সমকামি – বত্রিশতম পর্ব
অন্যন্যা সাথে সাথে কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করে এবং এসএমএস এর কথাটা জানায়। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যাকে বলে একটু সাবধানে থাকতে। ও যেনো একা হুট করে কোথাও না বের হয়। সকালে কৃষ্ণেন্দু আসবে ওকে নিতে আর ওর যতো কাজই থাক এবার থেকে ও অন্যন্যাকে একা ছাড়বে না। সেদিন ওর খুব ভুল হয়ে গেছে। কৃষ্ণেন্দু পরামর্শ দেয় অন্যন্যা যেনো ওর বাবাকে অন্তত সবটা জানিয়ে রাখে। তিয়াসাকে ও। এরপর অন্যন্যা বসার ঘরে গিয়ে দেখে বিকাশ বাবু টিভিতে খবর দেখছেন। অন্যন্যাকে দেখে বিকাশ বাবু বলেন: আয় মা বোস এখানে। কি যেনো বলবি বলছিলি? অন্যন্যা বললো এখানে বসে বলা ঠিক হবে বাবা? মার কানে গেলে আবার রাগারাগি করবে দুশ্চিন্তা করবে। বিকাশ বাবু উঠে গিয়ে দেখলেন রিনা দেবী রান্নার কাজে ব্যাস্ত। তিনি মেয়েকে এসে বললেন: তোর মা এখন রান্না ঘরে খুব ব্যাস্ত এখন এখানে কান দেবে না। তুই বল। অন্যন্যা সব ঘটনা খুলে বললো বাবাকে। বিকাশ বাবু শুনে খুব চিন্তিত আর বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি মেয়েকে বললেন: এতো সব কথা কি তোর মার কাছে লুকানো ঠিক হচ্ছে অনু? অন্যন্যা উত্তরে বলে আমি জানি বাবা কিন্তু মা তো সেই এক জাগায় দাঁড়িয়ে আছে। তুমি বলো একটা বিপদকে এড়ানোর জন্য যদি সেই বিপদের সাথেই কম্প্রোমাইজ করতে হয় তাতে সত্যি কি বিপদ এড়ানো যাবে বাবা? বিকাশ বাবু মাথা নীচু করে বললেন সেতো আমি ও বুঝতে পারছি মা। কিন্তু কি জানিস তো মেয়ে সন্তান হলে বাবা মার অনেক দায়িত্ব ভয় সব কিছুই বেড়ে যায়। ভয় শুধু একা তোকে নিয়ে না অনু ভয় তিয়াসাকে নিয়ে ও। আমি যে কি করবো? গাড়ি ঠিক করে ওকে সব জায়গায় পাঠানো কি সম্ভব এক তাতে তোর মা নানান প্রশ্ন করবে ও সবটা বুঝতেই পারবে। আর দুই এতো টাকা আমি কোথায় পাবো? অন্যন্যা বলে টাকা আমি দেবো বাবা তুমি টাকার চিন্তা করো না। বিকাশ বাবু প্রশ্ন করে আর তুই? অন্যন্যা উত্তর দেয়: আমাকে কৃষ্ণেন্দু নিয়ে যাবে পৌঁছে ও দেবে। তুমি চিন্তা করো না। আমি বরং বনুকে সবটা গিয়ে বুঝিয়ে বলি। অন্যন্যা তিয়াসার ঘরে গিয়ে দেখে ও পড়ছে। অন্যন্যা বলে: আমার তোর সাথে একটু কথা আছে। তিয়াসা উত্তর দেয়: হ্যাঁ দিদিয়া বল না। অন্যন্যা সবটা বুঝিয়ে বলে তিয়াসাকে। তিয়াসা অন্যন্যাকে বলে: দিদিয়া আমাকে গাড়ি ঠিক করে দিতে হবে না। আমি মৃন্ময়কে বললেই ও আমাকে এগিয়ে দিয়ে যাবে ও তো রোজ এগিয়ে দিতে চায় আমি না করি। আমি ওকে ডেকে নেবো তুই চিন্তা করিস না। অন্যন্যা তিয়াসার দিকে তাঁকিয়ে বলে: এই মৃন্ময় কে? আর তোকেই বা রোজ রোজ দায়িত্ব নিয়ে এসব করবে কেনো? তিয়াসা একটু আমতা আমতা করে বলে আরে দিদিয়া ও তো আমার ক্লাসমেট আমরা একসাথেই সব জায়গায় পড়ি। আরে ওই তো সব মাস্টার ঠিক করলো। অন্যন্যা তাঁকিয়ে থাকে তিয়াসার দিকে। তিয়াসা অন্যন্যাকে জড়িয়ে বলে দিদিয়া প্লিজ তুই যেটা ভাবছিস তেমন কিছু না বিশ্বাস কর। অন্যন্যা হাঁসি মুখ করে তিয়াসার দিকে তাঁকিয়ে বললো: আমি কি ভাবছি সেটা তুই কি করে জানলি? আমি তো কিছু বলিনি। তিয়াসা মুখ ভার করে বলে উফ্ দিদিয়া এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। অন্যন্যা হাঁসে। ওদের কথার মধ্যেই কৃষ্ণেন্দুর ফোন আসে অন্যন্যা তাড়াতাড়ি করে ফোনটা ধরে। ওপাশ থেকে কৃষ্ণেন্দু বলে অনু আমার সাথে কমিশনারের কথা হলো আমি তোমার এসএমএস টা পাঠিয়ে দিয়েছি ওকে। ও বললো আমাকে কাল থেকে তোমার সব ফোন ট্রাক করা হবে। যাতে কে বা কারা এটা করছে সেটা সহজে বুঝতে পারা যায়। তুমি সাবধানে থেকো। কাল দেখা হচ্ছে।
পরেরদিন সারাদিন অফিসে নানা ব্যাস্ততায় কেটে যায়। অফিসের পর অন্যন্যা বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছানোর আগেই কৃষ্ণেন্দু গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যায় সেখানে। তারপর অন্যন্যাকে নিয়ে সোজা বাড়ির পথে। আজ কৃষ্ণেন্দুকে একটু চুপচাপ দেখে অন্যন্যা প্রশ্ন করে কি হলো এতো চুপচাপ যে কিছু হয়েছে? কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যার দিকে তাকায়। অন্যন্যা আবার ও বলে চলো আজকে একটু ব্রিজের কাছে চায়ের দোকানে যাই অনেকদিন যাওয়া হয়নি। জায়গায়টা আমার ও ভীষণ ভালো লাগে। কৃষ্ণেন্দু উত্তর দেয়: না, ভালো লাগছে না অনু আজকে বাদ দাও। আজকে আমার মনটা সত্যি ভালো নেই। অন্যন্যা কৃষ্ণেন্দুকে গাড়ি থামাতে বলে। কৃষ্ণেন্দু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে গাড়ি কেনো থামবো? তুমি কি রাগ করলে? আচ্ছা বেশ চলো যাচ্ছি। অন্যন্যা আবার ও বললো প্লিজ তোমাকে বললাম তো গাড়িটা থামাও। কৃষ্ণেন্দু বাধ্য হয়ে একটা জায়গায় দেখে গাড়িটা থামায়। অন্যন্যা এবার কৃষ্ণেন্দুকে বলে: আমার দিকে তাঁকাও কি হয়েছে তোমার? সেই তখন থেকে দেখছি কেমন চুপচাপ। আমাকে ও কি বলা যায় না? কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় ধরে শক্ত করে। তারপর বলে: আজকে আমার মায়ের মৃত্যু দিন অনু। আর তার থেকে ও বড় খারাপ হলো: আমাকে ফ্রাইডে ব্যাঙ্গালোরে যেতে হচ্ছে আমার ফিরতে ফিরতে সোমবার। আমি জানতাম এই ট্যুরটা আমি কিছুতেই আটকাতে পারবো না। সেদিন মিটিং এ ও আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ট্যুরটা যাতে ক্যান্সেল করানো যায়। অনু আমি এবার কি করবো? আমার কিছুতেই এখন কলকাতা ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে তোমাকে নিয়ে। আমি সেদিন ও তোমার পাশে থাকতে পারিনি আর এখন আবার এই ট্যুর। অন্যন্যা ও কিছুক্ষনের জন্য চুপ করে যায়। তারপর আস্তে করে বলে তুমি চিন্তা করো না। আমি সাবধানে থাকবো। মাঝখানে তো সানডে পরে যাচ্ছে। দুটো দিন একটু কষ্ট করে ও ঠিক আছে তুমি ভয় পেয়ো না। কৃষ্ণেন্দু অন্যন্যাকে জড়িয়ে ধরে বলে তুমি জানো না তুমি আমার কাছে কি? অনু আমি তোমাকে ছাড়া অচল। অন্যন্যা ও জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণেন্দুকে তারপর বলে: ভয় পেয়ো না আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবো তুমি তাড়াতাড়ি নিজের কাজ সেরে ফিরে এসো।
ফ্রাইডে খুব ভোরের ফ্লাইটে কৃষ্ণেন্দু বেরিয়ে যায় ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে। অন্যন্যা ও নিজে একাই যাতায়াত করছে। ফেরার সময় অবশ্য ও অফিসের সামনে থেকে ক্যাব বুক করে নেয়। কৃষ্ণেন্দু বার বার বলে গেছে বাসের জন্য অপেক্ষা না করতে। এই কটাদিন অন্যন্যার ফেরার সময় রোজ কৃষ্ণেন্দু ওকে ফোন করেছে। অন্যন্যা বাড়ি না ঢোকা পর্যন্ত কৃষ্ণেন্দু ফোনেই ছিল। অন্যন্যা ও আগের দিনের মতো কাউকে ফলো করতে দেখেনি। অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে অন্যন্যার। এই কটাদিন খুব ভয়ে ভয়ে কেটেছে ওর। শনিবার রাতে কৃষ্ণেন্দু আর ফোন করেনি। একটা টেক্সট করেছিল : খুব ক্লান্ত লাগছে অনু। কাল সকালে তোমার সাথে কথা হবে। খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে। তারপর আর কোনো কথা হয়নি অন্যন্যার সাথে।
রবিবার সকাল অন্যন্যা তখন ও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। শুয়ে শুয়েই ভাবছে আর এই একটা দিন কালকে কৃষ্ণেন্দু চলে আসলে আর কোনো চিন্তা নেই। ফোনটা হাতে নিয়ে অন্যন্যা দেখলো প্রায় নটা বাজে কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর কোনো টেক্সট বা ফোন আসেনি। মনে মনে একটু অভিমান হয় ওর। তারপর নিজেই ভাবে হয়তো খুব টায়ার্ড ঘুমোচ্ছে। তাই ও নিজেই একটা টেক্সট করে মর্নিং উইশ করে। কৃষ্ণেন্দু ঘুম থেকে উঠে দেখে রিপ্লাই করবে এই ভেবে। এর মধ্যেই দরজায় বেলের শব্দ হয়। বিকাশ বাবু দরজা খুললে একজন অচেনা লোক বলে: এখানে অন্যন্যা দেবী বলে কেউ থাকেন? বিকাশ বাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে হ্যাঁ, অন্যন্যা আমার মেয়ে কেনো কি হয়েছে? লোকটা আবার বলে: ওনাকে একটু ডাকুন না প্লিজ। বিকাশ বাবু উত্তরে বলে: আগে আমাকে বলুন কি হয়েছে তারপর আমি ভাববো ওকে ডাকা যায় কিনা!!! ওদের দুজনের কথার আওয়াজ ঘরে সবার কানেই যায়। অন্যন্যা শুনতে পেয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। এসে বাবাকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে বাবা!!! এই লোকটা কে? বিকাশ বাবু উত্তর দেয় জানি না দেখ না সেই তখন থেকে জানতে চাইছি তোর সাথে কি দরকার ততোই বলছে তোকে আগে ডেকে দিতে কোনো কথাই শুনছে না। লোকটা এবার অন্যন্যাকে প্রশ্ন করে আপনি অন্যন্যা? অন্যন্যা উত্তর দেয়: হ্যাঁ কিন্তু কেনো আমাকে কি দরকার আপনার? আমার কোনো দরকার নেই ম্যাডাম। আসলে ওই রাস্তার মোড়ে একজন লোক গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে বিচ্ছিরি অবস্থা আপনার নাম বলছে বার বার। এতক্ষনে সবাই হসপিটালে নিয়ে চলে গেলো কিনা জানিনা। সেই কখন থেকে বলছি আপনাকে একটু ডেকে দিতে উনি কিছুতেই শুনছেন না কথা। অন্যন্যা লোকটার কথায় ভয় পেয়ে যায়। তাহলে কি কৃষ্ণেন্দু? তাহলে কি ওকে সারপ্রাইজ দেবে বলে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে ফোনে আর কথা হয়নি। কালকে লিখলো খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে। অন্যন্যা কিছু না ভেবেই লোকটাকে বললো আপনি দাঁড়ান আমি এখুনি ভীতর থেকে আসছি। লোকটা অন্যন্যাকে বললো ম্যাডাম একটু তাড়াতাড়ি করুন। ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো দেখলাম না ওনাকে আমি চিনি না কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট হতে আমিই প্রথম দেখেছিলাম। দরজা খুলে আমি ওনাকে বের করে আনি। অনেক কষ্ট উনি আমাকে এই কথাটুকু শুধু বলতে পেরেছেন। আপনি চলুন। অন্যন্যা ভীতরে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বেরোতে গেলে রিনা দেবী বাঁধা দেয়। কিন্তু অন্যন্যা মাকে বলে আমি তোমার সব কথা শুনবো মা কিন্তু এখন আমাকে যেতে দাও। মানুষটাকে না হলে বাঁচানো যাবে না। ওনার আর কেউ নেই যাকে আমি কিছু জানাতে পারি। ঘর থেকে বেরিয়ে লোকটার সাথে চলে যায় অন্যন্যা। অন্যন্যা ওখানে গিয়ে কিছু লোকের জটলা দেখে কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর গাড়ি বা অন্যকিছু ওর চোখে পড়ে না। অন্যন্যা প্রশ্ন করলে ওরা বলে লোকটাকে সিটি হসপিটালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ওনার গাড়ি ও কেউ একজন ড্রাইভ করে নিয়ে যায়। অন্যন্যার একটু সন্দেহ হলে ও চুপ করে থাকে। সাথে থাকা ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বলে: আমার কাছে গাড়ি আছে আপনি চলুন আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে। ম্যাডাম সময় নষ্ট করবেন না। অন্যন্যা আর কোনো কিছু চিন্তা না করে ওই অপরিচিত লোকটির সাথে গাড়িতে উঠে পড়ে। এর মধ্যেই অন্যন্যার বাবা ওখানে উপস্থিত হয় কিন্তু কাউকেই তার চোখে পড়ে না। এমন কি অন্যন্যাকে ও সেখানে দেখা যায় না।