Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সত্য মিথ্যা || Sankar Brahma

সত্য মিথ্যা || Sankar Brahma

শীতের সকাল। অপরাজিতা ফুলের মতো গাঢ় নীল আকাশ। ধূসর মেঘের ছিটেফোঁটা কোথায়ও ভেসে নেই। শীতের সকালে মিঠে রোদের দিকে পিঠ দিয়ে, গা এলিয়ে বসে আছেন নিবারণ শিকদার। পরনে তার লুঙ্গী,গায়ে ফতুয়া উপর একটা দামী কাশ্মিরী শাল। মাথায় উলের টুপি, তার উপরে ইংরেজী ক্যপিটেল লেটারে DARJEELING লেখা। বয়স তার প্রায় চল্লিশ – বিয়াল্লিশ হবে। টুপিটা খুললে দেখা যাবে, মাথা জুড়ে বিশাল টাক। বেশ আরামে ও সাচ্ছন্দে আছে বলে মনেহয়, গায়ে তার মেদ জমতে শুরু করেছে এরমধ্যেই।
বর্তমানে তিনি এই নিঝুমপুর গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। নিঝুমপুর গ্রাম হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে অবস্থিত একটি গ্রামীণ এলাকা। পূর্ব বর্ধমান জেলায় এক প্রান্তে অবস্থিত।
এখানে উঠে আসতে নিবারণের কম কসরত করতে হযনি। আগে বাজারের কাছে তার একটা এগরোল আর চাউমিনের দোকান ছিল। কিন্তু সেখানে রোজগারপাতি তেমন হতো না। তাই সে মনে মনে, এমন একটি ব্যবসার ফন্দি আঁটছিল, যাতে কোন রকম মূলধন না খাটিয়েই লাভ করা যায় ।
এমন সময় একদিন, চোখে রিমলেস চশমা পরা একজন মাষ্টার প্রকৃতির লোক তার দোকানে এগরোল খেতে এসে তার মনের গোপন ইচ্ছের কথা জানতে পেরে তাকে পরামর্শ দিল, একবার পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়িয়ে যান।

কিভাবে?

পার্টি অফিসে এখন থেকে নিয়মিত প্রতিদিন যাতায়াত করতে থাকুন। তারপর ভোটের সময় কাছে এগিয়ে এলে, পাঁচ কান না করে, গোপনে নেতার কানে মনের একান্ত গোপন ইচ্ছের কথাটা তুলে দিন যে আপনি এবার পঞ্চয়েত ভোটে দাঁড়াতে চান। তার একটা ব্যবস্থা যেন তিনি করে দেন।

নিবারণকে হয়তো লোকটি রসিকতা করেই এসব কথা বলেছিল। কিন্তু নিবারণ সেটাকে বেদবাক্য মনে করে, তা মেনে চলতে শুরু করে, এবং শেষপর্যন্ত সাফল্য লাভ করেন। নেতাকে ম্যানেজ করে পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ান এবং আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা গেল যে সে ভোটে জিতেও গেছেন। তারপর সে দলের প্রতি গভীর আনুগত্য দেখিয়ে, পার্টিরই গোপন কারসাজিতে পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে যান। এরপর সে তার দোকানটা তুলে দেন। রোজ পঞ্চায়েত অফিসে এসে বসা শুরু করেন। গ্রামের লোকজনের সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনেন, আর শুনে, তা তার নোটবুকে নোট করে রাখেন। যথসাধ্য তা সমাধানের চেষ্টা করেন। আর কারও সমস্যা সমাধান করতে না পারলে তার কারণও তাকে জানিয়ে দিতেন। এইভাবে কিছুদিন নিঃস্বার্থভাবে পঞ্চায়েতের কাজ করার ফলে তার নাম ডাক গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দলও খুশি হয় তার কাজকর্মের প্রসার দেখে। গ্রামের রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুতিকরণের কাজের জন্য সরকার থেকে ফান্ড মঞ্জুর করা হলে, সেই কাজের জন্য টেন্ডার ডাকতে হয়। জমা দেওয়া সব টেন্ডারগুলি বিবেচনা করে কাজের জন্য যোগ্য কাউকে বরাত দেওয়া হয়। এইসব কাজ তাকে একাই করতে হয়। কাজটা খুব সহজ নয়। বেশ ঘোরালো। সে সব তাকে সমলাতে হোত পঞ্চয়েত প্রধান হিসাবে। কখনও কখনও দলের উপর মহল থেকে চাপ আসত অযোগ্য কাউকে বরাত পায়িয়ে দেওযার জন্য। তখন সমস্যা হতো বেশ। নিবারণ শিকদারকে তাদের বোঝাত হত, এদের দিয়ে কাজ করালে, কাজের মান ভাল হবে না। গ্রামবাসীরা সেটা মেনে নেবে না। তার কথা শুনে তারপর উপর মহল থেকে প্রস্তাব এলো, যে প্রোমোটার যা কাজ পাবে, তার কিছু অংশ তাদের দলের ফান্ডে দান করতে হবে।

মানে?

মানে দু’লাখ টাকার কাজ পেলে, দলের ফান্ডে তাদের কুড়ি হাজার টাকা দান করতে হবে।

ওহ্, আচ্ছা।এই ব্যাপার! বেশ বোঝা গেল তাহলে।

এইভাবেই নিঝুমপুর গ্রামের উন্নয়নের কাজ ধারাবাহিক চলতে লাগল। যারা কাজ পাচ্ছে, তারা মনে কিছুটা অখুশি হলেও, টেন পারসেন্ট দিয়েই কাজ করতে রাজি হলো। এই দেখে নিবারণ পরের বার থেকে যারা টেন্ডার থেকে কাজ পাবে, তাদের জন্য দেয়ো পারসেন্টটা টেন পারসেন্ট থেকে বাড়িয়ে ফিফটিন পারসেন্ট করে দিল। দশ পারসেন্ট দলের ফান্ডে জমা পড়ত। আর পাঁচ পারসেন্ট তার নিজের ফান্ডে জমা হতো। এইভাবে নিবারণের জীবনের মানের উন্নতি ঘটতে লাগল। আগে তিনি সাইকেল চালিয়ে পঞ্চায়েত অফিসে যাতায়াত করতেন। এখন বাইক কিনেছেন। সেটা চড়েই পঞ্চায়েত অফিসে যাতায়াত করেন। আগে তারা টালির চাল আর বাঁশের বেড়ার ঘরে বাস করতেন। এখন সেটা দু'কামড়ার পাকা ঘর হয়েছে। আগে তার বউয়ের হাতে শুধু কয়েক গাছা কাঁচের চুড়ি ছিল। এখন হাতে অনেকগুলি সোনার চুড়ি হয়েছে। আগে তার ছেলে অনামী একটা বাংলা স্কুলে পড়ত। এখন পড়ে নামী-দামী একটা কনভেন্ট স্কুলে। আগে ছেলেটা মাটিতে মাদুর পেতে বই নিয়ে পড়তে বসত। এখন টেবিল চেয়ারে বসে পড়াশুনা করে। আগে তার ছেলে হেঁটে স্কুলে যেত। এখন নিবারণের বাইকে করে স্কুলে যায়। নিবারণের জীবনের মান উন্নয়নের সাথে সাথে দায়িত্বও বেড়েছে তার অনেক, জীবনে সেই মান ধরে রাখবার জন্য। গ্রামের লোকেরা অবশ্য তার উপর আস্থা রাখে। কারণ, তারা কোন দরকারে তার কাছে এলে, তিনি তাদের সবার অভাব অভিযোগের কথা মনদিয়ে শোনেন। নিজের নোট বুকে টুকে রাখেন। ততাপর যতটা পারেন সমাধানের চেষ্টা করেন। কন্টাকটারের কাজকর্ম নিয়মিত দাঁড়িয়ে থেকে তিনি দেখভাল করেন, যাতে তারা কাজে নিম্ন মানের সরঞ্জাম দিয়ে কাজ করে ফাঁকি দিতে না পারে। ফলে, তার গ্রামের রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট, বিদ্যুৎ পোষ্ট, স্কুল বিল্ডিংয়ের কাজ অন্য গ্রামের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছ। একথা গ্রামবাসীরাও বিশ্বাস করে। সেই কারণে গ্রামবাসীদের তার উপরে আস্থা অটুট আছে। তবে মানুষের স্বভাব তো, সুগোগ সুবিধা পেতে পেতে, দিন দিন তাদের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। তাদের সব চাহিদা পূরণ করা নিবারণের সীমিত ক্ষমতার পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে কারণে কারও কারও মনে ক্ষোভ জমা হওয়াও অস্বাবিক নয়। সেই ক্ষোভকে ভোটের আগে, বিরোধী দলের নেতারা খুঁচিয়ে ঘা করে তুলতে চায়। সে সব সামলাতে হয় নিবারণ শিকদারকে। তাই সেকারণে ভোটের সময় কিছু দুর্বৃত্তদের হাতে রাখতে হয়। নিবারণের নিজের কাছে যুক্তি, আমি তো গ্রামবাসীদের কোন ক্ষতি করছি না। ঠিক মতো যাতে কাজ হয়, কন্টাকটাররা যাতে ফাঁকি দিতে না পারে, তার দেখভাল আমি ঠিক মতো করি। তার বদলে সরকারি টেন্ডার থেকে মাত্র ফাইভ পারসেন্ট কাটমানি খাই। তাতে কি? দল খায় তারও দ্বিগুণ বেশি। দলের এতে কোনও
অপরাধ না হলে, তবে তার আর আমার অপরাধ কী? একটু পরেই দেখা গেল, দূর থেকে কেউ একজন তার দিকেই ধেয়ে আসছে। নিবারণ বাবু চোখ তুলে একবার তার দিকে তাকালেন। তারপরে খবরের কাগজের পাতায় ডুবে গেলেন। লোকটি কাছে এলে দেখা গেল, নকুল বিশ্বাস। তাদের দলেই একজন কর্মী। সে কাছে এসে নিবারণ বাবুকে বললেন, স্যার ওদিকে তো গোলমাল হয়ে গেছে। বাচ্চুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভোর বেলা ওর মা এসে আমার কাছে কান্নকাটি করে জানাল, কাল দুপুরে বেরিয়ে রাতে আর বাড়ি ফিরে আসেনি বাচ্চু। কথাটা শুনে নিবারণবাবু কাগজ থেকে চোখ তুলে তাকালেন তার দিকে। বললেন, থানায় খবর দিয়েছিস?

  • না স্যার, খবরটা শুনে আপনার কাছেই প্রথম ছুটে এসেছি। আপনি বললে, থানায় খবর দেব।
  • একমুহূর্ত ঠোঁট কামড়ে, নিবারণবাবু কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল?
  • তা তো জানি না স্যার।
  • চায়ের দোকানে, বাজারে, সেলুনে গিয়ে আগে সেই খবরটা নে, ওর সঙ্গে আর কেউ ছিল কিনা? কেউ তাকে দেখেছে কিনা?
  • আচ্ছা স্যার।
  • খবরটা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারিস আমাকে জানাস।
  • আচ্ছা স্যার।
  • তুই বাপ্পার বাড়িটা চিনিস তো?
    লোকটা মাথা কাৎ করে জানাল, যে সে বাপ্পার বাড়িটা চেনে।
  • একবার গিয়ে তুই, ওকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বল।
  • আচ্ছা স্যার।
  • ঠিক আছে, আমি দেখছি কি করা যায়। তুই এবার যা।
  • আচ্ছা স্যার।

বলে নকুল চলে গেল।
বাপ্পা তার পোলিং এজেন্ট।

নকুল পার্টির ইনফর্মার। একসময় নিবারণের একরোলের দোকানের কর্মচারী ছিল। এখন সে বাজারের একটা পাইস হোটেলে কাজ করে। মা বাবা কেউ নেই তার। বিয়ে করেনি। হোটেলেই একা পড়ে থাকে। নিবারণের খুব বিশ্বস্ত ও অনুগত লোক।

বাচ্চু ছেলেটা ডাকসাইটে গুন্ডা মাস্তান।
দুর্বৃত্ত প্রকৃতির। আগে চুরি ছিনতাই করত। ছুরি চাকু চালাতে পারে অনায়াসে। পেটো বোমা বাঁধতে পারে। রিভালবার চালাতে পটু। ভোটের সময় এরা খুব কাজে লাগে। কয়েক বোতল মদ আর কিছু টাকা হাতে তুলে দিলেই, ভোটটা উৎরে দেয়। তাই এইসব ছেলেদের হাতে রাখতে হয়। খবর রাখতে হয়, কোথায় যায়? কি করে? কাদের সঙ্গেে মেশে? বিরোধী দলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখে কিনা? দল বিবোধী কোন ভাবনা মনে আছে কিনা? এইসব আরকি।

পঞ্চয়েত ভোটের আর এক মাসও বাকি নেই। তাই এই সময়, বাচ্চু ছেলেটাকে নিয়ে ভাবনায় পড়লেন নিবারণ শিকদার। ভাবনায় তন্ময় হয়ে ছিলেন তিনি। সেই সময় কখন বাপ্পা এসেছে দাঁড়িয়ছে তার পাশে, টের পাননি।
বাপ্পা বলল, স্যার কাল রাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে?

  • কি হয়েছে?
  • কাল আম বাগানে পেটো বাঁধতে গিয়ে বাচ্চুর ডান হাতটা উড়ে গেছে, ওকে গোপন শেল্টারে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
  • ওকে হাসপাতালে না দিয়ে, গোপন শেল্টারে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে কি হাতটা সারবে?
  • তা তো জানি না
  • তবে ওকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দে।
  • হাসপাতাল নিয়ে গেলে, বোমা বাষ্ট কেস দেখে, ডাক্তার যদি পুলিশ কেস করতে বলে? যদি থানায় খবর দেয়?
  • দিলে, দেবে। থানা মনে করলে, বাচ্চুকে অ্যারেষ্ট করবে।
  • থানায় নিয়ে গেলে তো সব খবর চাউর হয়ে যাবে। মিডিয়া ঢুকে পড়বে খবরের কাঁটা বাছতে।
  • যাদের যা কাজ, তারা সেটা করবে। তাতে আমাদের আপত্তি কী? তুই শুধু একটা কাজ কর। বাচ্চুকে দশ হাজার টাকা দিয়ে বল, থানায় ধরে নিয়ে গেলে, ও যেন শুধু একটা কথাই বলে পুলিশের কাছে, বিরোধী পক্ষের দলের পক্ষ থেকে তাকে দশ হাজার টাকা দেবে বলেছিল, যদি সে তাদের জন্য কিছু বোমা বেঁধে দেয়, গোপনে আম বাগানে বসে। সেই কাজ করতে গিয়ে তার হাত উড়ে যায়। ওকে আরও বলবি কোর্টে ওর জেল হয়ে গেলেও, ইলেকশনের পরে আমরা ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসব।
  • বেশ বলে, বাপ্পা চলে গেল। তারপর নিবারণ শিকদারের কথা মতো সে বাচ্চুকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। বোমা বাষ্ট কেস দেখে, ডাক্তার চিকিৎসা শুরু করার আগেই লোকাল ধানায় খবর দিল। থানা থেকে পুলিশ এসে তাকে নিয়ে পুলিশ হাসপাতালে চলে গেল। সেখানে তার চিকিৎসা শুরু হল।

পরদিন সকালে স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা 'নিঝুমপুর গ্রাম বার্তা'-র প্রথম পাতায় বড় বড় করে ছাপা হল - আম বাগানে অমিত সাহা, ডাক নাম বাচ্চু, বোমা বাঁধতে গিয়ে, তা বাষ্ট করে, তার ডান হাতটা উড়ে গেছে। পুলিসি জেরায় সে একথা স্বীকার করেছে যে শাসকদের প্রতিপক্ষ দলের জন্য সে আম বাগানে লুকিয়ে বোমা বাঁধতে গিয়ে, অন্যস্কতার ফলে তার হাত থেকে বোমাটা ছিটকে মাটিতে নীচে পড়ে গিয়ে ফেটে যায়, তাতে তার ডান হাতটা উড়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *