর্সা ছিল খুবই আজও বোঝা যায়। সানট্যানড বলতে কী বোঝায় তা আহুক বোসকে দেখে জানতে হয়। সামনের দিকে চুল প্রায় নেই বললেই চলে। নাকটা চাপা। খাড়া হলে কেমন দেখাত, কে জানে! হয়তো পশ্চিম-দেশের সাহেবদের মতোই দেখাত। কিন্তু এই সামান্য চাপা নাক এক আলগা আলাদা আভিজাত্য দিয়েছে আহুক বোসকে। হাসিটি ভারি সুন্দর। ঝকঝকে দাঁত। নড়েনি। পড়েনি। রাবারের স্লিপার পরে, জিন-এর খাটো শর্টস এবং আড্ডাস-এর খয়েরি রঙা গেঞ্জিতে বাঙালি বলে একেবারে মনেই হচ্ছে না তাঁকে। তলপেটের কাছে সামান্য মেদ আছে। কিন্তু শরীরের আর কোথাওই মেদ নেই। ধিকি ধিকি আগুনের সামনে বসা চারিদিকে সমুদ্র-ঘেরা এই নির্জন দ্বীপের রবিনসন ক্রুসো আহুক বোস এর দিকে তাকিয়ে রংকিনী শরীরের মধ্যে এক অননুভূত স্পষ্ট রিকিঝিকি অনুভব করল। এই শারীরিক অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি ওর এই চৌত্রিশ বছরে। হঠাৎ-ই ভীষণ ভয় করতে লাগল। আন্দামানি পেঁচার ডাক শুনেও অত ভয় করেনি।

রংকিনী ভাবছিল যে, ও ঠিকই বলেছিল এখানে আসবার সময়ে চুমকিকে। বলেছিল যে, রংকিনী নিজেকে যতখানি ভয় পায় ততখানি ভয় আর কারোকেই পায় না। নিজের বাঁচন, নিজের মরণ, নিজের নিয়তি সে তার নিজের দুই সুন্দর বুকের মধ্যেই জীবন-কাঠি মরণ কাঠিরই মতো বয়ে বেড়াচ্ছে জন্মাবধি। ও জানে, ও জানে সেকথা। শি হ্যাঁজ স্টারড দ্য হর্নেটস নেস্ট। কিছু একটা অঘটন ঘটবে এখানে। চুমকি এই দ্বীপের রহস্য জানে বলেই একটি রাতও কাটায়নি এখানে আজ অবধি। সেকি রংকিনীর বন্ধু? না শত্রু?

আহুক বোস রংকিনীর দিকে চেয়েছিলেন। জংলা কাজের হালকা সবুজ সালোয়ার-কামিজে আগুনের মধ্যে থেকে প্রতিসরিত আলোর প্রজাপতিরা নাচানাচি করছিল। স্ফুলিঙ্গর মতো জ্বলছিল নিভছিল রংকিনীর চোখের তারায়। বাঁ-হাত দিয়ে তাঁর সল্ট অ্যাণ্ড পেপার দাড়িকে মুঠো করে ধরে আহুক চেয়েছিলেন রংকিনীর দিকে। রংকিনীর শারীরিক সৌন্দর্যকে এক অতীন্দ্রিয় সৌন্দর্য ধার দিয়েছে ওর বুদ্ধিমত্তা, রুচি এবং সম্ভত ওর শিক্ষাও। এই প্রসাধনের চেয়ে সুন্দরতর প্রসাধন, কী পুরুষ কী নারী কারোরই ঈপ্সিত নয়। এই প্রসাধন পারি শহরের সম্ৰান্ততম বিউটিশিয়ানের পার্লারে গিয়েও কিনতে পারা যায় না কোনো অর্থমূল্যেই। যার চোখ আছে দেখার, শুধু সে-ই এই প্রসাধন চেনে। সব জিনিস সকলের জন্যে নয়।

আহুক ভাবছিলেন, টিটিঙ্গি আর তার বিয়ের পরে পরেই যদি কোনো সন্তান জন্মাত এবং যদি আরও কয়েক বছর আগে বিয়ে করতেন তবে আজ হয়তো রংকিনীর সমবয়েসি একটি মেয়ে নিঃসন্তান আহুকের থাকতে পারত। নিজের কোনো সন্তান নেই তাই অপত্যবোধ কাকে বলে তা জানার সুযোগ তাঁর হয়নি এ জীবনে। এক গভীর বোধ থেকে তিনি এ জীবনে বঞ্চিতই রয়ে গেলেন। তাই সববয়েসি নারীকেই নারীর পূর্ণ মহিমাতে প্রেমিকা হিসেবেই দেখতে তিনি অভ্যস্ত।

ঘুম পায়নি? সেই কাকভোরে তো উঠেছ? সারাদিনে বিশ্রামও তো পাওনি একটুও।

আহুক জিজ্ঞেস করলেন।

বিশ্রামই বিশ্রাম। আমাকে যে কী টেনশান-এ থাকতে হয় সারাদিন তা আপনি অনুমানও করতে পারবেন না। শুধু দিনই বা কেন? রাত-দিন যেকোনো সময়েই। ভারি বিশ্রী কাজ। তবে চুমকির অত রকমের বাণিজ্যের মতো অত যাচ্ছেতাই নয়। অবশ্য ওর আয়ও সেইরকম। কিন্তু নিজের উপার্জিত টাকা নিজে হাতে যে একটুও খরচ করবে সেই সময়টুকুও পায় না বেচারি। সত্যি বলছি। এখানের প্রতিটি মুহূর্তই তাই বিশ্রাম আমার। তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করছি।

অনুভব না উপভোগ?।

ওই হল। অত ভালো বাংলা জানি না আমি।

তুমি কি আর একবার চান করবে শোয়ার আগে? এখানে না আছে এসি, না ফ্যান। ঘেমে-চুমে তো একাকার। হিউমিডিটিও আছে।

জলে টান পড়বে না?

কী জন্যে?

না, চান করলে।

তা পড়বে না। তবে ভোলা জলে চান করবেই বা কেন এখানে এসে! সমুদ্রে চান করো।

এই রাতের বেলা?

রাত আর দিনে তফাত কী? এই দ্বীপের মালকিন তো তোমার বন্ধু। তার বকলমে আমি। আমি না-হয় এই দ্বীপের চারদিকে তটভূমির মালিক করে দিলাম তোমাকেই। এমন সুযোগ পাবে কোথায়? তবে সাঁতার জানো তত ভালো?

তা জানি। কিন্তু সুইমিংপুলে সাঁতার কাটা আর সমুদ্রে সাঁতার কাটা তো এক নয়।

তা নয়। তবে সমুদ্রে সাঁতার কাটার চেয়েও অনেকই কঠিন জীবনে সাঁতার কাটা। সেখানেই যখন পটু সাঁতারু হয়েছ তখন সমুদ্রে ভয় কী?

তার পরই বললেন, স্যুইমস্যুট এনেছ তো?

এনে তো ছিই! কিন্তু সে তো হোটেলেই রয়ে গেছে সুটকেস-এ। হোটেলের সুইমিং পুলটা ছোটো তাই আমাদের দুজনের কেউই জলে নামিনি।

স্যুইমস্যুট না এনেছ না এনেছ বার্থডে স্যুটটা তো এনেছ সঙ্গে করে। এখানে তোমাকে দেখছেটা কে? তোমাকে তো আগেই বলেছি। এমন দ্বীপের মালিকানা গ্রিস শিপিং-ম্যাগনেট আরি ওনাসিস আর জ্যাকুলিন কেনেডি বা লেডি ডায়ানা আর ডোডিদেরই মানায়। আমাদের মতো পাতি আর ভীতু আর পুতুপুতু মধ্যবিত্ত মানসিকতার বাঙালিরা এই সম্পদের মূল্য বুঝব কী করে! এই মালিকানার দামই বা দেব কী করে।

আমার মধ্যে যে একজন জ্যাকুলিন বা লেডি ডি নেই, তা আপনি জানলেন কী করে?

আমি কী করে জানব? আছে কি না তো তোমারই জানার কথা। থেকে থাকলেও থাকার লক্ষণ এখনও প্রকট হয়নি।

কথা ঘুরিয়ে রংকিনী বলল, রাতের বেলা সি-বিচ-এ সাপটাপ থাকে না?

প্রত্যেক মেয়েই গুগলি-বোলার। কোন কথা কোথায় ফেলে কোন দিকে কেমন করে ঘোরাতে হয়, তা তাদের মতে, পৃথিবীখ্যাত পুরুষ বোলারেরাও জানে না।

আহুক বললেন, ভয় পাচ্ছ চান করার সময়ে কামড়ে দেবে বলে?

হ্যাঁ। পাচ্ছিই তো। এমন অভিজ্ঞতা তো কোনোদিনও হয়নি। পুরী কি গোপালপুর কি কোভালোম-এও তো সন্ধের পরে কেউ থাকে না সি-বিচ-এ।

থাকে না ঠিকই। তবে সেটা মানুষেরই ভয়ে। কাঁকড়া বা অন্য কিছুর ভয়ে নয়। মানুষের মতো ভয়াবহ জীব এই পৃথিবীতে আর তো নেই!

তা তো বটেই! বিশেষ করে পুরুষমানুষ।

আহুক বললেন, ডালহাউসি স্কোয়ারে যত শ্বাপদ আছে তত তো ভারতের কোনো জঙ্গলেও নেই। এখানে মানুষের ভয় নেই। আমাকে পুরুষ বলে গণ্য কোরো না। আমি না হয় তোমার সঙ্গে যাবই না। তোয়ালে দিচ্ছি। চলে যাও। এখান থেকে তো তটভূমি দেখাও যায় না। যদি দেখা যেতও তবেও চাঁদের আলোতে কোনো Mermaid বা জিন বা পরি তটভূমিতে নেমেছে সমুদ্রে জলকেলি করতে মনে হত, অস্পষ্ট, রহস্যময়ী তাকে, দূর থেকে। চোখ দিয়ে ছুঁলে তাতে তো জিন বা পরির কিংবা Mermaid-এর সতীত্ব নষ্ট হত না! তবে, এত ভয় কীসের তোমার?

হঠাৎ-ই রংকিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাব চান করতে। একটা তোয়ালে দিন।

শুধুই তোয়ালে? তোমাকে নতুন সাবানও দেব।

কী সাবান?

চন্দন সাবান। তার পরে আতরও দেব।

কী আতর?

ফিরদৌস।

আতর কী করে মাখে তা আমি জানি না। আতর তো মাখে মুসলমানেরা।

মুসলমানেরাই তো জানে জীবন কী করে উপভোগ করতে হয়। খাওয়া-দাওয়া আদর সোহাগ তো তাদের কাছ থেকেই শেখার ছিল সকলেরই। বোকারা শিখল না, তা কী করা যাবে।

আতর মাখতে অনেকেই জানে না। সবকিছুই শিখতে হয়। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। থাকো তুমি কটা দিন এখানে তোমাকে শেখাব কী করে ভালোবাসতে হয় জীবনকে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে। তুমি সম্পূর্ণ অন্য নারী হয়ে ফিরবে এখান থেকে।

আর যদি না ফিরি?

তোমার খুশি। তবে হাতে অনেকই সময় আছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তার ওপরে শয়তানের ভর হলে তবেই মানুষে তাড়াহুড়ো করে। কখনও তাড়াহুড়ো কোরো না। কী কাজে, কী খেলায়। তাড়াহুড়ো করলেই স্টাম্প-আউট হবে।

কাঁকড়া নেই বিচ-এ? সত্যি তো?

তোমার খাওয়ার জন্যে কাঁকড়া আছে জালাতে। এখানে অতিথি এলে যাতে অপ্রস্তুতে না পড়তে হয় তাই কাঁকড়া রাখা থাকে। তবে সেসব বড়ো কাঁকড়া জেলেদের কাছ থেকে কেনা। জিয়োনো থাকে। সি-বিচ-এ কাঁকড়া নেই।

তার পর একটু চুপ করে থেকে আহুক বললেন, তবে ভয়ের মধ্যে একটি ভয় আছে।

কী?

একটা খুব বড়ো মেয়ে টুনামাছ।

মাছটি যে মেয়ে, তা জানলেন কী করে?

সে যে আমার প্রেমিকা। কত গল্প হল সেদিন তার সঙ্গে। তাকে ধরার জন্যে কতদিন ধরে প্রাণপাত করছি কিন্তু ধরতে পারিনি। কিন্তু সেদিন সে নিজেই ধরা দিল।

ধরেছেন! কই? দেখি। খুব বড়ো মাছ?

খুবই বড়ো। তবে যে স্বেচ্ছায় ধরা দেয় তাকে কি ধরা যায়? না খাওয়া যায়? কোনো ভদ্রলোক পুরুষই তা করতে পারে না। মাছ তো ধরে, ধরেছে কত মানুষেই, কিন্তু মাছের সঙ্গে প্রেম করেছে এমন একজন মানুষকেও কি তুমি জানো স্বদেশে বা বিদেশে!

আপনি সত্যিই অদ্ভুত মানুষ।

অদ্ভুত কী! এল কিম্ভুত। নইলে এই হর্নেটস নেস্ট-এ কেউ থাকে? একা একা?

এখানে নাকি অনেক প্রেতাত্মা আছে?

থাকতে পারে। অনেকেই বলে আছে। তবে আমি নিজেই বাঘা-ভূত বলে কোনো lesser ভূত আমার সামনে সাহস করে আসেনি এপর্যন্ত। ভীরাপ্পানের সঙ্গে নাকি একটা শাঁখচুন্নি আর একটা ব্ৰহ্মদৈত্যের দেখাও হয় মাঝে মাঝে। শাঁখচুন্নি থাকে একটা অর্জুন গাছে আর ব্রহ্মদৈত্যটা থাকে বহু প্রাচীন এক প্যাডক গাছে।

শাঁখচুন্নি আর ব্রহ্মদৈত্য তো বাঙালি ভূত।

ঠিকই। ভীরাপ্পান তেলুগু নামেই ডাকে তাদের। তবে তাদের চেহারার যা-বর্ণনা দেয় তা শুনেই আমি তাদের বাঙালিকরণ করেছি।

সেটা ভালোই করেছেন।

ভীরাপ্পান মাঝে মাঝে দিনমানে গিয়ে তাদের ভেট-টেটও দিয়ে আসে।

কী ভেট? খাবার?

না না। খাবার-টাবার নয়। এত বড়ো দ্বীপ রয়েছে, চারদিকেই সমুদ্র তাদের, খাদ্য পানীয়র অভাব নাকি?

তবে কী ভেট দেয়?

শাঁখচুন্নিকে দেয় লালরঙা শায়া, চুল বাঁধার রিবন। কুড়ি গজ মার্কিন কাপড়ে তৈরি হয় সেই শায়া। তার পর রঞ্জক সাবান দিয়ে অনেক যত্নে লাল রং করে ভীরাপ্পান। অদ্ভুত সাইজ। লম্বাতে পেল্লাই অথচ কোমরের মাপ তোমারই মতো।

লজ্জা পেল রংকিনী।

মনে মনে বলল, আমার কোমরের মাপ আপনি জানলেন কোত্থেকে?

তার পরে বলল, সেই শাঁখচুন্নি কি অন্য রঙের শায়াও পরে?

আরে না। কিছুই পরে না। একদিন ভীরাপ্পানের সঙ্গে ভরসন্ধ্যায় মিষ্টি জলের পুকুরের পারে নাকি তার দেখা হয়েছিল। একেবারে উদোম। তার পরে এরকম লেঙথ উইদাউট ব্রেথ অ্যাণ্ড ব্রেস্টস চেহারা! ভীরাপ্পান তো এমনিতেই পয়লা নম্বরি নারীবিদ্বেষী, জীবনে নারী সঙ্গ করেনি, নগ্না রমণী দেখেওনি, সে-ই পড়ল তো পড় উদোম শাঁখচুন্নির খপ্পরে। লজ্জা পেয়ে ভয় পেয়ে, জিভ কেটে দৌড়োত দৌড়োতে এসে সে তার সেই নগ্নিকামূর্তি দর্শনের বর্ণনা দিল তার খিচুড়ি ভাষাতে। সেই বর্ণনা যদি তুমি শুনতে! তেলুগু, তামিল, হিন্দি এবং ইংরেজি মেশানো সে কী অপাচ্য পাঁচন। পাছে তাকে নগ্নিকা আবারও দেখা দেয় সেই ভয়েই বীরাপ্পান তাকে তুষ্ট করে চলেছে।

রংকিনী হেসে উঠল খুব জোরে।

হেসে উঠেই চুপসে গেল। বহু বছরের মধ্যে এমন নির্দোষ আনন্দর ভাগীদার যে, সে হয়নি তা হঠাৎ-ই বুঝতে পেল। এমন অট্টহাসিও হাসেনি বহুদিন যে, সেকথাও। বুঝল যে, তারমধ্যে থেকে ঘুমিয়ে-থাকা অন্য একজন রংকিনী আস্তে আস্তে পাপড়ি মেলছে এক এক করে। যে রংকিনীকে ও চিনত না। জানত না কখনোই।

হাসির দমক সামলে উঠে বলল, আর ব্রহ্মদৈত্যকে কী ভেট দেয় ভীরাপ্পান?

তাকে দেয় খেটো ধুতি, কাঠের খড়ম দু-হাত লম্বা বাঁশের বাখারির তৈরি কানখুশকি আর কালো নারকোল-এর খোলের মালা।

বাঃ।

বা: কেন?

শুনে রোমাঞ্চ হচ্ছে আমার, তাই বাঃ।

চানের কী হল?

আজ থাক। আগে দিনমানে কাল সব দেখে-টেখে নিই। তটভূমির কোন জায়গাটি সবেচেয়ে রোমান্টিক সে-জায়গাটা আবিষ্কার করি তার পরে মন যদি লাগে, ভয় যদি কাটে, তবে না-হয় রোজই রাতেও চান করা যাবে।

আমাকে সঙ্গে নেবে তো? লাইফ-গার্ড ছাড়া কিন্তু যাওয়াটা ঠিক হবে না।

নিতেই পারি। ভেবে দেখব। চানঘরে সবাই একাই যায় কিন্তু সমুদ্রস্নানে যায় সদলেই।

কথাটা যেন কোথায় পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। কোনো বাংলা উপন্যাসে কি?

ইয়েস স্যার। চানঘরে গান। পত্রোপন্যাস।

তুমি বাংলা বই পড়ো নাকি?

আমি পড়ি। কিন্তু চুমকি বলে বাঙালি সাহিতিকেরা সবাই আতা-ক্যালানে।

হো হো করে হেসে উঠলেন আহুক। বললেন, গ্রেট। শি ইজ রিয়্যালি গ্রেট। একেবারে ওরিজিনাল ওর সব অভিব্যক্তি। দারুণ মেয়ে কিন্তু তোমার বন্ধু ওই চুমকি।

আপনি পড়েন?

পড়ি। তবে খুব বেছে বেছে। চুমকি খুব খারাপ বলেনি কথাটা। তবে এমন জেনারালাইজ করাটা ঠিক না। ইংরেজিতেই বা কী লেখা হচ্ছে? সাহিত্যিক এল, গায়ক এল, আঁকিয়ে এল সর্বত্রই এখন আতা-ক্যালানে পায়ে-তেল-মাখানোদের যুগ। নয়তো এস্টাব্লিশমেন্টের আত্মসম্মানজ্ঞানহীন চাকর, কুকুর-মেকুরের দিন এখন।

তার পর বলল, আপনি এখানে খবরের কাগজ তো পান না, ইলেকট্রিসিটিও নেই যে টিভি দেখবেন, আপনার পাগল-পাগল লাগে না? পৃথিবীতে রোজ কত কী ঘটছে তার কিছুমাত্র খোঁজ রাখেন না, আপনার আই কিউ তো একেবারেই নেমে যাবে।

আমি তো আর কারো কাছে চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি না। এখন তো সব কিছুরই মূল্যায়ন টাকাতেই। যার বেশি আই কিউ সে বেশি মাইনের চাকরি পাবে। ওসব Pettifogging থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। বেশ আছি। খবরের কাগজ পড়ে হয়টা কী? কাগজওয়ালাদের বড়োলোক করা ছাড়া? মিসেস মার্গারেট থ্যাচার, ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর জীবনীর দ্বিতীয় খন্ডে কী লিখেছিলেন জানো, খবরের কাগজ সম্বন্ধে?

কী?

If what the press wrote was false, I could

ignore it, and if it was true. I already knew

it… …, I learned to sheild myself from

newspapers by the simple expediency of not

reading them.

রংকিনী হাসল শুনে। বলল, বাঃ। ওঁর জীবনীর নাম কী? আত্মজীবনী?

হ্যাঁ। নাম হচ্ছে The Path to Power। কলকাতায় ফিরেতে গিয়ে জোগাড় করে পড়ে ফেলো।

রংকিনী চুপ করে রইল।

তার পরেই হাতঘড়ি দেখে আঁতকে উঠল। বলল, ইশ! সাড়ে-এগারোটা।

আজই ওই বিচ্ছিরি জিনিসটিকে হ্যাঁণ্ডব্যাগে পুরে ফ্যালো। যত নষ্টের গোড়া। আসলে এই ঘড়িই আমাদের সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছে। আমি একে একেবারেই বর্জন করেছি। ক্যালেণ্ডারকেও। আমার জন্মদিন কবে তা আমি জানতে পারি না। মৃত্যুদিনও জানবে শুধু ভীরাপ্পান। অবশ্য যদি সেইসময়ে সে এখানে থাকে। ও না থাকলে জানবে সামুদ্রিক পাখিরা। যারা এসে বসবে আমার শবের ওপরে। কী শান্তি এল তো! শান্তি কি শুধু আমারই! শান্তি কত্ত মানুষের! যারা উঠতে বসতে আমার মৃত্যুকামনা করেছে তাদেরও ফুল হাতে করে আসতে হবে না মৃতদেহের কাছে। আমার আত্মাও বেঁচে যাবে মৃত্যুর পরেও সেইসব দুরাত্মার সংস্পর্শ থেকে। তোমরা সভ্য সমাজের মানুষেরা প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টা যাই করো, তার খুব কমই মানুষের মতো কাজ। তোমরা তোমাদের ঘড়ির চাকর, মনিবের চাকর, অভ্যেসের চাকর, চক্ষুলজ্জার চাকর, সামাজিকতার চাকর, লোকভয়ের চাকর। সকলেরই চরণ ছুঁয়ে বেড়াচ্ছ তোমরা।

বাঃ। তবুও সমাজকে কি একেবারে বর্জন করলে চলে?

সমাজ? যে সমাজ তোমার ভালো হলে ঈর্ষায় সবুজ হয়ে যায়? যে সমাজ তোমার ক্ষতি হলে উল্লাসে মেতে ওঠে? সেই ভন্ড সমাজের মেকি মানুষদের সঙ্গে ঘড়ি মিলিয়ে পায়ে-পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে একদিন দেখতে পাবে যে, আমার মতো বুড়ো হয়ে গেছ। তার পর একদিন মরেও যেতে হবে। মিছিমিছি। বুঝবে যে, মিছিমিছি জন্মে মিছিমিছিই মরে গেলে। না বাঁচলে এ জীবনে নিজের জন্য, না সত্যি সত্যিই পরের জন্যে। চুমকির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, তোমরা এই সভ্য, সংস্কৃত, শিক্ষিত, সামাজিক সব জীবেরা প্রত্যেকেই এক একটি আতা-ক্যালানে।

রংকিনী চুপ করেছিল। অনেকক্ষণ চুপ করেই রইল।

আহুকও চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ।

হঠাৎই এক সময়ে উঠে পড়ে বললেন, ওঠো! এবারে শুয়ে পড়ো গিয়ে।

আপনি কোথায় শোবেন? বিছানা তো একটাই।

জানি। বিছানাতে নতুন ধোওয়া ও ইস্তিরি-করা চাদর পেতে দিয়েছি। বদলে দিয়েছি বালিশের ওয়াড়। আতর লাগিয়ে দিয়েছি বালিশে, পাশবালিশে। ফুল ছড়িয়ে দিয়েছি বালিশের পাশে।

কী আতর?

শাবে দুলহান।

তা তো হল, আপনি শোবেন কোথায়?

বারান্দার ইজিচেয়ারে।

সে কী? রাতে যদি বৃষ্টি আসে?

যদি কেন, বৃষ্টি তো আসবেই।

তবে?

তবে কী? তোমার বিছানা থেকে শাবে দুলহান-এর গন্ধ উড়ে আসবে বৃষ্টিভেজা হাওয়াতে। চেয়ারে আমি অন্য কাতে শোব তখন। কী করা যাবে? বিছানা আর খাট তো একটাই।

কিন্তু খাটটা তো মস্ত চওড়া।

তা চওড়া। বিবাহিত দম্পতিরা অনায়াসে শুতে পারেন।

আমি যে অন্য কারো সঙ্গেই শুতে পারি না।

রংকিনী অসহায়ের গলাতে বলল।

আমিও না, আহুক বললেন। তার পরই বললেন, কী মিল এল তো দুজনের। সারারাত কি কারো সঙ্গেই শুয়ে থাকা যায়? আমি তো ভাবতেই পারি না। ভাল্লুকের সঙ্গে তবু হয়তো পারি কিংবা আন্দামানি শুয়োরের সঙ্গে কিন্তু কোনো যুবতীর সঙ্গে? নেভার। কোনো সুন্দর কিছুকেই বেশিক্ষণ একটানা কাছে, অত কাছে রাখতে নেই। ফুলেরই মতো সৌন্দর্য, রহস্য, সুগন্ধ তাতে দলে গিয়ে মলিন হয়ে যায়। এই তো ভালো। কত যে ভালো, তা এখানের এক একটি করে রাত পোয়বে আর বুঝতে পারবে। তুমি তো ছোট্ট মেয়ে। খুকিটি। তুমি কিছু বোঝো না।

রংকিনী অবাক হয়ে ওই কিম্ভুত মানুষটির দিকে চেয়েছিল।

আহুক বললেন, এখানে অভাব শুধু জিনিসের।

কীসের?

আয়নার। আয়না নেই কোনো। তোমার যখনই নিজেকে দেখতে ইচ্ছে হবে, আমার সামনে আসতে হবে তোমাকে।

সে কী? কেন?

আমার চোখই তোমার আয়না।

তার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবারে শুয়ে পড়ো। কাল একেবারে ভোরে, আলো ফোঁটার আগে আগে আমরা বেরিয়ে পড়ব। তোমাকে পুরো দ্বীপটি ঘুরিয়ে দেখাব। দ্য হর্নেটস নেস্ট। এখনও ঝড়ে-পড়া ভাঙা জাহাজের অংশ দেখতে পাবে তটের ওপরে। যদি চাও তো গুপ্তধনও খুঁজে দেখতে পারো। অনেকে বলে, সেশেলস দ্বীপপুঞ্জের আশ্চর্য দ্বীপেরই মতো, সেখানের বো ভালো তটেরই মতো, এই দ্য হর্নেটস নেস্ট-এও অনেক গুপ্তধন পোঁতা আছে। রাতের বেলা তো সব প্রেতাত্মারা নাকি সেইসব ধনই পাহারা দেয়। যক্ষ আর যক্ষিনী আছে নাকি অনেক।

ভয় দেখাবেন না আমাকে।

ভয় দেখাচ্ছি না। Mere statement of fact.

এই সেজ-বাতিটা ঘরে জ্বললে সারারাত আমি শোব বা ঘুমোব কী করে? জানালাতেও তো কোনো পরদা-টরদা নেই। বাতি জ্বললে ঘুমোতে পারি না আমি। তা ছাড়া এমন আব্রুহীন ঘরে…

তোমার কোনো ভয় নেই। শোয়ার আগেই বাতির শিখা কমিয়ে দিয়ো। চাঁদের আলো থাকবে। এখন শুক্লপক্ষ। সারারাতই চাঁদ থাকবে, মাঝে মাঝে মেঘে ঢাকা পড়লেও। সুন্দর সব স্বপ্ন দেখো তুমি আজ ঘুমের মধ্যে। কাল সকালে তোমাকে একটি ফুল-ফোঁটা গাছের নীচে নিয়ে যাব। গাছটি অস্ট্রেলিয়ান। সাদা সাদা ফুল ধরে। মূলভূখন্ডে ফুল ধরে মার্চ মাসে আর শেষ হয় এপ্রিলে। অথচ এখানে, দেখো ডিসেম্বরে ফোটে।

কী নাম?

গ্লিনিসিডিয়া সুপার্বা।

বলেই, বললেন, তুমি কখনো পালামৌর বেতলাতে গেছ? যেখানে টাইগার প্রোজেক্ট হয়েছে?

না।

বেতলার মূল বন-বাংলোর হাতাতে, আর বাওয়ার্চিখানার মধ্যে এই গাছ আছে একটি। গাছটি তো দেখে সকলেই, ফুলও দেখে, কিন্তু চিনে রাখে ক-জন এল? কখনো গেলে গাছটিকে দেখে এসো।

বলেই, একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আর এদিকে এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যদি এ জীবনে আবারও কখনো আসো তবে এই আহুক বোস-এর খোঁজ কোরো দ্য হর্নেটস নেস্ট এ এসে। বেতলার গাছটা থাকবে অনেকই দিন তবে আমি যে থাকবই তা কে বলতে পারে। গাছ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, নালা, কুমির, কচ্ছপ সকলেই মানুষের চেয়ে অনেকই বেশি আয়ু নিয়ে এসেছে এই পৃথিবীতে। অথচ পরম বুদ্ধিমান মানুষ এই কথাটাই সবসময়েই কেমন ভুলে থাকে। বাঁচো, বাঁচো, বাঁচো রংকিনী। দারুণভাবে বাঁচো।

তাহলে এবারে তুমি দরজাটা বন্ধ করে নাও। বাথরুমের বাতিটা জ্বলে সারারাত। সাপখোপ আছে তো। ওটা নিভিয়ো না। তবে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে। শোয়ার ঘরের বাতিটা নেভালে চাঁদ আর সমুদ্রকে উপভোগই করতে পারবে না। বিছানাতে শুয়ে শুয়েই দেখবে সমুদ্র তোমার দিকে অপলকে চেয়ে আছে আর চেয়ে আছে চাঁদ। চানঘরে তোয়ালে-সাবান সব আছে। গুডনাইট।

গুডনাইট। বলেই, রংকিনী বলল, দরজা বন্ধ করে দিলে রাতে আপনার যদি বাথরুমে যেতে হয়…

কোনো চিন্তা নেই। এতবড়ো দ্বীপে সেসব কোনো ব্যাপারই নয়। আমি তো জংলিই।

আমাকে পাহারা দেবেন কিন্তু।

নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাকে কে পাহারা দেবে?

মানে?

আমার লোভকে?

লোভ? কীসের লোভ?

না : কিছু না। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও। সব কথার পিঠে কথা বলতে নেই। সব প্রশ্নের উত্তরও চাইতে নেই। উত্তর হয় না সব প্রশ্নের। তুমি সত্যিই একটা ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে।

আর আপনি একটি..

মুখে কিছুই বলল না রংকিনী।

মনে মনে বলল অনেক কথা। তবে সেগুলোর একটিও নিন্দাবাচক নয়।

নতুন জায়গা। তার পর বড়ো বড়ো খোলা জানালা। বারান্দাতে শুয়ে একজন সদ্য পরিচিত, সানট্যানড, অভিজ্ঞ, শক্ত-সমর্থ শরীরের পুরুষমানুষ। যতই বুড়ো বুড়ো করুন নিজেকে, বুড়ো যে মানুষটি আদৌ নন তা, না বোঝার মতো বোকা রংকিনী নয়। ইংরেজি প্রবাদ বলে After forty-Naughty।

গতকালই চুমকি বলছিল, আহুক বোস অন্য ধরনের পুরুষ।

কীরকম?

রংকিনী জিজ্ঞেস করেছিল।

পুরুষ যতই বুড়ো হয় তত বেশি ছুঁকছুকে হয়। যত বুড়ো ততই বিপজ্জনক। যারা স্ত্রৈণ থাকে যৌবনে, তারাই ঝৈন হয় প্রৌঢ়ত্বে।

ঝৈন কী?

রংকিনী জিজ্ঞেস করেছিল।

স্ত্রীতে যে আসক্ত, সে যদি স্ত্রৈন হয়, তবে ঝি-তে আসক্ত যে, সে ঝৈন হবে না কেন?

এবার একটা বাংলা ব্যাকরণের বই লেখ তুই।

রংকিনী বলেছিল।

অস্বস্তি তো হয়ই। কিন্তু মানুষটিকে ইতিমধ্যেই খুবই ভালো লেগে গেছে রংকিনীর। এমন রোমান্টিকতা কোনো-বয়েসি পুরুষেরই মধ্যে দেখে তো নিই, কখনো দেখবে বলেও ভাবেনি। তবু, উনি জাতে তো পুরুষ! বিশ্বাস কী?

চাঁদভাসি সমুদ্র দেখেছে রাতে সমুদ্রমুখী জানালার কাছে একা দাঁড়িয়ে। এর পর যখন আতরের তীব্র, বিজাতীয় এবং অনভ্যস্ত সুগন্ধে আমোদিত বিছানাটি ভরে গেছে নরম চাঁদের আলোতে তখন বিছানার ওপরে জোড়াসনে বসে দু-চোখ ভরে সমুদ্র দেখেছে। পলশান যে কী? তা এখানের আকাশ বা বাতাস জানেই না। নির্মল, পবিত্র পরিবেশ, প্রতিবেশ। নানা শব্দ উঠেছে ঘন বনের গভীর থেকে রাতের বিভিন্ন প্রহরে। পাখি, পোকা, সরীসৃপের গা-ছমছম করা আওয়াজ। বর্ষাস্নাত হাওয়াবিহীন গভীর রাতের বন থেকে এককথাতে অপ্রকাশিতব্য এক মিষ্টি-তিক্ত-কটু-কষায় গন্ধ উঠেছে। যদিও এখন বর্ষাকাল নয়, চুমকি এবং আহুক-এর কাছে শুনেছে, বর্ষা এখানের নিত্যসঙ্গী। ক্যালেণ্ডারের তোয়াক্কা না করেই সে আসে, যখন তখন তার খেয়াল-খুশি মতো।

কেন যে, এই সাংঘাতিক নামের দ্বীপে রয়ে গেল রংকিনী কে জানে, খাটে বসে ভাবছিল ও। কী লিখে রেখেছেন তার নিয়তি, তার জন্যে এই সমুদ্রমেখলা দ্বীপে? এখন সেই প্যাডক। গাছের ব্রহ্মদৈত্য আর গর্জন গাছের শাঁখচুন্নি কী করছে, কে জানে! সেই অস্ট্রেলিয়ান ফুলের গাছটিতে কি এই রাতে নিভৃতে এখন ফুল ফুটছে? ফুল ঝরছে? সাদা সাদা? সুপার্বা গ্লিনিসিডিয়াতে?

কাল সকালে আহুক বোস এর সঙ্গে দ্বীপ পরিক্রমাতে যাবে– এই ভাবনাই তাকে এক চাপা উত্তেজনাতে উত্তেজিত করে রেখেছে। কিন্তু ভীরাপ্পান যদি কালও না আসে? অন্তর্বাস কাল কাঁচতেই হবে। কোথায় শুকোতে দেবে ব্রা আর প্যান্টি? কী যে করে রংকিনী! নানা চিন্তা করতে করতে কত রাত অবধি জেগেও ছিল ও, জানে না। যেই মনে করেছে এমন সমুদ্রমেখলা-পরা একটি আদিম অরণ্যসংকুল ছোট্ট দ্বীপে সে একা এক অচেনা পুরুষের সঙ্গে রাত কাটাচ্ছে, ওর নিজেকে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এ কি স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন? কী করে পারল ও এমন অঘটন ঘটাতে? সমাজ জানলে কী বলবে? ছি! ছি :! সমাজ কি বিশ্বাস করবে যে…

আহুক বলছিলেন, এই দ্বীপে ইগুয়ানো আছে অনেক। কালকে দুটি শিকার করে খাওয়াবেন। কী দিয়ে শিকার করবেন তা কে জানে! একটা ছবি দেখেছিল রংকিনী বহুদিন আগে এলিজাবেথ টেইলর আর রিচার্ড বার্টনের। ছবিটির নাম ছিল দ্য নাইট অফ দ্য ইগুয়ানো। আরও একটি ছবি দেখেছিল ওঁদেরই। তার নাম ছিল দ্য স্যাণ্ডপাইপার্স। এখানে নাকি অনেক স্যাণ্ডপাইপার্স পাখিও আছে। সমুদ্রতটেই সে পাখিরা থাকে। কালু। সি-ইগল। সেদিন বে-আইল্যাণ্ড হোটেলের বারান্দার মতো ড্রয়িংরুমে বসে যে বড়ো পাখি দুটোকে দেখেছিল ওরা সেগুলোর নাম নাকি হোয়াইট বেলিড সি-ইগল? সত্যি! মানুষটা অনেকই জানেন। কিন্তু কেবলি বলেন যে, আমি তো ইউনিভার্সিটিতে যাইনি। কোনো ডিগ্রি পাইনি। আমি তো সর্বার্থেই অশিক্ষিত।

উনি যদি অশিক্ষিত হন তবে শিক্ষিত কাকে বলবে ভেবে পায় না ও। রংকিনীর বাবা Thcoat The purpose of a University is to bring the horse near the water and to make it thirsty. এই তৃষা কারো কারো হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে না গেলেও থাকে। অধিকাংশরই আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পচে-গলেও সে তৃষা জন্মায় না।

.

০৭.

এই ভাবনাটি আগে কখনোই মনে আসেনি আহুক বোস-এর। এ এক বিধুর বিরহের বোধ। আসছে কিছুদিন হল, ফিরে ফিরেই।

মানুষটি তাঁর নামেরই মতো। অসাধারণ নন। তবে অবশ্যই অন্যরকম। অন্যরকম অবশ্যই। তা নইলে সমুদ্রঘেরা এই ছোট্ট দ্বীপে ছ-বছর একা আছেন কী করে?

দ্য হর্নেস্ট নেস্ট আইল্যাণ্ডের পুবের আকাশে আর সমুদ্রে এখন আলোর আভাস ফুটছে। কোনোদিন চাঁদকে সাক্ষী রেখেই পুবালি বাতাস পাখিদের জাগাতে জাগাতে দ্বীপে আসে, বড়ো ভালোবেসে আসে, কোনোদিন বা সাক্ষীহীন। এই সুন্দর সমুদ্রমেখলা-ঘেরা দ্বীপ এবং এই নিতুই-নব সমুদ্রকে, প্রাচীন, আদিম সব প্যাডক গাছেদের ঘনসন্নিবিষ্ট বনের গভীর রহস্য, প্যারাকিটদের চাবুকের মতো ডাকে যখন ফুটন্ত আলোতে দ্রবীভূত না হয়ে আরও ঘনীভূত হয়, তখন আহুক নিজের আস্তানা ছেড়ে দ্বীপের শেষপ্রান্ত অবধি হেঁটে গিয়ে পুবে চেয়ে সূর্যকে স্বাগত জানান।

না, না সূর্যপ্রণাম-ট্রণাম করেন না তিনি। কোনো দিনও করেননি। প্রণম্য কোনো কিছুর সংস্পর্শেও আসেননি এখনও। না কোনো মানুষ, না কোনো দেব-দেবতা। তবে, তাঁর হৃদয়ে যে ভুবনেশ্বর, হৃদয়েশ্বর বাস করেন তাঁর কাছে সদাই মাথা নোয়ান, মনে মনে।

কোরান, সব ইসলাম ধর্মাবলম্বীকে শিখিয়েছে যে, আল্লার কাছে ছাড়া আর অন্য কারো কাছেই মাথা নোয়বে না কখনো। আহুক তাঁর নিজস্ব অদেখা কিন্তু সদানুভূত ঈশ্বর, বা হৃদয়েশ্বর বা ভুবনেশ্বর ছাড়া এ জীবনে কারো কাছেই মাথা নোয়াননি। আশা রাখেন তিনি যে, যতদিন প্রাণ আছে, নোয়াবেন না।

সেলুলার জেল শুধু আন্দামানেই নেই, বন্দিরা শুধু সেখানেই অত্যাচারিত হননি নির্মমভাবে, সেই জেল আছে প্রত্যেক মানুষেরই বুকের মধ্যেও। সেই জেলে সে নিজেই বন্দি, নিজেই জেলার, নিজেই ফাঁসির আসামি। এবং ঘাতক।

বিরহী মন, বিরহী দ্বীপ, বিরহী সমুদ্র বুকের মধ্যে কেন জানেন না, ভোরের পুবালি বাতাসের মতো মুঠো মুঠো দুঃখ বয়ে আনে। অথচ এ দুঃখ কোনো মানুষকেই ক্লিষ্ট করে না, বরং স্নিগ্ধ করে।এ দুঃখের শেষ একদিন নিশ্চয়ই হয় সব মানুষেরই জীবনে। শেষ হওয়ারই কথা। কারণ, এ অশেষ নয় বলে।

একটা সময়ে, সপ্তাহে অন্তত একবার নিজের গাড়ি চালিয়ে কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরে যেতে হত আহুক-এর। ষাটের দশকে। বিরহী নামের একটি জনপদকে পেরিয়ে গেছে সে পথ। উষালগ্নে যাওয়ার সময়েও সেই জনপদ ঘুমিয়ে থাকত, অনেক রাতে যখন ফিরতেন তখনও সে জনপদ ঘুমিয়ে থাকত। আশ্চর্য সুন্দর একটি বাঁক ছিল সেই পথটিতে বিরহীর কাছে। সেই বাঁকটি যেন বিরহী নামটিকে সার্থকতা দিত। যেখানে বাঁক নেই সেখানে তো বিরহ থাকে না।

আজকের ন্যাশনাল হাইওয়েতে সেই বাঁক নিশ্চয়ই নেই। নেই প্রকান্ড প্রকান্ড ঝুঁকে-পড়া মহীরুহ–সরু, আঁকাবাঁকা পথের দু-পাশে। নেই সেই নির্জনতা।

আহুক বোস ভাবেন যে, এই নীল সমুদ্রের মধ্যে এই লাল-মাটি সবুজ-বনের দ্বীপ, সেই দ্বীপে এমনই সুন্দর সকাল প্রতিদিনই ফিরে ফিরে আসবে, যদি না মানুষের লোভ আর অহং আর হঠকারিতা, একে অন্য অনেক সুন্দর নির্জন জায়গারই মতো, ধ্বংস করে দেয়।

প্রার্থনা করেন, সবই থাকবে। এই প্যাডক গাছের বন, চিড়িয়া টাঙ্গু, ওয়াণ্ডারুর থেকে শুরু হওয়া সুন্দরী ম্যানগ্রোভ বন, জলপথের দু-ধারের পাহাড়ময় দ্বীপের গায়ে গায়ে বিহারের চিলবিল বা ওড়িশার গোঙুলি গাছেদের মতন সাদা নরম-কাঠের ধবধবে উরুর দীর্ঘাঙ্গী সব গাছ। তাদের নিম্নাঙ্গ, ঊধ্বাঙ্গের চেয়ে লম্বা বেশি। নানা রঙা সবুজের সমারোহর মধ্যে তাদের গায়ের সাদা, ভারি এক বৈচিত্র্য আনে। জলিবয় দ্বীপের নীল মেখলা, প্রবালমালা, সবই থাকবে। স্কিনক দ্বীপপুঞ্জর পাঁচ বোনেরা হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের মধ্যে নীল মেখলা মেলে খেলা খেলবেই প্রতিদিনই, যখন ভাটা পড়বে। রঙিন মাছ খেলা-করা আর রঙিন প্রবাল-ঘেরা স্বচ্ছ অগভীর প্রায় নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে সমুদ্র পেরিয়ে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে তখনও শিহরিত নববিবাহিত মানুষ-মানুষী হাতে হাত রেখে হেঁটে যাবে। থাকবে, সমুদ্রের গন্ধ, সাদা-পেটের ইগল-দম্পতির চকিত তীক্ষ্ণ ডাক, দূরের মেগাপড দ্বীপে মেগাপড় পাখিদের স্বপ্নও থাকবে। থাকবেন না শুধু আহুক নিজে।

সাম্প্রতিক অতীত থেকে মাঝে মাঝেই এই সুন্দরকে ছেড়ে যেতে হবে বলে বড়ো বিষণ্ণ বোধ করেন আহুক। এ নার্সিসিজম নয়। নিজেকে কোনো দিন তেমন ভালোবাসেননি তিনি। আজও বাসেন না। হয়তো বাসতেন, যদি তাঁকে কেউ তেমন করে ভালোবাসত। একমাত্র ভালোবাসাই অন্য ভালোবাসার জন্ম দিতে পারে। আনন্দই, অন্য আনন্দর।

এই প্রকৃতিকে আহুক বোস অবশ্যই ভালোবাসেন। একমাত্র প্রকৃতিই এই আদিম এবং চিরকালীন সুন্দরী, তাঁর ভালোবাসাকে দশ গুণ করে ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই ভালোবাসা সত্যি না হলে একা এই সমুদ্রমেখলা দ্বীপে তিনি থাকতে পারতেন না ছ-টি বছর।

সুখের সঙ্গে, আনন্দর সঙ্গে, ভোগ আর আরামকে নির্বিবাদে গুলিয়ে ফেলেছে আজকের এই উন্নত মানুষেরা। সর্বজ্ঞ হয়েছে তারা। কোমরে মোবাইল-ফোন ঝোলানো, হাতে কম্পিউটার-ঘড়ি পরা, বস্তুবাদী আর বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের গর্বে, মদমত্ত, আধুনিক, উদ্ধত মানুষ তার কল্পিত কোনো অস্তিত্বহীন ধ্রুবতারার দিকে দুর্বার বেগে ছুটে চলেছে, পতঙ্গ যেমন আলোর দিকে ধেয়ে যায় চিরদিন মরারই জন্যে। মহাকাশের চিরদিনের নিশ্চিন্ত নিরাপদ কোণ ছেড়ে কোনো গ্রহ বা তারা যেমন কক্ষচ্যুত হয়ে জ্বলে গিয়ে উল্কাপিন্ডে পরিণত হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তেমনই এই দুর্বিনীত মানুষেরাও নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

শেষ, সব কিছুরই আছে। ক্ষয় সব কিছুরই হয়। কিন্তু একজনের, একগ্রহের ক্ষয়-ক্ষতি বিনাশ যদি অন্য জনের মনে, অন্য গ্রহের মাটিতে ফুলই না ফোঁটাতে পারল, যদি নতুন কোনো পাখিই না ডাকল সেখানে, যদি ভয় নাশই না হল, তবে সেই ক্ষয় বা ক্ষতি তো বৃথাই। একের ভয় যদি অন্যের অভয় হয়েই না আসে, তবে তো সেই ভয় ভীষণা রাক্ষসীই!

এতসব এলোমেলো ভাবনা মনে সত্যিই আসে আজকাল আহুকের। কিন্তু এসব কথা বলবেন কাকে? আর বললেই বা শুনবেটা কে? এই ভাবনাগুলো সমুদ্রপারের টার্ন আর স্যাণ্ডপাইপারদের মতন তাঁর মস্তিষ্কের ভেতরে ঘূর্ণিনাচন নাচতে নাচতে, সর্বনাশা, চকিত, সংক্ষিপ্ত ডাকে তাঁর মাথার মধ্যে ডিম ফুটোতে ফুটোতে যখন সামুদ্রিক দিগন্তে বা ঘন সবুজ আদিম রেইনফরেস্টের অটল বাধার দিকে উড়ে যায়, নয়তো ভেঙে যাওয়া ঢেউয়ের মতো মনের বিবাগি বেলাভূমিতে ছড়িয়ে পড়ে, তখন নীচু হয়ে বসে সেইসব বিন্যস্ত ভাবনার টুকরো-টাকরা কুড়িয়ে নিতে বড়োই অনীহা আসে। যা যায়, তা যায়ই, যা গেছেই। তাঁর অনেক ঠগি প্রেমিকাদের মতো। যারা, তাঁর সঙ্গে প্রেম-প্রেম খেলা খেলেছে, তাঁকে কেউই বোঝেনি। কেই বা কাকে বোঝে?

নিজের মনে আজকে আর কোনো সংশয় বা দ্বিধা নেই। নির্জনতা ও একাকিত্ব তাঁকে অনেক কিছু ফিরিয়েও দিয়েছে, যা-কিছুই তিনি হারিয়ে ছিলেন। ওয়াল্ট হুইটম্যান, হেনরি ডেভিড থোরো, নট হামসুন, শ্রীঅরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, সকলের কাছ থেকেই তিনি নির্জনতার আর প্রকৃত আনন্দর পাঠ নিয়েছেন। সুখের আর আলসেমির পাঠ নিয়েছেন বাট্রাণ্ড রাসেল-এর কাছ থেকে।

বেশ আছেন। সুখে আছেন। কাজ বলতে যা, তা অতিসামান্যই। জীবনে আহুক অনেকই দিন, অনেকই কাজ করেছেন। কাজকে ভয় পাননি কখনোই। এখন বাণপ্রস্থর সময়। সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলে, হাওয়ার সঙ্গে কথা বলে, গাছের সঙ্গে কথা বলে, মাছের সঙ্গে কথা বলে এবং বাঁচাল মানুষদের সঙ্গে কথা না-বলে দিন বেশ কেটে যায়।

দুঃখ শুধু একটিই! এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে একদিন। এবং সেদিনের খুব বেশি দেরিও নেই। সবই আছে, থাকবে। তাঁর কাঠের বাংলোয় তাঁর পোয়র কাঠের মাচাখানি, তাঁর জুতো, চটি, তাঁর সুইম সুট, টোকা, তাঁর কলম, প্যাড, চশমা। শুধু তিনিই থাকবেন না। কত জনকেই তো বিদায় দিলেন আজ অবধি। বলে এলেন, যদি পরজন্ম থাকে তবে দেখা হবে। যদি স্বর্গ থাকে, তবেও।

যদি!

যদি নাই থাকে, নাই বা থাকল। আছে ভাবতে ক্ষতি কী?

জীবনের পরে আর কিছু নেই– এই কথাকে নিশ্চিত করে জানলে, এতে বিশ্বাস করলে, কোনো কিছু থেকেই নিজেকে নিবৃত্ত করা ভারি মুশকিল হয়ে ওঠে। তাই বোধ হয়, আহুক ভাবেন, আছে ভাবাই ভালো।

আছে। আছে। আছে। সবই আছে।

ঝিনুকের বুকের ভেতরে মুক্তোর মতন, প্রথম সংগমের স্মৃতির মতন, তাঁর প্রথমা স্ত্রী টিটিঙ্গির সারল্য ও সতোর মতন, তাঁর দ্বিতীয়া নারী, ঠগি চিচিঙ্গার শঠতার মতন, তাঁর কল্পনার প্রেমিকার ফুটি-না-ফুটি প্রেমের মতন, স্বপ্নে-দেখা তার আগুন-পারা নগ্নতার মতন স্পৃশ্য বা দৃশ্যমান না হয়েও সবই আছে।

আছে, প্যাডক-এর ছায়াতে, বালুতটে, স্থলে,
আছে মৎসগন্ধি জলে, মাছে,
আছে, আছে, আছে
সবই আছে।

.

০৮.

ঘুমটা হঠাৎ-ই ভেঙে গেল পরিচিত একঝাঁক পাখির তীব্র চাবুকের মতো ডাকে। তারা সারাবনে পুলকভরে কোনো বিশেষ খবর যেন জানান দিতে দিতে তিরের মতো উড়ে গেল সেই বন-বাংলোর উপর দিয়ে।

কী খবর? কলঙ্কিনী রংকিনীর খবরই কী?

কী পাখি?

তা প্রথমে মনে পড়ল না চট করে। তার পরই মনে এল চকিতে, টিয়া! টিয়া! টিয়া! প্যারাকিট!

হয়তো ও, উঠে বসে হাই তুলেছিল বা আড়মোড়া ভেঙেছিল। আহুক জানতে পেরে গেছিলেন যে, রংকিনীর ঘুম ভেঙেছে। বারান্দা থেকেই গলা তুলে বললেন, গুড মর্নিং ইয়াং লেডি। শ্যাল আই ব্রিং ইয়োর টি দেয়ার অর উইল ইউ কাম টু দ্য ভারাণ্ডা?

রংকিনী বলল, ভেরি গুড মর্নিং ইনডিড।

মনে মনে বলল, এ রাতটা তো কাটল নির্বিঘ্নে।

মুখে বলল, আমিই আসছি বাইরে।

চা ভিজিয়ে দিলাম কিন্তু।

আমাকে কি কিছুই করতে দেবেন না? তার পর বাথরুমে গিয়ে খুলে-রাখা ব্রা-টা পরতে পরতে না-বলে, বলল, একটা আয়নাও নেই ছাই! তার পর চানঘরের বাতিটার সলতে নামিয়ে দিল।

নিজেই তো বললে কাল যে, ওমলেট ভাজা আর চা করা ছাড়া আর কিছুই জানো না করতে। তা ব্রেকফাস্টে ওমলেটটা না হয় ভেজো। চা-টা আমিই করে দিচ্ছি। তবে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। অনেক দূরে যেতে হবে তো। উঁচু-নীচু পাকদন্ডী পথ, পাহাড়ে, সমুদ্রতটে। তাড়াতাড়ি করে কিছু খেয়ে নিয়েই চলো বেরিয়ে পড়ি।

আর চান?

চান তো সমুদ্রে।

কী পরে?

কিছু না-পরে। কোনো চিন্তা নেই তোমার। আজ আমি তোমাকে তেল মাখিয়ে সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে দেব। এমন সোহাগে তোমার মাও তোমাকে কোনোদিন চান করাননি।

হুঁ। এটাই বাকি আছে।

মুখে বলল বটে কথা ক-টি রংকিনী কিন্তু তার শরীরে কথা ক-টি রোমাঞ্চ জাগাল।

মানুষটি সত্যিই জংলি। কী যে বলেন আর কী যে বলেন না, তার ঠিক নেই।

বলতে বলতে, পায়ে জুতো গলিয়ে বাইরে এল। বাথরুম স্লিপারও তো আনেনি সঙ্গে। শোয়ার সময়ে দু-বিনুনি করে শুয়েছিল।

আহুক বললেন, বাঃ। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে। তুমি সত্যিই ছোট্ট মেয়ে এবং ভারি সুন্দর মেয়ে। এই দু-বিনুনিতে তা আরও স্পষ্ট হল।

তার পর বললেন, তোমার ক-চামচ চিনি আর কতটুকু দুধ? তুমি পাতলা লিকার পছন্দ করো? না, কড়া?

আপনি আপনার পছন্দসই করে বানিয়ে নিন তার পরে আমি আমারটা বানিয়ে নেব।

তা বললে হবে কেন ইয়াং লেডি। তুমি যে আমার অতিথি। তার ওপরে আমার মালকিন এর বান্ধবী। খাতির-যত্ন ঠিকমতো না হলে যে, আমার চাকরিটাই যাবে।

আপনাকে দেখে তো মনে হয় না, পৃথিবীতে কারো চাকরিরই আপনি তোয়াক্কা করেন।

অন্যের চাকরির কথা জানি না। তোমার চাকরির তোয়াক্কা অবশ্যই করি। এমন চাকরি গেলে আর কি পাব, এ জীবনে আর কোথাওই?

বলেই বললেন, একী! শুধু শুধু চা খাচ্ছ কেন? নারকোল কুচি দিয়ে দু-মুঠো মুড়ি দিয়ে খাও। এই যে!

মুড়ি। ওমা আপনি মুড়ি খান? মুড়ি তো ছোটোলোকেরা খায়।

জানি। আমি তো ছোটোলোক ভারতীয়। আর তোমরা সব বড়োলোক সাহেব-মেমসাহেব। তোমরা খাও কেলগ-এর সিরিয়ালস। দশ কেজি মুড়ির দাম দিয়ে পাঁচশো গ্রাম সিরিয়ালস। চিড়ের বদলে প্যাকেটের কর্নফ্লেকস। মাঝে মাঝে আমার সত্যিই সন্দেহ হয় ভারতবর্ষ পঞ্চাশ বছর হল স্বাধীন হয়েছে! তোমরা পাটিসাপটা খাও না, ভীষণ Messy বলে। কেক খাও। কুচো নিমকি বা কড়াইশুঁটি বা ফুলকপির শিঙাড়া খাও না চিকেন বা মাটন প্যাটিজ বা হ্যাম-বেকন খাও। প্রোটিন-এর জন্যে তোমরা হা-ভাতে হাড়-জিরজিরে রোগা-হাগা গোর খাও, তোমরা বাবাকে এল ড্যাড, মাকে এল মাম, নমস্কার না বলে এল, হাই! বাংলা ভাষা তোমাদের কাছে হিব্রু বা ল্যাটিনের চেয়েও কঠিন। তোমরাই নব্য আধুনিক উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়। তোমরা হিংলিশ-এ হেক্সপার্ট কিন্তু ইংরেজিটা শিখলে না।

তার পরেই বললেন, পৃথিবীতে এখন কোন রোগটি সবচেয়ে ভয়াবহ এল তো?

হঠাৎ এই প্রশ্ন?

আহা এলই না!

আমার বুদ্ধি এখনও ঘুমোচ্ছে। পেটে এককাপ চাও পড়েনি যে!

তবু এল।

এইডস?

উহুঁ।

থ্যলাসেমিয়া?

উঁহু!

তবে? কী?

আমেরিকার প্রভাব। সারাপৃথিবীটাকে ওই একটা দেশই শেষ করে দিল। ধনে মারল, প্রাণে মারল, সংস্কৃতিতে মারল, চরিত্রে মারল, স্বভাবে মারল, ভাষাতেও মারল।

যাকগে এমন সুন্দর সকালবেলাটা আমেরিকাকে উৎসর্গ না করলেও চলবে। অন্য কথা বলুন।

ঠিক আছে। চা খেয়েই একটা গান শোনাতে হবে। তোমার সম্বন্ধে চুমকি আমাকে সবই বলে গেছে।

কখন?

যখন ও দ্বীপ ইন্সপেকশানে গেছিল আমার সঙ্গে। তুমি তো দুপুরের খাওয়ার পরে ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলে।

সত্যি। জেগে উঠে দারুণ ভয় লেগেছে। দ্বীপে আমি একা।

তার পর বলল, চুমকি কী বলেছে তা আমি জানি না, তবে এখন আমার মোটেই গান গাইতে ইচ্ছে করছে না।

রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?

পাহারাদার তো খারাপ ছিল না। ভালো ঘুম না হওয়ার তো কোনোই কারণ নেই।

আর পাহারাদারের পাহারদার? সে কিন্তু আদৌ ভালো নেই। কাল সারারাত আমার ঘুম হয়নি।

কেন?

এমনিই।

এমনিই আবার কী কথা?

এমনিই। আর কথা নয়। নাও চা-টা খাও। তার পর আধঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে চলো বেরিয়ে পড়ি।

চা-এ চুমুক দিতে দিতে রংকিনীর মনে পড়ল যে, চিড়িয়া টাঙ্গুর আদিম রেইন ফরেস্টস দেখে গা-ছমছম করাতে চুমকি বলেছিল, যাই বলিস আর তাই বলিস, ভয় না থাকলে রহস্যও থাকে না। এখানে মাংসাশী শ্বাপদ নেই, তাই ভয়ও নেই।

ভয় না থাকলে যে, রহস্যও থাকে না সে-কথা কাল রাতে খুব ভালো করেই বুঝেছে রংকিনী। মাংসাশী শ্বাপদ যে সবসময় চার পেয়েই হবে এমন কোনো মানে তো নেই। দু পেয়েও হতে পারে!

ভাবছিল, রংকিনী।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress