Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সবুজ দ্বীপের রাজা || Sunil Gangopadhyay » Page 2

সবুজ দ্বীপের রাজা || Sunil Gangopadhyay

পাছে ঠিক সময় ঘুম না ভাঙে, তাই সন্তু সারারাত ঘুমোলই না প্ৰায়। জেগে। জেগে সে ঘড়ির আওয়াজ শুনল, একটা-দুটো-তিনটে। কিন্তু শেষ সময়েই সে ঘুমিয়ে পড়ল ঠিক। মা যখন তাকে ডেকে তুললেন, তখন সাড়ে চারটে বেজে গেছে। ঘড়ি দেখেই তার ভয় হল। কাকাবাবু রাগ করে একাই চলে যাননি তো?

না, কাকাবাবু যাননি। মা কাকাবাবুকেও একটু আগে ডেকে দিয়েছেন। কোথাও বাইরে যাবার সময় মা-ই সবাইকে ঠিক সময় তুলে দেন। মার কোনওদিন ভুল হয় না।

খুব তাড়াতাড়ি জামা-প্যান্ট পরে তৈরি হয়ে নিল সন্তু। কাকাবাবুর অনেক আগে। মা কত কী খাবার তৈরি করেছেন। এরই মধ্যে, কিন্তু উত্তেজনার চোটে সন্তুর খেতে ইচ্ছেই করছে না।

মাকে জিজ্ঞেস করল, এবার আমরা কোথায় যাচ্ছি, তুমি এখনও জানো না, মা?

মা বললেন, ঐ তো শুনলাম, সিঙ্গাপুর না কোথায় যেন যাওয়া হচ্ছে। দেখিস বাপু, খুব সাবধানে থাকিস। তোর কাকাটি যা গোঁয়ার

কাকাবাবু খাবার ঘরে এসে বললেন, সন্তু, রেডি? বাঃ! পাঁচটা বাজল, আর দেরি করা যায় না। যাও, একটা ট্যাক্সি ডাকো এবার

সন্তু রাস্তায় বেরিয়ে এল। ভোরবেলা ট্যাক্সি পাওয়ার কোনও অসুবিধে নেই। ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে সন্তু আবার তরতর করে উঠে এল ওপরে। কাকাবাবু এর মধ্যে খাবার ঘর ছেড়ে চলে গেছেন নিজের ঘরে। দরজাটা ভেজানো। দরজাটা ফাঁক করে কাকাবাবুকে ডাকতে গিয়ে সন্তু থমকে গেল।

বড় লোহার আলমারিটা খোলা। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু একটা fীভালভারে গুলি ভরছেন একটা-একটা করে।

সন্তু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এর আগে সে কাকাবাবুর সঙ্গে অনেক বার বাইরে গেছে, কোনওবার তো কাকাবাবুকে রিভলভার সঙ্গে নিয়ে যেতে দেখেনি। এবার কি আরও বিপজ্জনক কোনও জায়গায় যাওয়া হচ্ছে!

গুলি ভরা হয়ে গেলে কাকাবাবু রিভলভারটা সুটকেসের মধ্যে জামা-কাপড়ের নীচে সাবধানে রেখে দিলেন।

প্লেনে চাপাবার কথা ভেবেই সন্তুর এত আনন্দ হচ্ছে যে, তার মুখ দিয়ে ঘাম বেরিয়ে যাচ্ছে। জীবনে প্ৰথম সে প্লেনে চাপবে। প্লেনটা যখন ব্যাঁকা হয়ে মাটি থেকে আকাশে ওড়ে, তখন ভেতরের মানুষগুলো গড়িয়ে পড়ে যায় না?

দমদমে প্লেনে ওঠার আগে সবাইকে একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে হল। সেই ঘরের দরজায় লেখা আছে সিকিউরিটি চেকিং। একজন একজন করে সেই ঘরে ঢুকছে। কাকাবাবুর আগে সন্তুই ঢুকল। একজন পুলিশের পোশাক পরা লোক সন্তুর কাঁধের ঝোলানো ব্যাগটার দিকে আঙুল উচিয়ে বলল, দেখি, ওর মধ্যে কী আছে?

ব্যাগটার মধ্যে রয়েছে কয়েকটা গল্পের বই, তোয়ালে আর মায়ের দেওয়া খাবারের কৌটো। লোকটা সেগুলো এক নজর শুধু দেখল। তারপর সন্তুর গায়ে দু হাত দিয়ে চাপড়াতে লাগল। প্রথমে সন্তু এর মানে বুঝতে পারেনি। তার পরেই মনে পড়ল। লোকটি দেখছে, সন্তু জামা প্যান্টের মধ্যে কোনও রিভলভার কিংবা বোমা লুকিয়ে রেখেছে। কিনা। খবরের কাগজে সে পড়েছে, আজকাল প্ৰায়ই প্লেন-ডাকাতি হয়। চলন্ত প্লেনে ডাকাতরা পাইলটের সামনে রিভলভার কিংবা বোমা দেখিয়ে প্লেনটা অন্য জায়গায় নিয়ে যায়।

কাকাবাবুর কাছে তো রিভলভার আছে, ওরা সেটা কেড়ে নেবে? ও, সেইজন্যই কাকাবাবু রিভলভার পকেটে না-রেখে সুটকেসে রেখেছেন। সুটকেসগুলো তো আগেই জমা দেওয়া হয়ে গেছে, সেগুলো তো আর ওরা খুলে দেখবে না।

যাই হোক, সকলের সঙ্গে লাইন দিয়ে ওরাও সিঁড়ি দিয়ে প্লেনে উঠল। সিঁড়ির ঠিক ওপরে, একটি খুব সুন্দরী মেয়ে হাতজোড় করে প্রত্যেককে বলছে, নমস্কার। সন্তু জানে, এই মেয়েদের বলে এয়ার হস্টেস।

প্লেনের ভেতরটায় হালকা নীল রঙের আলো। মেঝেতে পুরু কর্পেট। সবাই এখানে খুব ফিসফিস করে কথা বলে। সন্তুর আর কাকাবাবুর পাশাপাশি দুটি সীটি। কাকাবাবু তাকে জানলার ধারের সীটটায় বসতে দিলেন। তারপর বললেন, দেখো, পাশে বেল্ট লাগানো আছে, তোমার কোমরে বেঁধে নাও।

সন্তু বেল্টটা খুঁজে পেল, কিন্তু ঠিক মতন লাগাতে পারল না। বেশ চওড়া নাইলনের বেল্ট, মোটেই সাধারণ বেল্টের মতন নয়। কাকাবাবু সেটা লাগাতে শিখিয়ে দিলেন। খোলা দিকটা খাপের মধ্যে ঢোকাতেই মট করে একটা শব্দ হয়। ও, এ-রকম বেল্ট বাঁধা থাকে বলেই বুঝি লোকেরা গড়িয়ে পড়ে যায় না?

তারপর কিন্তু আরও অনেকক্ষণের মধ্যে প্লেনটা ছাড়ল না। সবাই তো উঠে গেছে, দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে, তবু এত দেরি করছে কেন? সন্তু আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। জানলা দিয়ে এখন বাইরে দেখবার মতন কিছু নেই। এখানে মাটি নেই, সব জায়গাটাই শান বাঁধানো, সেখানে ঝকঝকি করছে রোদ।

সন্তু গলা উঁচু করে প্লেনের ভেতরের লোকজনদের দেখবার চেষ্টা করল। কতরকমের লোক, বাঙালি, মারোয়াড়ী, নেপালী, সাহেব-মোম, এমন-কী, একজন নিগ্রো পর্যন্ত আছে। সেই এয়ার হস্টেসটি একবার লোকজনদের গুনে গুনে গেল।

কাকাবাবু, এখনও ছাড়ছে না কেন?

কাকাবাবু উঠেই খবরের কাগজ পড়ায় মন দিয়েছিলেন। চোখ না তুলেই বললেন, সময় হলেই ছাড়বে!

এই সময় প্লেনের দরজা আবার খুলে গেল। একজন পুলিশ অফিসার ঢুকে ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ নিরিন্দর পাল সিং কে আছেন?

সামনের দিক থেকে একজন লম্বামতন লোক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি। কেয়া হুয়া?

আপনার পাসপোর্টটা একবার দেখান তো?

আবার দেখাতে হবে? একবার তো দেখলাম?

আর একবার দেখান!

লোকটি পরে আছে ধুতির ওপরে লম্বা ধরনের প্রিন্স কোট। প্রথমে কোটের সবকটা পকেট খুঁজল। তারপর হাতব্যাগটা খুলে নিয়ে দেখল। তারপর আবার পকেট চাপড়াল। কোথাও পেল না।

লোকটি চেঁচিয়ে বলল, মেরা পাসপোর্ট কোউন লিয়া? পকেটমেই তো থা!

