সতেরো শব্দের ম্যাজিক
খুন করলে শাস্তি পেতে হয়। সেটাই নিয়ম। আর আমি তো নিয়মের বাইরে নই! এখন যে এই জেলে বসে ফাঁসির জন্যে অপেক্ষা শুরু করেছি সেটাও নিয়মের মধ্যেই পড়ে।
কিন্তু কারও প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। কারণ, খুন করলে যে ফাঁসি হতে পারে সেটা আমার জানাই ছিল। তার ওপর নিজের দোস্তকে খুন করেছি, আর সেই খুনের কথা পুলিশের কাছে কবুলও করেছি।
একটু আগে টেলিফোন করে আমি নিজেই পুলিশে খবর দিয়েছি।
আমার পায়ের কাছে শুভঙ্করের দেহটা চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। ওর গলার ফুটো দিয়ে এখনও রক্ত বেরিয়ে আসছে—ঠিক কর্পোরেশনের ফুটো হয়ে যাওয়া জলের পাইপের মতো। হ্যাঁ, শুভঙ্করের হাত-পা তখনও সামান্য নড়ছিল। ঝাপসাভাবে একটু-আধটু চিন্তাও বোধহয় করতে পারছিল। ও কী ভাবছিল আমি জানি। আমিও একই কথা ভাবছিলাম। সতেরোটা শব্দের জন্যে ওকে মরতে হল। আমাকে মারতে হল ওই ক’টা শব্দের জন্যে। ওই সতেরোটা শব্দ দুনিয়ার আর কেউ জানে না। শুধু আমি জানি। আর শুভঙ্কর জানত।
এও জানি, সবাই অবাক হয়ে ভাববে বহুদিনের পুরোনো বন্ধু শুভঙ্কর মিত্রকে কেন আমি খুন করলাম। বিশেষ করে যে-শুভঙ্কর দিনকয়েক আগেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে একরকম অলৌকিকভাবে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে!
যদি আপনারা বিরক্ত না হন তা হলে শুরু থেকে সব খুলে বলি—শুধু ওই সতেরোটা শব্দ ছাড়া।
শুভঙ্কর আর আমি একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি, কলেজে পড়েছি। তবে ওই একসঙ্গে পড়েছি পর্যন্তই। পড়াশোনায় কখনও ওর ধারেকাছেও আমি আসতে পারিনি। পড়াশোনায় ও যদি জিরাফ হয়, আমি তা হলে ছারপোকা—এতটাই উচ্চতার ফারাক ছিল। কিন্তু আশ্চর্য মানুষ ছিল শুভঙ্কর। কী সহজভাবেই না আমার সঙ্গে মিশত! পরের উপকার করার জন্যে সবসময় এক-পা বাড়িয়েই থাকত। পরের দুঃখে দুঃখ পেত, পরের সুখে সুখ। আমাকে পড়াশোনায় ভালো করে তোলার ব্যাপারেও ও কম মেহনত করেনি। কিন্তু ধন্য আমার অপদার্থ মেধা! সে তার জায়গা থেকে একচুলও নড়েনি।
সুতরাং শুভঙ্কর সব পরীক্ষায় পাশ করত লাফিয়ে-লাফিয়ে, আর আমি গড়িয়ে-গড়িয়ে। কিন্তু একদিনের জন্যেও ওকে আমি ঈর্ষা করিনি। ও ছিল এমন মানুষ যাকে ঈর্ষা করা যায় না, শুধু ভালোবাসা যায়।
শুভঙ্কর বইয়ের পোকা ছিল। নানান ধরনের বই পড়ত ও। বেদ, উপনিষদ, গীতা থেকে শুরু করে চীনা আর তিব্বতি পুঁথির কপিও ওর প্রিয় ছিল। সবসময় দেখতাম চিন্তায় কেমন বিভোর হয়ে আছে। কিছু জিগ্যেস করলেই বলত, আত্মার শক্তির মূল রহস্যে পৌঁছনো দরকার। তা হলেই হাতে পাওয়া যাবে চরম শক্তি।
আমি যে ওর কথাবার্তার একটি বর্ণরও মানে বুঝতাম না, সেটা নিশ্চয়ই আর বলার প্রয়োজন নেই!
দুর্দান্ত রেজাল্ট করে রীতিমতো দার্শনিক হয়ে শুভঙ্কর কলেজের পড়াশোনা শেষ করে ইউনিভার্সিটির দিকে এগোল। আর আমি সেই গড়িয়ে-গড়িয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়ে পড়াশোনার চাকা থামালাম। এবং চাকরি পেলাম পুলিশে।
শুভঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ আর ছিল না। কী করে যেন দশ-দশটা বছর কেটে গেল। তারপর হঠাৎই একদিন শুভঙ্করের সঙ্গে রাস্তায় দেখা।
ওর বয়েস যেন দশের জায়গায় পনেরো বছর বেড়ে গেছে। মাথায় অনেকটা টাক পড়েছে। আর জ্ঞানও নিশ্চয়ই বহু-বহুগুণ বেড়েছে এই সময়ে। কারণ, এখনও ওর চোখে সেই কলেজজীবনের ভাবুক দৃষ্টি। আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এক অদ্ভুত উজ্জ্বল দীপ্তি। চশমার কাচদুটোও যেন সেই দীপ্তিতে চকচক করছে। একেই কি বলে জ্ঞানের আলো?
‘আরে, প্রদীপ না!’
‘শুভঙ্কর, তুই!’
এরপর রাস্তায় দাঁড়িয়েই হাত ঝাঁকানো, পিঠ চাপড়ানো, আর পুরোনো দিন নিয়ে নানা কথা।
‘কী করছিস এখন তুই?’ শুভঙ্কর জিগ্যেস করল।
‘আমি এখন চিফ মিনিস্টারের বডিগার্ড।’ আমি একটু গর্বের সঙ্গে বললাম। রাজ্যের হর্তাকর্তা বিধাতার প্রাণরক্ষী হওয়াটা নিশ্চয়ই খুব ফেলনা নয়!
খেলাধুলো বরাবরই আমার প্রিয়। ঝুঁকি নিতেও খারাপ লাগে না। তাই এই পাহারাদারির কাজটা বেশ মেজাজি ঢঙে করতে পারি। এই কাজের কতকগুলো ইন্টারেস্টিং দিক আছে। উঁচুমহলের কিছু-কিছু গোপন খবর আগেভাগেই জানা যায়। সেজন্যে বাঁকা-পথে কমবেশি কু-প্রস্তাব যে আসেনি এমন নয়। কিন্তু আমি অনায়াসে সেগুলো খারিজ করে দিয়েছি। বিশ্বাসঘাতকতা আমার ভৌত বা রাসায়নিক ধর্মে নেই। তা ছাড়া দেশের জন্যে আমি প্রাণ দিতেও রাজি, নিতেও।
অনেক সময় মুখ্যমন্ত্রীর কোনও অনুষ্ঠানে পাশ পাওয়ার জন্যে কেউ-কেউ আমাকে ধরে। আমি এরকম পাশ অনেককেই জোগাড় করে দিয়েছি। শুভঙ্করও আমাকে হঠাৎ একই অনুরোধ করল।
নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে সামনের শনিবার চিফ মিনিস্টার একটা আলোচনা-চক্র ডেকেছেন। তাতে পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, খরা, বন্যা ইত্যাদি নিয়ে বিশিষ্ট বক্তারা তাঁদের বক্তব্য পেশ করবেন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হিসেবে হাজির থাকবেন নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন। তিনি বলবেন, এইসব বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোকে কীভাবে উন্নত করা যায়।
শুভঙ্কর একেবারে নাছোড়বান্দার মতো আমাকে চেপে ধরল।
আমি ওর ফোন-নাম্বার নিলাম। বললাম, দেখছি, কী করা যায়। যদি একটা পাশ জোগাড় করতে পারি তা হলে ওকে ফোন করে দেব।
ও বলল, ‘স্টেজের একটু কাছাকাছি দিতে চেষ্টা করিস।’
তাই দিলাম। এবং অনুষ্ঠানের দিন দেখি শুভঙ্কর তৃতীয় সারিতে বসে আছে। ওর টানা-টানা ভাবুক চোখ বিশিষ্ট মানুষদের আলোচনা শুনতে মগ্ন। অবশ্য আমার কানে ওসব কথাবার্তা ঢুকছিল না। আমি দর্শকদের ওপরে তীক্ষ্ন নজর রেখেছিলাম। কারও এতটুকু বেচাল দেখলেই আমার ক্ষিপ্র ডানহাত পৌঁছে যাবে কোমরে আঁটা সার্ভিস রিভলভারে।
শেষ পর্যন্ত রিভলভারে হাত আমাকে দিতেই হল।
হলের চতুর্থ সারি থেকে তিনজন লোক হঠাৎই প্যাসেজে বেরিয়ে এল। তারপর আচমকা চিৎকার করে ওদের দুজন রিভলভার বের করে গুলি ছুড়তে শুরু করল।
এসব ঘটনা তো আপনারা কাগজে পড়েছেন! তবে আমি আপনাদের যেসব খুঁটিনাটি তথ্য দেব সেগুলো কাগজে বেরোয়নি।
অসমের একটা জঙ্গি দল—নাম, বিটা ফ্রিডম—গত কয়েকমাস ধরেই কলকাতায় নানারকম উৎপাত করছিল। এরা গুলি ছোড়ার আগে চেঁচিয়ে সেই নামটাই বলেছে। আর এদের সুইসাইড স্কোয়াড কখনও বেঁচে ফেরার কথা ভাবে না।
এসব জঙ্গি-ফঙ্গির কেসে আমিও ওদের সঙ্গে একমত। ওদের বাঁচিয়ে অ্যারেস্ট করার কোনও সিন নেই। অন্তত আমার কাছে। তাই স্টেজের একপাশ থেকে চিতাবাঘের মতো লাফ দিয়ে নেমে এলাম নীচে—প্রথম সারির দর্শকদের সামনে। রিভলভারসমেত ডানহাত তৈরি।
ওদের গুলিতে একটা ফুলদানি ঠিকরে পড়ল। স্টেজের দুজন আহত হয়ে বসে পড়েছে। সবাই দুদ্দাড় করে ছুটে পালাচ্ছে।
দর্শকরাও চিৎকার করে উদভ্রান্তভাবে ছোটাছুটি শুরু করেছে। তারই মধ্যে দেখি শুভঙ্করও ছুটে আসছে আমার কাছে।
আমি নিখুঁত নিশানায় গুলি করলাম। এজনের কপালে, আর-একজনের বুকে। ওরা জমার খাতা থেকে পলকে ঢুকে পড়ল খরচের খাতায়।
তিন নম্বরকে গুলি করতে গিয়েই আমি থমকে গেলাম।
লোকটা পিন টেনে একটা হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে দিয়েছে প্যাসেজে—আমার কাছাকাছি। তারপর ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে।
ওকে গুলি করার কথা ভুলে গিয়ে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম গ্রেনেডটার ওপরে—যদি ফেটে যাওয়ার আগে ওটাকে দরজার বাইরে ফাঁকা জায়গায় ছুড়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু আমাকে হারিয়ে দিয়ে এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় শুভঙ্কর মিত্র গ্রেনেডটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
পরদিনের কাগজে আমাদের দুজনকেই হিরো বানিয়ে দেওয়া হল। পঞ্চাশ হাজার টাকা করে সরকারি পুরস্কারও ঘোষণা করা হল। কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুভঙ্কর মিত্র একেবারে গ্রেনেডটার ওপরে গিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী-এক আশ্চর্য কায়দায় ও প্রেনেডটাকে এমনভাবে দরজা দিয়ে ছুড়ে দিয়েছিল যে, গ্রেনেডটা ফেটে গেলেও কেউই মারাত্মকরকম জখম হয়নি।
গ্রেনেডের বিস্ফোরণে কাঠ, লোহা, কাচ তিরবেগে ছিটকে গেছে নানা দিকে। কিন্তু সবাই বেঁচে গেছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় শুভঙ্কর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার ছ’ঘণ্টা পর ওর জ্ঞান ফিরেছিল। তারপর প্রায় তিরিশ ঘণ্টা ও একেবারে শয্যাশায়ী ছিল।
সব মিলিয়ে বিশ্বাস-হতে-চায়-না এমন একটা ঘটনা শুভঙ্কর ঘটিয়ে দিয়েছে।
দু-দিন পর সন্ধেবেলা ওর বাড়িতে গেলাম।
ও আমাকে দেখে খুশি হয়ে হাসল। হাসিটা কলেজজীবন থেকে নেওয়া। দেখে ভালো লাগল। আমাদের দুজনের বয়েস কমতে লাগল।
‘বোস, প্রদীপ। একেবারে কান ঘেঁষে বেঁচে গেছি, কী বলিস! বছরচারেক আগে তিব্বতে একবার এরকম সিচুয়েশন হয়েছিল।’
‘ওসব তিব্বত-টিব্বতের ব্যাপার জানি না। তুই সেদিন আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিস।’
‘আরে না, না। আমি শুধু সাহস করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম…তারপর সব কপাল। লাক, বুঝলি, লাক!’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘তুই বলছিস লাক। কিন্তু কাগজে তোর কথা যা লিখেছে…ফ্যান্ট্যাসটিক। লিখেছে, তুই চোখের পলকে যে-অ্যাকশান নিয়েছিস তা এক-কথায় অকল্পনীয়। কেউ দেখেশুনে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাজ শেষ।’
শুভঙ্কর লজ্জা পেয়ে গেল। চোখ নামিয়ে বিনয়ের সুরে আমতা-আমতা করে বলল, ‘ওরা সবকিছু ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে লেখে। আসলে আমার দিকে কেউ অতটা খেয়াল করেনি…।’
আমি অল্প হাসলাম: ‘আমি কিন্তু খেয়াল করেছি। কারণ, খেয়াল করাটাই আমার কাজ।’
শুভঙ্কর চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে। ওর চোখে কেমন যেন একটা ধরা-পড়ে-যাওয়ার ভয়।
আমি বলতে লাগলাম, ‘শুভঙ্কর, তোর আর গ্রেনেডটার মাঝে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুই আমাকে পেরিয়ে কী-করে ওটার কাছে গেলি সেটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। এই দেখলাম তুই দূরে দাঁড়িয়ে—তারপরই দেখি তুই একেবারে গ্রেনেডটার ওপরে। তা ছাড়া…।’
শুভঙ্কর আপত্তির ঢঙে মাথা নেড়ে আমাকে থামাতে চাইল। কিন্তু আমি থামলাম না। বলার নেশা আমাকে পেয়ে বসেছিল।
‘তা ছাড়া তুই পড়েছিলি গ্রেনেডটার একেবারে ওপরে। ওটা ফেটেছে তোর বডির নীচে। উহুঁ—আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না, কারণ, আমি বলতে গেলে তোর ওপরে গিয়ে পড়েছিলাম। গ্রেনেডের এক্সপ্লোশানের ধাক্কায় তুই ছিটকে শূন্যে উড়ে গিয়েছিস। তারপর—তুই কি বুলেটপ্রূফ জ্যাকেট পরেছিলি?’
শুভঙ্কর গলাখাঁকারি দিয়ে সময় নিল। তারপর বলল, না, আসলে ঠিক তা নয়….’
আমি ঠান্ডা চোখে শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘শুভঙ্কর, তুই হয়তো ব্যাপক বুদ্ধিমান। কিন্তু তাই বলে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, আমি এক ব্যাপক মূর্খ।’
শুভঙ্কর তা সত্ত্বেও চেষ্টা করল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখ থেকে চশমা খুলে চোখ মুছল। তারপর: ‘তুই কি ভালো করে কাগজ পড়িসনি! গ্রেনেডটা অনেকটা দূরে ফেটেছে…।’
‘শুভঙ্কর, আমি কিন্তু তোর কাছেই ছিলাম।’ অনেকটা গার্জেনি সুরে বললাম আমি।
শুভঙ্করের মুখ হঠাৎই কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ও চোখ বুজে চেয়ারে গা এলিয়ে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মেলল আবার। মেপে নেওয়ার চোখে তাকাল আমার দিকে। কিন্তু ওর দৃষ্টিতে কোনও তীব্র ভাব ছিল না—বরং কেমন যেন বিষণ্ণ, শান্ত। ওকে দেখে আমার মায়া হচ্ছিল।
শুভঙ্কর একচিলতে হাসল। অদ্ভুত এক দুর্জ্ঞেয় হাসি। তারপর হঠাৎই চাঙ্গা হয়ে উঠে টান-টান হয়ে বসল চেয়ারে, বলল, ‘নাঃ, আর গোপন করার কোনও মানে হয় না। একদিন তো কাউকে বলতেই হবে! তা তোকেই বলি।’
এরপর ও সব খুলে বলল আমাকে।
না, ওর সব কথা আমি আপনাদের বলতে পারব না। অন্তত সতেরোটা শব্দ— হ্যাঁ, সতেরোই তো—আমাকে বাদ দিতে হবে। এই সতেরোটা শব্দ কোনওদিন কাউকে বলা যাবে না।
বাকিটা আপনাদের বলছি।
‘তুই দেখছি কলেজ-লাইফের ব্যাপারগুলো মনে রেখেছিস—’ শুভঙ্কর বলল, হাসল পুরোনো কথা ভেবে: ‘সেই যে ক্যান্টিনে বসে ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা তর্ক। কথা বলতে-বলতে নির্জন পথে উদ্দেশহীন হেঁটে যাওয়া। আত্মা নিয়ে কত কী বকবক করে গেছি আমি। আর তুই একটুও বিরক্ত না হয়ে চুপচাপ শুনে গেছিস—মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ, মনে পড়ে। সেদিন ইনডোর স্টেডিয়ামের ওই ব্যাপারটার পর আরও বেশি করে সব মনে পড়ে গেছে। তুই বলতি, আত্মার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। চিন্তার গভীরতা আর তীব্রতা দিয়ে সেটা প্রমাণ করা যায়। শুধুমাত্র আত্মার শক্তি দিয়ে এক-পা-ও না হেঁটে, কোনও যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই কোনও মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে। তুই বলতি, আত্মার কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই।’
এসব পুরোনো কথা বলতে গিয়ে নিজেকে কেমন বোকা-বোকা লাগছিল। এসব অবাস্তব উদ্ভট চিন্তার কোনও মানে হয়! শুধুমাত্র চিন্তার জোরে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় যাওয়া! রাবিশ!
কিন্তু সেদিন ইনডোর স্টেডিয়ামের ওই ব্যাপারটা! আমি তো সেখানে হাজির ছিলাম, সব দেখেওছি!
কেমন যেন হতবুদ্ধিভাবে ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম শুভঙ্করের দিকে। কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
হেসে ফেলল শুভঙ্কর। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চলে এল আমার পাশে। পিঠে আলতো চাপড় মেরে বলল, ‘প্রদীপ, তুই যা-যা বললি সেগুলো একদিক থেকে ভুল, আবার একদিক থেকে ঠিকও বটে। যখন এসব কথা বিশ্বাস করতাম তখন আমার বয়েস কম ছিল, জ্ঞানও। শুধু আত্মার পক্ষে এসব করা সম্ভব নয়। কিন্তু…’ ওর চোখ উত্তেজনায় চকচক করে উঠল, ওর কথা বলার গতিও বাড়ছিল একইসঙ্গে: ‘কিন্তু এমন কিছু স্পেশাল টেকনিক আছে যা মনের সঙ্গে আমাদের জগতের সবরকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার যোগাযোগ তৈরি করে দেয়। মানে, মাইন্ড আর ফিজিক্যাল ফোর্সের একটা স্পেশাল লিঙ্ক। ফলে, শুধুমাত্র মন দিয়ে, আত্মার শক্তি দিয়ে সবকিছু—যা খুশি করা যায়। যেমন ধর, সমুদ্রের ওপর দিয়ে যেতে চাস? চোখের পলকে সেটা সম্ভব, প্রদীপ। একটা গ্রেনেডের এক্সপ্লোশানকে সামাল দিতে হবে? কোনও ব্যাপারটা নয়! তুই তো নিজের চোখেই দেখেছিস! তবে এ-কাজেও বহু শক্তি খরচ করতে হয়। শক্তির নিত্যতা সূত্রকে তুই তো আর এড়াতে পারিস না! দেখলি তো, ওই ব্যাপারটার পর আমার কী সাঙঘাতিক অবস্থা হয়েছিল! অবশ্য ওই কাজটা অনেক টাফ ছিল। সেই তুলনায় একটা বুলেটের নিশানা ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজ মোটামুটি জলভাত। আর তার চেয়েও সহজ হল ফায়ার করার আগেই বুলেটগুলো নিজের পকেটে নিয়ে আসা। তা হলে ফায়ার করার ব্যাপারটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কোহিনূর দেখবি? নিয়ে আসব?’
‘কোহিনূর!’ ওর আচমকা প্রশ্নে আমি হাঁ হয়ে গেলাম।
হাসল শুভঙ্কর: ‘হ্যাঁ রে, হিরে কোহিনূর।’
‘তুই ভবিষ্যৎ দেখতে পাস?’ আমি প্রসঙ্গ পালটে জিগ্যেস করলাম।
‘না। ওসব ভবিষ্যৎ-টবিষ্যৎ দেখার ব্যাপারটা…।’
‘তুই মনের কথা টের পাস? টেলিপ্যাথি?’
‘ওঃ, ক্যান্টিনের আড্ডার টপিকগুলো তুই ভুলিসনি দেখছি! না, ভাই, টেলিপ্যাথি জানি না—অন্তত এখনও। দু-চারবছর লেগে থাকলে হয়তো কোনও রেজাল্ট পেলেও পেতে পারি। তবে এখনই আমি অনেক কিছু পারি যেগুলো টেলিপ্যাথির চেয়ে কম ইন্টারেস্টিং নয়। ইচ্ছে করলেই আমি যে-কোনও শব্দ, যে-কোনও কথা শুনতে পারি। যা ইচ্ছে তা-ই দেখতে পাই। যেমন ধর, অ্যাস্টারয়েড বেল্টের গ্রহাণুগুলোর চেহারা আমি দেখেছি—এবড়োখেবড়ো পাথর…।’
আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে চাপা স্বরে বললাম, ‘আমাকে কিছু একটা করে দেখা তো!’
হাসল শুভঙ্কর। ভারি অদ্ভুত সে-হাসি। যেন অঙ্কে ডক্টরেট কোনও পণ্ডিতকে ক্লাস ওয়ানের অঙ্ক করতে বলা হয়েছে।
আমি অবাক চোখে শুভঙ্করকে দেখছিলাম। বিশ্বাস হতে চায় না, অথচ বিশ্বাস না করেও তো উপায় নেই। এই মানুষটা সব পারে! এই মানুষটা এখন ভগবান!
দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, বছরের-পর-বছর ও একই স্বপ্ন নিয়ে কাটিয়েছে। নানারকম জটিল তত্ত্ব, পুঁথিপত্র নাড়াচাড়া করেছে। বহুরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। সফল হতে পারেনি। কিন্তু তিলতিল করে ও এগিয়ে গেছে সাফল্যের দিকে—থামেনি একলহমার জন্যেও। শেষ পর্যন্ত হাতের নাগালে এসেছে অমৃতের পাত্র…।
আমাকে এসব কথা বলতে নিশ্চয়ই ওর ভালো লাগছিল। নিজের নিষ্ঠা, পরিশ্রম আর কৃতিত্বের কথা কার না বলতে ইচ্ছে করে!
‘কিছু একটা করে দেখাব?’ শুভঙ্কর যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলল, ‘দাঁড়া—’ ঘরের চারপাশে চোখ বোলাল ও: ‘ওই জানলাটা দেখছিস?’
ঘরের একটা বন্ধ জানলার দিকে তাকালাম। খট করে শব্দ করে জানলাটা খুলে গেল। পরমুহূর্তেই আবার বন্ধ হয়ে গেল।
‘টিভিটা দেখ!’ বলল শুভঙ্কর।
সঙ্গে-সঙ্গে টিভি-টা অন হয়ে গেল।
‘ওটার দিকে তাকিয়ে থাক।’
টিভি-টা অদৃশ্য হয়ে গেল। পরক্ষণেই আবার ফিরে এল। কিন্তু দেখলাম টিভি-টার সারা গায়ে মিহি বরফকুচি লেগে আছে।
‘ওটাকে হিমালয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম।’ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল শুভঙ্কর।
এবার ও তীব্র চোখে টিভি-র মেইনস কর্ডটার দিকে তাকাল।
আমার হতভম্ব দৃষ্টির সামনে কর্ডটা শূন্যে ভেসে উঠল সাপের মতো—তার শেষ প্রান্তে প্লাগটা যেন সাপের ফণা। ওটা এগিয়ে যাচ্ছিল দেওয়ালে বসানো সকেটের দিকে।
কিন্তু সকেটের কাছে পৌঁছনোর আগেই প্লাগটা আচমকা খসে পড়ে গেল মেঝেতে।
শুভঙ্কর কেমন একটা বিরক্তির শব্দ করে উঠল, বলল, ‘নাঃ! দাঁড়া, তোকে আরও কঠিন কিছু দেখাই।’
ওর শরীর থরথর করে কাঁপছিল। কাঁপা গলায় ও বলল, ‘টিভি-টার দিকে লক্ষ কর, প্রদীপ। সকেটে প্লাগ না গুঁজেই ওটা তোকে চালিয়ে দেখাব। স্রেফ বাতাস থেকে ইলেকট্রন নিয়ে…।’
রঙিন টিভি সেটটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল শুভঙ্কর।
হঠাৎই পাওয়ার অন হওয়ার ছোট্ট লাল বাতিটা জ্বলে উঠল। বারকয়েক দপদপ করে জ্বলল-নিভল। তারপর জ্বলেই রইল। টিভির স্পিকার থেকে শব্দ বেরোতে শুরু করল।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। আলতো পায়ে পৌঁছে গেলাম ওর পেছনে। কোমর থেকে সার্ভিস রিভলভারটা বের করে নিলাম।
বেশ বুঝতে পারছিলাম, একটা বিরাট জুয়া খেলছি—কিন্তু এ ছাড়া আর তো কোনও উপায় নেই।
রিভলভারের বাঁট দিয়ে ওর বাঁ-কানের পেছনে প্রচণ্ড ঘা বসিয়ে দিলাম। টুঁ শব্দ না- করে শুভঙ্করের দেহটা ভাঁজ খেয়ে উলটে পড়ল মেঝেতে। আরও একটা ঘা বসিয়ে দিলাম ওর মাথায়। পরখ করে নিশ্চিন্ত হলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওর জ্ঞান আর ফিরছে না। সুতরাং আমার কাজ শুরু করলাম।
পেশাদারি ঢঙে ওর ফ্ল্যাট তন্নতন্ন করে সার্চ করতে লাগলাম। একটু পরেই একটা ড্রয়ারে ওর গবেষণার কাগজপত্রগুলো পেলাম। যা চাই সবই রয়েছে সেখানে। লেখা রয়েছে ওর অলৌকিক ক্ষমতার গোপন রহস্য। জুয়ায় আমি জিতেছি।
টেলিফোন তুলে নিয়ে পুলিশে ফোন করলাম।
তারপর মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে থাকা শুভঙ্করের গলায় রিভলভার ঠেকিয়ে ফায়ার করলাম। পুলিশ এসে পৌঁছতে-পৌঁছতে শুভঙ্কর মিত্র মরে কাঠ।
শুভঙ্কর আমার বন্ধু ছিল। এমন বন্ধু যাকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ওই গোপন রহস্য জানার পরেও বিশ্বাস করা যায় কি না সেটাই প্রশ্ন।
মাত্র সতেরোটা শব্দে শুভঙ্করের অলৌকিক ক্ষমতা পাওয়ার রহস্য ফাঁস করা আছে গবেষণার কাগজে। এই মন্ত্রটা একবার কেউ পড়ে নিলেই হল! চোর-ডাকাত-খুনি-পাগল—যে-কেউ এটা পড়ে নিয়ে কাজে লাগাতে পারে, এতই সহজ সেই সূত্র।
শুভঙ্কর এমনিতে খুব সৎ, আদর্শবাদী। কিন্তু এই ক্ষমতা হাতে নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই ও নিজেকে ভগবান ভাবতে শুরু করবে। তখন?
ধরা যাক, আপনি ওই সতেরোটা শব্দ জেনে গেছেন। তখন আপনি অনায়াসে যে-কোনও ব্যাঙ্কের ভল্টে ঢুকে পড়তে পারবেন, যে-কোনও বন্ধ ঘরে উঁকি মারতে পারবেন, দেওয়াল ভেদ করে ইচ্ছেমতো যাতায়াত করতে পারবেন। পিস্তল বা রিভলভারের গুলি আপনাকে খতম করতে পারবে না। গ্রেনেড কিংবা অ্যাটম বোমার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়েও আপনার বিন্দুমাত্র ভয় করবে না। কারণ চোখের পলকে—শুধু ইচ্ছে করলেই—আপনি হাজার-হাজার মাইল দূরে চলে যেতে পারবেন।
এরকম ক্ষমতা যদি পান, তখন?
লোকে বলে, ক্ষমতা থেকে দুর্নীতির জন্ম হয়। সুতরাং চূড়ান্ত ক্ষমতা হাতে পেলে জন্ম নেবে চূড়ান্ত দুর্নীতি। ওই সতেরোটা শব্দই চূড়ান্ত ক্ষমতার শেষ কথা। সুতরাং, শুভঙ্কর আমার বন্ধু হলেও আমি ওকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছি। ওই সতেরোটা শব্দের ক্ষমতা হাতে দিয়ে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না—শুভঙ্করকেও না।
তবে নিজেকে বিশ্বাস করতে আমার আপত্তি নেই।
আপনার কোনও আপত্তি আছে নাকি?