শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 32
কাঁধ অবধি কাঁচা-পাকা চুল মাথায়। সরু লাল পাড় সাদা শাড়ি পরনে। হঠাৎ দেখলে খুব ফ্যাশনদুরস্ত এক প্রবীণা বলে মনে হয়। বোঝা শক্ত, ছেলের ওপর দুরন্ত অভিমানে, নিজের প্রতি বিতৃষ্ণায়, জীবনের প্রতি ধিক্কারে একদিন উনি চুল কেটে ফেলেছিলেন। সোনালি ফ্রেমের চশমার পেছনে গভীর আশ্বাস। ভুরুতে যেন অভয়মুদ্রা। আজ ওঁর ফেয়ারওয়েলের দিন। আর কোনও আলাদা দিনে ওঁকে কিছুতেই আনা যাবে না জেনে অফিসে ওঁর কাজের শেষ দিনটিতেই সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন সহকর্মীরা। উদ্যোক্তা জেনারেল ম্যানেজার পার্সোনেল— অনুপম সোমের পরিচালনায় অফিসার্স ক্লাব এবং ইউনিয়ন। টিফিনের পর সোম নিজে এসে যখন ওঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন বন্দনা তখন ভারি অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু কোনও পরিস্থিতির সামনে পড়ে গেলে বিব্রত হবার মানুষ মিসেস ভট্টাচার্য নন। মঞ্চের ওপর প্রশংসাসূচক বক্তৃতামালা তিনি প্রশান্ত মুখেই শুনে গেলেন। চশমার পেছনে চোখের মুদ্রা অপরিজ্ঞাত রইল। যেন বক্তৃতায় উল্লিখিত ব্যক্তি তিনি নন। শেষকালে তাঁকে কিছু বলবার জন্য অনুরোধ জানালেন অনুপম সোম।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বন্দনা ভট্টাচার্যের গলার স্বরে গাম্ভীর্য এসেছে। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন যেন প্রাচীন পাথরের মূর্তি। শূন্যের দিকে দৃষ্টি স্থির। অর্থব্যঞ্জনাময় এক আলোকিত শূন্য। বলছেন: ‘আপনাদের ভালোবাসার উত্তরে আমি আপনাদের আমার অন্তরতম আশীর্বাদ তো দিতে পারিই! কিন্তু কতটুকু মূল্য সেই বিমূর্ত আশীর্বাদের যদি তার সঙ্গে সাকার সাবয়ব আর কিছু না থাকে? জীবনকে কতকগুলো অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতার মালা করে কি লাভ? আনুষ্ঠানিক আশীর্বচনের বদলে যদি দিই এমন বিশ্বাস যা আপনারা জীবনের প্রতিদিন লগ্নি করতে পারবেন প্রতিদিন যার থেকে ফেরত পাবেন আশাতীত লভ্যাংশ? এই বিশ্বাস যদি কেউ জীবন দিয়ে পায়, তবে তাকে গ্রহণ করতেও সারাজীবনই লাগে। বিশ্বাস করুন মানুষের শক্তি শুধু নিজের জন্য, শুধু নিজের পরিবারের জন্য নয়। কণামাত্র হলেও কিছু শক্তি যদি অবশিষ্ট রাখেন, যদি তাকে সমর্পণ করেন দুঃখী, দুর্দশাগ্রস্ত, হতভাগ্য মানুষের জন্য, যদি একটিমাত্র অবোধ শিশুকেও পৃথিবীর আনন্দের শরিক করতে পারেন, একটিমাত্র দীনজনের কাছেও যদি বাঁচবার সঠিক পথের দিশা দেখাতে পারেন, তবে সেই উৎস থেকেই আপনার জন্য সর্বদুঃখহর আনন্দধারা বইবে। আমাদের আসল শত্রু—রোগ, দারিদ্র্য, অপঘাত। এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবার প্রকৃতিদত্ত হাতিয়ার আমাদের রয়েছে। তাকে আমরা পারস্পরিক বিবাদে, ঈর্ষায়, লোভে অপচয় করি। অথচ মানবযাত্রায় আমরা সবাই সমান শরিক। সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বমাপের দুঃখের মুখোমুখি হলেই সত্যিকারের সুখ আমাদের আয়ত্তে আসবে। আসবেই।’
শ্যামবাজারে ফিরতে দেখল কলি এসেছে। মুখে খুবই উদ্বেগের ছায়া। বন্দনা তার অফিসের উপহারগুলো কলির হাতে তুলে দিল। বউমণির সব রকমের প্রাপ্তিতেই কলির আনন্দ সবচেয়ে মুক্তধারা। কিন্তু কলি খুলে দেখল না কাশ্মীরি শালের প্যাকেট, ভালো ভালো বইয়ের বাক্স। শুকনো মুখে বলল—‘বউমণি, তুমি নাকি ইউরোপে যাচ্ছ? সারা ইউরোপ?’ সুতপা বলল—‘যাচ্ছেই তো। ভিসা পেয়ে গেছে।’
বন্দনা তার ব্যাগটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল—‘সবচেয়ে ধনী দেশগুলোয় যাব। বুঝলি কলি! সুইডেন, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, ফ্রান্স। আগে লন্ডনে পৌঁছই, দেখি কি শিডিউল করেছে ওরা। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে ওরা কিছু করুক! প্রাচুর্যের অনেকটাই তো যার-পরনাই ভালো খেয়ে, ভালো পরে, ভালো শিখে তারপর উদ্দেশ্যহীন স্বেচ্ছাচারে খরচ করে ফেলছে। পৃথিবীতে যারা অপুষ্ট মস্তিষ্ক নিয়ে আসছে, তাদের দায়িত্ব যে ওদেরও, সে কথা ওদের বুঝিয়ে বলার দরকার। শুধু তো টাকা নয়! চাই প্রযুক্তিগত জ্ঞান, গবেষণা, অনেক ধৈর্য, পরিশ্রম, ডেডিকেশন! ওরা বুঝবে!’
কলি বলল—‘সঙ্গে কে যাচ্ছে বউমণি?’
—‘কে আর যাবে! সুতপাকে সঙ্গে নিতাম, কিন্তু এখানকার এই এত বড় রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব ওরই, ওদিকে দীপু নির্মাল্য একদম একলা। বাচ্চাগুলোকে সামলাতে কত লোক লাগে বল তো! কাজের লোক যে সত্যিই বড় কম রে কলি! তুই এলে যে আমাদের কত সুবিধে হয়!’
বউমণির ষাট বছর বয়স হল, যে বয়সে কলির মা দুম করে চলে গেছেন। কলি বউমণিকে মায়ের চেয়েও ভালোবাসে। বহুদিনের সুখ-দুঃখে, আত্যন্তিক সহমর্মিতায় গড়া দুর্লভ ভালোবাসা যা মরে তো না-ই, কমেও না, ক্রমাগতই বেড়ে যায়, ক্রমেই গভীর, আরো গভীর হয়। বউমণি এই বয়সে অত দূর যাবে? কখনও সে সমুদ্র পার হয়নি, সমুদ্র দূরের কথা ভারতবর্ষেই সে মাঝে মাঝে প্রতিষ্ঠানের কাজে দিল্লি ছাড়া কোথাও, কখনও যায়নি। বয়সটা ভালো না। কলি ঢোঁক গিলছে। ইতস্তত করে অবশেষে বলল—‘কেন বউমণি! ঘোষালদা তো তোমাদের ‘আত্মদীপ’-এর বড় কর্তা। বড় বড় কাজ করেছেন। বহু দেশ-বিদেশেও ঘুরেছেন। কত অভিজ্ঞতা! অবসরও রয়েছে। উনি যেতে পারেন না তোমার সঙ্গে?’
বন্দনা হেসে বলল—‘পারবেন না কেন? কিন্তু তার তো আর দরকার নেই!