প্লেনের সব লোক ঐ লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে।

লোকটি তার পাসপোর্ট কিছুতেই খুঁজে পেল না। পুলিশ অফিসারটি গম্ভীরভাবে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে নেমে আসুন!

লোকটি প্রথমে আপত্তি করল খুব। তার খুব জরুরি দরকার আছে। তাকে যেতেই হবে। পাসপোর্ট তো তার সঙ্গেই ছিল, কী করে হারিয়ে গেল বুঝতে পারছে না।

পুলিশ অফিসারটি কিছুই শুনলেন না। লোকটিকে সঙ্গে করে নেমে গেলেন।

সন্তু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, পুলিশ কি লোকটাকে ধরে নিয়ে গেল?

পাসপোর্ট খুঁজে পেলে ছেড়ে দেবে।

যদি খুঁজে না পায়?

তা হলে যেতে দেবে না। এই দ্যাখ!

কাকাবাবু আঙুল দিয়ে খবরের কাগজের একটা জায়গা দেখালেন। সেখানে লেখা রয়েছে, পাসপোর্ট চুরি। কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে পাসপোর্ট খোয়া যাচ্ছে আজকাল। পুলিশের ধারণা, কোনও একটা জালিয়াতের দল কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এই পাসপোর্ট চুরি করেছে–ইত্যাদি।

সন্তু ভাবল, ওরে বাবা, পাসপোর্ট জিনিসটা তাহলে এত দামি? হারিয়ে গেলে তাকেও এখন এই প্লেন থেকে নামিয়ে দিত? তাড়াতাড়ি কোটের বুক-পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল তার নিজেরটা ঠিক আছে কিনা।

সেদিন তাহলে সেই যে ছেলেটা তার পাসপোর্টটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুটেছিল, সে কি চুরি করার চেষ্টা করছিল? সাহেবটা তাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছিল কেন? সবাই বলে, সাহেবরা কখনও অভদ্র হয় না। হঠাৎ ধাক্কা লেগে গেলেও তারা সরি বলে ক্ষমা চায়। সেই সাহেবটা তো ক্ষমা চায়নি।

সন্তু কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকাল। উনি আবার খবরের কাগজ পড়ায় মন দিয়েছেন। সব সীটের পেছনের খাপে অনেকগুলো করে খবরের কাগজ রাখা থাকে।

একটু পরেই আবার প্লেনের দরজা বন্ধ হল। গোঁ গোঁ করে শব্দ হল ইঞ্জিনের। নরিন্দর পাল সিং আর ফিরে এল না। লোকটার জন্য একটু একটু দুঃখ হল সন্তুর। ইস, প্লেনে উঠেও লোকটার যাওয়া হল না!

এবার প্লেনটা মাটির ওপর দিয়ে দৌড়তে শুরু করল। প্ৰথমে আস্তে, তারপর খুব জোরে। দৌড়চ্ছে তো দৌড়চ্ছেই। কখন একসময় যে প্লেনটা মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ল, সন্তু টেরও পেল না। কোমরের বেল্টে একটু হ্যাঁচকাটান লাগিল না পর্যন্ত।

হঠাৎ সে দেখল, নীচের মানুষগুলো ছোট হয়ে আসছে। এয়ারপোর্ট আর নেই, তার বদলে গাছপালা, মাঠে গোরু চরছে, ফিতের মতন সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। গাড়িগুলো সব খেলনার মতন, গোরুগুলো ঠিক যেন ছোট-ছেট মাটির পুতুল। রুপোলি ফিতের মতন একটা নদী। তারপর আর কিছু দেখা যায় না। সামনে তাকাতেই মনে হল কালো রঙের একটা বিশাল পাহাড়। প্লেনটা সোজা সেই দিকেই যাচ্ছে। কলকাতার এত কাছে পাহাড় কী করে এল? ভাল করে তাকিয়ে বুঝতে পারল পাহাড় নয় মেঘ। কী ভয়ংকর ঐ মেঘের চেহারা!

কাকাবাবু এর মধ্যেই বিমোচ্ছেন। খুব ভোর রাতে উঠতে হয়েছে তো। কিন্তু বাইরে এত চমৎকার সব দৃশ্য, তা না দেখে কেউ ঘুমোতে পারে? হাস্কা-হাল্কা মেঘ উড়ে যাচ্ছে প্লেনের খুব কাছ দিয়ে। এক-এক জায়গায় মেঘ জমে আছে এমন অদ্ভুতভাবে যে, দেখলে মনে হয়, সাদা রঙের দুর্গ কিংবা একটা জঙ্গল।

প্লেনের ভেতরে ইঞ্জিনের দিকটায় এতক্ষণ লাল আলোয় দুটো লেখা জ্বলছিল। ধূমপান করবেন না। আর সিটবেল্ট বেঁধে রাখুন। এবার সেই আলো দুটো নিভে গেল। মাইক্রোফোনে একটা মেয়ের গলা শোনা গেল, নমস্কার। এই বিমানের ক্যাপ্টেন দিলীপকুমার দত্ত আর অন্যান্য কর্মীদের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা তিন ঘণ্টা দশ মিনিটের মধ্যে রেজুন পৌঁছোব। এখন আপনার সীটবেল্ট খুলে ফেলতে পারেন–

রেঙ্গুনে! সন্তুর বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। তারা তাহলে রেঙ্গুন যাচ্ছে? রেঙ্গুন মানে বৰ্মা দেশ। প্যাগোডা। আর কী আছে। রেঙ্গুনে?

ঘোষণা শুনেই কাকাবাবু চোখ মেলে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আমরা তাহলে রেজুন যাচ্ছি?

না।

কী আশ্চর্য ব্যাপার, সন্তু নিজের কানে শুনল যে, প্লেনটা রেঙ্গুনে যাবে, আর কাকাবাবু তবুও না বলছেন। এর মানে কী?

এবার সেই এয়ার হস্টেসটি একটা ট্রেতে করে কিছু লজেন্স এনে সবাইকে দিয়ে গেল। তারপর নিয়ে এল। চা আর কফি।

কাকাবাবু বললেন, এদের চা ভাল হয় না। কফিটাই খাও।

তারপর সন্তুর কানের কাছে মুখ এনে বললেন, যদি বাথরুম পায়, বলতে লজ্জা পেও না। পেছন দিকে বাথরুম আছে।

সন্তুর বাথরুম পায়নি। কিন্তু প্লেনের বাথরুম কেমন হয়, তার খুব দেখতে ইচ্ছে করল।

এখন আর বাইরে দেখার কিছু নেই। শুধু মেঘ। তাই সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একটু যাব।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, নিজে নিজে যেতে পারবে?

হ্যাঁ।

ঐ যে দেখছ, টয়লেট লেখা আছে, ঐখানে।

এত উঁচু দিয়ে দারুণ জোরে প্লেন যাচ্ছে, অথচ ভেতর থেকে কিছুই বোঝা যায় না। ভেতরটা একদম স্থির। হেঁটে যেতে পাটলে যায় না।

সন্তু প্লেনের পেছন দিকে চলে গেল। তারপর বাথরুমের দরজা খুলবে, এমন সময় পাশের দিকে চোখ পড়ল। তার গা-টা একবার কেঁপে উঠল। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

একেবারে শেষের সীটটায় দুজন সাহেব বসে আছে। সন্তুর চিনতে কোনও অসুবিধে হল না, এর মধ্যে একজন হচ্ছে সেই সাহেবটা, যে পাসপোর্ট অফিসের সামনে সন্তুকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছিল! কাকাবাবুর কাছ থেকে সন্তু একটা জিনিস শিখেছে। একবার কারুকে দেখলে তার মুখটা সব সময় মনে রাখার চেষ্টা করতে হয়। সন্তু ঠিক মনে রাখতে পারে।

সাহেবটি অবশ্য আজ পোশাক বদলেছে। একটা খাকি প্যান্ট আর সাদা হাফ শার্ট পরে আছে। চার পাঁচ দিন দাড়ি কামায়নি। দেখলে খুব সাধারণ লোক মনে হয়। কিন্তু আগের দিন খুব সাজগোজ করা খাঁটি সাহেবের মতন দেখাচ্ছিল। নিশ্চয়ই ছদ্মবেশ ধরেছে। পাশের লোকটার পোশাকও সেইরকম। দুজনে খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। সন্তুকে দেখতে পায়নি।

সন্তু বাথরুমের মধ্যে একটুখানি থেকেই বেরিয়ে এল। বাথরুমটা ছোট্ট, বিশেষ কিছু নতুনত্ব নেই।

ধীরে সুস্থে নিজের জায়গায় ফিরে এল। তারপর মুখ নিচু করে ফিসফিস করে বলল, কাকাবাবু, সেই সাহেবটা?

কোন সাহেবটা?

সেদিন পাসপোর্ট অফিসের সামনে যে আমায়—

সন্তু মাথা পেছন দিকে ঘুরিয়ে ওকে আবার দেখতে কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, ওদিকে তাকবি না। তোকে চিনতে পেরেছে?

না, আমায় দেখতে পায়নি।

কাকাবাবুদীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কিন্তু আমায় ঠিক চিনবে।

কথাটা ঠিক। কাকাবাবুর একটা পা কাটা। ক্ৰাচ নিয়ে চলতে হয়। এরকম লোককে একবার দেখলেই সবার মনে থাকে। সন্তুর মতন ছেলেমানুষকে হয়ত ঐ সাহেব দুটো লক্ষ করত না।

প্লেনের গতি কমে এল। আবার সীটবেল্ট বাঁধতে হবে। রেঙ্গুন এসে গেছে। সন্তু আবার নীচের দিকে তাকাল। ছবির মতন শহরটা দেখা যায়। এমন-কী, প্যাগোডার চুড়াও চোখে পড়ে।

রেঙ্গুনে কিন্তু যাওয়া হল না। প্লেন। এখান থেকে তেল নেবে। তাই এয়ারপোর্টে আধঘণ্টা বিশ্রাম। একটু বাইরে বেরিয়ে শহরটাও দেখে আসা যাবে না!

সব যাত্রীরা নেমে এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে ঘোরাফেরা করছে। কাকাবাবু সন্তুকে একটা সোফা দেখিয়ে বললেন, এখানে চুপ করে বসে থাক। অন্য কোথাও যাবি না।

সেই সাহেব দুটো একটু দূরে দাঁড়িয়ে গুজগুজ করছিল। কাকাবাবু ক্ৰােচ ঠিকঠক করে তাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর হাতঘড়িটা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ঘড়িটা বোধহয় ঠিক চলছে না। আপনাদের ঘড়িতে কটা বাজে?

সাহেব দুটো একটু বিরক্ত হয়ে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। তারপর ঘড়ি দেখে অবহেলার সঙ্গে সময় বলে দিল।

সন্তু কাকাবাবুর সাহস দেখে অবাক। উনি নিজে থেকে ওদের দেখা দিতে গেলেন? ওরা যে খারাপ লোক তাতে তো আর কোনও সন্দেহই নেই। নইলে দাড়ি না-কামিয়ে কেউ প্লেনে চাপে?

খানিকটা বাদে কাকাবাবু ফিরে এসে বললেন, আবার প্লেনে উঠতে হবে।

আবার সীটবেল্ট বাঁধা, আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা। এবার প্লেন বেশ তাড়াতাড়ি উড়ল। এবারে মাইক্রোফোনে মেয়েটি ঘোষণা করল, নমস্কার, আর দু ঘণ্টা দশ মিনিটের মধ্যে আমরা পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছে যােব, যদি ঝড়বৃষ্টি না হয়-

পোর্ট ব্লেয়ার? পোর্ট ব্লেয়ার জায়গাটা কোথায়? সিঙ্গাপুরে? জাপানে? নামটা একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু, পোর্ট ব্লেয়ার কোথায়?

আন্দামানে।

তারপর একটু থেমে উনি বললেন, আমরা ঐখানেই নামব।

সন্তুর বুকটা দমে গেল। এত জল্পনা-কল্পনার পর শেষ পর্যন্ত আন্দামান? সেটা তো একটা বিচ্ছিরি জায়গা। সেখানে শুধু কয়েদীরা থাকে। সেখানে যাবার মানে কী?

সন্তু নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল গাঢ় নীল রঙের সমুদ্র। যতদূর চোখ যায় শুধু সমুদ্র। মাঝে মাঝে জলের ওপর রোদ এমন ঠিকরে পড়ছে যেন চোখ কলসে যায়!

আন্দামান তো ভারতবর্ষের মধ্যেই। তবু সেখানে যাবার জন্য পাসপোর্ট জোগাড় করা কিংবা এত তোড়জোড় লাগে কেন? সাহেব দুটোই বা কেন সেখানে যাচ্ছে? কী আছে সেখানে?

আন্দামানের নাম শুনে সন্তু ভেবেছিল একটা নোংরামতন বিচ্ছিরি দ্বীপ দেখবে। যো-জায়গায় এক সময় শুধু চোর-ডাকাত আর কয়েদীদের পাঠানো হত, সে জায়গা তো আর সুন্দর হতে পারে না। আগেকার দিনে অনেকেই নাকি আন্দামানে একবার গেলে আর জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারত না। সেই জায়গায় কেউ শখ করে যায়?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress